ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)
৩৫.
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ)
পর্দার আড়াল হতে উপচে আসা রোদ, চোখে পড়তে নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। আধো আধো চোখ মেলে আশেপাশে চাইল। অন্ধকার ঘরে এক ফালি রোদ এসে ছুঁইছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। তড়বড়ে হাতে বিছানায় মোবাইল খুঁজল। বালিশের পাশেই পেল। ঘড়িতে আটটা বাজছে। হেলেদুলে বিছানা ছাড়ল। ফ্রেশ হয়ে আলতো পায়ে শতাব্দের ঘরের সামনে গেল। ঘরে নেই শতাব্দ। এতো সকাল সকাল কোথায় গেল? আনমনা হয়ে ড্রাইং রুমের দিক এলো। কড়াই, খুন্তির আওয়াজে চমকে উঠল। রান্না ঘরে ধোঁয়া উড়ছে। কেউ রান্না করছে। কে করছে? শতাব্দ! আশ্চর্য মুখভঙ্গি নিয়ে সেদিকে পা বাড়াল। রান্নাঘরের দরজার সামনে যেতে চমকে উঠল। সেখানে মাঝবয়েসী একজন মহিলা রান্না করছে।
প্রিয়’র উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনে ফিরলেন তিনি। এক গাল হেসে বলল,
‘ কিছু লাগবো ম্যাডাম?’
হতভম্ব স্বরে প্রশ্ন করল প্রিয়,
‘ আপনি কে?’
কপালের ঘাম মুছে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
‘ আমি রহিমা। এই ছুসাইটির দারোয়ানের বউ। অনেক বছর এখানে কাজ করি। রান্নাবান্না, ঘর গোছানো সব করি। পোলাও গোস্ত সব রান্না পারি।’
মাথা নাড়াল প্রিয়। ঠোঁট গোল করে বলল, ‘ওহ’
রহিমা আবারও জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনার কিছু লাগবো ম্যাডাম?’
দুদিকে মাথা নাড়াল প্রিয়। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘ উনি কই?’
‘ কে শতাব্দ স্যার?’
মাথা ঝাঁকাল প্রিয়। রহিমা বলল,
‘ স্যার তো চইলা গেছে।’
অবাক হলো প্রিয়। ঘড়ির দিক চাইল। সবে আটটা বিশ। হতভম্ব হয়ে বলল,
‘ এতো তাড়াতাড়ি!’
‘ স্যার সবসময় এইসময়ই যায়। সকাল বেলা অফিস আদালতের সময় জ্যাম থাকে। তাই তাড়াতাড়ি বাইর হয়। কেন জানেন না আপনি? কইয়া যায় নাই?’
লজ্জায় পড়ে গেল প্রিয়। নিজের স্বামীর খবর বাড়ির কাজের লোক থেকে শুনতে হয়। চুপ করে রইল। রহিমা মৌনতার কারণ বুঝল হয়তো। বলল,
‘ মন কষাকষি চলতাছে বুঝি। ব্যাপার না নতুন বিয়া হইলে হয়। আমগো বিয়ার বিশ বছর। তেনার সাথে এখনও ঝামেলা হয়। দিনের বেলা হাজার ঝামেলা মা*রামারি কা*টাকা*টি যাই থাকুক রাইতে বিছানায় আইলে মিটা যায়। পুরুষ মানুষ তো।রাগ কইরা আর কতক্ষণ থাকবো।’
লজ্জায় মাখোমাখো হয়ে গেল রহিমা। কথা এড়াতে চাইল প্রিয়। বলল,
‘ উনি নাস্তা করে গেছে?’
‘ এক কাপ চা খাইয়া গেছে শুধু। আপনারে নাস্তা দিমু ম্যাডাম?’
মাথা নাড়াল প্রিয়। রহিমা রান্নাঘরের দিক পা বাড়াল। পেছন থেকে ডাকল প্রিয়। রহিমা থেমে গেল। পিছনে ফিরল। বলল,
‘ কিছু বলবেন ম্যাডাম?’
প্রিয় গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ আমাকে ম্যাডাম বলবেন না। আমার নাম ধরে তুমি করে ডাকবেন খালা।’
ছলছল করে উঠল রহিমার চোখ। ঢাকা শহরে এসেছে এতবছর! আজ অবধি এভাবে বলেনি কেউ। গরিব বলে বড়ঘরের লোকেরা দূরদূর করে তাড়িয়েছে সবসময়। প্রিয়’র মুখে ‘খালা’ ডাক শুনে অদ্ভুত এক টান জন্মাল। মনের কোণে প্রিয়’র প্রতি সম্মানটা আরো বাড়ল।
ক্লাসের জন্য রেডি হয়ে বাহিরে বের হতে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এলো। গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে কিন্তু কিন্তু করে বলল,
‘ স্যার গাড়িতে যেতে বলেছে ম্যাডাম।’
কপাল কুঁচকে তাকাল প্রিয়। জিজ্ঞেস করল,
‘ উনি গাড়ি করে যায়নি?’
‘ জি। স্যারকে পৌঁছে দিয়ে মাত্রই ফিরছি।’
‘ ওহ’
উবার আসতেই সামনের দিক পা বাড়াল প্রিয়। ড্রাইভার পেছন থেকে ডাকল। কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করল,
‘স্যারকে কি বলব ম্যাডাম?’
‘ আপনার কিছু বলতে হবেনা। যা বলার আপনার স্যারকে আমি বলব।’
বলেই উবারে চড়ে চলে গেল প্রিয়।
কেবিনের বাহিরে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা ‘ ডা. আহসান খাঁন শতাব্দ। তখন দুপুর দেড়টা। লাঞ্চ ব্রেক। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে শতাব্দ। চোখমুখ ক্লান্ত ভীষণ। ছুটিতে অনেক কাজ জমেছে। রোগী দেখে আপাতত ভীষণ ক্লান্ত সে। মোবাইল বের করতে, ড্রাইভারের অনেক গুলো মিসকল দেখল। কল ব্যাক করে ড্রাইভারের কাছ থেকে সকালের ঘটনা শুনল। কপালে হাত বুলিয়ে, হতাশ শ্বাস ফেলল শতাব্দ। মাথা ধরছে প্রচন্ড। কিভাবে ফিরে পাবে তার সেই প্রিয়। লোকে নাকি বউ নাচায়? অথচ তার সাথে ঘটছে উল্টো। আজকাল নিজেকে নিরুপায় লাগে প্রচণ্ড। যেখানে পুরো গ্রামের লোক, সিনিয়র, জুনিয়র তার ইশারায় চলে। সেখানে নিজের বউ তার অবাধ্য। জোর খাটিয়ে যদি প্রিয়’কে পাওয়া যেত, কবেই না পেয়ে যেত। কিন্তু তা সম্ভব না। মনের ব্যাপার গুলো ভীষণ নাজুক হয়। এখানে ক্ষমতা, জোরজবরদস্তি কিছুই খাটে না। ভালোবেসে-ই ভালোবাসা পাওয়া যায়। যদিও তা অনিশ্চয়!
কিছু একটা ভেবে মোবাইল হাতে নিলো শতাব্দ। ফেসবুকে লগইন করতেই দেখল নোটিফিকেশন। লাইভে এসেছে প্রিয়।পড়নে ড্রার্ক পিংক ঢাকায় জামদানী শাড়ি। হাত ভর্তি কাচের চুরি। নিদারুণ সেজে ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে। বেশ গুছিয়ে সুন্দর করে মন্তব্যের উত্তর দিচ্ছে,শাড়ির কোয়ালিটি ম্যাটেরিয়াল নিয়ে বলছে। মাঝেমাঝে কথার ফাঁকে আনমনা হাসছে। বিয়ের পর এই প্রথম প্রাণ খুলে হাসতে দেখছে। কি দারুণ লাগছে এই হাস্যোজ্জ্বল প্রিয়’কে।
মাঝেমধ্যে খুব রাগ হয় শতাব্দের, প্রিয়’র ভিউয়ার’সদের প্রতি প্রচন্ড হিংসা হয়। সবার সাথে হাসছে প্রিয়, কই তার জন্য একটু হাসেনা। তার জন্য কেন সাজে না। কেন তাকে একটু ভালোবাসেনা!
এক রাশ আক্ষেপ নিয়ে মোবাইলের স্কিনে আঙ্গুল ছোঁয়াল। কন্ঠে আফসোস জুড়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ তুমি আমার হয়েও, আমার হইলা না।’
সেদিনের পর পুরোপুরি বদলে গেছে প্রভা। আজকাল সমুদ্রের সন্দেহ হয়, ভীষণ চমকায়। সত্যি কি এটা তার-ই প্রভা? কথা বলা বন্ধ করেছে, বিছানা ছেড়েছে, শুধু ঘর ছাড়তে বাকি এখন। সম্ভব হলে ঘরটাও ছেড়ে দিতো বোধহয়। প্রভার এই রুষ্টতা মেনে নিতে পারছেনা সমুদ্র। অনেক তো হলো। আর কত? তার কথা একটাবার শুনুক অন্তত!
আটঘাট বেঁধে শক্ত হয়ে বসল সমুদ্র। যে করেই হোক, সামনা সামনি বসে প্রভার সাথে কথা বলে এর একটা বিহিত টানবে আজ।
রাতের খাবারের পর শাশুড়ীর হাতেহাতে সবকাজ গুছিয়ে ঘর ফিরল প্রভা। চৌকাঠ পাড় হতেই হাতে হেঁচকা টান পড়ল। ভারী আওয়াজে দরজা বন্ধ হলো। সবটা এত দ্রুত ঘটল যে, প্রভা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। শক্ত করে হাত চেপে ঝুকে আছে সমুদ্র। প্রভা হাত ছাড়াতে চাইল। শরীরের সব শক্তি মিলিয়ে ঠেলে সরাতে চাইল। পারল না। আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল সমুদ্র। প্রভা বিরক্তির কন্ঠ জুড়ে বলল,
‘ হাত ছাড়ো লাগছে আমার।’
সমুদ্রের অকপট আওয়াজ,
‘ লাগুক, ছাড়ব না হাত। আমার কথা শুনতে হবে আজ।’
‘ না শুনলে কি করবে তুমি?’ চাপা জিদ এঁটে বলল প্রভা।
‘ তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। তুমি শুনবে।’
প্রভা আরো বেশি রেগে গেল। হাত ঝাড়া দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সমুদ্র। আলতো স্বরে বলল,
‘ এতো ভালোবেসে, যুদ্ধ করে এমন ভবিষ্যৎ কি চেয়েছিলাম আমরা? এমন কিছুর তো কথা ছিলনা প্রভা!’
চিকচিক করে উঠল প্রভার চোখ। নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করার চেষ্টা করল। ভাঙ্গা সুরে বলল,
‘ তখন এই লুকোচুরি খেলার কথা যে জানতাম না।’
‘ সে আমার অতীত ছিল।’
‘ আমি তোমার জীবনের দ্বিতীয়জন, মানতে পারছিনা। তাকে এখনো ভালোবাসো? তাই বুঝি তার স্মৃতি আগলে রেখেছ!’
‘ আমার কালো অতীত সে। তুমি আমার একমাত্র।’
‘ অনেক দেরি হয়ে গেছে। মানতে পারছিনা আর।’
চোখমুখে হাত ঢোলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুমি কি চাও এভাবেই চলুক। দুরত্ব বাড়ুক?’
‘ দুরত্ব বাড়িয়ে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়। বাড়ুক না! ক্ষতি কি। ‘
অনড় চেয়ে আছে সমুদ্র। খানিক চুপ থেকে প্রভা আলতো স্বরে বলল,
‘আমার কিছু সময় চাই আপাতত।’
সমুদ্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে, চাদর নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল প্রভা।
বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বাজল। দরজা খুলে বিমূঢ় শতাব্দ। অন্ধকারে বিলীন চারিপাশ। তবে কি প্রিয় বাড়ি ফিরেনি? কপাল কুঁচকে আলো জ্বা*লালো। ভেতরে এসে আরো বেশি চমকাল। সব ঘরের আলো বন্ধ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে, প্রিয়’র ফোনে ফোন করল। বাড়িতেই বাজছে কোথাও। মোবাইলের রিংটোনের অনুসরণ করে বারান্দায় গেল। ঝুলন্ত দোলনায় বইয়ের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে প্রিয়। স্বস্তির শ্বাস ফেলল শতাব্দ। এক গাল হাসল।
বিয়ের এক সাপ্তাহ আগে বারান্দা রিডেকোরেট করিয়েছিল। কিছু গাছ এনেছে আর বড় একটা দোলনা ঝুলিয়েছে। দোলনা ঝুলা প্রিয়’র ভীষণ পছন্দ। ইমান্দিপুর প্রিয়’র নানা বাড়িতে দোলনা ছিল। সেখানে বসে সারাক্ষণ ঝুলতো। প্রিয়’র অবসর সময় এখানে কাটাবে বলে এসব করিয়েছিল। যাক কিছু তো পছন্দ হয়েছে ওর।
কয়েক কদম বাড়িয়ে দোলনার দিক এগিয়ে গেল। বইয়ের উপর মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে প্রিয়। পড়নে এখনো দুপুরে লাইভে পড়া সেই শাড়ি। মুখের মেকআপ তুললেও কাচের চুড়ি খোলা হয়নি। বাতাসে ঝনঝন করে বাজছে। চোখমুখ ক্লান্ত ভীষণ। রাতের খাবার খায়নি নিশ্চয়ই।
কারো ডাকে পিটপিট চোখ মেলল প্রিয়। দুর্বল হাতে ভর দিয়ে, ভারী মাথা তুলে উঠে বসল। পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল! টেরই পায়নি। ঘোলাটে চোখ জোড়া স্পষ্ট করে সামনে তাকাল। শার্টের হাতা ফোল্ড করা, কিচেন এপ্রোন পড়ে দাড়িয়ে আছে শতাব্দ। নড়েচড়ে বসলো প্রিয়। নিজের দিক নজর পড়তেই বড়বড় হয়ে এলো চোখ। কৌটা থেকে বেরিয়ে আসবে যেন। শাড়ির পাড় হাঁটু অবধি ঠেকেছে, বুকের আঁচল খানিক ঝুলে। লজ্জায় চোখজোড়া বুজে এলো। তড়িঘড়ি হাত চালিয়ে শাড়ি ঠিক করল। ধুপধাপ পা ফেলে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কখন এসেছেন আপনি?’
শতাব্দের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি আভাস। কন্ঠ শান্ত রেখে উত্তর দিলো,
‘ অনেকক্ষণ।’
‘ আমাকে ডাকেননি কেন?’ বিমূঢ় কন্ঠে বলল প্রিয়।
‘ ঘুমাচ্ছিলে। তাই বিরক্ত করিনি। রহিমা আন্টি কখন বেরিয়ে?’
‘ সন্ধ্যায়। যেতে চাচ্ছিল না। রাত হচ্ছিল তাই চলে যেতে বলেছি।’
‘ রাতে খাওয়া হয়েছে?’
‘ না’
‘ আমার আসার অপেক্ষা করছিলে?’
অস্বস্তিতে পড়ল প্রিয়। চোখমুখ স্বাভাবিক রেখে বলল,
‘ না, পড়ছিলাম খাওয়ার খেয়াল ছিলনা।’
হাসল শতাব্দ। বলল,
‘ খাবার রেডি চলো।’
কথা বাড়াল না প্রিয়। কুলি করে, হাত ধুয়ে চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল।আগেই ফ্রিজ থেকে সব নামিয়ে গরম করে টেবিল সেট করে রেখেছে শতাব্দ। কিচেন এপ্রোন খুলে প্রিয়’র সামনা সামনি চেয়ারটায় বসল। চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে প্রিয়। নিগূঢ় হয়ে শতাব্দের দিক চেয়ে আছে। ফোল্ড করা শার্টের হাতা, পরিপাটি মানুষটা সবকিছু গোছগাছ করে রেখেছে। ঠিক যেন জেন্টলম্যান!
প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে দিতে প্রিয়’র মুখপানে চাইল শতাব্দ। ভীষণ ক্লান্ত মুখ। একদিনেই মুরছে গেছে চেহারা। ঘুমে লাল টলমলে হয়ে আছে চোখজোড়া। শতাব্দ বলল,
‘ পড়াশোনা কাজ এক সাথে চালিয়ে নিতে কষ্ট হলে। আপাতত কাজ থেকে ব্রেক নিতে পারো। ফাইনাল এক্সামের পর কন্টিনিউ করিও আবার।’
স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো প্রিয়,
‘ আমার কাজ আমার পরিচয়। প্রিয়’কে কেউ চিনেনা। অশীতা জাফর প্রিয়কে অনেকেই চিনে। যখন আমি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কলেজের পর বিষন্ন ভরা অবসর সময় পাড় করছিলাম, তখন আমার কলেজের প্রত্যাশা ম্যাম তাদের ছোট ব্যাবসা’র মুখ হতে অনুরোধ করলেন। উনার আর তার ছোটবোনের ব্যাবসা। উনাত নামেই ‘প্রত্যাশা শাড়ি ব্র্যান্ড’। প্রথমে রাজি না হলেও, বিষন্নতা গোছাতে রাজি হলাম। শুরুর দিকে শাড়ির মডেল হলেও আস্তে আস্তে লাইভ করতে শুরু করলাম। আমার কনফিডেন্স লেভেল বরাবরই শূন্যের কোটায়। প্রথম লাইভে ভীষণ এলোমেলো, অশান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি হার মেনে নিয়েছিলাম একপ্রকার । প্রত্যাশা ম্যাম তখন সাহস জোগা্ল। এক নতুন আমি’র সাথে আমার পরিচয় হলো।পরবর্তীতে ব্যবসা বড় হলো, ছোট ব্যবসাটা ‘প্রত্যাশা শাড়ি ব্র্যান্ড ‘ নামে পরিচিতী পেল। জনপ্রিয়তার তুখোড়ে পৌঁছাল। আমি হলাম ব্র্যান্ড প্রমোটর। প্রত্যাশা শাড়ি ব্র্যান্ড আমার পরিবারেরই অংশ। যদিও অন্যকাজের তুলনায় আমার কাজটা তুচ্ছ। তবুও আমার কাজই আমার সব।’
‘ কাজ থেকে বিরতি নিবেনা। জ্যামজটের শহর। ক্লাস কাজে দৌড়াদৌড়ি করো। অন্তত গাড়িটা নিয়ে তো যেতে পারো! ‘
‘ প্রয়োজন নেই। এর আগেও আমার জীবন চলছিল। বিলাসবহুল জীবন আমার চাইনা। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত চলতে পছন্দ করি।’
কাঠকাঠ হয়ে চেয়ে রইল শতাব্দ। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ আমার চিন্তা হয়। সারাক্ষণ ব্যাকুল থাকে মন।’
‘ কাজ ফেলে যদি আমার চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করে সারাক্ষণ। সেটা আপনার সমস্যা। আমার না।’
‘ তো তুমি গাড়ি ব্যাবহার করবে না?’
‘ না’ প্রিয়’র রুখা উত্তর।
বিরক্ত হলো শতাব্দ। খাওয়া হলো না আর। রাগ চেপে, আড়ষ্ট হয়ে চেয়ে রইল মুখপানে প্রিয়’র।
চলবে………
ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )
৩৬.
( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
সময় বহমান। কারো জন্য থেমে থাকেনা। দিন ঘুরে রাত নামছে। সাপ্তাহ ঘুরে মাসে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু সম্পর্ক গুলো তখনো এলোমেলো অগোছালো। প্রত্যেক সম্পর্কের ভিন্ন ভিন্ন সমীকরণ। দূর থেকে দেখতে সম্পর্কগুলো একইরকম হলেও, বিচ্ছেদের কারণ গুলো ভিন্ন। কারো কারো মাঝে হাজারো দূরত্ব, কারো আবার এক ছাদের তলায় থেকেও না ছুঁতে পারার আক্ষেপ!
ভালোবাসার মাস। চারিদিকে বসন্ত আগমনি গান। ডালে ডালে হলুদ সাদা নানারকম ফুল। প্রকৃতি নতুন রূপে সাজতে মশগুল।
উৎসব মুখর ভার্সিটির আঙ্গিনা। পহেলা ফাল্গুনের আয়োজন চলছে। সিনিয়র জুনিয়র সকলে একত্রে জড় হয়েছে। প্রিয় মুখখানার সন্ধানে চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে। না, এখানে নেই সে।আশেপাশে কোথাও দেখছে না তুরফাকে। প্রচন্ডরকম বিরক্ত হলো শাদ। মোবাইল বের করে ফোন করতে, দেখল বন্ধ। ঢুকছে না ফোন। তুরফা কি আবারো তার নাম্বার ব্লক করেছে? আচমকা শাদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হন্য হয়ে তুরফাকে খুঁজতে শুরু করল। আশেপাশে খোঁজ করে, ক্যানটিনের দিকে পা বাড়াল। সদর দরজায় দাঁড়াতেই তুরফাকে দেখল। পেছনের টেবিলে জড়সড় হয়ে বসে। নোট বানাতে ব্যস্ত। ক্ষিপ্ত পা চালিয়ে তুরফার সামনে চেয়ার টেনে বসল।
শাদের উপস্থিতি ঠাহর করেও, মাথা তুলে চাইল না তুরফা। সম্পূর্ণ মনযোগ নিয়ে নোট বানাতে ডুবে আছে এখন।
তুরফার গম্ভীর মুখপানে নিমিষ চেয়ে শাদ। এতো এতো কৃত্রিমতার ভীড়ে , কোনরকম প্রসাধনী বিহীন সাদাসিধা সুশ্রী মুখ। মেয়েটার সাধারণ রূপই তাকে আরো বেশি অসামান্য করে বানায়। এইযে মেয়েটার গম্ভীরতা, রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা তাকে কতটা টানে সেই কথাটা কি মেয়েটা জানে? জানেনা। জানলে নিশ্চয়ই এভাবে তাকাত না।
কিছু সময় পিনপতন কাটল।গলা উঁচিয়ে শাদ ডাকল। তুরফা শুনেও, কানে তুলল না। রেগে গেল শাদ। তুরফার সামনের নোট খাতাটা টেনে নিলো। গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ সমস্যা কি তোমার! আমার কথা কানে যাচ্ছে না? ‘
চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে তুরফা কোন উত্তর দিলোনা। শাদের রাগ আরো বাড়ল। শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জার সব জায়গা থেকে ব্লক করেছ। ব্লাকলিষ্টে ফেলে রেখেছ। আমি কি তোমাকে খুব জ্বালাই?’
তুরফা এবার মুখ খুলল। চোখমুখে বিরক্তি এঁটে বলল,
‘ তোমাকে সহ্য হয়না। জাস্ট অসহ্য লাগে আমার!’
শাদ ক্ষে*পে গেল। পা দিয়ে তুরফার টেয়ার টেনে সামনে আনল। ভারী খড়খড় শব্দ হলো। তুরফার মুখের দিক ঝুঁকে গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ কি করেছি আমি? জোর করে চুমু খেয়েছি। নাকি বাজে ভাবে স্পর্শ করেছি?’
রাগে ফেটে পড়ল তুরফা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ দিন দিন অসভ্যতার মাত্রা ছাড়াচ্ছ। কি দারুণ! অপরাধ করে সাধু সাজছ। ছি আমার ভাবতেও অবাক লাগছে। নিজ স্বার্থে এত নিচে নামতে পারো তুমি?’
হতভম্ব শাদ। কন্ঠে বিস্ময় জুড়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ আশ্চর্য! আসার পর থেকে যা মুখে আসছে তাইল বলছ। কি করেছি তা বলবে তো অন্তত।’
অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে রইল তুরফা। রাগে চেচিয়ে বলল,
‘ তোমার তরফদারি করে আমাকে বুঝাতে প্রিয় আপাকে বলোনি?’
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে শাদ। বিস্ময় কাটিয়ে বলল,
‘ উনাকে আমার হয়ে তরফদারি করতে কেন বলবো?’
‘ মিথ্যা বলবেনা প্লিজ। তুমি না বললে তো আপা এমনি এমনি বলেনি।’
শাদ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি বলেছে উনি?’
তুরফা খানিক চুপ থেকে শিথিল কন্ঠে বলল,
‘ গতরাতে আপার সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল। কথা বলার এক পর্যায় তোমার কথা তুলল। সম্পর্কটা নিয়ে আরেকবার ভাবতে বলল। এসব বলতে তুমিই বলেছ। তাইনা?’
শাদ হতভম্ব, গম্ভীর। প্রিয় সাথে তার দেবর ভাবির হলেও সম্পর্ক হলেও। এখন অবধি ঠিকঠাক ভাবে তার সাথে কথাটা পর্যন্ত বলেনি। সেখানে তার জন্য তুরফার কাছে তরফদারি করতে বলবে! অসম্ভব। শাদ আরো গম্ভীর হয়ে তাকাল। বলল,
‘ তোমার কি সত্যি মনে হয় উনাকে এসব বলেছি? আমি কি এতটাই দুর্বল যে, আমার জন্য আকুতি মিনতী করতে অন্য কাউকে পাঠাব!’
তুরফা চুপ। শাদ আবারো বলল,
‘ আমার আত্মীয় তোমার বোনকে মে*রেছে এই অযুহাত দেখিয়ে সম্পর্ক মানতে চাইছ না। তাহলে উনাকে কেন এত পছন্দ করো? যাকে আপা আপা বলে মুখে ফেনা তুলো সে এখন আমাদের পরিবারেরই একজন।’
তেতে গেল তুরফা। রেগে চেয়ার ছেড়ে উঠল। শাদের দিক ঝুঁকে বলল,
‘ তোমার এখনো অযুহাত মনে হয়? এই বিশ্বাস করো আমায়।’
তাচ্ছিল্য হাসল তুরফা। ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,
‘ প্রিয় আপা তোমাদের পরিবারের অংশ হয়েও, তোমাদের কেউনা। এই বিয়ের পেছনে বড় উদ্দেশ্য আছে আপার। সে আমাকে কথা দিয়েছে, ন্যায় বিচার এনে দিবে।’
ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল তুরফা। চেয়ারে হতভম্ব হয়ে বসে রইল শাদ। তুরফার বলা কথা গুলো যদি সত্যি হয়। তাহলে, কি উদ্দেশ্যে এসেছে প্রিয়? কেন-ই বা শতাব্দকে বিয়ে করল।
ভার্সিটিতে ক্লাস ছিলনা আজ। সকাল সকাল অফিসে চলে গেছিল। পহেলা ফাল্গুন আজ। বেশ কয়েকটা লাইভ, ইভেন্ট ছিল। সব কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হলো। টি টেবিলে ব্যাগ রেখে, চোখ বুজে গা এলিয়ে দিলো সোফায়। ক্লান্তিতে ম্যাচ ম্যাচ করছে গা। অমনি ভেতর ঘর থেকে শতাব্দ এলো। হাতে ফোন। শতাব্দের আঁচ পেয়ে চোখ খুলল প্রিয়। শতাব্দ ফোন এগিয়ে দিলো। বলল,
‘ তোমার জন্য ফোন।’
ভ্রু কুঁচকে নিলো প্রিয়। ফোন কানে ধরতে অপর পাশ হতে রিক্তা বলল,
‘ কেমন আছো প্রিয়? রাতে ডিনারে তোমরা আসছো তো?’
প্রিয় হতভম্ব দৃষ্টিতে শতাব্দের মুখপানে চাইল। ডিনারের কথা আগে বলেনি শতাব্দ। প্রিয়’র ক্লান্ত চোখমুখ দেখে শতাব্দ রিক্তাকে না করতে যাচ্ছিল, অমনি প্রিয় কথা কে*টে হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলল,
‘ ভালো। আপনি কেমন আছেন? জি আপু আমরা আসছি।’
দুজনের আরো কিছু কথা হলো। কথা শেষে ফোন রাখতে শতাব্দ বলল,
‘ মেডিকেল ফ্রেন্ডদের গেট টুগেদারের আয়োজন। তুমি ক্লান্ত। ডিনারে যাওয়াটা জরুরী না। তুমি যেতে না চাইলে কোন বাহানা দিয়ে স্কিপ করতে পারি।’
‘ স্কিপ করার দরকার নেই। যেতে চাইছি আমি।’
‘ আর ইউ শিয়োর?’
প্রিয় মাথা নাড়াল।
খুব অল্প সময়ে প্রিয় তৈরি হয়ে এলো। ড্রইং রুমে আগে থেকে তৈরি হয়ে প্রিয়’র অপেক্ষায় বসে ছিল শতাব্দ। উঁচু হিলের ঠকঠক আওয়াজে শতাব্দের ঘোর কা*টল। ফোন থেকে চোখ উঁচিয়ে সামনের দিক চাইল। কালো মসলিন শাড়ি পড়ে, চোখে গাঢ় কাজল ল্যাপে, ঠোঁট মেরুন লিপস্টিকে রাঙিয়ে চমৎকার সেজে। চুলের খোপা ঠিক করতে করতে এদিকে আসছে প্রিয়। মন্ত্রমোহের মত উঠে দাঁড়াল শতাব্দ। প্রিয়’র মুখপানে নিগূঢ় চেয়ে রইল। ছোট ছোট পা চালিয়ে শতাব্দের সামনে এসে দাঁড়াল।
দু’কদম এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল শতাব্দ। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। চোখজোড়া নামিয়ে নিলো। শতাব্দ আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হলো।প্রিয়’র খোপার ক্লিপ খুলে দিলো। সুড়সুড় করে লম্বা কেশ কোমর গড়িয়ে পড়ল।চুলে আলতো হাত চালিয়ে, ছাড়িয়ে দিলো শতাব্দ। কানের কাছে চুল সরিয়ে, মুখ এনে মৃদু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ নাও পার্ফেক্ট।’
প্রিয় যেন থমকে গেল। ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল।স্মিত হাসল শতাব্দ। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ তুমি চাইলে ডিনারে না গিয়ে, আমরা এখানে নিজেদের ব্যক্তিগত সময় কা*টাতে পারি।’
প্রিয় নড়েচড়ে উঠল। বড়বড় পা চালিয়ে আগে আগে রওনা হলো। পেছন থেকে হেসে ফেলল শতাব্দ।
ঢাকার নামীদামী রেস্তোরাঁয় রিজার্ভেশন করা ছিল। সবাই অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। প্রিয়দের যেতে দেরি হলো। রিক্তা ছাড়া আশেপাশে সকলেই অচেনা। বান্ধুবী ইরার বড় বোন রিক্তা। সেই সুবাদেই রিক্তাকে মোটামুটি চেনা। বন্ধুমহলে সবার সাথে এক এক করে পরিচয় করিয়ে দিলো শতাব্দ। সকলেই প্রিয়’কে দেখে হতভম্ব। মাঝের থেকে অঞ্জন বলে উঠল,
‘ এর আগে তোমার সাথে দেখা না হলেও, আমরা সবাই তোমার সাথে পরিচীত। আমাদের কাছে রূপকথার নায়িকা তুমি। হোস্টেলে থাকা কালিন নিয়ম করে রোজ দুইবেলা তোমার গল্প শুনেছি। কি সাহসী, কি অকপটে মেয়ে ছিলে তুমি! ‘
অবাক চোখে শতাব্দের মুখ পানে চাইল প্রিয়। শতাব্দের নিগূঢ় চাহনি, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। পাশ থেকে রিক্তা বলল,
‘ কত আগে থেকে তোমাকে চিনি। অথচ জানতাম না, যে তুমিই আমাদের ডক্টর শতাব্দের প্রাণপ্রিয়! অনেক গল্প শুনেছি তোমার। সত্যি তুমি মনমুগ্ধকর।’
অঞ্জন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কথা কা*টলো শতাব্দ। কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। শতাব্দের লুকোচুরি ধরতে পেরেও সবার সামনে কিছু জিজ্ঞেস করল না প্রিয়।
ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা চল্লিশ। অঞ্জনের ঘাড়ে ভর দিয়ে চোখজোড়া ছোট ছোট করে আলতো চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ।
শতাব্দকে ড্রাংক দেখে হতভম্ব প্রিয়। ছেলেরা আলাদা আড্ডা দিচ্ছিল। সেই আড্ডায় ড্রিংকস ছিল জানা ছিলনা প্রিয়’র। শতাব্দের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে চুল ছিড়ে ফেলতে এখন। ক্রু*দ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। অঞ্জন আমতা আমতা করে বলল,
‘ ওর কোন দোষ নেই। বিকাশ! বেটা ফাজিল নতুন জামাই বলে বলে ধরে বেঁধে খাওয়াল। বেটা জানে শতাব্দের পেটে এসব পঁচা পানি সয়না। দু প্যাঁক মা*রতেই হুঁশ হারায়। তবুও এসব।’
এতটুকু বলে থেমে গেল। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রিয়। বাড়ি ফিরবে কি করে এখন? শতাব্দ ড্রাংক, ড্রাইভারকেও সাথে আনেনি।
অঞ্জন হয়তো বুঝল। বলল,
‘ সমস্যা নেই ভাবি, আমি বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি। ওই রোডেই আমার বাড়ি।’
স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। শতাব্দকে নিয়ে গাড়ির পেছনে সিটে বসলো। প্রিয়’র কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে শতাব্দ। বিড়বিড় করে কিছু বলছে আলতো। রাত বেশি হওয়ায় রাস্তাঘাট খালি প্রায়। মিনিট বিশেকে পৌঁছে গেল বাসায়। শতাব্দকে ঘর অবধি ছেড়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল অঞ্জন।
অঞ্জন চলে যেতেই সদর দরজা বন্ধ করে শতাব্দের ঘরে এলো। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে শতাব্দ। প্রিয় বিরক্ত হলো। এমন অবস্থা হবে আগে জানলে কখনো যেত না প্রিয়। একজন মানুষের কন্ট্রোল লেভেল এতটা ডাউন কি করে হয়।
কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। কোমরে শাড়ির আঁচল গুজে বিছানায় উঠে শতাব্দকে ঠিকঠাক শুয়িয়ে দিলো। পায়ের জুতা খুলে দিয়ে শরীরে চাদর টেনে যেই নিজের ঘরের দিক যেতে পা বাড়াল। অমনি শতাব্দ খপ করে পেছন থেকে হাত টেনে ধরল। বিমূঢ় মুখ নিয়ে প্রিয় পেছনে ফিরল। আধোআধো চোখে চেয়ে আছে শতাব্দ। আচমকা হেঁচকা টান দিলো। প্রিয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শতাব্দের বুকে যেয়ে পড়ল। হতভম্ব প্রিয় তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলে শতাব্দ আরো বেশি চেপে ধরল। কাছাকাছি মুখ এনে নিগূঢ়, মিহি কন্ঠে বলল,
‘ আজকের রাতটা এখানে থেকে যাও।’
বড় গোল গোল চোখ করে চেয়ে রইল প্রিয়। শতাব্দের চোখে গভীর ঘোর। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। সুস্থ স্বাভাবিক শতাব্দকেই তার প্রচন্ড ভয় হয়। এখন তো পুরোপুরি বেঘোরে সে। নিজেকে ছাড়ানো যথাসম্ভব চেষ্টা চালাল প্রিয়। কাজ হলো না। আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। স্বাভাবিক থাকলে কয়েকটা কড়া আঘা’ত করে কথা বলে রাগিয়ে, নিজেকে ঠিক ছাড়িয়ে নিতো। কিন্তু এখন রাগিয়ে দেওয়া মোটেও উচিত নয়। হিতের বিপরীত হবে উল্টো। অনেক চেষ্টা চালিয়ে কোন কায়দা করতে পারল না প্রিয়। ভারী-ভারী চোখ তুলে মুখপানে তাকাল শতাব্দ’র। শতাব্দ নাছড়বান্দা নিমিষ চেয়ে। প্রিয় ঢোক গিলল ভীতু স্বরে বলল,
‘ আমাকে ছেড়ে দিন। ঘুম ধরেছে, ঘরে যেয়ে ঘুমাব।’
শতাব্দে গাঢ় আওয়াজ,
‘ এটা কি ঘর না?’
‘ ছাড়ুন। আমি আমার ঘরে যাবো।’
‘ ছাড়বোনা। পারলে ছাড়িয়ে যাও।’
অসহায় হয়ে চেয়ে রইল প্রিয়।
শতাব্দ বুক থেকে নামিয়ে প্রিয়’কে পাশে শুয়িয়ে কোমরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নিজের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ করে মিশিয়ে নিলো। এবার প্রিয় আরো বেশি ঘাবড়ে গেল। এক ধ্যানে নিগূঢ় চেয়ে আছে শতাব্দ। মনে অদ্ভুত এক অস্বস্তি হতে শুরু করল। থরথর করে কাঁপছে হাতপা। শতাব্দ আরো ঝুঁকে এলো। তার তপ্ত নিশ্বাস মুখে পড়ছে প্রিয়’র। থরথরে কাঁপতে থাকা প্রিয় খানিক সাহস করল। আধোআধো স্বরে বলল,
‘ অস্বস্তি হচ্ছে। এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?’
হাসল শতাব্দ। কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে, প্রিয়’র ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ কেমন করে তাকিয়ে আছি প্রিয়?’
ভয়ে ঢোক গিলল প্রিয়। এই শতাব্দকে কি করে সামলাবে এখন!
চলবে…….
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।