ফিরে_আসা২ পর্ব-৬৪+৬৫+৬৬

0
497

#ফিরে_আসা২
৬৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আলস্য গায়ে মেখে বিছানায় পড়ে আছে অরা। জানালার ফাঁক দিয়ে শীতল হওয়া বয়ে আসছে। কেমন শীত শীত করছে তার। ব্যাঙ্কেট গলা পর্যন্ত টেনে নিয়ে চোখদুটো বুজে রইলো সে। ঘুমেই কেন জানি পৃথিবীর সমস্ত শান্তি লুকিয়ে রয়েছে। যতক্ষণ জেগে থাকে, নিজেকে সহ্য করতে পারে না অরা। বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরশাদকে তার বলা ওই কথাগুলো।

আরশাদকে তো সে সবথেকে বেশি ভালোবাসে। নিজের থেকেও বেশি। তাহলে কী করে পারলো তাকে এতটা আঘাত করতে? আরশাদের সকল ক্ষতগুলো পরম যত্নে সারিয়ে তুলেছিল যে মানুষটা, সে কী করে পারলো নতুন একটা ক্ষতর জন্ম দিতে? অরা জানে না, বুঝতে পারছে না নিজেকে। সেদিন পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল নিজেই। ওই ছবিগুলো এতটাই জীবন্ত লাগছিল সে, একবারের জন্যেও তার মাথায় এই চিন্তা আসেনি যে সুজানা আরশাদকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আরশাদ এমন খারাপ কাজ করতেই পারে না।

তার মন-মস্তিষ্ক ওই মুহূর্তে যৌক্তিক চিন্তার পর্যায়ে ছিল না। চোখের সামনে যা দেখেছে, তাই পরম সত্যি বলে বিশ্বাস করেছে। রাগের বশে ঝোঁকের মাথায় এত বড় একটা ভুল করে ফেলেছে সে। আরশাদকে ছেড়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে। আরশাদকে দেওয়া একমাত্র প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে নির্দ্বিধায়। তার জায়গায় অন্য মেয়ে থাকলে কি একই কাজ করতো না? না-কি অমন পরিস্থিতিতেও নিজেকে সামলে যৌক্তিক চিন্তা করতে পারতো?

কিছুক্ষণ আগে অরার মনটা আরও বেশি খারাপ করে দিয়েছে আশফিয়া। অবশ্য তাকে দোষ দিয়েও কোনো লাভ নেই। সব দোষ অরা নিজেকেই দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। ঝোঁকের মাথায় বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে একটাবারের জন্যেও তার মনে পড়লো না কথার কথা। এমন তো নয় কথাকে সে ভালোবাসে না। প্রয়োজনের থেকেও অতিরিক্ত ভালোবাসে। তবুও কেন মস্তিষ্কে কেন না তার চিন্তা? এতটা নিষ্ঠুর কী করে হতে পারলো সে?

কাল রাতে অরা যখন এসেছে, ততক্ষণে কথা ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে উঠে বাড়িতে অরাকে দেখে তার বিস্ময়ের শেষ নেই। কথাকে দেখেই অরা নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। কথা বড়দের চোখে জল সহ্য করতে পারে না।

সে নিজেই কেঁদে ফেলে বলল, “তুমি আমাকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলে মাম্মাম?”

‘মাম্মাম’ – কথার মুখে এই ডাকটা যেন অরার হৃদয়কে কয়েক খন্ডে বিভক্ত করে আবারও জোড়া লাগিয়ে দিলো। নিজের প্রতি ঘৃণা আর অনুতাপ বেড়ে আকাশ স্পর্শ করলো। সে তো কখনো কথাকে মা জাতীয় কিছু ডাকার জন্যে জোর করেনি। ভেবেছিল সেটা তার অধিকারে নেই। তবে কথা আজ যখন নিজ থেকেই ডাকলো, মনে হলো যেন এই ডাকের জন্যেই হাজার বছর অপেক্ষা করে ছিল সে।

আজ স্কুলে না গিয়ে সারাটা সকাল কথা অরার সাথেই কাটিয়ে দিলো। দুপুরের পরেও অরার নিচতলার ঘরে দুজনে শুয়ে শুয়ে গল্প করছে।

হঠাৎ আশফিয়া ঘরে এসে থমথমে গলায় বলল, “এই কথা! এখানে কী করছিস? হোমওয়ার্ক করতে যা।”

কথা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমার তো কোনো হোমওয়ার্ক নেই।”

আশফিয়া তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “হোমওয়ার্ক না থাকলে পড়তে বস, শুধু শুধু সময় নষ্ট করতে হবে না।”

অরা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “থাক না আপা। এই সময়ে কথা এমনিতেও পড়তে পারে না।”

আশফিয়া কঠিন গলায় বলল, “কথাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। ওকে ফেলে যখন চলে গিয়েছিলে তখন এত চিন্তা কোথায় ছিল তোমার?”

অরা কিছুই বলতে পারলো না। কোনো উত্তরই যে নেই তার কাছে। ফুপির ধমকের তীব্রতা আঁচ করে কথা আগেভাগেই নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আশফিয়াও অগ্নিকন্ঠে বলল, “অন্যের সন্তানের প্রতি যতই দরদ দেখাও না কেন, তাকে কখনো নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে পারবে না। কথা তোমার নিজের সন্তান হলে পারতে কখনো তাকে এভাবে ছেড়ে যেতে?”

প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করলো না আশফিয়া। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তবে তার প্রশ্নটা যেন কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো অরাকে। কথা তার নিজের সন্তান হলে আবার কী? কথা তো তার নিজেরই সন্তান। তবুও একবারের জন্যে তার চিন্তা আসেনি মস্তিষ্কে। কথার জায়গায় অরার পেটের ভেতরে লুকিয়ে থাকা মানুষটা থাকলেও এমনটাই হতো। পরিস্থিতির উত্তপ্তটা তার কাণ্ডজ্ঞান কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। অথচ আশফিয়া ভাবলো, কথাকে সে জন্ম দেয়নি বলে হয়তো তার প্রতি কোনো টান নেই।

এক হাতে চোখের কোণে জমতে থাকা জলের কণা সাবধানে মুছে ফেলল অরা। আশফিয়াকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তার রাগটা স্বাভাবিক। অরা যা করেছে, তার তুলনায় তার ওই রাগ কিছুই নয়। এর থেকেও আরও খারাপ কিছু হতে পারতো অরার সঙ্গে।

অরার বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করছে। এই হাহাকার কীসের, সে নিজেও জানে না। আরশাদের সামনেও স্বাভাবিক হতে পারছে না সে। মনের মাঝে হাজার কথা জমে থাকলেও বলতে পারছে না। আরশাদ সামনে এলেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে, লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে। যদিও আরশাদ খুব স্বাভাবিক। সকাল থেকে অরার যত্ন নিলো। তাকে নিজ হতে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিলো, এটা ওটা জিজ্ঞেস করলো। এমন ভাব যেন গত দুদিন তাদের জীবনে আসেনি কখনো। আসলেই তো! এই দুটো দিন জীবনে না এলে কী এমন ক্ষতি হতো?

বালিশের পাশে হাতড়ে ফোনটা হাতে নিলো অরা। তার ভাঙা ফোন আরশাদ সারিয়ে ফেললেও সেটা আর ব্যবহার করতে দেয়নি তাকে। আজ সকালে এই নতুন ফোনটা এনে দিয়েছে তার জন্যে।

মনের অজান্তেই অরা ডায়াল করলো আরশাদের নম্বরে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে খুব তার সঙ্গে। মানুষের যখন খুব অসহায় লাগে, ভালোবাসার মানুষের কাছেই আশ্রয় খোঁজে সে। কিন্তু এটা কি আরশাদের প্রতি অন্যায় হয়ে গেল না? নিজের অসহায়ত্বে আরশাদকে পাশে পেতে চাইছে, অথচ তার অসহায়ত্বে অরা ফেলে চলে গিয়েছিল তাকে। এক বুক অনুতাপ নিয়ে ফোনটা কানের ওপর রেখে পাশ ফিরে শুয়ে রইলো অরা।

ছাদের রেলিং ঘেঁষে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে আরশাদ। মিষ্টি একটা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কাছেই কোথায় মেঘ ডাকছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো বৃষ্টি নামবে। আকাশের মেঘেরা এসে জমেছে। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার হাতে থাকা জিনিসটার দিকে তাকালো।

এই হার্ডড্রাইভে রয়েছে ‘দিগন্ত’ সিনেমার ধারণ করা সকল ফুটেজ। শাফকাতের ধ্বংসের পরিকল্পনা করার সময় থেকেই এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিল আরশাদ। এই সিনেমা মুক্তি পাবে না। পদে পদে যে সিনেমার সঙ্গে অভিশাপ জড়িয়ে আছে, তাকে দর্শকের সামনে এনে ক্যারিয়ারে স্থায়ী জায়গা দিতে চায় না। এই সিনেমা মুক্তি না দিলে কে ফিল্মসের বিশাল ক্ষতি হবে এটা সত্যি, তবে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তবুও এই সিনেমা মুক্তি পেতে দেবে না আরশাদ।

হার্ডড্রাইভটা ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিলো আরশাদ। মুহূর্তেই তা ভেঙে কয়েক খন্ডে চুরমার হয়ে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আরশাদ। এই সিনেমা মুক্তি না পেলেও, ‘দিগন্ত’ ঠিকই মুক্তি পাবে। আবারও নতুন করে এই গল্পে, নতুন পরিচালক দিয়ে সিনেমাটা তৈরি করবে আরশাদ।

সিঁড়ির দিকে আরশাদ পা বাড়াবে তখনই বেড়ে উঠলো তার ফোন। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই দেখলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অরার নাম। প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে।

যে ঘটনা ঘটে গেল তার পর কি আরশাদের উচিত ছিল অরার ওপর রাগ করা? সে জানে না। অরাকে সহজে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্যে আপার কাছে কয়েক দফা ধমকও খেয়েছে আরশাদ। তবে তার তো কোনো রাগই নেই অরার প্রতি! মেয়েটা একটা ভুল করে ফেলেছে। ভুল কি মানুষ করে না?

ফোন রিসিভ করতেই অরা ওপর প্রান্ত থেকে অস্পষ্ট গলায় বলল, “আরশাদ?”

আরশাদ মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “অরা?”

এক মুহূর্তের নীরবতা শেষে দুজনেই ক্ষীণ হাসলো। ভালোবাসে মানুষ একে অপরকে কত আদরের ডাকনাম দেয়! তারা তেমন কিছুই করেনি কখনো। একে অপরের নামেই এমনভাবে ডাকে, যেভাবে ডাকার সাধ্য এই পৃথিবীতে কারো নেই।

অরা থেমে থেমে বলল, “কোথায় তুমি?”

আরশাদ হালকা বলল, “একটু ছাদে এসেছিলাম। কিছু লাগবে তোমার?”

“না, এমনিই। কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।”

আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “আচ্ছা, আসছি আমি।”

অরা আঁতকে উঠে ইতস্তত করে বলল, “না থাক, ফোনেই কথা বলি। তোমাকে মুখ দেখাতে আমার লজ্জা লাগে। কথা বলতে তো আরও বেশি লজ্জা লাগে।”

অরার ভেতরটা বুঝতে পারছে আরশাদ। যতই সে অরাকে কমফোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, দিনশেষে মেয়েটার মাঝে একটা অস্বস্তি থাকবেই। অপরাধবোধও থাকবে। তবে এগুলোর কোনটাই স্থায়ী হবে না। জীবনে আকস্মাৎ আবির্ভূত হওয়া ঝড়গুলোর মতো এই ছোট ছোট সমস্যাও যত্ন নিয়ে নিজ হাতে দূর করবে সে।

আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “বলো কী বলবে।”

অরা চুপ করে রইলো অনেকটা সময়। আরশাদও কিছু বলার জন্যে জোরাজুরি করলো না তাকে। প্রশান্তিময় নীরবতায় গা ভাসালো দুজনে। একদিকে কথা মনের মাঝে অনবরত কথা খুঁজে বেড়াচ্ছে, আরেকদিকে আরশাদ কান পেতে শুনছে তার ভালোবাসার মানুষটার কম্পিত নিঃশ্বাসের ধ্বনি।

অবশেষে দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে অরা বলল,
“ছোটবেলা থেকে আমার সাথে যা যা হয়েছে, তার পরে আমি তো কোনোদিন আশাও করিনি কারও ভালোবাসা পাবো। কিন্তু যখন পেলাম, আমার জীবনটা আষ্টেপৃষ্ঠে গেল ভালোবাসায়। পাগল করে দিলো আমাকে। এত ভালোবাসো কেন আমাকে আরশাদ?”

আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “তুমি এমনভাবে বলছো যেন অসহ্য লাগে আমার ভালোবাসা!”

অরা আর্দ্র গলায় বলল, “অসহ্য না, অসহনীয়। অতিরিক্ত কোনো কিছুই মানুষ সহ্য করতে পারে না। অতিরিক্ত ভালোবাসো তুমি আমাকে আরশাদ। পৃথিবীতে কেউ কি কোনোদিন কাউকে এতটা ভালোবেসেছে?”

আরশাদ সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে বলল, “বেসেছে তো। তুমি আমাকে বেসেছো।”

অরার বুকটা যেন হুহু করে উঠলো। চোখের কোণে আবারও জল জমতে শুরু করেছে। শুরু থেকেই যে জানে, এতটা ভালোবাসার যোগ্য সে নয়। আজ পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল। আরশাদের জায়গায় অন্য কোনো ছেলে থাকলে কী করতো? অরার অমন ব্যবহারের পর, তার ভালোবাসাটাকে মিথ্যা স্বীকৃতি দিয়ে দিতো। ভাগ্যিস আরশাদের জায়গায় আরশাদই আছে। আরশাদ জানে, পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে একটা ভুল করে ফেলেছে অরা। ভুল করলেও তার মনে আরশাদের প্রতি ভালোবাসা কমেনি একবিন্দুও।

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “আমার তো মনে হয় না। আমার মনে হয় না, আমি তোমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারি। আমার মনে হয় না, আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য।”

আরশাদ শান্ত কণ্ঠে বলল, “আর এমনটা মনে হওয়ার কারণ কী?”

অরা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “আমি তোমাকে বোঝার চেষ্টা করি না আরশাদ। একেবারেই না। সেই স্পাই ক্যামেরার ঘটনার পর রাগ পুষে রেখেছিলাম তোমার ওপরে। একবারও ভেবে দেখিনি, যে মানুষটা আমাকে এত ভালোবাসে, কী এমন হলো যে সে এমনটা করতে বাধ্য হলো। আর এবারের ঘটনায় তো সব লিমিট ক্রস করে ফেললাম।”

আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলে না? স্পাই ক্যামেরার ঘটনায় সব দোষ আমার ছিল। তারপরেও তো ক্ষমা করে দিয়েছিলে আমাকে। আমার ভেতরটা আমার থেকেও ভালো করে বুঝেছো তুমি। তাহলে কেন বলছো বোঝার চেষ্টা করোনি আমাকে?”

অরা চুপ করে রইলো। সে যে কাঁদছে নিঃশব্দে, বুঝতে দিতে চাইছে না আরশাদকে।

আরশাদ আবারও বলল, “অরা শোনো, আর কখনোই এই ঘটনার জন্যে নিজেকে দোষ দিবে না। যদি কারো দোষ থেকেই থাকে, সেটা আমার স্টারডমের, আমাদের কে ফিল্মসের সাফল্যের।”

অরা ভাঙা গলায় বলল, “তবুও, বাইরের মানুষ ষড়যন্ত্র করে আমাদের আলাদা করে দেওয়ার চেষ্টা করলো, আর আমি বোকার মতো সেই ষড়যন্ত্রে পা দেওয়ার আগে দুবার ভাবলাম না? তোমাকে একটা বারের জন্যেও বোঝার চেষ্টা করলাম না?”

আরশাদ অরাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “আমি বুঝি তোমাকে অরা। আমি জানি, সেদিন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারোনি তুমি। চোখের সামনে ওই আসলের মতো নকল ছবিগুলো দেখলে যে কারোরই মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। যতই বিশ্বাস থাকুক না কেন আমার ওপরে, ওরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে ঠিক রাখা সম্ভব না।”

অরা কতক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “দেখেছো, বললাম না। অতিরিক্ত ভালোবাসো আমাকে তুমি।”

আরশাদ হেসে বলল, “তুমিও তো বাসো। না-কি বাসো না?”

অরা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “বাসি!”

আবারও বয়ে গেল নীরবতাময় হাওয়া। বহুক্ষণ পর শ্বাস নিতে পারছে অরা। বুকের ওপরে যেন এতক্ষণ যেন কেউ ভারী পাথর চেপে ধরে রেখেছিল। পাথরটা সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে একটু কথা, সব দুর্যোগ কাটিয়ে দিতে সক্ষম।

অরা ভেজা গলায় বলল, “অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না তোমাকে?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হুঁ, দিয়েছো।”

অরার কী যে হলো, নিমিষেই ভেঙে পড়লো কান্নায়। এতক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদলেও এখন আর অস্ফুট আওয়াজ লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না।

কাঁদতে কাঁদতেই অরা বলল, “বিশ্বাস করো আরশাদ, আমি ইচ্ছা করে কষ্ট দিইনি তোমাকে। রাগের মাথায়, নিজেকে সামলাতে না পেরে মনে যা এসে তাই বলেছি। ওই কথাগুলো একটাও আমার মনের না।”

আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “আরে আশ্চর্য! তুমি আবার কান্না শুরু করলে? কষ্ট দিয়েছো তো কী হয়েছে, আমি কী মন খারাপ করেছি না-কি?”

অরা কেঁদেই যাচ্ছে অনবরত।

আরশাদ আবারও মমতামাখা গলায় বলল,
“প্লিজ কেঁদো না অরা। আমি তো তোমারই। আমাকে কষ্ট দেওয়ার অধিকারও একমাত্র তোমার।”

অরা কান্না না থামিয়েই বলল, “সত্যি ক্ষমা করেছো আমাকে আরশাদ? কোনদিন পারবে ক্ষমা করতে?”

আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “করেছি তো! কাঁদে না, বোকা মেয়ে একটা!”

নিজেকে একটু একটু করে শান্ত করে নিলো অরা।

আরশাদ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কত বড় একটা ঝড় বয়ে গেল না? সব কিছু যেন এলোমেলো করে দিয়ে গেল।”

অরা জোর দিয়ে বলল, “করুক! আমরা আবার সাজিয়ে নেবো।”

“অরা?”

“হুঁ?”

“আমার সাথে একটা প্রমিজ করবে?”

“করবো।”

আরশাদ হেসে বলল, “কী প্রমিজ না জেনেই রাজি হয়ে গেলে?”

অরা বাচ্চাদের মতো বলল, “তুমি যা বলবে, তাই করবো!”

আরশাদ মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “জীবনে যত বড় ঝড়ই আসুক না কেন, আমরা একে অপরের পাশে থাকবো। কখনো এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্বাস হারাবো না। আর একে অপরকে অনেক অনেক ভালোবাসবো।”

অরা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “প্রমিজ।”

আরশাদও বলল, “প্রমিজ।”

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “একটা কথা বলবো আরশাদ?”

আরশাদ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “সিরিয়াসলি?”

হেসে ফেলল দুজনের। ভারী কথোপকথনের ভার নিমিষেই চলে গেল যেন। আরশাদের ম্যানেজার অরা প্রত্যেকটা কথা বলার আগে তার অনুমতি চাইতো। বউ হওয়ার পরও অভ্যাস আর গেল না তার।

অরা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “আমার ওপর রাগ পুষে রেখো না। অভিমানও না। রাগ করে থাকলে এখনই তার প্রকাশ করো। আমাকে ধমক দাও, শাস্তি দাও। তবুও রাগ করে থেকো না।”

আরশাদ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “আমার রাগ দিয়ে পুরো পৃথিবীটা শেষ করে দিতে পারি অরা, তুমি বাদে।”

চুপ করে রইলো অরা। অনুভূতিরা যেন ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে মনের মাঝে। একবার অনুতাপে মনটা পুড়ছে আবার পরমুহুর্তেই ভাসছে আরশাদের ভালোবাসার স্রোতে।

দুজনের মধ্যকার এই গাম্ভীর্য দূর করতেই হয়তো আরশাদ হঠাৎ হালকা গলায় বলল,
“হ্যাঁ তবে, শাস্তি তুমি পাবেই। সেটা থেকে রেহাই নেই।”

অরা চিন্তিত গলায় বলল, “কী শাস্তি?”

আরশাদ দুষ্টুমির স্বরে বলল, “এখনই শুনতে চাচ্ছো, না-কি বাবু আসার পর একেবারে প্রাক্টিক্যালি দেখবে?”

মুহূর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে অরা বলল, “তোমার মতো অসভ্যকে ফোন করাটাই আমার ভুল হয়েছে।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তাই না? এতটুকুতেই অসভ্য হয়ে গেলাম? দাঁড়াও এসে দেখাচ্ছি অসভ্যতা কাকে বলে!”

ফোনটা কেটে দিলো আরশাদ। একা একা আনমনে হেসে উঠলো অরা। তাদের শেষের কথোপকথনটুকুই জানান দিচ্ছে, সব ঠিক হয়ে গেছে তাদের মাঝে। সব হয়ে গেছে আগের মতো।

বিছানা থেকে উঠে বসলো অরা। চোখের ওপর এসে পড়া এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিলো। যে মানুষটার মুখোমুখি হতে কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত সংকোচ বোধ করছিল, সেই মানুষটার মুখোমুখি হওয়ার জন্যে যেন আর তর সইছে না তার। একটা কথোপকথন কতটা শক্তিশালী হতে পারে!

কয়েক মিনিটের মাঝেই দরজাটা খুলে গেল বাইরে থেকে। আরশাদ অরার দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ব্যস্ত হয়ে পড়লো দরজায় লকের পাসওয়ার্ড অ্যাক্টিভেট করতে। লজ্জায় কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেল অরা।

বাইরের ঝড়ো হাওয়া ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মেঘের গর্জন। আরশাদ দরজার কাছে দাঁড়িয়েই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরার দিকে। যে দৃষ্টিতে কেবলই ছড়াছড়ি মুগ্ধতার। দোটানায় পড়ে গেছে অরা। লজ্জায় মুখ নামিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছে। আবার ওই মোহময় মুখটাও টানছে তাকে পাগলের মতো।

ছোট ছোট পা ফেলে আরশাদ এসে বসলো অরার সামনে। চোখদুটো নিচে নামিয়ে রেখেছে অরা। তবে কতক্ষণ? আরশাদ তার চিবুক স্পর্শ করে মুখটা তুলে ধরতেই তাকাতে হলো তাকে আরশাদের দিকে।

দুজনের চোখে ভেসে উঠতে একে অপরকে বলা-না বলা হাজারটা কথা। ভেসে উঠেছে মনের গভীরতম স্তরে একে অপরের জন্যে পালন করা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো। চোখে এত স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটতে পারে, কে জানতো?

অরার কানের নিচে হাত দিয়ে মোহনীয় স্পর্শে মোহাবিষ্ট করে তুললো তাকে আরশাদকে। অরা আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঠোঁট নিজের ঠোঁটের স্পর্শে মিশিয়ে দিলো আরশাদ। দিশেহারা অরা খামচে ধরলো আরশাদের টি-শার্ট। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে শুরু হলো তুমুল বর্ষণ। বাইরে বৃষ্টির ধ্বনি আর ভেতরে ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসাময় স্পর্শ। পাগল হয়ে যাচ্ছে অরা।

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৬৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ঘুম ভাঙতেই চুলের ভাঁজে এক যাদুকরী ছোঁয়া টের পেলো অরা। আনমনে প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। পিটপিট করে চোখদুটো মেলে তাকাতেই দেখলো সেই স্পর্শের মালিক মোহগ্রস্ত দৃষ্টিতে আছে তার দিকে। চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে। লজ্জায় আবারও চোখদুটো বুজে ফেলল অরা।

আরশাদ ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “উঠলেন এতক্ষণে ম্যাডাম?”

অরা চোখদুটো বুজে রেখেই অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ!”

আরশাদ এখনো একদৃষ্টিতে দেখেই যাচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষটাকে। চোখদুটো তার আজকাল বড্ড অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। অরার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই পারে না সে। অবশ্য তার প্রয়োজনও নেই। এই মেয়েটাকে যতক্ষণ দুচোখ ভরে সে দেখে ততক্ষণই মনের শান্তি।

আরশাদ এগিয়ে গিয়ে অরার কপালে চুমু খেয়ে বলল,“Good morning!

অরা মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “Good morning!”

আরশাদ সরে যেতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। একটা মানুষের উঠে বসাও এত সুন্দর হতে পারে? ঘোরগ্রস্ত আরশাদ তাকে দেখেই যাচ্ছে নিষ্পলকভাবে।

অরা হাই তুলতে তুলতে বলল, “কয়টা বাজে?”

আরশাদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “প্রায় নয়টা।”

অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আক্ষেপের সুরে বলল, “আর আমি না-কি এক কালে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতাম! এতক্ষণে আমার অর্ধেক দিন শেষও হয়ে যেত। সব বদভ্যাস করে দিচ্ছে তোমার বাবুটা।”

আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে উঠে বসতে বসতে বলল, “শোধ তুলছে।”

অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “শোধ?”

আরশাদ হেঁয়ালির সুরে বলল, “হুঁ, ওর বাবার মাঝে এত এত বদভ্যাস ছড়িয়ে দিয়েছো। ও তাই আমার হয়ে তোমার মধ্যে বদভ্যাস তৈরি করছে।”

অরা অবাক গলায় বলল, “আমি আবার তোমার কোন বদভ্যাস করলাম?”

আরশাদ একেবারে অরার কাছাকাছি গিয়ে তার কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। চোখদুটো বন্ধ কেঁপে উঠলো অরা। আরশাদ কাছে এলেই যেন অবরাধিতভাবে এলোমেলো হয়ে যেতে হবে তাকে।

আরশাদ ফিসফিস করে বলল, “এই যে, ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানায় পড়ে থাকি তোমার ঘুমন্ত মুখটা দেখার জন্য। যেখানেই যাই, যা-ই করি ঘুরেফিরে শুধু তোমার চিন্তায়ই ফিরে যাই। কোনো গান শুনলে মনের অজান্তেই মনে মনে তার প্রতিটা কথা উৎসর্গ করি তোমাকে। বৃষ্টি দেখলেই তোমার সঙ্গে ভিজতে ইচ্ছা করে। এগুলো বদভ্যাস ছাড়া আর কী? সব দোষ তোমার! একটু একটু করে পাগল করে দিয়েছো আমাকে।”

চোখ মেলে আরশাদের ঘোর লাগা চোখের দিকে তাকালো অরা। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে সে একটু একটু করে। এই হারিয়ে যাওয়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সকল আনন্দ।

হঠাৎ দরজায় টোকা পড়তেই সংবিৎ ফিরে পেলো অরা। দরজার অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো সেলিনা হকের কণ্ঠস্বর, “বৌমা উঠেছো?”

অরা উঁচু স্বরে বলল, “জি মা!”

সেলিনা হক মমতাময়ী কণ্ঠে বললেন, “এসো তাড়াতাড়ি, এতক্ষণ খালি পেটে থাকতে নেই।”

সেলিনা হক সিলেট থেকে চলে এসেছেন তিন দিন হলো। এই সময়টাতে একটা মেয়ের বেশি বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে বাবু আসার পর মা ও শিশু দুজনেরই যত্নের প্রয়োজন হবে। আরশাদ যদিও আগামী চার মাসের জন্য সকল কাজ থেকে বিরতি নিয়েছে। তবুও বেচারা একা হাতে কতদিক সামলাবে?

কাল অরাকে ডক্টরের কাছে শেষ চেকআপের জন্যে নিয়ে গিয়েছিল আরশাদ। ডক্টর নাসরিন স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এ সপ্তাহেই যেকোনো দিন অরার লেবর শুরু হয়ে যাবে। তাই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

আশফিয়াও অফিস থেকে বিরতি নিয়ে এ বাড়িতেই থাকছে। কথাকে সে সামলাচ্ছে। তাকে সকালবেলা স্কুলে নিয়ে যাওয়া, হোমওয়ার্ক করানো, গল্পের বই পড়ে শোনানো, তার সঙ্গে টিভি দেখা – সবকিছুই অতি আগ্রহ নিয়ে করছে। অরার প্রতি তার মনে জমে থাকা রাগটা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। বরং মায়াই হচ্ছে। আহারে! মেয়েটা প্রেগন্যান্সির এই কঠিন সময়েও কত বড় একটা ঝড় পাড় করলো।

নাস্তার টেবিলে পাশপাশি বসে আছে আরশাদ আর অরা। তাদের বিপরীতে পাশাপশি বসে আছে কথা আর সেলিনা হক। সেলিনা হক যত্ন নিয়ে নাতনিকে নাস্তা খাইয়ে দিচ্ছেন। আরশাদেরও বউকে খাইয়ে দেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা জেগে উঠলো। ভদ্রতার খাতিরেই সেই ইচ্ছা দমন করলো বহু কষ্টে।

আশফিয়ার মতে, “একটা মানুষ যদি নিজের কথা ভাবতে না শেখে তাহলে আর দশটা মানুষের কথা ভাববে কী করে?” নিজের কথা সে খুব ভাবে। তাই সকাল সকাল নাস্তা বানিয়েই আগে নিজে খেয়ে নিয়েছে। বাকিদেরটা পরে দেখা যাবে।

কাল সন্ধ্যায় আশফিয়া শুনেছে অরা এক স্টাফকে বলছে, তার খুব আলু-পরোটা খেতে ইচ্ছা করছে। বাবুর্চি আব্দুরকে যেন সে বলে আজ ব্রেকফাস্টে আলু পরোটা বানাতে। আব্দুরকে সেই সুযোগ না দিয়ে সে নিজেই যত্ন নিয়ে বানালো। অরা যাতে মনে না করে তার সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে গেছে, সেজন্যে ভ্রু কুঁচকে হেঁটে হেঁটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অরার প্লেটে রাখলো আরও একটা পরোটা।

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আপা আমি আর খেতে পারবো না।”

আশফিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “পারবে না মানে কী? এত কম খাবার-দাবার স্বাভাবিক মানুষই খায় না। আর তুমি তো প্রেগন্যান্ট।”

“আমি সত্যি আর পারবো না আপা।”

আশফিয়া ধমকের সুরে বলল, “কথায় কথায় বেয়াদবি করবে না তো অরা, চুপচাপ খাও।”

আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে আবারও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো আশফিয়া। ধমকে চুপসে অসহায় ভঙ্গিতে প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। ছোট্ট এই ঘটনায় মজা পেয়ে ফিক করে হেসে ফেলল কথা।

অরা ফিসফিস করে আরশাদকে বলল,“তোমাদের বংশে কী সবারই এমন বেশি রাগ?”

আরশাদ দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “অবশ্যই। হক হতে হলে রাগ থাকাটা ম্যান্ডেটরি।”

অরা পেটে হাত রেখে গোমড়া মুখে বলল,
“ভালো চিন্তায় পড়া গেল তো!”

আরশাদ হেসে বলল, “চিন্তার কিছু নেই। তুমি একেবারে নিশ্চিত থাকো বাবুও অসম্ভব রাগী হবে। দেখো না, কেমন হঠাৎ হঠাৎ তোমাকে কিক মেরে বসে।”

অরা অবিশ্বাসের সুরে বলল, “নাহ্! আমার বাবু আমার মতোই শান্ত হবে।”

আরশাদ বিস্ময় নিয়ে বলল, “কে বলল তোমার রাগ নেই?”

লজ্জা পেয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো অরা। ওই ঘটনা মনে পড়লেই তার মাঝে অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপারটা আরশাদেরও বুঝতে বাকি রইলো না। তাই দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে মায়ের সঙ্গে তার আর আপার ছোটবেলার গল্প শুরু করলো। অরাও হাসিমুখে অংশ নিলো সেই গল্পে।

ব্রেকফাস্ট শেষে আরশাদ আর অরা বসার ঘরের টিভির সামনে গিয়ে বসলো। টিভিতে দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। দুজন বয়স্ক লোক গম্ভীর মুখে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে আলাপ করছে। আরশাদ তাদের থেকেও গম্ভীর মুখ করে সেই আলাপ শুনছে। এমন একটা ভাব যেন পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। অথচ বাজারে কোন জিনিসের দাম কত, তাই সে জানে না।

অরা অবাক গলায় বলল, “এই আরশাদ! কী হলো তোমার? বুড়োদের মতো টক-শো দেখছো কেন?”

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “তো কী করবো? সবগুলো চ্যানেল ঘুরে এই একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস পেলাম। তাহলে চিন্তা করো, অন্য চ্যানেলগুলোতে কত বোরিং জিনিস দেখাচ্ছে!”

“একটা সিনেমা ছাড়ো!”

অরার বুদ্ধিটা পছন্দ হলো আরশাদের। যদিও সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি এই সময়টা সিনেমা দেখার জন্যে আদর্শ নয়। এই সময়টা কর্মব্যস্ততার। যেহেতু তাদের দুজনেরই কোনো কাজ নেই, তাই ঢুকে পড়লো নেটফ্লিক্সে। এত এত সিনেমার মাঝে একটা সিনেমা বেছে নেওয়াও কঠিন।

কঠিন কাজটা অরাই করলো। বেছে নিলো স্প্যানিশ সিনেমা ‘মির‍্যাজ’। সিনেমাটির গল্প চমৎকার। নতুন বাড়িতে এসে একটা মেয়ে আবিষ্কার করে তার বাড়ির পুরনো টিভিটা দিয়ে যোগাযোগ করা যায় অতীতের এক ছোট্ট ছেলের সঙ্গে। বিশ বছর আগে ওই ছোট্ট ছেলেটা এই বাড়িতেই থাকতো। ঘটনাক্রমে মেয়েটা আরও জানতে পারে, ছোট্ট ওই ছেলেটা এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এখন তাকে অতীতের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছেলেটাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

আরশাদ আর অরা দুজনেই প্রবল আগ্রহ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে চরিত্রদের পরবর্তীতে পদক্ষেপ কী হবে এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপও করছে।

হঠাৎ বসার ঘরে এলেন সেলিনা বেগম। তার হাতে বাটিভর্তি কেটে রাখা পাকা পেঁপে। এই ফলটা না-কি গর্ভবতী মেয়েদের জন্যে খুবই উপকারী। অরা বাধ্য মেয়ের মতো বাটি হাতে নিয়ে কাঁটাচামচ দিয়ে পেঁপে খেতে শুরু করলো। তবে আর আগ্রহ ভরা চোখদুটো টিভির দিকেই আটকে আছে।

সেলিনা হক বিজ্ঞ গলায় বললেন, “বৌমা, এভাবে এক জায়গায় বসে থাকাটা কিন্তু ঠিক না। সামনেই তোমার ডেলিভারি। একটু নড়াচড়া না করলে তো ডেলিভারির সময়ে সমস্যা হবে।”

অরা ভাবলেশহীন গলায় বলল, “সেটা আপনার ছেলেকে বোঝান মা। সে আমাকে নড়াচড়াই করতে দেয় না।”

সেলিনা হক ছেলেকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “এই আরশাদ! বেশি বুঝিস তুই? যা বৌমাকে নিয়ে বাগান থেকে হেঁটে আয়।”

সেলিনা হক চলে যেতেই আরশাদ আহত বলল, “কোনো রেসপেক্টই নেই আমার এই বাসায়!”

সিনেমা দেখা আপাতত বন্ধ রেখে বাগানে হাঁটতে এলো তারা। দ্রুত গতিতে হাঁটা এখন আর সম্ভব নয় অরার পক্ষে। ছোট ছোট পা ফেলে একটু একটু করে আগাচ্ছে সে। আরশাদ তার একটা হাত অরার কাঁধে রেখে আরেক হাতে তার হাত ধরে আছে। অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেছে অরা।

আরশাদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কষ্ট হচ্ছে?”

“কিছুটা।”

“এজন্যেই তো তোমাকে বেশি একটা হাঁটা-চলা করতে বারণ করি!’

অরা হেসে বলল, “তাও একটু হাঁটি আরশাদ। মা বলল না, ডেলিভারির সময়ে না-কি অসুবিধা হতে পারে।”

আরশাদ কোমল কণ্ঠে বলল, “আর মাত্র কয়েকটা দিন! তারপরেও বাবু আমাদের কাছে।”

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আচ্ছা আরশাদ! এমনও তো হতে পারে যে আজই লেবর পেইন উঠলো, আর আজই বাবু পৃথিবীতে চলে আসলো!”

বাবুর আজকেই পৃথিবীতে চলে আসার ধারণায় প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটে। বাবুকে দেখার জন্যে যেন আর তর সইছে না তার।

হাসিটা ধরে রেখেই আরশাদ বলল, “হতেই পারে।”

আরশাদ খেয়াল করলো অরাকে তার মতো উচ্ছ্বসিত বলে মনে হচ্ছে না। বরং এক খন্ড অন্ধকার যেন নেমে এসেছে অরার চোখেমুখে।

আরশাদ চিন্তিত গলায় বলল, “অরা? তুমি নার্ভাস?”

অরা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “না।”

অরার দু কাঁধে দুই হাত রেখে আরশাদ বলল, “ভয় করছে?”

অরা শুকনো গলায় বলল, “হুঁ। ডেলিভারির এই সময়টা নিয়ে মানুষের কত ভীতিকর গল্প শুনেছি। খুব তাড়াতাড়ি আমাকেও ওই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এজন্যেই ভয় করছে।”

আরশাদ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “ভয়ের কিচ্ছু নেই অরা। আমি থাকবো তো তোমার পাশে। তুমি শুধু চিন্তা করো, যার জন্যে এই নয় মাস এত কষ্ট করলে তাকে খুব জলদি নিজ চোখে দেখতে পাবে। কোলে নিয়ে আদর করতে পারবে। দেখবে, সব ভয় কেটে যাবে।”

আরশাদের কথাটা ভেবে দেখলো অরা। আসলেই তো, একবার বাবুর কথা চিন্তা করলেই তার ভয় কেটে যায়। ইদানিং নিজের মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে অরার। সন্তানকে পাওয়ার জন্যে কী কষ্টই না করতে হয় একজন মাকে। হারে হারে এবার তা টের পাচ্ছে অরা।

দুপুরে সেলিনা হক অরার পছন্দের সব খাবার রান্না করলেন। দুপুরের খাবার শেষে আবারও সিনেমাটা নিয়ে বসলো আরশাদ আর অরা। তবে এবার আর বসার ঘরে না। শোবার ঘরের টিভিতে আরশাদের বুকে লেপ্টে সিনেমাটা দেখছে অরা। তবে বারবার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে আরশাদ। একটু পর পর নানা অজুহাতে চুমু খাচ্ছে, সেই সঙ্গে তার অসভ্য হাতটা বিচরণ করে বেড়াচ্ছে অরার সারা শরীরে।

বসার ঘরে সিনেমাটা দেখার সময় কত ভদ্রভাবে বসে ছিল ছেলেটা। বদ্ধ ঘরের আড়ালেই শুরু করে দিয়েছে অসভ্যতা। তবুও, আরশাদের ছোট ছোট এই অসভ্যতাগুলোই যেন মিশে গেছে অরার অস্তিত্বে।

সন্ধ্যার পর আরশাদ আয়োজন করে ব্যাগ গোছাতে বসলো। হসপিটালে যাওয়ার সময় যেন তাড়াহুড়ো না লেগে যায়। একটা ব্যাগ অরার জন্যে আরেকটা ব্যাগ বাবুর। বাবুর ব্যাগে তার জন্যে কিনে রাখা টাওয়াল, নরম কাপড়ের টুকরো, ফিডার, ফ্লাস্ক, বেবি লোশন, বেবি অয়েল, বেবি পাউডার, হাত আর পায়ের মুজা, স্লিপ ম্যাট, সেলিনা হকের সেলাই করে রাখা কাঁথা। আর অরার ব্যাগে কয়েকটা ঢিলেঢালা জামা, স্যানিটারি ন্যাপকিন, বসতে সুবিধার একটা নরম পিলো, তাকে পড়ে শোনানোর জন্যে একটা বই, ডেলিভারির সময় শ্বাস নিতে সুবিধার জন্য চুইং গাম আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস।

মা ও বাবুর ব্যাগ গুছিয়ে আরেকটা ব্যাগে তার ক্যামেরা আর ক্যামেরার ব্যাটারি রাখলো আরশাদ। বাবুর সুন্দর সুন্দর ছবি তুলতে হবে তো! অরা অবাক হয়ে দেখছে আরশাদের কর্মকান্ড। মানুষটা এত সুন্দর করে যত্ন নিতে জানে কী করে?

ব্যাগ গুছিয়ে আরশাদ চলে গেল কথাকে দেখতে। কিছুটা সময় পর ঘরে এলো আশফিয়া। অরার জন্যে তার পছন্দের থাই নুডুলস বানিয়েছে সে।

অরা নুডুলসের বাটি হাতে নিতে নিতে শুকনো গলায় বলল, “আপা? এখনো আমার ওপরে রেগে আছেন?”

আশফিয়া থমথমে গলায় বলল, “রেগে না থাকার মতো কোনো কাজ তো তুমি করোনি।”

অরা অনুতপ্ত গলায় বলল, “আপা আমি বলছি না যা করেছি ঠিক করেছি। ভুল করেছি, জীবনের সবথেকে বড় ভুল। যে ভুলের জন্যে আজীবন অপরাধবোধে ভুগে যাবো।”

অরা যে অপরাধবোধে ভুগছে সেটা তার চোখেমুখেই স্পষ্ট। রাগের ভাবটা ধরে রাখা আর সম্ভব হলো না আশফিয়ার পক্ষে। ধীরেসুস্থে অরার সামনে বিছানায় ওপর বসলো সে।

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “কিন্তু আপা বিশ্বাস করুন, ওই সময়টায় আমার মাথা কাজ করছিল। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা আমি বুঝতে পারছিলাম। না। নিজের মধ্যে ছিলাম না। আমার জায়গায় কেউ না থাকলে সে বুঝবে না আমি কী অনুভব করছিলাম।”

আশফিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “অরা, আর কদিন পর মা হবে। আমার তো আর সেই ভাগ্য হয়নি। আরশাদকেই সন্তানের মতো আগলে রেখেছে আজীবন। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই, কোনো বিপদে পড়লে সবার আগে আপার কাছে ছুটে আসবে। কোনো সমস্যায় পড়লে আপাই সেটা সমাধান করে দেবে। ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না।”

অরা চুপ করে রইলো। আশফিয়া আবারও বলল, “আরশাদ তোমাকে অনেক ভালোবাসে অরা। পাগলের মতো ভালোবাসে। মেন্টালি তোমার ওপর ডিপেন্ডেন্ট আরশাদ। তুমি আশপাশে থাকলেই ও ভালো থাকে। আরশাদকে আর কষ্ট পেতে দিও না প্লিজ।”

অরা সজল চোখে বলল, “কখনো দেবো না আপা।”

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
৬৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

অপেক্ষার মুহূর্তগুলো বড়োই অদ্ভুত। চাপা এক ধরনের অস্থিরতা আর উত্তেজনা কাজ করে এ মুহূর্তগুলোয়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় কিছুটা ক্লান্তিও। অরার যেহেতু অপেক্ষা ছাড়া আর কোনোই কাজ নেই এখন, তাই তার ক্লান্তিটাও একটু বেশি। অরা বুঝতে পারছে, খুব শীঘ্রই তার অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। সারাটাক্ষণ শুধু ওই বহুল প্রতীক্ষিত মুহূর্তটা কল্পনায় ভাসে তার। বাবুকে যখন প্রথম দেখবে সে, কেমন অনুভূতি হবে তার? আরশাদ যখন বাবুকে দেখবে, তার কেমন অনুভূতি হবে? ডেলিভারির সময় যদি অরা অজ্ঞান হয়ে যায়? তাহলে তো দেখতেই পাবে না বাবুকে!

হাজারটা চিন্তা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে তার মাঝে। ভালোলাগা তো আছেই, কিছুটা মন খারাপও আছে বটে। বাবুটা এতদিন তার শরীরের মাঝে লুকিয়ে ছিল। অরা চাইলেই নিজের ভেতরে অনুভব করতে পারতো তাকে। একটা মানুষের লাথি যে এতটা সুখময় হতে পারে, এটা তো বাবুই শিখিয়েছিল তাকে। এসবের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। যদিও অরা নিশ্চিত, বাবুর তার চোখের সামনে আসা এসবের থেকেও হাজারগুণ সুখকর হবে।

অরা বেশ টের পাচ্ছে, আর বেশি দেরি নেই। জলদিই বাবুকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে যাচ্ছে সে। কাল রাতে হঠাৎ পেটের ভেতরটায় কেমন ব্যথা করে উঠলো। মনে হলো যেন পেটের ভেতরটা সংকুচিত হয়ে একটা চাপ দিচ্ছে তাকে। আরশাদ ভয় পেয়ে দ্রুত বেগে ফোন করলো ডক্টর নাসরিনকে। লক্ষণগুলো শুনে তিনি বললেন, এটা ফলস এলার্ম। লেবার পেইন ওঠার আগে দুয়েকবার এমন ফলস ব্যথা উঠবে। দশ মিনিটের ব্যবধানে দুই থেকে তিন বার এমন ব্যথা উঠলেই বুঝে নিতে হবে এটা লেবার পেইন।

যেহেতু ফলস এলার্ম শুরু হয়ে গেছে, সুতরাং লেবার উঠতেই বেশি দেরি নেই। আরশাদ তো আতঙ্কে-উত্তেজনায় কাল রাতে ঘুমাতেই পারলো না। না জানি কখন শুরু হয়ে যায় লেবার পেইন। অরার মাঝেও ভয় কাজ করছে খুব। এতটুকুই ব্যাথাতেই নাজেহাল হয়ে পড়েছে সে। আর ওটা না-কি ছিল নকল ব্যাথা! আসল ব্যাথার তীব্রতা তাহলে কতটা ভয়াবহ হবে চিন্তা করতেই গা বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল তার। ভয়ে বিছানায় মাথা রাখতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

দীর্ঘ দশ ঘন্টার ঘুম দিয়ে উঠেছে অরা। শরীরটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। ঘরের পর্দাগুলো সব সরিয়ে দিয়েছে আরশাদ। রোদে ভরে আছে ঘরটা। রোদে গা এলিয়ে বিছানার ওপরে বসে আছে অরা। আরশাদ তাকে যথারীতি যত্ন নিয়ে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিচ্ছে দিন দিন তার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছে ছেলেটা। এখন আর নিজের হাতে খেতেই ইচ্ছা করে না। আচ্ছা, বাবু এলেও কি আরশাদের এই যত্নগুলো থাকবে না-কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে? নাহ্! হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। আজীবন এভাবেই তার যত্নে মিশে থাকতে হবে অরাকে।

খেতে খেতেই আনমনে অস্ফুটস্বরে শব্দ করে উঠলো অরা, “উঁহ!”

আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী হয়েছে অরা?”

অরা আরশাদের হাত নিয়ে তার পেটের ওপরে রেখে বলল, “দেখো কীভাবে নড়ছে!”

আরশাদ মুগ্ধ হয়ে তার সন্তানের নড়াচড়া অনুভব করছে। অরার পেটের ওপরে ঢেউয়ের মতো খেলে যাচ্ছে। যদিও অরার কষ্ট হচ্ছে, তবুও দুজনের মাঝে মুগ্ধতার কোনো কমতি নেই।

অরা হতভম্ব গলায় বলল, “কীভাবে একটু একটু করে জীবন্ত হয়ে উঠলো! এতদিন কোথায় ছিল ও?”

আরশাদ মোহনীয় এক হাসি হেসে বলল, “এখানেই তো ছিলো।”

অরা অবাক হয়ে বলল, “এখানে কোথায়?”

আরশাদ অরার চোখের দিকে তাকিয়ে অন্যরকম গলায় বলল, “আমাদের ভালোবাসার মাঝে অদৃশ্য হয়ে ছিল। আমরাই দেখতে পাইনি।”

অরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরশাদের দুচোখের দিকে। তার আজীবনের সাধ ওই চোখদুটোর মাঝে ডুব দেওয়া। এ সাধ কি কখনো পূরণ হবে না?

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। একবার সেলিনা হক এলেন দুধ-হলুদ নিয়ে, একবার আশফিয়া এলো ফ্রুট কাস্টার্ড নিয়ে। দুপুরে খাওয়ার সময়েও সেলিনা হক নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন অরাকে। খাইয়ে দিলে চুলেও বেণী করে দিলেন। অরা অবাক হয়ে দেখছে নিজের ভাগ্যকে। এত যত্ন আসলেই তার ভাগ্যে লেখা ছিল?

আজ একেবারেই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না অরা। সকাল থেকে দুবার কাল রাতের মতো ব্যাথা অনুভব করেছে সে। শরীর দূর্বল হয়ে আসছে একটু একটু করে। আরশাদ সারাক্ষণই আছে তার পাশে। কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, এটা ওটা বলে হাসানোর চেষ্টা করছে। অরা শক্ত করে তার হাতটা ধরে শুয়ে আছে।

বিকেলের দিকে আশফিয়া ঘাড়ে কতগুলো কাজ এসে জমলো। কথাকে আর্ট ক্লাসে নামিয়ে দিয়ে মাকে ডক্টর দেখাতে নিয়ে যাবে সে। সেলিনা হকের হাঁটুর ব্যাথাটা দিন দিন বাড়ছে। সিলেটে নিয়মিত ডক্টর দেখাচ্ছেন তবে বিশেষ ফল পাচ্ছেন না। আশফিয়া এবং আরশাদ মিলে তাই ঠিক করেছে ঢাকায় একবার অন্য ডক্টর দেখাবে। বাবু চলে এলে সকলের তাড়াহুড়ো লেগে যাবে। তাই আজই যাচ্ছে তারা। অরাকে একা ফেলে আরশাদ কোথায় যাবে না বলে সব দায়িত্ব আপার ওপর তুলে দিয়েছে।

ডক্টরের অ্যাপয়েনমেন্ট সংক্রান্ত আলোচনা করতেই মায়ের ঘরে গেল আরশাদ। কথা অমনি সুযোগ পেয়ে ঢুকে পড়লো তাদের ঘরে। অরার গা ঘেঁষে শুয়ে রইলো কতক্ষণ। অরা আদুরে ভঙ্গিতে তাকে স্কুল নিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করছে। কথাও অতি উৎসাহে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে।

কথা হঠাৎ একরাশ আগ্রহ নিয়ে বলল, “আচ্ছা অরা! আমার ভাই হবে না-কি বোন?”

অরা হাসিমুখে বলল, “আর কয়েকটা দিন পর ও এলেই তো দেখতে পাবি।”

কথা অস্থির কণ্ঠে বলল, “উফ কবে যে ও আসবে!”

কথার অস্থিরতায় না হেসে পারলো না অরা। মেয়েটা সেই শুরু থেকে তাই ভাই বা বোনের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। স্কুলের পর সারাটা সময় তো একা একাই থাকে বেচারি। ভাবতেই অবাক লাগছে, কিছুদিন পরেই দুটো বিচ্ছু মিলে মাতিয়ে রাখবে অরার ঘর।

অরা কৌতুহল নিয়ে বলল, “তোমার কী মনে হয় অরা?”

অরা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমার তো মনে হয় তোর ফুটফুটে একটা ভাই হবে!”

কথা ঠোঁট উল্টে বলল, “কিন্তু আমি তো বোন চাই।”

“সে কি? ভাই হলে তুই খুশি হবি না?”

“হবো। কিন্তু বোন হলে একটু বেশি খুশি হবো।”

“সেটা কেন?”

কথা মুচকি হাসি হেসে বলল, “আমার বোন ছোট্ট কথা হবে না? সেজন্য!”

অরা আদুরে ভঙ্গিতে বলল, “ভাইও হলেও তো ছোট্ট কথা হবে।”

কথা অবাক গলায় বলল, “ভাই আবার ছোট্ট কথা হবে কী করে?”

অরা জোর গলায় বলল, “তোর ভাই বা বোন যেই আসুক, সে তো তোরই ছোট ভার্শন হবে।”

কথা কী যেন চিন্তা করতে করতে বলল, “সেটাও তো ঠিক! আচ্ছা অরা! ও দেখতে কেমন হবে?”

অরা প্রশংসার ভঙ্গিতে বলল, “খুব সুন্দর! একদম তোর মতো।”

কথা দ্বিগুণ কৌতুহল নিয়ে বলল, “ওর চুলগুলো কী রঙয়ের হবে?”

অরা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কালো। আমাদের সবার মতো।”

কথা হঠাৎ গলায় বলল, “উফ! সবার চুল শুধু কালোই হয় কেন? অন্য রঙ হলে কী হয়?”

“তুই অন্য কোনো রঙ চাস?”

“হুঁ। পারপেল বা গ্রিন হলে ভালো হলো।”

খিলখিল করে হেসে উঠলো অরা। সে বেশ বুঝতে পারছে, বাবুটা কথার অত্যন্ত শখের কেউ হতে যাচ্ছে।

“অরা?”

“হুঁ?”

কথা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শুকনো গলায় বলল, “ও আসার পর তুমি আর আমাকে এখনের মতো ভালোবাসবে না তাই না?”

এতটুকু একটা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে ধ্বক করে কেঁপে উঠলো অরার বুকটা। মেয়েটার এই সামান্যতম ভয় বিচিত্র অস্থিরতা সৃষ্টি করছে অরার মাঝে। সহ্য হচ্ছে না কথার এই ভয়টা।

অরা কথাকে এক হাতে আগলে ধরে কোমল স্বরে বলল, “কী যে বলিস তুই কথা! ভালোবাসবো না কেন?”

কথা গোমড়া মুখে বলল, “আমার একটা ফ্রেন্ড আছে জানো, এশা। বোন হওয়ার পর ওর মাও আর আগের মতো খেলে না ওর সাথে। আগে খাইয়ে দিতো, এখন আর দেয় না। আগে নিজে স্কুলে নিয়ে আসতো, এখন ড্রাইভার আঙ্কেলকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। তুমিও তাই করবে?”

অরা হাসিমুখে বলল, “কথা! তুই আস্ত একটা বোকা মেয়ে! এশার মা ওকে আগের মতোই ভালোবাসে। ছোট্ট বাবুকে সামলানো অনেক কঠিন তো। তাই আর আগের মতো সময় দিতে পারে না।”

কথা তবুও মন খারাপের রেশ ধরে রেখে বলল, “না! আমি জানি, আন্টি আর ওকে আগের মতো ভালোবাসে না। তুমিও আমাকে বাসবে না।”

কথা টুপ করে উঠে অরার থেকে দূরে সরে বসে রইলো। একরাশ মন খারাপ এসে জায়গা করে নিয়েছে তার চোখেমুখে। ছোট্ট হাতদুটো ভাঁজ করে বুকের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে কথা।

অরা ধীরেসুস্থে উঠে বসতে বসতে আদুরে কণ্ঠে বলল, “কথা, আমার কাছে আয়।”

কথা জেদ ধরে বলল, “না!”

অরা কিঞ্চিৎ অসহায়ত্ব নিয়ে বলল, “আয় না সোনা। আমি তো আগের মতো নড়াচড়া করতে পারছি না। পারলে এক্ষুনি খপ করে তোকে কোলে তুলে নিতাম।”

কথার মন বোধ হয় একটু নরম হলো। এগিয়ে এসে বসলো অরার গা ঘেঁষে।

অরা তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কোমল কণ্ঠে বলল, “আমি তোর কে বল তো?”

একটা সময় এই প্রশ্নটাকে পৃথিবীর সবথেকে কঠিন প্রশ্ন বলে মনে হতো কথার। কারণ, কোনো উত্তর তখন তার কাছে তখন ছিল না। তবে এখন আর প্রশ্নটাকে কঠিন বলে মনে মনে হচ্ছে না। কারণ উত্তরটা তার জানা।

কথা অস্পষ্ট গলায় বলল, “মাম্মাম।”

প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটজুড়ে। যতবারই কথার মুখে এ ডাকটা শোনে, ততবারই মনটা জুড়িয়ে যায়।

অরা কথার গাল টিপে দিয়ে বলল, “আর তুই আমার বাবু। ছোট্ট একটা বাবু। মাম্মাম কখনো পারে তার বাবুকে না ভালোবেসে থাকতে?”

কথা না-সূচক মাথা নাড়লো।

অরা আদরমাখা গলায় বলল, “তাহলে? বোকার মতো কথা বলছিস কেন? আমি সবসময় তোকে সবথেকে বেশি ভালোবাসবো।”

কথা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “সত্যি?”

অরা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “সত্যি!”

কথা অরার গালে চুমু খেয়ে বলল, “লাভ ইউ মাম্মাম!”

অরাও কথার গালে চুমু খেয়ে বলল, “লাভ ইউ টু আমার কথা সোনা!”

মাম্মাম-মেয়ের এই স্নেহভরা মুহূর্তের মাঝেই ঘরে আগমন ঘটলো আশফিয়ার।

ব্যস্ত ভঙ্গিমায় সে কথাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কী রে কথা? আমি তোকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি আর তুই অরার কাছে বসে আছিস? রেডি হতে হবে না?”

কথা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “এখনই যেতে হবে? একটু পর যাই?”

“এখনই চল বাবা। তোকে নামিয়ে দিয়ে আমি দাদিকে নিয়ে হসপিটালে যাবো না?”

অরা কথার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন যা সোনা। তুই বাসায় ফিরে এলে আমরা আবারও গল্প করবো।”

অরার কাছ থেকে এমন লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে হাসিমুখে বিছানা থেকে নেমে গেল কথা।

আশফিয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “অরা, তুমি বসে আছো কেন? রেস্ট নাও।”

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “শুয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছি আপা।”

“ওদিকে পরীক্ষার পড়া যেভাবে মুখস্ত করে, আরশাদ মাকে যেভাবে ডাক্তারকে কী কী প্রশ্ন করতে হবে মুখস্ত করাচ্ছে। দাঁড়াও, পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার কাছে।”

অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “না, না আপা। মায়ের সাথে কথা শেষ করেই আসুক। তাড়াহুড়ো করতে হবে না।”

আশফিয়া কথাকে নিয়ে চলে যেতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অরা। আরও একবার পেটের ভেতরে ব্যাথা করে উঠলো। তবে এবারের ব্যাথাটা পিঠ থেকে শুরু করে কোমর, তলপেট বেয়ে পায়ে ছড়িয়ে গেল। অরা হাত দিয়ে টের পেলো, পেট কেমন শক্ত হয়ে আসছে।

আশফিয়া কথাকে তৈরি করে দিতেই আরশাদ তাকে নিয়ে গাড়ির কাছে গেলো। সেলিনা হক আগে থেকেই তৈরি হয়ে বসে ছিলেন গাড়ির ভেতরে। আরশাদ কথাকে উঠিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মাথায় আশফিয়াও চলে এলো। তিনজন গাড়িতে উঠে বসতেই তাদের ড্রাইভ করে নিয়ে গেল অরার ড্রাইভার। জহিরকে যেকোনো সময়ে প্রয়োজন হতে পারে বলে তাকে এখানেই রেখে দিয়েছে আরশাদ।

গাড়ি বেরিয়ে যেতেই আরশাদ ডাকলো নিয়াজকে। এ বাড়ির সকল স্টাফদের মধ্যে এই নিয়াজ ছেলেটাই আরশাদের সবথেকে পছন্দের।

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “সকালে কী বললাম তোমাকে নিয়াজ? গাড়ি কোথায়?”

নিয়াজ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, “গ্যারেজের সামনেই আছে স্যার।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “গ্যারেজের সামনে থাকলে তো হবে না, একদম বাড়ির দরজার সামনে থাকতে হবে। জহিরকে বলো এখানে গাড়ি এনে রাখতে।”

নিয়াজ ঘাড় কাত করে বলল, “জি স্যার।”

“আর দরজার সামনে যেন ভুলেও বৃষ্টির পানি না জমে।”

“স্যার ইট বিছাবো?”

“ইট বিছাবে না কী বিছাবে সেটা তোমার ব্যাপার। আসল কথা, পানি জমতে দেওয়া যাবে না।”

আরশাদের এই বাড়তি সতর্কতা অরার জন্যেই। সেও বেশ বুঝতে পারছে আর বেশি একটা সময় বাকি নেই বাবুর আগমনে। লেবার শুরু হয়ে গেলে অরার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তাই আগেভাগেই সতর্ক হয়ে যাচ্ছে সে।

হঠাৎই ফোনট বেজে উঠলো তার। আরশাদ নিয়াজকে বিদায় করে ফোনটা পকেট থেকে বের করলো আরশাদ। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অরার নাম। এক মুহুর্তও অপচয় না করে ফোনটা রিসিভ করলো আরশাদ।

অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো অরার অস্থির কণ্ঠ, “আরশাদ? কোথায় তুমি?”

আরশাদ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “এই তো অরা, আপাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। কী হয়েছে?”

অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমার মনে হচ্ছে লেবার পেইন শুরু হয়ে গেছে।”

মুহূর্তেই এক লাফে বেড়ে গেল আরশাদের হৃদস্পন্দন। স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনাও থেমে রইলো কিছুক্ষণের জন্যে। মনে মনে কী নিখুঁতভাবে সবটা সাজিয়ে রেখেছিল সবকিছু। এই সময়টাতে কোন কাজের পর কোন কাজ করবে, সবই সাজানো ছিল মস্তিষ্কের ভেতরে। দুশ্চিন্তায় সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

আরশাদ ঝড়ের গতিতে ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে চিন্তিত কণ্ঠে বলল, “মানে কী? কখন থেকে? তুমি আমাকে বলবে না? চুপ করে বসে ছিলে কেন?”

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমি তো টেরই পেলাম।”

পাঁচ মিনিটের মাথায় দুবার ব্যাথা উঠেছে অরার। এই ব্যাথার সঙ্গে আগের ব্যাথাগুলোর কোনো মিল নেই। শুধু আগের ব্যাথা কেন? জীবনের কোনো ব্যাথার সঙ্গে মিল নেই এর। একটা মানুষের শরীর এতটা তীব্র ব্যাথাও সহ্য করতে পারে? থরথর করে কাঁপছে অরার সমস্ত শরীর। নিমিষেই ঘেমে একাকার হয়ে গেছে সে।

আরশাদ তড়িৎ গতিতে ঘরে প্রবেশ করলো। তার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠেছে। দুশ্চিন্তারা স্পষ্ট নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে তার দুটো চোখের মাঝে।

ছুটে অরার কাছে এসে আরশাদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “অরা! ঠিক আছো তুমি? একটু উঠে বসো।”

আরশাদ দুহাতে ধরে উঠে বসালো অরাকে।
ভয়ঙ্কর কষ্ট হচ্ছে অরার। তবুও প্রবল সাহস নিয়ে নিজেকে ধরে রেখেছে সে। ভেঙে পড়ছে না। খুব ভালো করে সে জানে, আজ এর থেকেও অধিক ব্যাথা সহ্য করতে হবে তাকে। আরশাদের সামনে ভেঙে পড়ে তাই তার দুশ্চিন্তা বাড়াতে চাইছে না। তবুও ব্যাথার তীব্রতা এতটাই বেশি যে দুচোখের জল ধরে রাখা সম্ভব হলো না তার পক্ষে।

আরশাদ একরাশ উদ্বেগ নিয়ে বলল, “কষ্ট হচ্ছে?”

অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে চোখমুখ কুঁচকে বলল, “মারাত্মক ব্যাথা করছে!”

আরশাদ নরম স্বরে বলল, “এইতো! আমরা এক্ষনি হসপিটালে যাবো।”

ব্যস্ততার সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো আরশাদ। অরা কষ্টে আছে, এই সত্যি এক মুহূর্তেই জন্যেও সহ্য হচ্ছে না তার। কোনো এক যাদুর বলে তার সমস্ত কষ্ট দূর করে দিতে পারলে ভালো হতো।

আরশাদ দ্রুততার সঙ্গে দরজা খুলে উঁচু স্বরে ডাকলো, “এই নিয়াজ!”

মুহূর্তের মাঝে হাজির হলো নিয়াজ। আরশাদ তার গুছিয়ে রাখা ব্যাগগুলো দেখিয়ে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “এই ব্যাগগুলো গাড়িতে তোলো। আর জহিরকে এক্ষনি গাড়ির নিয়ে আসতে বলো, কুইক!”

হসপিটালে ফোন করতে হবে। আরশাদ পকেট থেকে ফোন বের করতেই তার কম্পিত হাত সেটাকে সামলাতে না পেরে ফেলে দিলো মেঝেতে।

হাজার কষ্টের মাঝেও অরা হেসে ফেলে বলল,
“আরশাদ তুমি প্যানিক করছো কেন? আমি ঠিক আছি তো!”

আরশাদ চিন্তায় অস্থির হয়ে বলল, “তুমি হাসছো কীভাবে? টেনশনে মরে যাচ্ছি আমি!লম্বা শ্বাস নাও তো অরা!

লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত অরা। আরশাদ হসপিটালে ফোন করে জানিয়ে দিলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অরাকে নিয়ে হাজির হবে সে। গাড়িও ততক্ষণে চলে এসেছে বাড়ির সামনে। ফোনালাপ সংক্ষেপে সেরে অরার কাছে গিয়ে তাকে ওঠাতে উদ্যত হলো আরশাদ।

অরা লম্বা শ্বাস নিতে নিতে বলল, “আরশাদ শোনো!”

আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “পরে শুনবো অরা, এখন যেতে হবে তো!”

অরা জেদ ধরে বলল, “না! আগে শোনো।”

অরার জেদের সঙ্গে পেরে না উঠে আরশাদ বলল, “কী?”

এত কষ্টের মাঝেও অরা মজার ছলে বলল, “প্রমিজ করো! বাবু আসার পরও প্রতিদিন আমাকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিবে। প্রমিজ না করলে কিন্তু আমি যাবো না।”

অবাক হয়ে দেখতে মেয়েটাকে আরশাদ। এত যন্ত্রণা সহ্য করেও কী করে হাসিমুখে কথা বলছে সে?

আরশাদ হেসে ফেলে অরার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “I love you!”

অরাও ফিসফিস করে বলল, “I love you too!”

(চলবে)