ফিরে_আসা২ পর্ব-৫৭+৫৮

0
386

#ফিরে_আসা২
৫৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

কতক্ষণ পর চেতনা ফিরে পেলো সুজানা নিজেও জানে না। খুব কাছ থেকে কেউ হিমশীতল পানি ছুঁড়ে ফেলেছে তার মুখের ওপর। চেতনা ফিরে পেয়ে আঁতকে উঠে ছটফট করছে সে। দৃষ্টি এখনো ঘোলাটে হয়ে আছে। তবে বেশ বুঝতে পারছে তার হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা।

চোখদুটো খুলে স্পষ্টভাবে তাকাতেই পাথরের ন্যায় জমে গেল সুজানা। তীব্র ভয় তার শরীরে তড়িৎ গতিতে খেলে বেড়াচ্ছে। সামনে বসে থাকা মানুষটার শান্ত দৃষ্টি তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।

চাকাওয়ালা একটা চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে আরশাদ। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দৃষ্টি দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। যে আগুন নিমিষেই পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে আশেপাশের সব। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুজানাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে আরশাদ। আজ তাকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন করার জন্যে দায়ী মানুষটা তার সামনে। ইচ্ছা তো করছে রাশিয়ান পিস্তলটা মেয়েটার দিকে নিক্ষেপ করে রক্তারক্তি বাঁধাতে।

মনে জমতে থাকা সুপ্ত ইচ্ছাটা লম্বা শ্বাস নিয়ে দমন করলো আরশাদ। এখনো অনেক কাজ বাকি। তাকে বিপর্যের সম্মুখীন করার পেছনে দায়ী এই মেয়ে একা নয়। তার সঙ্গে যারা আছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। নিজের ইমেজ পরিষ্কার করতে হবে। সবশেষে সবাইকে একসঙ্গে ধ্বংসের মুখোমুখি করে তবেই শান্তি আরশাদের।

কে ফিল্মসের অফিসের বেজমেন্টে গাড়ি পার্ক করার জন্যে বিশাল গ্যারেজ রয়েছে। সেই গ্যারেজের ডান দিকে একটা ঘর রয়েছে। এই ঘরটা স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানেই সুজানাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেশি একটা ব্যবহার হয় না বলে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটা। মাথার ওপরে ঝকঝকে একটা বাল্ব জ্বললেও তা অন্ধকার পুরোপুরি দূর করছে না। আলো বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ আরশাদ নিলো না। অন্ধকারটাই ভালো, অপরাধীর মনে ভয়ের উদ্রেক সৃষ্টি করবে।

কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ঝড়-তুফান। আরশাদের যেকোনো প্রয়োজনেই যেন পাওয়া যায় তাদের।

শান্ত ভঙ্গিতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো আরশাদ। তার নিজের না, অরার মোবাইল। মেয়েটা আছড়ে ভেঙে ফেলার পরই ভাঙা মোবাইল নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। এটা ফেলে রেখেই চলে যায়। আরশাদও সময় অপচয় না করে ঝড়কে দিয়ে মোবাইলটা সারাতে পাঠিয়ে দেয়। একটাই উদ্দেশ্য, অতি সূক্ষ্ম হলেও কিছু একটা খুঁজে পাওয়া।

ভাগ্যিস অরার ফোনে কল রেকর্ডিং সব সময় অন থাকে। সুজানার সাথে তার কথোপকথন খুঁজে বের করতে তাই খুব একটা অসুবিধা হয়নি। পুরো কথোপকথনটা মন দিয়ে শুনেছে সে। সুজানা যেভাবে অরাকে উস্কে দিয়েছে, তাতে তার রেগে না যাওয়ার কোনো কারণই নেই।

ধীরস্থিরভাবে আবারও কল রেকর্ডিংটা প্লে করলো আরশাদ। সুজানার সামনে আবারও প্রথম থেকে শুনছে। মোবাইল থেকে ভেসে আসছে সুজানার কণ্ঠস্বর। নিজের কণ্ঠে যেন নিজেই ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছে সে।

“কাল রাতে শুটিং শেষে আমি কোনো উবার পাচ্ছিলাম না, ইউনিটের গাড়িও ছিল না। বাধ্য হয়ে আরশাদের কাছে লিফট চাই, সে রাজিও হয়ে যায়। গাড়িতে ড্রাইভার ছিল না। উনিই ড্রাইভ করছিলেন। গাড়িতে আমরা যথারীতি গল্প করছি। হঠাৎ মাঝরাস্তায় উনি গাড়ি থামিয়ে দিলেন।”

“তারপর?”

“আপু আমি আর বলতে পারবো না।”

“বলো তুমি! তারপর কী হয়েছে?”

“আরশাদ হুট করে আমার… ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসে।”

বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটের কোণে। এই হাসি যেই সেই হাসি নয়, ভয়ঙ্কর হাসি। সুজানার হৃদস্পন্দন এক লাফে বেড়ে গেল। নিজের মিথ্যাচারে ধরা পড়ে যাওয়ার থেকেও বেশি ভয় তার লাগছে পরবর্তী পরিণতির কথা চিন্তা করে।

ভয়ঙ্কর ওই হাসিটা বজায় রেখেই আরশাদ শীতল গলায় বলল, “আমার রুচি না-কি এতই খারাপ!”

ঢোক গিলল সুজানা। আরশাদের শীতল কণ্ঠস্বর বারবার তার ধ্বংসের পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে।

আবারও শোনা গেল কল রেকর্ডিংয়ে সুজানার কণ্ঠ, “আরশাদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আমার ফ্ল্যাটে যাওয়া যাবে কিনা। আমি একাই থাকি, তাই কোনো সমস্যা ছিল না। ঝোঁকের মাথায় সায় দিই। নিয়ে যাই উনাকে আমার ফ্ল্যাটে।”

আরশাদ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “ঢাকায় তো তোমার ফ্ল্যাটই নেই। থাকো একটা মহিলা হোস্টেলে। আমাকে তাহলে কোন ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিলে?”

ধরা পড়া চোখের ন্যায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সুজানা। আরশাদ রেকর্ডিং বন্ধ করে ফোনটা আবারও পকেটে ভরে রাখলো। তার শরীরে যে রাগ খেলে বেড়াচ্ছে তা সহজে মিটবে না।

আরশাদ অগ্নিকণ্ঠে বলে উঠলো, “তোমার বাবা প্রোস্টেট ক্যান্সারের রোগী না? যে মানুষের ঢাকায় কেমোথেরাপি চলছে, সে না-কি আবার গ্রামে বিয়ে খেয়ে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত পৃথিবী!”

সুজানার গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছে আরশাদ। তার বাবা দিব্যি সুস্থ মানুষ, গত পরশু কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানেও দেখা গেছে তাকে।

আরশাদ সুজানার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম একটা মানুষ কোনো কারণ ছাড়া আমার ক্ষতি কেন করতে চাইবে? পরে বুঝলাম, যে মানুষ নিজের বাবাকে নিয়ে এত বড় একটা মিথ্যা বলতে পারে সে সবই পারে।”

সুজানা চুপ করে রইলো। নিজের বাবার সমন্ধে এত ভয়ানক একটা মিথ্যা বলতে তার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগেনি। টাকার কাছে সব হেরে যায়। সামান্য একটা সত্যি হারতে পারবে না।

আরশাদ কঠিন গলায় বলল, “কেন করলে?”

আরশাদের প্রশ্নে কোনো কৌতুহল নেই, উত্তর পাবার জন্যে ব্যাকুলতা নেই। রীতিমত আদেশের সুরে প্রশ্নটা করলো সুজানাকে।

সুজানা এবার মুখ খুললো। কম্পিত স্বরে বলল, “আপনার সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্যে।”

আবারও সেই ভয়ঙ্কর বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। এই কেন’র উত্তর সে জানতো। তার দরকার আরেকটা কেন’র উত্তর। তাই আবারও সেই একই ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো সুজানার দিকে, “সেটা তো বুঝলাম। আমার বউকে এত বড় একটা মিথ্যা বললে কেন? তোমার মতো থার্ড ক্লাস একটা মেয়ের সাথে কোন দুঃখে রাত কাটাতে যাবো আমি?”

ক্ষীণ অপমান গায়ে লাগলেও চুপ করে রইলো সুজানা। আরশাদ যে পরিমাণে রেগে আছে, তাতে একটা ভুল পদক্ষেপই যথেষ্ট তার প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্যে।

আরশাদ গম্ভীর গলায় সতর্ক করে বলল, “আমি কিন্তু এক প্রশ্ন দ্বিতীয়বার করি না।”

সুজানা আবারও ঢোক গিলে বলল, “আপনার সংসার ভাঙার জন্যে বলেছি। যাতে আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে চলে যায়, আর আপনি আমার সাথে প্রেম করেন।”

সুজানা যে সত্যি বলছে না, খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে আরশাদ। মোটা অংকের টাকা খেয়ে বসে আছে এই মেয়ে। সহজে মুখ খুলবে না, সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেও না।

আরশাদ ভ্রু ওপরে তুলে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “খুব ভালো কথা। আমার সাথে প্রেম করবে বলে আমার সংসার ভাঙ্গার চেষ্টা করেছো – চমৎকার! কিন্তু ওই ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দিলে কেন? নিজের মুখটা তো ব্লার করতে ভুলোনি। আমার ইমেইজ যদি নষ্টই হয়ে যায়, তাহলে আর আমার সাথে প্রেম করে লাভ কী?”

সুজানা ধাঁধায় পড়ে গেল। এই লোকের আছে পরপর মিথ্যা বলে যাওয়া সম্ভব নয়। তবুও কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, “আপনার সাকসেস আমার সহ্য হয় না। হিংসা থেকে করেছি।”

আরশাদ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “যার সাথে প্রেম করতে চাও তাকেই হিংসা করো?”

সুজানা চুপ করে গেল। কখনো ভাবতেই পারেনি আরশাদের হাতে ধরা পড়তে হবে তাকে। তাই মিথ্যাগুলোও আগেভাগে সাজিয়ে রাখা হয়নি মস্তিষ্কে।

আরশাদ তার ভয়ঙ্কর শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো, “গত সাত দিনে ধাপে ধাপে তোমাকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পঞ্চাশ লাখ টাকা জমা হয়েছে। তোমার ব্যাগ থেকে আরও দশ লাখ টাকার চেক পাওয়া গেছে। এত টাকা তো আমার সিনেমায় অভিনয় করেও তুমি পাওনি। কে দিলো?”

সুজানা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “আমি কয়েকটা নতুন সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। সেগুলোরই সাইনিং মানি।”

“নতুন সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হলে তো সেটা নিউজে আসার কথা। এলো না কেন?”

সুজানা কিছুটা কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে বলল, “আপনাকে এত প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হলে, তুলে দিন।”

হেসে উঠলো আরশাদ। পুলিশের কাছে যাওয়ার বড্ড আকাঙ্ক্ষা এই মেয়েটার। কোর্টে গেলে নিজস্ব উকিল পাবে, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ পাবে। জামিন পেয়ে বেরিয়েও আসবে কারাগার থেকে। তার মাথার ওপরে থাকা মানুষগুলোকে কখনো আরশাদের মুখোমুখিও হতে হবে না।

তবে আরশাদ তো আর সেই সুযোগ করে দেবে না। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো সুযোগ আর অবশিষ্ট নেই। এই পৃথিবীতে আর কেউ জানুক বা নাই জানুক, সুজানা নিজে তো জানে আরশাদের ওপর তার তোলা সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা।

আরশাদ ঝাঁঝালো গলায় বলল, “তা তো দিবোই। এত অধৈর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। তোমাকে, তোমার মাথার ওপরে থাকা সবাইকে জেলের স্বাদ নেওয়াবো আমি।”

সুজানা দৃঢ় গলায় বলল, “আমার মাথার ওপরে কেউ নেই। আমি নিজের ইচ্ছায় এসব করেছি, বললাম তো!”

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমি বিশ্বাসও করলাম।”

পকেট থেকে এবার নিজের মোবাইলটা বের করতে করতে হালকা গলায় আরশাদ বলল, “আমার এত বড় ক্ষতি করলে, এখন আমারও তো উচিত তোমার ছোট-খাটো একটা ক্ষতি করা। তাই না?”

সুজানা হঠাৎ ভীত গলায় বলল, “কী করবেন আপনি?”

“নিজের মুখ ব্লার করে নকল ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিলে। কিন্তু আসল ছবি তো আমার কাছে।”

সুজানার চোখমুখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো। একরাশ ভয় নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে।

মোবাইলটা ভেসে ওঠা একটা ছবি সুজানার দিকে ফিরিয়ে তাকে দেখালো আরশাদ। অন্তরঙ্গ অবস্থায় এক লোকের সঙ্গে সুজানা। নিজের দিকে মোবাইলটা ফিরিয়ে আবারও আরেকটা ছবি বের করলো আরশাদ। আবারও দেখালো সুজানাকে। এই ছবিতে ভিন্ন এক লোকের সঙ্গে ওই একই অবস্থায় দেখা যাচ্ছে তাকে।

আরশাদ হিমশীতল কণ্ঠে বলল, “আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপরেই সবাই জেনে যাবে তোমার প্রথম সিনেমাটা পাওয়ার পেছনের কাহিনী। সেরা নবাগত অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার পাওয়ার কাহিনী।”

প্রথম সিনেমাটায় নিজের অবস্থান পাকা করে নেওয়ার জন্যে পরিচালকের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি সুজানা। প্রথম পুরস্কারের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটে
অ্যাওয়ার্ড শোয়ের আয়োজন পুরস্কারের বদলে একটা রাত চেয়ে বসে তার কাছে।

এই চাকচিক্যময় ইন্ডাস্ট্রির আড়ালে নোংরা কিছু মানুষের বসবাস। অবশ্য এদের নোংরামি প্রশয় দেওয়ার জন্যে তাদের থেকেও নোংরা মেয়ে মানুষ আছে বলেই এমনটা সম্ভব।

সুজানাকে একরাশ ভয় ঝেঁকে ধরলো। ওই লোকগুলো আরশাদকে ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার মানে জনসম্মুখে এসে সত্যি বলতেও পিছ পা হবে না তারা। যদিও দোষ ওই লোকগুলোরও ছিল। তবুও, আঙুল তো দিনশেষে সুজানার ওপরেই উঠবে।

আর এই ছবিগুলো যদি একবার ইন্টারনেটে চলে যায়? আরশাদের সঙ্গে ফাঁস হওয়া নকল ছবিগুলো নিজের চেহারা ঢেকে রেখেছে সুজানা। লোকে জানে, মেয়েটা সে-ই। তবে কেউ দেখতে পাচ্ছে না তাকে।

তবে এই ছবিগুলো ফাঁস হয়ে গেলে তো সর্বনাশ। গ্রামে সুজানার পরিবারের মানুষেরা দেখবে, তাদের নানা ভাবে অপদস্ত হতে হবে।

আরশাদ মোবাইলটা হাতে নিয়ে ছবিগুলো কাউকে পাঠাতে যাবে, তখনই সুজানা আঁতকে উঠে বলল, “ভাইয়া প্লিজ! প্লিজ এটা করবেন না। আমার বাবা ওসব দেখলে হার্ট অ্যাটাক করবে।”

আরশাদ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “আমি করতে চাইনি তো। তুমিই সত্যিটা বলবে না বলে ঠিক করেছো। আমার এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

সুজানা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ভাইয়া আমি সব সত্যি বলছি। আমি এসবের কিছুই জানি না। আমি শুধু মাহমুদের কথা মতো কাজ করেছি।”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার দিকে আরশাদ। “এই মাহমুদটা আবার কে?”

পেছন থেকে এগিয়ে এলো তুফান। কৌতুহলভরা কণ্ঠে বলল, “ক্রিয়েটিভ টিমের মাহমুদ?”

সুজানা তড়িৎ গতিতে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

তুফান আরশাদকে আশ্বস্ত করে বলল, “স্যার, এই ছেলে তো আমাদের অফিসের!”

তীব্র রাগে চোখদুটো বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস ফেলল আরশাদ। চারিদিকে জালের মতো শত্রু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এমনকি তার অফিসেও শত্রু?

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “যেখান থেকে পারো ধরে নিয়ে এসো একে।”

তুফান হন্তদন্ত হয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো।

আরশাদ তাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে বলল, “আর শোনো!”

তুফান ফিরে এসে বলল, “জি স্যার?”

আরশাদ ইশারায় সুজানাকে দেখিয়ে বলল, “মেয়েমানুষ বলে ওকে যতটা ছাড় দিয়েছ, এই মাহমুদকে অতটা ছাড় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। খাতির-যত্ন করে নিয়ে আসবে।”

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৫৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

চোখের সামনে এ জীবনে দেখা ভয়ংকরতম দৃশ্যটা দেখছে সুজানা। এতক্ষণে তার উপলব্ধি হলো, এই ঝামেলায় জড়ানোটাই তার বোকামি হয়েছে। টাকার জন্যে সে সব করতে রাজি। তবে সেই সবেরও একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে। সীমানা পেরিয়ে গেছে সুজানা। এর পরিমাণ যে হবে ভয়াবহ, তাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

মাহমুদকে সিলিংয়ের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। শার্ট খুলে তার শরীরে ধারালো চাবুক দিয়ে অনবরত আঘাত করে যাচ্ছে ঝড়-তুফান। জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে লালচে দাগ বসে গেছে। একটু পর পর অস্ফুটস্বরে চিৎকার করে উঠছে সে।

সুজানাকে ফোনে না পেয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিল মাহমুদ। তাই এই মধ্যরাতে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হয় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যের। যে বাড়িতে মাহমুদ ভাড়া থাকে তার সিকিউরিটি গার্ডকে ধরতেই সে বাড়ির নিচের সিসিটিভি ফুটেজ দেখিয়ে দেয়। সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটেই বাইক নম্বর খুঁজে বের করে গাড়ির নম্বর।

গাড়িটা উবার ছিল বলে রক্ষা। নম্বর মিলিয়ে গাড়ির মালিককে খুঁজে বের করতেও খুব একটা সময় লাগেনি। তাকে ফোন করতে সে জানায়, মাহমুদকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন নামিয়ে দিয়ে এসেছিল সে। সেখান থেকে তাকে ধরে আনা।

শুরুতে মাহমুদ বেশ দাপাদাপি করছিল। তাকে না-কি অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঝড়-তুফান দুজনকেই সে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে। তবে এখন তাদের হাতেই খেতে হচ্ছে চাবুকের আঘাত।

সুজানার ঠিক বিপরীতে কিছুটা দূরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মাহমুদকে। যাতে সে সরাসরি দৃশ্যটা দেখতে পারে। দুজনের মাঝখানে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে আরশাদ। তার দৃষ্টি আটকে আছে মাহমুদের ফাইলের দিকে। অফিসের সব এমপ্লয়িদের আরশাদ চেনে না। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তার অফিসে আসা হয় না। আর তাছাড়া আরশাদ অফিসে এলে বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথেই তার কথা হয়। এসব ছোটখাটো এমপ্লয়ি তার চোখে এড়িয়ে যাওয়ারই কথা। ক্রিয়েটিভ টিমের এই নতুন আমদানিকেও তাই চেনা হয়ে ওঠেনি তার। মাহমুদের ফাইল থেকে অবশ্য তার নাড়ি-নক্ষত্র সবই খুঁজে পাচ্ছে আরশাদ।

অনবরত আঘাত করতে করতে তুফান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সত্যি করে বল ক্যান করলি এইসব!”

মাহমুদ অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “ভাই! বিশ্বাস করেন ভাই। আমার কোনো দোষ নেই।”

কথাটা শেষ করার ঠিক আগমুহূর্ত আবারও এসে গায়ে এসে লাগলো চাবুকের কড়া আঘাত।

চাপা আর্তনাদ করে মাহমুদ বলে উঠলো, “আহহ!”

ঝড় আর তুফানের মাঝে দয়ামায়া কোনো কালেই ছিল না। আরশাদের সুরক্ষার জন্যে
যেকোনো পর্যায়ে যেতে প্রস্তুত দুজনে। স্যারের শত্রু হিসেবে এতকাল চিনে এসেছে নওশীনকে। তাকে তো আর উল্টো করে ঝুলিয়ে বেদম পেটানো যায় না। এত কাল অপেক্ষার পর অবশেষে সেই সুযোগ পেয়ে তার এক বিন্দুও অপচয় করছে না ঝড়-তুফান।

মাহমুদ হঠাৎ কী যে মনে করে সুজানার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “আমার কোনো দোষ নেই ভাই। সব প্ল্যান এই মেয়ের!”

ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরশাদ নিক্ষেপ করলো মাহমুদের দিকে। তার দৃষ্টিতে ভয়ে পাথর ভয়ে জমে গেল মাহমুদ।

ওদিকে সুজানা আঁতকে উঠে বলল, “মানে কী? আপনি বললেই হলো! আপনার কথামতোই তো সব করলাম।”

মাহমুদ দুর্বলভাবে ধমক দিয়ে বলল, “এই মেয়ে! মিথ্যা বলো কেন? তোমার প্ল্যানমাফিকই ম্যামকে তোমার নাম সাজেস্ট করেছিলাম। স্যার বিশ্বাস করুন, আমার কাজ ছিল শুধু প্রহর সিনেমার নায়িকা হিসেবে এই মেয়ের নাম সাজেস্ট করা। এতটুকুই আমার দোষ ছিল, স্বীকার করছি। এই মেয়ে আমাকে
পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল কাজটার জন্য। এর বাইরে আমি আর কিছুই জানি না।”

সুজানা আকাশ থেকে পড়ে বলল, “আমি পাঁচ লাখ টাকা কোত্থেকে পাবো? ভাইয়া, আমার ব্যাংকে যে টাকাগুলো এসেছে সব এই লোকটাই দিয়েছে। আজ বিকেলেও আমাকে ওই দশ লাখ টাকার চেকটা দেয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি তার ডিরেকশনেই কাজ করে যাচ্ছিলাম। এমনকি একটু আগেও, আমাকে ফোন করে সে বলেছে বেনাপোলে দুয়েকদিন লুকিয়ে থাকতে। বিশ্বাস না হলে ভাইয়া কল রেকর্ডিং বের করুন।”

দুজনের এই কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে রাগ যেন তরতর করে বেড়ে উঠলো আরশাদের সর্বাঙ্গে। পকেট থেকে সোনালী রঙের রাশিয়ান পিস্তলটা বের করে সজোরে সামনের টেবিলে ওপর রাখলো সে। দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চুপ।

আরশাদ ভয়ঙ্কর শীতল গলায় বলল, “তোমাদের দুজনের যেকোনো একজনের মুখ থেকে আর একটা কথাও যদি বের হয়, দুজনেই মরবে। আমি কিন্তু ঠাট্টা করি না।”

ভয়ে রীতিমত পাংশুবর্ণ ধারণ করলো সুজানার মুখ। মাহমুদকে ভয় পাবারও সুযোগ দিলো না ঝড়-তুফান। আবারও শুরু করলো চাবুকের প্রহার।

আরশাদ দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে মেকি বিস্ময় নিয়ে বলল, “চিন্তা করো তুফান! এই ছেলে না-কি ঢাকা ইউনিভার্সিটির টপার।”

ঝড়-তুফান চাবুকের আঘাত থামিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকালো আরশাদের দিকে।

আরশাদ ফাইলের দিকে দৃষ্টি
“টপ রেজাল্ট করে এম এ পাশ করেছিল। নামি-দামি একটা কলেজে চাকরিও পেয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করবে বলে, শিক্ষার আলো ছড়ানো বাদ দিয়ে অন্ধকারে ডুব দিলো! আর আমার না-কি শত্রুর অভাব!”

ঝড়-তুফান মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। যে পরিমাণ রাগ তাদের স্যারের মাথায় এই মুহূর্তে ভর করেছে তাতে মুখ না খোলাই শ্রেয়।

আরশাদ নতুন একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, “মারতে থাকো, যতক্ষণ না সত্যিটা বলছে ততক্ষণ মারবে।”

ঝড়-তুফান যেন সত্যিই ঝড় আর তুফান নিয়ে এলো মাহমুদের সমস্ত শরীরে। আঘাতে আঘাতে র/ক্তাক্ত করে ফেলেছে তার সমস্ত শরীর।

মাহমুদ এবার কেঁদে উঠে আকুতির সুরে বলল, “স্যার! আমি সব সত্যি বলবো!”

আরশাদ ক্ষীণ স্বরে ঝড়-তুফানের উদ্দেশ্যে বলল, “বসাও একে।”

ঝড় মাহমুদের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে একটা চেয়ারের ওপর সোজা করে বসিয়ে দিলো তাকে। আরশাদ তার চাকাওয়ালা চেয়ারটা পা দিয়ে ঠেলে বসে থাকা অবস্থাতেই নিয়ে এলো মাহমুদের মুখোমুখি।

এতক্ষণ উল্টো হয়ে ঝুলতে থাকার কারণে মাহমুদের শরীরের সমস্ত র/ক্ত যেন মাথায় উঠে গেছে। সেই সঙ্গে চাবুকের আঘাতে রীতিমত এলোমেলো হয়ে গেছে সে। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে সে।

তবে সেই সুযোগটুকু থেকেও তাকে বঞ্চিত করে ঝড় আরও এক বার চাবুকের আঘাত বসালো তার পিঠে।

“মুখ খোল হারামজাদা!”

মাহমুদ ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি স্যার কে ফিল্মসের ক্রিয়েটিভ টিমে জয়েন করি চার-পাঁচ মাস আগে…”

আরশাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে অগ্নিকণ্ঠে বলল, “ইতিহাস জানতে চেয়েছি আমি?”

মাহমুদ ভয়ে কুঁকিয়ে গিয়ে বলল, “সরি স্যার!”

সিগারেটের ধোঁয়া ঘিরে রেখেছে আরশাদকে। তবুও তার চোখেমুখে ফুটে ওঠা ভয়ঙ্করতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তার ওই অগ্নিদৃষ্টিই যথেষ্ট সামনে থাকা সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার জন্যে।

ভয়ে ঢোক গিলে মাহমুদ বলল, “আমার উদ্দেশ্য ছিল অরা ম্যামের বিশ্বাস অর্জন করা। একটু একটু করে উনার ভরসা অর্জন করেও নিয়েছিলাম আমি।”

গভীর নিঃশ্বাস ফেলল আরশাদ। অরা এমন কেন? এমনিতে অসম্ভব বুদ্ধিমতি, কোম্পানির বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো নিতে খুব বেশি একটা সময় অপচয় করে না তার মস্তিষ্ক। কিন্তু তার
ওই নরম মনটা মানুষ চিনতে বড্ড ভুল করে বসে। একটু হেসে কথা বললেই মানুষকে আপন মনে করতে শুরু করে সে।

তুফান পেছন থেকে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলছে স্যার! অফিসের সবাই জানে, ম্যামের এক নম্বর চামচ এই বদ।”

মাহমুদ কম্পিত স্বরে বলল, “খুব অল্প সময়েই ম্যামের প্রিয় হয়ে উঠি আমাকে। যেকোনো বিষয়ে আমার পরামর্শ বিবেচনা করেন উনি। আমার মতামত একেবারেই ফেলে দেন না।”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “তারপর?”

“তারপর স্যার… প্রহর সিনেমার কাস্টিং যখন শুরু হলো, তখন আমিই সুজানার কথাটা প্রথম তুলি।”

কোথা থেকে যেন রাগের তীব্র হাওয়া এসে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো আরশাদকে। মনে পড়ে গেল, কিছুক্ষণ আগে সুজানার সঙ্গে মাহমুদের অহেতুক ওই তর্কাতর্কি।

আরশাদ সজোরে একটা চর মারলো মাহমুদের গালে। চরের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল না মাহমুদ চেয়ার থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

আরশাদ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো, “তাহলে এতক্ষণ নাটক করছিলি কেন?”

ঝড় টেনে তুলে আবারও আগের জায়গায় বসিয়ে দিলো মাহমুদকে। তার গালে পাঁচটা আঙুলের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে আরশাদ বলল, “তারপর কী হয়েছিল?”

মাহমুদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “ম্যাম প্রথমদিকে রাজি ছিলেন না। আমিই জোর দিয়ে বলি, এই চরিত্রে সুজানার থেকে ভালো অভিনয় কেউই করতে পারবে না।”

সুজানা ওদিকে ভয়ে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। মাহমুদের ওপর চলতে থাকা অত্যাচার না জানি কখন তার ওপর এসে পড়ে। চোখমুখ কুঁচকে চোখদুটো বুজে আছে সে।

মাহমুদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “সুজানার অডিশনের ব্যবস্থাটা আমি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে সিলেক্ট করেছে রাহাত ভাই।”

আরশাদ বিস্মিত হয়ে বলল, “মানে কী? এর মধ্যে ডিরেক্টরও জড়িত?”

তুফান তড়িৎ গতিতে বলল, “স্যার ধরে আনবো ওই ব্যাটাকে?”

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “দাঁড়াও!”

মাহমুদ ভয়ে ভয়ে বলল, “রাহাত ভাই এর মধ্যে জড়িত না স্যার। উনি শুধু টাকার বিনিময়ে সুজানাকে অডিশনে সিলেক্ট করেছে।”

আরশাদ তাকিয়ে আছে মাহমুদের থেকে আরও বেশি কিছু জানার জন্যে।

মাহমুদ ঢোক গিলে বলল, “আমিই সুজানাকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে শুটিংয়ের সময়ে বেশি বেশি ভুল করে। ইন্ডাস্ট্রিতে কম-বেশি সবাই জানে, আপনি দুর্বল কোঅ্যাক্টরদের নিজে থেকে সব শিখিয়ে দেন। বেশি বেশি সময় দেন।”

আরশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আর সেই সুযোগটাই তোরা নিয়েছিস। তাই তো?”

“জি স্যার। আপনি যখন সুজানাকে আলাদা ভাবে দৃশ্য বুঝিয়ে দিতেন, তখন আড়াল থেকে প্রোডাকশনের এক ছেলে কায়দা করে আপনাদের ছবি তুলে ফেলতো। সেই ছবিগুলো আমিই ছোটখাটো নিউজ পোর্টালদের কাছে পাঠিয়ে দিতাম।”

আরশাদ বহুকষ্টে নিজের ভেতরে ফুটতে থাকা আগ্নেয়গিরি দমন করে চেয়ার ঠেলে সুজানার দিকে এগিয়ে গেল। সুজানা ভয়ে চুপসে যাওয়া সত্ত্বেও চোখ মেলে তাকালো।

আরশাদ হিমশীতল কণ্ঠে বলল,“ছবি-টবি তো নকলই ছিল। কিন্তু আমার জ্যাকেটে তোমার পারফিউমের গন্ধ আসলো কীভাবে?”

সুজানা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “গাড়িতে যখন আপনার সব জিনিসগুলো তোলা হচ্ছিল, তখন আমিই সুযোগ বুঝে আমার পারফিউম মেখে দিয়ে আসি ওই জ্যাকেটে। অরা আপু যাতে ওই পারফিউমটা চিনতে পারে, তাই আগেই একদিন ওটা মেখে ইচ্ছা করে জড়িয়ে ধরেছিলাম উনাকে।”

“শার্টে লিপস্টিকও নিশ্চয়ই তুমি লাগিয়েছিলে?”

সুজানা মাথা নিচু করে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।

চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে রাগমিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চমৎকার! আমার আর সিনেমা করার দরকার কী? আমার নিজের জীবনটাই তো আস্ত সিনেমায় পরিণত হয়ে গেছে!”

সুজানা এবং মাহমুদ দুজনেই ভয়ে জবুথবু হয়ে গেছে। কাজটা করার আগে একবারও কেন তাদের মাথায় এলো না, যার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে তারা, সেই মানুষটা কতটা ভয়ানক!

আরশাদ বিড়বিড় করে বলল, “একটা মানুষ জেলে বসে কীভাবে এত বড় ষড়যন্ত্র করতে পারে?”

আরশাদ আবারও মাহমুদের মুখোমুখি গিয়ে বসলো। সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “তোর মতো চুনোপুটি আমার ক্ষতি করার সাহস সাত জন্মেও করতে পারে না। কে আছে এসবের পেছনে? নওশীন তাই না?”

মাহমুদ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরশাদের দিকে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।

নিজের চকচকে কালো জুতোটা দিতো আরশাদ চেপে ধরলো মাহমুদের উন্মুক্ত পায়ের পাতা।

মাহমুদ ব্যথায় আঁতকে উঠতেই আরশাদ গর্জন দিয়ে বলল, “বল!”

মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে পরিণতি তো ভালো হলো না খুব একটা। মাহমুদ তাই এবার সত্যির পথটাই বেছে নিলো।

মাহমুদ ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বলল, “না স্যার!”

মনে মনে দারুণ বিস্মিত না হয়ে পারলো না আরশাদ। কাল অরা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর থেকেই আরশাদের দৃঢ় ধারণা এসব কিছুর পেছনে রয়েছে নওশীন। সে ছাড়া আর কে চাইবে আরশাদের সাজানো সংসার ভেঙে তছনছ করতে? তার চাকচিক্যে উজ্জ্বল ক্যারিয়ারকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে আসতে?

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তাহলে?”

“শাফকাত আলম।”

চোখ বন্ধ করে আরও একবার রাগমাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। নিজেকেই দোষারোপের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। তার যে শত্রুর অভাব নেই, এই কথাটা বারবার ভুলে যায় কেন সে?

(চলবে)