ফিলোফোবিয়া পর্ব-৩১+৩২

0
530

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

৩১.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

ভোরের আকাশে মেঘের পালকের ছড়াছড়ি। কুয়াশার চাদর কে*টে এক ফালি রোদ্দুর এসে ভুবন ছুঁইছে। ভারী পর্দার আড়াল হতে উজ্জ্বল আলো এসে প্রিয়’র মুখ ছুঁইছে। ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। যেন প্রচন্ড বিরক্ত হলো সে। সরু ঠোঁটের কোণে ক্ষুব্ধতার আভাস। হরিণটানা আঁখিজোড়া পিটপিট করে কাঁপছে। মসৃণ গালে গোলাপি র*ক্তিম আভা ছড়িয়ে। অবাধ্য কেশে কপাল ঢেকে। শতাব্দের এক হাত জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে।
হাত বাড়িয়ে প্রিয়’র কপালে পড়ন্ত কেশ গুছিয়ে দিলো শতাব্দ। গতরাতে ঘুমাতে পারেনি সে। অনেক বছর আগের ফোবিয়াটা প্রিয়’র এখনো আছে। সারারাত ছটফট করে, ভোরের দিক ঘুমিয়েছে। ঘুমের ঘোরে গভীর গোঙানির আওয়াজ। বিড়বিড় করে বলেছে,’আমাকে নিওনা আপা…আমি বাঁচতে চাই। একটু প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই।’ এতবছরেও কোন পরিবর্তন আসেনি। সেই ফোবিয়া থেকে পরিত্রাণ পায়নি। গতরাতে প্রিয়কে দেখে তার মনে হলো, পুরানো ভয়টা কমেনি বরং বেড়েছে আরো। ধীরেধীরে অন্ধকারের দিক টেনে হিঁচড়ে জড়িয়ে নিচ্ছে। প্রিয়’র দিক ঝুকে এলো শতাব্দ। তার মসৃণ গালে, ঠোঁটে আঙ্গুলের পিঠ ছুঁয়ে আলতো আদর করে দিলো। কপালে গভীর চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ একদিন সব অন্ধকার কাটিয়ে। উজ্জ্বল ভোর নামবে। তুমি হাসবে, প্রাণ খুলে বাঁচবে আবার।’
নিমিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আচমকা দরজার কড়া নড়ল। দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীর হয়ে তাকালো শতাব্দ। ময়না এসেছে। হাতে চায়ের কাপ। রাশভারি আওয়াজে শতাব্দ বলল,
‘ রেখে যাও।’
চায়ের ট্রে রাখতে রাখতে মৃদু স্বরে বলল ময়না,
‘ ভাইজান। আম্মা বড় ভাবিরে নিচে ডাকছে।’
‘ মাকে বল, প্রিয় অসুস্থ। ঘুমাচ্ছে।’
মাথা নাড়িয়ে চলে গেল ময়না। বাহিরে শোরগোলের আওয়াজ। পিছনের বাগানে লোক জড় হতে শুরু করেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘড়ির দিক তাকালো একবার। আটটা বাজতে পনের মিনিট বাকি। দশ মিনিটে বেরিয়ে যেতে হবে এইবার। চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো শতাব্দ। প্রিয়’র দিক এক পলক চেয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে সবাইকে কড়া ভাবে বলে গেল, প্রিয়’র খেয়াল রাখে যেন।

বাহিরে প্রচন্ড শোরগোল কথার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল প্রিয়’র। মাথা ধরছে খুব। মাথা চেপে উঠে বসতেই ময়না ছুটে আসলো। অস্থির হয়ে বলল,
‘ কিছু লাগবো ভাবিজান।’
ঘুম জড়ানো পিটপিট দৃষ্টিতে সামনে তাকালো প্রিয়। দুইদিক আলতো মাথা নাড়িয়ে ‘না’ সূচক ইঙ্গিত দিলো। কর্ণার টেবিল থেকে মোবাইল তুলে তাকাতেই আঁতকে উঠল। নয়টা বিশ। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
‘ এত দেরি হয়ে গেছে ডাকোনি কেন আমাকে?’
‘ ভাইজান মানা করছে। বলছে, আপনার খেয়াল রাখি যেন।’
ময়নার মৃদু আওয়াজ। বুক ফুলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। শ্বশুরবাড়ি সকাল সকাল উঠা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ মাথা ব্যথা নেই তার। বাড়ি ভর্তি মানুষজন সবার সামনে ঘুম নিয়ে কেউ কিছু বলবে তা শুনতে রাজি না সে।
বাহিরে অনেক মানুষের কিচিরমিচির আওয়াজ। মনে হচ্ছে শত শত মানুষজন এক সাথে জড় হয়েছে। প্রিয়’র সন্দিহান চাহনি। শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ বাহিরে আওয়াজ কিসের?’
‘ আইজ শনিবার। শুক্রবার ভাইজান বাড়ি আইলে ।প্রতি শনিবার পেছনের বাগানে সভা, সালিশ বসে। বড় ভাইজানের কাছে গ্রামের মানুষ বিচার আচার, গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়া আলাপ-আলাপ-আলোচনা করে।’
কপাল কুঁচকে এলো প্রিয়’র। বলল,
‘ বড় ভাইজান? শতাব্দ?’
ময়না হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। প্রিয় সন্দিহান কন্ঠে আওড়াল,
‘ তাহলে চেয়ারম্যান সাহেব?’
‘ চাচাজান এসব এখন আর দেখেনা। বছর কয়েক আগে পাশের গ্রামের লগে বড় মা*রামা*রি হইছিল। খু*নাখু*নি পর্যায় গেছিলো। সেই বিচারে বিরাট ঝামেলা বাঁধছিল। সবটা বড় ভাইজান সামলাইছে তখন। তারপর থাইকা গ্রামের লোকজন সবাই ভাইরে চাচাজান থাইকা বেশি মান্যগণ্য করে। চেয়ারম্যান চাচাজান হইলেও ভাইয়ের কথায় গ্রামের লোকজন চলে।’
রাজনীতিতে তেমন কোন কৌতূহল ছিলনা শতাব্দের। বরাবরই এড়িয়ে চলতে চাইত। পড়াশোনা সেড়ে ঢাকাতেই শিফট হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তাহলে হঠাৎ কেন রাজনীতিতে জুড়ে গেল? গম্ভীর হয়ে ভাবছিল প্রিয়। ময়না ডাকল। কিন্তুকিন্তু করে জিজ্ঞেস করল,
‘ মাথা ব্যথা কমছে? কড়া লিগার দিয়া চা কইরা দিমু ভাবি!’
গহিন ভাবনায় ডুবে থাকা প্রিয় মাথা নাড়াল। মৃদু স্বরে বলল,
‘ আচ্ছা।’

উষ্ণ চায়ের কাপে গরম ধোঁয়া উড়ছে। সূরের উজ্জ্বল নরম আলো চোখেমুখে পড়ছে। কানে ইয়ারফোন গুজে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে প্রিয়। দৃষ্টি দূর বাগানে। কাঠে ভারী চেয়ারে বসে আছে শতাব্দ। গায়ে কালো পাঞ্জাবি। শীত থেকে পরিত্রাণ পেতে মোটা শাল মুড়িয়ে। চুল গুলো ব্যকব্রাশ করে গোছানো। ফরসা চেহারায় চাপ দাঁড়ি। গম্ভীর চোখমুখ। চেহারায় গভীর পরিবর্তন। এত বছরে অনেক কিছু পরিবর্তনের সাথে শতাব্দের ব্যাক্তিত্বেও বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আগের মত হুটহাট রেগে যায় না এখন। অনেক পরিবর্তন এসেছে। শান্ত হয়ে সামনের জনের সমস্যা শুনছে। ভেবেচিন্তে তারপর প্রতিক্রিয়া করছে। যদিও আগের থেকে আরো বেশি গম্ভীর আর রাশভারি হয়েছে সে। শক্ত চোয়াল, রাগ এখনো আগের মত নাকের ডগায়। নিখাঁদ দৃষ্টিতে দেখছে প্রিয়।

‘ বিয়ে করে এনেছে বলে তুমি রাজরানি হয়ে গেছ এমন না। পুরুষ মানুষের মন বদলাতে সময় নেয় না। একবার ছেড়েছিল তোমাকে, আবারো ছাড়বে।কথায় আছে না যে থাকার সে কখনো ছাড়েনা।’
কানের ইয়ারফোন খুলে পেছন ফিরে তাকালো প্রিয়। লুবনা এসেছে। সরু দৃষ্টিতে পরখ করল প্রিয়। র*ক্তিম ফোলা চোখের নিচে কালি জমেছে তার। খোলা উষ্কখুষ্ক চুল। হ্যাংলা শরীর। কালচে ফ্যাকাসে ঠোঁট।
প্রিয় ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি টেনে বলল,
‘ ঘুরেফিরে বারবার সেই আমার কাছেই আসে। অনেকবছর তো দূরে ছিলাম। কি হলো! কোনকিছু কি বদলালো? তার নজর আমাতেই আবদ্ধ এখনো।’
লুবনা কিড়মিড়িয়ে বলল,
‘ আমাদের বিয়ে হচ্ছিলো।’
কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। খানিক অবাক হলেও চোখেমুখে ফুটে উঠতে দিলো না তা। আগের মত স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ হয়নি তো! আমার জন্য তোমাকে রিজেক্ট করেছে। ভীষণ বেদনা দায়ক তাইনা?’
‘ এতো অ*হংকার! কি আছে তোমার?’
‘ কেন করবো না অহংকার? আমার জন্য সে তোমাকে রিজেক্ট করেছে এই কারণটা কি যথেষ্ট না!’
‘ রূপের অহংকার করছ? চোখেমুখে এসিড পড়লে এই রূপ থাকবে তো?’
লুবনার ঠান্ডা হু*মকিতে এক চিলতে হাসল প্রিয়। হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ শতাব্দের কাছে আমি ভীষণ দামী। ভীষণ! আমার দিক হাত বাড়ালে তুমি আস্ত থাকবে তো?’
লুবনা দমে গেল। ফুসফুস রাগী শ্বাস ফেলল। কানে ইয়ারফোন গুজলো প্রিয়। লুবনার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চমৎকার হেসে ভ্রু নাচিয়ে ডার্ক হর্স গানের সুর টেনে বলল,
‘ ডোন্ট মেক মি ইউ’র এনিমি।’
লুবনা আরো ক্ষেপে গেল। প্রিয়’র দিক ঝুকে এলো। কালসিটে দাঁত বের করে কিড়মিড়িয়ে বলল,
‘ বিচ’
বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল।

লুবনা যেতেই প্রিয় ফোন বের করে কাউকে টেক্সট করল,
‘ আমরা যা খুঁজছিলাম আই থিংক পেয়ে গেছি। শোয়েব হক আর ছবি বেগমের দুর্বলতা।’
সাথে সাথেই অপর পাশ হতে উত্তর এলো,
‘ কি?’
‘ লুবনা হক।’
‘ লুবনা?’
‘ হ্যাঁ। আমাদের গন্তব্যে লুবনা নিয়ে যাবে।’
‘ বি কেয়ারফুল। টেক কেয়ার।’
মুচকি হাসলো প্রিয়। সব টেক্সট ডিলিট করে দিলো।

বিকালের শেষ প্রহর। চারদিকে ঝিমিয়ে থাকা আলো। প্রকৃতিতে মৃদু হিম হাওয়া বইছে। সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে। বেড়াতে বের হবার বুদ্ধি মূলত প্রভা এঁটেছে। গ্রাম ঘুরে দেখবে বলে। সমুদ্রকে ছলছুতা দিয়ে রাজি করিয়েছে। দুপুরের পরপর সমুদ্র সবাইকে নিয়ে বেরিয়েছে। পশ্চিমের বড় পুকুর পাড়ের ছাউনির নিচে বসে আছে প্রিয়। বাকি সবাই ছবি তুলতে, ঘুরে দেখতে ব্যস্ত। পুকুরটা বোধহয় নতুন খোড়া হয়েছে। পাড়ে বেশ সুন্দর ছোট ছোট ছনের ছাউনি ঘর তোলা আছে। বসার জন্য সিমেন্টের চেয়ার টেবিল বানানো। বিকালে চায়ের আড্ডার জন্য জায়গাটা মন্দ নয়। বাঁধানো পুকুর পাড়ে রঙিন নকশা গুলো নজর কাড়ছে বেশ। পানির কলকল আওয়াজ প্রিয়কে টানছে খুব। উঠে দাঁড়ালো সে। পা বাড়াল সেদিক। কয়েক সিড়ি ডাঙ্গাতেই কেউ বলল,
‘ শেওলা জমেছে, সিড়ি পিচ্ছিল। সামনে পা বাড়িও না।’
পেছন ফিরে তাকালো প্রিয়। শতাব্দ এসেছে। গায়ে লেদার জ্যাকেট। পায়ে ক্যাডস। পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিকটাতেই তাকিয়ে। সাথে আরো দুজন লোক। ভ্রু কুঁচকে নিলো প্রিয়। শতাব্দের কথা উপেক্ষা করে সামনের দিক পা বাড়াল। দুইধাপ নামতেই পা পিছলে পড়লো। ছুটে এলো শতাব্দ। প্রিয়’কে টেনে তুলল। ছাউনি নিয়ে চেয়ারে বসালো। শাড়িতে কাঁদা মাটি লেগে একাকার। সিড়ির ধাপে ব্যথা পেয়ে হাত চিঁ*ড়ে র*ক্ত ঝরছে। ক্ষেপে গেল শতাব্দ। রাগী গর্জন করে বলল,
‘ সবসময় সবকিছু নিয়ে ত্যাড়ামো করাটা কি জরুরি?’
উত্তর দিলো না প্রিয়। রাশভারি মুখ করে বসে আছে সে। গাড়ি থেকে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ আনিয়ে লাগিয়ে দিলো প্রিয়’র হাতে। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,
‘ খুব ব্যথা করছে?’
দুদিকে মাথা নাড়াল প্রিয়। শতাব্দ আবার বলল,
‘ বাড়ি ফিরব। চলো।’
নাচক করল প্রিয়। কপাল কুঁচকে রাশভারি গম্ভীর মুখ করে উত্তর দিলো,
‘ উহু, সামান্য লেগেছে। সবার সাথে যাবো।’
ফস করে শ্বাস ফেলল। শতাব্দ বেশ ভালো করে জানে প্রিয়’কে যা বলবে তার উল্টোটা করবে সে। কিছু বললে শুনবেনা। বরং জেদ ধরে কাঁদা মাটি নিয়ে এখানে বসে দেরি করবে আরো। পানি টিস্যু নিয়ে তার দিক এগিয়ে যেতেই পিছিয়ে গেল প্রিয়। হাত পা গুটিয়ে নিলো। প্রিয়’র আরোধ শুনল না শতাব্দ। এক প্রকার টেনে হাত বের করে। পরিষ্কার করে দিতে লাগল। মুখ ভার করে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো প্রিয়। শতাব্দ বলল,
‘ পুকুরে মানুষ খে*কো আফ্রিকান মাগুর আছে। যদি পা পিছলে পড়তে কি অবস্থা হতো! ভেবেছ?’
প্রিয় দমলো না। নাক উঁচু করে জবাব দিলো,
‘ সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগানো উচিত ছিল।’
‘ লাগনো আছে। তোমার হয়তো চোখে পড়েনি।’
আশেপাশে তাকাল প্রিয়। পুকুরের সামনে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘পুকুর হতে সাবধান’।
শতাব্দের সামনে নত হতে প্রিয় নারাজ। গলা উঁচু করে বলল,
‘ আফ্রিকান মাগুর চাষ নি*ষিদ্ধ। এটা ক্রা*ইম।’
‘ আমার শখ আমি করেছি। কোন সমস্যা? বাজারে বিক্রি না করলেই হয়।’
‘ তাহলে এগুলো দিয়ে কি করেন?’ প্রিয়’র প্রশ্নবিদ্ধ আওয়াজ।
‘ মানুষ হ*ত্যা করি।’ শতাব্দের সোজাসাপ্টা উত্তর।
‘ আচ্ছা? তাই! এখন অবধি কতজন মা*রলেন?’
‘ একজন। নতুন তো!’
তাচ্ছিল্য হাসলো প্রিয়। বলল,
‘ কেন মারলেন! আপনাদের কথা মত চলেনি, তাই?’
শতাব্দের স্পষ্ট আওয়াজ,
‘ উহু, এক রাক্ষস প্রেমনগরের রাজকন্যার দিক হাত বাড়িয়েছিল। রাজকন্যার মায়ের কাছে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। সারা রাজ্যের মানুষের সম্মুখে তাদের অপদস্ত করেছে। পুরো অঞ্চল অপকর্মে জড়িয়ে নিয়েছিল। তাই তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়াটা জরুরী ছিল।’
শতাব্দের কথার আগাগোড়া না বুঝলেও, সবটা যে বানানো বেশ ভালো করেই বুঝল। তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘ বাহ! বেশ দারুণ গল্প তো। ডাক্তারী, রাজনীতির পাশাপাশি এত ভালো গল্পকার আপনি জানতাম না তো।’
উত্তর এলো না কোন। পানির দিক থেকে চোখ সরিয়ে পেছনে তাকাতেই থমকে গেল প্রিয়। হিম শীতল অদৃশ্য এক অনুভূতিতে জমে গেল। শতাব্দের চাহনিতে কেমন জানো অদ্ভুত এক হিং*স্রতা। কোনো অজানা নেশা। দৃষ্টিতে কিঞ্চিত কোন পরিবর্তন নেই। দৃঢ়ভাবে প্রিয়’র দিক চেয়ে এখনো।
তবে, কি সত্যিই এমন কিছু ঘটেছে! সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়। বলল,
‘ সত্যি কি কারো খু*ন করেছেন?’
শতাব্দ তখনো আগের মত দৃঢ়ভাবে চেয়ে। প্রিয় ঘামছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। খেয়াল করল শতাব্দ। ফিক করে হাসল। চোখ মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। বলল,
‘ উহু, মজা করছিলাম।’
বুক চিড়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। বিরক্তির চাহনি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়াল। হন হন করে গাড়ির দিক চলে গেল।

প্রভা দূর থেকে পুরো ঘটনা ঠাহর করল। প্রিয় চলে যেতেই প্রভা শতাব্দের মুখোমুখি বসল। তখনো প্রিয়’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শতাব্দ। প্রভার আওয়াজে হুঁশ ফিরল।
প্রভা বলল,
‘ কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। অনেক বছরের রাগ-জেদ চেপে রাখতে রাখতে আপার এমন রুখা স্বভাব।’
তাচ্ছিল্য হাসল শতাব্দ। ভারী কন্ঠে বলল,
‘ অধিকার আছে তার!’
প্রিয় গাড়িতে চড়ে বসেছে ততক্ষণে। রাগ তখনো তার নাকের আগায়। সেদিকে তাকিয়ে মলিন হাসল শতাব্দ। উদাসীন কন্ঠে বলল,
‘ কাঙ্ক্ষিত মানুষটা্র চোখের সামনে থেকেও তাকে না ছুতে পারার যন্ত্রণা কতটা কঠিন হয়! তা বেশ ভালো করে জানে তোমার আপা। তাইতো ক্ষণে ক্ষণে পো*ড়াচ্ছে আমায়।’
খানিক নীরবতা। নীরবতা ভেঙ্গে প্রভা বলল,
‘ অনেক কিছু সহ্য করেছে আপা। অনেক রাত নির্ঘুমে ফুঁপিয়ে কেঁদে কাটিয়েছে। হাউমাউ চিৎকার করে বারবার একটা কথাই জিজ্ঞেস করতো, ‘যারা ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা পায় তারা দেখতে কেমন হয়? তাদের ভাগ্য কি সোনার কলমে লেখা হয়?’
শতাব্দের বুক কেঁপে উঠল। রক্তিম চোখের আ*হত চাহনি।
অন্ধকার নেমে আসছে। সমুদ্রের হাঁক ডাকে উঠে গেল প্রভা। প্রিয়’র গম্ভীর রুখা মুখখানায় তখনো চেয়ে আছে শতাব্দ। বিরবির উদাসীন আওয়াজে বলল,
‘ আমি ছেড়ে যাইনি প্রিয়। দৃষ্টির আড়ালে থেকেও সর্বদা তোমাতে নজর ছিল।’

চলবে……..

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

৩২.

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

বৌভাত আজ। সকালে পার্লার থেকে লোক এসে দুই বোনকে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। বাহিরে বিরাট ভোজের আয়োজন চলছে। সবাই ব্যস্ত। নতুন বউদের ঘরে বসানো হয়েছে। অতিথি আসতে শুরু করলে নিয়ে যাওয়া হবে।

‘ আকাশের চাঁদটা কি ঘরে নেমে এলো আমার! তুমি কোনো পরী নাকি অপ্সরী?’
প্রভা লজ্জায় মিয়িয়ে গেল। চোখ লুকাতে ব্যস্ত। ক্ষান্ত হলো না সমুদ্র। প্রভার চোখে নিমিষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। প্রভার লাজুক চোখজোড়া নুয়ে এলো আরো। কন্ঠে লজ্জা জড়িয়ে বিরবির করে বলল,
‘ এভাবে তাকাবেন না। লজ্জা লাগে আমার।’
দুষ্টু হাসল সমুদ্র। বলল,
‘ লাগুক সব লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিবো আজ। আজ সারারাত…
সমুদ্রকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে, কান চেপে চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়। আধঘন্টা ধরে দুজনের প্রেমালাপ শুনছে। কেউ কারো থেকে কম যায় না। দুজনই সমপরিমান বেশরম। সামনে প্রিয় বসে আছে যে সেদিকে গুরুত্বই দিচ্ছে না। নিজেদের প্রেমের গীত চালিয়ে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়।
চোখেমুখে বিরক্ত ঢেলে গলা উঁচিয়ে বলল প্রিয়,
‘ গত আধঘন্টা আপনাদের লাভি-ডাবি কথা শুনে আমি ক্লান্ত বিরক্ত। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এমন টিনেজারদের মত কি করে আচরণ করতে পারে? আর প্রভা! আমি না তোর বড় বোন? বড় বোনের সামনে এ কি রকম আচরণ। লজ্জাশরম কি সব বেঁচে এসেছিস বোন!’
প্রিয়’র করুণ আওয়াজ। কথা এড়াতে চাইল প্রভা। এদিক সেদিক তাকিয়ে মাথার ঘুমটা ঠিক করার ভাণ করল। প্রিয় ফস করে শ্বাস ফেলল। হতাশ সুরে বলল,
‘ সরি টু স্যে সমুদ্র ভাই, আপনার কাব্যিক গুণ একদমই নাই। ভীষণ বাজে ছিল আপনার পয়েট্রি লাইন।’
মুখ ছোট হয়ে এলো সমুদ্র’র। তা দেখে প্রভা জ্বলে উঠল। ঝাঁজালো গলায় বলল,
‘ উনি তোর বোন জামাই। উনার সাথে তুই এমন করে কথা বলতে পারিস না আপা।’
‘ আলবাত পারি। বোন জামাইয়ের পাশাপাশি সমুদ্র ভাই আমার দেবর।’
‘ উনি বয়সে বড় তোর।’
‘ তাতে কি! রিশতায় আমি বড়। উনার বড় ভাইয়ের বউ!’
বোনের সাথে তর্কে না পেরে দমে গেল প্রভা। মুখ ভার করে। বিড়বিড়িয়ে প্রিয়’কে গালমন্দ করতে করতে চলে গেল সে। সমুদ্র আফসোস ঠেলে বলল,
‘ দিলে তো আমার বউটাকে রাগিয়ে!’
গুরুত্ব দিলো না প্রিয়। বলল,
‘ ও ব্যাপার না। এটা প্রভার সবসময়কার অভ্যাস। কথায় না পাড়লে উঠে পালায়।’
মৃদু হাসল সমুদ্র। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
‘ তবু্ও, বউটা তো আমার। মান তো ভাঙ্গাতেই হবে। নয়তো দেখা যাবে, কাঁথা বালিশ ছাড়া মেজেতে ঘুমাতে হবে রাতে। রেগে বাঘ হয়ে কোথায় গেল যাই দেখি গিয়ে।’
‘ আপনার সাথে কিছু কথা ছিল সমুদ্র ভাই।’
প্রিয়’র রাশভারি আওয়াজ। বাড়ানো পা’টা পিছিয়ে নিলো সমুদ্র। সামনের সোফায় বসলো। প্রিয়’কে গম্ভীর দেখে, চোখেমুখে গম্ভীরভাব এঁটে বলল,
‘ সিরিয়াস কিছু?’
‘ কিছুটা সিরিয়াস।’
সমুদ্রের কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় হলো। খানিক চুপ থেকে প্রিয় বলল,
‘ তানহার কথা জানে প্রভা?’
তানহার নাম শুনতে সমুদ্রের মুখখানা আরো রাশভারি হয়ে এলো। নীরব হয়ে গেল হ্ঠাৎ। প্রিয় উত্তরের অপেক্ষা করল খানিক। সমুদ্রের কোন জবাব না পেয়ে বলল,
‘ আমার বোনটা বড্ড বোকা সমুদ্র ভাই। যাকে ভালোবাসে নিজের সর্বস্র দিয়ে ভালোবাসে। মান আত্মসম্মান সব ভুলে শুধু সেই মানুষকে নিয়ে ভাববে। দরকার পড়লে তার জন্য জান দিয়ে দিবে। এইযে আমার সাথে দা কুমড়ার সম্পর্ক, সবটাই ওর লোক দেখানো। মনে মনে প্রচন্ড ভালোবাসে আমাকে। প্রকাশ করেনা কিন্তু আমি বুঝি। আমার জীবন গোছানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে ও। বুদ্ধি হাঁটুর গোড়ায়, কিন্তু মন সচ্ছ পরিষ্কার। আপনাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। এক কথায় আপনি বলতে পাগল প্রভা। আমি জানি, আপনাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলা আমার উচিত না। তবুও বলছি, তানহার ব্যাপারটা জানিয়ে দিন। এ বাড়িতে অতীত টানার অনেক মানুষ আছে। অন্যকারো থেকে জানলে কষ্ট পাবে, দুরত্ব বাড়বে।’
গম্ভীর মুখ করে সমুদ্র মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ প্রভা, আমার আঁধার রাতের আলো। তানহার বিশ্বাসঘা*তকতা যখন আমাকে পুরোপুরি ভেঙ্গে দিয়েছিল। টুকরো টুকরো সেই ভাঙ্গা অংশ গুলো খুঁজে খুঁজে এনে সে জোড়া লাগিয়েছিল। আমি তো এই দিনদুনিয়া, নিজেকে এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম। প্রেম, ভালোবাসা, মানুষ এসবের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল আমার। গভীর নেশার ঘোরে ডুবে গেছিলাম। কিন্তু প্রভা থামেনি! আমার সাথে লড়াই করে সেই নিকৃষ্ট জগৎ থেকে টেনে তুলেছে। নতুন এক জীবন দান দিয়েছে। এই জীবন শুধুই প্রভার। আমার মন প্রাণ, আত্মা, ভালোবাসা সবটাই তার। কথা দিচ্ছি, কখনো দূরত্ব হবে না। সবসময় হাসিখুশি থাকবে প্রভা।’
হাসলো প্রিয়। বলল,
‘ আপনার উপর ভরসা আছে।’
জবাবে মলিন হেসে চলে গেল সমুদ্র।

লেহেঙ্গার স্কার্ট নিয়ে টানাটানি করছে প্রিয়। শক্ত গিট এঁটে গেছে কোমরে। পেট কে*টে পরার উপক্রম। লেহেঙ্গার ভারী ঘের আর পাথরের কারুকাজ নিচের দিক টানছে। তার উপর ফুলে থাকা ক্যানক্যান! সবমিলিয়ে অতিষ্ঠ প্রিয়। বউভাতের জন্য খুব অল্প সময় পেয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো করে এখানেই আশেপাশের দর্জি থেকে লেহেঙ্গা সেলাই করিয়েছে। ফলস্বরূপ ব্লাউজের ফিটিং খুব বাজেরকম এঁটে গেছে। শ্বাস ফেলা দুস্কর মনে হচ্ছে।
টানাটানিতে হাঁপিয়ে উঠল প্রিয়। গ্লাসে পানি ঢেলে ,ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেয়ে নিলো। কোমরে হাত রেখে ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলে জিরিয়ে, আবারো লেগে গেল কাজে। অমনি দরজার কড়া নড়ল। গিট খোলার চেষ্টা করতে করতে প্রিয় গলা উঁচিয়ে বলল,
‘ দরজা খোলা আছে।’
দরজা খুলে কেউ ভেতরে এলো। সেদিকে তাকাল না প্রিয়। সামনের মানুষটা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। লাল টকটকে বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাণপ্রিয়। এত বছর এই দিনটার-ই তো অপেক্ষায় ছিল। বুক ফুলিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল শতাব্দ। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে এখনো। মুগ্ধতার ঘোর কাটেনি তার। এভাবে সময়টা থেমে গেলে খুব একটা মন্দ হয় না!
প্রিয়’কে অস্থির, বিরক্ত লেহেঙ্গা’র গিট নিয়ে টানাটানি করতে দেখে শতাব্দ বলল,
‘ কোন সমস্যা! সাহায্য করবো?’
শতাব্দের আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকাল। খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে, দুহাত উঁচিয়ে কপাল কুঁচকে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ লেহেঙ্গা’র গিট শক্ত ভাবে এঁটে গেছে। কোমরে লাগছে। হাতে ফেইক নেইল। চাপ দিতে গেলে খুলে পড়বে। কাউকে ডেকে দিন সাহায্য লাগবে।’
প্রিয়’র কথা কাজে হেসে ফেলল শতাব্দ। আজ অনেক বছর পর আগের সেই পুরনো প্রিয়’কে দেখল। বলল,
‘ আমি করে দিচ্ছি।’
দু’কদম পিছিয়ে গেল প্রিয়। ঝাঁজাল কন্ঠে বলল,
‘ লাগবেনা। আমি আমি পারবো।’
ততক্ষণে শতাব্দ প্রিয়’র মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। শেরওয়ানির হাতা খানিক গুছিয়ে নিলো। হাঁটু গেড়ে সামনে বসল। আড়চোখে শতাব্দকে দেখছে প্রিয়। গোল্ডেন কারুকাজ করা কালো শেরওয়ানি। চুল গুলো সবসময়ের ব্রাশড ব্যাক করে গোছানো। হরহামেশার মত গম্ভীর মুখশ্রী। প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
‘ বৌভাতে কালো শেরওয়ানি কে পরে?’
‘ কেন! সবাইকে যে নেভি ব্লু ব্লেজার পরতে হবে এমন কি কোন বরাদ্দ আছে নাকি?’
‘ বিয়েতে কালো পরাটা অস্বাভাবিক নয় কি?’
‘ আমার জীবনে স্বাভাবিক আছে কি! সবটাই তো অস্বাভাবিক।’
চুপ করে রইল প্রিয়। শতাব্দ জিজ্ঞেস করল,
‘ এই গেটআপে খারাপ লাগছে?’
‘ না।’
‘ ভালো লাগছে?’
‘ না।’
‘ আবার প্রেমে পড়ছ?’
‘ না।’ প্রিয়’র ঝাঁজাল কন্ঠে রুখা উত্তর।
ঠোঁট মেলে হাসল শতাব্দ। স্বাভাবিক শান্ত স্বরে বলল,
‘ তাহলে বারবার কেন আড়চোখে তাকাচ্ছ?’
প্রিয় উত্তর দিলো না কোন।লেহেঙ্গার গিট ছাড়িয়ে আলতো করে বেঁধে দিয়ে উঠে দাঁড়াল শতাব্দ। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিমিষ চেয়ে রইল। চোখেতে গভীর ঘোর, মুগ্ধতা ছড়ানো। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো প্রিয়। আচমকা শতাব্দ আরো কাছে চলে এলো। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। ফ্যালফ্যাল চেয়ে আধোআধো কন্ঠে বলল,
‘ ক…কি করছেন?’
জবাবে কিছু বলল না শতাব্দ। চোখে তখনো গভীর ঘোর। আরো কাছে চলে এলো। প্রিয়’র কাজলটানা চোখের কোণে আঙ্গুল ছুঁয়ে কানের পেছনে কালি লাগিয়ে দিলো। নিগূঢ়, গভীর কন্ঠে বলল,
‘ নজর না লাগে যেন আমার চাঁদের গায়ে।’
পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। ফ্যালফ্যাল চাহনি। চোখে এখনো বিস্ময়, ঘোর। তখনি হুড়োহুড়ি কয়েকজন মেয়ে ঢুকলো ঘরে। অতিথি আসতে শুরু করেছে বলে হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগল প্রিয়’কে। প্রিয়’র বিস্মিত দৃষ্টি তখনো শতাব্দতে আটকে।

চারিদিকে হাজার হাজার লোকজন। হবে নাই বা কেন? চেয়ারম্যান বাড়ির ভোজের আয়োজন। রাজনীতি জড়ানো অনেকেই এসেছেন। শাহরিয়ার সাহেব বেশ হাস্যোজ্জ্বল মুখে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন পুত্রবধূদের সাথে। প্রিয় প্রভা বেশ বিনয়ী ভাবে কুশল বিনিময় করছে। এত এত লোকের ভিড়ে বাবাকে দেখে অভিমানে ভরে এলো প্রিয়’র চোখ। রুষ্ট হয়ে সরিয়ে নিলো মুখ। আসার পর থেকে জাফর সাহেব অনেকবার প্রিয়’র সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। প্রত্যুত্তরে এড়িয়ে গেছে প্রিয়। প্রভা লক্ষ করল। প্রিয়’র কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ তুই বাড়াবাড়ি করছিস আপা। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে আব্বা। ইচ্ছে করে সবাইকে কেন নিজের থেকে সরিয়ে দিচ্ছিস?’
আচমকা ক্ষেপে উঠল প্রিয়। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বলল,
‘ তুইও দূরে থাক। আমার কাছে এলে জ্ব*লে যাবি সবাই।’
বিরক্তির মুখ করে দূরে সরে গেল প্রভা।

অতিথি বিদায় করে ঘরে ঢুকতেই হতভম্ব সবাই। লুবনা বেশ বড়সড় কান্ড বাঁধিয়ে বসে আছে। শতাব্দের ঘরে যেয়ে ভাঙচুর করে এসেছে। প্রিয়’র জিনিসপত্র সব ফেলে দিয়েছে। সাজানো বাসরঘর লণ্ডভণ্ড করে রেখেছে। ফুলের মালা সব ছিড়ে ফ্লোরে ফেলে তার উপর হাতপা ছড়িয়ে বসে আছে। এলোমেলো চুলে মুখ ডেকে আছে। র*ক্তিম বুজে আসা চোখে গোলগোল চেয়ে। বিরবির করে কিছু বলছে। প্রিয়’কে দেখেই তেড়ে আসতে চাইল। ঘাবড়াল না প্রিয়। লুবনার দিক বিরক্তির মুখ করে চেয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে ড্রা*ক’স নিয়েছে। প্রিয়’র দিক তেড়ে আসতে দেখে রেগে গেল শতাব্দ। ক্ষে*পে লুবনার দিক পা বাড়াল। এর কোন একটা বিহিত করেই ছাড়বে আজ।
পরিস্থিতী বিপরীত। শতাব্দকে এমন ক্ষে*পতে দেখে ছবি বেগম এসে সামনে দাঁড়াল। হাত জোড় করে সবার থেকে ক্ষমা চাইল। ‘লুবনা অসুস্থ’ তা বলে কথা এড়িয়ে চলে গেল।

রাত নেমেছে। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। মাথা যন্ত্রণা করলেও চোখে ঘুম নামছে না একদম। হিম শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে গা।
শতাব্দ ঘরে আসেনি এখনো। বাবার সাথে কথা বলে লুবনার ব্যাপারটা ইতি টানতে গেছে। ঘর জুড়ে আবছা অন্ধকার। ড্রিম লাইটের আলোয় ছেয়ে আছে সামান্য।
আচমকা একজোড়া হাত এসে প্রিয়’র কোমর জড়িয়ে ধরেছে। মুখ গুজেছে ঘাড়ে। পেছনের মানুষটার তপ্ত নিশ্বাস গলায় পড়তেই কেঁপে উঠল প্রিয়। নিজেকে ছাড়ানো যথাসাধ্য চেষ্টা করল। পারলো না! পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে আরো। চোখ বুজে নিগূঢ় আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল শতাব্দ,
‘ নতুন বউকে আদর করব নাকি অভিমানী প্রেমিকার মান ভাঙ্গাবো প্রিয়?’
সামনের থেকে উত্তর এলো না কোন। প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করল শতাব্দ। কোন উত্তর না পেয়ে, প্রিয়’কে নিজের দিক ফিরালো। নেশাতুর চাহনিতে নিমিষ চেয়ে রইল। দু’গালে হায় ছুঁয়ে বেঘোরে চেয়ে রইল। আবছা আলোতে চন্দ্রসুধা’র মত জ্বলে আছে প্রিয়। টলমল চাহনি তার। অধৈর্য হয়ে উঠল শতাব্দ। অস্থির হয়ে প্রিয়’র দিক ঝুঁকে পড়লো। চোখ বুজে প্রিয়’র গায়ের মাতাল সুবাসে মিলিয়ে যেতে লাগল। ঠোঁট জোড়ায় ছুঁই ছুঁই ভাব। অমনি প্রিয়’র ঝাঁজাল আওয়াজ কানে এলো ,
‘ এইসব ভালোবাসার নাটক এই শরীরি চাহিদার জন্য তাইতো?’
বিতৃষ্ণা নিয়ে চোখ খুলল শতাব্দ। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিলো। প্রিয়’র চোখেমুখে তাচ্ছিল্য। কন্ঠে ক্ষুব্ধ রাগ নিয়ে বলল,
‘ যখন চাহিদা শারিরীক তাহলে বিয়ে, ভালোবাসার নাটক করার কি দরকার ছিল? আমাকে বলতেন চলে যেতাম হোটেলে। অন্তত এই বাধ্যবাধকতার সম্পর্ক থেকে তো মুক্তি মিলতো।’
শতাব্দের মেজাজ বিগড়ে গেল। লাথি মে*রে পাশের টি টেবিলটা দূরে ছু*ড়ে ফেলল। রাগী ধাপ ফেলে প্রিয়’র দিক এগিয়ে এলো। বাহু চেপে ভারী গর্জন করে বলল,
‘ তোমার সত্যি মনে হয় আমার তোমাকে শারিরীক চাহিদার জন্য চাই?’
প্রিয় শক্ত চোখমুখ। উত্তর দিলো না কোন। শতাব্দ চিৎকার করে বলল,
‘ উত্তর দিচ্ছ না কেন?’
প্রিয় কেঁপে উঠল। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। বলল,
‘ হ্যাঁ’
ক্ষেপে উঠল শতাব্দ। ঘর কাঁপা আওয়াজে চেঁচিয়ে বলল,
‘ যদি তাই করার হতো তাহলে কু*ত্তার মত এতবছর পিছনে পড়ে থাকতাম না। বাড়ি থেকে তুলে, হোটেলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ছেড়ে দিতাম। তুই আসলে…..’
প্রিয়’র মুখপানে চেয়ে থেমে গেল শতাব্দ। ফোসফোস শ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। এমন ঘনিষ্ঠ সময়ে প্রিয়’র এমন আচরণ কথাবার্তা মাথা বিগড়ে দিয়েছিল। কোন পুরুষের পক্ষেই এমন পরিস্থিতীতে মাথা ঠান্ডা রাখা সম্ভব না। একটু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে প্রিয়’র দিক এগিয়ে গেল শতাব্দ। প্রিয়’র গালে আলতো হাত রাখল। মলিন দৃষ্টিতে চেয়ে করুণ কন্ঠে বলল,
‘ কি ভাবে ভালোবাসলে আমার সেই প্রিয়কে ফিরে পাবো আবার।’
‘বোধহয় পাবেন না আর। ম*রে গেছে সেই প্রিয়।’
যন্ত্রের মত করে উত্তর দিলো প্রিয়। প্রিয়’র গাল ছেড়ে হতাশ শ্বাস ফেলল শতাব্দ। বলল,
‘ তোমাকে না ছুঁয়ে থাকা যদি আমার ভালোবাসার পরিক্ষা হয়। তাহলে তাই হোক! তুমি আমার নয়ন ডোরে আবদ্ধ এতটুকুই আমার যথেষ্ট।’

চলবে……..