ফিরে আসা২ পর্ব-২১+২২+২৩

0
344

#ফিরে_আসা২
২১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

রাত বারোটার কাছাকাছি। বসার ঘরের সোফায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে অরা। ঘুম আসছে না এখনো। প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। গভীর রাত পর্যন্ত ঘুম আসছে না, ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখে উঠে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম এই সমস্যা খুব ভুগিয়েছে তাকে। এখন অরা প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে স্বল্প ঘুমের জীবনে।

পেটের ওপরে হাত রেখে অন্যমনস্কভাবেই অরা মনে মনে বলে উঠলো, “দেখেছিস, এখনো এলো না তোর বাবা!”

পরমুহূর্তেই নিজেই চমকে উঠলো । সে কি এতক্ষণ বাবুর সঙ্গে কথা বলছিল? তা তো বটেই! বাবুর অস্তিত্ব একটু একটু করে টের পেতে শুরু করেছে অরা। আনমনেই হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। কয়েকদিন আগেও স্বাভাবিক মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতো সে। তার মাঝে যে আরেকজন লুকিয়ে আছে, এটা প্রায় ভুলেই যেত। এখন আর ভুলে যায় না। বাবুর ভালো-মন্দ তাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে।

প্রথম তিন মাস ভালোয় ভালোয় পেরিয়ে গেল। ডক্টর বলেছিলেন এই প্রথম তিনটা মাস অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে। প্রথম প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে এই তিনটি মাসে ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। সেই আশঙ্কা আপাতত কেটে গেছে। ডক্টর সেদিন চেকআপের পর বললেন, খুব ভালো ভাবেই না-কি বাবুর গ্রোথ হচ্ছে। মনে মনে আজকাল বাবুকে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে অরা। তার সুখের সংসারে বাবু যেন একরাশ বাড়তি সুখ হয়ে আসবে।

দরজার লকে পাসওয়ার্ড চাপার শব্দে নড়েচড়ে বসলো অরা। আরশাদ এসে গেছে। ব্যস্ততায় ঘেরা দিনটার সকল ক্লান্তি যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে গেল তার সমস্ত অন্তরাত্মা। অরা উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

দরজা খুলে যেতেই চোখে পড়লো আরশাদের স্নিগ্ধ মুখটা। সাদা টিশার্ট আর কালো জিন্সে ছেলেটাকে রাজপুত্রের মতো লাগছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। এই মানুষটা যে একান্তই তার, ভাবতেই অবাক লাগে।

অরাকে দেখতে পেয়েই আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “অরা! তুমি এখনো জেগে আছো কেন?”

প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না অরা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে। যেন হাজার বছর পর দেখছে তাকে। বউয়ের এমন কান্ডে মনে মনে অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিলো আরশাদ। একহাতে অরাকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে বলেছি না রাত করে আমার জন্যে অপেক্ষা না করতে! শরীর খারাপ করবে তো।”

অরা আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে আদুরে গলায় বলল, “আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ তোমার বাবুর। ও বলেছে তোমাকে ছাড়া ঘুমাবে না।”

আরশাদ দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “ও আচ্ছা! নিজের সব দোষ আমার বাবুটার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে না?”

অরা চুপ করে রইলো। একরাশ প্রশান্তিতে ছেয়ে আছে তার সমস্ত শরীর। সময়টাকে ঠিক এখানেই থামিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। যেখানে কোনো ক্লান্তি থাকবে না, দুশ্চিন্তা থাকবে না। থাকবে কেবলই ভালোবাসার ছড়াছড়ি।

আরশাদ বলল, “কথা ঘুমিয়েছে?”

“হুঁ। তুমি ডিনার করেছো?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

ব্যস্ততময় দিনগুলো তাদের এভাবেই কাটে। অরার সারাটাদিন কাটে অফিসে আর আরশাদের শুটিং সেটে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোনে কয়েক মিনিটের জন্যে দুজনের কথা হলেও সে কথা যথেষ্ট নয়। দিনশেষে দুজনে একে অপরকে কাছে পেলেও কেবল রাতটুকুর জন্যে। সূর্য উঠে গেলেই তো আবার সেই কর্মব্যস্ততা।

ফ্রেশ হয়ে এসে আরশাদ সোজা চলে গেল মেয়ের ঘরে। প্রকান্ড এক টেডি বেয়ারকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে আচ্ছন্ন কথা। আনমনে মেয়ের মাথার হাত বুলিয়ে দিলো আরশাদ। একটা সময়ে তার থেকে দূরে দূরে থাকা ভীষণভাবে ভুগিয়েছে তাকে। এখন আর সেই ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। মন চাইলেই চোখের সামনে দেখা যায় মেয়েটাকে। কথার কপালে চুমু খেয়ে ব্ল্যাঙ্কেটা ভালোভাবে তার গায়ে টেনে দিলো।

নিজেদের ঘরে ফিরে এসে দেখলো অরা ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘুমানোর আগে অরা বিছানায় নতুন করে চুল বাঁধে, গায়ে লোশন মাখে।

আরশাদ আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লো অরার পাশে। তার কপালের ওপর একটা হাত। যখন আরশাদের মাইগ্রেন ওঠে তখনই এভাবে মাথার ওপর হাত রেখে নিঃশব্দে শুয়ে থাকে।

অরা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “মাথা ব্যাথা?”

আরশাদ চোখদুটো বুজে রেখেই বলল, “অল্প।”

দ্রুত চুল বাঁধা শেষ করে অরা গিয়ে বসলো আরশাদের মাথার কাছে। নিজের নরম হাতের স্পর্শ মাথা টিপে দিতে লাগলো আরশাদের।

আরশাদ মজার ছলে বলল, “আজ হঠাৎ এত টেক কেয়ার? মতলবটা কী তোমার?”

অরা ক্ষীণ আহত গলায় বলল, “কোনো মতলব ছাড়া আমি তোমার টেক কেয়ার করি না?”

“তা করো। কিন্তু আজ কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো একটা মতলব আছে।”

অরা হাসিমুখে বলল, “কোনো মতলব নেই। এমনিই ইচ্ছা হলো তোমার টেক কেয়ার করি।”

শান্তির আবেশে চোখ বুজে রইলো আরশাদ। অরার একেকটা স্পর্শ যেন তার মাঝে যাদু ছড়িয়ে দিচ্ছে। অরার হঠাৎ কী যেন হলো। আচমকা তার শীতল ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করলো আরশাদের গাল।

আরশাদ চোখদুটো খুলে রহস্য মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “উফ অরা! এবার বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। এত আদরে তো অভ্যস্ত না। কী মতলব তোমার? কোনো ঝামেলা বাঁধিয়েছো?”

অরা আমতা আমতা করে বলল, “আরে না! কী ঝামেলা বাঁধাবো?”

ঝামেলা একটা ঠিকই বাঁধিয়েছে। যদিও সেই ঝামেলার সঙ্গে আদরের কোনো সংযোগ নেই। অরা বুঝতে পারছে না কী করে আরশাদের কাছ থেকে ওই শুটিং সেটে যাওয়ার অনুমতি চাইবে। আরশাদের যে স্বভাব, শুটিংয়ে যাওয়ার কথা বললেই রেগে আগুন হয়ে যেতে পারে। রেগে আগুন যাতে না হয়, তাই তো পরিস্থিতিটা সহজ করতে চাইছে অরা।

কয়েক মুহূর্ত পর অরা কোমল স্বরে বলল,
“এই শোনো না!”

“বলো।”

মনে মনে লম্বা শ্বাস নিয়ে অরা বলল, “তুমি তো জানোই ছাইয়ের শুটিংয়ে কত বড় সমস্যা হয়েছে।”

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “অরা! কতবার বলেছি কাজের আলাপ বেডরুম পর্যন্ত টেনে আনবে না।”

আরশাদ কখনোই চায় না, তারা যখন একাকী সময় কাটাবে তখন সেই সময়ের এক মুহুর্তও কাজের কথা বলে অপচয় হোক। কাজের কথা বলার জন্যে অফিস রয়েছে। আরশাদ যদি অরার হাসবেন্ড না হয়ে কেবল বস হতো তাহলে তো আর রাত-বিরেতে কাজের আলাপ করার উপায় থাকতো না।

অরা থমথমে গলায় বলল, “আচ্ছা তাহলে লিভিং রুমে চলো। ওখানে গিয়ে আলাপ করি।”

আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “এই তুমি কে? তুমি কি সত্যিই আমার বউ? না-কি ওর ওপরে অন্য কেউ ভর করে আছো?”

“মানে?”

“মানে আমার নিরামিষ বউটা আজ ঠাট্টা করছে, লজ্জা-টজ্জা না পেয়ে আমাকে আদর করছে। ব্যাপারটা কী?”

লজ্জায় থতমত খেয়ে অরা বলল, “কী শুরু করলে তুমি?”

“আচ্ছা, আচ্ছা। কী বলছিলে?”

অরা পরিষ্কার গলায় বলল, “শুটিংয়ে একটা বড়সর সমস্যা হয়েছে। তুমি তো সবটাই জানো। সেটের বাড়িঘরের ভেতরে কতগুলো আসল বাড়িঘর ছিল। পুরো সেটে আগুন দেওয়ায় ওই বাড়িঘরগুলোও পুড়ে যায়। ওখানকার বাসিন্দারা এই নিয়ে খুব ক্ষেপেছে। শুটিং করতে দিচ্ছে না। তারা নতুন বাড়ি চাইছে, অনশন করছে।”

আরশাদ হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “প্রোডাকশন টিম বসে বসে করছে কী? এসব ঝামেলা সামলানোর দায়িত্ব তো তাদের।”

“তারা তো উল্টো ঝামেলা আরও বাড়িয়ে এসেছে। কাল অনশনে থাকা ফ্যামিলিদের সাথে ঝগড়া করে এসেছে।”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ফায়ার করে দাও।”

“কী?”

“যে টিম সামান্য একটা প্রবলেম সলভ করতে পারে না, তাদের কোম্পানিতে রেখে আর লাভ কী?”

এই ছেলেটা ফায়ার করা ছাড়া কিছুই জানে না। অরা যখন তার ম্যানেজার ছিল, তখনও তো কথায় কথায় ফায়ারের হুমকি পেত।

অরা বলল, “ফায়ার করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”

“রাগ তো মিটবে।”

“আমার তো আর তোমার মতো রাগ নেই আরশাদ। সমস্যার একটা সমাধান অবশ্য বের করেছি।”

“কী সমাধান?”

অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “আজ মিটিংয়ে সবাই বলছিল আমার না-কি ফেস ভ্যালু আছে। কে ফিল্মসের সিইও হিসেবে না, তোমার বউ হিসেবে।”

“হ্যাঁ, আছেই তো।”

“এখন আমি যদি ওদের বুঝিয়ে বলি। দেখো শুটিং ফেলে রেখে নতুন বাড়ি তৈরি করে দেওয়া তো সম্ভব নয়। এদিকে ওরা কম্পেনসেশনও নিতে চাইছে না। আমি যদি ওদের কাছে গিয়ে ওদের বুঝিয়ে বলি, কম্পেনসেশনটা নিয়ে নিতে…”

আরশাদ হঠাৎ উঠে বসতে বসতে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল “এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড! ওদের কাছে গিয়ে বুঝিয়ে বলবে মানে? তুমি কালিয়াকৈরে যাবে?”

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “হ্যাঁ।”

সন্তানেরা কোনো অন্যায় করার পর বাবা-মা যে দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকায়, ঠিক সেই দৃষ্টিতে অরার দিকে তাকিয়ে রইলো আরশাদ। দৃষ্টিতে কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা হতাশা।

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “অরা! চুপচাপ শুয়ে পড়ো। এমনিতেই অনেক রাত জাগা হয়ে গেছে।”

“আরশাদ শোনো।”

“আমি কিছুই শুনতে চাই না অরা। এখন তুমি কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়বে।”

“আমি না গেলে সমস্যার সমাধান হবে না আরশাদ।”

আরশাদ কড়া গলায় বলল, “হতে হবে না সমাধান। সমস্যা সমস্যার জায়গায় থাক।”

অরা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো, “এসব কী বলছো আরশাদ? কতগুলো মানুষ আটকা পড়ে আছে।”

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “অনশন তো আর সারাজীবন করবে না। কোনো না কোনো সময়ে ভেঙেই যাবে। কিন্তু আমার কথা একটাই, তুমি ওখানে যাবে না।”

“কিন্তু কেন আরশাদ? সিইও হিসেবে এটা তো আমার দায়িত্ব।”

“আর মা হিসেবে কোনো দায়িত্ব নেই? কালিয়াকৈরে তো আর প্লেনে যাওয়া যায় না। প্রায় চার ঘন্টা গাড়িতে ট্রাভেল করতে হবে। এই অবস্থায় এতটা দীর্ঘ সময় জার্নি করা কি ঠিক?”

অরা গোমড়া মুখে বলল, “তুমিই তো বলেছিলে, প্রেগন্যান্সি কোনো কাজে বাঁধা হতে পারে না।”

আরশাদ আবারও শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, “সেই আমিই এখন বলছি তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ো।”

“কিন্তু আরশাদ…”

অরাকে বাঁধা দিয়ে আরশাদ বলল, “বললাম না অরা আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।”

আরশাদের সঙ্গে আর তর্কে জড়ালো না অরা। সে জানতো এমনটাই হবে। আরশাদের ঠিক এমন প্রতিক্রিয়াই হবেই। শুটিং আর কোনো দিনও শুরু না হলেও তার কিছুই যায় আসবে না। অরা একদিন ওখানে গেলেই এত বড় একটা সমস্যার সমাধান হতে পারে। সহজ কথা এই ছেলেটা বুঝিয়ে বলা এত কঠিন কেন?

অরা কাঁধ পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টেনে শুয়ে পড়লো।

সঙ্গে সঙ্গে আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “দূরে সরে শুয়েছ কেন? কাছে এসো।”

এই ছেলেটা কখন রাগ করে, আর কখন যে এই রাগ গলে জল হয়ে যায় বোঝা মুশকিল। অরা বাধ্য মেয়ের মতো আরশাদের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। মুহূর্তের মাঝে আরশাদের চোখে ঘুম নেমে এলেও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রইলো অরা। শুটিং সেটের এই সমস্যার সমাধান কোথায়?

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
২২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

জানালার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে অরার মুখে। নভেম্বরের মাঝামাঝি এখন, অথচ শীতে রীতিমত দাঁত কটমট করছে। অফিসের জন্যে তৈরি হচ্ছে অরা। তার পরনে সাদা শার্ট, ধূসর বর্ণের লম্বা কোট আর কালো লেগিংস। গলার ওপর দিয়ে গাঢ় বেগুনি রঙের একটা মাফলার বাঁধার চেষ্টা করছে অরা। আজকাল সকলে কেমন কায়দা করে মাফলার বাঁধতে পারে। অরা তা পারে না।

ঘরের আরেক প্রান্তে ব্যাকপ্যাক গোছাতে ব্যস্ত আরশাদ। আগেই গোছানো ছিল, সে কেবল নিশ্চিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ঠিকমত আছে কিনা। আরশাদের এই লেদার ব্যাকপ্যাকে শুটিংয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই থাকে। এই যেমন স্ক্রিপ্ট, তার বড় বড় দুটো নোটবুক, ইয়ারপড, পাওয়ারব্যান্ড।

হঠাৎ আরশাদের চোখ পড়লো আয়নায় ভেসে ওঠা অরার প্রতিচ্ছবির দিকে। মেয়েটা সেই তখন থেকে মাফলার বাঁধার চেষ্টায় ব্যর্থ হচ্ছে।ব্যর্থতার হতাশা তার চোখেমুখে দৃশ্যমান। আরশাদ হাতের কাজটা ফেলে রেখেই এগিয়ে গেল অরার দিকে।

মাফলারটা অরার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আরশাদ কৃত্রিম হতাশ গলায় বলল, “এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলে। আর তুমি না-কি দুদিন পর বাচ্চার মা হবে!”

যত্ন নিয়ে স্টাইল করে অরার গলায় মাফলারটা বেঁধে দিলো আরশাদ। আড়চোখে অরার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো তার চোখেমুখে বিচিত্র এক মলিনতা। আরশাদ হকের বউয়ের চোখেমুখে মলিনতা জায়গা পায় কোন সাহসে?

আরশাদ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই আরশাদের ফোন বেজে উঠলো। শুটিং সেট থেকে পরিচালক ফোন করেছেন। নিশ্চয়ই জরুরি কোনো প্রয়োজনে। আরশাদ ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেল।

আরশাদের কাজ কখনোই অরার হিংসার কারণ হয়ে ওঠে না। কাজকে বেশি সময় দিতে গিয়ে তাকে হয়তো মাঝেমধ্যে একটু কম সময় দিয়ে ফেলে। দিক গিয়ে! যতটুকু সময় তাকে দেয়, ততটুকু তো একান্তই তার।

স্কুলের জন্যে তৈরি হয়ে বিছানা খাতাপত্র নিয়ে বসেছে কথা। শেষ মুহূর্তে হোমওয়ার্ক করছে। গতকাল আগে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে হোমওয়ার্কটা শেষ করতে পারেনি। তাই তো আজ এত তাড়াহুড়ো।

অরা কথার ঘরে প্রবেশ করে বলল, “কথা! নিচে চল, ব্রেকফাস্ট করবি।”

কথা খাতার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “হোমওয়ার্কটা শেষ করে আসছি অরা।”

কথার খাতার দিকে চোখ গেল অরার। সামান্য যোগ-বিয়োগের অঙ্ক। যদিও এতটুকু বাচ্চার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।

কথার পাশে বসতে বসতে অরা বলল, “এমন তাড়াহুড়ো করলে তো অঙ্ক ভুল হবে। একদিন হোমওয়ার্ক না করলে কী হয়?”

“পানিশমেন্ট হয়!”

অরা বিস্মিত গলায় বলল, “তোর স্কুলে পানিশমেন্টও দেয়?”

কথা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “দেয় তো। কেউ হোমওয়ার্ক না করলে পুরোটা ক্লাস তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। এতটুকু বাচ্চাদের শাস্তি দেওয়ার পেছনে স্কুলগুলোর কোন যুক্তি কাজ করে? বাচ্চারা যাতে পুনরায় একই ভুল না করে? ভুল না হয় শুধরে নিলো। কিন্তু গোটা ক্লাসের সামনে শাস্তি পাওয়ায় তার মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হলো, স্কুল নামক জায়গাটার প্রতি যে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হলো, তা কি সহজেই মিটে যাবে?

অরা গ্রামের স্কুলে শিক্ষাজীবন পাড় করেছে। সেখানে হোমওয়ার্কের মতো বাড়তি কোনো কাজ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হতো না। তবে তাই বলে যে শাস্তির ব্যবস্থা নেই তা নয়। ওখানকার শাস্তি পুরো ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকার মতো হালকা-পাতলা নয়। ভয়াবহ রকমের শাস্তি। এই যেমন এক হাতে ইট নিয়ে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা, কান ধরে উঠবস করা, স্যারদের বেতের আঘাত মাথা পেতে নেওয়া।

শাস্তি পাওয়ার কারণগুলো হতো তুচ্ছ। কেউ যদি ক্লাসে বেশি কথা বলে তাহলে শাস্তি, নিজের খাতার পৃষ্টা নিজেই ছিঁড়ে ফেললে শাস্তি, পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে শাস্তি, স্কুলের শিক্ষকের কাছে আলাদাভাবে কোচিং না করলে শাস্তি।

কথা যে স্কুলে পড়ে সেখানে আরও বেশ কিছু সেলিব্রিটি এবং প্রভাবশালী মানুষদের বাচ্চা-কাচ্চা পড়াশোনা করে। স্কুল তাদের ক্ষেত্রে তেমন একটা কড়াকড়ি করে না। স্কুলের নিয়ম প্রতিদিন রোল অনুযায়ী পাঁচজন করে ক্লাসের ফ্লোর ঝাঁট দেবে, বোর্ড মুছবে। এতটুকু বাচ্চারা তো আর ভালো করে কাজগুলো করতে পারবে। তবুও এই নিয়ম তৈরি করা হয়েছে যাতে তাদের মাঝে দায়িত্ব গ্রহণের প্রবণতা গড়ে ওঠে। কথাকে এই নিয়মের বাইরে রাখা হয়েছিল।

এই সংবাদ আরশাদের কানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে যে স্কুলের অধ্যক্ষকে ফোন করে বলে, “কথা স্পেশাল কেউ নয়। ও অন্যান্য বাচ্চাদের মতোই সাধারণ। ওকে সাধারণদের মতোই ট্রিট করবেন প্লিজ।”

ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে তারা তিনজন। এই ভোরবেলা ব্রেকফাস্ট করার অভ্যাস তার নেই। অন্যান্য সময় তার ব্রেকফাস্ট করতে করতে সকাল দশটা বেজে যায়। তবে এই সময়টা অন্যান্য সময়ের থেকে আলাদা। তার ক্ষুধা না লাগলেও তার মধ্যে যে লুকিয়ে আছে তার তো নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে। তাছাড়া সকালের খাবারের পর একগাদা ওষুধ খেতে হয় তাকে।

আরশাদ লক্ষ্য করলো অরার মধ্যকার মলিনতা এখনো কাটেনি। নিঃশব্দে ব্রেকফাস্ট করে যাচ্ছে মেয়েটা। যেন গভীর এক চিন্তায় মগ্ন তার সমগ্র অন্তরাত্মা।

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “মন খারাপ?”

অরা সংবিৎ ফিরে পেয়ে দৃঢ় গলায় বলল, “না।”

“তাহলে মুখ ভার করে আছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্কুলের টিচারের কাছে কড়া ধমক খেয়েছ।”

কথা আচমকা হতবাক ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “বাবা? অরাও স্কুলে যায়?”

“না বাবা। কথার কথা বললাম।”

কথার মজার ছলে বলল, “কথার কথা মানে কী? আমার কথা?”

মেয়েটা এতটুকু বয়সেই ঠাট্টা করতে শিখে গেছে। আরশাদ আর অরা দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলো।

আরশাদ হাসি থামিয়ে বলল, “হ্যাঁ তোর কথা। এখন ব্রেকফাস্টটা শেষ কর তো।”

কথা আবারও ব্রেকফাস্টে মনোযোগ দিলো। আরশাদ লক্ষ্য করলো আবারও চিন্তায় ডুবে গেছে অরা। নিঃসন্দেহে শুটিং সেটের ওই ঝামেলা এখনো ভাবাচ্ছে তাকে। এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। কাজ ছাড়া মাথায় তার কিছুই ঘুরপাক খায় না।

আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী ব্যাপার তোমার?”

“কোনো ব্যাপার নেই তো।”

“তাহলে মুখ গোমড়া কেন?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অরা শুকনো গলায় বলল, “আমার শুটিং সেটে যাওয়াটা দরকার আরশাদ।”

আরশাদের ধারণাই সত্যি হলো। এখনো সেই শুটিংয়ের চিন্তার তার মাথায়। অন্য সময় হলে অরার কাজে কোনপ্রকার বাঁধা দিতো না আরশাদ। আগেও কখনো দেয়নি। কাজের প্রয়োজনে অরা অনেক সময়েই ঢাকার বাইরে শুটিং সেটে গেছে। তবে এই অবস্থায় যাওয়া কতটুকু উচিত হবে, আরশাদ তাই বুঝতে পারছে না।

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি এখনো ওই চিন্তা নিয়ে পড়ে আছো? আমি তো একবার বলে দিয়েছি, তুমি কোথাও যাচ্ছো না।”

অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি না গেলে তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না আরশাদ। শুটিং বন্ধ হয়ে আছে, পত্রিকায় আমাদের কোম্পানি নিয়ে আজেবাজে কথা লেখা হচ্ছে। সিইও হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব যত দ্রুত সম্ভব সমস্যার সমাধান করা।”

“আমি খুব ভালো করেই জানি এটা তোমার দায়িত্ব। কিন্তু এই অবস্থায় এতটা লম্বা পথ জার্নি করা কি তোমার জন্যে ঠিক?”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “কথাটা আমার হাসব্যান্ড হিসেবে বলছো। আমার বস হিসেবে বলতে পারতে।”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি যা, তাই হিসেবে বলছি।”

অরা প্রতিবাদের সুরে বলল, “প্রেগন্যান্সির জন্যে একটা মেয়ের কাজ থেমে থাকবে কেন? আমি প্রেগন্যান্ট, অসুস্থ তো নই।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এসব ফেমিনিস্ট টাইপের কথাবার্তা আমার কাছে বলে লাভ নেই।”

অরা পাল্টা উত্তর দিয়ে বলল, “আমি ফেমিনিস্ট টাইপের কথা বলছি না, সত্যি কথা বলছি।”

আরশাদ কথার দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল, “দেখ কীভাবে ঝগড়া করছে আমার সাথে!”

কথা বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলল, “ভেরি ব্যাড অরা।”

দমে গেল অরা। মুড সুইংয়ের কারণে সে আজকাল অকারণেই রেগে যাচ্ছে, রেগে না গেলেও রাগের প্রকাশ করছে।

অরা শুকনো গলায় বলল, “সরি।”

যে চিন্তারা এতক্ষণ অরাকে জ্বালিয়েছে, তা এবার ঘ্রাস করে নিলো আরশাদকে। শুটিং সেটের ঝামেলাটা নেহায়েত অগ্রাহ্য করার মতো নয়। পত্র-পত্রিকায় লেখালিখির ব্যাপারটা তার কানেও এসেছে, তবে আরশাদ তাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। দুশ্চিন্তার বিষয় শুটিং আটকে আছে। সিনেমার বাজেট বেড়ে যাচ্ছে। প্রোডাকশন হাউজের জন্যে যা নিঃসন্দেহে বিশাল ক্ষতি।

এই সময়ে একজন দক্ষ সিইও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। তার মন ঢাকার অফিসে পড়ে থাকার কথা না। তার মন পড়ে থাকার কথা কালিয়াকৈরের ওই শুটিং সেটে। অরার মনের অবস্থাটা আরশাদ বুঝতে পারছে। তবুও কেন জানি তার মন সায় দিচ্ছে না অরাকে যেতে দিতে। বিচিত্র দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে তাকে। যেন ওই শুটিং সেটে কোনো জটিল ফাঁদ, যে ফাঁদে পা রাখলেই তলিয়ে যাবে অরা।

আবারও অরার দিকে চোখ গেল আরশাদের। মেয়েটা ঠিক একই ভঙ্গিতে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। কথায় কথায় বাচ্চাদের মতো মুখ গোমড়া করার স্বভাব আর তার গেল না। এই গোমড়া মুখটাই তার সবথেকে অপছন্দের। অরা কি বোঝে না, প্রচ্ছন্ন হাসি ছাড়া আর কিছুই তার মুখে মানায় না?

আরশাদ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “কয়দিন থাকবে?”

অরা উচ্ছ্বাসে ঝলমলে কণ্ঠে বলল, “তার মানে যেতে দিবে?”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “আমি কি বলেছি যেতে দিবো?”

দমে গেল অরা। এই ছেলেটা এমন কেন? একবার আশা দেখিয়ে আবারও নিরাশ করে তুলছে অরাকে।

আরশাদ আবারও বলল, “শুধু জিজ্ঞেস করেছি, যেতে দিলে কয়দিন ওখানে থাকবে।”

“একদিন।”

“আর জার্নির সময়ের ধকল?”

“পুরোটা সময় ঘুমিয়েই থাকবো।”

আরশাদ হুমকির ভঙ্গিতে বলল, “যখনই আমি ফোন করবো, এক সেকেন্ডের মধ্যে রিসিভ করতে পারবে?”

অরা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, “পারবো।”

“ডক্টর তোমার সাথে যাবে। রাজি?”

অরা অবাক গলায় বলল, “চাইলেই কি ডক্টর রাজি হবেন?”

“সেটা আমার দেখার বিষয়। তুমি রাজি কিনা বলো।”

“হ্যাঁ রাজি।”

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কী আর করা, যাও তাহলে।”

অরা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “সত্যি?”

আরশাদ গম্ভীর স্বরে বলল, “না মিথ্যা।”

“আরশাদ!”

“যাও, যাও। সমস্যাটা মিটিয়ে এসো।”

মুখে হ্যাঁ বললেও মনের মাঝে বিচিত্র ওই দুশ্চিন্তার রেশ রয়েই গেল। ঝামেলা মিটিয়ে অরা ভালোয় ভালোয় ফিরে এলেই হয়!

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
২৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

স্ক্রিপ্টের দিকে চোখদুটো আটকে আছে আরশাদের। তবে মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য চিন্তা। চিন্তাগুলো কেবলই অরাকে ঘিরে। আজ ভোর বেলা অরা রওনা করেছে কালিয়াকৈরের শুটিং সেটের উদ্দেশ্যে। অরা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হতে লাগলো, বিশাল ভুল হয়ে গেছে। মেয়েটাকে একা ছেড়ে দেওয়া তার মোটেও উচিত হয়নি। ঝোঁকের মাথায় এত বড় একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়ে নিলো সে?

নিজেকে যথেষ্ট প্রাক্টিকাল মানুষ বলে মনে করে আরশাদ। আবেগের বশে বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার মতো মানুষ সে নয়। তবে কেন অরার গোমড়া মুখ দেখে গলে গিয়ে এই ভুল সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল সে?

আরশাদের পরবর্তী সিনেমার শুটিং চলছে আজ। সিনেমার নাম এখনো ঠিক হয়নি। শুটিং বেশ অনেক দূরেই এগিয়ে গেছে। প্রথম থেকেই এই সিনেমায় নিজের অভিনয় নিয়ে মনোযোগী ছিল আরশাদ। তবে আজ কিছুতেই শুটিংয়ে মন বসাতে পারছে না। প্রতি মুহূর্তে নিজের নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে অনুতাপ জাগছে তার মধ্যে।

মেয়েদেরকে আজকাল থামিয়ে রাখার উপায় নেই। যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন, তারা সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রেগন্যান্সি তাদের চলার পথে কোনো বাঁধা নয়। প্রেগন্যান্সি তো আর অস্বাভাবিকতা নয়। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার কারণে জীবনটাকে অস্বাভাবিক করে ফেলার তো কোনো অর্থ নেই।

তবে অরা অন্যদের মতো নয়। অরা তো অরাই। শুটিংয়ের প্রয়োজনে পরিচালক যদি তাকে আরও কয়েকদিন থেকে যেতে অনুরোধ করে, তবে না বলতে পারবে না সে। ওখানে একদিনের বেশি থাকার অরার ওপরে আরও বেশি ধকল যাওয়া। মেয়েটা তো একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে! এত ধকল সামলাবে কী করে?

আরশাদের মনের মধ্যে তীব্রভাবে খচকচ করছে। কাজে তো মন বসছেই না, অরাকে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে সে ভাবতেও পারছে না। নিজেকে নিজেই বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে আরশাদ। একটা মানুষ যখন নিজেকে বুঝতে পারে না, তার থেকে বেশি অসহায় তখন আর কেউই হতে পারে না। আচ্ছা? আরশাদ কি শুধু শুধুই অরাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে? কিন্তু কেন? শুধু শুধু তো কেউ আর দুশ্চিন্তা করতে পারে না।

হঠাৎ আরশাদের মনে পড়ে গেল গত মাসের একটা ঘটনা। বহু বছর পর আরশাদ গিয়েছিল তার স্কুলের পুনর্মিলনীতে। তার স্কুল প্রতি বছরই এই উৎসবটা পালন করে থাকে। এসএসসি পাশ করার পর আরশাদ মাত্র দুবার গিয়েছিল ওই অনুষ্ঠানে। তাও আবার সুপারস্টারে পরিণত হওয়ার আগে।

এবার কেন যেন তার ইচ্ছে হলো, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আবারও দেখা করতে। আরশাদ আসছে বলে এবারের পুনর্মিলনী আরও জাকজমকভাবে আয়োজন করা হয়। পুরনো অনেক বন্ধুদের সঙ্গেই দেখা হয় সেখানে।

সেসব পুরনো বন্ধুদের মধ্যে একজন রাশেদ। আরশাদের সঙ্গে তার সেই ক্লাস ওয়ান থেকে বন্ধুত্ব। নওশীনের সঙ্গে আরশাদের ডিভোর্সের সময় রাশেদ তার পাশে ছিল। যে কয় বার আরশাদকে কোর্টে যেতে হয়েছে প্রত্যেকবারই রাশেদ গিয়েছিল তার সঙ্গে।

ডিভোর্সের সময়ে যেহেতু আরশাদের খুব কাছাকাছি সে ছিল, ডিভোর্সের কারণটাও তাই তার অজানা নয়। ওই ঘটনার পর বহুদিন রাশেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। মাঝে কেটে গেল কতগুলো বছর। ভেঙে চুরমার হয়ে পড়া জীবনটাকে নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছে আরশাদ।

বহুদিন পর দেখা করে আড্ডায় মেতে ওঠে দুই বন্ধু। আড্ডার এক পর্যায়ে রাশেদ গম্ভীর মুখে বলে ওঠে, “বিয়ে করে ভালোই করেছিস। তবে আবারও মেয়েমানুষকে বিশ্বাস করতে পারবি তো?”

কথাটাকে একেবারেই গায়ে মাখে না আরশাদ, কৌশলে এড়িয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যেই ওই কথাটা ভাবিয়ে তোলে তাকে। অরাকে অবিশ্বাস করার চিন্তা কোনোদিনও তার মাথায় আসেনি। সব মেয়ে তো আর নওশীন নয়।

নওশীন তার বিশ্বাস ভাঙার পর পৃথিবীর সব মেয়েদেরকে একই রকম মনে হতো আরশাদের কাছে। যাদের কাছে ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে যারা সব করতে পারে। সেই আরশাদের চিন্তাধারা এত দ্রুত বদলে গেল কী করে? কী করে অরার ওপরে জন্মালো এতটা অগাধ বিশ্বাস।

অরার শুটিং সেটে যাওয়া তাকে এত ভাবাচ্ছে কেন? সে কি কোনো কারণে অরাকে অবিশ্বাস করছে?

“স্যার! শট রেডি।”

এলোমেলো ভাবনাগুলো থেকে বেরিয়ে এলো আরশাদ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরেরকে ইশারায় “আসছি” বলতেই বেরিয়ে গেল সে।

লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো আরশাদ। শুধু শুধু এতক্ষণ দুশ্চিন্তা করছিল সে। নিজেকে বুঝতে না পারার কারণেই এমনটা হচ্ছে। অরাকে সে অবিশ্বাস করতে যাবে কেন? যে মানুষটাকে নিজের থেকেও সে বেশি ভালোবাসে, তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তার মধ্যে যা কাজ করছে, তা কেবলই উদ্বেগ। মেয়েটার প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই তাকে নিয়ে একটু বেশি উদ্বিগ্ন থাকে আরশাদ। দুশ্চিন্তাকে দূরে সরে সেটের দিকে পা বাড়ালো সে।

তিন ঘন্টা যাবত গাড়ি চলছে রাজপথের বুকে। গাড়ি কেবল গাজীপুর পাড় হলো। এখনো বেশ অনেকটা সময় লাগবে। সব দোষ রাস্তার অসহনীয় যানজটের। যানজট না থাকলে তিন ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় কালিয়াকৈরে।

পেছনের সিটে বন্ধ জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আলস্যের ভঙ্গিতে বসে আছে অরা। কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভাঙলো তার। আরশাদকে দেওয়া কথা অনুযায়ী পুরোটা পথ সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। তাই তেমন একটা ক্লান্তি বোধ হচ্ছে না।

অরার পাশের সিটেই উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বসে আছেন ডক্টর নাসরিন। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে, অথবা শুটিং সেটের ক্লান্তিময় পরিস্থিতিতে অরা যদি অসুস্থ হয়ে পড়তেই পারে। তাই সতর্কতা হিসেবে আরশাদ তার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে ডক্টর নাসরিন। নাসরিন ব্যস্ত মানুষ, দিনে হাজারটা রোগী সামলাতে হয় তাকে। অরা ভেবেছিল হয়তো সে সময় করে উঠতে পারবে না। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল, শুটিং সেটে আসা নিয়ে তার আগ্রহই সবথেকে বেশি।

গাড়ি অবশেষে এসে থামলো ‘রজনী’র পেছনে। যে হোটেলে এই সিনেমার অভিনয়শিল্পী, পরিচালক এবং কলাকুশলীরা অবস্থান করছে, তার নামই রজনী। রজনী থেকে মিনিট কয়েক দূরেই ওই গ্রামের সেট বানানো হয়েছিল। ওই সেট এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নয়। তবে মূল শুটিং হবে সেই ধ্বংসস্তূপের মাঝেই। শুটিং আটকে আছে অনশনরত মানুষগুলোর কারণে। যাদের বাড়িঘর পুড়ে গেছে তারা রজনীর মূল দরজার সামনেই চাদর বিছিয়ে অনশনে বসেছে।

অরার গাড়ির পেছনে আরও দুটো গাড়ি থামলো। কে ফিল্মসের প্রোডাকশন টিম এবং ম্যানেজমেন্ট টিমের বিভিন্ন সদস্যরাও এসেছে তার সঙ্গে। গাড়ির বাইরে সিনেমার পরিচালকসহ অন্যান্য সকলে এসে ভীড় করেছে। শুটিং সেটে বরাবরই প্রযোজকদের একটু বাড়তি খাতির করা হয়। আর সেখানে যদি, প্রযোজক নিজেই শুটিং সেটের কোনো একটা সমস্যার সমাধান করতে আসে তাহলে তো কথাই নেই।

গাড়ির দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই সকলে “ম্যাম! ম্যাম!” করে অতিষ্ট করে তুলল তাকে।

অরা এই সিনেমার পরিচালক সাইদ সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “কী অবস্থা সাইদ ভাই?”

সাইদ সাহেব শুকনো গলায় বললেন, “খুবই ডেঞ্জারাস অবস্থা আপু। এরা যা শুরু করেছে, আমরা রীতিমত আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।”

“কেন? কী করেছে?”

সাইদ সাহেব আতঙ্কিত স্বরে বললেন, “রাত-বিরেতে হোটেলের জানালায় ঢিল ছুঁড়ে মারছে। ভয়ে থাকি কখন গায়ে ঢিল এসে পড়ে। এই পর্যন্ত সাতটা জানালার কাঁচ ভেঙেছে ওরা।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আপনি কথা বলেছেন ওদের সঙ্গে?”

“চেষ্টা করেছি আপু, কোনো কথাই তো শুনতে চাচ্ছে না। এদের একটাই দাবি, নতুন ঘর তুলে দিতে হবে। না হলে অনশন বন্ধ করবে না। এদিকে আবার আর্টিস্টরাও প্রচন্ড জ্বালাচ্ছে। তারা না-কি আর থাকতে পারবে না, অন্য জায়গায় ডেট দেওয়া আছে।”

অরা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আর্টিস্টদের সমস্যাটা তো এখন মুখ্য নয়। আগে এই সমস্যার সমাধান করি।”

অনশনরত মানুষগুলো হোটেল থেকে কাউকে বের হতে দিচ্ছে না। কেউ বের হওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের আক্রমণ করা হয়। এমনকি পেছনের দরজা দিয়ে কেউ বের হলেও ছুটে আসছে তারা। আপাতত অরার বডিগার্ডরা তাদের সামলাচ্ছে। তাই হোটেলের সবাই বের হবার সাহস করে উঠতে পেরেছে।

অরা বলল, “কোথায় ওরা?”

সাইদ সাহেব বললেন, “সামনের দিকে আপু।”

“চলুন যাই তাদের কাছে।”

সাইদ সাহেব ইতস্তত করে বললেন, “আপনি আপু আগে একটু রেস্ট নিয়ে নিলে ভালো হতো না? এতটা পথ জার্নি করে এসেছেন।”

অরা ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “যে কাজটা করতে এসেছি, সেটা আগে করি। রেস্ট তো পরেও নেওয়া যাবে।”

হোটেলের সামনে দিকে এগিয়ে যায় অরা। তার পিছু নিলো পরিচালক, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, প্রোডাকশনের লোকজনসহ তার সঙ্গে আসা টিমের মেম্বাররা।

হোটেলের সামনে দুটো বড় বড় রঙ চটা চাদর বিছিয়ে রাখা। তার ওপরে বসে আছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। মাঝ-বয়সী নারী-পুরুষ, ছোট ছোট বাচ্চা, বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধা। গ্রামের দিকে এই সময়েই শীতের আগমন ঘটে। তীব্র শীতে এরা দুদিন ধরে বাইরে দিনযাপন করছে। আর্দ্রতার অভাবে শুষ্ক হয়ে তাদের চেহারা তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। কারো কারো সঙ্গে দুয়েকটা পোটলা রয়েছে। সেই পোটলা জড়িয়ে ধরে শীত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত তারা।

অরা সেদিকে এগিয়ে যেতেই একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালো সকলে। উঠতে পারলেন না কেবল বয়সের ভারে ন্যুব্জ সেই বৃদ্ধা। সকলের চোখমুখে প্রবল বিস্ময়। আরশাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই অ্যাওয়ার্ড শো কিংবা ইন্টারভিউতে যেতে হয় অরা। সেই বদৌলতে তার পরিচিতিও নেহায়েত কম নয়। যে কারোর কাছেই তাকে এক পলক দেখায় চেনা চেনা লাগে।

অরা সেই বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তার দিকে ঝুঁকে হাসিমুখে বলল, “নানি, শীতের মধ্যে মাটিতে বসে আছেন কেন?”

নিতান্তই স্বাভাবিক প্রশ্ন। তবুও থতমত খেয়ে গেলেন বৃদ্ধা। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছেন। অরা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধার হাতদুটো নিঃসংকোচে তার হাতের মুঠোয় নিলো। হিমবাহের মতো শীতল বৃদ্ধার হাতদুটো।

অরার এমন কান্ডে অনশনরত মানুষগুলোর পাশাপাশি অবাক হলো সেটের সকলের। বড়লোকেরা তো গরীব মানুষের আশেপাশেই ঘেঁষতে চায় না। আর সেখানে অরা নির্দ্বিধায় এই দরিদ্র বৃদ্ধার হাত ধরছে?

বৃদ্ধা ভাঙা ভাঙা গলায় বিস্ময়ে সুরে বললেন,
“তোমারে যেন কই দেখছি মা?”

পেছনে অনশনরত দলের দুজনের ফিসফিস কথা শোনা গেল, “আরশাদ হকের বউ না?”

“হ সেইরকমই তো দেখায়!”

বৃদ্ধা পেছনে ঘুরে তাদের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে বললেন, “নায়ক আরশাদ?”

অনশনরত লোকটা জোর দিয়ে বলল, “হ, হ!”

অরা মনে মনে কথা গোছাচ্ছে। তাকে দেখেই হয়তো অনশনরতদের মন গলতে শুরু করেছে। তবুও নরম স্বরে কথা বলে পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।

অরার সঙ্গে আসা ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান রবিন সাহেব সকলের উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় বললেন, “উনি আরশাদ স্যারের ওয়াইফ, আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”

অনশনে থাকা সকলের চোখেমুখে বিস্ময় স্থায়ী জায়গা করে নিলো। সঙ্গে হয়তো কিছুটা ভয়ও কাজ করছে। গরীব মানুষেরা স্বভাবতই শক্তিশালী কারোর মুখোমুখি হতে ভয় পায়।

তবুও বৃদ্ধা সাহস করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ম্যাডাম? এই শুটিংয়ের মানুষগুলা আফনের লোক?”

অরা আবারও হাসিমুখে বলল, “আমাকে ম্যাডাম ডাকতে হবে না নানি। আমার নাম অরা।”

আরেকদফা বিস্ময়ের প্রবল হাওয়া বয়ে গেল সকলের ওপর দিয়ে। এই মেয়েটা কি আদৌ আরশাদ হকের স্ত্রী? যে মেয়ে আরশাদ হকের মতো একজন সুপারস্টারের স্ত্রী, তার তো অহংকারে মাটিতে পাই পড়ার কথা নয়। আর সেই মেয়ে কিনা বলছে, “আমাকে ম্যাডাম ডাকতে হবে না।”

অরা বৃদ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনিও অনশন করছেন নানি?”

বৃদ্ধা এমনভাবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন, যেন ছোট্ট বাচ্চা কোনো অপরাধ করতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়েছে।

অরা কোমল স্বরে বলল, “এই বয়সে শীতের দিনে রাস্তায় বসে অনশন করাটা কি ঠিক নানি? আপনার অসুখ-বিসুখ বাঁধতে পারে না?”

বৃদ্ধা চুপ করে রইলো।

অরা পেছনে ঘুরে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “পানি দাও।”

সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকে উঁচু স্বরে বলল, “এই প্রোডাকশন! পানি!”

মুহূর্তের মধ্যেই একজন প্রোডাকশন বয় পানির বোতল নিয়ে হাজির হলো। অরা যত্ন নিয়ে সেই পানির বোতল তুলে দিলো বৃদ্ধার মুখে। যাক, অনশনটা তো ভাঙা গেল!

অরা এবার অনশনরত অন্যান্য মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলল, “বলুন, আপনাদের সমস্যাটা আমাকে বলুন।”

ভীড়ের মধ্যে থেকে এক লোক কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “ম্যাডাম, শুটিংয়ের লোকজন আমাগো ঘরে আগুন দিসে। আমাগো বিছানা-পত্তর, হাঁড়ি-পাতিল সব পুইড়া গেছে। আমরা এহন কই যামু?”

আরেকজন লোক সাহস পেয়ে ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে বলল, “আমরা ম্যাডাম গরীব মানুষ। দিন আনি, দিন খাই। মাথার ওপর যদি ছাদটুকুন না থাকে, তাইলে যাই কই?”

অরা ভদ্রভাবে বলল, “একটা ভুল হয়ে গেছে। এজন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা কখনোই ইচ্ছা করে আপনাদের ঘরে আগুন দিতে চাইনি। ভুলে আগুন লেগে গেছে। আমার লোকজন তো আপনাদের ক্ষতিপূরণও দিতে চেয়েছে।”

লোকটা দুঃখিত গলায় বলে উঠলো, “আফনের লোকজনের ব্যবহার ভালো না ম্যাডাম। এমনভাবে ট্যাকা দিতে গেছে, যেন ভিক্ষা দিতেছে। আমরা কি ভিক্ষা চাইতে আসছি। আমাদের হকের টাকা এইডা।”

অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে অনুতাপমাখা স্বরে বলল, “তার জন্যেও আমি দুঃখিত। যারা আপনাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে, তাদের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।”

সকলে ব্যস্ত হয়ে বলল, “না, না ম্যাডাম। আফনের ক্ষমা চাওন লাগবো না।”

অরা মিষ্টি গলায় বলল, “আপনারা তো টাকা নেবেন না। আপনাদের দাবি আমরা যেন আপনাদের জন্যে নতুন ঘর বানিয়ে দিই? তাই তো?”

“জে ম্যাডাম। আমাগো ট্যাকা লাগবো না। আমাগো ঘর গেছে, আমরা ঘর চাই।”

“ঠিক আছে, আমি কথা দিচ্ছি আপনাদের ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে। আজ থেকে ঘর তৈরির কাজ শুরু হবে।”

সকলে আবারও একসঙ্গে বিস্মিত হয়ে উঠলো। যে ঘরের জন্যে এতকিছু, সেই ঘরটাই শেষমেশ পাচ্ছে তারা? আনন্দের প্রবল হাওয়া বয়ে গেল তাদের মাঝে।

অরা হাসিমুখে বলল, “আমার একটাই অনুরোধ, আমাদের শুটিং করতে দিন। ঘর বানাতে একটু তো সময় লাগবেই। ততটা দিন আপনারা এই হোটেলেই থাকবেন। কোনো সমস্যা হবে না আপনাদের। কিন্তু এতগুলো দিন শুটিং বন্ধ থাকলে সত্যিই আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।”

প্রস্তাবটা খারাপ নয়। চোখের সামনে নতুন করে তাদের বাড়ি তৈরি হবে। বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তারা এই হোটেলেই থাকতে পারবে। কেবল শুটিং ইউনিটকে শুটিং করতে দিতে হবে। তাদের মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো না কোনো আপত্তি আছে।

তবুও অরা নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার জন্যে বলল,
“রাজি আপনারা?”

“জে ম্যাডাম! আমরা রাজি!”

(চলবে)