#ফিরে_আসা২
২৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
অন্যমনস্কভাবে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে অরা। মিনিট দশেক হলো গাড়ি প্রবেশ করেছে ঢাকায়। কালিয়াকৈরে যাওয়ার সময়ে পুরোটা পথ ঘুমিয়ে কাটিয়েছে অরা। তবে আজ ঠিক উল্টো চিত্র। ঘুমের নামগন্ধ নেই দুটো চোখে। কাল রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। ভোর রাতে চোখদুটো লেগে এলেও ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখে উঠে যায় সে।
ঘুমটা এই মুহূর্তে মুখ্য নয়। পৃথিবীর কোনোকিছুই মুখ্য নয়। একটি প্রশ্নের উত্তর ছাড়া। কেন? আরশাদ কেন তার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখতে গেল? অরার মনের একটা অংশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে এই কাজ আরশাদ করেনি। হোটেলের লোকজন মিথ্যা বলেছে তাকে। হয়তো এর পেছনে অন্য কেউ আছে। তবে মনের আরেক অংশ মনে করছে, হোটেলের লোকেরা মিথ্যা বলছে না। তবে কেন? আরশাদ কেন এমন কাজ করতে যাবে? হতাশায় মাথা চেপে ধরলো অরা। বাড়িতে পৌঁছানো না পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
“আপনি ঠিক আছেন অরা?” চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর নাসরিন।
অরা জোরপূর্বক ঠোঁটে একটা কৃত্রিম হাসি টেনে এনে বলল, “হ্যাঁ ডক্টর, আমি ঠিক আছি।”
“আপনাকে দেখে বেশ চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে।”
অরা হালকা গলায় বলল, “তেমন কিছু না। আসলে আমি একটু টায়ার্ড, তাই হয়তো এমনটা মনে হচ্ছে।”
অজুহাত দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই অরার কাছে। যে সত্যির মুখোমুখি সে হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সত্যি পৃথিবীর কাউকে জানানো যায় না। অরার স্বামী, তার সবথেকে ভালোবাসার মানুষটা কেন তারই ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখবে?
হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে পড়ে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো। হ্যান্ডব্যাগ খুলে মোবাইল বের করার প্রয়োজন মনে করলো না অরা। খুব ভালো করেই সে জানে কে ফোন করেছে তাকে, আরশাদ। গত রাত থেকে অসংখ্যবার আরশাদ কল করেছে অরাকে। একবারও সেই কল রিসিভ করেনি অরা। অচেনা এক অভিমান আঁকড়ে ধরেছে তাকে।
মুঠোর মধ্যে থাকা জিনিসটাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরলো অরা। যাত্রার শুরু থেকেই সেই স্পাই ক্যামেরা অরার মুঠোয় বন্দী। আরশাদ না-কি আজ শুটিংয়ে যায় নি। হুট করে সকালবেলা শুটিং প্যাকআপ করেছে সে। ভালোই হলো, বাড়ি পৌঁছেই এই ক্যামেরার বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা যাবে।
গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামলো দুপুর নাগাদ। অন্যান্য দিনের মতোই সাধারণ একটা দিন। মাথার ওপরে মিষ্টি একটা রোদ। দুজন মালী তার বাড়ির সামনের বিশাল বাগানের যত্ন নিচ্ছে। মূল দরজার সামনে সিকিউরিটি গার্ডরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও, স্বাভাবিক নেই অরা। তার সমস্ত চিন্তাভাবনা যেন এক জায়গাতেই আটকে রয়েছে।
গাড়ি থেকে নেমে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না অরা। দ্রুত পায়ে প্রবেশ করলো বাড়ির ভেতরে। দরজার সামনেই একজন স্টাফকে পাওয়া গেল।
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় তাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার স্যার কোথায়?”
“লাইব্রেরিতে ম্যাম।”
লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল অরা। কাল রাত থেকে যে প্রশ্নগুলো তার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেগুলোকে আর ধরে রাখতে পারছে না নিজের মাঝে। উত্তরগুলো জানা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।
লাইব্রেরি ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই অরা দেখলো, সোফার ওপর পা তুলে বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে আরশাদ। দিন কয়েকের দূরত্বের পর আবার যখন তাদের দেখা হয়, অরা তখন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আরশাদকে। নিজেদের বন্দী করে রাখে আরশাদের বাহুডোরে। দিন কয়েকের দূরত্বের পর আজ তাদের দেখা হয়েছে ঠিকই, তবে আরশাদের বাহুডোরে নিজেকে বন্দী করার মতো পরিস্থিতি আজ নেই।
অরা থমথমে ভঙ্গিতে আরশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাতের মুঠো থেকে সেই স্পাই ক্যামেরা বের করে এনে তার সামনে মেলে ধরলো বলল, “এসবের মানে কী আরশাদ?”
বইয়ের মাঝে আরশাদ এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে এতটা সময় অরার উপস্থিতি টেরই পায়নি। অরার কণ্ঠে সংবিৎ ফিরে পেয়ে বই রেখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “Finally! এত দেরি হলো কেন? রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল না? অনেক টেনশন করছিলাম। টেনশনে আজকের শুটিংই প্যাকআপ করে ফেলেছি।”
অবাক হয়ে আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। ক্যামেরার বিষয়টা একেবারেই এড়িয়ে যাচ্ছে সে? এত বড় একটা ঘটনা অরার সামনে এলো, অথচ সে পাত্তাই দিচ্ছে না?
অরা আবারও একই প্রশ্ন করলো, “এসবের মানে কী?”
আরশাদ এবারও এড়িয়ে গেল তার প্রশ্ন। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কাল রাত থেকে আমার কল রিসিভ করছো না কেন তুমি? জানো কতটা টেনশনে ছিলাম?”
আরশাদ বারবার ক্যামেরার বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? তার মানে অরার ধারণা ভুল? সে তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করে গেছে আরশাদকে। তার ধারণা ছিল হোটেলের লোকজন মিথ্যা বলছে। কিংবা অন্য কেউ ক্যামেরা ফিট করিয়ে আরশাদের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তেমনটা হলে তো এই ক্যামেরা দেখেই তার চমকে ওঠার কথা ছিল? কিন্তু না, শান্ত ভঙ্গিতে সুকৌশলে পুরো ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আরশাদ। তার মানে অন্য কেউ নয়, এই ক্যামেরা তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল খোদ আরশাদই?
অরা সন্দেহযুক্ত গলায় বলল, “কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবে না আরশাদ। আমার হোটেল রুমে আমি এই স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছি, আর আমি খুব ভালো করেই জেনে গেছি এটা তোমার কাজ। কী হচ্ছে এসব?”
আরশাদ এগিয়ে এসে ক্যামেরাটা অরার হাত থেকে নিয়ে হালকা গলায় বলল, “এটা তুমি নিয়ে আসতে গেলে কেন? শুটিংয়ে কাজে লাগতে পারতো তো!”
অরা এবার ধৈর্যহারা হয়ে উঠলো। তার ওপরে আরশাদের এই শান্ত ভঙ্গিতে তার রাগের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো।
নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে অরা চিৎকার করে বলল, “Answer me damn it!”
কয়েক মুহূর্তের জন্যে নীরবতার হাওয়া কেটে গেল ঘরজুড়ে। নীরবতার মাঝে আরশাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছে অরা। তার সঙ্গে নীরবতায় কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই পরম শান্তিময়। আজকের এই মুহূর্তটা বাদে। আজ এই নীরবতা যেন বড় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অরা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে কখন নীরবতা কেটে যাবে। কখন আরশাদ মুখ খুলবে আর কখন সে তার কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর পাবে।
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশাদ বলল, “আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল।”
অরা অবিশ্বাসে তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে। একেবারেই অবিশ্বাস্য একটা উত্তর। এর আগেও তো তারা দূরে দূরে থেকেছে। আরও লম্বা সময়ের জন্যে দূরে থেকেছে। তখনও তাকে দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল আরশাদের। কিন্তু কোনোবারই তো তার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি আরশাদ। তবে এবার কেন?
অরা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “আরশাদ আমাকে বোকা মনে করবে না। দেখতে ইচ্ছা করলে ভিডিও কল করতে পারতে। হোটেলের স্টাফ দিয়ে আমার অজান্তে আমার ঘর এই স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রাখতে না।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “ভিডিও কলে তো সার্বক্ষণিক দেখার সুযোগ নেই। আমার তোমাকে সবসময় দেখতে ইচ্ছা করছিল।”
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা, মানলাম সবসময় দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাহলে ক্যামেরার ব্যাপারটা আমাকে জানালে কী হতো?”
আরশাদ গম্ভীর গলায় “এখন যা হচ্ছে তা অভয়েড করার জন্যে জানাইনি?”
অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “এখন যা হচ্ছে মানে? এখন কী হচ্ছে?”
“তুমি অকারণে সিনক্রিয়েট করছো।”
অরা হতবাক গলায় বলল, “আমি অকারণে সিনক্রিয়েট করছি? আরশাদ আমার রুমে তুমি একটা স্পাই ক্যামেরা লুকিয়ে রেখেছিলে, আমার পারমিশন ছাড়া।”
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “এখানে তোমার পারমিশন নিতে হবে কেন?”
অরা জোর গলায় বলল, “তুমি খুব ভালো করেই জানো কেন পারমিশন নিতে হবে। আমার রুম আমার পার্সোনাল এরিয়া। তুমি চাইলেই পার্সোনাল এরিয়ায় আমার ভিডিও করতে পারো না। রুমের মধ্যে মানুষ ফর্মালি থাকে না। আমার জামাকাপড়ের ঠিক থাকে না, আমি কতবার চেঞ্জ করেছি! আর সেগুলো তুমি ভিডিও করেছো।”
আরশাদ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “তো সমস্যা কোথায়? সেই ভিডিও আমি ছাড়া কেউ তো দেখেনি।”
“তোমার ফোন থেকে ভিডিও অন্য কোথাও চলেও তো যেতে পারে।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “অন্য কোথায় যাবে? তোমার পার্সোনাল ভিডিও আমি এখনো ফোনে রেখে দিয়েছি না-কি? সাথে সাথে ডিলিট করে দিয়েছি।”
মোবাইলে ব্যক্তিগত এমন কোনো ছবি বা ভিডিও থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। আমরা তো ভাবি একটা ডিলিট বাটনে চাপ পড়লেই বুঝি সেই ছবি বা ভিডিও চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। তবে বাস্তবে তেমনটা হয় না। ডিলিট হওয়ার পরও তা থেকে যায় ফোনের কোনো এক অংশে।
পৃথিবীতে কোনোকিছুই তো নিশ্চয়তা নেই। কড়া নিরাপত্তার মাঝে থাকা সত্ত্বেও আরশাদের এই ফোন তার কাছ থেকে চুরি হয়ে যেতে পারে। কিংবা তার ফোন কেউ কোনো দক্ষ হ্যাকার হ্যাকও করে ফেলতে পারে। আরশাদের ফোন চুরি বা হ্যাক হওয়ার অর্থ অন্য কারো কাছে অরার ভিডিও পৌঁছে যাওয়া। যা অরা দুঃস্বপ্নেও চায় না। তার রাগের মূল কারণ এটাই। কিন্তু আরশাদ তো বুঝতেই চাইছে না!
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তবুও কেন রেকর্ড করবে?”
“আমি এখনো বুঝতে পারছি না এখানে সমস্যা কোথায়?”
“আমার সমস্যা আছে!”
“তুমি আমার ওয়াইফ অরা। আমি তো অন্য কারো ঘরে ক্যামেরা রাখিনি, তোমার ঘরে রেখেছি।”
অরা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, “আমি তোমার ওয়াইফ হোই আর যেই হোই না কেন, তুমি সেটা পারো না আরশাদ। আমার প্রাইভেসি বলে তো একটা কথা আছে না-কি? রুমের মধ্যে আমি একা যেকোনো অবস্থায় থাকতে পারি!”
অনেকটা সময় নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে আরশাদ। আর সম্ভব হলো না তার পক্ষে। তার মনে যে অবিশ্বাসের উঁকিঝুঁকি তা আর গোপন করে রাখতে পারলো না অরার কাছ থেকে।
আরশাদ অধৈর্য হয়ে বলল, “একাই তো ছিলে। সাথে অন্য কেউ তো আর ছিল না।”
চোখ বড় বড় আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইল অরা। বুকে বড়সর ধাক্কার মতো খেল। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন নিমিষেই থেমে গেছে। মনের মাঝে একই সাথে হাজারো অনুভূতি ঘোরাফেরা করছে। একই সঙ্গে রাগ, বিস্ময়, হতাশা ঘিরে ধরলো তাকে।
অরা কাঁপা কাঁপা স্বরে ভীত ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদ! ডোন্ট টেল মি তুমি আমাকে সন্দেহ করো।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ শীতল গলায় বলল, “সন্দেহ করি না কিন্তু এখন তোমার কথাবার্তার সন্দেহ করতে বাধ্য হচ্ছি।”
“মানে?”
“মানে বুঝতে পারছো না?”
“না পারছি না।”
আরশাদ জিজ্ঞাসাবাদের ভঙ্গিতে বলল, “স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পেয়ে এত রিয়্যাক্ট করছো কেন তুমি? শুধুমাত্র তোমার পার্সোনাল ভিডিও রেকর্ড করেছি বলে? আর সেই ভিডিও অন্য কোথাও চলে যেতে পারে এই ভয়ে?”
অরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ! আর কী কারণ থাকবে?”
আরশাদ অবিশ্বাসের সুরে বলল, “না। শুধুমাত্র এই কারণে তো কারও এত রিয়্যাক্ট করার কথা না। আমার কী মনে হচ্ছে জানো?”
“কী?”
আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ওই রাতে তোমার ঘরে কারোর আসার প্ল্যান ছিল। আমার স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পাওয়ায় তুমি সতর্ক হয়ে যাও আর তোমার প্ল্যানটাও ভেস্তে যায়। সেজন্যেই এত রিয়্যাক্ট করছো, তাই না?”
অরা উচ্চ স্বরে বলল, “আরশাদ!”
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শরীরের সমস্ত জোর যেন হারিয়ে ফেলেছে অরা। মনের জোরটাও এই মুহূর্তে হারিয়ে ফেলল। ধপ করে বসে পড়লো সোফার ওপরে। আরশাদ তার মানে তাকে সন্দেহ করছে? শুধুমাত্র সন্দেহই নয়, আরশাদ তো রীতিমত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে অরা অন্য কারোও সঙ্গে… বাকিটা আর ভাবতে পারলো না অরা। তার গা গুলিয়ে উঠছে।
চোখ তুলে অসহায় দৃষ্টিতে আরশাদের দিকে তাকালো অরা। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে? আসলেই তার আরশাদ? না-কি আরশাদের রূপধারী অন্য কেউ? এতকাল যে মানুষটাকে সে চিনে এসে, আজ মুহূর্তের মধ্যেই সেই মানুষটা অচেনা হয়ে উঠলো।
অরাকে দমে যেতে দেখে আরশাদ বলল, “এত গায়ে লাগলো কেন কথাটা? সত্যিই এমন প্ল্যান ছিল না-কি?”
অরা আবারও উঠে দাঁড়িয়ে তেজী ভঙ্গিতে বলল, “যে মানুষটা দুদিন পর তোমাকে বাচ্চার মা হবে তাকে এত বড় অপমান কী করে করতে পারলে তুমি?”
বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল আরশাদের। তার মনে গেল নওশীনের কথা। নওশীন তো ঠিক এভাবেই নিজের দোষগুলো ঢাকার জন্যে ওই একটা পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতো। আরশাদের বাচ্চার মায়ের পরিচয়। অরাও ঠিক একই কাজ করছে। তার মানে নওশীন আর তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “কথায় কথায় বাচ্চার মায়ের কার্ড প্লে করবে না তো!”
অরা আর্তনাদ করে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। যে মানুষটা তোমার বিয়ে করা বউ, যাকে তুমি ভালোবাসো, যে মুখ দিয়ে ভালোবাসি বলো সেই মুখ দিয়েই ওরকম নোংরা একটা কথা কী করে বলতে পারলে? বলার পর বিন্দুমাত্র রিগ্রেটও নেই তোমার মধ্যে।”
অরা কাঁদতে চাইছে না। ভেঙে পড়তে চাইছে না। কিন্তু কথাগুলো বলতে গিয়ে তার চোখদুটো বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়লো।
যে আরশাদ অরার চোখে একবিন্দু জল দেখলেও ব্যস্ত হয়ে যায় সেই জল মুছে দিতে, আজ অরার কান্না সেই আরশাদের মনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারছে না। এই একদিনের মধ্যে কী এমন হলো, যা এতটা বদলে দিয়েছে আরশাদকে?
আরশাদ বিন্দুমাত্র সংকোচ না করে বলল, “আমার বলা নোংরা কথাগুলো মিথ্যা হলে তো তোমার এতটা গায়ে লাগতো না।”
দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো অরা। সে প্রাণপণ বিশ্বাস করতে চাইছে, তার সঙ্গে যা ঘটছে তা বাস্তব নয়। তার দেখা আর দশটা দুঃস্বপ্নের মতো, এই মুহূর্তটাও কোনো এক দুঃস্বপ্নের অংশ।
একটা মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা তার জন্যে সবথেকে আঘাতের, সবথেকে অপমানের। আর সেই অপমানটা যদি তারই সবথেকে কাছের মানুষটা করে! তার তো বেঁচে থাকার সকল ইচ্ছাই ফুরিয়ে যায়।
অরা বিড়বিড় করে বলল, “কার সাথে ঘর করছি আমি?”
বিড়বিড় করে বললেও কথাটা শুনতে পেলো আরশাদ। তেজী ভঙ্গিতে সে বলল, “এখন তো এ প্রশ্ন করবেই! অন্য মানুষের স্বাদ পেয়ে গেছ না!”
নিজের সম্পর্কে এমন বিশ্রী কথা আর শুনতে পারলো না অরা। আকুতির সুরে বলল, “আরশাদ প্লিজ! প্লিজ!”
চুপ করলো আরশাদ। অরা আবারও কম্পিত স্বরে বলল, “I’m sorry. আমারই ভুল হয়েছে তোমার কাছে এসে।”
আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো অরা। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পা ফেলে হাঁটাও যেন কষ্টকর কাজে পরিণত হয়েছে। আরশাদ তো কেবল তার স্বামী নয়। তার ভালোবাসার মানুষ, তার হৃদয়ে বসবাসকারী। সেই মানুষটাই কিনা তাকে নিয়ে এসব ভাবে? নিজের অস্তিত্বের ওপর ঘৃণা ধরে যাচ্ছে অরার।
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
২৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
অরার বয়স তখন চৌদ্দ কী পনেরো। তার অতটুকু শরীরের ওপরে সংসারের সকল কাজের বোঝা। কাকভোরে পুকুর ঘাটে এক গাদা কাপড়-চোপড় নিয়ে যেত কাঁচবে বলে। বাড়ি ফিরে বাসন ধুঁয়ে তরকারি কুটতে বসে যেত। তার নতুন মা আয়েশা বেগম তখন কেবল ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে এসে নানান অজুহাতে গালমন্দ করতেন তাকে। এ যেন রোজকার রুটিন। একটা সময়ে তার কটু কথাগুলো গায়ে মাখা ছেড়ে দেয় অরা।
তরকারি কুটে ঘর ঝাট দিয়ে মুছে অরা চলে যেত স্কুলে। তার স্কুলে যাওয়া নিয়েও আয়েশার আপত্তির শেষ ছিল না। অরা যেহেতু ঘরের সব কাজ করে রেখেই যেত, তাই বেশি কিছু বলতেও পারতেন না তিনি। পড়াশোনা, ঘরের কাজ, ছোট ছোট ভাইদের দেখাশোনা আর নতুন মায়ের অমানবিক অত্যাচার। একেকটা দিন যেন অরার কাছে একেক বছরের সমান ছিল। শুরু হলে শেষ হতেই চাইতো না দিনগুলো।
দিনভর খেটেখুটে সেদিন একটু বিশ্রাম নিতে এসেছে। চোখদুটো বন্ধ করতেই তার কানে আসে নতুন মায়ের চেঁচামেচি। আয়েশা কোনো না কোনো কারণে সারাদিনই চেঁচামেচি করতেন। বিষয়টাকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে আবারও চোখ বুজে ফেলে অরা।
তখনই তার ঘরে প্রবেশ ঘটে আয়েশার। তার পিছু নেন অরার বাবা হাফিজ মিয়া। কথা নেই বার্তা নেই আয়েশা প্রকান্ড এক বেত দিয়ে আঘাত করে অরার গায়ে। চমকে উঠে বসে অরা। হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার বাবা আর নতুন মায়ের দিকে। তাকে আঘাত করার জন্যে কখনোই কোনো কারণের প্রয়োজন ছিল না আয়েশার। তবে আজ মনে হলো যেন কোনো কারণ আছে।
আয়েশা অগ্নিকন্ঠে বলে উঠলো, “এই হারামজাদিই নিসে আমার চেন! ওরে বলেন চেনটা বাইর কইরা দিতে।”
হাফিজ মিয়া বিরক্ত গলায় বললেন, “ওয় নিতে যাইবো ক্যান?”
আয়েশা খেঁকিয়ে উঠে বলল, “ওয় না নিলে কেডা নিবো? এই বাড়িতে আর কেডা আছে কেন নেওনের?”
অরা অবাক ভঙ্গিতে শুনছে তাদের কথোপকথন। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তার বুঝতে বাকি রইল না আয়েশার সোনার চেইন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দামি গয়নাগাটি বলতে তার ওই একটা সোনার চেইন আর এক জোড়া সোনার কানের দুল ছিল। সেই চেইন হারিয়ে গেলে তা চুরির অপবাদ কেন অরার ঘাড়ে পড়বে? সে চেইন দিয়ে করবে কী?
হাফিজ মিয়া হাই তুলতে তুলতে বললেন, “যা ইচ্ছা করো! চিল্লাফাল্লা করবা না। রাত্তির হইছে। তোমার তো সারাদিন কোনো কাম কাইজ নাই, মাইনসের আছে। চিল্লাফাল্লা কইরা মাইনসের ঘুম হারাম করবা না।”
হাই তুলতে তুলতে মেয়েকে বিপদের মুখে রেখে চলে গেলেন হাফিজ মিয়া। শুরু হলো অরার ওপরে অমানবিক অত্যাচার। আয়েশা তার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে আসে বাড়ির উঠানে। সেখানে তাকে ছুঁড়ে ফেলে ফুটবলের মতো লাথি মারে। সঙ্গে বেতের আঘাত তো আছেই। অরা আর্তনাদ করে বহুবার বলেছে, “আমি চেইন নিই নাই!”
কোনোবারই সে কথা প্রবেশ করেনি আয়েশার কর্ণকুহরে। তার মনে বদ্ধ ধারণা, চেইন অরাই নিয়েছে।
আয়েশা তাকে অনবরত আঘাত করতে করতে বলল, “আমার চেন ফিরত দে আখি!”
এতটুকু জীবনে এতটা যন্ত্রণা সে কোনোদিন পায়নি। যে অন্যায় সে করেনি, তার শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছিল তাকে। তাও এতটা ভয়াবহ শাস্তি। নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না তার সামনে। ভাগ্য বারবার তার সঙ্গে অন্যায় করেছে। তার জীবনটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। সেই ভাগ্য যখন তাকে দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে দেখলো, কোনো কারণ ছাড়াই এই ভয়াবহ শাস্তি দিলো তাকে।
অরা যদি সত্যিই চেইনটা নিয়ে থাকতো, কিংবা জীবনে কোনোদিন সেই চেইনটা চুরি করার কথা মনেও আনতো – তাহলেও এই শাস্তি মাথা পেতে নিতো। কিন্তু না, সে তো স্বপ্নেও কোনোদিন এমনটা ভাবেনি। তবুও তাকে চোর ভাবা হলো। এর থেকে যন্ত্রণার আর কীই বা হতে পারে?
হায় রে আখি! জীবনে বিন্দুমাত্র আনন্দ পায়নি সে। আনন্দ যে কী জিনিস, তাই জানা ছিল না তার। নরকে বেড়ে ওঠা মেয়ে সে। অরা তো ভাবতো আখির জীবনের সঙ্গে তার জীবনের কোনো মিল নেই। আছে বটে। যে অপরাধ আখি করেনি, তা করার অপবাদে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। অরার ক্ষেত্রেও তাই। মিথ্যা অপবাদে শারীরিক অত্যাচার করা হয় আখিকে, আর অরাকে মানসিক।
দুপুরে আরশাদের সঙ্গে কথোপকথনের পর থেকে নিজেকে নিচতলার এই ঘরটাতে বন্দী করে রেখেছে অরা। এই ঘরটা বাড়ির গেস্টরুম। মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে অরা। একফোঁটাও হেলদোল নেই তার মাঝে। বেলা গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে, কতটা রাত হয়েছে তাও সে জানে না।
বড্ড অসহায় লাগছে আজ নিজেকে। বারবার মনে পড়ছে ওই দিনটার কথা। সেদিন নতুন মায়ের মার খেতে খেতে সে যেমন নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছিল, আজও তাই করছে। তার আগেই বোঝা উচিত ছিল, এতটা সুখ তো তার ভাগ্য সহ্য করতে পারবে না। আবারও তাকে টেনে হিঁচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে নরকে। জীবনটা রূপকথার গল্পের মতো হয়ে গিয়েছিল। আজ, এক নিমিষেই, অরার চোখের সামনে তা এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো।
আরশাদ, যে মানুষটা তার জীবনকে যাদুর মতো বদলে দিয়েছিল সেই মানুষটা আজ আরেকদফা বদলে দিলো জীবনকে। তবে এবার দুঃস্বপ্নের মতো। যে আরশাদ অরার চোখে জল সহ্য করতে পারে না, অরা অসাবধানতাবশত আঘাত পেলে সহ্য করতে পারে না – সেই একই মানুষ আজ অরাকে আঘাত করলো। অরার ভেতরে সৃষ্টি করলো এক তীব্র রক্তক্ষরণের, অরার হৃদয়টাকে কয়েক কোটি টুকরোয় ভেঙে ফেলল, নির্দ্বিধায়।
“ওই রাতে তোমার ঘরে কারোর আসার প্ল্যান ছিল। আমার স্পাই ক্যামেরা খুঁজে পাওয়ায় তুমি সতর্ক হয়ে যাও আর তোমার প্ল্যানটাও ভেস্তে যায়। সেজন্যেই এত রিয়্যাক্ট করছো, তাই না?”
কথাগুলো ভাঙা টেপরেকর্ডারের মতো অনবরত বেজেই যাচ্ছে অরার মাথায়। দুহাত দিয়ে নিজের চুলগুলো খামচে ধরলো অরা। তবুও মস্তিষ্কে এই কথাগুলোর বিচরণ বন্ধ করতে পারলো না।
উঠে বসলো অরা। এখনো তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অসহায়ের মতো আশেপাশে তাকালো অরা। এই ঘর, এই বাড়ি, আরশাদ – কোনোকিছুই কী তার হওয়ার কথা ছিল? না তো! তার বিয়েটা তো অঘটন ছাড়া আর কিছুই নয়। অঘটনেই অরাকে ভালোবাসতে শুরু করে আরশাদ। নিজের জীবনের সঙ্গে আজীবনের জন্যে জড়িয়ে ফেলে তাকে।
তবে কি সেই ভালোবাসা আজ ফুরিয়ে গেছে? আরশাদ কি এখন তবে ঘৃণা করে অরাকে? নির্ঘাত করে। মনে মনে তাকে নিয়ে ওরকম বাজে একটা চিন্তা পুষে রেখেছে যে। কিন্তু অরা তো কোনো দোষ করেনি। আরশাদ ছাড়া অন্য কারোর সঙ্গে…?
আর ভাবতে পারলো না অরা। দুহাতে মুখ লুকিয়ে অসহায়ের মতো কাঁদছে সে। কেন এলো আরশাদ তার জীবনে? কেন ভালোবাসতে গেল তাকে? সেই ভালোবাসার অবসান কেন এতটা তিক্ততার মধ্যে দিয়ে করলো সে? এতটা নিষ্ঠুর কী করে হতে পারলো আরশাদ?
এত বড় একটা অপবাদ দেওয়ার আগে একবারের জন্যে নিজেকে প্রশ্ন করলো না আরশাদ? সে তো অরাকে খুব ভালো করেই চেনে, তার তো ভাবার কথা নয় যে অরা এমন একটা কাজ করবে। কী করে এই পুরো ব্যাপারটা তার মাথায় এলো?
অরার ফোন বেজে উঠলো। এতসবের মাঝে ফোনটা আর হ্যান্ডব্যাগ থেকে বের করা হয়নি। শরীরে একবিন্দুও শক্তি পাচ্ছে না অরা। তবুও কোনমতে উঠে গিয়ে হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে আশফিয়ার নাম। অরা সঙ্গে সঙ্গে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকা অশ্রুগুলো মুছে ফেলল।
ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল আশফিয়ার চিরচেনা উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর, “হ্যালো অরা? আমি কথাকে নিয়ে আসছি। বাসায় আছো তো?”
অরা প্রাণপণ গলায় স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ আপা, আসুন।”
স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও অরা স্বাভাবিক নেই। নিঃশ্বাস নিতে এতটাই কষ্ট হচ্ছে, কেন মনে হচ্ছে কেউ তার গলা চেপে ধরে রেখেছে।
ফোন রেখে নিজেকে সামলাতে চলে গেল অরা। কেঁদেকেটে বিধ্বস্ত অবস্থা করেছে নিজের। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই চমকে উঠলো। তার অশ্রুর সঙ্গে কাজল মিশে গালের ওপর কালো দাগ বসে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। নিজেকে ফের পরিপাটি করতে গোসল ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
অরা গোসল করে বেরিয়ে আজ সারাদিন পর ঘরের বাইরে পা রাখলো। তার বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে ঘরের বাইরে পা রাখলে আবারও তাকে মুখোমুখি হতে হবে আরশাদের। আবারও মানসিক আঘাতে বিধ্বস্ত হতে হবে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! দিনশেষে যে আরশাদকে দেখার জন্যে তার মনটা ছটফট করে, আজ তারই সামনে পড়তে চাইছে না অরা। অসহনীয় হয়ে উঠেছে বাস্তবতা।
ডাইনিং হলের পৌঁছাতেই মারিয়াকে দেখতে পেলো অরা। মারিয়া এ বাড়ির সকল স্টাফদের প্রধান। আগে এই দায়িত্ব পালন করতো মতিউর। বয়স হয়ে গেছে বলে বছর খানেক হলো কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। মারিয়া তার জায়গাটা নিয়েছে, এবং ভালোভাবেই নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
এ বাড়ির সকল স্টাফরা সন্ধ্যার পর পর চলে যায়। সন্ধ্যারও পরও তাই মারিয়াকে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না অরা।
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “মারিয়া? তুমি বাড়ি যাওনি?”
মারিয়া মিষ্টি গলায় বলল, “স্যার তো দুপুরের পর পরই বেরিয়ে গেলেন। আপনিও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আপনাকে একা রেখে যাবো? তাই ভাবলাম আপনি উঠলে তারপরই যাবো।”
আরশাদ বাড়িতে নেই তাহলে? হাফ ছেড়ে বাঁচলো অরা। এই মুহূর্তে আরশাদের মুখোমুখি হওয়ার মতো মানসিক জোর তার নেই।
অরা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল, “থ্যাংক ইউ মারিয়া। আমি এখন একাই থাকতে পারবো।”
মারিয়া চলে যাওয়ার পরপরই আশফিয়া এলো কথাকে নিয়ে। মাত্র দুদিন হয়েছে, তবুও কথার এমন একটা ভাব যেন অরাকে দেখে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অরার গলা জড়িয়ে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে গল্প জুড়ে দিলো তার সঙ্গে।
অরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকতে। তার চিরচেনা ভঙ্গিতে আশফিয়া এবং কথার সামনে নিজেকে ধরা দিতে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। তার মস্তিষ্কে এখনো বেজে যাচ্ছে আরশাদের বলা ওই কথাগুলো। অচেনা এক ব্যাথায় জর্জরিত তার মন।
ব্যাপারটা বোধ হয় আশফিয়ার চোখে পড়লো। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “তুমি ঠিক আছো তো অরা?”
অরা কৃত্রিম হাসি হেসে জোর দিয়ে বলল, “হ্যাঁ আপা, আমি তো সবসময় ঠিকই থাকি।”
অরার হাসি আর দৃঢ়তা সন্দেহ দূর করলো না আশফিয়ার। সে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি সিওর?”
অরা আরও প্রশস্ত হাসি হেসে বলল, “হ্যাঁ আপা! অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি তো, তাই একটু খারাপ লাগছে।”
আশফিয়া চিন্তিত গলায় বলল, “দেখেছো! আমার ভাইটা আগেই বলেছিল যেও না। ওর কথা না শুনলে তো এমনটাই হবে।”
অরা আবারও হাসার চেষ্টা করলো। ঠিকই তো! না গেলেই বোধ হয় ভালো হতো। স্পাই ক্যামেরা, সন্দেহ – কোনোকিছুই সৃষ্টি হতো না তাহলে।
কিছুটা সময় গল্পগুজব করে তিনজন ডিনার করতে বসলো। অরা অবাক হয়ে লক্ষ করলো, সকলের নাস্তার পর থেকে সে কিছুই খায়নি। সে কিছু খায়নি এটা মুখ্য নয়, মুখ্য হলো বাবুও কিছু খায়নি। আরশাদের বলা ওই তিক্ত কথাগুলো শোনার পর নিজের ওপর তো ঘৃণা ধরেই গিয়েছিল। সেই ঘৃণা এখন আরও তীব্রতর হলো।
ডিনারের পরপরই বেরিয়ে গেল আশফিয়া। অরা কয়েকবার তাকে জোরাজুরি করলো থেকে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু আশফিয়া থাকলো না। তার ডিজাইনার হাউজে কাল সকালেই না-কি জরুরি একটা মিটিং আছে।
আশফিয়া চলে গেলে অরা কথাকে ঘুমের জন্যে প্রস্তুত করে দিলো। তার দাঁত ব্রাশ করে দিলো, চুল বেঁধে দিলো। কথা তো অনবরত গল্প করেই যাচ্ছে। অরা বারবার চেষ্টা করছে কথার গল্প মন দিতে, কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও।
রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। অথচ আরশাদের ফেরার নামগন্ধ নেই। শুটিং না থাকলে তো এত রাত অব্দি বাইরে থাকে না সে। অন্য সময় হলে উদ্বিগ্ন অরা ফোন করতো আরশাদকে। তবে আজ যেন, আরশাদকে ফোন করার অধিকারটুকু তার নেই।
কথার ঘরেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলো অরা। হঠাৎ শুনতে পেলো পাশের ঘরের দরজাটা ধাম করে লাগিয়ে দেওয়ার শব্দ। আরশাদ ফিরে এসেছে তার মানে? আবারও নিঃশ্বাস আটকে গেল অরার।
অরা এখন কী করবে? আরশাদের সঙ্গে ঘুমানো যায় না। আরশাদ হয়তো আর কখনোই তার সঙ্গে ঘুমাতে চাইবে না। একা একা গেস্ট রুমে ঘুমাবে? আজ মনের যে অবস্থা, তার ওপরে দুঃস্বপ্ন দেখার বাতিক। সাহস করে উঠতে পারলো না অরা।
কথার হাতদুটো ধরে তাকে কোমল গলায় বলল, “কথা?”
কথা তার ঘরের দেয়ালে ঝুলন্ত টিভির দিকে চোখদুটো আটকে রেখে বলল, “হুঁ?”
অরা কম্পিত স্বরে বলল, “আমি আজ তোর সাথে ঘুমাই?”
সঙ্গে সঙ্গে চওড়া এক হাসি ফুটে উঠলো কথার ঠোঁটে।
উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “সত্যি? অরা তুমি সত্যিই আমার সাথে ঘুমাবে?”
উচ্ছ্বাসে মিনিট দশেকের মধ্যেই অরার গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো কথা। জেগে রইলো অরা, মধ্যরাত অব্দি। আচ্ছা, সে এই পৃথিবীতে না এলে কি খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেত? যন্ত্রণা বাদে আর তো কিছু পায়নি সে এই পৃথিবী থেকে।
কথাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো অরা। শব্দ করে কাঁদলে তো মেয়েটার ঘুম ভেঙে যাবে। তার কান্নার সাক্ষী কেবল এই অন্ধকার ঘর। এই পৃথিবীর সবথেকে অসহায় মানুষটা বুঝি আজ অরাই।
(চলবে)
#ফিরে_আসা২
২৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
যে ঘটনা অরার ভেতরে তীব্র এক কালবৈশাখীর ঝড়ের সৃষ্টি করছে, তার মনটাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলছে, সেই একই ঘটনা যেন কোনো ছাপই ফেলতে পারেনি আরশাদের মাঝে। অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক সে। সকালে উঠে স্বাভাবিকভাবে কথাকে কোলে নিয়ে বাগানে ঘোরাফেরা করলো, নাস্তা করে শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিলো। সবকিছুর মাঝেও এড়িয়ে গেল অরাকে। যেন এ বাড়িতে অরার অস্তিত্ব তার চোখেই পড়ছে না।
সকাল থেকে কাজের ফাঁকে দুয়েকবার আরশাদের সামনে পড়েছে অরা। একবারও তার দিকে চোখ তুলে তাকালো না আরশাদ। অবশ্য তাকিয়েছে কিনা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। অরা নিজেই তো তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি তার দিকে। মনে হচ্ছিল যেন আরশাদের দিকে তাকানো বিশাল কষ্টের কাজ।
এক দিনের ব্যবধানে জীবনটা কেন এমন এলোমেলো হয়ে গেল? এমন নরকীয় জীবনে তো অরা অভ্যস্ত নয়। বিয়ের পর থেকেই রূপকথার জীবনে তাকে অভ্যস্ত করেছে আরশাদ। কোনোদিন যে দুজন ঝগড়া করে দুজনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, এমন পরিস্থিতি কল্পনাও করতে পারেনি অরা।
ঝগড়া তো সেবারও হলো তাদের মাঝে। অরা যখন আরশাদের অজান্তে কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গেছিল। আরশাদ তো সেবার পরদিনই নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে নিঃসংকোচে ক্ষমা চেয়েছিল অরার কাছে। ক্রমেই পাল্টে গেল সেই মানুষটা। মনের মধ্যে তীব্র এক মিথ্যা লালন করছে আরশাদ। সেই মিথ্যাটাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করছে।
আরশাদ কি আর কোনোদিনও অরার সঙ্গে কথা বলবে না? তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেই কাটিয়ে দেবে বাকিটা জীবন? একদিনেই দমবন্ধ লাগছে অরার। সহ্য হচ্ছে না আরশাদের অবহেলা। কিছুক্ষণ আগেই শুটিংয়ের জন্যে বেরিয়ে গেল আরশাদ। বিয়ের পর থেকে এই প্রথম তাকে না বলে, তার কপালে চুমু না খেয়ে শুটিংয়ে চলে গেল সে। যদি অবহেলাই করার ছিল, তবে এত এত ভালোবাসায় জীবনটাকে ভরিয়ে দিয়েছিল কেন?
কথার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে বসলো অরা। খাওয়ার ইচ্ছা তার একেবারেই নেই। তবুও খেতে হচ্ছে বাবুর জন্যে। আচ্ছা? বাবু পৃথিবীতে আসার পরও কি আরশাদ এমন অবহেলা করবে অরাকে? আরশাদ যদি বাবুকেও অবহেলা করে? বেশি কিছু আর ভাবতে পারলো না অরা। এমনিতেই কাল থেকে মনের ওপর প্রবল চাপ পড়ছে।
কথাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে এলো অরা। সে ভেবেছিল কয়েকটা দিন অফিস থেকে ছুটি নেবে। কাজ করার মতো মন-মানসিকতা এই মুহুর্তে তার নেই। শরীরের অসুখের জন্যে সিক লিভের ব্যবস্থা আছে। মনের অসুখ হলেও তো সেই লিভ নেওয়া যায়। শেষমেশ সেই পরিকল্পনা ছেড়ে অফিসে এলো সে। মনের এমনিতেই যে বিধ্বংসী অবস্থা, ঘরে অবরুদ্ধ থাকলে তো আরও খারাপ লাগবে। কাজের মাঝে ডুবে থাকলে হয়তো ভালো থাকবে অরা। যতক্ষণ কাজ নিয়ে ভাববে ততক্ষণ আরশাদের চিন্তা প্রবেশ করতে পারবে না তার মস্তিষ্কে।
গোটা অফিস আজ অরার প্রশংসায় ভাসছে। অরা যেভাবে আধঘন্টার মধ্যে অনশনরতদের অনশন ভেঙে শুটিং শুরু করার ব্যবস্থা করে দিলো, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। যেই আজ অরার সামনে পড়ছে, সেই অভিনন্দন জানাচ্ছে। প্রশংসায় খুব একটা বিগলিত বলে মনে হলো না অরাকে। নিজের কেবিনে গিয়ে কাজে মন দিলো সে।
পরপর তিনদিন অফিসে না আসায় একগাদা ফাইল জমে গেছে তার টেবিলে। একেক করে সবগুলো ফাইল চেক করলো অরা। যে ফাইলগুলোতে ভুল আছে সেগুলো সংশোধন করতে পাঠালো।
হঠাৎ বেজে উঠলো ডোরবেল। সিসিটিভি ফুটেজের দিকে একনজর তাকাতেই অরা দেখতে পেলো বাইরে দাড়িয়ে আছে রিয়াজ। রিয়াজ কে ফিল্মসের ফাইন্যান্স হেড।
অরা উঁচু গলায় বলল, “Come in!”
রিয়াজ নিঃশব্দে অরার কেবিনে প্রবেশ করলো। ফাইন্যান্স টিম আর প্রোডাকশন টিম – দুটোরই কাজ টাকা-পয়সাকে ঘিরে। তবে দুটো টিমের কাজের মাঝে বিস্তর পার্থক্য আছে। প্রোডাকশন টিম প্রত্যেকটা সিনেমার জন্যে আলাদা আলাদা বাজেট তৈরি করে। বাজেটের টাকা তাকে বেঁধে দেয় ফাইন্যান্স টিম। টাকা-পয়সা ছাড়াও অন্যান্য খাতে প্রোডাকশন টিমকে কাজ করতে হয়। এই যেমন সিনেমার লোকেশন, সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি। তবে ফাইন্যান্স টিমের কাজের ক্ষেত্র কেবলই টাকা-পয়সা।
ফাইন্যান্স টিমের কাজ কোন কোন সিনেমায় কত টাকা খরচ হবে, সিনেমার বাইরেও আলাদা কোথায় খরচ হবে – এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া। ফাইন্যান্স টিমের মূল উদ্দেশ্য বছর শেষে কে ফিল্মসকে একটি লভবান প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। রিয়াজ যেহেতু এই টিমের প্রধান, তাই তার দায়িত্বটাও বেশি।
রিয়াজ অরার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “Good Morning Mam.”
অরা স্বাভাবিক গলায় বলল, “Good Morning. বসুন রিয়াজ।”
রিয়াজ নিঃশব্দে বসতে বসতে বলল, “অন্যুয়াল মিটিং নিয়ে একটু কথা ছিল ম্যাম।”
কে ফিল্মসে প্রতি বছর, বছরের শেষের দিকে এই অ্যানুয়াল মিটিং হয়। বছরে কত টাকা খরচ হলো, কোথায় কোথায় টাকা খরচ হলো, কত লাভ হলো, এসব নিয়ে আলোচনা করা হয়। ফাইনাল রিপোর্ট এ সপ্তাহের প্রথম দিকেই তৈরি করেছে রিয়াজ এবং তার টিম। কালিয়াকৈরে যাওয়ার আগে সেই রিপোর্ট দেখে গেছে অরা।
এ বছর দুর্দান্ত ব্যবসা করেছে কে ফিল্মস। নিট লাভ ২৮.৮%। গত বছরের থেকে প্রায় ৫% বেশি। এই ফলাফলকে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয় অ্যানুয়াল মিটিংয়ে। ভবিষ্যতে কী করলে এই লাভের অংশ আরও বেড়ে দাঁড়াবে সেই নিয়েও আলোচনা করা হয়। অ্যানুয়াল মিটিংয়ে কে ফিল্মসের সকল টিমের প্রধানরা উপস্থিত থাকে। অরাকে তো থাকতেই হয়। তবে সবার ভয়ের কারণ হলো, এই মিটিংয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান আরশাদও উপস্থিত থাকে। একটু পান থেকে চুন খসলেই যার মেজাজ বিগড়ে যায়।
অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “একটা ডেট ফিক্সড করুন তাহলে! আপনাদের কোনো প্রিপারেশন নেওয়ার থাকলে সেটাও নিয়ে ফেলুন।”
“আমাদের প্রিপারেশন নেওয়া হয়ে গেছে ম্যাম। সকলেই মোটামুটি রেডি। আরশাদ স্যার কাল আমাদের সময় দিয়েছেন।”
অরা অবাক হয়ে বলল, “আগামীকাল?”
“জি ম্যাম।”
অরা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “এতটা বড় একটা মিটিংয়ের ডেট আমাকে না জিজ্ঞেস করেই ফিক্সড করে ফেলেছেন আপনারা?”
রিয়াজ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “না মানে ম্যাম, আপনিই তো বলেছিলেন আরশাদ স্যারের সুবিধামতো একটা ডেট ফিক্সড করতে।”
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। আরশাদের মুখোমুখি হওয়ার মতো মন- মানসিকতা এই মুহূর্তে তার নেই। অ্যানুয়াল মিটিংয়ে তো কোম্পানির সিইও আর চেয়ারম্যান কথা না বলে থাকতে পারে না। মিটিংটা কোনোভাবে পেছাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু কালকের পর নিজের ব্যস্ত শিডিউল থেকে আর কবে সময় বের করতে পারবে আরশাদ তার ঠিক নেই। মিটিংটা হওয়া কোম্পানির জন্যে জরুরি। নিজেদের মধ্যে হওয়া তিক্ততার প্রভাব কোম্পানির ওপর পড়তে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
রিয়াজ চলে যেতেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে ডেস্কে মাথা রাখলো অরা। হৃদয়ের জ্বালাপোড়া আবারও বাড়তে শুরু করেছে। যতক্ষণ কাজের মাঝে ছিল, আরশাদকে ভুলে ছিল ততক্ষণই ভালো ছিল অরা। আবারও আরশাদের কথা মনে পড়তেই যেন মনে হলো কেউ তার বুকের ওপর ভারী পাথর চেপে ধরে রেখেছে।
চোখদুটো বন্ধ করলো অরা। মুহূর্তেই তার সামনে ভেসে উঠলো আরশাদের মুখটা। তার গতকালের কথা বলার ধরণ। আরশাদের চোখদুটোর মধ্যে নিজের জন্যে তীব্র ঘৃণা দেখতে পাচ্ছিল অরা। যে মানুষটার ভালোবাসায় দিনভর তার ডুবে থাকা, তার ঘৃণা তো মোটেও সহনীয় অরা। অরার আক্ষেপ একটাই, সে তো ঘৃণা পাবার মতো কোনো কাজ করেনি। তবে কেন?
অসম্ভব দমবন্ধ লাগছে অরার। মনে হচ্ছে কেউ যেন তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। শ্বাস নিতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে থাকলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে সে। কী যেন মনে করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অরা। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। তার গন্তব্য ছাদ। এতটাই দমবন্ধ লাগছে যে ছাদে গিয়ে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া না পর্যন্ত গতি নেই।
ছাদে এসে দাঁড়াতেই কিছুটা হালকা অনুভব করলো অরা। বুকের ওপরের পাথরটা একটু একটু করে হালকা হতে শুরু করেছে। আবারও স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে অন্তরাত্মা। ছাদের রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকালো অরা। একঝাঁক পাখি ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা করার মতো মেয়ে অরা নয়। তবে আজ তার ভীষণ ইচ্ছা করছে পাখি হয়ে যেতে। কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়া, কোনো আঘাত ছাড়া যে কেবলই আনন্দ নিয়ে বিচরণ করে বেড়ায় আকাশজুড়ে।
“Good Morning Mam! আপনি এখানে?”
চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালো অরা। মাহমুদ হাসিখুশি ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন আসতে মানা আছে না-কি?”
মাহমুদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “না, না! কী যে বলেন ম্যাম। আসলে এই সময়টায় সবাই ব্যস্ত থাকে। ছাদটায় সারাদিন আমরা ক্রিয়েটিভ টিমের সদস্যরাই ঘুরে বেড়াই।”
মাহমুদের সঙ্গে এই মুহূর্তে কোনপ্রকার কথোপকথনে জড়াতে ইচ্ছা করছে না অরার। তবে মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে। মাহমুদ সর্বক্ষণ তার দুরন্তপনা দিয়ে সামনের মানুষটার মন ভালো করে দেওয়ার চেষ্টায় মেতে থাকে। মন ভালো তো আর হবে না, তবুও মনটাকে কিছুটা হলেও হালকা করার জন্যে কথোপকথনে জড়ালো তার সঙ্গে।
হালকা গলায় বলল, “তাই না-কি?”
“জি ম্যাম! অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের মতো আমাদের তো লাগাতার কাজ করতে হয় না। ক্রিয়েটিভ হওয়ার এই একটা মজা! আমাদের কাজে কোনো যান্ত্রিকতা নেই। তবে যাদের কাজে আছে, তারা আমাদের হিংসা করে।”
“সেটা কীভাবে?”
মাহমুদ আক্ষেপের সুরে বলল, “আপনি জানেন না ম্যাম? গোটা অফিস আমাদের আড়ালে ডাকে বেকার টিম! এটা কোনো কথা হলো বলুন?”
মাহমুদের কথা বলার ধরণ দেখে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল অরা। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতেই বলল, “তোমাকে দেখে আমার একজনের কথা মনে পড়ে যায় মাহমুদ।”
মাহমুদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কার কথা ম্যাম?”
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “মোবারক, আমার ভাই। সেও তোমার মতোই ছিল। দুরন্ত, ছটফটে। একবার কথা শুরু করলে তাকে থামানোর সাধ্য পৃথিবীর কারোরই ছিল না।”
নতুন মা তার নির্মম অত্যাচার দিয়ে অরার জীবনটাকে নরকে পরিণত করে ছেড়েছিল। নতুন মায়ের প্রতি তার মনে জন্মেছিল তীব্র ঘৃণা। তবে ছোট ছোট ওই নিষ্পাপ শিশুগুলো তো কোনো দোষ করেনি। অরা তার ভাইদের অসম্ভব ভালোবাসতো। আজও মনের ডায়েরিতে তাদের নাম ‘সৎ ভাই’ হিসেবে লেখা নেই। ওরা তো তার নিজেরই ভাই। ভাই-বোনের সম্পর্কে কোনো আপন-সৎ থাকে না।
মাহমুদ কৌতূহলী গলায় বলল, “বাহ্! তা এখন তিনি কোথায়?”
অরা ফ্যাকাশে গলায় বলল, “কী জানি! কত বছর হয়ে গেল ওদের দেখি না!”
আবারও দীর্ঘশ্বাসে ছেয়ে গেল অন্তরাত্মা। মাঝেমধ্যেই ভাইদের কথা মনে পড়ে অরার। ওরা নিশ্চয়ই এখন আর সেই আগের মতো ছোট্ট নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে। অরাকে কি এখনো মনে রেখেছে তারা? মনে রাখার কথা তো নয়। অরার ইচ্ছা করে, তাদের খুঁজে বের করতে। কিন্তু এত বড় একটা পৃথিবীতে খুঁজবে কী করে? তার কাছে না আছে তাদের ছবি, না আছে ঠিকানা। আছে শুধু নামগুলো।
অরাকে গম্ভীর ভঙ্গিতে চিন্তায় ডুবে যেতে দেখে মাহমুদ পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে বলল, “আমারও একটা বোন আছে ম্যাম।”
“তাই?”
মাহমুদ মজা করে বলল, “হুঁ। আমার থেকে আট বছরের ছোট, তবে এমন একটা ভাব করে যেন আমার বড় বোন। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেই জেরা করে। যদি টের পায় আমি মায়ের কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছি, তাহলেই হলো! নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে আমাকে।”
অরা ফিকে হাসি হেসে বলল, “আর কে কে আছে তোমার বাড়িতে?”
“আমার মা আর বোন।”
“আর বাবা?”
“বাবা দুবছর আগেও ছিলেন। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে একদিন চলে গেলেন।”
ছেলেটার কথাবার্তায় অবাক না হয়ে পারলো না অরা। মৃত্যুর মতো এত করুণ একটা ঘটনার বর্ণনা এমন হালকা গলায় কেউ কী করে করতে পারে?
অরা ব্যথিত গলায় বলল, “I’m sorry, আমি জানতাম না।”
মাহমুদ হাসিমুখেই বলল, “সরি বলবেন না ম্যাম, জানার তো কথাও নয়।”
কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেল।
নীরবতা ভঙ্গ করে মাহমুদ বাবার স্মৃতি রোমন্থন করে বলে উঠলো, “আমার বাবা ছিলেন নিউরোলজিস্ট। মানুষের মাথা নিয়ে ছিল তার করবার। আর সেই মানুষটাই কিনা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেলেন। আমার বাবা আমার ওপরে মোটেও খুশি ছিলেন না ম্যাম। আমার সারাটাদিন তখন কাটে লেখালিখি করতে করতে। নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখি, নিজের আনন্দের জন্য কবিতা লিখি। বাবা এসব একদমই পছন্দ করতেন না। ডক্টরের ছেলে দিনরাত লেখালিখি করছে, এই সত্যি তিনি মেনেই নিতে পারতেন না। শুধু বলতেন, লেখালিখি করে খাবি কী? আজ বাবা বেঁচে থাকলে বেশ ভালো হতো। তাকে দেখাতে পারতাম, লেখালিখির জন্যে আজ আমার এত বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে।”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “তাও তো তোমার একটা পরিবার আছে, You should be grateful.”
পরিবার বলতে কিছুই নেই অরার। যে মানুষগুলোর মাঝে সে বেড়ে উঠেছে, তারা তো কোনোদিন তাকে পরিবারের অংশই মনে করেনি। মনে করেছে কেবল বোঝা। জীবনে প্রলয়ংকারী এতগুলো দিন পাড় করে এসে অবশেষে যে মানুষটাকে অরা নিজের পরিবার মনে করতে শুরু করলো, সেই মানুষটাও কোনো কারণ ছাড়াই মুখ ফিরিয়ে নিলো তার ওপর থেকে। পরিবার না থাকার কষ্ট অরার থেকে ভালো করে আর কে-ই বা বুঝবে?
(চলবে)