ফিরে আসা ২ পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0
393

#ফিরে_আসা২
৫২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“আরশাদের সাথে তোমার কী?”

নিজের কণ্ঠস্বর নিজেই চিনতে পারলো না অরা। কালবৈশাখীর ভয়ংকরী ঝড় লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে তার ভেতরটা। বুকের ঠিক মাঝখানে কেউ যেন অনবরত হাতুড়ির আঘাত করে যাচ্ছে। হাত-পা রীতিমত থরথর করে কাঁপছে।

আরশাদের জ্যাকেটে সুজানার পারফিউমের গন্ধ অনেককিছুরই প্রমাণ দেয়। নিজেকে বারবার অরা বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে, সিনেমায় জড়িয়ে ধরার দৃশ্য ছিল হয়তো তাদের। সেকারণেই জ্যাকেটে লেপ্টে আছে ওই গন্ধ। তবে নিজের বুঝ কিছুতেই মানতে পারছে না অরা। অনলাইন পোর্টাল ওই নিউজগুলো আগে থেকেই তাকে উশকে দিয়েছিল, তার ওপরে আজ আবার যুক্ত হলো পারফিউমের গন্ধমাখা ওই কালো জ্যাকেট। অরার মন বলছে, আরশাদ আর সুজানার মধ্যকার সম্পর্কটা কেবলই প্রফেশনাল নয়। এর থেকেও ঢের বেশি কিছু।

দিশেহারা হয়ে পড়েছে অরা। কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে। তার উচিত ছিল আরশাদ ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। প্রশ্নটা তাকেই করা। তবে অরা যে একেবারেই নিশ্চিত, আরশাদ তাকে প্রতারণা করছে। যে মানুষ স্ত্রীকে প্রতারণা করতে পারে, তার কাছে সামান্য পারফিউম নিয়ে মিথ্যা বলা নিশ্চয়ই কঠিন কাজ হবে না। সত্যিটা জানার জন্যে অরা তাই ফোন করেছে সুজানাকে।

সুজানা অপরপ্রান্ত থেকে বিভ্রান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ আপু?”

অরা থেমে থেমে আবারও ওই একই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো সুজানার দিকে, “আরশাদের সাথে তোমার কী?”

সুজানা কম্পিত স্বরে বলল, “মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না আপু। আরশাদ ভাইয়ার সাথে আমার কী থাকবে?”

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। যা ঘটছে তা ক্রমেই ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে অরার ধৈর্যের বাঁধ।

চিরচেনা শান্ত-শিষ্ট রূপটা ঠেলে অরা গর্জন দিয়ে উঠে বলল, “কিছু যদি না-ই থাকে তাহলে ওর আরশাদের জ্যাকেটে তোমার পারফিউমের গন্ধ কী করে এলো?”

নীরবতা নেমে এলো কলের মাঝে। সুজানা অপরপ্রান্ত থেকে কিছুই বলছে না। অরা লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। তার চোখে বারবার জল এসে জমছে। কষ্টের অশ্রু নয়। রাগের অশ্রু, তেজের অশ্রু। যে অশ্রু চারপাশকে ধ্বংসের মুখোমুখী করার জন্যে যথেষ্ট। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে ফেলল অরা।

কঠিন স্বরে বলল, “কত দিন ধরে চলছে এসব?”

সুজানা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দুর্বল গলায় বলল, “আমি জানতাম কাজটা ঠিক হচ্ছে না। এটা পাপ। আমি উনাকে থেমে যেতেও বলেছিলাম। কিন্তু উনি কোনো কথাই শোনেননি। আমারও তখন মাথা ঠিক ছিল না।”

অরার হৃদয়টা যেন ধুকপুক করতে ভুলে গেল। সুজানা এই কথাটা বলার আগ পর্যন্ত মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল, যা হচ্ছে তা হয়তো কেবলই তার ভ্রম। ভুল বুঝছে সে আরশাদকে। কিন্তু না, তার একমাত্র আশার আলোটাও নিভে গেল। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পাথরের ন্যায় জমে গেল অরা।

ক্ষীণ স্বরে বলল, “মানে কী এসবের?”

সুজানা হয়তো নিঃশব্দে কাঁদছে। কান্নার কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না, তবে একটু পর পর টেনে টেনে শ্বাস নেওয়ার শব্দ ভেসে আসছে।

সুজানা আর্দ্র গলায় বলল, “অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে আপু। বিশ্বাস করো তোমাকে কষ্ট দেওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না। ভুলটা করার সময় মনে হয়নি ভুল। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কাজ করছি।”

অরা অস্থির কণ্ঠে বলল, “আরশাদ তোমার সাথে প্রেম করছে তাই না?”

“আপু তুমি একটু শান্ত হও।”

অরা হুমকির সুরে বলল, “আমাকে শান্ত করার দায়িত্ব তোমার নিতে হবে না। তুমি সত্যিটা বলো!”

সুজানা চুপ করে রইলো। যা সে বলতে যাচ্ছে, কোনোদিনও হয়তো ভাবেনি বলতে হবে অরাকে।

সুজানা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “অস্বীকার করবো না, শুরু থেকেই আমি আরশাদকে পছন্দ করি।”

আরশাদের প্রতি অন্য মেয়েদের আকর্ষণ কখনো বিন্দুমাত্র ঈর্ষার সৃষ্টি করতে পারেনি অরার মাঝে। একজন সুপারস্টারকে নিয়ে মেয়েরা তো পাগল থাকবেই। তবে আজ সুজানার মুখে এই কথাটা যেন অরার সমস্ত শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিলো।

সুজানা আবারও বলছে, “উনার গুড লুকস, কথা বলার ধরন, রাগ – সবকিছুতেই আকৃষ্ট ছিলাম। আমি জানতাম এটা ঠিক না, উনি বিবাহিত। তাও অনুভূতিগুলোকে প্রশয় দিয়েছি। ভেবেছি অনুভূতিগুলো তো একতরফা। উনি তো কোনোদিন জানতেই পারবে না। এমন অনেক মেয়েই তো আছে যারা প্রতিনিয়ত তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, আমার প্রতি উনারও ওই একই অনুভূতিগুলো জন্মাবে।”

চুপ করে রইলো অরা। হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তার মনের মাঝে। প্রশ্নগুলো দমিয়ে রেখে চুপ করে বসে রইলো সে। মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনছে সুজানার কথাগুলো।

সুজানা অপরাধীর ন্যায় বলল, “শুরু থেকেই আরশাদ শুটিং সেটে আমাকে একটু বেশিই প্রায়োরিটি দেয়। আমাকে প্রত্যেকটা সিন বুঝিয়ে দেওয়া, কোন সিনে কেমন অভিনয় করতে হবে শিখিয়ে দেওয়া – সবটা খুব যত্নের সাথে করে সে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোঅ্যাক্টর হিসেবে সবার সাথেই এমনটা করে। কিন্তু একটা পর্যায়ে বুঝলাম, এই বাড়তি যত্ন শুধু আমার জন্য। একটা মেয়ে তো ছেলেদের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে কোন ছেলেটা তাকে পছন্দ করে। আমিও বুঝতে পারছিলাম।”

অরার মনটা অবশ হয়ে আসছে। কোনোকিছুই সে আর অনুভব করতে পারছে না। আরশাদ এই মেয়েটা পছন্দ করতো? যে আরশাদ তাকে ভালোবাসার চাদরে সারাক্ষণ মুড়িয়ে রাখে, সেই আরশাদ?

সুজানা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “প্রশয় দিয়েছি। উনার ভালোলাগাটা উপভোগ করতে শুরু করি। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করার ছলে তার সাথে আরও বেশি সময় কাটাতে শুরু করি।”

অরা শীতল কণ্ঠে বলল, “কবে থেকে?”

“নারায়ণগঞ্জে শুটিংয়ের সময় থেকে।”

নারায়ণগঞ্জে শুটিং হয়েছে প্রায় একমাস আগে। এক মাস ধরে এসব চলছে তাহলে? নিজেকে অসম্ভবভাবে প্রতারিত বলে মনে হচ্ছে অরার। এদিকে সে প্রেগন্যান্সির শেষ পর্যায়ে এসে ক্লান্তিতে বিছানায় পড়ে আছে, আর ওদিকে আরশাদ আরেকটা মেয়ের প্রতি তার ভালোলাগা প্রশয় দিয়ে বেড়াচ্ছে? এতটা নিষ্ঠুর সে?

“আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা ভালোলাগা পর্যন্তই সীমাবন্ধ থাকবে। আরশাদকে তো ফ্যামিলি ম্যান হিসেবেই চিনি, ভাবিনি এর থেকে বেশি তিনি এগোবেন। কিন্তু…”

অরা অস্থির কণ্ঠে বলল, “কিন্তু কী?”

“কাল রাতে শুটিং শেষে আমি কোনো উবার পাচ্ছিলাম না, ইউনিটের গাড়িও ছিল না। বাধ্য হয়ে আরশাদের কাছে লিফট চাই, সে রাজিও হয়ে যায়। গাড়িতে ড্রাইভার ছিল না। উনিই ড্রাইভ করছিলেন। গাড়িতে আমরা যথারীতি গল্প করছি। হঠাৎ মাঝরাস্তায় উনি গাড়ি থামিয়ে দিলেন।”

সুজানা থেমে গেল। আর কিছুই বলছে না সে। এদিকে অরার মন কৌতুহলে উসখুশ করছে। যথেষ্ট বুদ্ধিমান মেয়ে অরা। একটা ছেলে কেন মাঝরাস্তায় গাড়ি থামাতে পারে, খুব ভালো করেই জানে সে। তবুও নিজের জানাকে মানতে চাইছে না। হয়তো পছন্দ করেছে সুজানাকে, প্রেমের সূচনাও হয়তো করেছে। কিন্তু যে আরশাদকে সে এতকাল ধরে চিনে আসছে, সে এতটা খারাপ হতে পারে না। অরা মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছে, সে যা ভাবছে তা যেন সত্যি না হয়।

অরা ব্যাকুল হয়ে বলল, “তারপর?”

সুজানা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “আপু আমি আর বলতে পারবো না।”

অরা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “বলো তুমি! তারপর কী হয়েছে?”

অরার ঝাঁঝালো কণ্ঠে রীতিমত দমে গেল সুজানা। যা ঘটেছে, তার বর্ণনা করার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করলো কয়েক মুহূর্ত ধরে।

অবশেষে মুখ খুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আরশাদ হুট করে আমার… ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসে।”

থ হয়ে বসে রইলো অরা। তার পুরো দুনিয়াটা চক্কর দিয়ে উঠলো। আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা দেখছে অরা। হ্যাঁ, এমনটা আরশাদের কাজ। মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে হুটহাট সে চুমু খায়। তবে অরা জানতো এই নিয়মটা কেবল তার বেলায় প্রযোজ্য।

আরশাদের এই হুটহাট চুমু খাওয়াকে এতকাল পৃথিবীর পবিত্রতম কাজ বলে মনে হতো অরার। তবে আজ বুঝতে পারছে, এর থেকে নিকৃষ্ট কাজ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।

সুজানা অনুতপ্ত স্বরে বলল, “শুরু থেকেই উনাকে চাই তো। একফোঁটাও বাঁধা দিতে পারিনি। ভেসে যাচ্ছিলাম কোথায় যেন। আরশাদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আমার ফ্ল্যাটে যাওয়া যাবে কিনা। আমি একাই থাকি, তাই কোনো সমস্যা ছিল না। ঝোঁকের মাথায় সায় দিই। নিয়ে যাই উনাকে আমার ফ্ল্যাটে।”

আরেকদফা অস্থিরতার হাওয়া বলে গেল অরার গা বেয়ে। আরশাদ হক এতটা খারাপ? এতটা চরিত্রহীন? নিজের ওপরে নিজেরই রাগ হচ্ছে অরার। পৃথিবীতে কারো কোনো দোষ নেই। সব দোষ তার। সেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে আরশাদকে। ভেবেছিল সে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায় না আরশাদ।

সুজানা বলল, “তখন টনক নড়ে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আরশাদকে বলেছিলাম, কানে নেয়নি। নিজের মধ্যে ছিল না সে।”

চুপ করে রইলো অরা। কতটা সময় এভাবেই ফোন কানে নিয়ে বসে রইলো সে নিজেও জানে না। এটাই হওয়ার ছিল। ভাগ্য তার সঙ্গে চিরকাল ঠাট্টা করে এসেছে। অরা অবাক হয়ে ভেবেছিল, দ্বিতীয় জীবনটা এত সুখময় হয়ে উঠলো কী করে? আজ বুঝতে পারছে, এই জীবনে সুখটা আসল ছিল না কখনোই।

অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “সুজানা? তুমি সত্যি বলছো তো?”

সুজানা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “অবিশ্বাস করতেই পারো আপু। ভাবতেই পারো সুপারস্টার আরশাদ হককে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা বলছি। কিন্তু আপু, তুমি তো একটা মেয়ে। তুমি নিশ্চয়ই বোঝো, একটা মেয়ে নিজের সম্পর্কে এত বড় মিথ্যা বলতে পারে না। এই ঘটনা জানাজানি হলে আমারই বদনাম হবে। মানুষ আমাকে চরিত্রহীন বলবে। অথচ আরশাদের স্টারডমে বিন্দুমাত্র আঁচ লাগবে না।”

অরা চুপ করে রইলো। বুকের ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন নেভার নামই নিচ্ছে না। হয়তো এ জীবনে কোনদিন নিভবেও না। আজীবন আগুনটা বুকের ভেতরে করে বয়ে বেড়াতে হবে তাকে।

“দোষ আমার ছিল আমি অস্বীকার করছি না। তবে দোষ আরশাদের ছিল। প্রমাণ রেখে দিয়েছি আমি। তুমি চাইলে দেখতে পারো।”

“কী প্রমাণ?”

“পাঠাচ্ছি।”

কল কেটে যেতেই উদগ্রীব হয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে রইলো অরা। মিনিট কয়েকের মাঝেই সুজানার নম্বর থেকে কয়েকটা ছবি এলো তার হোয়াটসঅ্যাপে।

ছবিগুলো দেখে অরার আত্মা কেঁপে উঠলো। চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠলো। দুটো মানুষের হাস্যোজ্জ্বল অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি। কারও মুখই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবে ছবির মানুষদুটো যে আরশাদ আর সুজানা তা বুঝতে তার বাকি রইলো না।

ভালোবেসেছিল অরা ওই মানুষটাকে। নিজের চাইতেই বেশি। ভালোবাসার মানুষকে পরনারীর গায়ে ঢলে পড়তে দেখার দৃশ্য কটা মেয়ে সহ্য করতে পারে? অরাও পারলো না।
হাত থেকে মোবাইলটা আছড়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল।

দুহাতে মাথার দুপাশ চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে অরা। কার সঙ্গে সংসার করছে সে এত দিন ধরে? তবে কি আরশাদের পুরোটাই ছিল অভিনয়?

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৫৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আরশাদ অফিসে পা রাখার পাঁচ মিনিটের মাথায় বাজেট সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। রিয়াজ আর পরিচালক ফয়সাল দীর্ঘ তিন দিনের বিবাদ ভুলে হয়ে গেল আজন্মের ভাই। অরার বেঁধে দেওয়া বাজেটেই সাইন করে দিলো আরশাদ।

নিজের কেবিনে বসে আরও কয়েকটা জরুরি ফাইল চেক করছে আরশাদ। হঠাৎ বেজে উঠলো ডোরবেল। আরশাদ টিভিতে ভেসে ওঠা সিসিটিভি ফুটেজে দেখলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পিআর টিমের প্রধান খালেদ। এই ছেলেটাকে কিছুদিন আগে ফোনে বেশ ধমকাধমকি করেছিল আরশাদ। অনলাইন পোর্টালগুলোতে তাকে এবং সুজানাকে নিয়ে নিউজ হচ্ছে – সেই নিউজ সামলাতে ব্যর্থ খালেদ। উল্টো বলেছিল, এতেই না-কি সিনেমারই প্রচার বাড়বে। সেদিনের ধমকের রেশ এখনো লেগে আছে খালেদের মাঝে। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “Come in.”

খালেদ ছোট ছোট পা ফেলে প্রবেশ করলো কেবিনে। আরশাদের ডেস্কের সামনে এসে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “Good evening sir”

আরশাদ ফাইলের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “Good evening, বসো খালেদ।”

খালেদ নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কোনো একটা বিষয় তার মাঝে একরাশ ভয়ের সৃষ্টি করেছে। যে কথাটা আরশাদকে সে বলতে এসেছে, সেটা বলার জন্যে মনে মনে সাহস সঞ্চয় করেছে।

অবশেষে সাহস সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়ে খালেদ ইতস্তত করে বলল, “একটা কথা ছিল স্যার।”

আরশাদ গলায় গাম্ভীর্যের ভাবটা ধরে রেখে বলল, “হুঁ।”

“ওই নিউজ পোর্টালগুলো এখন আমাদের কন্ট্রোলে।”

আরশাদকে দেখে খুব একটা খুশি বলে মনে হলো না। যেন এটা হওয়ারই ছিল।

স্বাভাবিক গলায় বলল, “Good.”

খালেদ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু স্যার, আরেকটা সমস্যা হয়ে গেছে।”

আরশাদ ক্ষীণ বিরক্তি নিয়ে বলল, “আবার কী?”

“স্যার সিনেব্লাস্ট আবারও আমাদের পেছনে উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের সিইও প্রেস কনফারেন্সে বলেছে, আমাদের এখানে না-কি অনেক অনিয়ম হয়। আমরা ক্যামেরার পেছনের মানুষদের ন্যায্য টাকা দিই না। বড় বড় টিভি-মিডিয়া এটা নিয়ে নিউজ করছে। ফেসবুকেও মানুষ লেখালিখি করছে।”

বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। সিনেব্লাস্ট মিডিয়া, এ দেশের এক সময়কার শীর্ষ প্রোডাকশন হাউজ। তাদের প্রযোজিত প্রত্যেকটা সিনেমাই বক্স অফিসে ঝড় তুলতো। ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় সেলিব্রিটিরা সব তাদের ব্যানারের সিনেমায় অভিনয় করার জন্যেই মুখিয়ে থাকতো।

সিনেব্লাস্টের মালিক শাফকাত আলম, আরশাদের সঙ্গে একসময় তার দৃঢ় বন্ধুত্ব ছিল। আরশাদ এবং নওশীনের একসঙ্গে অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘আয়না’ প্রযোজনা করে সিনেব্লাস্ট। ‘আয়না’ দিয়ে আরশাদ এবং শাফকাত দুজনেই সমানভাবে লাভবান হয়। আরশাদের খ্যাতি হয়ে যায় আকাশচুম্বী, আর শাফকাতের আয়ের খাতাও হয়ে ওঠে ভারী।

বছরে অন্তত একটা সিনেমা তো আরশাদ করতোই সিনেব্লাস্টের সঙ্গে। কখনো কখনো আবারও দুটোও। সব ঠিকই চলছিল, তবে একদিন শাফকাত হঠাৎ আরশাদকে ফোন করে বলে একটা সিনেমায় তাকে সাইন করতেই হবে।

সিনেমাটা বাংলাদেশ এবং আরেকটি দেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হবে। বিদেশের প্রযোজককে শাফকাত কথা দিয়ে এসেছে, এই সিনেমার মুখ্য চরিত্রে সুপারস্টার আরশাদ হকই থাকবে। শাফকাতের ওপর অগাধ বিশ্বাস থেকেই আরশাদ স্ক্রিপ্ট না পড়েই একদিনের মাথায় ওই সিনেমায় সাইন করে ফেলে।

কিন্তু সবটা বদলে যায়, যখন ওই সিনেমার স্ক্রিপ্ট পড়ে আরশাদ। বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেই স্ক্রিপ্টে, ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। যে ভক্তকূল আরশাদকে উচ্চতার শিখরে পৌঁছে দিয়েছে, তাদের কাছে ভুল তথ্য উপস্থাপন করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।

কথাটা শাফকাতকে বলতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে সে। কারও জ্বলে ওঠার ধার আরশাদ ধারে না। ওই সিনেমার চুক্তি বাতিল করে ফেলে সে। শাফকাতের ওপর ওই বিদেশি প্রযোজক অখুশি হয়ে সিনেমাটাই বাতিল করে দেয়। এ নিয়ে শুরু হয় দুজনের মধ্যে তিক্ততা।

আরশাদের ওপর শাফকাতের ক্ষোভের আরও একটা কারণ কে ফিল্মস। যে জায়গায় গত দশ বছর ধরে সিনেব্লাস্ট একাই রাজত্ব করছিল, সে জায়গাটা মাত্র তিন বছরেই দখল করে নেয় কে ফিল্মস। হয়ে দাঁড়ায় দেশের শীর্ষ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান।

কে ফিল্মসকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামানোর জন্যেই কিছুদিন পর পরই সিনেব্লাস্ট অহেতুক সব মন্তব্য করে মিডিয়ার কাছে।

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “ওদের সিইও বললেই কি সব সত্যি হয়ে যাবে না-কি? যা ইচ্ছা বলুক, এদের নিয়ে আমরা কিছুই বলবো না। এসব ছোট ছোট ব্যাপারে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।”

খালেদ বিদায় নিয়ে চলে গেল। সবগুলো ফাইল চেক করা শেষ করতে আরও আধ ঘন্টার মতো সময় লাগলো আরশাদের। অবশেষে মনে হলো, ফোন দিয়ে একবার অরার খোঁজ নেবে। অরার নম্বরে ফোন করলো আরশাদ, কিন্তু রিং হচ্ছে না। অদ্ভুত ব্যাপার! অরা কখনো তো তার ফোন বন্ধ করে রাখে না।

চিন্তিত ভঙ্গিতে আরশাদ ফোন করলো বাড়ির স্টাফদের প্রধান মারিয়াকে। মারিয়া আশ্বস্ত করলো, অরা ঘরেই আছে। আরশাদ কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। হয়তো চার্জ ফুরিয়ে গেছে, উঠে গিয়ে মোবাইলটা চার্জে দিতেও মেয়েটার আলসেমি লাগছে। হালকা মেজাজে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো আরশাদ। এখনো সে জানে না, বাড়িতে এক প্রলয়ংকারী ঝড় অপেক্ষা করছে তার জন্যে। যে ঝড় তাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।

বাড়িতে পা রাখতেই, বসার ঘরে কোথাও অরাকে দেখতে পেলো না। নিচতলার যে ঘরে আজ তারা শিফট করেছে, সে ঘরের দিকেই পা বাড়ালো আরশাদ। দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই দেখলো, পাথরের ন্যায় জমে সোফার ওপরে বসে আছে অরা। বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই তার মধ্যে। মনে হচ্ছে যেন এখানে বসে থেকেই ভিন্ন জগতে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে অরা। তার দৃষ্টি মেঝের ওপর আবদ্ধ।

আরশাদ ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলল, “অরা? কী ব্যাপার তোমার ফোন বন্ধ কেন?”

কোনো উত্তর নেই। অরার এক ধ্যানে মেঝের দিকেই তাকিয়ে আছে। আরশাদ একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে যেতেই চমকে উঠলো। অরার চোখদুটো রীতিমত রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে। এলোমেলো চুলগুলো কপালের ওপর পড়ে আছে।

আরশাদ অরার কাঁধে হাত রেখে বলল, “এখনো চেঞ্জ না করে বসে আছো?”

তড়িৎ গতিতে আরশাদের হাতটা সরিয়ে ফেলল অরা। ভয়ঙ্কর তেজ কাজ করছে তার মধ্যে। আরেকদফা চমকে উঠলো আরশাদ। এমন করছে কেন মেয়েটা?

অরা শীতল গলায় বলল, “আমাকে ছোঁয়ার দুঃসাহস আর কখনোই করবে না আরশাদ। সেই অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলেছো।”

আরশাদ বিস্মিত গলায় বলল, “কী?”

অরার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। তার রক্তিম চোখদুটো বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। সেই জল না মুছেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উঠলো অরা। মেয়েটার হাসি চিরকালই মোহনীয় বলে মনে হয় আরশাদের কাছে। তবে আজ মনে হচ্ছে এই হাসির থেকে ভয়ঙ্কর এ পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।

হাসতে হাসতেই অরা আক্ষেপের সুরে বলল,
“কত বড় বোকা না আমি? তোমাকে পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষ বলে মনে করতাম। মনে করতাম তোমার থেকে ভালো মানুষ এই পৃথিবী আর একটাও নেই।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। নির্ঘাত আবারও মুড সুইং করছে অরার। মুড সুইংটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো অরা পরিবর্তিত এই আবেগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

আরশাদ আলতো স্পর্শে অরার গালে একটা হাত রেখে বলল, “কী হয়েছে? দেরি করে এসেছি বলে রাগ করেছো?”

আবারও বিদ্যুতের গতিতে গালের ওপর থেকে আরশাদের হাতটা সরিয়ে ফেলল অরা। গর্জন দিয়ে উঠে বলল, “Don’t you dare to touch me!”

আরশাদের বিস্ময়ের কোনো অন্ত নেই। অরাকে তার থেকে ভালো করে কেউ চেনে না। মেয়েটা রেগে গেলেও নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে আজ কেন এমন বেসামাল আচরণ করছে? চেনা অরা নিমিষেই অচেনা হয়ে উঠলো আরশাদের কাছে।

আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী হয়েছে বলবে তো অরা! না বললে আমি বুঝবো কীভাবে?”

অরা থমথমে ভঙ্গিতে বলল, “তুমি খুব ভালো করেই জানো কী হয়েছে।”

“না আমি জানি না। কী হয়েছে?”

আরশাদের চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরা। এই দৃষ্টি একটুও ভালো লাগছে না আরশাদের। রাগ-ঘৃণা-হতাশা-অবিশ্বাস মাখা এক দৃষ্টি।

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমার ভাগ্যটা এত খারাপ কেন বলতে পারো? একটা মানুষের ভাগ্য এত খারাপও হতে পারে? আমি ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ের পর থেকে আমার জীবনটা রূপকথার মতো বদলে গেছে। কিন্তু না! আমার জীবনটা চিরকালই দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। এখনো তাই আছে।”

আরশাদ বেশ বুঝতে পারছে গুরুতর কোনো ঝামেলা বেঁধেছে। সে ঝামেলার সমাধান যে খুব সহজে হবে না সেটাও বুঝতে পারছে।

তবুও বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
“অরা, প্লিজ বলো কী হয়েছে। কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে বলো। তুমি না বললে তো আমি সমাধান করতে পারছি না।”

অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “যা তুমি করেছো, তার কোনো সমাধান নেই।”

“কী করেছি আমি?”

“জানো না, তাই না?”

আরশাদ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরার দিকে। কী এমন করেছে সে যার জন্যে এতটা রেগে আছে মেয়েটা?

আরশাদ ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “সুপারস্টার আরশাদ হক, এত ভালো অভিনয় কী করে করো তুমি? ক্যামেরার সামনে অভিনয় করতে করতে অভ্যাস হয়ে গেছে তাই না? ক্যামেরার বাইরেও সারাক্ষণ অভিনয় করতে হবে? কী সুন্দর অভিনয় তোমার! এই অভিনয় দেখে আমি নিজেই ধাঁধায় পড়ে যাই। কতদিন ধরে আমার সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছো বলো তো?”

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছে আরশাদ। কী বলবে নিজেই বুঝতে পারছে না।

অরা ঘৃণার সঙ্গে বলল, “তুমি না-কি ট্রমাটাইজ আরশাদ! তোমার এক সময়কার ভালোবাসার মানুষ তোমার ওপরে চিট করেছে বলে এত বছরেও না-কি ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারোনি। ট্রমাটা কি আসল না-কি এটাও অভিনয়?”

আরশাদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ভ্রু কুঁচকে বলল, “কীসের অভিনয়? অরা তুমি খুব ভালো করেই এই ব্যাপারটা আমার জন্য কতটা সেনসেটিভ।”

অরা তেজী স্বরে বলে উঠলো, “অন্য কেউ তোমার সঙ্গে প্রতারণা করলে সেটা তোমার জন্যে সেনসেটিভ। আর প্রতারণাটা যখন তুমি নিজেই করো? আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, নওশীন কি আসলেই চরিত্রহীন ছিল? না-কি নিজের দোষ ঢাকার জন্যে সবার কাছে ওকে চরিত্রহীন বানিয়ে রেখেছো তুমি?”

আরশাদ ধৈর্যহারা হয়ে ধমকের সুরে বলল, “Enough Aura! কী যা-তা বলছো তখন থেকে?”

অরা তার ধমকে বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি তো যা-তাই বলছি। কিন্তু সত্যি কখনো চাপা থাকে না। ওই মেয়েটা আমাকে সব সত্যি বলে দিয়েছে। সব!”

“কোন মেয়ে?”

“যে মেয়ের ফ্ল্যাটে কাল রাতে তুমি ছিলে?”

আরশাদের পুরো পৃথিবীটা ঘুরে উঠলো। পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে একটু একটু করে।

আরশাদ অবিশ্বাস নিয়ে বলল, “What rubbish! মাথা ঠিক আছে তোমার?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অরা মেকি প্রশংসার সুরে বলল, “বাহ্ আরশাদ! শুনেছি দুশ্চরিত্র পুরুষ নিজের কুকীর্তি ঢাকার জন্যে সমাজের সামনে স্ত্রীকে পাগল বানিয়ে রাখে। তুমিও দেখি তার ব্যতিক্রম নও।”

লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো আরশাদ। কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে। যা হচ্ছে, খুবই খারাপ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিটা শক্ত হাতে সামাল দিতে হবে।

আরশাদ নিজেকে শান্ত করে বলল, “অরা কোথাও খুব বড় একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।”

“তাই না?”

সোফার শেষ প্রান্ত থেকে ওই জ্যাকেটটা তুলে অরা আরশাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার জ্যাকেটে ওই মেয়েটার গায়ের গন্ধ তো সেটা বলে না!”

জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো আরশাদ। সুজানা! সুজানাই তাহলে বিগড়ে দিয়েছে অরাকে?

আরশাদ ঠান্ডা মাথায় বলল, “অরা আমি জানি না সুজানার পারফিউমের গন্ধ এই জ্যাকেটে কীভাবে এসেছে। হয়তো শুটিংয়ের সময়…”

আরশাদকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “প্লিজ আরশাদ! অজুহাত দেওয়াটা বন্ধ করো। সুজানা সব সত্যি বলে দিয়েছে আমাকে। আমি নিজ চোখে দেখেছি সব।”

আরশাদ কৌতুহল নিয়ে বলল, “কী দেখেছো তুমি?”

অরা একরাশ ঘৃণায় চোখমুখ বিকৃত করে বলল, “কী দেখেছি জানতে চাও? তোমাকে আর সুজানাকে একই বিছানায়…”

আরশাদ এক ধমকে অরাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “Shut up! বাজে কথার একটা লিমিট আছে!”

অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“খুব গায়ে লাগছে তাই না? সত্যি কথা গায়ে তো লাগবেই! বিশ্বাস হচ্ছে না সুজানা যে আমাকে সব বলে দিয়েছে তাই না? দাঁড়াও, নিজের চোখের দেখবে!”

পায়ের কাছ থেকে মোবাইলটা তুলল অরা। আছাড় মেরে ফেলে দেওয়ার কারণে স্ক্রিন ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। তাও কতক্ষণ ওই ছবিগুলো বের করার বৃথা চেষ্টা করলো অরা।

অবশেষে ব্যর্থ হয়ে আক্ষেপ নিয়ে বলল, “ধুর!”

বারবার নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে আরশাদ। বিশ্বাস হচ্ছে না, তার জীবনে এটা হচ্ছে। এমন বিশ্রী পরিস্থিতির মুখোমুখি তাকে হতে হচ্ছে। আরশাদ লম্বা শ্বাস নিয়ে বসে পড়লো অরার সামনে, মেঝেতে।

অরাকে ভরসা দেওয়ার ভঙ্গিতে আরশাদ বলল, “অরা শোনো, আমি জানি না ওই মেয়ে তোমাকে কী বলেছে বা কী দেখিয়েছে। কিন্তু এটা জানি ও মিথ্যা বলছে। কাল রাতে আমি শুধুই ওকে লিফট দিই। That’s it!”

অরা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে বিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ আমার কাছে নেই। নিজের চোখে যা দেখেছি তা অবিশ্বাস করি কী করে?”

অরার চোখেমুখে তীব্র ঘৃণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে মেয়েটার ভালোবাসা আরশাদের বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ, তার ঘৃণা কী করে সহ্য করবে সে? এটাই কি আরশাদের প্রাপ্য ছিল?

অরা আক্ষেপের সুরে বলল, “ভালোবেসেছিলাম তোমাকে। নিজের থেকেও বেশি। কিন্তু তোমার কাছে তো ভালোবাসার কোনো মূল্যই নেই।”

আরশাদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “ভালবেসেছো না? তাহলে একটু বিশ্বাস রাখো। আমি সব ঠিক করে ফেলবো।”

অরা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “কী ঠিক করবে তুমি? ওই মেয়েটাকে গিয়ে থ্রেট দিবে? ওকে বাধ্য করবে, যেন আমাকে বলে যা বলেছে সব মিথ্যা?”

আরশাদ নিজেও জানে না কী করবে সে? কী করলে এই মুক্তি মিলবে এই মহা প্রলয় থেকে?

অরা বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল, “ছি আরশাদ! এতটা নিকৃষ্ট তুমি? এতটা চরিত্রহীন? সাধারণ চিটারদের থেকেও নিকৃষ্ট তুমি। কারণ তুমি তখন আমার ওপর চিট করেছো যখন তোমার বাচ্চা আমার পেটে!”

আরশাদ কী জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না। অরার একেকটা শব্দ ধারালো বর্শার মতো এসে আছড়ে পড়েছে তার বুকে। একটু একটু করে আঘাত করে রক্তাক্ত করে তুলছে তার হৃদয়টাকে।

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে তেজদীপ্ত স্বরে বলে উঠলো, “আমি থাকবো না তোমার সাথে।”

আরশাদ অরার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ভয় লাগা কণ্ঠে বলল, “মানে কী?”

“সম্ভব না। তোমার মতো চরিত্রহীন একটা মানুষের সাথে আর এক সেকেন্ডও থাকা সম্ভব না।”

আরশাদের মনটা এবার দিশেহারা হয়ে উঠেছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না সে।

অরা হুমকির সুরে বলল, “খবরদার তুমি আমার বাচ্চার মুখ দেখবে না। তোমার ছায়াও ওর ওপরে পড়তে দেবো না আমি। ওর জন্মের পর তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো ওকে নিয়ে।”

আরশাদের হৃদস্পন্দন থেমে গেল। এই পৃথিবীতে কোনোকিছুকেই ভয় করে না সে। একটা মাত্র ভয় তার। এখন কি সেই ভয়টাই সত্যি হতে চলেছে?

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৫৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

এ জগতে প্রত্যেকটা মানুষেরই নির্দিষ্ট একটা আশ্রয়স্থল থাকে। বাইরে হাজারো ঝড়-ঝঞ্ঝাট বয়ে যাক না কেন, সেই আশ্রয়স্থলটা মানুষকে পরম মমতায় তাকে আগলে রাখে। সকল বিপদের হাত থেকে দৃঢ়ভাবে যে রক্ষা করে। ইট-পাথরের দালান মানুষকে আশ্রয় দেয় ঠিকই, তবে প্রকৃত আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে না। সেই দায়িত্ব নিতে হয় আরেকটা মানুষকেই।

আরশাদের জীবনের একমাত্র আশ্রয়স্থল অরা। যাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কল্পনা করাটাও যে কত কঠিন, এখন সে টের পাচ্ছে। চিরকালই আরশাদের তীব্র ভয়, অরা তার কাছ থেকে বহু দূরে চলে যাবে। কোনো এক অদৃশ্য কালো শক্তি আলাদা করে দেবে তাদের দুজনকে। হারিয়ে ফেলার ভয়েই বেশি বেশি করে তার ভালোবাসা। সেই ভয়টা যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে, কখনো ভাবেনি আরশাদ। অসম্ভব অসহায় লাগছে নিজেকে, সেই সঙ্গে দিশেহারা। এই দিনটার মুখোমুখি হওয়ার থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেওয়াও তার কাজে সহজতর।

অরা অস্থির ভঙ্গিতে তার ড্রাইভারকে কল দিয়েছে। সে নিয়মিত অফিসে না যাওয়ার কারণে ড্রাইভার এতদিন ছুটিতেই ছিল। অরার কল পেয়ে সে ছুটে আসছে। এদিকে অরা ছোট একটা ব্যাকপ্যাকে তার প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস গোছাতে ব্যস্ত।

আরশাদের হৃদস্পন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মনে মনে সে বারবার একটাই প্রার্থনা করছে, সে যেন ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আরশাদ চায় না এই অসহনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে। হাজার তপস্যার পর অরাকে পেয়েছে নিজের করে। নিজের বলতে এই একটা মানুষই তার আছে। এই মানুষটাই শেষমেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাকে?

আরশাদ যা করেনি, তার জন্যে এর আগেও দোষারোপ করা হয়েছিল তাকে। এই অনুভূতি তার কাছে নতুন কিছু নয়। নওশীনের সঙ্গে ডিভোর্সের পরপর দেশের শীর্ষ নিউজ মিডিয়া ঠিক এভাবেই আঙুল তুলেছিল তার চরিত্রে। একটু একটু করে ভেঙে দিয়েছিল তার আগে থেকেই ভাঙা অন্তরাত্মাকে।

আরশাদের যেমন রাগ হচ্ছে ঠিক তেমনই হচ্ছে আক্ষেপ। রাগ হচ্ছে ওই সুজানার মেয়েটার ওপরে। আরশাদ বেশ বুঝতে পারছে তাকে এবং অরাকে আলাদা করার জন্যে কেউ গভীর ষড়যন্ত্র রচনা করেছে। সেই রচয়িতাটা কে তাও খুব ভালো করে জানা আছে তার। সুজানা এই ষড়যন্ত্রের একটা অংশ মাত্র। আক্ষেপ হচ্ছে অরাকে নিয়ে। মেয়েটা এতটুকু বিশ্বাস রাখতে পারলো না আরশাদের ওপরে? অবশ্য আরশাদও তো ঝোঁকের মাথায় অবিশ্বাস করেছিল অরাকে। তবে কি এটাই তার প্রাপ্য ছিল?

সকল অনুভূতিকে ছাপিয়ে যে অনুভূতি প্রখর হয়ে মনের মাঝে ধরা দিয়েছে, সেটা হলো ভয়। অরা ছাড়া বেঁচে থাকার ভয়। আরশাদ সত্যিই পারবে না এই মেয়েটাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে। ইতোমধ্যেই তার বুকটা কয়েকবার গভীর মোচড় দিয়ে উঠেছে।

অরা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তার ব্যাকপ্যাক গোছাচ্ছে। আরশাদ কাছে গিয়ে তার হাতদুটো ধরে বাঁধা দিয়ে বলল, “অরা প্লিজ পাগলামি কোরো না। এটা ঠিক সময় না।”

অরা তার হাতটা এক ঝটকায় সরানোর চেষ্টা করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “ছোঁবে না আমাকে। আমার ঘেন্না লাগে তোমার স্পর্শ।”

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতটা সরিয়ে নিলো আরশাদ। সত্যিই তার বেঁচে থাকার সকল ইচ্ছা ফুরিয়ে গেছে। যে মেয়ে তার বুকে লেপ্টে না থেকে ঘুমাতেই পারে না, আজ না-কি তার ঘেন্না লাগছে আরশাদের স্পর্শ! এই দিনের মুখোমুখি কেন তাকেই হতে হলো?

আরশাদ নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে বলল, “ঠিক আছে। আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ। আমি জানি না সুজানার উদ্দেশ্য কী, কিন্তু ওই মেয়েটা আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।”

অরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ছোট বাচ্চা পেয়েছো আমাকে? যা বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করবে তাই বুঝবো? আমাদের ক্ষতি করে ওর লাভ কী?”

আরশাদ অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “আমি জানি না অরা। আমাকে একটা সুযোগ দাও, সব সত্যি খুঁজে বের করবো। সবকিছু ঠিক করে ফেলবো আমি।”

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “অনেক হয়েছে আরশাদ। এবার আমাকে সুযোগ দাও, আমি চলে যাই। তোমার মতো নিকৃষ্ট একটা মানুষের সঙ্গে আর এক সেকেন্ডও ঘর করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি চলে যাচ্ছি, এখন একটা না দশটা মেয়ের সাথে শুয়ে বেড়াও তুমি। আমার কিছুই যায় আসবে না।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা কী ধরনের ভাষা?”

“নিচু শ্রেণীর ভাষা। হাজার হোক গরীব ঘরের মেয়ে আমি। তিন কূলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আমার। সে কারণেই তো ভেবেছো যা ইচ্ছা তাই করবে আমার সঙ্গে।”

মনে মনে বিস্ময় বেড়েই যাচ্ছে আরশাদের। এমনটা কী করে ভাবতে পারলো অরা? এ জীবনে কোনদিন অরার অতীত আরশাদের মনে প্রভাব ফেলতে পারেনি। কোনদিন অরাকে সে গরীব ঘরের মেয়ে বলে মনে করে নিচু চোখে দেখেনি। এমনকি অরা যখন তার ম্যানেজার ছিল, তখনও না। অরা এতটা নিচ ধারণা রাখতে পারলো আরশাদের সম্পর্কে?

অরার ড্রাইভার চলে এসে কল দিলো তাকে। অরা গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করে বাড়ির সামনে আসতে বলল।

আরশাদের হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। অরা আসলেই এমনটা করছে? যে অরা আজীবন তার পাশের থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেই অরা?

অরা ব্যাকপ্যাকটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। আরশাদ তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে এমন একটা কাজ করলো, যা সে এ জীবনে করেনি।

অরার সমানে হাত জোড় করে বলল, “অরা আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ। প্লিজ অরা। যদিও আমার কোনো দোষ নেই, তবুও তোমার যা ইচ্ছা তাই শাস্তি দাও। তবুও ছেড়ে যেও না। তুমি না আমাকে কথা দিয়েছিলে, কখনো ছেড়ে যাবে না আমাকে?”

যে আরশাদ হক পৃথিবীর কাউকে তোয়াক্কা করে না, কারও সামনে মাথা নত করে না – সেই আরশাদ কিনা হাত জোড় করছে অরার সামনে। তাকে ছেড়ে না যাওয়ার মিনতি করছে।

তবুও অরার কঠিন হৃদয় বিগলিত হলো না। অরা কঠিন গলায় বলল, “এই কথাটা আমি সেই আরশাদকে দিয়েছিলাম, যার পুরোটা জুড়ে শুধুই আমি। চরিত্রহীন আরশাদকে দিইনি।”

আরশাদের চোখদুটোতে জল ছলছল করছে। আরশাদের অশ্রু চিরকালই তীব্র যন্ত্রণা দেয় অরাকে। এমনকি সিনেমার দৃশ্যেও তার চোখে জল সহ্য করতে পারে না। সেই অরা আজ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন তার কিছুই যায় না। আজ তার কাছে মনে হচ্ছে এই চোখের জল আরশাদের বাস্তবিক অভিনয়ের অংশ মাত্র।

আরশাদ অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “প্লিজ যেও না অরা। এ জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তুমি। তুমি চলে গেলে সহ্য করতে পারবো না আমি।”

“আমিও কম কষ্ট পাইনি। কষ্ট বাড়িও না। যেতে দাও আমাকে।”

অরা চলে গেল। আরশাদের হাজার অনুনয়, হাজার অনুরোধ উপেক্ষা করে চলে গেল। আরশাদের নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এসেছে। কেউ যেন ভারী পাথর চেপে ধরেছে তার বুকে। প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস মৃত্যুযন্ত্রণার স্বাদ দিয়ে যাচ্ছে।

রাগে-আক্ষেপে নিচতলার এ ঘরটার সমস্ত শোপিস আছড়ে ভেঙে ফেলল আরশাদ। বেডসাইড টেবিলের ল্যাম্প শেড থেকে শুরু করে দেয়ালে ঝুলন্ত দামী পেইন্টিং, কোনো কিছুই বাঁচলো না তার রাগের হাত থেকে। মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা কাঁচ আরশাদের খালি পা মুহূর্তেই র/ক্তাক্ত করে দিলো। সেদিকেই কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই তার। রাগে গজগজ করে সামনে যা পাচ্ছে তাই ভেঙে ফেলছে।

রাগটা সম্পূর্ণ তার নিজের ওপরে। সে যদি তখন অফিসে না গিয়ে অরার সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসতো, অসহনীয় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।

ভাঙচুর করে ক্লান্ত হয়ে ধপ করে সোফার ওপরে বসে পড়লো আরশাদ। একটু আগে ঠিক যেখানে অরা বসে ছিল। মেয়েটা যে এতটা হৃদয়হীন, জানা ছিল না আরশাদের। সত্যিটা যাচাই না করে, আরশাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল? এ জীবনের সবথেকে বড় কষ্টটা অরাই আজ দিলো তাকে। তবুও অরার প্রতি রাগ-অভিমান কিছুই অনুভব করতে পারছে না আরশাদ।

মনটা বারবার চাইছে যেন কোনো মিরাকেল ঘটে যাক। অরা যেন ফিরে আসুক। হাসিমুখে তাকে জড়িয়ে ধরে মুখটা লুকিয়ে রাখুক তার বুকে।

যে মানুষটা তাকে এত কষ্ট দিয়ে চলে গেল, সেই মানুষটার প্রতিই উদ্বেগের শেষ নেই আরশাদের। অনিয়ন্ত্রিত আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আরশাদ কল করলো অরার বডিগার্ড জহুরুলকে।

সে কল রিসিভ করতেই আরশাদ এ প্রান্ত থেকে শীতল কণ্ঠে বলল, “তোমার ম্যামের গাড়িটা ফলো করো। সীমার বাসায় যাচ্ছে। ও বাসার ভেতরে চলে গেলে তুমি গাড়ি নিয়ে বাইরেই বসে থাকবে। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে।”

জহুরুল বিনয়ী গলায় বলল, “জি আচ্ছা স্যার।”

ফোনটা রাখতেই দুহাতে মাথার দুপাশ চেপে ধরলো আরশাদ। মাথার দুপাশের রগ দপদপ করে জ্বলছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট এখনো দূর হয়নি। আরশাদ চাইলেই পারে জোর খাটিয়ে মাঝ রাস্তা থেকে অরাকে তুলে আনতে। সেই ক্ষমতা তার আছে।

তবে যে মানুষের মনটাই তার প্রতি ঘৃণায় বিষিয়ে আছে, তাকে জোর করে ফিরিয়ে এনে লাভ কী? আরশাদ খুব ভালো করেই জানে অরা সীমাদের বাসায় গেছে। ওখানে সে নিরাপদেই থাকবে।

নিজের ভাগ্য নিয়ে উপহাস করতে ইচ্ছা করছে আরশাদের। ভালোবাসা নামক জিনিসটার প্রতি তার এত আসক্তি, অথচ ভালোবাসাই তার ভাগ্যে লেখা নেই। ছোটবেলায় বাবা তাকে ছেড়ে চলে গেল, যাকে মন উজাড় করে ভালোবাসলো সেও প্রতারণা করলো। আর আজ অরা।

অরা কি চিরতরেই চলে গেল তাকে ছেড়ে? আরশাদ কি আর কখনোই দেখতে পাবে না তাকে? সত্যিই কি অরা বাবুর ওপর আরশাদের ছায়াও পড়তে দেবে না? নিজের সন্তানের সঙ্গে সে পৃথিবীতে আসার আগেই দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে গেছে আরশাদ। তাকে ছাড়া সে বাঁচে কী করে?

ছোট ছোট পা ফেলে উঠে দাঁড়ালো আরশাদ। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়। পায়ের তলে কাঁচের গুঁড়ো লেগে থাকায় একেকটা পদক্ষেপ একটু একটু করে ক্ষতবিক্ষত করছে তাকে। ব্যথায় নির্বিকার আরশাদ। তার এবং অরার ঘরের ক্লজেট খুলে তার সাজানো টাইগুলোর আড়াল থেকে বের করে আনলো সোনালী রঙের ওই জিনিসটা।

বিছানার এক পাশে বসে ধীরস্থিরভাবে আরশাদ আঙুল বুলাচ্ছে তার রাশিয়ান পি/স্তলের ওপর। এই পি/স্তল ব্যবহারের সুযোগ আজ পর্যন্ত আসেনি। তবে ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে এর ব্যবহার করতে। শেষ করে ফেলতে নিজেকে। নিজের ওপর তীব্র ঘৃণা হচ্ছে কেন যেন।

সব দোষ তো তারই। সেই পারে না, ভালোবাসার মানুষগুলোকে আগলে রাখতে। ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসার মর্যাদা দেওয়া হয়তো তার সাধ্যে নেই। তাই তো বারবার নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাকে। আরশাদের চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে। আচ্ছা, তার মৃ/ত্যুতেও কি অরা একই ভাবে ঘৃণা পুষে রাখবে তার ওপরে?

“বাবা?”

চমকে দরজার দিকে তাকালো। কথাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলটা লুকিয়ে ফেলল ভাঁজ করে রাখা ব্ল্যাঙ্কেটের আড়ালে। ঘোরে আচ্ছন্ন মনটা সংবিৎ ফিরে পেলো। কষ্টে এতটাই পাগল হয়ে যাচ্ছিল সে? নিজেকে নিজেই ভর্ৎসনা করলো আরশাদ। এত ফুটফুটে একটা মেয়ে যার, সে নিজেই নিজেকে মে/রে ফেলার ভাবনা মাথায় আনে কী করে?

কথা দৌড়ে এসে উঠে বসলো আরশাদের কোলে। আরশাদ শক্ত করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। যেন হাতের বাঁধন একটু আলগা হলেই কথাও ছেড়ে চলে যাবে তাকে।

কথা কৌতুহল নিয়ে বলল, “অরা কোথায়?”

আরশাদ ভেবে পাচ্ছে না কী জবাব দেবে। অরার কি এই হৃদয়হীনের মতো কাজটা করার সময়ে একবারও মনে ছিল না কথার কথা? এই তার মমতা?

আরশাদ শান্ত গলায় বলল, “একটু বাইরে গেছে।”

কথা উদগ্রীব গলায় বলল, “কখন আসবে?”

“কয়েকদিন লাগবে।”

“কয়েকদিন? কোথায় গেছে অরা?”

আরশাদ আর কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, “বেড়াতে গেছে।”

কথা একই সঙ্গে বিস্মিত এবং অসহায় গলায় বলল, “অরাও বেড়াতে চলে গেল বাবা?”

কথার এই অসহায়ত্ব একেবারেই সহ্য হচ্ছে না আরশাদের। মেয়েটা এমনিতেই বহুকষ্টে প্রতিনিয়ত তার মাকে ভুলে থাকে। যে মানুষটা সারাক্ষণ মায়ের মমতায় আগলে রাখে, সেও চলে গেল। মেয়েটার কী হবে এখন? এ জীবনে কার কাউকেই তো ভরসা করতে পারবে না সে।

কথা অস্পষ্ট গলায় ডাকলো, “বাবা?”

আরশাদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ মা?”

কথা ভীত ভঙ্গিতে বলল, “অরা কি আর কখনোই ফিরে আসবে না?”

চুপ করে রইলো আরশাদ। এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও জানে না। যে মিথ্যাকে অরা সত্যি ভেবে বসে আছে, সেটা যে আসলেই মিথ্যা এটা প্রমাণ কী করে করবে তাই ভেবে পাচ্ছে না আরশাদ।

তবুও কথাকে আশ্বস্ত করার জন্যে বলল, “আসবে বাবা। আসবে।”

কথা পায়েলের সঙ্গে চলে গেল তার ঘরে ফ্রেশ হতে। ব্ল্যাঙ্কেটের আড়াল থেকে আবারও পিস্তলটা বের করলো আরশাদ। নাহ্! ভেঙে পড়লে চলবে না। এর আগেও কতগুলো মিথ্যার তীর জর্জরিত করেছিল তাকে। প্রতিবাদ করেনি সে।

আরশাদের রক্তিম চোখদুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। চিরচেনা রাগ তার ভেতরে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করছে। ওই সুজানাকে ছাড়বে না। তার জীবনে দাবানলের মতো আগুন ছড়াতে এসেছে সুজানা। নিজের ছড়ানো আগুনে এবার সে নিজেই পুড়বে।

সুজানা তো কাঠের পুতুল মাত্র। কাঠের পুতুলের নিয়ন্ত্রণে যে আছে, তাকেও ছাড়বে না আরশাদ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে তার ষড়যন্ত্রের নীলনকশা।

কয়েকটা নোটিফিকেশনের শব্দ কানে ভেসে আসতেই পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো আরশাদ। ফেসবুকে ঢুকতেই চোখে পড়লো কয়েকটা কুৎসিত ছবি। অরার রাগের মূল কারণ তাহলে এই ছবিগুলোই?

সত্যিকার অর্থে এই মুহূর্তটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল আরশাদ। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটা কেবল তার সংসারই ভাঙতে চায় না, চায় আরশাদের ক্যারিয়ার চিরতরে শেষ করে দিতে। ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটের কোণে। সুপারস্টার আরশাদ হকের ক্যারিয়ার ধ্বংস করা কি এতই সহজসাধ্য ব্যাপার? মানুষ এই চিন্তা করেই বা কী করে?

ফেসবুক থেকে বের হয়ে আরশাদ কল করলো তার বডিগার্ড তুফানকে। তার বলশালী দুই বডিগার্ড ঝড়-তুফানের বহুদিনের স্বপ্ন, যে আরশাদের ক্ষতি করতে চাইবে তাকে নাটকীয় ভঙ্গিতে নিশ্চিহ্ন করা। তাদের সেই স্বপ্ন হয়তো আজই সত্যি হতে চলেছে।

অপরপ্রান্ত থেকে কল রিসিভ হতেই আরশাদ শীতল গলায় বলল, “আজ রাতে জরুরি একটা কাজ করতে হবে তোমাদের দুজনকে।”

(চলবে)