বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-১৬+১৭

0
413

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — ষোল

একজন স্বার্থপর মানুষের দুটো চেহারা থাকে। প্রথমটা বাহ্যিক দ্বিতীয়টা অভ্যন্তরীণ। সচরাচর যেকোনো মানুষের প্রথম চেহারাটাই চোখে লাগে বেশি। দ্বিতীয় ও মুখোশের আড়ালে থাকা চেহারা মানুষ স্বচক্ষে তখনই দেখতে পায়, যখন ব্যক্তি খোলস ছেড়ে বাইরে উঁকি দেয়। প্রয়োজনে যে মানুষ পাশে এসে দাঁড়ায়, অপ্রয়োজনে দূরে সরে গিয়ে অভ্যন্তরীণ রূপ চিনিয়ে দেয়, তখনই একটা ব্যক্তি বুঝতে পারে, একজন স্বার্থপর মানুষের দ্বিতীয় চেহারাটাও অন্যসব সাধারণ মানুষের মতো দেখতে ঠিক কেমন ও কতটা স্বাভাবিক হয়। ওরা দেখতে মানুষ হলেও, আপাদমস্তক অমানুষ। বিবেকহীন, স্বার্থপর অমানুষ কখনও মানুষের কাতারে পড়ে না। কিছু মানুষের আড়ালের চেহারাটা ততদিন আড়ালেই থাকবে যতদিন তার স্বার্থে আঘাত পড়বে না। কিন্তু যখনই তার স্বার্থে আঘাত পড়বে, তখনই সে আপন-পর ও সম্পর্কের গভীরতা ভুলে রক্তাক্ত বুককে আরও ক্ষত-বিক্ষত করে দিবে। ঠিক এমনই ভাবে, কঠিন বিপদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে একটা স্বার্থপর মানুষের অভ্যন্তরীণ চেহারা চোখে পড়েছিল শাদাবের। সেদিন সে বুঝে গিয়েছিল, স্বার্থের জন্য মানুষ ঠিক কতটা নিচে নামতে পারে।

সায়রা করীমের উদোরে তখন ছোট্ট প্রাণের সঞ্চালন ঘটেছিল। ভ্রুণ থাকা অবস্থাতেই সেই প্রাণকে মেরে ফেলা ও বাঁচানোর জন্য অ্যাবরশন নিয়ে বাবা-মায়ের দিনরাত ঝগড়াঝাটি, কথা কাটাকাটি এসব দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিল শাদাব। সায়রা করীমকে অঝোরে কাঁদতে দেখেছিল দিনরাত। নিজের ভেতরে থাকা ছোট্ট প্রাণকে বাঁচাতে সাহায্য চেয়েছিলেন শায়লা সুলতানার কাছে। এমদাদ কায়ছারকে যেন এই ব্যাপারে বুঝান, জঘন্যতম হত্যার হাত থেকে যেন আটকাতে পারেন, এরূপ সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়ার পর, শায়লা সুলতানা তাকে ভরসা দেন। দিন গড়ায়, সপ্তাহ পেরোয়, সায়রা করীম নিশ্চিত হোন, নিশ্চয়ই শায়লা সুলতানা তাকে সাহায্য করবেন, পাশে থাকবেন। তিনি নিজেও স্বামীকে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু মিসক্যারেজ হওয়ার ঔষধ খাওয়ানোর ঠিক আগের দিন শায়লা সুলতানা ফোন করেন কায়ছার সাহেবের নম্বরে। তিনি তখন রুমে না থাকায় ফোনটা রিসিভ করে শাদাব। হ্যালো বলে সালাম দেয়ার আগেই শায়লা সুলতানা তাড়াহুড়ো করে একটা ঔষধের নাম বলেন, তারপর ঝটপট গলায় বললেন,

-‘ঔষধটা এনে আপনি ভিটামিন বলে চালিয়ে দিবেন। খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়াবেন। মনে রাখবেন, আপনার সম্মান যদি একবার নষ্ট হয়, তবে আপনি তা আর ফিরে পাবেন না। ভাবুন তো একবার, টোটোনের বিয়ে হয়ে গেছে। হোক বাল্যবিবাহ, হয়েছে তো! এখন যদি দ্বিতীয় সন্তান আসে, রাস্তায় বের হতে পারবেন? আশেপাশের দশজন তো জানে, আপনার প্রথম সন্তান বিবাহিত। যদি দিয়াকে নিয়ে আমি কোনোদিন দেশে ফিরি, মুখ দেখাতে পারব? দিয়ার নিজেরও একটা সম্মান আছে। ও কীভাবে বলবে, ওর বিয়ের পর শাশুড়ি প্রেগন্যান্ট হয়েছেন! ছিঃ ছিঃ। আমার তো ভাবতেই খারাপ লাগছে। আমি হলে জানা মাত্রই, অ্যাবরশন করিয়ে ফেলতাম।’

তৃতীয় ব্যক্তি! যেকোনো সম্পর্কে ফাটল ধরানোর জন্য একজন তৃতীয় ব্যক্তির আগমনই যথেষ্ট। শাদাব ভাবতে পারেনি, শায়লা সুলতানা তার মাকে সাহায্যের বদলে এরূপ বিপদের মুখে ঠেলে দিবেন। সে পরদিন স্পোকেনে যাওয়ার আগে ফোনালাপের উক্ত অংশ মাকে বলে গিয়েছিল। যার কারণে সায়রা করীম স্বামীর সাথে বিষয়টা নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু করেছিলেন। একপর্যায়ে মারও খেয়েছেন। জোরজবরদস্তির সাহায্যে ঔষধ পেটের বাইরে নিয়ে এসেছেন কেবল গর্ভের সন্তানকে বাঁচাতে। শাদাব ভেবেছিল, তৃতীয় ব্যক্তি যা-ই বলুক, তার বাবা এমন একটা জঘন্য কাজ করবেন না। করতে পারেন না। কারণ স্ত্রীকে তিনি যথেষ্ট সম্মান করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু সে বুঝেনি, দীর্ঘ আঠারো বছরের ভালোবাসার যে এই রূপ, এই করুণ দৃশ্যের আগমন। চেনা রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এমন বিশ্বাসঘাতক। স্বামী ও ভরসার একমাত্র সঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অবিচার, এটা কেই-বা আশা করেছিল! যদি শাদাব মাকে ওই কথাগুলো না জানাত, তবে আজ শিহাব এই পৃথিবীতে আসত না। নিজের নিষ্পাপ, অবুঝ ভাইটার দিকে তাকালে শাদাব সবসময় একটাই কথা ভাবে, সেই স্বার্থপর মানুষটার আসল উদ্দেশ্যটা কী ছিল! কেন তিনি শিহাবকে মেরে ফেলার মতো এমন বিদঘুটে, জঘন্য বুদ্ধি তার বাবাকে দিলেন? কেন তিনি তার বোন সমতুল্য বেয়াইনের সাথে প্রতারণা করলেন? সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার তো কায়ছার সাহেব ঘটালেন। শেষবেলাও যখন নিজের সম্মানের অহমিকাকে ধরে রাখতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে রাস্তায় নামিয়ে দিলেন, তখন তিনি কেন একবার বিবেককে মনে জাগতে দিলেন না! কেন ভালোবাসা ও সম্মানের কাছে অহংকারের অদৃশ্য প্রাচীর তৈরী করলেন? সেদিন থেকে দুটো মানুষের প্রতি ঘৃণায় বুকের ভেতর তার বিষিয়ে উঠেছিল। এখনও সেই ঘৃণার পরিমাণ একবিন্দুও কমেনি। বরং দিনেদিনে তা বেড়ে গিয়ে মন ও জীবনের একাংশকে তিক্ততায় ভরিয়ে দিয়েছে।

ওফিং হিলে আসার পরই সায়রা করীমের নম্বর থেকে ফোন আসে। শিহাবকে একটা জায়গায় মনোযোগী হতে দেখে সেই ফাঁকে ফোনালাপটা সেরে নিল। মাহদিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই পুরনো দিনগুলোর কথা স্মৃতির অন্দর থেকে একে একে বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগল। আনমনেই হাসল শাদাব। সায়রা করীম ওপাশ থেকে আগ্রহীস্বরে জানতে চাইলেন,

-‘দিয়াকে সাথে আনিসনি?’

-‘না। তোমার দিয়া অসুস্থ। তার হাতে অ্যালার্জি দ্যাখা দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত সেটা আমার দোষেই। তাই সে নিজে থেকেই আসার প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করেছে। যদিও এতে ছোটোন কিঞ্চিৎ মন খারাপ করেছিল, কিন্তু ‘ওফিং হিল’-এর সৌন্দর্যের কাছে সেই মন খারাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না।’

সায়রা করীম হাসতে গিয়েও মন খারাপ করে ফেললেন। মাহদিয়াকে একসময় তাঁর ভীষণ পছন্দ ছিল, এখনও হয়তো আছে, কিন্তু দূরে থাকাতে সেই গভীরতা একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। তিনি শত চাইলেও শাদাবের মন ফেরাতে পারেন না। তাকে সম্পর্কের ব্যাপারটা বুঝাতে গেলেই এড়িয়ে যায়। সম্পর্কটাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেও কিছু কারণে মন তাকে সঠিক সিগন্যাল দিচ্ছে না। যার জন্য মন ও মস্তিষ্কের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সম্পর্ক সহজ ও তার সমাধানের জন্য যুথসই পথ সে খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি জোর দিলেও কাজ হয় না। শাদাব পাত্তা না দেয়ার ভান ধরে এড়িয়ে গিয়ে স্বস্তি, শান্তি খুঁজে নেয়। তবুও তিনি হাল ছেড়ে দিতে পারেন না। তিনি যে মা। একজন বুদ্ধিসম্পন্ন নারী। সম্পর্কটাকে তিনি কীভাবে ফেলনা ভাবতে পারেন? তাই যথাসম্ভব ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করে যান। এখনও তাই করলেন। শিহাব তার থেকে কিছুটা দূরে আছে এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে বললেন,

-‘তুই কি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিসনি?’

-‘কোন বিষয়ে?’

তৎক্ষনাৎ মায়ের প্রশ্ন বোধগম্য হয়নি শাদাবের। সে একমনে ভাইয়ের ছোটাছুটি, দুরন্তপনা ও চাঞ্চল্য দেখছে। মায়ের কথা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই প্রশ্ন ছুঁড়ে পরক্ষণেই বুঝতে পেরে নীরব হয়ে রইল। সায়রা করীম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-‘সম্পর্কটা আর কতদিন এইভাবে ঝুলে থাকবে? কিছু একটা তো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত তোর! দিয়া একটা মেয়ে হয়ে এতদূর অবধি ছুটে আসতে পারল, তুই কিছু করতে পারিস না?’

মাহদিয়ার গতরাতের আচরণ মনে হওয়াতেই ম্লানমুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করল শাদাব। বলল,

-‘ও মুক্তি নিতে এসেছে মা! নিজের জীবন সাজাতে পারছে না তো, তাই নামহীন বন্ধন থেকে মুক্তি নিতে এসেছে।’

সায়রা করীম আঁৎকে উঠলেন। মনে ব্যথা পেলেন। মাহদিয়াকে তিনি এমনটা ভাবেননি। দূর থেকে ছুটে এসেছে, নূরুন্ নাহারের মুখে তাদের খোঁজা নিয়ে অস্থির হওয়ার কথা শোনে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, শাদাবকে দিয়ে না পারলেও মাহদিয়ার মাধ্যমে সম্পর্কটা ঠিকই আটকে দিতে পারবেন। কিন্তু এযে উল্টো দিকে ঘুরে গেল পুরোটাই। তিনি মন কেমনের সুরে বললেন,

-‘তুই তো এটাই চেয়েছিলি তাই না?’

-‘হ্যাঁ চেয়েছিলাম।’

-‘ও সম্পর্ক বাঁধতে চাইবে দ্যাখে তুই ওর মুখোমুখি-ই হতে চাসনি। এখন যখন দু’জনার একটাই ইচ্ছা, তাহলে আর ঝামেলা কী! সমাধান তো সামনেই আছে। শুধু সময়ের মধ্যে সেটা কার্যকর করে ফেলো দু’জনে।’

মায়ের কথার উত্তর দিতে পারল না শাদাব, ফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন করে ‘ওফিং হিল’-এর সৌন্দর্য দেখাতে মনোযোগ দিল। এই সৌন্দর্যের বর্ণনা করা অসম্ভব। কিন্তু তবুও মন আজ বহু বছর আগের একটা দিনে ফিরে যেতে চাইছে, চোখের সামনে একটা চঞ্চল প্রাণের ছোটাছুটি, প্রজাপতি ধরার বাহানায় তার পিছনে দৌড় দেয়া, এদিক-ওদিক ছুটতে ছুটতে ব্যর্থ হয়েও হাল ছেড়ে না দেয়া এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের টানে! যে সৌন্দর্য সেদিন চোখে লাগার আগে মনে লেগেছিল! আজও সেই সৌন্দর্যে একফোঁটা কমতি আসেনি। আগের মতোই, রঙিন শৈশবের মতোই সৌন্দর্যটা ঝকঝকে, রঙিন, অতুলনীয় সুন্দর। চোখ ও মন যা দেখে তৃপ্তি খুঁজে নেয়, সেই সৌন্দর্যের বর্ণনা খোঁজার মতো উপমা শাদাবের মনে নেই। সে শুধু জানে, সেদিনের সেই সৌন্দর্যের কাছে অন্যসব সৌন্দর্যও যেন ম্লান হয়ে আসে!

আচমকাই হাতে টান পড়ল। শিহাব তাকে টানতে টানতে পাহাড়ের উঁচুনিচু অংশ ছাড়িয়ে সবুজে ভরা চা-বাগানের ভেতর দিয়ে ছুট দিল। চমকের দরুন শাদাব জানতে চাইল,

-‘কী হলো তোমার? এইভাবে কেউ হাত ধরে টানে?’

-‘তুমি দিনদিন রোবট হয়ে যাচ্ছ। এমন একটা চমৎকার জায়গায় এসে কেউ খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকে? তুমি ফোনটা হাতে রাখো, আমি দিয়াপিকে পুরো জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দ্যাখাই।’

দৌড়াতে দৌড়াতে বলল শিহাব। হাতে থাকা ভিডিওকলটা ধরিয়ে দিল ভাইয়ের হাতে। শাদাব প্রথমে খেয়াল করল না। যখন সেলফিস্টিকসহ ফোনটা শিহাবের দিকে তাক করল, অমনি স্ক্রিনে মাহদিয়ার মুখটা ভেসে উঠল। দু’সেকেন্ডও ঠিকঠাক ওই চেহারার দিকে তাকাল না শাদাব। ব্যাক ক্যামেরা অন করে শিহাবের দিকে বাড়িয়ে রাখল। শিহাব একটু একটু করে উপরের দিকে উঠছে আর জায়গা ও চা-বাগানের সম্পর্কে বিস্তারিত বলে যাচ্ছে। সাউন্ড বাড়ানো থাকায় মাহদিয়ার সব কথা শাদাবের কানেও আসছে। না চাইতেও মন বার বার বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছে। একাধারে ফোন ধরে রাখতে রাখতে বিরক্ত হলো শাদাব। বলল,

-‘ছোটোন, ফোনটা নাও। এটাতো তুমি-ই দ্যাখাতে পারো।’

শিহাব দৌড়ের ওপর থেকে বলল,
-‘আরেহ্, আমি-ই তো তাকে দ্যাখাচ্ছিলাম। কিন্তু দিয়াপি দ্যাখতে চাইল, তুমি কী করছ! তাইতো দিলাম।’

এটা শোনে শাদাব আরও রেগে গেল। দুম করে ক্যামেরা অফ করে পুরো স্টিকটাই দু’হাতের সাহায্যে কটমট আওয়াজ তুলে ভেঙে ফেলল। শিহাব হা হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,

-‘কী করলে এটা?’

জবাব দিল না শাদাব। ফোন ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘তোমার যা কিছু করতে মন চায় তাই কোরো, কিন্তু নেক্সট টাইম, এইভাবে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দেয়ার মতো ভুল করবে না।’

শিহাব বোকার মতো তাকিয়ে রইল ফোনের দিকে। স্ক্রিনে তখন মাহদিয়ার চোখেমুখে বিস্ময়, কৌতূহল। সে ভ্রু নাচিয়ে শিহাবের কাছে ‘কী হয়েছে’ জানতে চাইল। সে দু’দিকে কাঁধ নাচিয়ে বলল,

-‘বুঝলাম না কিছুই। কাঁধে কোনো ভূত-পেত্নী ভর করল না-কি? কোথাকার রাগ কোথায় ঢালল? আশ্চর্য!’

***

ফোন কাটার পর থেকে থম মেরে বসে আছে মাহদিয়া। হায়দার সাহেব পাশে বসে কারণ জানতে চাইছেন, সে কোনো উত্তর দিল না। গম্ভীরমুখে বসে রইল। পুলসাইডের এইদিকে এসে বসলে রিসোর্টসহ বাইরের দৃশ্যটা চোখে লাগে খুব। চারিদিকে উঁচুনিচু পাহাড় ও দৃষ্টিনন্দন জায়গাটা অশান্ত মনকেও শান্ত করে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পরও মাহদিয়ার মুখটা মলিন হয়ে থাকতে দেখে তিনি চিন্তায় পড়লেন। বাইরে ঘুরতে এসেছিলেন, এই মেয়ের মনের শান্তির জন্য। অথচ সেসব হচ্ছে না। হুট করে শাদাব সামনে এসে সবকিছু কেমন পালটে দিল। ঘুরাঘুরি তো হলোই না, উলটে সময়টা কাটছে বড্ড অস্থিরতাকে সঙ্গে নিয়ে। তারমধ্যে শাদাবের মুখ থেকে শায়লা সুলতানা সম্পর্কে ওইসব কথা জেনে তিনি পড়েছেন মহা যন্ত্রণায়! কাকে কী বলবেন এখন? কাকে কী বুঝাবেন? এই অবুঝ মেয়েটা এখনও জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছে! কীভাবে তাকে সাহায্য করবেন, সঠিক গন্তব্য চেনাবেন, সেটা ভেবেই তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। কোনো কূল-কিনারা খুঁজে না পেয়ে মাঝেমধ্যে তাঁরই মনে হয়, সব সত্যি তুলে ধরেন মাহদিয়ার সামনে। কিন্তু ভয় একটাই, পাছে এই মেয়েটা তাদের সম্পর্কে খারাপ মনোভাব না পুষতে শুরু করে অন্তরে! নিজের মায়ের সম্পর্কে এমন কথা সে কীভাবে বিশ্বাস করবে! কীভাবেই-বা মাকে ছেড়ে শাদাবকে বেছে নিবে? এই কঠিন কাজটা করতে গেলে মাহদিয়ার প্রচুর ধৈর্য্য ও সাহসের দরকার আছে। এই মুহূর্তে যা তারমধ্যে একটুও নেই। প্রচণ্ড ধৈর্যের অভাব টের পাচ্ছেন তিনি। তাই ভয়ও মনে বেশি। কখন, কোন স্রোতে জীবনতরী ভেসে যায় ঠিক নেই! দুটো ছেলেমেয়েকেই তিনি ভালোবাসেন। তাই চান না, দু’জনে সম্পর্ক নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিক। মাহদিয়ার এই মন খারাপের মুহূর্তটা তাকে খুব বেশি পীড়া দিলেও তিনি মনের ভয়কে দূর করতে মুখ খুলে বললেন,

-‘দীর্ঘ তিনমাস ছোটাছুটির প্রয়োজন হবে না তোর। ভাগ্য সহায় ছিল দ্যাখে, টোটোনকে এখানে পেয়ে গিয়েছিস। এবার সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়ি নিয়ে নিতে পারলেই সব ঝামেলা শেষ।’

মাহদিয়া মুখভার রেখে বলল,
-‘আমার এখানে আসাটাকে তোমরা সবাই ঝামেলা ভাবছ?’

-‘ঠিক তা নয়। খোঁজ নেই, ঠিকানা নেই, একটা মানুষকে খুঁজে বের করা কঠিন না? এটা তো ছোটোখাটো একটা ঝামেলারই অংশ।’

-‘যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের লুকিয়ে ঝামেলা তৈরী করল তাদের কোনো দোষ নেই, না? আমি খুঁজতে বেরিয়ে এখন ঝামেলা তৈরী করে ফেললাম!’

বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল মাহদিয়ার। হায়দার সাহেব নিশ্চুপে শুনলেন। বললেন,
-‘এখন আর এসব ঘেঁটে লাভ নেই। তুই বরং নিজের কথা ভাব। কী সিদ্ধান্ত নিলি? কথা বলেছিস ওর সাথে? থাকবি না-কি ফিরে যাবি?’

গতরাতের সম্পূর্ণ কথা হায়দার সাহেবকে শোনাল মাহদিয়া। তিনি শোনে শুধু বললেন,
-‘তুই একবারও জানতে চাসনি, টোটোন কেন যোগাযোগ রাখেনি?’

-‘চেয়েছি, কিন্তু রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা বকে ফেলেছি।’

-‘তুই কী চাস, মন কী চায়, আগে সেটা নিশ্চিত হয়ে নে মা, তারপর ওকে গিয়ে বল! টোটোন খুব চাপা স্বভাবের। কখনও নিজের কষ্ট কারও সাথে শেয়ার করেনি। আমার সাথেও করে না। হয়তো তোর সাথে শেয়ার করতে পারে। তোদের সম্পর্কে আমি তৃতীয় ব্যক্তি। আমার কোনো কথাই এখন তুই কানে নিবি না। সম্পর্ক যদি বাঁচাতে চাস, তাহলে সবদিক ভেবে এগো। আর যদি মুক্তি-ই চাস, তবে দেরী হওয়ার আগে শীঘ্রই সম্পর্কের ইতি টেনে যোগাযোগ চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন করেদে।’

মাহদিয়া চমকাল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘সম্পর্ক যদি শেষ করেই দেই, তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে কেন? এমন কি কোনো লজিক আছে, সম্পর্ক ভাঙলে যোগাযোগ রাখা যাবে না?’

-‘কারণ শাদাব তোর মুখোমুখি হতে চেয়েছিল বলেই, এখানে তুই ওর দ্যাখা পেয়েছিস! নয়তো গোটা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজলেও আমরা এখনও কানাগলিতেই আটকে থাকতাম। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর এই শহরে আর ও পা ফেলবে না। এই শহরটা ও’কে যা কিছু দিয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ কেড়ে নিয়েছে।’

মাহদিয়া এবার নিশ্চিত, শাদাব ইচ্ছে করেই যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিল। সে কি-না মরিচীকার পিছনে ছুটতে ছুটতে এতদূর চলে এলো! ঘোর আফসোস হলো তার। নিজের দিক স্পষ্ট করতে বলল,

-‘তোমার ভাতিজাকে বলেই দিয়েছি, আমি তার গলায় ঝুলতে আসিনি। ডিভোর্সের কাজ শেষ হয়ে গেলেই আমি ফিরে যাব।’

-‘তুই ওর সাথে সরাসরি আলাপে নামবি না?’

-‘আর কী আলাপ করব? সে ইচ্ছাকৃতভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছিল, এটা তো নিশ্চিত এখন! এরপর আর কী জানার থাকতে পারে? আমার তো আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো ধৈর্য্য নেই। ইচ্ছে কিংবা আগ্রহও নেই। আমি নিজের ইগো ডুবিয়ে বলব না যে, সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে চাই।’

-‘এটা ইলজিক্যাল কথা হয়ে গেল। বুঝেও অবুঝের মতো আচরণ করছিস তুই। ওর দিকটা ভাববি না একবার?’

-‘তোমার ভাতিজা একাই রিজেক্ট করতে জানে, আমি জানি না?’

হায়দার সাহেব প্রচণ্ড হতাশ হলেন মাহদিয়ার এই কথায়। রাগ করলেন। মেজাজ ঠিক রাখতে গিয়েও খানিকটা ধমকের সুরে বললেন,

-‘ডিভোর্সের কথা তুই আগে উচ্চারণ করেছিস। ও কিন্তু বলেনি, ওর ডিভোর্স চাই। হয়তো কিছু বলার আছে, তাই দ্যাখা করতে ছুটে এসেছে। ধৈর্য্য নিয়ে সেটুকু শুনবি না?’

-‘ওর যদি কিছু বলার থাকত, সেটা অনেক আগেই বলতে পারত। এইভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে নিজেকে একটা মেয়ের চোখে কাপুরুষের আসনে জায়গা দিত না।’

মাহদিয়া এতটাও অবুঝ নয়, এটা তিনি নিশ্চিত ছিলেন। অথচ ভুল দেখলেন। এই মেয়েটা এখন যে আচরণ করছে, সেটা মোটেও গ্রহণ করার নয়, মেনে নেয়ার নয়! তিনি মেজাজ হারিয়ে এবার কথা আটকে রাখতে পারলেন না। সমস্ত রাগ উগড়ে দিতে বললেন,

-‘অবুঝ ছিলি তাই সম্পর্কের মূল্য আগে বুঝিসনি। এখন তো অবুঝ নোস। কেন বুঝতে পারছিস না? তোদের সম্পর্কটায় অনেক আগেই ‘তৃতীয় ব্যক্তি’ জড়িয়ে গিয়েছে। অজান্তে, না চাইতেও তোদের মাঝে দেয়াল তৈরী হয়ে গেছে। তুই ভেবে দ্যাখ, টোটোনের সাথে তোর সম্পর্ক কত সুন্দর, স্বাভাবিক ও সহজ ছিল। এই সহজ, সুন্দর সম্পর্কটা কি এমনি এমনি কঠিন হয়ে গেছে, কোনো ‘তৃতীয় ব্যক্তি’-র আগমন কিংবা চালাকি ছাড়া?’

মাহদিয়ার থমকানো ভাব শুরু হলো মাত্র। সে হায়দার সাহেবের কথা শোনে এমনভাবে ধাক্কা খেল, যেন কেউ অদৃশ্য ছুরি চালিয়েছে বুকে! এমনকিছু যদি থাকে, তবে সে কেন কিচ্ছু টের পায়নি। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর জ্বলতে শুরু হলো তার। বোধশক্তি হারিয়ে যেতে লাগল। এমনিতেই এতদিন পর শাদাবকে চোখের সামনে দেখে একটার পর একটা রাগ দেখাচ্ছে। অভিমান দেখাতে গিয়ে বার বার মুক্তির কথা বলে সম্পর্কটাকে একটা অহেতুক ঝামেলা সেটা বুঝাতে চাইছে! অথচ এখন দেখছে, তার সব রাগ, সব অভিমান সবটাই মিছে হয়ে যাচ্ছে। উলটে সবকিছুকে এখন তার অসহ্য লাগছে। নিজের বলা কথা ও কাজের জন্য হাঁসফাঁস লাগছে। বার বার মনে পড়ছে, শাদাবের বলা কথা — ‘এই সম্পর্কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যতটুকু চেষ্টা আমি একা করেছি, তার এককোণাও তুমি কোরোনি!’ কণ্ঠস্বরে জোর এনে মাহদিয়া উচ্চারণ করল,

-‘তুমি বলতে চাইছ, কেউ একজন আছে যে আমাদের মাঝখানে চলে এসেছে!’

হায়দার সাহেব উপরনিচ মাথা নাড়লেন। মাহদিয়া ঢোক গিলল। গলা শুকিয়ে এলো তার। তবুও টেনে টেনে বলল,
-‘কে সে? কার জন্য শাদাব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে? এমন কে আছে, যে ওর কাছে আমার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ!’

মা ও মেয়ের মাঝে কোনো ভুল বোঝাবুঝির দেয়াল তুলতে চান না হায়দার সাহেব। তিনি শুধু চান, মাহদিয়া সম্পর্কের মূল্য বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত আগে নিক। তারপর মায়ের স্বরূপ জেনে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে নামুক। এইভাবে মাকে ঘিরে খারাপ কথা শুনলে তার বদহজম হবে। তখন শাদাবকে সে বিনাবাক্যে ভুল বুঝে বসবে। ঘটনার সত্যতা তো জানতে চাইবেই না উলটে অবুঝ মনে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে, শাদাবের প্রতি আরও বিতৃষ্ণা জন্মাবে। ফলে যে ভুল বোঝাবুঝির দেয়াল সম্পর্কে বেড়ে উঠেছিল, সেটার স্থায়িত্ব বেড়ে যাবে। তিনি বুদ্ধিমান মানুষ বলেই কিছুটা যুক্তি ও বুদ্ধির সাথে মাহদিয়ার কথার উত্তরে বললেন,

-‘একটা সম্পর্কে ‘তৃতীয় ব্যক্তি’ কখনওই গুরুত্বপূর্ণ হয় না। তবে জেনে-বুঝে যদি কেউ কোনো সম্পর্কের মাঝখানে দেয়াল তুলে দিতে চায়, তবে সে ওই সম্পর্ক ও দুটো মানুষের জন্য বিষধর সাপের চেয়েও বিষাক্ত হয়ে উঠে। সে আড়ালে থেকে অদৃশ্যে বিষ ছাড়ে। এমনভাবে ছাড়ে, যার বিষ ও বিষের যন্ত্রণায় মানুষ ছটফট করছে জেনেও বিষ তুলে নিতে চায় না। উলটে বিষাক্ত জায়গাটাকে আরও বিষে ভরিয়ে তুলতে ক্রমাগত সেখানে বিষের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে নিজে দূরে থেকে পৈশাচিক আনন্দ নেয়।’

***

চলবে…

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — সতেরো

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

ক্লান্ত শরীর নিয়ে রিসোর্টে ফিরেছে দুই ভাই। শাদাব যথেষ্ট স্ট্রং ও ফিট থাকলেও সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি ও ছোটাছুটিতে শিহাব খুব বেশি দুর্বল ও কাহিল হয়ে গিয়েছে। এতবেশি দৌড়েছে আজ, তার পা’দুটো ব্যথায় টনটন করছে। রিসোর্টে ফিরে কোনোমতে অল্পকিছু খেয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। অমনি তার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। অন্যদিন হলে এই ছেলের ঘুমোতে দেরী হয়। আর আজ, নয়টা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শাদাব ভাইকে ঠিকঠাক শুইয়ে, তার পায়ের কাছে পাশবালিশ রেখে সামান্য কুসুম-গরম অলিভওয়েল দিয়ে পা ম্যাসাজ করে দিল। তাতেই ঘুম গাঢ় হয়ে গেল শিহাবের। আজ প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে ঘুরাঘুরির সময়টাকে উপভোগ করেছে সে। ফিরে এসে মাহদিয়াকে সব বলবে, ভিডিও ও ছবি দেখাবে, আরও কত-শত গল্প করবে। কিন্তু শরীরে জোর না থাকায়, চোখ খোলা রাখা কষ্টকর হয়ে গেল তারজন্য। তাই রাত গভীর হওয়ার আগেই সে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় হয়নি তখনও। রিসোর্টে ফিরে একবার শুধু মাহদিয়ার অসুস্থতার খোঁজ নিয়েছিল, রুমে গিয়ে দেখা করার মতো মনের সুমতি ছিল না তার। একজন কর্মচারীর মাধ্যমেই খোঁজ নিয়ে এখন বসে বসে আজকের তোলা প্রত্যেকটা ছবি দেখছিল। ইন্টারকম বেজে উঠতেই রিসিভ করে কানে ঠেকাল। ওপাশ থেকে রিসেপশনিস্ট বললেন,

-‘আপনি কি একটু পুলসাইডে আসবেন স্যার? ওখানে আপনার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করছে।’

তারজন্য অপেক্ষা করবে, এমন মানুষ আছে আর? মা ও ভাই ছাড়া কে তাকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছে কোনোদিন! অবচেতন মনে কত ভাবনাই তো উঁকি দিল। সে সব ভাবনাকে দূরে ঠেলে বলল,

-‘জি, কে বা কারা অপেক্ষা করছে?’

-‘আপনার স্ত্রী ছাড়াও আরও বেশ কয়েক জোড়া নবদম্পতি।’

ভীষণরকমভাবে চমকাল শাদাব। আশ্চর্যের রেখা ফুটে উঠল তার চেহারায়। জানতে চাইল,

-‘কেন জানতে পারি?’

-‘সেটা আপনি নিচে এসেই দ্যাখুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসুন স্যার।’

ইন্টারকম রেখে বিছানা ছাড়ল শাদাব। ভাইয়ের ক্লান্ত, ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে কপালের একপাশে চুমু খেয়ে পাতলা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে দিল তার। ঝটপট পা ফেলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলসাইডে চলে আসলো। সেখানে মাহদিয়া ছাড়াও আরও কয়েকজন যুবক-যুবতীদের একসাথে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো। ততক্ষণে মাহদিয়া সব মেয়েদের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। মেয়েরা সবাই একদিকের চেয়ারে গোল হয়ে বসেছে, ছেলেরা সবাই অন্যদিকের চেয়ারে বসে খোশমেজাজে গল্পের আসর জমিয়েছে। মাহদিয়া সবার সাথে এমনভাবে কথা বলছে, যেন সবাই তার কত চেনা, কত আপন। কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাহদিয়ার মুখোমুখি চেয়ারে বসল শাদাব। চেয়ারটা তারজন্যই এতক্ষণ ফাঁকা ছিল। সে বসা মাত্রই সব পুরুষেরা তার সাথে ভাব বিনিময় করতে বসে পড়ল। আড়চোখে মাহদিয়াকে বেশ খানিকক্ষণ দেখল। ফোলা ফোলা চোখদুটো এখন আর ফোলা নেই, তবে অ্যালার্জির কারণে বেশ লালচে হয়ে আছে। ঠিকঠাক ঔষধ খেল কি-না কে জানে! মনে প্রশ্ন জাগলেও সবার সামনে কিছু বলবার মতো সুযোগ হয়ে উঠল না। এর আগেই একঝাঁক যুবকেরা তাকে নিয়ে আমোদে মেতে উঠবার পরিকল্পনা করছে। হুটহাট এই আড্ডার আয়োজন কেন, বুঝতে পারল না শাদাব। সবার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকাতে জাহিদ নামের একজন যুবক বলল,

-‘এখানে যাদের দ্যাখছেন, সবাই নিউকাপল এবং প্রত্যেকেরই এটা ফার্স্ট হানিমুন।’

শাদাব মাথা নাড়ল। মাহদিয়ার দিকে সরাসরি দৃষ্টি ফেলে চোখ নাচিয়ে দু’দিকে হাত প্রসারিত করে বলল,
-‘তো! সবার সাথে আমরা কেন? এটা কি আমাদেরও ফার্স্ট হানিমুন?’

মাহদিয়া মাথায় হাত রেখে বসে রইল। কতবার ম্যানেজারকে বলেছিল, সবার মধ্যে তাদের দু’জনকে যেন না টানেন। তারা এখানে হানিমুন ট্রিপে আসেনি। এসেছে অন্য কাজে। কিন্তু ম্যানেজার সাহেব শুনতে নারাজ। যেহেতু সব দম্পতি নিয়েই আয়োজন, তাই দু’জন বাদ থাকবে সেটা তিনি মানতে পারছিলেন না। এই কারণে মাহদিয়ার বারণ ও অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও তিনি সবার সাথে তাদের নাম টুকে দিয়েছেন। প্রতি বছর নিউকাপলদের নিয়ে একটা গেমসের আয়োজন করে হোটেল কর্তৃপক্ষ। কয়েক ধরনের গেমসের মাধ্যমে যে কাপলদের পয়েন্ট বেশি ও যারা প্রথম স্থান অধিকার করে অন্যসব কাপলদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়, তাদের জন্য কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে পরবর্তী বছরের ছোট্ট একটা ট্রিপের ব্যবস্থা থাকে। যে ট্রিপের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও খরচাদি হোটেল কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করে নেয়। সেই ট্রিপ হয় পাক্কা এক সপ্তাহের। এসব শোনেই মাহদিয়া নিষেধ করেছিল, এখানে তাদের নাম যেন না দেয়া হয়। সবাই তাদের সামনে থেকে যেমন দেখছে, যা ভাবছে, তাদের সম্পর্কটা যে আদৌ তেমন সহজ ও সুন্দর নয়, সেটা প্রকাশ করতে না পারা ও মনের ভেতর গিলটি ফিল নিয়ে সবার সাথে হাসিমুখে গল্প করারটাও অসহ্য লাগছিল মাহদিয়ার। তবুও মানিয়ে নিচ্ছিল। দু’জন মানুষের ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, বাইরের মানুষের চোখে পড়তে দিবে না বলেই সবার সাথে সহজ হতে চাইছিল সে। তারমধ্যে শাদাবের এই কথা তাকে আরও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিল। সে অসহায় চোখে শাদাবের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই ঠোঁটে হাসি টেনে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘দ্যাখেছেন আপনারা! বিয়ের পর এটাই যে আমাদের প্রথম হানিমুন, সেটা দিব্যি ভুলে বসে আছে আমার গুণধর স্বামী। আমি তো ভয় পাচ্ছি বাপু! কোনদিন জানি বলে দেয়, এ্যাই মেয়ে, তুমি কে? তুমি আমার বিয়ে করা বউ তো? সত্যি করে বলো তো, আমি কি তোমাকে ‘কবুল’ বলে বিয়ে করেছিলাম? কী জানি ভাই, আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না।’

মাহদিয়ার হাস্যরসের এই কথা শোনে সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করল। শাদাব হাসল না। চোখ পাকিয়ে দাঁত কটমট করে তাকাল। শক্ত চোখে বলল,

-‘আমার স্মৃতিশক্তি এতটাও দুর্বল নয় যে, নিজের বিয়ে করা বউকে ভুলে যাব।’

-‘হয়েছে, হয়েছে। স্মৃতির ভাণ্ডার দ্যাখাতে এসো না আর। খুব দ্যাখিয়েছ। এখন গেমসে মনোযোগ দাও। মনে রেখো, এই গেইমে আমাদের জিততেই হবে।’

কপাল টানটান করে কতক্ষণ মাহদিয়ার কথা শোনে পুরো ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করল শাদাব। যখন বুঝল, এখানে একটা গেমসের আয়োজন হয়েছে, সবাই একসাথে এই কারণেই জড়ো হয়েছে, তখন নিজের বেখেয়ালি কথাবার্তার ওপর বিরক্ত হলো সে! ভাগ্যিস বেফাঁস কিছু মুখ দিয়ে বের হয়নি, নয়তো এতক্ষণে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যেত। এবার নীরব শ্রোতার মতো বসে বসে নিজেই সবার সাথে আগ বাড়িয়ে সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করল। মাহদিয়া বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করল,

-‘মাথামোটা! তোমাকে শায়েস্তা করব পরে। আগে গেমসটা জিতে নিই।’

***

পুরো রাতজুড়ে বেশ কয়েকটা গেমস হবে। ম্যানেজার সাহেবসহ রিসোর্টের কয়েকজন কর্মচারী সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। অন্যরা কাজে ব্যস্ত থাকায়, এখানে কেবল পাঁচ-ছয়জন এসেছেন। যেন প্রত্যেক কাপলদের খেলা ও হারজিত স্বচক্ষে দেখে তার ভিত্তিতে একটা রেজাল্ট তৈরী করতে পারেন। প্রথম যে খেলাটা দেয়া হলো, তাতে একটা ছোট্ট বাটিতে অনেকগুলো টোকেন রাখা হলো। প্রত্যেক কাপলদের মধ্যে থেকে মেয়েরা সবাই একটা একটা করে টোকেন হাতে তুলে নিল। কারও বেলায় পড়ল গান, কারও নাচ, কারও আবৃত্তি আবার কারও পড়ল কৌতুক, তবে মাহদিয়ার বেলায় পড়ল নিকনেম। টোকেন খুলে হা হয়ে তাকিয়ে রইল মাহদিয়া। সেটা ধরিয়ে দিল শাদাবের হাতে। সে টোকেনে একবার চোখ বুলিয়ে বিড়বিড় করল,

-‘দিস ইজ টু মাচ্! আর কোনো অপশন ছিল না?’

ইচ্ছে হলো মাহদিয়াকে একগাদা বকে দিক। টোকেনটা নেয়ার সময় একটু নেড়েচেড়ে তুলবে না? আর কিছু তুললেই তো হতো। এটা কেন তুলতে গেল এই মেয়ে? গাল ফুলিয়ে বসে থেকে বাকিদের খেলা দেখতে মনোযোগ দিল। প্রথমে এক কাপল বাংলা একটা চমৎকার গানের সাথে নাচল। নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় ও অনুভূতি আদান-প্রদানের সময় যেন এটাই। ব্যাকগ্রাউন্ডে লিরিক বাজছিল,

আমি এমন একটা তুমি চাই,
এমন একটা তুমি চাই,
যে তুমিতে আমি ছাড়া অন্য কেউ নাই।
তুমি একবার বলো যদি,
আমি পাড়ি দেবো খরস্রোতা নদী।
তুমি একবার বলো যদি,
আমি পাড়ি দেবো খরস্রোতা নদী।
ভালোবাসা দেবো পুরোটাই,
আমি এমন একটা তুমি চাই,
এমন একটা তুমি চাই,
যে তুমিতে আমি ছাড়া অন্য কেউ নাই।

সিনথিয়া ও হিমেল যখন নাচছিল, সবাই তাদের নাচের তালে তালে দুলতে দুলতে তালি ও গানের লিরিকের সাথে গুনগুন করছিল। এমন একটা আয়োজনের মুখোমুখি এবার প্রথম হলো মাহদিয়া। মুহূর্তটা তার কাছে ভীষণরকম সুন্দর। একদম স্বপ্নের মতো। দু’জনার নাচ শেষ হলে সবাই করতালিতে মুখরিত করে ফেলল চারপাশ। সবাই যার যার মতো করে প্রশংসাবার্তা ছুঁড়ে দিতে লাগল। ম্যানেজার সাহেব ও কর্মচারীরা নীরবে কথোপকথন সেরে একটা নির্দিষ্ট মার্ক বসালেন। সিনথিয়া নিজের জায়গায় এসে বসতেই মাহদিয়া ও অন্যান্য মেয়েরা তারিন, নাদিয়া, মুনমুন ও কান্তা তাকে জড়িয়ে ধরল। মাহদিয়া বলল,

-‘তোমাদের দু’জনকে ভীষণ সুন্দর মানিয়েছে। চমৎকার নেচেছ। বেস্ট অব লাক।’

সিনথিয়া লাজুক হাসল। এতক্ষণে সবার সাথে সবার সম্পর্কটা বেশ এগিয়েছে। তাই সম্বোধনটা আপনিতে না থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। সে নিজের আসনে বসার পর পরবর্তী কাপল নাদিয়া ও জাহিদ পার্টিসিপ্যান্ট করার জন্য মধ্যখানে গিয়ে দাঁড়াল। তাদের টোকেনে পড়েছে একটা রোমান্টিক কবিতা। দু’জনেই চমৎকার কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি শুরু করল। রবীন্দ্রনাথের ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতা আবৃত্তি করতে কর‍তে নিজেদের মধ্যে অনুভূতির লেনদেন চালিয়ে গেল।

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার,
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়, গাঁথিয়াছি গীতহার-
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ যে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

কবিতা শেষ হওয়ার পর আবারও করতালিতে ভরে উঠল চারপাশ। এবার আসলো তৃতীয় কাপলের পালা। নিজেদের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মুনমুন ও রাফসান। তাদের বেলায় পড়ল, ছোট্ট একটা কৌতুক। মুনমুন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। কী কৌতুক করবে, সে নিজেই তো আস্তো একটা কৌতুকের বাক্স। মুখে হাত চেপে রাফসানের পেটে গুঁতো দিয়ে বলল,

-‘আমাকে দ্যাখতে কার মতো লাগছে?’

রাফসান হাসিমুখে বলল,
-‘সত্যি বলব না-কি মিথ্যে বলব?’

-‘অবশ্যই সত্যি বলবে। মিথ্যে বললে তোমাকে এই সুইমিংপুলে চুবিয়ে রাখব।’

-‘তাহলে সত্যিই বলি কেমন!’

-‘হ্যাঁ সত্যিটাই বলো।’

রাফসান দোয়াদরুদ জপতে শুরু করল। এরপর ব্যোম যে কোনদিকে ফাটবে কে জানে! যদিও কৌতুক সম্পর্কে তার ধারণা নেই, তবুও উপস্থিত দর্শকদের হাসানোর জন্য ও স্ত্রীকে রাগানোর জন্য বলল,

-‘তুমি একবার নিজেকে আয়নায় দ্যাখো, তাহলে দ্বিতীয়বার আর দ্যাখতে ইচ্ছে করবে না।’

এরমধ্যেই সবাই হেসে উঠল। মুনমুন মন খারাপের স্বরে বলল,
-‘কেন? আমার চেহারা কি খুব খারাপ?’

-‘খারাপ না-কি ভালো বুঝব কী করে? মুখে তো একগাদা মেকাপ! পেত্নী, শাঁকচুন্নির চেয়েও বেশিকিছু। আগে মুখ ধুয়ে আসো, তারপর বলি?’

মুনমুন ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে উঠে ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই রাফসানকে ক্যালাতে শুরু করল। সবাই ওদের কৌতুকে নয় কাণ্ডকারখানা দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল। রাফসান বউকে শান্ত করার জন্য বলল,

-‘আরেহ্ বাবা, আমি তো মজা করে বলেছি! সিরিয়াসলি বলিনি। আমার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী তুমি!’

মুনমুন সে কথা বিশ্বাস করল কি-না বোঝা গেল না। তবে তার চোখে আর একবিন্দু পানিও খুঁজে পাওয়া গেল না। বাকিরা সবাই মিলে সান্ত্বনার বাণী শোনাতে লাগল। মুনমুন সবার আদর, আহ্লাদী কথাবার্তা শোনে কিছুটা শান্ত হয়ে পূণরায় হাসিঠাট্টায় মেতে উঠল। তারিন ও পারভেজের টোকেনে ছিল গানের লিরিক। দু’জনেই একটা চমৎকার গান গলা ছেড়ে গাইল। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বাকিরাও গান ধরল। গুনগুন সুরে পুরো পরিবেশটাকে জমিয়ে তুলল। আশেপাশে যত নারী-পুরুষ ছিল, সবাই এসে ভীড় জমাল পুলসাইডে। আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠল একঝাঁক তাজা প্রাণ। কান্তা ও তার স্বামী ইফাদের বেলায় টোকেনে পড়ল, ভালোবাসা নিয়ে নিজেদের অনুভূতি শেয়ার করা। ওদের দু’জনের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলেও সম্পর্কে কীভাবে ভালোবাসা আসলো, কীভাবে একে-অন্যকে বুঝতে শিখল, তার ছোট্ট একটা গল্প শুনিয়ে দিল সবাইকে। সবশেষে মাহদিয়ার তোলা টোকেনটা নিয়ে সবাই আগ্রহী হয়ে তাকিয়ে রইল, তাদের গল্প শোনার জন্য। নাদিয়া জানতে চাইল,

-‘তোমার লাইফ পার্টনার তোমাকে কী নামে ডাকে? আমার ও কিন্তু আমাকে ‘স্যুইটি’ বলে ডাকে।’

***

যে সম্পর্কটা এখনও অনিশ্চিত, যে মানুষটার সাথে বন্ধনটা চিরস্থায়ী নয়, তার দেয়া ‘নিকনেম’ সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে, কিছু মুহূর্তের জন্য নিজেকে পরিপূর্ণ ভাববার কী দরকার, ভেবে পেল না মাহদিয়া। নীরবতার মাধ্যমে এই দিকটা সে এড়িয়ে যেতে চাইল। কিন্তু নাদিয়ার কথা ও অন্যান্যদের জোরাজুরিতে তা আর সম্ভব হলো না। বলতে গিয়েও সবকথা ঠোঁটের কিনারায় এসেও আটকে গেল। কান্তা তাকে আলতোভাবে ধাক্কা দিয়ে বলল,

-‘এ্যাই মাহদিয়া, বলো! ভাইয়া তোমাকে কী নামে ডাকে? আমরা কিন্তু শোনবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।’

টোকেনটা হাতের মুঠোয় দলা পাকিয়ে ফেলছিল শাদাব। মাথা নিচু রেখে সেটা একবার খুলছে তো আরেকবার হাতের চাপে চ্যাপ্টা করে দিচ্ছে। মাহদিয়া একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়েই বলল,

-‘ভ্রমর! ভ্রমর বলে ডাকে।’

সবাই উচ্চস্বরে ‘ওয়াও’ বলে উঠল। শাদাব চোখ তুলে মাহদিয়ার মনোভাব বুঝবার চেষ্টা করল। এই নামে মেয়েটার কী পরিমাণ অ্যালার্জি সেটা মনে হলেই আর ‘ভ্রমর’ বলে ডাকতে ইচ্ছে হয় না। যে এই নাম সহ্য করতে পারে না, সে-ই আবার সবাইকে শুনিয়ে বলছে, শাদাব তাকে ‘ভ্রমর’ বলে ডাকে! উপস্থিত সবাই ঘিরে ধরল শাদাবকে। হোটেল কর্তৃপক্ষের একজন মাহদিয়ার কাছে জানতে চাইল,

-‘কেন তিনি আপনাকে ‘ভ্রমর’ বলে ডাকেন? আর কোনো ‘নিকনেম’ নেই? ডার্লিং, সুইটহার্ট, মাই লেডি, স্যুইটি, হানি কতকিছুই তো আছে। শুধু ‘ভ্রমর’ই কেন?’

মাহদিয়ার তখন অসহায় অবস্থা। সে নিজেও জানে না, শাদাব তাকে কেন এই নামে ডাকে! কতদিন জানতে চেয়েছে, বলেনি। আজ সকালে যখন বলল, তাকে রাগানোর জন্যই ‘ভ্রমর’ বলে ডাকে, সে কথা বিশ্বাস করেনি মাহদিয়া। মন বলছিল, কিছু একটা যুক্তি তো নিশ্চয়ই আছে এর পিছনে। যা শিহাব সামনে থাকায় এড়িয়ে গিয়েছিল। এখন যে এড়িয়ে যাবে সেই উপায় নেই। কিন্তু তার নিজেরও জানা নেই দেখে দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,

-‘আমি নিজেও জানি না ও কেন আমাকে ‘ভ্রমর’ বলেই ডাকে।’

একঝাঁক মানুষের আগ্রহী চোখ তখন শাদাবের দিকে। সবাই আগ্রহচিত্তে তাকিয়ে আছে, নামের পিছনের গল্প শোনবার জন্য। শাদাবের মনে হলো, এরচেয়ে কঠিন ও ভয়ানক মুহূর্ত তার জীবনে আর আসেনি! যে কথা কেবল তার মন ও অন্তর্যামী জানেন, সে কথাই আজ সবার সামনে বলতে হচ্ছে। কোনোদিন এই কথা মাহদিয়াকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি সে। কিন্তু, কীসব উল্টাপাল্টা মুহূর্ত সামনে এসে তাকে একাধারে শক্ত খোলসের আবরণ থেকে টেনে বাইরে নিয়ে আসছে! এরচেয়ে কেউ যদি বলত, সে প্রেম করেছে কি-না! তাহলে উত্তরটা সহজেই দিয়ে দিতে পারত। এই কঠিন ও জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই মাহদিয়ার সামনে ধরা পড়ে যাবে সে। যদিও মাহদিয়া তা বুঝবে কি-না, সে বিষয়ে এখনও কোনো নিশ্চিয়তা নেই, তবুও রিস্ক তো আছেই! অনেকক্ষণ ধরে তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ইফাদ বলল,

-‘চুপ করে আছেন কেন? এমন কি কোনো যুক্তি নেই এই ডাকের পিছনে?’

মুখ নামিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল শাদাব। অমনি চোখের কোলজুড়ে ভেসে বেড়াতে লাগল সেদিনের সেই ছোট্ট মাহদিয়ার দৌড়। প্রজাপতি ধরার বাহানায় এদিক-ওদিক তার ছোটাছুটি। সেদিন এলোমেলো কোকড়ানো চুলে যখন মাহদিয়া ফুলের ওপর থেকে প্রজাপতি ধরার জন্য হাত বাড়িয়েছিল, শাদাব দূর থেকেই উপলব্ধি করছিল, একজোড়া পবিত্র হাত প্রজাপতি ছোঁয়ার বাহানায় পবিত্র ফুলকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ফুল সবসময়ই তার কাছে পবিত্র। সুন্দর। যে সৌন্দর্যে পবিত্রতা মিশে থাকে, তাকে অসুন্দর বলার ক্ষমতা শাদাবের নেই। সে তখন আনমনেই ভেবে যাচ্ছিল, একটা মৌমাছি যখন নিজের সবটুকু পবিত্রতা দিয়ে ফুলের মধু সংগ্রহ করে, মাহদিয়াও যেন ঠিক একইভাবে ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফুলের মধ্যে থাকা পবিত্রতার সবটুকু রস শুষে নিচ্ছিল। বিস্ময় হোক কিংবা সৌন্দর্য, তখন ওই মুহূর্তে মাহদিয়াকে দেখে তার মাথায় একটাই কথা কিলবিল করছিল, একটা পবিত্র মৌমাছি। যার হাসি ও চঞ্চল দু’খানা হাত দিয়ে ফুল থেকে প্রজাপতি ধরার দৃশ্যটায় লুকিয়ে ছিল অত্যাধিক মিশ্র অনুভূতি, যেই অনুভূতি তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল পুরোটাই। সে হারিয়ে গিয়েছিল অন্যরাজ্যে। চোখের সামনে এমন পবিত্র প্রাণের ছোটাছুটি দেখে মুখ, মন ও মস্তিষ্ক তাকে সিগন্যাল দিয়েছিল, ওই অবুঝ চঞ্চল মেয়েটা মৌমাছির মতোই পবিত্র। মৌমাছি নিজে যেমন পবিত্র, মানুষকে দান করেও পবিত্র এক খাবার। কোনো ফুল গাছের ওপর বসলে সে অতি সাবধানে বসে, যেন কোনো ফুল নষ্ট না হয়। মাহদিয়ার ওই ছোটাছুটির মধ্যেও বাগানের ফুলগুলো নষ্ট হচ্ছিল না দেখে, মন থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ভ্রমর। মৌমাছি ডাকটা অনেক লম্বা হওয়াতে তখন সে মাহদিয়াকে একটা পবিত্র মৌমাছির নামে আখ্যায়িত করেই ‘ভ্রমর’ ডেকেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই মাহদিয়া তার ডাক শোনে ভয়ে বেশ কয়েকটা ফুলগাছ একসাথে চ্যাপ্টা করে দিয়েছিল। তা দেখে শাদাবও যথেষ্ট রেগে গিয়েছিল সেদিন। নিমিষেই প্রথম আলাপ, প্রথম দেখা ঝগড়াতে রূপান্তরিত হয়েছিল।

চোখের সামনে পুরনো দৃশ্যকে কল্পনা করে, কণ্ঠ নীচু রেখেই শাদাব বলল,
-‘বহু বছর আগে একটা নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে সৌন্দর্য ও পবিত্রতার যে রূপ আমি দ্যাখেছিলাম তাতে সেদিন একটা কথাই উপলব্ধি করেছিলাম, ও পবিত্র! সেদিন ও’কে দ্যাখে মনে হয়েছিল, একটা পবিত্র মৌমাছিকে ফুলের ওপর থেকে মধু সংগ্রহ করতে দ্যাখছি। আমি এত ব্যাখ্যার হিসেব না দিয়েই ও’কে ‘ভ্রমর’ বলে ডেকেছিলাম। আজও ও আমার কাছে ততটাই পবিত্র আছে, যতটা সেদিন ছিল।’

কথা শেষ করেও মুখ নামিয়ে বসে রইল শাদাব। চারপাশ থেকে করতালির আওয়াল ভেসে এলো কানে। কেউ কেউ সিটি বাজিয়ে উঠল। সবার এত এত রি’অ্যাকশনের ভীড়ে একজোড়া জল টলমল চোখ দু’হাতে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে গেল। তার মনে হলো, এমন চমৎকার কথা সে আগে শোনেনি। শাদাব তাকে এইভাবে উপলব্ধি করেছিল! এতটা গভীরভাবে! অথচ সবসময় কীটপতঙ্গের কথা বলে এই ছেলে তাকে রাগিয়ে গিয়েছে। সকালেও রাগিয়েছে। নিশ্চয়তা দিয়েছে। আর সে কভু ওই নামে ডাকবে না। সত্যিই কি শাদাব তাকে আর ‘ভ্রমর’ বলে ডাকবে না? অশ্রুমাখা চিবুক নিয়ে সামনে চোখ রাখল মাহদিয়া। প্রশ্নের উত্তর জানতে গভীর আবেশে তাকিয়ে রইল। শাদাব চোখ তুলল না। তখনও তার মুখ নিচু! মাহদিয়া বুঝতে পারল না, এখনও কেন এই ছেলে চোখ নামিয়ে রেখেছে! কেন তার দিকে তাকাচ্ছে না? কেন ‘ভ্রমর’ বলে ডাকছে না? বেশ খানিকক্ষণ পর কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ তুলল শাদাব। মাহদিয়ার পুরো শরীরসহ মনটাও ঝাঁকুনি নিল। মুখফুটে কিছু বলবার আগেই শাদাব সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘স্যরি। পাঁচ মিনিট পর আসছি!’

***

চলবে…