#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_১৫
#লেখিকা_সারা মেহেক
দুদিন ধরে টুকটাক করে নতুন বাসা গুছালো আদ্রিশ ও মিম। এ দু দিন আদ্রিশের ছুটি ছিলো। তবে আজ থেকে পুনরায় হসপিটালে জয়নিং এর তারিখ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আদ্রিশ ফ্রেশ হয়ে নিলো। ততক্ষণে মিম তার জন্য নাস্তা বানালো। নাস্তা বানানো শেষে রুমে আদ্রিশের জন্য নাস্তা নিয়ে এলো সে। তার হাতে নাস্তা দেখে আদ্রিশ জিজ্ঞেস করলো,
” কালকে যে পাউরুটি এনেছিলাম,শেষ সেটা?”
” হুম। এজন্য রুটি বানিয়েছি। ”
বলেই সে এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে আলু ভাজি দিয়ে আদ্রিশের মুখে পুড়ে দিলো। আদ্রিশ তা খেতে খেতে বললো,
” আমাকে দুপুরের দিকে একবার মনে করিয়ে দিও পাউরুটি আনার কথা৷ এভাবে সকালে উঠে রুটি বানানো তোমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। এ দু তিনদিন আমার ডিউটি ছিলো না তাই তোমাকে হেল্প করতে পেরেছি। এখন তো আর পারবো না।”
এ বলতে বলতে আদ্রিশের রুটি খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এলো। একদম শেষ টুকরো রুটি তার মুখে দিয়ে মিম মিষ্টি হেসে বললো,
” পাউরুটি হলে যে এভাবে আপনাকে খাইয়ে দিতে পারবো না তাই রুটি বানিয়েছি। আর এখন আমার এমনিতেও কোনো কাজ নেই, সারাদিন বাসায় বসে থাকা ছাড়া৷ তাই একটু রান্নাবান্না করলে ক্ষতি কি।
আচ্ছা, আমি প্লেটটা রেখে আসি।”
বলেই মিম রান্নাঘরে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে নিলো। এরপর রুমে এসে আদ্রিশের সোজাসুজি দাঁড়ালো সে। আদ্রিশের পরনের শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,
” শুনুন, এখন আমি সবসময় বাসায় আছি। একা একা ভালো লাগবে না। তাই আপনার ডিউটি শেষ হওয়া মাত্রই চলে আসবেন। কোনোপ্রকার দেরি করবেন না। আর হসপিটালে যদি কোনো প্রোগ্রাম থাকে সেক্ষেত্রে আমাকে আগে থেকে বলে রাখবেন। আমি খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়বো।”
আদ্রিশ মিমের এই মিঠা আবদারে মুচকি হাসলো। মিমের কোমড় ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আর প্রোগ্রাম না থাকলে?”
মিম খানিকটা লাজুক হাসলো। আদ্রিশের শার্টের এক অংশ মুঠোয় ধরে তার বুকে মাথা ঠেকালো। বললো,
” খাবার রান্না করে আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। সবাই যেমন করে! একটু আদর্শ স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা আরকি।”
আদ্রিশ মিমের কথায় হেসে ফেললো। বললো,
” এতো আদর্শ হতে হবে না তোমাকে। দুপুরে ক্ষুধা লাগলে আমাকে ছাড়াই খেয়ে নিবে। ”
” উঁহু, দুপুরে দুজন সামনাসামনি বসে খাওয়াদাওয়া করবো,এটাও চান না আপনি? আমার ক্ষুধা লাগলেও আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো।”
আদ্রিশ পুনরায় হাসলো। মিমের কপালে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে বললো🫢,
” আচ্ছা, অপেক্ষায় থেকো।
আর শুনো, তোমার একটা শাড়ি পরা ছবি দিও তো আমাকে। ”
মিম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” কেনো? আমার ছবি আপনার ফোনে নেই?”
” সে আছে। আমি প্রিন্ট আউট করা ছবি চাইছিলাম।”
” ওটা দিয়ে কি করবেন? আমার কাছে শাড়ি পরা ওমন ছবি নেই।”
আদ্রিশ খানিক বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’সূচক উচ্চারণ করলো। বললো,
” তাহলে আমাকে আবার দোকানে গিয়ে বের করতে হবে ছবি।”
” কিন্তু আপনি ছবি দিয়ে কি করবেন?”
আদ্রিশ মিমের কপালে পুনরায় অধর ছুঁইয়ে বললো,
” এই যে, মানিব্যাগের ছোট্ট জায়গাটিতে রাখবো তোমাকে। যেনো শত ব্যস্ততার মাঝেও তোমার মুখখানা একবার হলেও দেখতে পারি আমি।”
এই বলে সে শার্টের পকেটের উপর হাত রেখে বললো,
” ইচ্ছে ছিলো এই বুকপকেটে রাখবো তোমায়। কিন্তু এমন হলে রোজ একই শার্ট পরতে হতো, নয়তো সব শার্টেই তোমার ছবি রাখতে হতো।”
আদ্রিশের হেন কথায় ফিক করে হেসে ফেললো মিম। বললো,
” হয়েছে হয়েছে৷ এবার হসপিটালে যান। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!”
আদ্রিশ আর কথা বাড়ালো না। মিমের পানে তাকিয়ে ভালোবাসায় জড়ানো এক টুকরো হাসি দিয়ে তার কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিলো। সে চলে যেতেই মিম প্রথমে নাস্তা করে নিলো। অতঃপর আলমারির কাপড়ের ভাঁজ হতে তার চিরচেনা ডায়েরিটা বের করলো। বহুদিন পেরিয়ে গিয়েছে এই ডায়েরিতে কলম ছোঁয়ানো হয়নি। তাই আজ একটু লিখতে বসলো সে।
” অনেকদিন হয়েছে মনের কথাগুলো লিখি না। সে কথা জমে জমে এখন পাহাড় হয়ে গিয়েছে। তবে এই পাহাড় খুঁড়ে জমানো কথাগুলো গুছিয়ে লিখার প্রচেষ্টা কি করা উচিত? কেননা এই কথা বা অনুভূতিগুলো শব্দে তুলে ধরতে গেলে হয়তো শব্দহীনতায় ভুগবো আমি!
শুনেছিলাম বিয়ের পর প্রেম, ভালোবাসা, অনুভূতি সব ফিকে হয়ে যেতে শুরু করে। বড়জোর দুই তিন মাস সেসবের স্থায়ীত্ব হয়। কিন্তু আমার বেলায় যে উল্টোটা দেখছি! মনে হচ্ছে এই প্রেম,ভালোবাসা, অনুভূতি ফিকে হওয়ার পরিবর্তে উল্টো গাঢ় হচ্ছে। অদ্ভুত!
অবশ্য এই গাঢ় হওয়ার কারণটা আমি বেশ উপলব্ধি করতে পেরেছি। বিয়ের প্রথম দিকে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে নিতে কিছুটা সময় লেগেছিলো। কিন্তু এখন সব মানিয়ে নিয়ে আমি নিজের অনুভূতিগুলো আঁকড়ে ধরে রাখতে শিখেছি।
আমি ঢের টের পাচ্ছি, আদ্রিশের প্রতি আমি দিন দিন ভীষণ দূর্বল হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি যে কারোর প্রতি দূর্বল হতে চাই না। কেননা ভালোবাসার দূর্বলতা যার একবার হয়েছে সে নিজেকে খুঁইয়ে দিয়েছে। বাঁচতে শিখে গেছে অপর মানুষটির মাধ্যমে। এ যেনো এক পরজীবির জীবন! আশ্চর্য! যে জীবন আমি কখনোই চাইনি, এখন সে জীবনটাই রোজ মোনাজাতে চাইছি আমি! কাউকে ভালোবাসলে বুঝি এতোটা পরিবর্তন আসে কারোর মাঝে!
আমি রোজ ভাবি আদ্রিশকে নিয়ে। রোজ ভাবি আমাদের এই সংসার নিয়ে। রোজ ভাবি আদ্রিশের যত্ন নিয়ে৷ মাঝে মাঝে ভাবি, যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় ছোট্ট এ জীবনে, তাহলে বাঁচবো তো আমি! নাকি এই দুনিয়াতে আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। হয়তো তখন শিরোনামে থাকবে, একটি ছেলেকে ভালোবেসে নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেললো মেয়েটি!
ভাবতে অবাক লাগে, কারোর মনে আমি ঠিক এতোটাই জায়গা করে নিয়েছি যে সে আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না! সে ভালোবেসে মানিব্যাগের ঐ ছোট্ট পকেটে আমার ছবি রাখে! নিজেকে তখন ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হয়। ভীষণ।”
——————
সময় গড়িয়ে যায় যেনো চোখের পলকে। দেখতে দেখতে কেটে গেলো প্রায় এক মাস। এই এক মাসে আদ্রিশ ও মিমের সময় কেটেছে সাধারণভাবেই। মিম সারাদিন বাসায় সময় কাটায়। আর আদ্রিশ সময় কাটায় হসপিটালে, ক্লিনিকে। বাকি যে সময়টুকু দুজনে একসাথে পায় সে সময়টাতে তারা ‘কোয়ালিটি এন্ড কোয়ান্টিটি টাইম স্পেন্ড’ করে। বাইরে একটু ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও আদ্রিশ কাজের চাপে মিমকে সময় দিতে পারে না। এতে অবশ্য মিমের মন খারাপ হলেও সে আদ্রিশকে কিছু বলে না। কারণ সে জানে এসব তাদের ভবিষ্যতের জন্যই করা হচ্ছে।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতি দেখছিলো মিম। তার দৃষ্টিজোড়া অপেক্ষায় ছিলো আদ্রিশের। বাসার এ গলিতে আসা প্রতিটি হুড তোলা রিকশায় দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছে। এভাবে আধ ঘণ্টা যাবত অপেক্ষার পর হঠাৎ দূর হতে তার বোধ হলো একটা রিকশায় আদ্রিশকে দেখতে পেয়েছে সে। কিন্তু এ কি, তার সাথে একটা মেয়েও বসে আছে! আদ্রিশের পাশে মেয়েটিকে দেখে মিমের বুকটা ধক্ করে উঠলো। ক্ষণিকের জন্য যেনো তার দম বন্ধ হয়ে এলো। মস্তিষ্কের নিউরনগুলোও ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিলো বোধহয়। সে দেখলো হুড তোলা রিকশায় আদ্রিশ ও একটি মেয়ে বসে আছে। দুজনে বেশ হাসাহাসি করে কথা বলছে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই রিকশাটি তাদের বাসা পেরিয়ে পরের গলিতে চলে গেলো। মিম সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মস্তিষ্কে তখন হাজারো প্রশ্নের মেলা বসলো। ‘মেয়েটি কে?’, ‘এতো রাতে মেয়েটি আদ্রিশের সাথে রিকশায় কেনো?’ তবে কি এতোদিন ধরে যে বিশ্বাসের খুঁটি সে স্থাপন করেছে তা কি ভেঙে যাবে? আদ্রিশ কি তাকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে দিবে? কই, কখনো তো আদ্রিশের ব্যবহারে এমনটা মনে হয়নি। আদ্রিশ এমন করলে সে বাঁচবে কি করে? ভেঙে পড়বে তো সে!
আর ভাবতে পারছে না মিম। কোনোমতে রুমে এসে বসলো সে। মিনিট পাঁচেকের মাঝে হঠাৎ বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। চমকে উঠলো সে। টলমল পায়ে গিয়ে দরজা খুললো সে। দরজা খুলতেই আদ্রিশের ক্লান্তিমাখা মুখখানা নজরে এলো। আচ্ছা, এই মানুষটা কি সত্যিই তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। নাকি সম্পূর্ণটাই চোখ আর মনের ভুল?
আদ্রিশ রুমে চলে এলো। মিমের মুখে কোনো হাসি নেই। সে নিরস ও কঠোর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” রিকশায় মেয়েটি কে ছিলো?”
আদ্রিশ তখন শার্টের বোতাম খুলছিলো। হঠাৎ মিমের প্রশ্নের জবাবে সে জিজ্ঞেস করলো,
” কোন মেয়ে?”
তারপর হঠাৎ মনে এসেছে এমনভাবে বললো,
” ওহ, জ্যোতি আপুর কথা বলছো?”
এই একটি প্রশ্নই যেনো মিমের বুকের উপর হতে মস্ত বড় এক পাথর সরিয়ে দিলো। সে আড়ালে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” ঐটা জ্যোতি আপু ছিলো? উনি কে?”
” তুমি চিনবে না বোধহয়। উনি আমাদের মেডিকেলের সিনিয়র। আমার তিন ব্যাচের সিনিয়র।”
আদ্রিশের কথাগুলো শুনে মিম ধীরে ধীরে স্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু ব্যাপারটি আদ্রিশকে বুঝতে দিলো না সে। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই তার নীরবতা ও দৃষ্টির অস্থিরতা দেখে আদ্রিশ ঠিকই বিষয়টি ধরতে পেলো। আদ্রিশ তার কাছে এসে তার গালে হাত রেখে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
” অন্য কিছু ভেবেছিলে তুমি?”
মিম নীরব রইলো। দৃষ্টি লুকালো আদ্রিশ হতে। আদ্রিশ ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। সে নিশ্চিত হলো মিম জ্যোতি আপুর সাথে তাকে রিকশায় দেখে সন্দেহ করেছে। এতে খানিক ব্যথিতও হলো সে। তবে মিমকে জিজ্ঞেস করলো,
” এখনও বিশ্বাস করতে ভয় পাও? এখনও কি আমার পুরোপুরি আস্থা আনতে পারোনি?”
মিম তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি তুললো। অস্থির কণ্ঠে বললো,
” এমনটা না। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। কিন্তু এতো রাতে একটা মেয়ের সাথে রিকশায় দেখে সত্যিই আমার ভালো লাগেনি। যদিও আমি কিছুক্ষণের জন্য…..”
সম্পূর্ণ বাক্যটি শেষ করতে দিলো না আদ্রিশ। এর পূর্বেই মিমকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” ইটস ওকে মিশমিশ। তোমার সন্দেহ করাটা স্বাভাবিক। এতো রাতে একটা মেয়ের সাথে একটা ছেলের রিকশায় চড়া দেখলে অন্যকিছু ভেবে নেওয়াটা স্বাভাবিক মনে করছি। কিন্তু এ ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না বুঝলে। জ্যোতি আপু প্রেগন্যান্ট। এক সপ্তাহ হলো হসপিটালে জয়েন করেছে। আজ নাইট ডিউটি ছিলো। কিন্তু উনার হাজবেন্ড ছিলো শহরের বাইরে। এখন এতো রাতে তো উনাকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না। আর যখন শুনলাম উনার বাসা আমাদের কাছেই তখন উনাকে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আচ্ছা, বলো তো, এখানে কি আমার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিলো? ”
মিম আদ্রিশকে ছেড়ে দাঁড়ালো। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” না ভুল ছিলো না। আপুর এ অবস্থায় রাতে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ভালো করেছেন। কিন্তু আমি কি করবো বলুন তো? আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি উনাকে আপনার পাশে দেখে। উল্টাপাল্টা অনেক কিছু ভেবে নিয়েছিলাম।
আচ্ছা, শুনুন, আমাকে প্রমিস করুন, কখনও উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না হ্যাঁ? এমনটা করলে আমি সত্যিই বাঁচতে পারবো না।”
বলেই মিম অঝোরে কেঁদে দিলো। আদ্রিশ সাথে সাথে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তার পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বললো,
” পা’গ’ল মেয়ে। বলে কি! বাঁচবে না কেনো! এসব কথা বলতে হয় না। আর আমি প্রমিস করছি, এমন অঘটন কখনও ঘটবে না। ”
মিম আদ্রিশকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
” সত্যি প্রমিস তো?”
” হ্যাঁ সত্যি প্রমিস।”
” একটা মেয়ে আর যাই কিছু ভাগাভাগি করুক না কেনো, স্বামীর ভাগ সে কখনো কাউকে দিবে না। এটা জেনে রাখুন আপনি। ”
বলে সে ঈষৎ ফুঁপাতে লাগলো। আদ্রিশ তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
” এই যে জেনে রাখলাম আমি।”
মিম আর কথা বললো না। আদ্রিশকে সেভাবে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো।
—————-
দু মাস পর মিমের ফাইনাল প্রফের রেজাল্ট বের হলো। তিন সাবজেক্টেই পাশ করলো সে। অর্থাৎ এক চান্সেই প্রফ পাশ করলো সে।
আদ্রিশ ও মিম একসাথেই রেজাল্ট দেখলো। রেজাল্ট পাওয়ার সাথে সাথেই আদ্রিশ মিমকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
” কংগ্রাচুলেশনস মাই ডিয়ার ওয়াইফ। এট লাস্ট, ইউ আর আ ডক্টর।”
বলে তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
” শেষমেশ নামের পাশে ডাক্তার বসাতে পারছেন মিসেস। ডা.উম্মে মিম। হাউ আর ইউ ফিলিং?”
প্রচণ্ড খুশিতে মিমের চোখের কোনে পানি চকচক করছে। সে হাসিমুখে বললো,
” আই এম ফিলিং লাকি৷ আমার পাঁচ বছরের সংগ্রাম শেষ হলো। যে নামের পাশে ডাক্তার শব্দটা বসাতে এতো কষ্ট করেছি শেষমেশ সে উপাধিটা পেয়েছি আমি। আলহামদুলিল্লাহ।
আমি আব্বু আম্মুকে জানাই।”
বলেই সে তার বাবা মা’কে কল করে জানালো এ সংবাদটি। আর আদ্রিশ জানালো তার বাবা মা’কে। দুজনের বাবা মা’র সাথে কথা শেষ হলে দুজন ব্যালকনিতে গিয়ে বসলো।
আকাশটা শেষ বিকেলের ছোঁয়ায় স্বর্ণালি রূপ ধারণ করেছে। নীল মেঘের সাথে আলপনা আঁকছে লালচে কমলা মেঘ। প্রকৃতিটা ধীরেধীরে দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠছে।
আদ্রিশ মিমকে জিজ্ঞেস করলো,
” কি চাও রেজাল্ট উপলক্ষে? ”
” জানি না। একটু ভেবে নেই। তারপর বলি।”
” পরের সময়ের জন্য ভাবো। আজকে ডিনার ডেটে চলো।”
মিম ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
” এতো সাদামাটা গিফট? যদি না যাই ডেটে?”
” না গেলে আর কি। তোমার জন্য এখানেই ডিনার ডেটের আয়োজন করবো। একটা রোমান্টিক ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করবো। ”
” আর?”
” কম মনে হচ্ছে? আচ্ছা, তাহলে তোমার জন্য একটা সুন্দর কালো শাড়ি আনবো। গোলাপের পাপড়ি দিয়ে রুম সাজাবো। ”
” এরপর?”
” এরপর? এরপর তোমার প্রশংসায় মত্ত হবো আমি। তোমার চোখে চেয়ে থেকে মুগ্ধ হবো। তোমার রূপের প্রশংসা করবো। একটা স্লো সং এ নাচবো। তোমার কপালে একটা চুমু দিবো।”
” বাহ! এতো প্ল্যানিং! যেনো ওয়াইফ না, গার্লফ্রেন্ড আপনার!”
” কেনো? ওয়াইফের সাথে বোধহয় এমন করা যায় না?”
” যায় তো। তবে এসব সাধারণত গার্লফ্রেন্ডের সাথেই বেশি করে ছেলেরা। যেনো পটে যায়। ”
এই বলেই সে ঠোঁটের কোনে চাপা হাসি রেখে ভ্রুজোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” এক মিনিট, এক মিনিট, আপনি আমাকে পটাতে চেষ্টাতে করছেন না তো?”
আদ্রিশ বাঁকা হেসে মিমকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বললো,
” তোমাকে পটানোর কি আছে। তুমি তো আমারই। এই মিম শুধু আদ্রিশের।”
#চলবে
®সারা মেহেক
#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_১৬
#লেখিকা_সারা মেহেক
রেজাল্ট দেওয়ার এক সপ্তাহের মাঝে ওরিয়েন্টেশনের মাধ্যমে ইন্টার্নিরা হসপিটালে জয়েন করলো। ইন্টার্নি ডিউটি রোস্টারে প্রথম চার মাসের জন্য মিমের ভাগে পড়লো মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের ডিউটি। যেহেতু মেডিসিনে ডিউটি পড়েছে সেহেতু আদ্রিশ চাইলো প্রথমেই যেনো কার্ডিওলজিতে মিমের ডিউটি প্লেসমেন্ট হয়। কিন্তু অনেক অনুরোধের পরও কার্ডিওলজিতে কারোর প্লেসমেন্টই দেওয়া হলো না৷ আপাতত কার্ডিওলজি গত বছরের ইন্টার্নিদের হাতেই রয়েছে। এখন নতুন ইন্টার্নিদের মেডিসিনের ইউনিট হিসেবে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। সে হিসেবে মিমের ভাগে মেডিসিন ইউনিট এক এর ডিউটি পড়লো। দু’জনেরই মন খারাপ হলো। কিন্তু কিছুই করার রইলো না।
সকাল আটটার মধ্যে জয়েন হলেও আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কাজ শুরু করতে করতে দশটা বেজে গেলো।
প্রথম দিন হিসেবে মিমসহ নতুন ইন্টার্নিরা বেশ দ্বিধাদ্বন্দে কাজ শুরু করলো। যেহেতু প্রথম দিন সেহেতু তাদের ডিউটি চলাকালীন কি কি দায়িত্ব তা বুঝে নিতে খানিক সময় লাগলো। তাদের ডিউটি শুরু হলো সিএ এর রাউন্ড দিয়ে। এরপর রাউন্ডে এলেন প্রফেসর স্যার। রাউন্ড শেষে ইন্টার্ন রুমে বসতে না বসতেই সিভিয়ার এবডোমিনাল পেইন নিয়ে এক পেশেন্ট ভর্তি হলো। দুজন মেডিকেল অফিসারের সাহায্য নিয়ে মিমসহ দুজন ইন্টার্নি সেই পেশেন্টকে ম্যানেজ করলো। এভাবেই তাদের পুরোটা দিন চলে গেলো। মর্নিং ডিউটি,ইভিনিং ডিউটি শেষে রাত প্রায় সাড়ে নয়টায় বাসায় ফিরলো মিম। আদ্রিশ তখন বাসায় ছিলো।
বাসার প্রধান দরজা খুলে যখন মিমের ক্লান্তিমাখা মুখখানা দেখলো আদ্রিশ তখন তার ভীষণ মায়া হলো। হঠাৎ বলাকওয়া ছাড়াই অকস্মাৎ মিমকে জড়িয়ে ধরলো সে।
মিম তখন কেবলই বাসার ভেতরে পা রেখেছে। আদ্রিশের এমন আচমকা জড়িয়ে ধরাতে সে খানিক চমকে উঠলো। অতঃপর সাথে সাথে আদ্রিশকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
” সারাদিন ডিউটি করে মাত্র বাসায় আসলাম। ঘেমে-নেয়ে একাকার। এর মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন কেনো? দুর্গন্ধ লাগে না? ”
আদ্রিশ হেসে উঠলো। বললো,
” ওসব দুর্গন্ধ নাকে লাগে। এই যে সারাদিনের একটা ক্লান্তি ভাব ছিলো তোমার চেহারায়, সেটা আমার জড়িয়ে ধরার পরপরই তো শেষ হয়ে গেলো। কি? হলো না?”
মিম ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো। বললো,
” হয়েছে হয়েছে। এসব একদিনই করবেন। জানা আছে। রোজ কি আর সেই ইচ্ছা থাকবে নাকি?”
আদ্রিশ ততক্ষণে বাসার দরজা আটকে দিয়েছে। মিমের পিছু পিছু যেতে যেতে সে বললো,
” তুমি যদি চাও, তাহলে রোজ বাসায় আসার পর এভাবে জড়িয়ে ধরবো তোমাকে। চাও এমনটা?”
মিম রুমে এসে পরনের এপ্রোন খুলতে খুলতে মৃদু হাসির সহিত ক্লান্তিমাখা কণ্ঠে বললো,
” সারাদিনের ক্লান্তি যদি এক নিমিষেই এভাবে গায়েব করা যায় তাহলে এ সুযোগ সুবিধা কে না চাইবে বলুন। ”
” আচ্ছা, বুঝলাম তোমার কথা।
এবার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। একসাথে রাতের খাবার খাবো। রান্না করেছি তোমার জন্য।”
আদ্রিশের হেন কথা শুনে মিম বিস্মিত চাহনিতে চেয়ে বললো,
” আপনি রান্না করেছেন!”
” হ্যাঁ। এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমি কি রান্না পারি না ভেবেছো!”
” না সেটা বলিনি। মানে ডিউটি শেষে রান্না করার এনার্জি ছিলো?”
” আমার ডিউটি পাঁচটায় শেষ হয়েছে ম্যাডাম। আপনি এই রাতে এসে রান্না করতে পারবেন না দেখে আমি রান্না করেছি। এবার দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিন। আর আমার হাতের রান্না খেয়ে টেস্ট করে বলুন কেমন হয়েছে। ”
” আচ্ছা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
বলে মিম ওয়াশরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে আদ্রিশের হাতের রান্না খাওয়ার পর সে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো। সত্যিই সে ভাবেনি আদ্রিশের হাতের রান্না এতো দারুণ হবে!
এভাবে সময় কেটে যাচ্ছে দুজনের। ভালোমন্দ সময় নিয়ে বেশ সময় কাটাচ্ছে তারা৷ কখনও ডিউটির ফাঁকে একটু সময় পেলে ঘুরে আসে দুজনে। কখনো কারোর ডিউটি টাইম কম থাকলে সে এসে বাসায় রান্না করে। এমনই একদিন মিমের ডিউটি পড়লো রাতে। আদ্রিশের সেদিন ক্লিনিকের ডিউটি ছিলো না বিধায় সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে মিমের জন্য রান্না করলো। রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে সে খাবার নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হলো। হসপিটালে এসে দেখলো ওয়ার্ড একদম অন্ধকার। রোগীরা সবাই যে যার মতো বাতি নিভিয়ে ঘুমাচ্ছে। তাই সে খাবার নিয়ে সোজা ইন্টার্ন রুমে চলে আসলো। ইন্টার্ন রুমে এসে দেখলো দুটো মেয়ে বিছানায় ঘুমাচ্ছে, একটা ছেলে ও একটা মেয়ে বসে গল্প করছে। আর মিম না গল্প করছে, না ঘুমাচ্ছে। সে বসে বসে ঝিমাচ্ছে।
ইন্টার্ন দুজন যারা জেগে ছিলো তারা আদ্রিশকে দেখা মাত্রই সম্মান দিতে দাঁড়িয়ে পড়লো। আদ্রিশ তাদের ইশারায় বসতে বলে মিমের পাশে নিঃশব্দে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ বিরক্ত না করে এভাবেই বসে রইলো সে। এরপর হঠাৎ মিমের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
” মিশমিশ! ”
চমকে উঠলো মিম। উপরন্তু আদ্রিশকে পাশে বসে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলো সে। তার এ কান্ড দেখে আদ্রিশসহ বাকি দুই ইন্টার্নিও হেসে উঠলো। মিম তৎক্ষনাৎ নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি এখানে কি করছেন?”
আদ্রিশ ব্যাগ থেকে খাবার বের করতে করতে বললো,
” তোমার জন্য খাবার এনেছি। ভাবলাম নাইট ডিউটি করে হয়তো রাতে খুব ক্ষুধা লাগতে পারে তাই খাবার আনলাম। ”
” শুধু শুধু এতো রাতে কষ্ট করার দরকার কি?”
” কষ্ট কিসের? তুমি যে নাইট ডিউটি করছো সে হিসেবে তোমার দেখভাল করার দায়িত্ব কি আমার কাঁধে পড়ে না?”
” তারপরেও! খামোখা কষ্ট করা শুধু। ”
আদ্রিশ ও মিমের এ মুহূর্তগুলো দেখে ইন্টার্ন মেয়টা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। বললো,
” ভাইয়া তোকে কত ভালোবাসে মিম! আমার বরটাও যদি এমন ভালোবাসতো!”
মিম জবাবে কিছু বললো না। মুচকি হাসলে শুধু।
আদ্রিশ তাদের জন্য খাবার বের করলো। ডিউটিতে মিম একা নেই বলে তারসহ আরো দু একজনের খাবার অতিরিক্ত রান্না করে এনেছিলো আদ্রিশ। সে খাবারই দুজন ইন্টার্নিকে দিলো সে।
খাওয়াদাওয়া শেষে চারজনে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলো। এরপর রাতে ইমার্জেন্সি এক পেশেন্ট আসলো বলে তারা তিনজনই চলে গেলো ওয়ার্ডে। তাই আদ্রিশও আর বসে রইলো না। খাবারের বক্সগুলো গুছিয়ে বাসায় চলে এলো।
————–
মেডিসিন প্লেসমেন্টের শেষ এক মাসের প্রথম দু সপ্তাহের জন্য কার্ডিওলজি ইউনিটে ডিউটি পড়লো মিমের। সে সময় আদ্রিশের অধীনে ভালোভাবেই পেশেন্ট হ্যান্ডেল করতে শিখে গিয়েছিলো সে। কিন্তু তিন বাদে হঠাৎ এক বিপত্তি ঘটলো।
হসপিটালের সামনের এক মুদিখানা দোকানে হঠাৎ কার্ডিয়াক এরেস্ট নিয়ে ইমার্জেন্সি থেকে এক পেশেন্ট কার্ডিওলজি ইউনিটে আসলো। লোকটি কার্ডিয়াক এরেস্ট সাথে সিভিয়ার ব্রেথলেসনেস নিয়ে ওয়ার্ডে আসলো। ওয়ার্ডে আসার পরপরই সবার মাঝে হুলস্থুল এক কান্ড বেঁধে গেলো। মিম ও আদ্রিশসহ দুজন মেয়ে ইন্টার্নি তখন পেশেন্ট দেখছিলো। হঠাৎ সেই ইমার্জেন্সি পেশেন্ট আসায় আদ্রিশ ছুটে গেলো সেদিকে। বাকি তিনজনও তার পিছু পিছু ছুট লাগালো।
আদ্রিশ দ্রুত গিয়ে লোকটির পালস চেক করলো। চোখের পাতা খুলে দেখলো। দ্রুত মিমকে বললো সিপিআর দিতে আর সে চলে গেলো ডিফিব্রিলেটর এর ব্যবস্থা করতে।
হঠাৎ ইমার্জেন্সি এ সিচুয়েশনে পেশেন্টকে দেখে মিম খানিক অস্থির হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু যখন তাকে সিপিআর দিতে বলা হলো তখন সে আরোও অস্থির হয়ে পড়লো। কেননা সে এর পূর্বে কখনও সিপিআর দেয়নি। তবে পাঠ্য বইয়ের জ্ঞান অনুযায়ী যতটুকু পারলো সে চেষ্টা করলো।
বুকের হৃদপিণ্ড যেখানে অবস্থিত সেখানে বাম হাত রেখে ডান হাত দিয়ে দেহের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো। কয়েকবার চাপ দেওয়ার পরও পেশেন্টের অবস্থার উন্নতি হলো না। ততক্ষণে আদ্রিশ চলে এসেছে। সেও বেশ অস্থির হয়ে পড়েছে। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘ যেকোনো মূল্যে এই লোকটিকে বাঁচাতে হবে।’ এ বাদে আর কোনো কথাই তার মাথায় নেই। ফলে সে মিমের সিপিআর দেওয়ার কৌশল দেখে বেশ রেগে গেলো। মিমকে খানিক ধমকের সুরে বললো,
” সরো এখান থেকে। আমি দিচ্ছি। তুমি অক্সিজেন মাস্ক লাগাও।”
হঠাৎ আদ্রিশের ধমক শুনে মিম চুপসে গেলো। সরে এলো সেখান থেকে। অক্সিজেন মাস্ক লাগানোর মতো মনমানসিকতা রইলো না তার। ফলে অন্য এক ইন্টার্নি মাস্ক লাগালো।
পাঁচ মিনিটের মাথায় পেশেন্ট কিছুটা স্বাভাবিক হলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো আদ্রিশসহ বাকি দুই ইন্টার্নি। শেষ পর্যন্ত লোকটিকে বাঁচাতে পেরেছে তারা। বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো তাদের চেহারায়।
এদিকে মিম গোমড়ামুখে বসে আছে হসপিটালের লবিতে। নিজেকে এ মুহূর্তে ভীষণ ব্যর্থ মনে হচ্ছে তার। তার মাথায় একটা বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছে, একটা ইমার্জেন্সি পেশেন্টকে সে ভালোমতো ট্রিটমেন্ট দিতে পারলো না! এভাবে হলে সে ভবিষ্যতে কি করবে! উপরন্তু আদ্রিশের ধমক শুনে সে খানিক ব্যথিতও হয়েছে বটে।
আদ্রিশ ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে দেখলো মিম লবিতে বসে আছে। সে গিয়ে মিমের পাশে বসলো। মিমের গোমড়ামুখো ভাব দেখে সে অনুমান করলো, তার ধমকের ফলেই এমনটা হয়েছে। তাই সে অনুতপ্ত স্বরে বললো,
” সরি মিশমিশ। আসলে তোমাকে ওভাবে ধমক দিতে চাইনি। এমন ইমার্জেন্সি কেস দেখলে আসলে মাথা ঠিক রাখা যায় না। ”
মিম প্রত্যুত্তর জানালো না। ধীরেধীরে আদ্রিশের কাঁধে মাথা রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বললো,
” আপনার দোষ নেই। এমন সিচুয়েশনে রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। আসলে দোষটা আমারই। আমিই কেসটা হ্যান্ডেল করতে পারিনি। ”
” এজন্য মন খারাপ করছো তুমি? পাগল মেয়ে। এজন্য কেউ মন খারাপ করে?”
” করাটা কি স্বাভাবিক না? একজন ইন্টার্নি হয়েও পেশেন্ট হ্যান্ডেল করতে পারলাম না আমি।”
” দেখো মিশমিশ, কেউ শুরু থেকে সব শিখে আসে না। ধীরেধীরে শিখে, ভুলের মাধ্যমে শিখে, নতুন নতুন কাজের মাধ্যমে শিখে। তুমি এমন কেস প্রথম পেয়েছো। তাই হ্যান্ডেল না করতে পারাটাই স্বাভাবিক। আজ যে পারোনি, দেখবে পরবর্তীতে এমন সিচুয়েশনে পড়লে কিছুটা হলেও হ্যান্ডেল করতে পারবে। এজন্য এ নিয়ে মন খারাপ করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
মিম প্রত্যুত্তর দিলো না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুধু। আদ্রিশ যতই তাকে বুঝানোর চেষ্টা করুক, তার মাথায় শুধু নিজের ব্যর্থতাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেকে বলছে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজেকে বুঝাতে পারছে না, এ ব্যাপারটা স্বাভাবিক।
—————–
শেষ সপ্তাহে ইমার্জেন্সি ডিউটি রোস্টার হলো মিমের। এখন ইমার্জেন্সি পেশেন্ট মোটামুটি ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে।
রাতভর ইমার্জেন্সিতে ডিউটি করে সকালের দিকে খানিকটা চোখ লেগে গিয়েছিলো তার। হঠাৎ চারদিকে তুমুল হইহট্টগোলের আওয়াজ শুনে পিটপিট করে চোখ খুললো সে। উড়ো খবর এলো, হসপিটালের কাছের রাস্তায় বাইক এ” ক্সি” ডে” ন্ট করেছে একজন। অবস্থা খানিক নাজুক।
মিম খবরটা শুনলো। খুব একটা চিন্তা বা অস্থিরতা কাজ করলো না তার মাঝে। কেননা এর পূর্বেও দু’বার এমন রোড এ” ক্সি” ডে” ন্টে” র পেশেন্ট হ্যান্ডেল করেছে সে। আজকের কেসটাও সে হ্যান্ডেল করতে পারবে এমন আত্নবিশ্বাস আছে তার। তাই নার্সকে গজ,তুলো রেডি করতে বলে স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো সে। ততক্ষণে স্ট্রেচারে করে পেশেন্টকে ইমার্জেন্সিতে আনা হয়েছে। মিম ঘুমঘুম চোখে এগিয়ে গেলো স্ট্রেচারের দিকে। কিন্তু স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে সেখানে শুয়ে থাকা র” ক্তা” ক্ত মানুষটির চেহারা দেখে তার চোখের ঘুম মুহূর্তেই উবে গেলো। কেননা স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা র” ক্তে জর্জরিত মানুষটি আর কেউ নয় বরং আদ্রিশ। আদ্রিশকে এ অবস্থায় দেখে মিমের পুরো দুনিয়া যেনো কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলো সে।
#চলবে
®সারা মেহেক