ফিলোফোবিয়া পর্ব-৪৫+৪৬

0
598

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৪৫.

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

পুরানো খুবলে খুবলে উঠা মানিব্যাগের ভাঁজ থেকে একটা সাদাকালো ছবি বের করল শোয়েব। চোখের সামনে ভেসে উঠল আয়শার হাস্যোজ্জ্বল চন্দ্রপ্রভা মুখ। আনমনে শোয়েবের ঠোঁটের কোণে, মৃদু রেখা ভাসলো। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল পুরানো সেই দিন গুলো। গা জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ। আলতো হাতে আয়শার ছবিটায় ছুঁয়ে দিলো। অশ্রুভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে নিমিষ তাকিয়ে রইল। কান্নাভেজা অভিযোগ জুড়ে বলল,
‘ এত অভিমান এত ঘৃ*ণা আয়শা। কেন এমন করলে? আমার অন্যায়ের সাজা নিজেকে কেন দিলে! কেন ছেড়ে গেলে বহুদূরে। তোমার মৃ*ত্যু য*ন্ত্রণার চেয়ে, এই চোখের ঘৃ*ণা সহ্য করা আমার কাছে অনেক বেশি সহজ ছিল। নিজের লোভে সব হারিয়েছি। সারাজীবন শুধু ঘৃ*ণা কুড়িয়েছি। না রইলে তুমি, না রইল প্রিয়। প্রিয় সে যে তোমারি প্রতিচ্ছবি। তোমার মতই গভীর তার ঘৃ*ণার দৃষ্টি।’
বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে শোয়েব বিড়বিড় করছিল। ধুপধাপ পা ফেলে ছবি এলো। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে ভেজা চোখ মেলে তাকাল। ছবিকে দেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে অন্যদিকে তাকালো।
ছবি বাজখাঁই গলা করে বলল,
‘ উকিলের সাথে দেখা করেছিলে? সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ লিখে দিতে চাইছ ওই মেয়েটাকে? এতবড় সাহস তোমার। আমা্দের ভাগের সম্পত্তি লিখে দিবে ওকে। ওই ফ*কিন্নি’র বাচ্চাকে?’
রাগে চেঁচিয়ে উঠল শোয়েব,
‘ সাবধানে কথা বলো। প্রিয় আমার মেয়ে। আর আমি আমার সম্পত্তি কাকে দিবো, তার কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে কেন?’
ছবি বেগম রাগে গরগর করে উঠলেন। শোয়েবের পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরল। ক্রো*ধে রিরি করে বলল,
‘ অনেক হয়েছে, আর না। আজ যা কিছু আছে সব আমার জন্য। রাস্তার ফকিন্নি ছিলি। কু** ফিরে তাকাত না। আমার বাপ ভাইয়ের টাকা দিয়ে এখানে উঠেছিস। প্রথমে মা, এখন মেয়ে। সারাজীবন ওদের পেছনে কেন দাঁড়াতে হবে আমাকে? ছোট থেকে সবসময় কেন আয়শাই জিতে যায়।এত বছর আমার সাথে সংসার করেছিস, মনে মনে সবসময় শুধু আয়শাকেই চেয়েছিস। কেন? আমি যথেষ্ট ছিলাম না?’
ঝারি দিয়ে হাত ছাড়াল শোয়েব। রাগে গর্জিয়ে উঠল। বলল,
‘ তুমি সবসময় আয়শাকে হিংসা করতে। বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নিয়েও, আয়শার বরাবর কখনোই হতে পারোনি।ওর যা আছে তোমার তা চাই। তাই তো যখন মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে গ্রামে ফিরলাম, রাতে আমার ঘরে এসে আমাকে ফাঁসিয়েছিলে। লোক শালিস বসিয়ে বিয়ে করলে! তোমার ঈ*ষা সব জ্বা*লিয়ে দিয়েছে।’
‘ এখন সব দোষ আমার? মেয়ের পরিচয় জেনে পিতৃপ্রেম জেগেছে! র*ক্তের ঘ্রাণ টানছে। তাইনা? তুই যে আমার বাপের টাকা দেখে বিয়ে করলি, আয়শাকে ঠকালি। এখন চাপা পড়ে গেল সব? স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। সামনে আমার নির্বাচন ওই মেয়ের জন্য যদি কোন ঝামেলা বাঁধে নিজের হাতে খু*ন করবো ওকে। এবার ছাড় পাবেনা। শতাব্দও বাঁচাতে পারবেনা। আর যদি তুমি বাঁধা হও, ছাড় দিবোনা তোমাকেও।’
শোয়েব টনটনে আওয়াজ,
‘ তোমার বাপ ভাই যেই টাকা ধার দিয়েছিল, তার তিনগুন ফিরিয়ে দিয়েছি তাদের। এই ব্যবসা সম্পত্তি টাকা পয়সা সব আমার পরিশ্রমে গড়া। আর আমিও দেখবো কিভাবে ক্ষ*তি করো আমার মেয়ের! এবার আয়শার স্বামীর না, প্রিয়’র বাবার মুখোমুখি হবে। একজন বাবা তার সন্তানের জন্য কতটুকু গভীর যেতে পারে, জানো নিশ্চয়ই।’
রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেল শোয়েব। যাওয়ার দিক ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ছবি বেগম। না, এভাবে আর চলবে না। আজকাল বড্ড বেড়ে গেছে শোয়েব। সারাজীবন আয়শাকে স্বামীর সুখ থেকে বঞ্চিত রেখেছে। তার ভালোবাসার শোয়েবের সাথে ঘর বেঁধে দিনের পর দিন তিলে তিলে মে*রেছে। এরচেয়ে ভ*য়ানক প্রতি*শোধ আর কি হতে পারে? এখন আয়শা নেই। ম*রে গেছে। শোয়েবকে দিয়ে এখন আর কাজ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পত্তি ট্রান্সফার করার আগে। রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে হবে তাকে। যতদ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে।

দুপুর মাড়িয়ে বিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ তারকা হোটেলের বিপরীত পাশের রাস্তাটায় গাড়ি থামিয়ে বসে প্রিয় শতাব্দ। দৃষ্টি হোটেলের গেটে। গেটের দিক তাকিয়ে প্রিয় সন্দিহান সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি শিয়োর বাবা আসবে?’
শতাব্দের আত্মবিশ্বাসী আওয়াজ,
‘ আমি ডেকেছি অবশ্যই আসবে।’
‘ যদি না আসে?’
‘ এক্ষুনি চলে আসবে, নিজ চোখে দেখে নিও।’
অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে প্রিয়। তার অস্থির দৃষ্টি উঁচিয়ে বারবার গেটের দিক তাকাচ্ছে। ঘড়িতে সময় দেখছে। মিনিট দশেক যেতেই, জাফর সাহেবের গাড়ি থামতে দেখল গেটের পাশে। উৎসাহিত হয়ে প্রিয় বলল,
‘ বাবা এসেছে!’
প্রিয়’র মুখপানে একপলক তাকাল শতাব্দ। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ বলেছিলাম আসবে। ভাইয়াদের লাউঞ্জে আসতে বলেছিলে?’
ঠোঁট মেলে হাসল প্রিয়। বলল,
‘ বলেছি। এবার কি হবে! ভাই আর বাবা মুখোমুখি হবে কিভাবে। আর হলেও যদি বাবা এড়িয়ে যায় ভাইকে।’
‘ থিংক পজিটিভ। উল্টোটাও ঘটতে পারে। হয়তো নাতিনাতনিদের দেখে বাবার মন গলতে পারে।’
প্রিয় ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকালো। কন্ঠে চাপা উত্তেজনা ঠেলে বলল,
‘ প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। বাবার সাথে তানিম ভাইকে সরাসরি দেখা করালেই হতো। এই নাটকীয়তার কি দরকার ছিল। যদি সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় এখন!’
শতাব্দ আশ্বস্ত সুরে বলল,
‘ নাটকীয়তার দরকার ছিল। তানিম ভাইকে বললে রাজি হতো না কখনো। বাবার সামনে দাঁড়ানোর তার সাহস নেই এখনো। কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়া, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হলে তার ট্রু ফিলিংসটা বেরিয়ে আসবে। আর তাছাড়া বাবার সাথে যতবার সময় কাটিয়েছি, বুঝতে পেরেছি ছেলের শূণ্যতা তাকে কতটা খাঁখাঁ করে পো*ড়ায়। তিনি হয়তো কখনো প্রকাশ করবেনা, তবে মনেপ্রাণে চায় ভাইয়া বাড়ি ফিরুক।’
‘ বাবার হয়তো এমনি। স্নেহ, ভালোবাসা আড়ালে রাখতে পছন্দ করেন।’
প্রিয়’র উদাসীন আওয়াজ। ছলছল চোখ। শতাব্দের চোখে পড়ল। কথা এড়াতে বলল,
‘ অনেকক্ষণ হয়েছে, সব ঠিক আছে কিনা ভিতরে গিয়ে দেখবে?’
শতাব্দের আওয়াজে প্রিয়’র ঘোর কাটল। বলল,
‘ চলুন যাই।’
গাড়ি থেকে নেমে দুজন চলে গেল ভিতরে। হোটেলের লাউঞ্জে পৌঁছাতেই বাপ ছেলের আবেগাপ্লুত হয়ে কান্না জড়িত আলিঙ্গন ভেসে উঠল চোখে। টলমল করে উঠল প্রিয়’র চোখ, এই দিনটা দেখার জন্য কতই না অপেক্ষা করেছিল। কাচের বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়। জাফর সাহেব নাতি নাতনিদের কোলে তুলে আদর করছে। চুমু খাচ্ছে। ইডিলি হাত জোড় করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলছে। দূরে থাকায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছেনা। শতাব্দ ডাকল। বলল,
‘ ভিতরে যাবে?’
মৃদু হাসল প্রিয়। শতাব্দের দিক ফিরে তাকাল। বলল,
‘ ইচ্ছে করছে না। এইসময়টা একান্তই বাপ ছেলের। তাদেরই ইঞ্জয় করতে দিন।’
হাস্যোজ্জ্বল মুখ অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখ নিয়ে গাড়িতে বসলো। আজ অনেক দিন পর বুকে প্রশান্তির হাওয়া বইছে। অতি আনন্দে চোখে জল নামছে। এই দিনটার জন্য কতই না অপেক্ষা ছিল। কত শতবার ভাইয়ের আফসোস শুনেছে। আহাজারি কান্না দেখেছে। সবশেষে বাপ ছেলের মিলন তিথি এসেছে।
চোখে জল দেখে এগিয়ে এলো শতাব্দ। হাত বাড়িয়ে আলতো করে মুছে দিলো। দু’গালে হাত রেখে বলল,
‘ আমার সব খাটনি বৃথা গেল। এই চোখে জল না, আনন্দ দেখতে চেয়েছি।’
হেসে ফেলল প্রিয়। শতাব্দ আবার বলল,
‘ চলো, তোমার মন ভালো করার জায়গায় যাই।’
নাকচ করল না প্রিয়। ঠোঁট মেলে হাসল শুধু। আর কয়েকটা দিনই তো! তারপর পাল্টে যাবে সব। সে শতাব্দের সাথে প্রাণবন্ত হয়ে, খোলা আকাশের নিচে একটু বাঁচতে চায়। প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে চায়। কিছু সুন্দর মুহূর্ত তৈরি করবে, যা ভেবে ভেবে এক জীবন পাড় করা যায়।

ইটপাথরের শহর ছেড়ে, কৃত্রিম আলোর আকাশ মাড়িয়ে। গাড়ি গ্রামের মেঠোপথে নেমেছে। নড়বড়ে রাস্তা দিয়ে, নদীর পাড়ে এসে থেমেছে। চারিদিকে অন্ধকার নামছে, কৃত্রিম আলো জ্বলতে শুরু হয়েছে। পাড়ের দিকের মানুষ কমতে শুরু হয়েছে। ঘাটপাড়ে নৌকা থেমেছে। হুড়মুড়িয়ে লোকজন উঠছে। পাশেই ঝালমুড়ি, আচার অন্যসব মুখরোচক খাবার নিয়ে বিক্রেতারা বসেছে। হুড়মুড় করে লোকজন ঝেঁকে ধরেছে। দোকানীদের বেশ বেচাকেনা চলছে। গ্রাম্যজীবনের এক ব্যতিক্রম পরিবেশ। মুহূর্তেই প্রিয়’র মন হালকা হয়ে এলো।
গাড়ি থেকে নেমে দুজন নিরিবিলি সিড়ির ধারে সবুজ ঘাসে যেয়ে বসল। নদীর শীতল হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। শরীর মনের ক্লান্তি কোথাও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক শান্তি লাগছে। এলোমেলো বাতাসে শাড়ির আঁচল অগোছালো, চোখে মুখে খোলা কেশের ঝাপটা এসে লাগছে। এলোমেলো বাতাসে চোখ বুজে আসছে প্রিয়’র। বুকের বা পাশে হাত রেখে আঁচল সামলাতে চেষ্টা করল। আচমকা একজোড়া হাত থামিয়ে দিলো। পিটপিট দৃষ্টি মেলে সামনে তাকাল প্রিয়। শতাব্দের গভীর দৃষ্টির নিমিষ চাহনি। নেশাতুর, অধৈর্য! দৃষ্টি নামিয়ে নিলো প্রিয়। শতাব্দের হাত ঠেলে দিতে চাইল। মানলো না শতাব্দ। প্রিয়’র কোমর টেনে মিশিয়ে নিলো। দমকা হাওয়ায় অগোছালো চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে প্রিয়কে বলল,
‘ তোমার এলোমেলো চুল গুছিয়ে দেওয়ার অধিকার একমাত্র আমার। আর এই অধিকার থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে পারবেনা কখনো!’
প্রিয় বিবস হয়ে নিমিষ চেয়ে রইল শতাব্দের চোখে। কি জানো এক অদ্ভুত যাদু আছে এই চাহনিতে। বারবার ডুবে যায় এই মন্ত্রবদ্ধ আঁখিতে।

ঘন্টা দুএক নদীর পাড়ে সময় কাটিয়ে। গাড়িতে বসলো দুজন। এতটা সময় এক সাথে থেকে কথা না হলেও, চোখেচোখে কথা হয়েছে দুজনের। কখনো কখনো মুখের কথার চেয়ে চোখের ভাষা অনেক গভীর হয়। হাতের হাওয়াই মিঠাই টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে প্রিয়। এই জিনিসটার প্রতি ছোট থেকে ভীষণরকম দুর্বলতা। একবার ইমান্দিপুরে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে শাদের সাথে ঝগড়া বেঁধেছিল তার। বিক্রেতার কাছে একটাই ‘হাওয়াই মিঠাই’। অথচ ভাগিদার দুজন। একটা সময় ঝামেলা বাড়ে, হাওয়াই মিঠাই নিয়ে টানাটানি শুরু হলে। চেচামেচির আওয়াজ পেয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে শতাব্দ। তখন তাকে প্রচন্ডরকম অপছন্দ ছিল প্রিয়’র। তাকে দেখেই কপাল কুঁচকে বিরক্তির ভঙ্গিতে বাড়ি ফিরে গেছিল। সেই কথাটা এতবছর পর মনে আছে শতাব্দ’র! তাইতো হাওয়াই মিঠাই নিয়ে এলো।
ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ভেসে উঠল। আনমনে হাওয়াই মিঠাই ছিঁড়ে মুখে দিলো। গাড়ি চলছে অন্ধকার গ্রামের মেঠোপথে। আচমকা গাড়ি থামল। কপাল কুঁচকে পাশে তাকাতেই, শতাব্দ নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আষ্টেপৃষ্টে গভীরে জড়িয়ে নিলো। কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রিয়’র ঠোঁট জোড়া শুষে নিলো। বিহ্বল প্রিয় আবেশে চোখ বুজে নিলো। শতাব্দের এলোমেলো অবাধ্য হাত প্রিয়’র শাড়ির বেঁধ করে ফর্সা কোমর ছুঁয়ে দিলো। আরো শক্ত ভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। অনুভূতিতে ঠকঠক কাঁপছে প্রিয়। নিশ্বাসের গতি উঠানামা করছে বারবার। গলা শুকিয়ে আসছে। মাথা ঝেঁকে বসেছে এলোমেলো অনুভূতিতে। মিনিট কয়েক কা*টল। ঠোঁটের কাছে লেগে থাকা হাওয়াই মিঠাই শুষে নিলো। প্রিয় তখনো ঠকঠক কাঁপছে। শরীর জুড়ে বইছে অদ্ভুত শিহরণ। চোখ ভিজে আসছে ভালো লাগার অনুভূতিতে। খানিক সময় এভাবেই পাড় হলো। শতাব্দের বলিষ্ট বুকে বিড়ালছানার মত চোখ বুজে পড়ে রইল। গায়ের পুরুষালি ঘ্রাণে মগ্ন হয়ে রইল। প্রাণভরে মিষ্টি সুবাসটা টেনে নিচ্ছে মনে। আরো কিছুক্ষণ এভাবে বুকের গভীরে জড়িয়ে রইল নিস্তেজ প্রিয়। আলতো স্বরে ডাকল শতাব্দ। সাড়াশব্দ করল না প্রিয়। লজ্জায় আরো জড়সড় হলো। একটু অপেক্ষা করে বুক থেকে টেনে তুলল শতাব্দ। দু গালে হাত ছুয়ে প্রিয়’র সুশ্রী মুখপানে চেয়ে রইল। নিকষ আঁধারে চন্দ্রসুধার মত চকচক করছে যেন। তার চোখেমুখে পড়ে থাকা চুল গুলো গুছিয়ে দিলো শতাব্দ। সামনের চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে, গালে হাত রেখে মুখখানা উঁচিয়ে ধরল। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শতাব্দ। লজ্জা পাচ্ছে প্রিয়। নিজের স্বামীর সামনে এভাবে লজ্জা পাওয়াটা কি খুব বেশি অস্বাভাবিক? ভাবতে ভাবতেই কপালে উষ্ণ ছোঁয়ার অনুভব হলো। তারপর একএক করে চোখ গাল, ঠোঁট ছাড়িয়ে গলায় এসে থামলো শতাব্দ। শাড়ির আঁচল নিচে নেমে গেছে। ফর্সা কাঁধ, গলা স্পষ্ট ভেসে। শতাব্দের উন্মদনা যেন বাড়ল আরো। প্রমত্ত প্রেমিকের মত ঝাপিয়ে পড়ল। গভীর ভাবে নাক ঘষতে ঘষতে নিষ্প্রাণ, নেশাতুর সুরে বলল,
‘ প্রিয়! এই প্রিয়, ভালোবেসে কি কেউ পাগল হয়? আমি হচ্ছি। ভয়*ঙ্কর রকম কোন অঘটন ঘটাতে চাইছি। তোমাকে ছোঁয়ার তৃষ্ণা পাগল করে দিচ্ছে আমায়। আর তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নাই।’
কেঁপে উঠলো প্রিয়। শতাব্দের গভীর আওয়াজ, শিহরণ তুলে দিচ্ছে প্রিয়’র। চোখ বুজেই শতাব্দের চুলে আঙুল ডুবিয়ে শক্ত মুঠিবদ্ধ করে নিলো।

চলবে……

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৪৬.

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

ছুটির দিনটা সাধারণ অলস ভাবেই কাটে প্রিয়’র। অফিসের টুকটাক কাজ সেরে সারাদিন বাড়িতে থাকে। গতরাতে শতাব্দের নাইট ডিউটি ছিল। বাড়ি ফিরে প্রিয় শতাব্দকে নিজের ঘরে দেখলো। বেশ পরিপাটি ভাবে তৈরি হয়ে বসে। খানিক চমকাল প্রিয়। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে, বিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ যাচ্ছেন কোথাও?’
শতাব্দের অকপটে আওয়াজ,
‘ তুমিও সাথে যাচ্ছো।’
প্রিয়’র কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো। সন্দিহান সুরে বলল,
‘ কোথায়? আর কেন?’
শতাব্দের স্বাভাবিক শান্ত আওয়াজ,
‘ আছে কোথাও। ফ্রেশ হয়ে তৈরি হও। ঘন্টা খানেকের ভেতর বের হবো।’
প্রিয় আরো কিছু বলতে চাইল। তার পূর্বেই শতাব্দ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। শতাব্দকে স্বাভাবিক দেখালেও কথার জালে রহস্য মোড়ানো ছিল। যেন কোন কিছু নিয়ে বেশ চিন্তিত।

গাড়ি এসে কোন এক নামীদামী বিশাল রেস্তোরাঁর সামনে থামল। সদর দরজার কাছাকাছি যেতেই, শতাব্দ থামল।শঙ্কিত দৃষ্টিতে তার দিক তাকালো প্রিয়। শতাব্দের চোখেমুখে চাপা উত্তেজনা, চিন্তার ভার। বেশ গম্ভীর চিন্তা ভারী কন্ঠে বলল,
‘ লিসেন প্রিয়, একজন তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। যদিও মানুষটাকে আমার প্রচন্ডরকম অপছন্দ। তবুও সে তোমার সাথে কথা বলতে একটা সুযোগ চাইছে। বেশ কয়েকদিন যাবত রিকোয়েস্ট করছে।’
প্রিয়’র টলমল চোখ। শান্ত গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ মানুষটা কি শোয়েব হক?’
কয়েক পলক চেয়ে ছোট শ্বাস ফেলল শতাব্দ। বলল,
‘ হ্যাঁ’
প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না প্রিয়। গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। প্রিয়’র হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো শতাব্দ, অকপট কন্ঠে বলল,
‘ নার্ভাস হবে না। আমি আছি। পাশেই থাকবো।’
প্রিয় চুপ। নিস্তেজ ভঙ্গিতে মাথা নুয়ে নিলো। উত্তরে মাথা নাড়াল একটু।

রেস্তোরাঁর ভেতর প্রবেশ করতেই পেছনের সারিতে শোয়েব হককে দেখল। জড়সড়ভাবে বসে আছে তিনি। মুহূর্তেই প্রিয় চোখেমুখে অস্বস্তি ভাব ফুটে উঠল। অপছন্দের মানুষের মুখোমুখি হওয়ার অস্বস্তি। কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। শতাব্দের হাত শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরল। ছোট ছোট পা ফেলে সেদিকে গেল। প্রিয়’কে দেখে শোয়েব হকের ছলছল চোখজোড়ায় হাস্যোজ্জ্বল ভাব ফুটে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়ল। শতাব্দ শোয়েব হকের দিক এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে প্রিয়’কে বলল,
‘ আমি ওইদিকটায় বসছি। তুমি কথা বলো।’
প্রিয় উত্তর দিলো না। হাত ছেড়ে চলে গেল শতাব্দ। প্রিয় জড়সড় হয়ে বসল। মাথা নত। চেহারায় বিরক্তি ভাব।
শোয়েব হক উচ্ছ্বসিত সুরে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছো মা।’
উত্তর কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রিয় বলল,
‘ ভালো। কেন ডেকেছেন?’
প্রিয়’র কন্ঠে স্পষ্ট রাগ। শোয়েব নিমিষ চেয়ে রইল, বলল,
‘ বাবার মেয়ের সাথে দেখা করবে। এতে কোন কারণ লাগবে?’
তাচ্ছিল্য হাসল প্রিয়। বলল,
‘ আপনি আমার বাবা নন। আমার বাবা জাফর সাহেব।’
শোয়েব মনটা ছোট হয়ে এলো। চোখ জোড়া টলমল করছে তার। তার মেয়ে তাকে মুখের উপর অস্বীকার করছে, অন্যকাউকে বাবা বলছে। ব্যাপারটা প্রচন্ডরকম যন্ত্র*না দায়ক। শোয়েব হকের করুন আকুতি,
‘ আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না মা?’
‘ কিসের সুযোগ চাইছেন আপনি! জন্ম দিলেই কেউ বাবা হয়ে যায় না। বাবা হতে কঠোর তপ করতে হয়। ছেলেমেয়েদের প্রতি দায়িত্ব থাকতে হয়। যা আমার বাবার আছে। আমার বাবা আমাদের জন্য নিজের সুখ, আরাম আয়েশ সব বিসর্জন দিয়েছে। ভীষণ আদর যত্নে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। ওই মানুষটা আমার দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ। যিনি অন্যের সন্তানকে নিজের ঘরে এনে লালন পালন করেছে। নিজের সবটা উজাড় করে রক্ষা করেছে। আপনার মত কাপুরষ না যে প্রয়োজনের সময় নিজের স্ত্রী, গর্ভের বাচ্চাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। আপনার জন্য আমি এখন সবার সামনে অবৈধ!’
শোয়েব হক আওয়াজ করে উঠল। প্রিয় থামিয়ে দিলো। রাগী চাপাস্বরে বলল,
‘ চেঁচাচ্ছেন কেন? পিতৃহীন সন্তানকে এই ভদ্র সমাজ অবৈধ-ই বলে!’
শোয়েব হকের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল। অনুতপ্ততার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। বলল,
‘ আমি জানতাম না তুমি আমার মেয়ে প্রিয়। আয়শা আমাকে জানায়নি।’
‘ কেন জানাবে? আপনার দয়া ভিক্ষার জন্য? আমার মায়ের আত্মসম্মানবোধ ছিল। আপনার সামান্য দয়া ভিক্ষার জন্য সেই আত্মসম্মানে আঁচ লাগতে দিবেনা কখনো।’
শোয়েব অধৈর্য হয়ে পড়ল। বোঝানোর স্বরে বলল,
‘ আমি অনেক বার আয়শার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি। অনেক মাধ্যমে বারবার। পারিনি। আয়শা নিজেকে ততদিনে ভীষণ কঠোর করে গড়ে ফেলেছিল। আমার চেহারা তো দূর, আওয়াজটাকেও প্রচন্ডরকম ঘৃ*ণা করত। হ্যাঁ আমি আয়শাকে ঠ* কিয়েছি। আমি নিজেও ছবির ষ*ড়যন্ত্রের শিকার ছিলাম। হ্যাঁ আমি গ্রাম থেকে পালিয়ে শহরে চলে আসতে পারতাম। কিন্তু এতে আমার বোনের সংসারে অশান্তি হতো। দুলাভাই ভালো মানুষ। কিন্তু তার বাবা বড্ড দেমা*গি মানুষ ছিলেন। তার দম্ভে সাধারণ আঁচ লাগলেও তিনি কাউকে ছাড়তেন না। সেখানে আমাকে কি করে ছাড়তেন? সব শেষ করে দিতো তিনি। অভিলাষার সংসার ভাঙ্গতো। আর তাছাড়া তখন আমার মনে হয়েছে ছবিকে বিয়ে করে আমি আয়শার সব শখ আশা আকাঙ্খা পূর্ণ করতে পারবো। আমার কাছে টাকা থাকলে আয়শাকে রানি বানিয়ে রাখতে পারবো। টাকার অভাব যে কতটা য*ন্ত্রণা দায়ক ভ*য়ানক তা তুমি কি জানো। এমনও অনেক দিন কেটেছে ন*ষ্ট পান্তা খেয়ে কেটেছে। আয়শা আমার জন্য নিজের পরিবার সুখ আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়ে এসেছিল। আমি তাকে অনাহার, অভাব ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি কখনো। দুজোড়া কাপড়ে বছর কাটাতে হয়েছে। ছিড়া কাপড়ে তালি দিয়েও পড়েছে। আয়শার বি*সর্জন আমাকে ক্ষণে ক্ষণে পো*ড়াত। তখন আমার মাথায় ন্যায় অ*ন্যায় কোন ভেদাভেদ ছিল না। ডা*কাত বনে গেছিলাম। টাকার য*ন্ত্রণা নিবারন করাটা জরুরী ছিল। চেয়েছিলাম ছবিকে বিয়ে করে আয়শাকে নিয়ে দূরে ঘর বাঁধবো যেখানে আয়শার সব সুখ আহ্লাদ পূরণ হবে রানির মত রাখবো। আমাদের সুন্দর একটা গোছানো সংসার হবে। খানিকের জন্য দুরত্ব টানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আয়শা আমার থেকে চিরকালের মত দূরে সরে গেল। আমাকে জানালো আমার সন্তানকে মে*রে ফেলেছে ও। কথাটা শুনে প্রচন্ডরকম আঘা*ত পেয়েছিলাম। চাপা জেদ ধরে বসলো। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু পারলাম না। আয়শাকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি। ছবির সাথে আমার সংসার হলেও এই সংসারে আমি নেই। এই দেশ থেকে, দেশের মানুষ থেকে অনেক দূর দুবাইতে থাকতে শুরু করি।’
প্রিয় শান্ত। চোখ জোড়া অশ্রুভারাক্রান্ত। জড় ভারী কন্ঠে বলল,
‘ অথচ আপনি জানলেন-ই না যে তার সব সুখ ছিল আপনাতে। এই দিন দুনিয়ার চাকচিক্য কখনো সুখী করতে পারেনা কাউকে। যদি না অন্তরে শান্তি মিলে।’
শোয়েব হক উদাসীন কন্ঠে বলল,
‘ আমার অন্তরে কোনদিন শান্তি মিলবেনা। আমি নিজের হাতে সব শান্তি দাফন করে দিয়েছি। আমার সব সুখ শান্তি আয়শার সাথেই শেষ। এই বেঁচে থাকাটা অভিশাপের।’
প্রিয় দৃঢ় কন্ঠের জিজ্ঞাসা,
‘আপনার আমার কাছে এখন কি চাই?’
শোয়েব হক প্রোপার্টি পেপার’স গুলো এগিয়ে দিলো। অনুতপ্ত করুন সুরে বলল,
‘ আমি যা করেছি তা কখনো ক্ষমার যোগ্য না। সেই আশাটাও আমি করছিনা। শুধু বলবো, এই প্রোপার্টি গুলো নেওয়ার অনুরোধ রইল। আমার বুকে জ*লন্ত অগ্নিশিখাটায় একটু স্বস্তির মিলবে।’
তাচ্ছিল্য হাসলো প্রিয়,
‘ আপনার সত্যি মনে হয় এই প্রোপার্টি আমি নিবো। এতটা আত্মসম্মানহীন আমি? ভুলে যাবেন না আমি আয়শার মেয়ে। আমার মায়ের মত আমারো কঠোর আত্মসম্মান, বিবেকবোধ! আপনার সম্পত্তি নেওয়ার চেয়ে আমি না খেয়ে, অভাবে ম*রে যেতে পছন্দ করব। এর কানাকড়িও আমার চাইনা। আমার অল্প আয়ে আমি সন্তুষ্ট। এসব আপনার ক্ষমতা লোভী স্ত্রী আর নেশাখোর ছেলেমেয়েদের জন্য রেখে দিন। কিছুদিন পর ওদেরই প্রয়োজন পড়বে।’
তড়াক করে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল প্রিয়। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ আপনার সাথে কোনদিন সাক্ষাৎ না হলে খুশি হবো। আসি।’
অকপটে পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রিয়। শতাব্দ পাশ থেকে উঠে এসে শোয়েবের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ মামা ভাগিনার সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ। আপনি মানবতার খাতিরে দেখা করতে চেয়েছেন, করিয়েছি। আর কোনদিন ওর মুখোমুখি হবেন না। অনেককাল প্রিয় দূরে ছিল আমার। আপাতত সংসারে শান্তি চাই।’
শোয়েব হক নত সুরে বলল,
‘ এই প্রোপার্টি গুলো যদি প্রিয়…
কথা কাটলো শতাব্দ। বলল,
‘ আমার বউকে ভালো রাখার মত যথেষ্ট সামর্থ্য আছে আমার। আপনার চ্যারিটি’র প্রয়োজন নেই।’
‘ আমার মেয়ের খেয়াল রেখো।’
শতাব্দের দৃঢ় আওয়াজ,
‘ ভয় নেই, আমি আপনার মত কাপুরষ নই। স্ত্রীর’র পাশে দাঁড়াতে জানি।’
বড়বড় ধাপ ফেলে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল শতাব্দ। পার্কিং সাইডে গাড়ির সাথে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। হাত পা কাঁপছে অনবরত। শতাব্দ গাড়ির দরজা খুলতে তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে বসলো। বড়বড় নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত, স্বাভাবিক করতে চাইছে প্রিয়। নির্ভীক দৃষ্টিতে চেয়ে শতাব্দ। প্রিয়’র অস্বাভাবিক চোখমুখ দেখে হাতের উপর হাত রাখল শতাব্দ। আলতো স্বরে ডাকল। বলল,
‘ প্রিয়! তুমি ঠিক আছো?’
তাসের ঘরের মত মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়ল প্রিয়। জাপ্টে পড়ল শতাব্দের বুকে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। চিৎকার করতে করতে বলল,
‘ সব ভেঙ্গে ঘুড়িয়ে এই লোকটা এখন কেন এসেছে শতাব্দ। কেন এমন পিতৃত্ববোধ জাগ্রত হলো তার। তাকে যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সে আর নেই। কেন বুঝে না, আমার তাকে এখন আর চাইনা। চাইনা আর। ‘
প্রিয়’কে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো শতাব্দ। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করল। বোঝানোর সুরে বলল,
‘ তোমার য*ন্ত্রণার কারণ হতে দেবনা কাউকে আর। আমি আছি, তোমার কাছে।’

ভারাক্রান্ত মন, পরাজীত হয়ে গাড়িতে চড়ল শোয়েব হক। মেয়েকে পাওয়ার শেষ সুযোগ হাতছাড়া হলো আজ। শতাব্দ আর কোন দিন প্রিয়’র মুখোমুখি হতে দেবে না তাকে। সে বেশ ভালো করে চিনে ভাগিনাকে। প্রিয়’র জন্য কতটা পাগলাটে সে। বয়স স্বভাবে যতই ম্যাচিউর হোক। প্রিয়’র জন্য সকল সীমানা বাঁধাকে ভঙ্গ করে প্রস্তুত। শোয়েব হক এতটুকুতেই খুশি। তার মেয়েটা যোগ্য হাতে। এখন সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। শত ঝড় হোক, বিপত্তি আসুক শতাব্দ আগলে রাখবে প্রিয়’কে। আয়শা বোধহয় এমনি একটা শক্ত, বিশ্বস্ত হাত ভেবে শোয়েবের হাত ধরেছিল। আফসোস, শোয়েব প্র*তারণা করল। জ*ঘন্য ভাবে ঠকালো। যার আফসোস কোনদিন ফুরাবে না। চিরকাল শুধু পো* ড়াবে। এই জীবনে কি মুক্তি মিলবে! অনুতপ্তার জল গাল বেয়ে পড়ল। নির্জন ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই আচমকা একটা বড় ট্রাক এসে ধাক্কা দিলো। গাড়িটা ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে শেষ প্রান্তে ঝুলছে। আয়নার দিকে তাকাল শোয়েব। পেছনের গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে লিমন বসে। ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা দিয়েছে। হতভম্ব হয়ে নিমিষ চেয়ে রইল। তার ছেলে তাকে খু*ন করতে চাইছে। কেন? এই প্রোপার্টি’র জন্য! প্রিয়কে দিচ্ছে বলে। এই দুনিয়ার নিয়ম। সম্পত্তির জন্য ছেলের হাতে ম*রতে হবে বাবাকে! প্র*তারণার শান্তি প্রতা*রণা। আয়শার সাথে প্*রতারণা করেছে বলেই হয়তো ভাগ্য প্রতি*শোধ নিচ্ছে। তাকে তার ভাগের প্রাপ্য প্রতা*রণা ফিরিয়ে দিচ্ছে। সত্যি বলতে মানুষ নিজের জন্য কবর নিজে খুড়ে। দোষ দেয় ভাগ্যকে। ভাগ্যের কোন দোষ নেই, সে যথাসময়ে মানুষের প্রাপ্যটুকু ফিরিয়ে দেয়। শোয়েব ছলছল অশ্রুভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে । লিমন আরেকটা ধাক্কা দেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে বলছে। শেষ ধাক্কা দিতেই গাড়ি ব্রিজ থেকে খাঁ*দে যেয়ে পড়ে। মুহুর্তেই অন্ধকারে ডেকে যায় সব।

চলবে…….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।