#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — বাইশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
সন্তান যখন অসুস্থ হয়, একজন মা তখন দিশেহারা অবস্থায় পড়ে যায়। তার সেবাযত্ন করা, তাকে সুস্থ করার কত-শত চেষ্টা দিয়ে দিনরাত নিজেকে সন্তানের সেবা-যত্নে নিয়োজিত রাখে। সন্তানের সুস্থ মুখের হাসি একজন দিশাহীন মায়ের সারাদিনের প্রশান্তি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু একজন মা অসুস্থ হলে সন্তানের মনের অবস্থা কেমন হয়? যদি সে হয় বেকার, অবুঝ ও সহায়-সম্বলহীন এক পথহারা পথিক! যার নিজেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকে না, সে তো অসুস্থ মা’কে নিয়ে অথৈজলে ভেসে যায়! কৈশোরের ওই সময়টায় শাদাবের অবস্থাও ঠিক একইরকম ছিল। মা’কে সুস্থ করে সাওদা করীমের বাসায় ওঠার পর তার মাথায় একটাই চিন্তা খেলা করছিল, যে করেই হোক একটা চাকরি তার দরকার! অসুস্থ মায়ের দায়িত্ব নেয়া দরকার! রোজগারের পথ খুঁজে না পেলে পেটে ভাত জুটবে কী করে? কতদিন পরের অধীনে থাকবে? কতদিন ঋণের বোঝা বাড়াবে? ঋণ করে কি আর সুখী জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়? একটা চাকরির জন্য, কাজের জন্য ওইটুকু বয়সে সবার চোখের আড়ালে রাস্তায় নেমেছিল শাদাব। অন্তত মায়ের চিকিৎসার খরচটা যোগাড় হলে, আর্থিক কিছু সহযোগিতা হবে এইভেবে। তখন সাওদা করীম কিংবা নাবহান, কেউ তাকে কিছু না বললেও নিজের বুদ্ধি ও অবুঝ বয়সের ভাবনা দিয়েই টাকা উপার্জনে নামবার উৎস খুঁজছিল সে। তখনও তার এসএসসি’র রেজাল্ট আসেনি। কোথাও ভর্তি হওয়ার তাড়া ছিল না। তাই ওই সময়টায় টাকা উপার্জন করবে বলেই মনস্থির করেছিল শাদাব। সকলের অগোচরে নেমে এসেছিল রাস্তায়। ফুটপাত থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা ছোটোবড়ো কাজের ধরন দেখে মালিকদের কাছে কাজ চেয়েছিল। কিন্তু বয়স ও অভিজ্ঞতা কম বলে কোথাও কোনো কাজ পাচ্ছিল না সে। প্রখর রোদে রাস্তার ব্রেঞ্চে বসে কর্মব্যস্ত মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা দেখে ভাবতে লাগল ঠিক কী কাজ করবে! সেখানে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে পথশিশু, হকার, টোকাই, সব মানুষের সব ধরনের কাজের মতিগতি দেখে ও আয়-ইনকামের অংশ দেখে বাজ পড়েছিল মাথায়। দিনরাত পরিশ্রম করেও পকেটে টাকা আসে তিন থেকে চারশো। কারও কারও পাঁচশো কিংবা ছয়শো। টাকার পরিমাণ অল্প হলেও তারও আগ্রহ জন্মায়, এইরকমই ছোটোখাটো একটা কাজ করে, মায়ের হাতে কিছু টাকা দিতে পারলে, প্রতি মাসে মায়ের চেক-আপ ঠিকমতো হবে, এইভেবে। ডাক্তার কত সাবধানে থাকতে বলেছিলেন সায়রা করীমকে। তাই মায়ের সুস্থতা ও চিকিৎসার দিক ভেবে, প্রত্যেকটা স্টেশনে ঘুরেঘুরে দেখেছিল, মানুষ কীভাবে দিনমজুরী করে, কীভাবে স্টেশনের কোণে দাঁড়িয়ে হকার সাজে, কীভাবে ফুল হাতে নিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে মাঝরাস্তায় নেমে পড়ে। সবকিছু দেখেশোনে একদিন সায়রা করীমকে বলেছিল,
-‘মা আমি কাজে নামি?’
সায়রা করীম সেদিন যেন আকাশ থেকে পড়েছিলেন। অল্প বয়সে কী কাজ করবে এই ছেলে! খাবার খেতে বসেও গলা দিয়ে ভাত নামছিল না তাঁর। হতবাক কণ্ঠে জানতে চেয়েছিলেন,
-‘কী কাজ করবি? কে দিবে কাজ তোকে?’
-‘ফুল বিক্রি করব, নয়তো ফুটপাতে একটা চায়ের দোকান দেব। টাকা না হলে, তোমার চিকিৎসা করাব কী করে?’
সেখানে পরিবারের বাকি সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। নাবহান জানত, এই ক’দিন শাদাব কোথায় কোথায় গিয়ে কাজ খুঁজেছে। না পেয়ে হতাশ হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। বেশ কয়েকটা মুদি দোকানেও কাজের আশায় গিয়েছিল। কিন্তু কেউ তাকে ছোটোখাটো কেন, সামান্য একজন সাহায্যকারী হিসেবেও কাজ দেয়নি। উলটে একজন নাবহানের কাছে নালিশও দিয়েছে। বলেছে, ‘ওইরকম মোটা শরীর নিয়ে সে তো ঠিকমতো নড়তে-চড়তেও পারে না, কাজ করবে কী! এই ছেলেকে দোকানে রাখলে, একাই সব খেয়ে শেষ করে ফেলবে। লাভ তো হবেই না, আমার দোকানের সব খাবার ওর পেটে যাবে।’ নাবহান খুব অপমানবোধ করছিল তখন, শাদাব কাজ খুঁজতে গিয়েছে এইজন্য নয়। অবুঝ বাচ্চাটাকে লোকটা ওর স্বাস্থ্য ও খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিয়েছিল দেখে। এসব নিয়ে সে আর বাড়িতে কোনো আলোচনা করেনি, ভেবেছে শাদাব আর কাজ খুঁজতে যাবে না কোথাও। কিন্তু তা আর হলো কই! মানুষের গালমন্দ শোনেও হন্নে হয়ে এই বয়সে কাজের আশায় ছুটেছে। আদৌ, মানুষ তাকে তারমতো করে বুঝবে তো?
খাবার টেবিলে এই কথা শোনে নাবহানের রাগ চড়ে গেল মাথায়। বলল,
-‘তোর কাজের এত তাড়া কেন? এই বয়সে কী কাজ করবি তুই? আমাকে দ্যাখ্, অনার্স ফার্স্ট ইয়ার মাত্র। যা কয়েকটা টিউশনি করি তা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে পারি। আমাকেই তো কেউ কাজ দিবে না। তুই কোথায় কাজ পাবি?’
মনমরা মন নিয়ে শাদাব উত্তর দিয়েছিল,
-‘কিন্তু এভাবে থাকলে চলবে? মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে না? আমার চেয়েও ছোটো ছোটো বাচ্চারা ফুটপাতে কাজ করে! সংসার চালায়। আমি কেন পারব না?’
নাবহান তার পাশে বসে, পরম আদর ও মমতার সাথে বুঝিয়ে বলেছিল,
-‘কথাটা পারা না পারা নিয়ে নয়! মানুষ চাইলে সব পারে। যখন মাথার উপর ছাদ থাকে না, তখন মানুষ কাজের আশায় ফুটপাতেও নামে। এখন তোর মাথার উপর ছাদ আছে। বাবা আছেন, আমি আছি। আমরা যতদিন আছি, ততদিন তোকে কোনো কাজ করতে হবে না। তখনই রোজগার করবি, যখন পর্যাপ্ত বয়স ও অভিজ্ঞতা হবে। এখন যদি কাজে নামিস, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবি না। ভালো মানুষ হতে পারবি না। দায়িত্ব ও কর্তব্যের যাতাকলে পড়ে স্বপ্ন পূরণের দ্বার থেকে ছিঁটকে পড়বি। তাই বলছি, মাথা থেকে ওসব ভূত তাড়িয়ে পড়াশোনায় মন দে। ভালো রেজাল্ট না করলে, মেডিক্যালে অ্যাডমিশন হবে না কিন্তু।’
যার বসতবাড়ি নেই, তার আবার বড়ো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা। আগে যাহোক, স্বপ্ন পূরণের আশা ছিল। এখন তো সেই আশা জলে ভেসে গিয়েছে। তাই আর এত বড়ো বড়ো ডিগ্রী অর্জনের স্বপ্নও সে দেখতে পারছে না। এগোনোর কোনো পথই যে আর খোলা নেই। কীভাবে এগোবে? নাবহানের কথার উত্তরে বাচ্চামো কণ্ঠে বলল,
-‘মেডিক্যাল অ্যাডমিশন, বড়ো বড়ো ডিগ্রী, এসব অর্জন করতে যে অনেক টাকা লাগবে। এত টাকা কোথা থেকে আসবে? আমি আর পড়তে চাইছি না। এখানেই থেমে যাওয়া ভালো।’
-‘এক্ষুণি হাল ছেড়ে দেয়ার দরকার নেই। কষ্ট করে আরও দুটো বছর এগো। আল্লাহ্ চাইলে সব হবে। আমি আছি তো। তোর সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার। খালামনিকে নিয়ে টেনশন করিস না। ট্রিটমেন্ট হবে। আগামীর দিনগুলোও সুন্দর হবে। তুই শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববি, আর এটা ভাববি যে, উপযুক্ত হওয়ার পর কীভাবে এতসব অন্যায়ের জবাব দিবি।’
এরপরও শাদাব চেষ্টা করত, কাজ খুঁজত, কিছু একটা কাজ হলে অল্প হলেও টাকা হাতে আসবে। একেবারে শূণ্য পকেটে আর কতদিন! একবার সায়রা করীমের ঔষধ কেনার জন্য মনস্থির করেছিল, হাতে থাকা ‘নোকিয়া সি’টু’ মডেলের বাটনের ফোনটা বিক্রি করে দিবে। কিন্তু এটাতে শায়লা সুলতানার ফোন আসে। মাহদিয়ার সাথে কথা হয়। বিয়ের দিনের বেশকিছু ছবি ছিল এতে। বিক্রি করে দেয়া মানেই ছবিগুলো হারিয়ে ফেলা। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া। যদিও বাড়িতে বাড়তি ফোন আছে, কিন্তু তবুও এই ফোনটা কোনো এক অজানা কারণে বিক্রি করতে পারছিল না শাদাব। ঔষধ শেষ এটাও বোনের কাছে বলতে পারছিলেন না সায়রা করীম নিজে। লজ্জা ও সংকোচের কারণে চুপ হয়ে থাকতেন। মায়ের অসুস্থতা ও তার মনের অবস্থা বুঝেই একদিন দিনমজুরীর কাজে নেমেছিল সে। নাবহান সেই দৃশ্য দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিল, পরবর্তীতে বাড়ি এসে একগাদা কাজ ও নায়রাকে তার কোলের ওপর দিয়ে বলেছিল,
-‘সারাদিন খালামনির কাছে থাকবি, নায়রাকে সামলাবি, মায়ের কাজে সাহায্য করবি। তবুও কাজের বাহানায় বাইরে যেন না দ্যাখি তোকে।’
আমতা আমতা স্বরে শাদাব বলেছিল,
-‘মায়ের ঔষধ আনতে গিয়েছিলাম।’
-‘ঔষধ শেষ, সেটা আমাকে বলা যাচ্ছিল না? ফেরার পথে নিয়ে আসতাম। কী করে এমন একটা কঠিন কাজের দিকে হাত বাড়ালি তুই? একগাদা রডের ওজন জানিস কত? যদি গায়ের ওপর পড়ত, বেঁচে থাকতি? ওখানেই লাশ হয়ে পড়ে থাকতি।’
ওইটুকু কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল শাদাব। দুটো হাতে ফোসকা পড়েছিল। মায়ের আদর-শাসনে বড়ো হওয়া সন্তানের এরূপ অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন সায়রা করীম। সমস্ত রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা জমা হচ্ছিল কায়ছার সাহেবের প্রতি। সেদিনের পর আর কোনোদিন কাজের নাম মুখে নেয়নি শাদাব। নাবহানের বকাঝকা খেয়ে পড়াশোনাতেই মনোযোগ দিয়েছিল। যেভাবে ধমক-ধামক দিত, ভয়ে সে কেঁপে উঠত। কখনও শাসন করত, বকত, আবার দিনশেষে আদর করে বুকে টেনে নিত। পড়াশোনা ও ছোট্ট নায়রা হয়ে যায় শাদাবের সারাদিনের সঙ্গী। সে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে স্বপ্ন পূরণের পথে। পাশে পায় একজোড়া বিশ্বস্ত হাত। যে হাতের জন্যই আজ সে নামি-দামি ডাক্তার হতে পেরেছে। নিজের একটা পরিচয় ও মায়ের জন্য একটা মাথাগোঁজার ঠাঁই তৈরী করতে পেরেছে। নাবহান পাশে না থাকলে, এইপথে হেঁটে এত দামী সার্টিফিকেট অর্জন করা কঠিন হয়ে যেত। হয়তো হতোই না। আজ সে কোনো এক ফুটপাতের হকার কিংবা কোনো এক দোকানের চা-বিক্রেতাই থেকে যেত।
-‘তোমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, না? বড়ো মামার ওপর রাগ হয় না এসবের জন্য?’
পুরনো সব কথা মনে হলে বুকছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। এসব আজ মনে পড়ত না, শুধু মাহদিয়া জানতে চেয়েছিল বলেই পুরনো স্মৃতিকে পূণরায় তাজা করে রক্তক্ষরণ বাড়ানো। ‘সাতছড়ি’ প্রবেশের পরই নিজের ছেলেমানুষী জেদ থেকে সায়রা করীম ও তাদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা জানতে চায় মাহদিয়া। শিহাবকে হায়দার সাহেবের সাথে সামনে পাঠিয়ে তারা দু’জন পিছনে থেকেই গল্প করতে করতে হাঁটছিল। হাঁটার মাঝেই প্রশ্ন করল মাহদিয়া। শাদাব বুকফাটা আর্তনাদকে লুকিয়ে বলল,
-‘রাগ হয় না, ঘৃণা হয়! আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না, উনি আমার বাবা। একটা সময় আমি ওনাকে যতখানি ভালোবাসতাম, এখন ততখানি-ই ঘৃণা করি। ছোটোনকে বলতেও ভয় লাগে, বাবা নামক জঘন্য মানুষটা আজও বেঁচে আছেন। আমি চাই না, আমার মতো ঘৃণা ও বুকভরা যন্ত্রণা নিয়ে বড়ো হোক ও। আপন মানুষটাকে ঘৃণা করে বাঁচা অনেক কঠিন। দিনদিন যে কঠিন মুহূর্তকে ফেইস করে চলেছি, সেটা ছোটোনকে কোনোপ্রকার ধাক্কা দিক, এটা চাই না বলেই, এই শহরের নামটাও মুখে নিই না। আমি ভুলে যেতে চাই ওই মানুষটাকে, সবসময়ের জন্য। হয়তো সম্ভব নয়, তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু পারছি না।’
মাহদিয়া তার কষ্ট বুঝে একটুখানি ভরসা হতে আলগোছে আঙলের ফাঁকে আঙুল আটকাল। শাদাব ভ্রু নাচিয়ে তাকাতেই দু’দিকে না’বোধক ইশারা করে কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
-‘একদম বকবে না। ছোটোন কিচ্ছু দ্যাখছে না। বেশি রাগারাগি করলে আন্টির কাছে নালিশ করব। ভাইয়া আর ভাবীকে দিয়েও বকা খাওয়াব।’
শুকনো কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল শাদাব। বলল,
-‘ভাইয়া-ভাবীকে কিন্তু আমি ভয় পাই না, তাই ওসব বলে অযথাই আমাকে ভয় দ্যাখানোর চেষ্টা কোরো না। আমি তাদের দু’জনকে শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি, তাই তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করি। উল্টোপাল্টা না বকে দূরে থেকে হাঁটো।’
দূরে যাওয়ার নামও নিল না মাহদিয়া। উলটে তাকে নাজেহাল করতে বলল,
-‘আমি ফিরে আসাতে তুমি খুশি হওনি?’
-‘আমার খুশি হওয়া না হওয়াতে কী আসে যায়! দিনশেষে তুমি ঠিকই চলে যাবে। কারণ একটা অপশন বেছে নেয়া অসম্ভব। সেটা তুমি কোনোদিনও পারবে না। প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে তার মা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। মায়ের মতো দ্বিতীয় কেউ হয় না।’
খানিকটা চমকাল মাহদিয়া। শাদাব নিশ্চিত, সে চলেই যাবে। তাকে তাড়িয়ে দিতেই এত কঠিন একটা অপশন দিয়েছে ছেলেটা। নয়তো মা ও মেয়েকে কেউ আলাদা করতে চায়! বড্ড অভিমান জন্মাল তার। বলল,
-‘তার মানে তুমি চাও, আমি চলে যাই? আমার জীবনে তোমার প্রয়োজন থাকলেও তোমার জীবনে আমার কোনো প্রয়োজনই নেই। এই কারণেই কোনো যোগাযোগ রাখোনি তুমি।’
শাদাবের ইচ্ছে হলো সে-ও বলুক, ‘তোমাকে আমার ততটাই প্রয়োজন, যতটা প্রয়োজন তৃষ্ণার্ত মরুর বুকে একপশলা বৃষ্টির।’ কিন্তু বলতে পারল না। সে তো যোগাযোগ করেছিল, কতবার, কতদিন, কত মুহূর্ত। একবার কথা বলার জন্য, একটা ছবির জন্য, সম্পর্কটাকে বাঁচাবার জন্য, প্রতি সপ্তাহ, প্রতি মাস, এমনকি প্রত্যেকটা দিন ছটফট করেছিল। অথচ শায়লা সুলতানা দিনরাত তাকে ভুলিয়েছেন! কত-শত অপমান, গালিগালাজ, তর্কবিতর্ক, কিচ্ছু ভুলেনি শাদাব। ভুলবেও না কোনোদিন। সেসব কথা এড়িয়ে গিয়ে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের হিসাব বুঝাতেই বলল,
-‘বার বার বলছ, আমি যোগাযোগ রাখিনি। মানছি, আমি যোগাযোগ রাখিনি, চেষ্টা করিনি, দোষটা আমারই। তুমি কেন চেষ্টা করোনি? তুমি তো চাইলেই পারতে, তোমার বাবা-মায়ের কাছে সব সত্যি জেনে একবার আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে! দোষ তুমি আমারই দ্যাখছ, নিজের দ্যাখছ না। কৈফিয়ত তুমি আমার কাছেই চাইছ, নিজের কাছে চাইছ না। অথচ সম্পর্ক আগলে রাখতে দু’দিক থেকেই পর্যাপ্ত সাপোর্টের প্রয়োজন ছিল।’
মাহদিয়া নিজেও বার বার মায়ের কাছে জানতে চাইত, দেশ থেকে ফোন আসে কি-না। কিন্তু শায়লা সুলতানা প্রতিবার তাকে বলতেন, ‘ওরা খারাপ। ওরা নিজেদের দিক ভেবে তোর বড়ো মামাকে অপমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। খুব স্বার্থপর ওরা। ওদের কোনো খোঁজ কারও কাছে নেই। চাইলে তোর মামার সাথে কথা বলতে পারিস। তবে ওই দুটো মানুষকে নিয়ে কোনো কথা বলবি না। ওমন অসভ্য, বেয়াদব ছেলে আমি বাপের জন্মেও দ্যাখিনি।’ কার কী দোষ, কী অপরাধ এসব জিজ্ঞেস করলেও ধমক দিয়ে মেয়েকে ঠাণ্ডা করে দিতেন তিনি। সে জানত না, দেশ থেকে শাদাব ও সায়রা করীম বেশ কয়েকবারই যোগাযোগ করেছেন। এখনও জানে না, পিছনে ঠিক কী কী খারাপ ঘটেছে, আর কতটা ভয়াবহ সেসব গল্প। তার মা তাকে যতটুকু বলেছেন, সে বিশ্বাস করে নিয়েছে। নিজেও কোনোদিন স্বেচ্ছায় ফোন করেনি দেশে। যাদের জন্য করবে, তারাই তো ‘সুখনীড়’-এ নেই। মাঝেমধ্যে শায়লা সুলতানা যখন কায়ছার সাহেবের সাথে কথা বলতেন, তখন সে-ও কথা বলত। ওই দুটো মানুষের কথা জানতে চাইলে, সবাই তাকে এড়িয়ে চলতেন। তার কোনো কথা কানে নিতেন না। তবুও এসব মেনে নিয়েই অপেক্ষায় ছিল, একদিন দেশে ফিরবে। শাদাবকে খুঁজে বের করে জানতে চাইবে, কেন সে কায়ছার সাহেবকে ছেড়ে চলে গেল! ফিরে এসে হায়দার সাহেবের মুখ থেকে শোনে বুঝেছিল, সেদিন দোষটা মা ও ছেলে কারোরই ছিল না। দোষ তো কায়ছার সাহেবের বিবেকের মধ্যে। তিনি-ই স্ত্রী-সন্তানের প্রতি অবিচার করেছেন। এতদিন পর সম্পর্ক বাঁচাতে ফিরে এসে এসব জেনে, এমন অযাচিত অপশনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে চরম অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করল মাহদিয়া। বলল,
-‘আচ্ছা ঠিক আছে, দোষ আমারও। ভুল আমিও করেছি। এখন যখন সম্পর্ক বাঁচাতে চাইছি, তখন তুমি কেন এত কঠিন হচ্ছ? এখন তো তোমার সাপোর্ট আমার ভীষণ দরকার। নয়তো একা কীভাবে আমি এই সম্পর্ক বাঁচাব?’
শাদাবের দুঃখ তো একটাই, শায়লা সুলতানা! এমন নিকৃষ্ট মন-মানসিকতার মানুষের জন্যই শিহাব আজ পুরোপুরি সুস্থ নয়। যতবার শিহাবকে দেখে, ততবারই মনে হয়, জঘন্য ওই মানুষদের শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু মাহদিয়া সব জটিল করে দিচ্ছে। ওই মহিলাকে শাস্তি দেয়া মানেই, মাহদিয়ার মনে আঘাত করা। এক্ষুণি এই আঘাতটা সামলে নিতে পারবে না এই মেয়ে। আঘাত পাওয়া মাত্রই তাকে ভুল বুঝবে। কীভাবে যে সবকিছু সামলাবে, সেটা ভেবেই অশান্ত হয়ে গেল শাদাব। বলল,
-‘আমি তো বলেছি, একজনকেই গ্রহণ করতে হবে তোমায়। হয় তোমার মা, নয়তো আমি।’
শাদাবের এই কঠিন কথার হিসাব কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারল না মাহদিয়া। বলল,
-‘একজন সন্তানের কাছে তার মা যেমন খুব আপন, একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীও ঠিক তেমনই আপন। আমার কাছে তোমরা দু’জনই অনেক দামী। তোমাদের দু’জনকেই চাই আমার। কাউকেই ছাড়তে পারব না।’
-‘এজন্যই বলেছি, সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নাও। তাড়াহুড়োর প্রয়োজন দ্যাখছি না।’
-‘আমি তাড়াহুড়ো করছি না শাদাব। ভেবেচিন্তেই বলছি। তুমি-ই বুঝতে চাইছ না। বাই অ্যানি চান্স, তুমি অন্য কারও প্রেমে পড়ে যাওনি তো? হয়তো এই কারণেই আমাকে পথের কাঁটা ভেবে এমন একটা অপশন দিয়েছ। ‘বাল্যবিবাহ’ ভুল ভেবে আমাকে অস্বীকার করতে চাইছ। যেন কোনোভাবেই আমি তোমাকে নিজের করে চাইতে না পারি! যদি এমনটা হয়, তাহলে তো খুবই ভালো। পনেরো বছর তো কম সময় নয়! মন অন্যকারো মায়ায় ডুবতেই পারে। যেহেতু আমার প্রতি তোমার কোনো অনুভূতি নেই! অন্যকেউ আসতেই পারে জীবনে। এটা অবিশ্বাস্য কিছু না।’
এমন চমৎকার স্বীকারোক্তি ও আবেগ প্রকাশের ধরন দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল শাদাব। মাহদিয়ার হিংসাত্মক মনোভাব দেখতেই হাসতে হাসতে বলল,
-‘যা বলেছ। মনের ওপর জোর চলে না। তোমার ধারণা পুরোটা ভুল নয়, সামান্য ঠিক। ছিল একজন, সে দ্যাখতে কিন্তু ভীষণ সুন্দর। এখনও তার রূপে একফোঁটাও কমতি আসেনি। কাল রিসোর্টে আসবে। দ্যাখা করবে তার সাথে?’
এটা বোধহয় ফাঁসির দড়ির চেয়েও আরও কঠিন এক শাস্তি হয়ে গেল মাহদিয়ার জন্য। চোখে তো জল জমলই, নিজেকে আটকেও রাখতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতক্ষণের সবটুকু আলাপ ও মাহদিয়ার কান্নামাখা মুখখানির ছবি টুপ করে তুলে ফেলল শাদাব। ঝটপট সেটা সেন্ড করল, শায়লা সুলতানার নম্বরে। লিখল, ‘আপনার মেয়ে তো আমাকে ছাড়তেই নারাজ, শাশুড়ি আম্মা। দ্যাখেন, কেঁদেকেটে শেষ। অপশন দিলাম, তবুও তার আমাকেই চাই। আমি বরং এক কাজ করি, কাছেপিঠে কোনো কাজী অফিস পেলে বিয়ে করা বউকে আবারও বিয়ে করে ফেলি। আপনি আমাদের আশীর্বাদ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। যেকোনো দিন আমি আপনার মুখোমুখি হচ্ছি। একেবারে জামাই আদর না করা পর্যন্ত আপনাকে নিস্তার দেব না। একটা পবিত্র সম্পর্কে কেমন টান থাকে সেটা আপনাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেব। পাপ কমাতে চাইলে, নিজের সুখ-শান্তি চাইলে, মেয়ের সামনে নিজেকে সৎ দ্যাখতে চাইলে, স্বেচ্ছায় নিজের মেয়ের কাছে সব সত্যি স্বীকার করুন। আমি যদি একবার মুখ খুলি, আপনাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব। আপনার মেয়ে আমার হাত-পা বেঁধে দিচ্ছে। নয়তো, আপনার এই ভালো মানুষীর রূপটা ওর সামনে এক্ষুণি প্রকাশ করে দিতাম। পারছি না, সেটা আপনার সৌভাগ্য। তবে বেশিদিন চুপ থাকতে পারব না। খুব বেশি দেরী হওয়ার আগেই, নিজ দায়িত্বে আত্মসমর্পণ করুন।’ ম্যাসেজ পাঠিয়ে সামনে তাকাল শাদাব। ততক্ষণে মাহদিয়া তাকে একা ফেলে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। তার রাগ, অভিমানের পারদ মেপে পিছনে তাকিয়েই তৃপ্তিভরে হাসল সে। অস্ফুটস্বরে আওড়ে গেল,
-‘তুমি আমার হয়েও কেন আমার নও, ভ্রমর? তোমার এই অভিমানী মুখ দ্যাখলে মন চায় তোমায় বুকের মাঝে খুব করে জড়িয়ে ধরি। পৃথিবীর সমস্ত খারাপ নজর থেকে আগলে রাখি। অথচ আমি তা পারছি না। এই তীব্র ইচ্ছা ও অনুভূতিকে আর কতদিন লুকিয়ে রাখব আমি? কতদিন তোমাকে না ছুঁয়ে থাকব? তুমি শুধু একবার আমার হও, ভ্রমর। একবার আমার হও…।’
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — তেইশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
প্রতিহিংসা, লোভ, স্বার্থপরতা যখন একটা মানুষের অন্তরে বাসা বাঁধতে শুরু করে, তখন নিজের অজান্তেই সেই মানুষ অমানুষে পরিণত হয়। কেবল নিজের জন্য সুখ ও শান্তি চাইতে গিয়ে হিংসায় জ্বলেপুড়ে মানুষ হয়ে যায় পশু। কারও মনে যদি একবার লোভ জন্ম নেয়, তাহলে সেই লোভ তাকে ধীরেধীরে পাপের দিকে একেকধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। ভুল-সঠিকের বিচার না করেই মানুষ পাপের দিকে অগ্রসর হয়। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য না খুঁজেই, পিছন থেকে চাবুক চালায়। ‘সুখনীড়ে’-এ পা দিয়ে শায়লা সুলতানা হতবাক হয়েছিলেন, এই নীড়ে এত সুখ কেন, এটা দেখে! কেন এই বাড়ির নাম ‘সুখনীড়’? দুটোদিন অতিবাহিত করার পর তিনি আবিষ্কার করলেন, সংসারে সুখ কীভাবে আসে! নিজের স্বামীর আয়-রোজগার ও সাংসারিক টানাপোড়নের কারণে তিনি কোনোদিন সুখ কী তা উপলব্ধি করতে পারেননি। সংসার, দায়িত্ব-কর্তব্য ও স্বামীর অল্প আয়ের বিনিময়ে দু’বেলা দুমুঠো খাবার জুটলেও পরিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্য সেখানে ছিল না। ছিল শুধু কোনোকিছু মনভরে না পাওয়ার আক্ষেপ ও বোবাকান্না। সায়রা করীম ও এমদাদ কায়ছারের বন্ধন, সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা; পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য ও আয়-ইনকামের বহর দেখে, সেই একই সুখে নিজেকে দেখার লোভে পনেরো বছর আগেই ছোট্ট একটা প্ল্যান সাজান তিনি। খুব ভালোভাবেই জানতেন, তার স্বামীর ইতালি যাওয়ার পিছনে সমস্ত খরচ বহন করেছেন কায়ছার সাহেব। টাকা-পয়সাসহ অন্যান্য যত সাহায্য-সহযোগিতা আছে, সবই তিনি করেছেন, একজন আপন ভাইয়ের মতো। এসবে অবশ্য সায়রা করীমের কিছু চমৎকার সাজেশন ছিল। তিনি-ই স্বামীকে বুঝাতেন, ‘কারও উপকার করলে লাভ বৈ ক্ষতি হয় না। বিপদে তো মানুষ মানুষের জন্যই।’ রক্তের সম্পর্কের মানুষও বোধহয় এতটা আপন হয় না, যতটা আপন ও কাছের হয়ে আজাদ সাহেবকে ইতালি পাঠিয়েছিলেন তাঁরা। তাছাড়া, অবুঝ মাহদিয়া ছিল সায়রা করীমের জান-প্রাণ ও কলিজার একটুকরো অংশ। স্বার্থ ও লোভের জন্য দাবার গুটি হিসেবে তিনি নিজের মেয়েকেই বেছে নিয়েছিলেন একদিন।
সেদিন ফুল বাগানের কাছে ছোটাছুটি করছিল শাদাব ও মাহদিয়া। অবুঝ বাচ্চাটার টেডিবিয়ার নিয়ে তাকে পুরো বাড়িতে চক্কর দিতে বাধ্য করছিল শাদাব। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত মাহদিয়া হেরে গিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কেঁদে ফেলেছিল। দু’জনের সেই দৌড়, ছোটাছুটি দূর থেকে লক্ষ্য করছিলেন সায়রা করীম ও শায়লা সুলতানা। মায়া-মমতা ও ইচ্ছা থেকেই সায়রা করীম বলেছিলেন,
-‘ওদের খুব সুন্দর মানিয়েছে আপা। যদি চারহাত এক করা যেত। আমি যদি দিয়াকে এই বাড়ির একজন হিসেবে চাই, তুমি কি খুব বেশি রাগ করবে?’
আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যান শায়লা সুলতানা। তবুও একটু ভণিতা করে বলেছিলেন,
-‘কী যে বলেন আপা! ওরা এখনও অবুঝ। দিয়াকে নিয়ে তো চলেই যাচ্ছি। আর কী দ্যাখা হবে? ওরা যেভাবে একজন-অন্যজনের পিছনে লাগে, ওদের নিয়ে ওসব ভাবনা মাথায় না আনাই ভালো।’
-‘লাগুক অসুবিধা নেই। এখন তো এসবেরই বয়স। বড়ো হলে ঠিকই বুঝবে। তুমি যদি চাও, আমি টোটোনের বাবা ও আজাদ ভাইকে ম্যানেজ করতে পারি। যাওয়ার আগেই ওদেরকে একসাথে বেঁধে দিই!’
আচমকা সুখ যদি দু’হাতের মুঠোয় চলে আসতে চায়, কেউ কি তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে পারে? যদি সুখ হয় তার সারাজীবনের পরম চাওয়া ও পাওয়ার একটা! এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না তিনি। মাহদিয়া এই বাড়ির একজন হওয়া মানেই, তিনিও এখানকার একজন। সেই হিসাবে সব সুখ নিজের দখলে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। সাত-পাঁচ ভেবে তিনি কিছুটা বাহানা দেখিয়ে বললেন,
-‘একসাথে বেঁধে দিলেই ওরা থাকতে চাইবে?’
-‘আরেহ্, এখুনি থাকতে হবে কেন? বিয়েটা হয়ে যাক। দিয়া চলে গেলেও বন্ধন পাকাপোক্ত থাকবে। বড়ো হয়ে যখন ফিরে আসবে তখন পুরো গ্রাম ও আত্মীয়স্বজনদের জানিয়ে বিরাট আয়োজন করে ওদেরকে আবার এক করব। আসলে আমি দিয়াকে নিজের মেয়ে হিসেবে চাইছি। একেবারে। তাই বলছি। তুমি আপত্তি করলে থাক্…!’
-‘আমি আর আপত্তি কী করব আপা? দিয়ার বাবা আজ যা হয়েছেন, তা তো আপনাদের জন্যই। আপনি কিছু চাইলে আপনাকে ফিরিয়ে দেব, এতবড়ো স্পর্ধা আমার হয়নি। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি ওদের নিয়ে! ওরা এখনও ছোটো। বিয়ের জন্য কিংবা সম্পর্কে বাঁধা পড়ার জন্য উপযুক্ত নয়। এটা ‘বাল্যবিবাহ্’ হয়ে যাবে।’
-‘তা হবে। কিন্তু আমরা তো এক্ষুণি সংসারের বোঝা ওদের ওপর চাপিয়ে দিব না। ওরা বড়ো হোক, বুঝতে শিখুক, তখন নিজেরা-নিজেরাই সম্পর্কের মূল্য দিতে শিখবে।’
কপালে সুখ আসতে চাইলে তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই! শায়লা সুলতানার মনোভাবও ঠিক সেরকমই ছিল। সামান্য লোভের মোহে পড়ে সুখকে আঁকড়ে ধরতেই তিনি সায়রা করীমের এমন একটা প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। ঘরোয়াভাবে ছোটোখাটো পরিসরে বিয়ে হয় তাদের। সেদিন থেকেই ছোট্ট একটা ইচ্ছেকে বুকের মধ্যে লালন করে এসেছেন শায়লা সুলতানা। যে করেই হোক, এই ‘সুখনীড়’-এর সুখ তার চাই-ই চাই। মাহদিয়াকে এই ঘরের একজন করার মাধ্যমে সুখ হাতের মুঠোয় আসার একটা রাস্তা তৈরী হয়। সেই রাস্তা ধরেই এতপথ হেঁটে এতদূর এগিয়েছেন তিনি। আজ তার সুখের রাস্তাতেই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শাদাব। পনেরো বছর আগে, ইতালিতে ফিরে গিয়ে যখন শুনেছিলেন, সায়রা করীম দ্বিতীয়বার মা হতে যাচ্ছেন, তখনই তার সব সুখে ছাঁই পড়ার ভয়ে তিনি দূরে থেকেই কায়ছার সাহেবকে নানানভাবে তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে উসকে দিচ্ছিলেন। এতে কায়ছার সাহেবেরও দোষ আছে। তিনি নিজেও চাইছিলেন না, শিহাব এই পৃথিবীতে আসুক। তাঁর সেই কাজটা সহজ করে দিয়েছিলেন শায়লা সুলতানা নিজে। অথচ এখন, এত বছর পর, মাহদিয়াকে ব্যবহার করে শাদাব তার দিকে তীর ছুঁড়তে চাইছে। তিলতিল করে যে প্ল্যান তিনি সাজিয়েছেন, এত বছর পর নিজের মেয়ের কারণে সাজানো-গোছানো প্ল্যান নষ্ট হতে দিতে পারেন না। ঠিক এই কারণেই তিনি চাননি, মাহদিয়া দেশে ফিরুক। মেয়েটা সম্পর্ক বাঁচাতে এতটাই মরিয়া যে, বুঝদার হওয়ার পর থেকেই দেশে আসার জন্য ঘ্যানঘ্যান করে কানে পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। এড়িয়ে গিয়েও পারেননি। বাধ্য হয়েছেন দেশে ফেরার পাশাপাশি এত বছরের স্বপ্নকে পূরণ করে ‘সুখনীড়’-এর পরিপূর্ণ সুখকে ছুঁয়ে দেখতে।
নিজের মেয়ের এরূপ বোকামিতে যথেষ্ট বিরক্ত শায়লা সুলতানা। ফোনের দিকে তাকাচ্ছেন আর রাগে ফুসফুস করছেন। ফোনটা ছুঁড়ে ফেললেই যেন শান্তি পেতেন। কিন্তু না। এভাবে শাদাবকে থামানো যাবে না। অন্য উপায় দেখতে হবে। দ্রুতপায়ে ছুটে আসলেন কায়ছার সাহেবের সামনে। কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন,
-‘ভাইজান, দিয়া রিসোর্টে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি এত করে বলছি, বাড়ি চলে আয়। আসতেই চাইছে না। আপনি যদি ও’কে একটু বুঝাতেন।’
ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুতে লোকসান হওয়ার পর কায়ছার সাহেব বাড়িতেই থাকেন। ধন-সম্পদ বলতে এখন এই বাড়ি, কিছু জমিজমা ও ব্যাংকে জমানো টাকা। একজীবন যত রোজগার করেছেন, বেশিরভাগ টাকাই ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন। সায়রা করীম ও শাদাব চলে যাওয়ার পর টাকার আর প্রয়োজন পড়েনি তাঁর। সব রোজগার, সব অর্থ তিনি স্ত্রী-সন্তানের জন্যই গচ্ছিত রেখেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে সেসব প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। তাই সব টাকা-পয়সা ও জমিজমা মাহদিয়ার নামেই দিতে চেয়েছিলেন তিনি। বোকা মেয়েটা সেটা গ্রহণ করল না। সব ছিঁড়ে ফেলল। তবে তিনিও দমে যাননি। মেয়েকে না পেয়ে, সবকিছু মেয়ের মায়ের নামেই দিয়ে যাবেন। একদিন মাহদিয়া সেটা গ্রহণ করবে নিশ্চয়ই। এইভেবেই পূণরায় কাগজপত্র গোছাচ্ছেন তিনি। ইজিচেয়ারে বসে ভাবছিলেন, অতীতকে কীভাবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দূরে সরাবেন। এরমধ্যেই শায়লা সুলতানার এই আর্তনাদ শোনে বললেন,
-‘দিয়া কি আমার কথা শুনবে? তুমি-ই বুঝিয়ে বোলো।’
শায়লা সুলতানা অধৈর্য্য হয়ে বললেন,
-‘আপনি বুঝতে পারছেন না ভাইজান, এই মেয়ে যেকোনো দিন টোটোন অবধি পৌঁছে যাবে। একবার যদি টোটোন এই বাড়িতে আসে, কতটা কলঙ্কিত হবেন আপনি, ভাবেন। যদি বেঁচে থাকে, নিশ্চয়ই ও ওর সম্পত্তির ভাগ চাইতে এখানে আসবে।’
-‘এসব নিয়ে তুমি খামোখাই চিন্তা করছ শায়লা। টোটোন আমার কাছে সবসময়ই মৃত। ও আমার সন্তান ছিল, কিন্তু এখন আর নয়। এই বাড়ির কোনোকিছুর ওপর অধিকার নেই ওর। বাকি রইল দিয়া। তোমার মাথামোটা মেয়েটা অকারণ ছুটছে। যাদের কোনো অস্তিত্ব হায়দার পায়নি, তাদেরকে ও খুঁজে পেয়ে যাবে। তা-ও মাত্র তিনমাসে! অকারণ ভয় না পেয়ে উকিল সাহেবকে ডাকো। শীঘ্রই সব ঝামেলা শেষ করি।’
শায়লা সুলতানা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন। ভেতরে ভেতরে হাজারও সুখের পায়রা উড়ছে, কিন্তু বাইরের আচার-আচরণ দিয়ে তা বুঝতে দিলেন না। বললেন,
-‘যদি দিয়া ওদের খোঁজ পেয়ে যায়?’
-‘পেলেও ওই অভদ্র ছেলেকে নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকার করব না।’
খানিকটা অসহায় ও কাতর গলায় শায়লা সুলতানা বললেন,
-‘সায়রা আপা কেন যে বোকামি করলেন! এক বাচ্চার জন্য সবকিছু হারাতে হলো তাঁকে।’
-‘ধন-সম্পদের মূল্য যে বুঝে না, সে সবকিছু হারাবেই। তার তো শুধু বাচ্চার দরকার ছিল। তাই প্রয়োজনীয় জিনিসটা নিয়েই চলে গিয়েছে। তাদের জন্য তোমার এত হা-হুতাশ করা মানাচ্ছে না শায়লা! যদি ওরা দিয়ার কথা ভাবত, তবে এইভাবে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সাহস করত না। ওরা শুধু নিজেদের কথাই ভেবেছে।’
-‘কিন্তু তবুও, ওসবে ওনার একটা অধিকার ছিল।’
কায়ছার সাহেব দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন,
-‘হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু এখন নেই।’
***
‘সাতছড়ি’ হবিগঞ্জের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। এটি চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত। পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য ‘সাতছড়ি’ একটি চমৎকার উদ্যান। ‘লাউয়াছড়া’র মতো এখানেও তিনটি ট্রেইল রয়েছে। হাজার হাজার পর্যটক সবুজের লীলাভূমি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নানা রূপবৈচিত্র দেখতে ছুটে আসেন এখানে। ‘সাতছড়ি’ মূলত সাতটি পাহাড়ি পানিবিহীন ছড়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে যে সাতটি ছড়া প্রবাহিত হয়েছে, তাতে পানি না থাকলেও শুকনো বালিবিশিষ্ট ছড়া দেখতে ভীষণ সুন্দর ও আকর্ষণীয়। বর্ষাকালেও এই ছড়াতে পানি থাকে না। প্রত্যেকটা ছড়ার মধ্যে প্রকৃতি যেন নিজ নিয়মে বিছিয়ে রেখেছে পানিবিহীন দুধের ন্যায় সাদা সাদা ঝুরঝুরে বালি। এই বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় উদ্যানের অভ্যন্তরে। তখন দর্শনার্থীদের কাছে মনে হবে এ-যেন প্রকৃতি নিজ দায়িত্বে সাদা গালিচা বিছিয়ে অভ্যর্থনা করছে সবাইকে। ছড়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে চারিদিকে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি, পশুপাখি ও নাম না জানা অসংখ্য উদ্ভিদ। যেগুলো বরাবরই প্রকৃতির রং ও রূপকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে সাহায্য করে।
প্রকৃতির মাঝে রূপ, প্রাণী ও উদ্ভিদের এই অসাধারণ খেলা দেখে বিস্মিত মাহদিয়া। কখনও এইভাবে, এত কাছে থেকে দেশের রূপবৈচিত্র দেখার সুযোগ হয়নি তার। তারা উদ্যানের যত গহীনে এগোচ্ছিল, ততই যেন দিনের আলো মিইয়ে গিয়ে ভরদুপুরে চারপাশ আঁধার মনে হচ্ছিল। মূলত গাছপালার জন্যই এমন ঝিকিমিকি রূপে আলো-আঁধারির খেলা চলছিল সেখানে। ভেতরের দৃশ্য তখন জনমানবশূন্য আমাজনের ন্যায় অন্ধকার হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখে। অথচ চারপাশে মানুষের উপচেপড়া ভীড়। সেই অন্ধকারের বুক ছিঁড়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে একফালি সূর্যের তীর্যক আলো। চারিদিকে এত গাছ, প্রকৃতির এত রূপ, এত সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। অনেকদিন পর দেশে ফিরে এমন চমৎকার পরিবেশকে পেয়ে স্বর্গসুখকে ছুঁয়ে দেয়ার সুযোগ পেল মাহদিয়া। উদ্যানের এই মায়াভরা রূপ তাকে এতটাই আনন্দ দিল, সে ডানাবিহীন পাখির মতো উড়তে লাগল চারিদিকে। ব্যথাতুর পা নিয়ে সে ছুটছে অবিরত। বিরামহীন, ক্লান্তিহীন ছোটা। তাকে অনুসরণ করে শিহাবও দৌড়াচ্ছে। ছবি তুলছে। হাসছে, নাচছে, গাইছেও। পথহারা পথিক হয়ে যেতে চাইছে দু’জনেই। হায়দার সাহেব তাদের সাথে পেরে উঠছেন না। ক্লান্ত হয়ে থেমে যাচ্ছেন। শাদাব দু’জনার ছোটাছুটি দেখছে, নিজে তাতে যোগ না দিলেও কাছেপিঠে থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। বেশ কয়েকজন ট্রি অ্যাডভেঞ্চার অ্যাকটিভিটি’স উপভোগ করতে শরীরে বিভিন্ন সেফটি ব্যবহার করছে। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত মাহদিয়া এসব দেখে আগ্রহচিত্তে শাদাবের পাশে দাঁড়িয়ে কণ্ঠে একরাঁশ উচ্ছ্বাস জড়িয়ে বলল,
-‘আমিও এই ট্রি অ্যাকটিভিটির ফিলিংস নিতে চাই।’
শাদাব চমকে গেল। চোখদুটোতে নেমে এলো বিস্ময়, ভয়, আতঙ্ক। বলে কী এই মেয়ে! পড়লে আর আস্তো থাকবে? হাড়গোড় ভেঙে গিয়ে এখানেই মৃত্যু নিশ্চিত। সে চোখ পাকিয়ে না’বোধক ভঙ্গিমায় মাথা নেড়ে বলল,
-‘দরকার নেই। এটাতে ঝুঁকি আছে।
মাহদিয়াও ঘাড়ত্যাড়া মেজাজে বলল,
-‘থাকুক ঝুঁকি। চলো না, প্লিজ। একবার যাই। আমি কখনও এমন অ্যাডভেঞ্চারের সাক্ষী হইনি।’
শখ কত! যেচেপড়ে মৃত্যুর মুখে পা রাখবে! সে থাকতে কখনওই এটা হতে দিবে না। কী বলবে মা’কে! তার জন্য ‘ভ্রমর’-এর ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছেও। ত্রিশ ফুট উচ্চতা থেকে পড়লে মানুষ মারা যায় কি-না জানা নেই, তবে শরীরের একটা হাড়ও আর সোজা থাকবে না এটা নিশ্চিত। এত ঝুঁকিপূর্ণ একটা রাস্তায় অ্যাডভেঞ্চার করার শখ হয় কী করে কারও! তার নীরবতা দেখে মাহদিয়া বলল,
-‘তুমি খামোখাই ভয় পাচ্ছ! ভয় পাওয়ার মতো কিছু হবে না। দ্যাখো, সবাই কত সহজেই অন্যগাছে চলে যাচ্ছে।’
-‘তুমি কি বানর না-কি, লাফিয়ে লাফিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাবে?’
-‘লাফাতে হবে কেন? এখানে তো পর্যাপ্ত দড়ি আছে। রাস্তাও আছে। কী দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হবে বোলো তো! আমার তো ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে।’
মাহদিয়ার শখ ও লাফঝাঁপ দেখে বাঁধা দেয়ার কারণ খুঁজে পেল না শাদাব। ঘুরতে যখন এসেছে, একবার অভিজ্ঞতা হয়েই যায়। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করেই উচ্চতা একটা নির্দিষ্ট সীমা অবধি রাখা হয়েছে। সাথে আছে নিরাপত্তা সরঞ্জাম, সেফটি হার্নেস, গ্লাভস্, হেলমেট। খুশিমনেই নিজেকে এই সেফটি সরঞ্জামে বেঁধে ফেলল মাহদিয়া। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় পা রেখে হাতের কাছে থাকা দড়ি শক্ত করে ধরল। তখনও পা ফেলবার সাহস পায়নি সে। এক’পা ফেলতেই টের পেল, শূণ্যে ভাসতে শুরু করেছে তার পুরো দেহখানি। ভয়ে তখনই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো তার। সমস্ত শরীর কাঁপতে কাঁপতে টালমাটাল অবস্থা। শাদাব পাশে দাঁড়িয়ে বেশ মজা নিচ্ছে। মিটিমিটি হাসছেও। মাহদিয়ার বিড়বিড় দেখে বলল,
-‘এইভাবে কাঁপছ কেন ইডিয়ট? যেকোনো সময় পা ফস্কে যাবে। পটল তোলার শখ জেগেছে খুব?’
অসহায়, করুণ অবস্থা তখন মাহদিয়ার। এক দয়ামায়াহীন নিষ্ঠুর পুরুষের দিকে থমথমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সাথে সাথে অভিমান যেন ঠিকরে ঠিকরে বেরুল। চোখে সম্মোহনী যে আহ্বান স্পষ্ট, তা দিয়ে যেকোনো পুরুষকে ঘায়েল করা সম্ভব। অথচ শাদাব সেই দৃষ্টির সামনে নির্বিকার। সবাই কি আর চোখ দিয়ে মন পড়তে জানে? মুখে শব্দ না করলেও মন যেন বার বার বলছে, ‘তুমিও এসো না প্লিজ। একবার পাশে এসে দাঁড়াও। হাত ধরো, ভরসা হয়ে যাও, তাহলে আর ভয় পাব না।’ অভিমানী মনের এই হৃদয় উজাড় করা আকুতি শাদাব শুনলও না। এগোলও না। দূরে থেকেই বলল,
-‘শখটা সুন্দর না? একেবারে রূপকথার গল্পের মতো?’
বিড়বিড় বন্ধ করল মাহদিয়া। সাহস নিয়ে বলল,
-‘ভীষণ সুন্দর। আমার তো এক্ষুণি মরতে ইচ্ছে করছে!’
-‘মাথা খারাপ! সৌন্দর্য দ্যাখে মানুষ মুগ্ধ হয়, মরতে চায় না। তুমি তো দ্যাখি, অদ্ভুত মেয়ে। সৌন্দর্য উপভোগ করার বদলে নিজের মৃত্যুকে কাছে ডাকছ!’
মাহদিয়া ধরা গলায় বলল,
-‘কী করব বোলো! যে কঠিন অপশন তুমি দিয়েছ, তার থেকে মৃত্যুই আমার জন্য সহজ হয়ে গেছে। জেনে-বুঝে তুমি আমাকে কঠিন এই সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছ! এখন যদি আমি মরেই যাই, তবে একটা অপশন বেছে নেয়ার মতো দমবন্ধ করা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব। বেঁচে থাকতে, দু’জনের কাউকে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। আমি একজনকে নয়, তোমাদের দু’জনকেই আমার জীবনে চাই।’
চোখের সামনেই সবগুলো সেফটি সরঞ্জাম খুলে ফেলতে শুরু করল মাহদিয়া। কোমর, হাত-পা ও উন্মুক্ত করে দড়িতে ব্যালেন্স রেখে একেবারে মাঝখানে চলে গেল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-‘কাউকেই তো ছাড়তে পারব না, তাই নিজেকেই মুক্তি দিচ্ছি।’
দড়িতে টানা গাছের সিঁড়ি বেয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়া যতখানি কঠিন, তারচেয়েও কঠিন মুহূর্ত এসে দাঁড়াল শাদাবের সামনে। তড়িঘড়ি অন্য একটা সেফটি সরঞ্জামে নিজেকে আবদ্ধ করে ঝটপট পা ফেলল ঝুলন্ত সেতুর সিঁড়িতে। পুরো দড়ি নড়ে উঠল। মাহদিয়াও টাল সামলে দড়ি আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মন চাইছে, এক্ষুণি এখান থেকে ঝাঁপ দিক। শেষ করে দিক নিজেকে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু না আসলেও শাদাব তো একটুখানি উতলা হবে তারজন্য, এটাই তো তীব্র ব্যথা থেকে তাকে মুক্তি দিবে। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে ওই কঠিন চোখের মাঝে একটুকরো স্বচ্ছ অনুভূতি দেখতে চায় মাহদিয়া। নিজেকে ও সম্পর্ককে সে ভালোবাসে বলেই, দূরত্ব থাকার পরও পবিত্র এই বন্ধনকে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারেনি। অথচ যার জন্য ছুটে আসা, সে-ই তাকে চাইছে না। কঠিন অপশনের মাঝে দাঁড় করিয়ে প্রতিক্ষণে বুঝাতে চাইছে, সম্পর্কের প্রতি অনুভূতি কেন, সামান্যতম দায়বদ্ধতাও তার নেই। এইটুকুই মাহদিয়ার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। তাকে অস্থির করে তুলে। নিজেকে তখন তার নিঃস্ব, একা, অস্তিত্বহীন এক অসহায় মানবী মনে হয়।
আচমকাই শাদাবের গলা ভেসে এলো,
-‘ওখানেই দাঁড়াও, আর এক’পা সামনে এগোবে না।’
কথা কানে নিল না মাহদিয়া। বন্ধ চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠল তার। ঝুলন্ত সেতুর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ল। শাদাব যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে দড়ি আরও বেশি দুলছে। একটা সময় মাহদিয়ার মনে হলো, সে আর ব্যালেন্স ধরে রাখতে পারছে না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। পা ফসকে যাচ্ছে। দড়ি থেকে হাত সরে যাওয়া মাত্রই কাঠের সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চির চিকন শরীরটা ঢুকে পড়তেই শক্তপোক্ত হাতের পাঁচটে আঙুলের চাপে পিষ্ট হয়ে যেতে লাগল তার হাতের কবজির অংশ। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতিতে পড়ে, চোখের সামনে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে দড়িতে ধরে নিজেকে আটকানোর প্রয়োজন বোধ করল না। ইচ্ছাকৃতভাবেই চাইল, সে নিচে পড়ে যাক। চোখ রাঙিয়ে শাদাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘হাতটা ছাড়ো!’
-‘সাহস বেড়ে গেছে না? মরতে চাও, নিজে একা এসে মরো। আমাকে ফাঁসিয়ে কোনোভাবেই তুমি ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করতে পারো না।’
ক্রমান্বয়ে হাত মুচড়াতে শুরু করল মাহদিয়া। তীব্র রাগের সাথে বলল,
-‘আমি মরি কি বাঁচি, তাতে তোমার কী? তুমি তো এটাই চাও, মুক্তি, শান্তি। যার কাছে সম্পর্কের মূল্য নেই, তার কাছে জীবনের মূল্য আশা করা বোকামি!’
শক্ত কাঠের সিঁড়িগুলোর ওপর নিজের সমস্ত শরীর রেখে ভর দিয়ে দু’হাতে মাহদিয়াকে টেনে তোলবার চেষ্টা করল শাদাব। কাঁধ ছুঁতেই মাহদিয়া রাগে ফেটে পড়ল। বলল,
-‘হাত ছাড়তে বলেছি!’
-‘ছাড়ব না। খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। দড়ি ধরে উঠবার চেষ্টা কোরো।’
-‘অসম্ভব! অপশন বেছে নিয়ে আমি তোমাকে মুক্তি দিব না। তুমি মুক্তি পাবে আমার মৃত্যু দেখে।’
-‘একবার উঠো, বুঝাচ্ছি; মৃত্যু কাকে বলে!’
প্রচণ্ড কান্না পেল মাহদিয়ার। সম্পর্ক বাঁচানোর চেষ্টা শুধু তার একার। শাদাব তাকে চায়-ই না। এটা এখন নিশ্চিত! কেন আসলো সে দেশে? থাকত ইতালিতে! এত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হোতো না। মিছে অনুভূতি ও সম্পর্কের টানে, অপেক্ষা করতে করতে জীবনটা তার শেষ! শাস্তি শুধু সে একা পাচ্ছে। দুঃখ, কষ্ট, শূণ্যতা, হারানোর তীব্র হাহাকার এই পাষণ্ড পুরুষকে ছুঁয়েও যাচ্ছে না। এত কেন পাষাণ হয় মানুষ? এত কেন দয়ামায়াহীন হতে হবে কাউকে? একটু আবেগী হোক না সে! একটু তো কাছে আসুক। অনুভূতি মিছে হওয়ার এই শূণ্যতা নিঃশেষ করে দিল তাকে। হাত ছাড়াতে গিয়েই দেখল, তার শরীরটা না চাইতে উপরের দিকে উঠছে। সে পা নাচাতে শুরু করল। বলল,
-‘ব্যথা পাচ্ছি আমি, ছেড়ে দাও। কেন জোর করছ?
মাহদিয়া আর কিছু বলার সময়-সুযোগ পেল না। সিঁড়ির ওই ফাঁক দিয়ে তার শরীরটা উপরে উঠে আসলো। এতক্ষণের টানাটানিতে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। এটা সয়ে নেয়া যাবে! কিন্তু মনের ব্যথার কী হবে? কিছু বলবার আগেই ফেলে রাখা সেফটি হার্নেস দিয়ে তাকে পুরোটাই বেঁধে ফেলল শাদাব। মাহদিয়ার দুটো হাত টেনে নিজের কোমরে রেখে বলল,
-‘চুপচাপ আমাকে ধরে এগোবে। চারপাশে অনেক মানুষ আছে। সবাই দ্যাখছে। যে কেউ এসব ব্যাপার নিয়ে খারাপ ইস্যু তৈরী করতে পারে।’
মাহদিয়া জেদ ধরে বলল,
-‘করুক। আমি কারও তোয়াক্কা করি না। কাউকে ভয় কিংবা লজ্জাও পাই না।’
শাদাব সিঁড়িতে পরবর্তী পদক্ষেপ ফেলতেই দড়ি দুলে উঠল। ভয়ে, আতঙ্কে, নিজেই পিছন থেকে শাদাবকে আঁকড়ে ধরল মাহদিয়া। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করল,
-‘চলো একসাথে মরি!’
এমন কথা শোনে পাগলেও হেসে উঠবে। শাদাবও হাসল। বলল,
-‘মরব। কিন্তু এইভাবে ঝুলে ঝুলে নয়। যখন মৃত্যু আসবে তখন। আমি তোমার মতো আধপাগল নই যে, যখন-তখন ভূত-পেত্নী কাঁধে ভর করলে উল্টাপাল্টা আচরণ করি! এমন বোকা বোকা কাজ তোমার মতো ঢিলেমাথার প্রাণীরাই করে।’
হাত দিয়ে শাদাবের পিঠে একটা কি ল বসাল মাহদিয়া। পরক্ষণেই সেখানে মাথা ঠেকিয়ে অদ্ভুত সুখ অনুভব করল। বিশ্বস্ত পুরুষের সান্নিধ্যে আসলে, এত শান্তি পাওয়া যায় জানত না সে। অবুঝ মন এমন অদ্ভুত সুখকে ছুঁয়ে দেখেনি আগে। পিঠে মাথা ঠেকিয়েই বলল,
-‘বোকামি করেছিলাম বলেই তুমি এত কাছে এসেছ! নয়তো এইভাবে তোমায় ছুঁতে পারতাম? দূরে থাকো, দূরে থাকো বলে তোমার মনের ভেতর প্রবেশ করার কোনো রাস্তাই তুমি খোলা রাখছ না। এটা অবিচার, অন্যায়! এরজন্য কঠিন শা স্তি পেতে হবে তোমাকে।’
পিঠে সামান্য ব্যথা পেলেও মুখে হাসি নিয়ে শাদাব বলল,
-‘দূরত্ব কখনও মনের প্রবেশদ্বার বন্ধ করতে পারে না, মাহদিয়া। কারও মনে প্রবেশ করার জন্য স্বচ্ছ অনুভূতি ও সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাসই যথেষ্ট। মন যদি অদৃশ্য না হোতো, মনের দরজা যদি সবার সামনে উন্মুক্ত করা যেত, তবে কারও মনের ভেতরে থাকা সমস্ত অনুভূতি কেউ কোনোদিন লুকিয়ে রাখতে পারত না। নিজের বলতে কিছুই থাকত না আর। মন অদৃশ্য বলেই স্বচ্ছ অনুভূতি মানুষ গোপন রাখতে পারে। কেউ যদি নিজের অনুভূতি গোপন রেখে শান্তি পায়, তাকে সেভাবেই শান্তি দেয়া উচিত। জোর করে কারও মনের ঘরের দখলদারি পাওয়া যায় না। এটা তোমাকে বুঝতে হবে।’
কখন যে ঝুলন্ত সেতু থেকে রাস্তার কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি মাহদিয়া। গায়ে জড়ানো সেফটি সরঞ্জাম খুলে রেখে দিয়েছে শাদাব। চোখ তুলে তাকাচ্ছেও না একবার। কারও প্রতি অনুভূতি থাকলে লুকিয়ে রাখবে ভালো কথা, তাকে কেন মা’কে ত্যাগ করার মতো কঠিন অপশন দেবে! এর সঠিক ও যৌক্তিক কোনো কারণই তো সে খুঁজে পাচ্ছে না। কথা বলার মতো কোনো অজুহাতও সামনে আসছে না। উশখুশ মেজাজেই দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণ নিজেকে নিরাপদ ও সুখী মনে হলেও এখন নিজেকে তার চরম দুঃখী ও বিপদগামী একজন মানুষ বলে হলো। চারপাশে মানুষ যেভাবে দৌড়াচ্ছে, যে কেউ তার সাথে ধাক্কা খাবে। পাশ দিয়ে একজন ‘বৃষ্টি আসছে, বৃষ্টি আসছে’ বলে দৌড়ে যাচ্ছিল, ধাক্কা লাগার আগেই হুট করে শাদাবের বুকের সাথে লেপটে গেল মাহদিয়া। একহাতে তাকে আগলে নিয়ে রাস্তার একপাশ ধরে এগোতে লাগল শাদাব। অবাক হলেও ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। কাছেপিঠে চোখ ঘুরিয়ে শিহাবকে কোথাও দেখতে পেল না। সাহস নিয়ে প্রিয় পুরুষের একটা হাত আঁকড়ে ধরে, অন্য হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল আটকে লাজেভরা কণ্ঠ নিয়ে স্পষ্ট স্বীকারোক্তির স্বরে বলল,
-‘এইযে, এই দুটো হাত দ্যাখছ। এই দুটো হাতের মুঠোতেই সম্পর্কের মধ্যে থাকা সমস্ত বিশ্বাসকে এতদিন গচ্ছিত রেখেছিলাম। আমার সমস্ত সত্ত্বাকে এই হাতের মুঠোয় আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়েই দূরে চলে গিয়েছিলাম। আজ ফিরে এসেছি, শুধু এই হাতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসাকে গ্রহণ করে দুটো মানুষের মধ্যকার নামহীন সম্পর্ককে চিরস্থায়ী করতে। যে হাতে আমি নিজেকে অনেক আগেই সঁপে দিয়েছিলাম, সেই হাত এত সহজে ছাড়ি কী করে, বোলো? আমি নিজেকে এই দুটো বিশ্বস্ত হাতের মধ্যেই নিরাপদ দ্যাখতে পাচ্ছি, শাদাব। তুমি পাচ্ছ না?’
***
চলবে…