#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — আঠারো
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
চোখ দিয়ে মানুষ নিজের মনের অব্যক্ত ভাষা কীভাবে প্রকাশ করে আজ তা স্বচক্ষে দেখার মতো সৌভাগ্য হলো মাহদিয়ার। খুব বেশি আবেগ, অনুভূতি, সুখ কিংবা দুঃখ, মনের ভেতর একাধারে লুকিয়ে রাখতে রাখতে মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে আসে, তখন চোখের কোণে শূণ্যতা ও বরফ শীতল চাহনি অনেক সময় মনের গোপন ঘরের কথা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কখনও কোনো পুরুষের চোখের দিকে এত গভীর ও মায়াময় দৃষ্টি দিয়ে তাকায়নি মাহদিয়া। আজ যখন শাদাব নিজের অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসলো, তখনই ওইদুটো চোখ দিয়ে মন পড়ের নেয়ার বড্ড তৃষ্ণা জাগল বুকে। সেই তৃষ্ণা মেটাতেই শাদাবের চোখের ভাষা দিয়ে মন পড়তে চাইছিল মেয়েটা। যখন আচমকাই সে চোখ তুলল, কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে তাকে এলোমেলো করে দিল, তখনই ওই দুটো চোখে কঠোরতার বদলে অদ্ভুত সম্মোহন লুকিয়ে থাকতে দেখে সুখ ও দুঃখের সংমিশ্রণে ডুবে ডুবে ভাসতে লাগল সে। এভাবে চোখে চোখ রাখা যে অসম্ভব, সেটা বুঝতে পেরেই নিজেকে লুকোতে দূরে সরে গেল শাদাব। সবাই তার চলে যাওয়াটাকে সহজভাবে নিলেও মাহদিয়ার কান্না দেখে ভরকে গেল। কান্তা অবাক হয়ে বলল,
-‘তুমি কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে? এটা তো চমৎকার একটা উপলব্ধি। কারও কাছে তুমি সবসময় স্বচ্ছ ও পবিত্র আছো এই সত্যটা তো তোমার কাছে সুখের ও আনন্দের হওয়ার কথা। এমন মুহূর্তে কেউ কাঁদে?’
মাহদিয়া জবাবে শুধু হাসল। চোখের পানি মুছে নিজেও বসে থাকার মতো ধৈর্য্য পেল না আর। ছুটে গেল শাদাবের পিছন পিছন। অনেক কথা জানার আছে তার। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। সবকিছুর উত্তর না পেলে জীবন নিয়ে সে শুধু ভুল সিদ্ধান্তই নিবে। এত বছর পর পবিত্র সম্পর্কের টানে ফিরে এসে তাকে যদি এইভাবে গলাটিপে হত্যা করে চলে যায়, তবে নিজেকে কোনোদিন সে ক্ষমা করতে পারবে না। যেভাবেই হোক, শাদাবের পেটের ভেতরে থাকা সবটুকু লুকায়িত অনুভূতিকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে বের করে আনতে হবে। নয়তো স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না এই ছেলে। দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে নির্ঘাত। সে বুঝদার একটা মেয়ে হয়ে এত সহজে এই দৃশ্য দেখে, জেনে-বুঝে কখনওই কোনো ভুল কাজ আর করবে না। লুকিয়ে রাখা সমস্ত অব্যক্ত কথা ও ঘটনাকে জেনে তারপর সম্পর্ক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। এইভেবেই ছুট দিতে বাধ্য হলো সে। কেউ কিছু লুকাতে চাইলে যেমন জোর করে জানা যায় না, তেমনি কেউ নিজেকে খোলসের ভেতর আটকে রাখতে চাইলে তাকে পুরোটা না বুঝে খোলস থেকে মুক্ত করাও যায় না। মনে মনে হাজারও দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে মাহদিয়া।
পুলসাইডের অন্যদিকে একটা যুবক সিগারেট টানছিল। শাদাব তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘একটা সিগারেট হবে?’
বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল সিগারেট চাইতে। কিন্তু না চেয়েও পারছিল না। বুকের ভেতর দাউদাউ করে যে আগুন জ্বলছে সেই আগুন নেভানোর জন্য হলেও নিজেকে শান্ত রাখার প্রয়োজন আছে। কখনও সিগারেট ছুঁয়ে দেখেনি শাদাব। এই জিনিসের প্রতি আগ্রহ তার কোনোকালেই ছিল না। অচেনা পুরুষের কাছে সিগারেট চাইতেও সংকোচ হচ্ছিল, কিন্তু তবুও নিজের মনটাকে সামলাতে এইমুহূর্তে তার সিগারেটকেই আপন মনে হলো। যুবকটা বাড়তি একটা সিগারেট ও দিয়াশলাই বের করে দিল। শাদাব নির্মিশেষ চেয়ে রইল সেটার দিকে। সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে অনভ্যাসের কারণে প্রথম টান দিতেই পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার জোগাড় হলো তার। অনবরত কাশি ও ধোঁয়ার গন্ধে নাকমুখ বাজেভাবে কুঁচকে এলো। ডানহাত দিয়ে ধোঁয়া সরিয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে জ্বলন্ত সিগারেট ধরিয়ে দিল যুবকের হাতে। অস্বস্তি ভাব এড়াতে বলল,
-‘স্যরি। এই বাজে জিনিস ছুঁয়ে দ্যাখার অভ্যাস একদমই নেই।’
যুবকটা কাঁধ নাচিয়ে হাসল। বলল,
-‘হঠাৎ করে এই জিনিসের প্রতি আগ্রহ জন্মাল কেন?’
হাত দিয়ে তখনও নিজের নাসারন্ধ্রে জমে থাকা সবটুকু ধোঁয়াকে দূরে সরিয়ে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করল শাদাব। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গিয়ে পালটা প্রশ্ন সাজিয়ে বলল,
-‘এটা টানলে কী হয়?’
-‘শান্তি পাওয়া যায়।’
-‘সিগারেটে শান্তি আছে?’
ম্লানমুখে যুবকটা উত্তর দিল,
-‘সুখে থাকতে যাদের ভূতে কিলায়, তারাই সিগারেটের মতো বাজে খাদ্য খেয়ে মরণব্যাধি ক্যানসারের দিকে একধাপ এগিয়ে যায়।’
শাদাব হাসতে গিয়েও যুবকটার অবাক করা কথায় থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। যুবকটা হাসিমুখে বলল,
-‘সিগারেট মানুষ তখনই খায়, যখন খুব বেশি কষ্ট তাকে মৃত্যু যন্ত্রণার মতো কঠিন যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড় করায়। বেশিরভাগ টিন-এজ তরুণেরা নিজেদের ব্যর্থতা সহজেই মেনে নিতে পারে না দেখে সিগারেটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আমিও তাদেরই একজন। অভ্যাস হওয়ার পর আর ছাড়তে পারিনি। এখন তো এটা নেশার মতো আমার প্রত্যেকটা রক্তকণিকার সাথে মিশে গিয়েছে। আমি নাহয় নিজের কষ্ট ভুলবার জন্য এটা অভ্যাস করে নিয়েছি। আপনি কেন এটা টানতে যাচ্ছিলেন?’
জবাব খুঁজে পেল না শাদাব। শুনেছিল, সিগারেট খেলে বুকের ভেতর হালকা হয়। মনের কষ্ট, যন্ত্রণা দূর হয়। কিছুক্ষণ আগে যে পরিস্থিতির সামনে সে পড়েছিল, ওইমুহূর্তের কষ্ট ও সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য একটা সিগারেট দরকার ছিল তার। তাই অচেনা যুবককে দেখে তার কাছেই সিগারেট চাইতে এসেছিল। যে জিনিসের প্রতি অভ্যাস নেই, আগ্রহ নেই, সেটা পেটে চালান করা যে কত কষ্ট, তা স্বজ্ঞানে উপলব্ধি করতে পেরে নিমিষেই সিগারেটের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নিল। হাওয়ায় মাছি তাড়ানোর ভান করে বলল,
-‘এমনি-ই। ইচ্ছে হয়েছিল।’
যুবকটা কী বুঝল কে জানে! আর কিছু জানতে চাইল না। নিজের হাতের সিগারেটটায় টান দিয়ে উপরের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। মাহদিয়া পিছন থেকে এমন দৃশ্য দেখে প্রথমে বিস্মিত হলো, পরক্ষণেই শাদাবের কাশি ও ধোঁয়ার সাথে কুস্তি দেখে রেগে গেল। সামনে এসে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-‘বাহাদুরি শেষ?’
চমকে গিয়ে পাশে তাকাল শাদাব। মাহদিয়াকে দেখেও কিছু বলল না। যুবকটা দাঁড়িয়ে থেকে একাধারে সিগারেট টানছে তো টানছেই। দু’জনের দিকে লক্ষ্য নেই তার। শাদাবের থেকে জবাব না পেয়ে মাহদিয়া পূণরায় বলল,
-‘আর লাগবে? এখন থেকে এটার অভ্যাস করে নাও। ভেতরে যত কষ্ট আছে সব এই সিগারেটের মধ্য দিয়েই উগড়ে দাও। তা-ও বুকের ভেতর কষ্টের পাহাড় আটকে রেখে নিজেকে শেষ কোরো না।’
তখনও নিশ্চুপ রইল শাদাব। মাহদিয়া হাত বাড়িয়ে ছেলেটার কাছ থেকে জ্বলন্ত সিগারেট চেয়ে নিল। সেটা আবার শাদাবের হাতের মধ্যে জোরপূর্বক ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘শুরু কোরো। দ্যাখি এটা শেষ করতে পারো কি-না। কত্তবড়ো সাহস। সিগারেট টানতে এসেছে! কী আছে এর মধ্যে? সুখ না-কি শান্তি? তুমি একজন ডাক্তার হয়ে কী করে এই বাজে নেশার অভ্যাস করতে যাচ্ছিলে? একবার ভাবলে না, বেঁচে থাকাটা তোমার জন্য কতটা জরুরী! আমি তো কেউ হই না, তোমার। আমার জন্য না হোক, অন্য দুটো মানুষের জন্য শক্ত থাকতে হবে তোমাকে। বাঁচতে হবে।’
নিজের মা ও ভাই যে তার কতটা আপন সেটা শুধু শাদাব একাই জানে। তার বেঁচে থাকা, শক্ত থাকা, হাসিখুশী থাকা কেবল এই দুটো মানুষের জন্যই। তাদেরকে নিরাপদ ও সুস্থ জীবন দিতে, ভরসা ও সাহস দিতে, নিজের জীবনের সুখকে তুচ্ছ করে তাদের জন্যই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। জীবনে আর কিছু না থাকুক, এই দুটো মানুষ না থাকলে সে নিঃস্ব হয়ে যাবে। নিয়তি তাকে যত কষ্ট দিয়েছে, যত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, সব জায়গায় মনোবল পেয়েছে শুধু নিজের মা ও ভাইয়ের জন্য। কিছু না থাকুক, তারজন্য দুটো মানুষ রোজ পথচেয়ে থাকে, এটাই তার এত না পাওয়া ও যন্ত্রণার ভীড়ে বিরাট পাওয়া। যার কারণে বার বার নিজে অসুস্থ হলেও মনের জোর দুটো মানুষের কথা ভেবে সুস্থ জীবনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার পথ খুঁজে নিয়েছে সে। কিন্তু আজ! এতগুলো বছরে বুকের ভেতর জমে থাকা যন্ত্রণার পাহাড় যেন তাকে শেষ করে দিচ্ছিল। নিজেকে সর্বহারা মনে হচ্ছিল। সবকিছু থাকার পরও কিছু একটা নেই, যারজন্য নিজেকে তার অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছিল! সুখটা অধরা মনে হচ্ছিল। অথচ জীবন নিয়ে সে কোনোদিন এত হতাশায় দিন কাটায়নি। তবে একটা সময় খুব করে চেয়েছিল, সুখী হতে। খুব কাছ থেকে জীবনের পরিপূর্ণ সুখকে ছুঁয়ে দেখতে। ভাগ্য কখনওই তার সহায় হয়নি। সবসময় ভাগ্য তার সাথে নিষ্ঠুর খেলা খেলেছে। আজও খেলছে। প্রতিযোগিতার নাম করে মাহদিয়া এই গেইমে জিততে চাইছে। প্রতিযোগিতায় জিতে লাভ হবে কী! দিনশেষে যদি সে মুক্তি চেয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। তবে এই লোকদেখানো জিত ও সম্পর্কের মূল্য রইল কোথায়? পরিস্থিতির চাপে পড়ে মাহদিয়া তাকে ব্যবহার করে জিততে চাইছে। এই মেয়েটার যে জিতে যাওয়ার নেশা আছে। সেটা সে ছাড়া আর কে ভালো জানে!
হাতের মুঠোয় জ্বলন্ত সিগারেটকে দলা পাকিয়ে নিল শাদাব। চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিবে এমন ভয়ানক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মাহদিয়া ঘাবড়াল না। যেভাবে শক্ত মেজাজে দাঁড়িয়েছিল, সেভাবেই রইল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার সবটুকু ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল শাদাব। কণ্ঠে রাগ, জোর ও কঠরতা মিশিয়ে বলল,
-‘আমার যা মন চায় আমি সেটাই করব, তাতে তোমার সমস্যা কী? কে তুমি? কী হও আমার? কেউ হও না। কিচ্ছু হও না। আমার ব্যক্তিগত জীবন ও ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে একদম বাড়াবাড়ি করবে না। আমি বাঁচি কি মরি তাতে তোমার কী?’
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরেই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল মাহদিয়া। বাইরের মানুষের সামনে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক ও তার মধ্যকার ঝুটঝামেলা নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা করে অযথা সম্পর্কের দিকে নোংরা কালি ছুঁড়ে লোকের সামনে সেটাকে হাসি-ঠাট্টার উপকরণ সাজিয়ে লাভ নেই। এতে ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। রাগ ও মেজাজকে গিলে নিয়ে সহজভাবে বলল,
-‘সবার সামনে থেকে এভাবে উঠে এসেছ, কী ভাববে সবাই? আমাদের মধ্যে যা-ই থাকুক, রাগ-ক্ষোভ, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, সেটা মানুষের চোখের সামনে কেন পড়তে দেব? আমি আর কিছু বলব না। কিছু জানতেও চাইব না। তোমার যা খুশি তুমি তা-ই করবে। কিন্তু এখন সবার সামনে চলো। আমরা একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি। জিততে হবে তো।’
যুবকটা ততক্ষণে সেখান থেকে চলে গেছে। এতে শাদাব নিজেও স্বস্তি পেয়েছে। তাদের সম্পর্ক নিয়ে যা-ই হোক, সেটা বাইরের মানুষের চোখে পড়তে দেয়া উচিত না। বিষয়টা যত সহজে বুঝতে পারল, রাগ ও মেজাজকে তত সহজে সামলাতে পারল না। জেদ ধরেই বলল,
-‘আমি কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি না।’
-‘অলরেডি একটা গেইম শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন অংশগ্রহণ করছি না, বললে তো হবে না। সবাই ভাববে হেরে যাওয়ার ভয়ে পিছিয়ে এসেছি। তুমি তো জানোই, জিততে না পারলে রাগটা কোথায় ঢালব!’
সুযোগ পেয়ে মাহদিয়া তাকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে চাইছে। আর তাকেও লোকদেখানো নাটক করতে হচ্ছে। চলেই তো যাবে, তাহলে এত নাটকের কী দরকার! কেনই-বা জিততে হবে এই প্রতিযোগিতায়? হারলে ক্ষতি কী? সে তো হেরেই এসেছে সবসময়। জীবনের সবচেয়ে দামী খেলাতেই তো সে হেরে বসে আছে। এই খেলায় জিতে কী হবে তবে? জিত যার কপালে নেই, সুখ যার জীবনে নেই, তার জীবনে লোকদেখানো জিতের কী প্রয়োজন? কীসের জন্য খেলবে সে? কার জন্য খেলবে? শাদাব খুব ভালোভাবেই জানে জিততে না পারলে মাহদিয়া রাগটা তারউপরই প্রয়োগ করবে। এই মেয়েটার সমস্যা একটাই। হার সে মেনে নিতে পারে না। মানলেও রাগটা শাদাবের উপর দিয়ে ঝড়তুফানের মতো উড়িয়ে দেয়। সেই সাতদিনের একটা অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিল শাদাব। এরপর আর এই মেয়েটাকে তার হারাতে মন চায় না। সবসময়ই চায়, জিতে যাক। সে সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাক। এখনও চাইল। নিজেই হারটা মেনে নিয়ে বলল,
-‘জিতে কী করবে? আগামী বছর আসবে আর? পরবর্তী ট্যুরে যদি না-ই থাকো, এই জিতে যাওয়ার কোনো মূল্য থাকবে বলো! কেন জেদ করছ?’
-‘আমি জেদ করছি না শাদাব। তুমি-ই বাড়াবাড়ি করছ। মুখ ফুটে কিছু বলছ না। কিছু বুঝবারও সুযোগ দিচ্ছ না। পনেরো বছর আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। আমার রাগ করাটা কি স্বাভাবিক না? জেনে-বুঝে নিজেকে আড়াল করে রেখেছ। কষ্ট দিচ্ছ আমাকে। দোষটা কি আমার? আমার ওপর কেন রাগ দ্যাখাচ্ছ? প্রতিমুহূর্তে নিজেকে অসহায় মনে হোতো। এত বছরের রাগ, অভিমান থেকেই হুট করে এখানে এসে তোমাকে দ্যাখার পর মেজাজ হারিয়ে ফেলেছি। মেয়েদের মন কীভাবে বুঝবে তুমি? যদি কখনও কাউকে ভালোবাসতে তবে বুঝতে, কারও প্রতি তোমার একপাক্ষিক অনুভূতি তোমাকে কত যন্ত্রণা দিচ্ছে। না মুক্তি আছে আর না শান্তি। জীবন তো ষোলো’আনাই বৃথা।’
মাহদিয়া কারও জন্য অপেক্ষা করছে! একপাক্ষিক অনুভূতির টানেই, সেই কেউ একজনের জন্যই তার ছুটে যাওয়ার তাড়া। মুক্তি ও ছুটি পাওয়ার তাড়া। শোনে শুধু হাসল শাদাব। বলল,
-‘বললাম তো শীঘ্রই মুক্তি পেয়ে যাবে। তখন আর জীবন বৃথা হবে না। যার জন্য ছটফট করছ, তাকে নিয়েই সুখী হও।’
তার হাতের মুঠোয় থাকা সিগারেটটা বের করে দূরে ছুঁড়ে ফেলল মাহদিয়া। টানতে টানতে এগোতে লাগল। শাদাব বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘আশ্চর্য! এত জোর করছ কেন? একবার বললাম তো, এসব ফালতু খেলায় আর অংশগ্রহণ করব না আমি।’
নির্ভার হাসল মাহদিয়া। দাঁতপাটি বের করে শাদাবকে রাগাতে বলল,
-‘কোরো না। অসুবিধা নেই। একবার সবগুলো পোট্রের্ট নষ্ট করে দিয়েছি। এবার ছোটোনকে গিয়ে বলব, তুমি নিজের বিয়ে করা বউকে অস্বীকার করছ! লুকোচুরি করছ ভালো কথা, লুকিয়েই রাখো। এই মাহদিয়া একবার যখন দেশে ফিরেছে, তখন সব সত্যি না জেনে এত সহজে ফিরে যাবে না। তাতে তুমি রাগ দ্যাখাও কিংবা ভয় দ্যাখাও, আমি ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব নিয়েই থাকব।’
পুরনো দৃশ্য মনে হতেই শাদাবের চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল! কীভাবে তার শখের পোট্রের্টগুলো ভেঙে ঘুরিয়ে দিয়েছিল এই মেয়ে! ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদেকেটে ঘরশুদ্ধ লোককে এক করে, তাকেই বকা শুনিয়েছিল। বহুদিন পর, পুরনো দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটার ভয়ে গলার পানি শুকিয়ে গেল তার। মনে যে জ্বালা-যন্ত্রণা ছিল, তার পাশাপাশি এখন দুঃশ্চিন্তাও বেড়ে গেল। আর পারা গেল না। এইটুকুন মেয়ে, তাকে কীভাবে ভরকে দেয় দেখো! শিহাব এখনও অবুঝ। সবকিছু বুঝার মতো বয়স তার হয়নি। এখনই যদি এতকিছু জানে ধাক্কা তো খাবেই, মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়বে। মন ও মস্তিষ্কে আঘাত পাবে। মা ও ভাইকে ভুল বুঝতে শুরু করবে। প্রাণের চেয়েও প্রিয় যে ভাই, নিজের সামান্য ভুলে সেই ভাইকে অসুস্থ হতে দেখবে কী করে! মাহদিয়ার মনোভাব ও তার ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব দেখে বলল,
-‘তুমি আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছ। এটা কিন্তু অন্যায়। কাউকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করা উচিত না।’
হাত ছেড়ে দিল মাহদিয়া। নিজের দুই হাত ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখল। চোখ নাচিয়ে বলল,
-‘ঠিক আছে। আমিও আর জোর করছি না। তুমি এক কাজ কোরো, ট্যুর শেষ করে বাড়ি যাও। পারলে এক্ষুণি যাও। গিয়ে আন্টিকে বলো যে, বঁধুবরণ করার জন্য তিনি যেন তৈরী থাকেন। আয়লা, নার্গিস, তিতলি যা আছে, সব ঘুর্ণিঝড়কে সঙ্গে নিয়ে যেকোনো দিন, যেকোনো মুহূর্তে, কাঁথা-বালিশসহ হাজির হয়ে যাব। তখন কোনো জোরাজুরিও হবে না, ঝামেলাও হবে না। যা হবে, এই মাহদিয়ার ইচ্ছেতেই হবে।’
দুঃশ্চিন্তা আরও গাঢ় হলো শাদাবের। এই মেয়েটা ইচ্ছে করেই নাকানিচুাবানী খাওয়াচ্ছে। মানুষ এত স্বার্থপর হয় কী করে! মুক্তি চেয়ে এখন আবার বলছে কাঁথা-বালিশ নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। এটা কোনো কথা? কীভাবে এত কঠিন পরিস্থিতি সামলাবে সে? কীভাবে শিহাবকে সব সত্য বলবে? টেনশনে তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। এই টেনশন সরানোর একটাই উপায়, মাহদিয়ার কথা মেনে নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা। যখন-তখন যা খুশি করতে পারে এই মেয়ে। চাইলে ঘাড়ে উঠে নাচতেও পারে, আবার ঘাড় মটকে দিতেও পারে। বিশ্বাস নেই একে। একদমই নেই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে, কণ্ঠে জোর এনে বলল,
-‘ঠিক আছে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করব। কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও, এক্ষুণি ছোটোনকে কিচ্ছু বলবে না। ও এখনও অবুঝ। এই সত্যিটা সামলাতে পারবে না। অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে।’
বিজয়ীর মতো গাল ভরে হাসল মাহদিয়া। বলল,
-‘হাত দাও।’
-‘কেন?’
-‘বাড়ে, কথা দিতে হলে হাত ছুঁতে হবে না? পা ছুঁয়ে কথা দিব? তাহলে দাঁড়াও, ছুঁই।’
শাদাবকে জ্বালাতে ইচ্ছে করেই নিচের দিকে খানিকটা ঝুঁকে গেল মাহদিয়া। এক লাফে দূরে সরে গেল শাদাব। অস্বস্তি নিয়ে বলল,
-‘এ্যাই, না। পা ছুঁতে হবে না। হাত ছুঁয়েই বলো।’
মাহদিয়ার তখন হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার দশা। সে একহাত মুখে চেপে শব্দহীন হাসিতে ঠোঁট ভরিয়ে তুলল। অন্যহাত বাড়িয়ে দিয়ে শাদাবের একটা হাত ধরে বলল,
-‘এক্ষুণি বলব না। তবে আজ তোমায় ছুঁয়ে একটা কথা বলছি, বড়ো মামাকে উচিত শিক্ষা দিবই। সেটা তুমি চাও বা না চাও। দুটো অবুঝ মানুষকে একই সুতোয় বেঁধে, সম্মান ও অহমিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের স্ত্রী-সন্তানদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে যে ভুল উনি করেছেন, সেই ভুলের যথাযথ শাস্তি ওনাকে পেতেই হবে।’
চোখ ছোটো করে তাকাল শাদাব। বলল,
-‘এসব অহেতুক ঝামেলার দরকার নেই।’
-‘বললেই হলো। ওনার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পনেরোটা বছর কষ্ট পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি। বাকিজীবন কী হবে জানি না, তবে ইতালি ব্যাক করার আগে সব হিসাব চুকিয়েই যাব। কোনো পিছুটান রেখে যাব না।’
হাঁটতে হাঁটতেই প্রতিযোগিতার আসরে উপস্থিত হলো দু’জনে। তখনও দু’জনার হাতে হাত রাখা। মাহদিয়ার মধ্যে কোনো জড়তা দেখা যাচ্ছিল না, তবে শাদাব সবকিছু সহজে গ্রহণ করতেও পারছিল না। তার মাথার শুধু একটা কথাই খেলা করছে। বিচ্ছেদ যখন নিশ্চিত, তখন মাহদিয়া কেন জল ঘোলা করতে চাইছে? কেন কায়ছার সাহেবকে শাস্তির নামে পুরনো সবকিছু সামনে আনতে চাইছে? ও আসলে চায় কী? মুক্তি না-কি অন্যকিছু? কেন তার মনে হচ্ছে, এই মেয়ে মুখে বলছে এক, কাজে করবে আরেক! কেন বুঝেও বুঝতে পারছে না সে! একটা মানুষ এত কেন অচেনা হলো তার? আরেকটু গভীরভাবে চেনা-জানা হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? মনের ভেতর যন্ত্রণার সবটুকু ঢেউ এসে আঁচড়ে পড়ে তাকে এলোমেলো করে দিল। গন্তব্যহীন সম্পর্কের পরিণতি কল্পনা করে মনে মনে বিড়বিড় করল,
-‘একমাত্র তুমি-ই পারো আমাদের মধ্যে থাকা এই নামহীন সম্পর্কের বন্ধনটাকে মজবুত করতে। আমার হাতে আর কিচ্ছু নেই ভ্রমর। চাইলেও এক’পা এগোতে পারব না আর। অনেক আগেই এগোবার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছি আমি।’
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — উনিশ
কার্টেসিসহ কপি করা নিষেধ!
প্রতিযোগিতার এই অংশে, গেমে একটা দারুণ ব্যাপার যোগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটা দম্পতির জন্য এক মিনিট সময় বরাদ্দ করার পর তাদেরকে বলা হলো, মুখোমুখি বসে থাকা অবস্থাতেই একজন স্বামী তার স্ত্রীর দিকে চোখের পলক না ফেলে টানা এক মিনিট তাকাবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যার চোখের পলক আগে পড়বে সে-ই দম্পতি হেরে যাবে। এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যে স্বামী একদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাবে সে-ই দম্পতিকে এই রাউন্ডের বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। তবে এক্ষেত্রে মেয়েদেরকে একটা রুলস্ মানতে হবে। ছেলেরা যখন নিজেদের স্ত্রীদের দিকে তাকাবে, স্ত্রীরা তখন বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজেদের পার্টনারকে বিরক্ত করবে অথবা বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করবে। সেই বাঁধাকে উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যারা এই খেলা চালিয়ে যেতে পারবে তাদের পয়েন্টও অন্যান্য দম্পতিদের তুলনায় বেশি হয়ে যাবে। এমন আজব রুলস্ ও খেলা শোনে সবাই উচ্ছ্বসিত হলেও মাহদিয়া হতাশার স্বরে শাদাবকে বলল,
-‘তুমি তো আমার দিকে দুই-তিন সেকেন্ডও ঠিকমতো তাকাও না। এক মিনিট কীভাবে একদৃষ্টিতে তাকাবে? এই গেমে আর জিততেই পারব না। দূর…!’
খেলা শুরুর আগেই মুখের হাসি মুছে যেতে শুরু হলো তার। জিততে না পারলে মনে যে অশান্তি নামবে তার দরুন সবার সামনেই শাদাবের চুল টেনে ধরতে পারে সে। নিজের উপর থেকে সবটুকু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে তখন। তারমধ্যে আবার স্ত্রীদের বাঁধা দেয়া লাগবে। হার ও জিতের এই খেলায় সে যে আগেই হেরে বসে আছে, এটা টের পেয়েই মুখ কালো করে নিজের চেয়ারে বসে রইল মাহদিয়া। শাদাব তার এই চুপসে যাওয়া মুখখানি দেখে কোনোমতে হাসি আটকাল। নিচুস্বরে বলল,
-‘যাহ্, খেলা শুরু হওয়ার আগেই হেরে বসে আছো দ্যাখছি। নিজের ওপর কনফিডেন্ট লেভেল এত কম কেন?’
-‘আমার নিজের ওপর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে। কিন্তু তোমার ওপর একফোঁটাও বিশ্বাস নেই। তুমি সবসময় চাও আমি হেরে যাই।’
-‘ওহ্। কারণটা এই। আচ্ছা, খেলা শুরু হোক, দ্যাখা যাক কত সেকেন্ড তাকাতে পারি। তুমি এটা ভাবো যে, তুমি কী করে আমাকে বিরক্ত করবে!’
মাহদিয়ার মুখে হাসি না আসলেও সে ভাবতে লাগল কীভাবে এই গেমটা জিতবে! এক মিনিট এই ছেলে তাকাবে তো তার দিকে, না-কি ইচ্ছে করেই মাঝপথে তাকে আটকে দিবে? হেরে যাওয়ার ভয় দূর করে মনে সাহস সঞ্চয় করল মাহদিয়া। পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে মুখোমুখি বসে বাকিদেরকেও একনজর দেখে নিল। সবাই-ই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছে, খেলা শুরু হওয়ার। বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে সবাই প্রত্যেকটা দম্পতির দৃষ্টি বিনিময় শুরু হলো। প্রথম পাঁচ সেকেন্ড শেষ হওয়ার পরই মেয়েদেরকে বাঁধা প্রধান করার অনুমতি দেয়া হলো। নাদিয়া মুখ ভেংচি দেয়া মাত্রই জাহিদ ফিক করে হেসে চোখের পলক ফেলে দিল। অমনি সে গেম থেকে আউট হয়ে গেল। বাকিরাও যে যার মতো করে নিজেদের পার্টনারকে বাঁধা দেয়া শুরু করল। কেউ হাসল, কেউ চিমটি দিল, কেউ বিষম খাওয়ার ভান ধরতেই সব ছেলেরা এক এক করে এক মিনিটের আগেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। মাহদিয়া প্রথমে সুযোগ পাওয়াতে শাদাবকে চোখ দিয়ে টিপ্পনী কাটল, শাদাব চোখ সরাল না। অন্যদিকেও ঘুরল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাহদিয়া অন্য উপায় খুঁজে নিয়ে বলল,
-‘ছোটোন এইদিকে আসছে, দ্যাখো। যদি জানতে চায়, এখানে কী হচ্ছে, উত্তর দিতে পারবে?’
শাদাব শুধু মুচকি হেসে চোখ খোলা রেখেই বলল,
-‘এখন ওর ঘুম ভাঙবে না। ভাঙলেও সবার আগে আমাকে ফোন করবে। নিশ্চিত না হয়ে এখানে আসবে না।’
মাহদিয়া বাকিদের দিকে তাকাল। মুনমুন বলল,
-‘অন্যকিছু চেষ্টা করে দ্যাখো।’
শাদাবের চোখের সামনে নিজের দু’হাত বাড়িয়ে দিল মাহদিয়া। বলল,
-‘তুমি ডাক্টারটা সুবিধার না। ভালো ঔষধ দাওনি। দ্যাখো, এখনও হাতের দাগ সারেনি। কী বিচ্ছিরি লাগছে তাই না? ইশ, আমার পুরো স্কিনটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
-‘ধৈর্য্য এত কম কেন? কোন রোগ একদিনেই সারে? না সারলেও অসুবিধা নেই। বড়োসড়ো একটা সার্জারী করে দেব। তখন হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিজের এই সুস্থসবল হাতকে গলার সাথে ঝুলিয়ে রেখে দিও।’
তখনও নিষ্পলক চোখে তাকিয়েই জবাব দিল শাদাব। মাহদিয়া নিজেই এবার বিব্রতবোধ করছে। কোনোভাবেই এই ছেলে চোখ সরাচ্ছে না। অথচ পুরো এক মিনিট ধরে তাকে বাঁধা দিতে হবে। আর কী উপায় আছে? কোনোকিছু না পেয়ে নিজের কোঁকড়াচুলের কাঁকড়া ক্লিপে হাত দিল মাহদিয়া। দুই আঙুলের সাহায্যে একটা একটা করে ক্লিপ খোলায় মনোযোগ দিল। অমনি দুটো হাত ধরে ফেলল শাদাব। বলল,
-‘আর কোনো টেকনিক জানা নেই? চুলে হাত দিচ্ছ কেন?’
-‘এগুলো তো তোমার বিরক্ত লাগে, তাই খুলে ফেলছি। এগুলোর জন্য তুমি আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা কোরো না। চুল স্ট্রেইট করি না বলে, সবসময়ই বোলো, আমার ফোলা ফোলা চুল পাখির বাসার মতো দ্যাখতে।’
কথা শেষ করে শাদাবের চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল মাহদিয়া। সময় ও সুযোগ পাওয়াতে এই ছেলে তাকে ইচ্ছেমতো দেখছে। যেভাবে তাকাচ্ছে, ওই দু’চোখে আজ শুধু মুগ্ধতা দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য! আগে তো কখনও এত গভীরভাবে তাকায়নি। তবে আজই কেন? তাকে অবাক করে দিয়ে শাদাব পালটা জবাব দিল,
-‘প্রতিটা মানুষের চোখের পর্দায় সৌন্দর্যের আলাদা আলাদা সংজ্ঞা ভেসে ওঠে। আমি রূপ, স্ট্যাটাস, ধন-সম্পদ দিয়ে সৌন্দর্যকে কোনোদিন বিচার করিনি। আগামীতেও করব না। আমার চোখে তুমি এমনই সুন্দর। এইভাবেই। সবসময়। তোমার এই এলোমেলো চুলটাই আমার ভালো লাগে। আমার কাছে সৌন্দর্যের সবচেয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত, তুমি।’
সময় শেষ হলো। পূণরায় বাঁশি বাজল। চমকে গিয়ে স্বাভাবিক হলো মাহদিয়া। সবাই করতালি দেয়া শুরু করল। মেয়েরা মাহদিয়াকে অভিনন্দন জানাল। সবকিছু সহজ ও সুন্দর হলেও পুরো ব্যাপারটা মাহদিয়ার কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হলো। বিশেষ করে শাদাবের কথাগুলো। শেষে কী বলল ছেলেটা? স্ব-জ্ঞানে বলল তো? না-কি লোকদেখানো? এক মিনিট দশ সেকেন্ড সময় ধরে শাদাব তাকে দেখছিল। খেয়াল হতেই আনন্দে তার সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরল। চোখমুখে অবিশ্বাসের ছাপ তুলে শাদাবের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
-‘ইয়াহু, জিতে গিয়েছি। থ্যাংক য়্যু, থ্যাংক য়্যু, থ্যাংক য়্যু সো মাচ্।’
শাদাব উত্তর দিল না। শুধু সামনে বসে থাকা বিজয়িনীর মুক্তোঝরা হাসি দেখল। সামান্য একটা খেলায় জিতে এত সুখ অনুভব হয়? এখনও তো পুরো খেলা বাকি! শেষ পর্যন্ত এই উপচেপড়া হাসি ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে রাখতে পারবে তো? কভু মুছে যাবে না তো? এই হাসিকে বাঁচিয়ে রাখতে, মনোযোগ দিয়ে খেলা উচিত তার। এইভাবে যদি দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে পুরো গেমটা জিতে নেয়া যায়, তবে জীবনভর তাকিয়ে থাকতেও কোনো বাঁধা নেই। নিয়তি দৃষ্টির আড়াল করেছিল বলেই, চোখে চোখ রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটা সাধারণ খেলা, কত সহজেই চোখের ভাষা দিয়ে দুটো মনকে এত কাছে নিয়ে এলো! শাদাব টের পাচ্ছে, ওই হাসিতেই তার ভেসে যাওয়ার শুরু হলো কেবল। এমন মোহমায়া জড়ানো হাসিতেই যেন এতদিনের দমবন্ধ করা, চারদেয়ালের ভেতরে আটকে রাখা অনুভূতির মরণ দেখতে পাচ্ছে সে। এমন যদি হয়, তবে এই মায়াবিনীর মন ভুলানো হাসিতে নির্ঘাত সে মারা যাবে। যেকোনো দিন, যেকোনো মুহূর্তে!
***
পরবর্তী খেলাটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু হলো। পুরুষদের চেয়ারে বসিয়ে রেখে পিছনদিকে সব মেয়েদের দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হলো। প্রত্যেককেই বুঝানো হলো, আঙুলের সাহায্যে সঙ্গীর পিঠে কিছু একটা শব্দ খেলার জন্য। চিরকুটে লেখা যে ইংরেজি শব্দ সেটাই লিখতে হবে। পুরুষেরা সেটা অনুমান করে বলবে এবং উত্তর দেয়ার সাথে সাথে মিলিয়ে দেখা হবে, তাদের আন্দাজটা ঠিক না-কি ভুল। এবারও বাঁশির আওয়াজ শোনে প্রত্যেকেই নিজেদের পার্টনারের পিঠে আঙুল দিয়ে কাগজে লেখা শব্দটা লিখতে শুরু করল। যার যার হাতে যেটা পড়ল সবাই সেটাই লিখল। কান্তা লিখল, হার্ট। নাদিয়া লিখল, ট্রাস্ট। মুনমুন লিখল, লাভ। তারিন লিখল, হানী। সিনথিয়া লিখল, সুইটহার্ট। মাহদিয়া যখন শাদাবের পিঠে নিজের ডানহাতের শাহাদত আঙুল রাখল, স্পর্শ পেয়েই নিজের দু’চোখ বন্ধ করে নিল শাদাব। অজানা বিস্ময়ের কারণে তার হৃৎপিণ্ড যেভাবে লাফাতে শুরু করেছিল, সে টের পাচ্ছি বুকপাঁজরে চিনচিনে এক ব্যথার আগমন ঘটেছে। বন্ধ চোখের কোণেই অনুভূতিরা লুটোপুটি খাচ্ছিল। একে একে প্রত্যেকটা শব্দ লেখা শেষ হলে যখন প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করা হলো, কী কী লেখা হয়েছে! কেউ কেউ উত্তর দিতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছিল। আবার কেউ কেউ সঠিক উত্তর দিচ্ছিল। শাদাবও মাহদিয়ার দিকে তাকিয়ে স্পষ্টকণ্ঠে বলল,
-‘এটা লাইফলাইন ছিল। রাইট?’
উপরনিচ মাথা নাড়ল মাহদিয়া। হাতের চিরকুটটা শাদাবকে দেখিয়ে বলল,
-‘খুব মনোযোগী হয়ে যাচ্ছ দ্যাখছি। এত সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করেছ! জিততে পারব?’
শাদাব চারপাশে তাকাল। এরমধ্যেই প্রত্যেকের প্রাপ্ত নম্বর লেখা শেষ। সবাই যে যার মতো আনন্দ-ফুর্তিতে ব্যস্ত। সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
-‘তুমি জিততে চেয়েছ!’
-‘আমি না চাইলে নিজে থেকে জিতবার আগ্রহ দ্যাখাতে না?’
-‘আগ্রহ থাকলেই কি সবার ভাগ্যে সব জিত আসে? সময় কখনও কখনও কারও না কারও সাথে ঠিকই বেঈমানী করে। আগ্রহ দিয়ে কিচ্ছু হয় না। ভাগ্যে কী আছে সেটা কি আর মানুষ আগে থেকে টের পায়, বোলো? যদি টের পেত, সব না পাওয়াকে নিমিষেই জয় করে ফেলত।’
এত গম্ভীর কথা দিয়ে শাদাব কী বুঝাল কে জানে! মাহদিয়া নিশ্চুপ রইল শোনে। কথা খুঁজে পেল না। মাঝে মাঝে কথারা হারিয়ে যায়। শব্দেরা ফুরিয়ে যায়। উপযুক্ত শব্দ ও বাক্যের অভাবে নীরবতাকেই আপন করে নেয় মানুষ। সে-ও নিল। শাদাব পূণরায় বলল,
-‘জীবন নিয়ে তোমার ও আমার অভিজ্ঞতা অনেক কম। কিন্তু সময় ও বাস্তবতা আমাদের অনেক কিছু বুঝতে শিখিয়েছে। তুমি কতটা বুদ্ধিমতী-বিচক্ষণ হয়েছ, সেটা আমি এখনও টের পাইনি, বুঝিনি। বুঝবার কোনো সুযোগ তৈরী হয়নি। অসময়ে যে ঝড় জীবনে এসেছিল, সেটার তাণ্ডব এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, অকূলে কূল হারানোর মতো পরিস্থিতি হয়েছিল আমার। অসুস্থ মা’কে নিয়ে সেদিন হয়তো পথেই বসতে হোতো। টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পদ, ধৈর্য্যশক্তি কিচ্ছু ছিল না। নিজেকে তখন ভিখারী মনে হচ্ছিল। চারপাশে শুধু অন্ধকার দ্যাখছিলাম। বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম, শিক্ষাগত যোগ্যতাও কম। দাঁড়ানোর মতো কোনো উপায়ও জানা ছিল না আমার। ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া আমি, অনেক কষ্টে এই অবধি এসেছি! এর পিছনের সম্পূর্ণ ক্রেডিট খালা, খালু ও ভাইয়ার। সবকিছুর পরেও আমি চেয়েছিলাম, কেউ একজন পাশে থাকুক, একান্তই আমার হয়ে! কিন্তু ভাগ্য, সেখানেও আমাকে এমনভাবে ধোঁকা দিল; এরপর আর সম্পর্ক নিয়ে পজেটিভ কোনো ভাবনাকেই মনে ঠাঁই দিতে পারিনি। শুধু চেয়েছি, দূরে থাকতে। যত দূরে থাকলে আপন মানুষদের থেকে দূরে থাকা যায়, তত দূরে থাকতে।’
জড়তার কারণে মাহদিয়া কিছু বলতেই পারল না। নিঃশব্দে কাঁদল। মানুষ কতটা অসহায় পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে নিজেকে ভিখারী ভাবতে পারে, সেসব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকলেও, শাদাবের মনের কোণে যে যন্ত্রণা লুকায়িত আছে তার পরিমাণ আন্দাজ করেই কাঁদতে বাধ্য হলো সে। স্বান্তনা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত শব্দেরও অভাব পড়ল। অব্যক্ত কথারা মনের ভেতর ভীড় জমালেও মুখ দিয়ে তা বেরিয়ে আসতে না পারার যন্ত্রণায় ভেতরেই আটকে রইল। দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল মাহদিয়া। সমস্ত রাগ-ক্ষোভ জমা হলো, কায়ছার সাহেবের ওপর। ওই মানুষটাকে সে ছাড়বে না। কোনোভাবেই না।
***
-‘আমাদের এবারের আয়োজনে থাকছে চোখে রুমাল বেঁধে, হাতের স্পর্শে নিজেদের পার্টনারকে খুঁজে বের করা। সব মেয়েদের চোখ বেঁধে দেয়া হবে। প্রত্যেকেই ‘কানামাছি’ খেলার মতোই হাতড়ে কিংবা ছুঁয়ে নিজেদের সঙ্গীকে খুঁজে বের করবে। আমাদের আজকের আয়োজনের এটাই ফাইনাল রাউন্ড। এই রাউন্ডের মাধ্যমেই খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।’
হৈ হৈ শব্দ শুরু হলেও মাহদিয়া ও শাদাব দু’জনেই নীরব। এটাতে জেতা অসম্ভব। দু’জনের কেউ-ই এতটা কাছাকাছি আসেনি, যতটা কাছে আসলে হাতের স্পর্শে সঙ্গীকে চিনে নেয়া যাবে। দুঃশ্চিন্তায় গলার পানি শুকিয়ে গেল মাহদিয়ার। এতক্ষণ জিতে গেলেও এবার যে নিশ্চিত হারবে, গ্যারান্টি। সে চিন্তিত মনেই হোটেল কতৃপক্ষের কাছে জানতে চাইল,
-‘আর কোনো খেলা নেই? আই মিন, এটা ছাড়া! এটা কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু না। অ্যাকচুয়ালি, আমি অন্য কোনো পুরুষকে ছুঁতে পারব না। ছুঁতে চাইছিও না। আমার জন্য এটা ভীষণ অস্বস্তিকর ও অপ্রীতিকর। আমাকে এই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দিয়ে দিন। আই কান্ট!’
চোখ বন্ধ করে খুঁজতে হবে এই নিয়ে মাহদিয়ার সমস্যা না থাকলেও, অন্য পুরুষকে ছুঁয়ে শাদাবকে খুঁজতে হবে, চিনতে হবে, এখানেই তার আপত্তি। যেখানে সে কখনও, কোনো পুরুষ মানুষের দিকে স্বস্তিতে তাকায়নি, সেখানে ছোঁয়াছুঁয়ি! অসহ্য। সেদিন তো শাদাবকেও তার অচ্যুত মনে হয়েছিল। নিজের মন ও বিবেকের কাছে সৎ থাকতে কতদিক ভেবে, বুঝে পা ফেলে এসেছে সে। জীবনের এতগুলো বছর অভিমানী অপেক্ষায় দিন কাটিয়েছে। ফিরে এসে তাকে চিনতে, অন্য পুরুষকে ছুঁয়ে পরীক্ষা দিবে! জিতবার দরকার নেই তার, তবুও মনে কোনোপ্রকার অহেতুক ভাবনা না আসুক। তাই নিজের দিক ভেবেই সে প্রতিযোগিতা থেকে নিজের নামটাই সরিয়ে ফেলতে চাইছে। সবাই তখন মুখ চাওয়া-চাওয়িতে ব্যস্ত হওয়ায় শাদাব নিজেই তাকে ভরসা দিতে বলল,
-‘এটা শুধুই একটা গেম। আর কিছু না।’
-‘তবুও আমি পারব না।’
-‘তুমি জিততে চাও না?’
-‘এইভাবে না।’
-‘তবে? কীভাবে?’
-‘আর কোনো গেম দিতে বোলো! যা দিবে তা-ই খেলব। এটা পারব না। প্লিজ…!’
মাহদিয়ার অনুনয়-বিনয় দেখে কর্তৃপক্ষ এই খেলাটা প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে নিল। অন্য একটা খেলার নাম রাখল। নিয়ম হলো, এবার সব মেয়েদের চোখ বেঁধে দেয়া হবে। এবং হাতে একটা লাঠি ধরিয়ে দেয়ার পর তারা লাঠির সাহায্যে হাড়ি ভাঙতে যাবে। ছেলেরা পিছনে দাঁড়িয়ে শুধু উৎসাহ দিতে পারবে, বাড়তি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে না। এই গেমের নাম শোনে খুশি হলো মাহদিয়া। সহজেই সেটা মেনে নিল। একজন, একজন করে সব মেয়েরাই হাড়ি ভাঙতে গেল। প্রথমেই কান্তা চোখ বন্ধ করে হেঁটে হেঁটে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে হাড়ি ভেঙে ফেলল। পরবর্তীতে নাদিয়া এগোলেও সে হাড়ি ফেলে রেখে চলে গেল দূরে। ভাঙা তো দূর, ছুঁতেও পারল না। মুনমুন কাছাকাছি গিয়েও ভুল জায়গায় লাঠি দিয়ে আঘাত করল। ফলস্বরূপ অল্পের জন্য হেরে গেল সে। তারিন চোখে কাপড় বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে শেষপ্রান্তে গিয়ে হাড়িতে একটা জোরসে আঘাত করল। সিনথিয়া লাঠি হাতে এমন আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে যাচ্ছিল, তার হাঁটা ও যাওয়ার গতি দেখে সবাই হাসতে হাসতে শেষ। মাহদিয়াও চোখে কাপড় বেঁধে ভয়ে ভয়ে এগোল। এই ধরনের খেলায় সে আগে কোনোদিন অংশগ্রহণ করেনি। কতটা পারবে কে জানে! সাহস নিয়ে এগিয়ে তো গেল। এক’পা, দু’পা এগোতেই তার হোঁচট খাওয়ার দশা। শাদাব পিছন থেকে তার সাহস ও মনোবল বাড়ানোর জন্য খানিকটা চিৎকার করেই বলল,
-‘ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। তোমাকে জিততেই হবে এমনটা নয়! হারলেই যে সবকিছু থেকেও নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, এমন অহেতুক যুক্তিকে মাথায় জায়গা দিও না। নিজের ওপর কনফিডেন্ট রাখো। এইটুকুই তোমাকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।’
কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যাবে, এমন অনুভূতি হচ্ছিল মাহদিয়ার। তবুও কষ্ট করে হেলতে-দুলতেই এগিয়ে গেল। এক সময় পায়ের গতি কমিয়ে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। যা হয় হবে, এইভেবে লাঠি দিয়ে বেশ জোরেই একটা আঘাত করল। অমনি মাটির পাতিল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। চোখের বাঁধন খুলে মাহদিয়া বিস্ময়ে থ! চোখ বাঁধা অবস্থায় কোনোকিছু টার্গেট করা যে কত কঠিন, সেটা উপলব্ধি করেই জান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হচ্ছিল তার। এখন চোখ খুলে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিল। এই গেমের যে তিনজন হাড়ি ভেঙেছে, এবার সেই তিনজনকে নিয়েই আলাদা একটা গেম হবে। যেহেতু তিনজনে সমানভাবে হাড়ি ভেঙেছে, তাই তাদেরকে একসাথে আবার সুযোগ দেয়া হলো। এখান থেকেই যাদের পয়েন্ট বেশি হবে, সে-ই দম্পতি-ই হবে আজকের বিজয়ী।
***
হাতে সুঁই নিয়ে সেটার চিকন ছিদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে মাহদিয়া। জিততে গেলে এখন কি-না তাকে সুঁইয়ের ছিদ্রে সুতো ঢুকাতে হবে। এত চিকন ছিদ্র দিয়ে সুতো ঢুকবে? যত বেশি কৌতূহল তারচেয়েও বেশি ভয় কাজ করছে মনে। কান্তা ও তারিন মিটিমিটি হাসছে। মাহদিয়া যেভাবে সুঁইয়ের দিকে তাকাচ্ছে, যেন এটা সুঁই না তিব্বতের ওই বরফ শীতল হিমালয় পর্বত। এটা জয় করা অসম্ভব! তার এই দুঃখী দুঃখী চেহারা দেখে তারিন বলল,
-‘কী মনে হয়? এটা খুব বেশি কঠিন? সুতোয় সুঁই ভরতে পারে না, এমন মেয়ে আছে না-কি!’
মাহদিয়া তখনও গভীর চোখে সুঁইয়ের ছিদ্রটা দেখছে। ছোটোবেলা পুতুল পুতুল খেললেও, সুঁই সুতো নিয়ে কোনো খেলা সে খেলেনি। ইতালিতেও এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। এখন কি-না এটা সবার আগে ঢুকাতে হবে! ভাবতেই তো নিজেকে চরম অসহায় মনে হচ্ছে তার। তারিনের এই কথা যেন তার হেরে যাওয়ার আগাম একটা সুক্ষ্ম তাচ্ছিল্য ছিল। সে তার জবাবে মুচকি হেসে বলল,
-‘কঠিন কি-না জানি না, তবে অসম্ভবও নয়। কখনও সুঁই সুতো নিয়ে খেলিনি। তাই ভাবছিলাম, এটার ছিদ্র এত ছোটো কেন!’
তারিন ও কান্তা হো হো করে হাসতে শুরু করল। সুযোগ পেয়ে এবার কান্তাও বলল,
-‘আরেহ্ বোকা, ছোটো ছোটো সুঁইয়ের ছিদ্র তো ছোটোই হয়। সুঁই এরচেয়েও বড়ো আছে। কিন্তু সহজেই যেন সুতো ভরতে না পারো এইজন্যই এই চিকন সুঁই। আমার অবশ্য অভ্যাস আছে। কেন, তোমার নেই? তুমি যেভাবে সুঁইয়ের দিকে তাকাচ্ছ, সেটা দ্যাখেই বুঝা যাচ্ছে, সুঁই তুমি জীবনেও দ্যাখোনি।’
দু’দিকে মাথা নাড়ল মাহদিয়া। বলল,
-‘আগ্রহ জন্মায়নি কখনও।’
-‘ওহহো। তাহলে তো এটা তোমার জন্য কঠিনই। আগ্রহ না জন্মালেও বাঙালি মেয়েরা এসব কাজে এমনিতেই অভ্যস্ত। তুমি শুধু নামেই বোধহয় বাঙালি। কাজে নও। তোমার পোশাক-আশাক ও কথাবার্তাতে তোমাকে বাঙালি মনে হলেও বাঙালি মেয়েদের মতো কোনো গুণ তোমার মাঝে নেই। চুলও যেমন এলোমেলো, তোমার কাজও তেমন এলোমেলো-ই।’
অল্প সময়ের দেখা-সাক্ষাতে কারও সম্পর্কে এরূপ ধারণা মনে পোষণ করা অনুচিত। হুট করে কান্তা ও তারিন যেন তাকে একটু বেশি-ই খোঁচাচ্ছে। এমন কথার পিঠে কথা না বলাই শ্রেয়। নিজের ড্রেসাপ ও গুণাগুণ নিয়ে সে যথেষ্ট খুশি। আর কোনো বাড়তি গুণের দরকার নেই তার। যেসব গুণ, অন্যকে ছোটো করতে মনের ভেতর ভুল ভাবনার জন্ম দেয়, সেসব অদ্ভুত গুণের কোনো প্রয়োজন নেই। সে যেমনই আছে, তেমনই ঠিক। এই গেমটা কঠিন হোক কি সহজ, সে শুধু জানে তাকে এই গেমে জিততে হবে। বিড়বিড়িয়ে দোয়াদরুদ জপতে শুরু করল সে। আড়চোখে শাদাবকেও দেখল। অন্যদের সাথে আড্ডা দিতে বসলেও কয়েক হাত দূর থেকে শাদাব তাকেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই ইশারা করল শাদাব। জানতে চাইল, ‘ইজ এ্যানিথিং রং?’ দূরে থেকেও অস্পষ্ট সেই শব্দ, বাক্য বুঝতে পারল মাহদিয়া। জবাবে শুধু মুচকি হাসল। আঙুল তুলে ‘বেস্ট অব লাক’ বলল শাদাব। তাতেই সমস্ত মন ও শরীরে সাহস ফিরে পেল সে। জিতবার আগ্রহ বাড়ল। কর্তৃপক্ষ জানতে চাইল,
-‘মেয়েরা কি প্রস্তুত?’
আত্মবিশ্বাসের সাথে হ্যাঁ’বোধক শব্দ উচ্চারণ করল সবাই। সময় শুরু হলো। এক, দুই, তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে যার যার সুঁইয়ের ছিদ্রে সুতো ভরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়েরা। মাহদিয়া সুতোটা ঢুকাতে গিয়েও পারছে না। এইদিক থেকে ওইদিক চলে যাচ্ছে। বিরক্তি হয়ে বিড়বিড় করল,
-‘এত দেরী করছিস কেন? ঢুকে যা না। না ঢুকলে ফ্রিতে ট্যুরে আসার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। তুই বুঝতে পারছিস না, আমি এখানে আবারও আসতে চাইছি। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে থাকা অদৃশ্য দেয়ালটা সরিয়ে দে না, প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’
সুঁই সুতো যদি শব্দ করতে জানত, মানুষের মনের কথা শুনতে ও বুঝতে পারত, তবে মাহদিয়ার এমন কথা শোনে তারাও অট্টহাসি দিত। হতাশ হয়ে বাকি দু’জনের দিকে চোখ রাখল মাহদিয়া। ওরাও পারছে না দেখে ঠোঁটমুখ শক্ত করে সুঁই ঢুকাতে চাইছে। দু’জনকে দেখলেই বুঝা যাচ্ছে, আর কিছুক্ষণ পর এরা সুঁইয়ের সাথে কুস্তি শুরু করবে। তাদের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে ভ্রু কুঁচকে নিল মাহদিয়া। আনমনেই আওড়ে গেল,
-‘সুঁই এইভাবে ধরে?’
তার বিড়বিড় শব্দ কেউ শুনল না। হতাশাকে সঙ্গী করে আবারও ছিদ্রটাকে লক্ষ্য করে সুতো ভরতে গেল। তখনই খেয়াল করল, সুতোর একদিকের অংশ বেশ এলোমেলো হয়ে আছে। মাথার অংশটা সূঁচালো না হওয়াতেই এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। ঠোঁট গোল করে সামনে থাকা টেবিল থেকে কাঁচি তুলে নিয়ে ফট করে সুতোর মাথাটা কেটে ফেলল। এরপর খুব সূক্ষ্মদৃষ্টিতে সুঁইয়ের ছিদ্রে সুঁই ভরতে গেল। এবার আর মিস হলো না। সহজেই সুঁইয়ের ওই ছোট্ট প্রবেশপথ দিয়ে সুতো ঢুকে গেল। আনন্দে, বিস্ময়ে চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠল মাহদিয়া। কণ্ঠে একরাশ উচ্ছ্বাস, সুখ ও আবেগ মিশিয়ে বলল,
-‘হেই শাদাব, লুক, ইট’স ওভার।’
হাসিমুখেই তাকে অভিনন্দন জানাল শাদাব। তার কাজ ও চেষ্টাকে সম্মান করে বলল,
-‘নিয়্যাত অনুযায়ী ফল পাওয়া যায়। তোমার নিয়্যাতটা নিশ্চয়ই সৎ ও পবিত্র ছিল, তাই পেরেছ। কিছু কিছু কাজে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আত্মবিশ্বাস যতটা জরুরী ততটা জরুরী সৎ চিন্তাভাবনা।’
নিজের ভাবনা ও কাজে মাহদিয়া শুধু চেয়েছিল, আবারও এখানে আসতে। পবিত্র সম্পর্কটাকে আগলে বাঁচতে। হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারছে না, কিন্তু মন তো এটাই চায়। তবে শাদাব কেন এটা বলল, সেটা সে বুঝল না। আনন্দে তার সর্বাঙ্গ খুশিতে ঝলমল করে উঠল। তার ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে থাকা হাসিটা তখন, দেখার মতোই ছিল। মাহদিয়ার এই আনন্দ ও হাসি দেখে বাকি দু’জন মেয়ে ভ্রু বাঁকাল। খানিকটা হিংসাও হলো তাদের। যে মেয়ে সুঁই ধরেনি কোনোদিন, সে পেরে গেল! আর যারা সুঁই-সুতোর কাজ করে অভ্যস্ত তারা পারল না। নিজেদের এই হার যেন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সেই কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে গেল। যখন কতৃপক্ষ ঘোষণা করল,
-‘প্রত্যেকটা গেম ও পয়েন্টের ভিত্তিতে আমাদের আজকের এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী দম্পতি হচ্ছেন, শাদাব ও মাহদিয়া জুটি। অভিনন্দন আপনাদের। নেক্সট ট্যুরে ‘গ্রান্ড সুলতান’ আপনাদের অপেক্ষায় থাকবে। দ্যাখা হচ্ছে আবারও।’
খুশি আটকে রাখতে পারল না মাহদিয়া। ‘ইয়া আল্লাহ্’ বলেই মুখে হাত দিয়ে হাসতে লাগল। সে হাসছে, কিন্তু চোখের কোণ চিকচিক করছে। জিতে তো গেল, আগামীর ট্যুরটা কি হবে! অজানা ভয় ও আগামীর দুঃশ্চিন্তা সরিয়ে মুহূর্তটা উপভোগ করার চেষ্টা করল। নাদিয়া, মুনমুন ও সিনথিয়া তাকে অভিনন্দন জানাতে জড়িয়ে ধরলেও, কান্তা ও তারিন হিংসায় জ্বলেপুড়ে গেল। দু’জনার ঠোঁটে লোকদেখানো হাসি ও মনে হাজারও ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা। শাদাব একনজর মাহদিয়ার হাসি দেখল, আবার ওই দু’জনের চুপসানো মুখ দেখল। কয়েক মিনিট আগেই মেয়ে দুটো মাহদিয়ার সুঁই ধরার ধরন ও অসহায় চেহারা দেখে মজা নিচ্ছিল। মাহদিয়া যে মনে মনে কিছু একটা বিড়বিড় করছিল, সেটা দূর থেকেই খেয়াল করছিল শাদাব। তার ঠোঁটের নড়চড়ই বলে দিচ্ছিল, মেয়েটা ভয়ে প্রার্থনা করছে। মাহদিয়ার এই জয় নিশ্চিত হওয়ার পর ওই দু’জনের মুখের ভাবভঙ্গি তাকে নিশ্চিত করল, এরা ইচ্ছে করেই তার স্ত্রীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিল। কিন্তু ওইযে, নিয়্যাত ও মনের শুদ্ধতা। জয় বোধহয় কখনও কখনও এই কারণেই হয়! সে আগ বাড়িয়ে মাহদিয়ার কাছে এলো। সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে একটা হাত আঁকড়ে ধরল। বলল,
-‘কখনও কারও কোনো নেগেটিভ কথাবার্তাকে মনে জায়গা দিও না। ডানে-বামে খারাপ মানুষ যেমন আছে, ভালো মানুষও আছে। বন্ধু হোক কি শত্রু, কেউ তোমাকে ছোটো করতে চাইলেও তুমি নিজে থেকে কখনও কাউকে আঘাত কোরো না। মন ও মুখকে সবসময় শুদ্ধ রেখো। জীবনে পাওয়ার অংক পরিমাণে কম হলেও সুখটা তখন আকাশছোঁয়া মনে হবে।’
***