#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — আটাশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
নরম ও শান্তশিষ্ট মেজাজের মানুষটাকে কোনোদিন কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য করতে দেখেনি মাহদিয়া। আজ যেন হায়দার সাহেবকে অন্য এক রূপে আবিষ্কার করল সে। রাগে এখনও ফুঁসছেন তিনি। একাধারে বকাবকি করছেন শায়লা সুলতানাকে। বার কয়েক ফোন করেছেন নূরুন্ নাহারের নম্বরে। ওপাশ থেকে সেটা রিসিভই হচ্ছে না। তার এই রাগী, থমথমে মুখ দেখে যতখানি ভয় পাচ্ছে মাহদিয়া, তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে নিজের মায়ের আচরণে! একজন বিশ্বস্ত মানুষকে তার মা কীভাবে এমন জঘন্য অপবাদ দিলেন ভেবে পেল না সে! কায়ছার সাহেবও কিছু বললেন না। আটকালেন না। সামান্য বাঁধা দেয়া তো দূর, মুখ দিয়ে টু’শব্দটিও করলেন না। এমন আত্ম-অহংকারী, একচেটিয়া মেজাজের মানুষ জীবনে এই একজনকেই বোধহয় দেখল সে। কোনোকিছু ভাবনাচিন্তা না করেই দৌড় দিল নিজের রুমে। পরনের পোশাক পালটে আরেকটা কুর্তি গায়ে জড়িয়ে এলোমেলো রুম গোছাতে গিয়েই বিছানার ওপর অ্যালবাম পেল। খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল সেই ফেলে রাখা অ্যালবামের দিকে তাকিয়ে। মিউজিক প্লেয়ারের কাছে অ্যালবামটা তুলে রেখে পার্স ও মোবাইল নিয়ে আবার দৌড়ে এলো ড্রয়িংরুমে। হায়দার সাহেবকে তখনও গজগজ করতে দেখে বলল,
-‘ছোটো মামা আমি রিসোর্টে যাচ্ছি। তুমি পারলে নাহার খালাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। খালা ছাড়া এই বাড়ি অন্ধকার। তোমার ভাইজানের তো অহংকারের শেষ নেই। অহংকারের দাপটে ঘরের সর্বস্ব হারিয়েছেন তিনি। আর কী কী হারানোর বাকি আছে, কে জানে!’
হায়দার সাহেব ডগডগ করে সামান্য পানি পান করে বললেন,
-‘এখন রিসোর্টে গিয়ে কী করবি? টোটোনকে পাবি?’
রাস্তা যতদূরের হোক, একবার তো রিসোর্টে যেতেই হবে। শেষবেলা যদি দেখা করার সুযোগ পায়, কথা বলে রাগ-অভিমান মিটিয়ে নেয়ার সুযোগ পায়। সম্পর্ক বাঁচানোর জন্য হলেও তাকে যেতে হবে। পাবে কি পাবে না, সেই হিসাবেই গেল না মাহদিয়া। শুধু বলল,
-‘চেষ্টা করে দ্যাখি! আমার ভাগ্যটাই খারাপ। এত বছরের অপেক্ষার পর ও’কে এত কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম। কেন যে এমন বোকামি করলাম…।’
যত দেরী করবে, সময় নষ্ট হবে। পাখির ডানায় ভর দেয়ার মতোই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। নিজের বোকামি ও ভুলের কারণে এত দামী সম্পর্কে রাতারাতি বিচ্ছেদ চাইছে না মাহদিয়া। যেভাবেই হোক, শাদাবকে মানাতে হবে। তাই ছুট দিল সে। হায়দার সাহেব এই মেয়েটার চিন্তায় অস্থির। এদের ভবিষ্যৎ যে কী, সেটা চিন্তা করলেই বুক কেঁপে উঠে তাঁর। দীর্ঘবছরের ভালোবাসা, বিশ্বাস, সাপোর্ট থাকার পরও দুটো মানুষের সংসার ঠিকল না, সেখানে ওদের সম্পর্ক তো খুঁটিহীন ঝুলন্ত এক সেতু। এপার-ওপার দুটো পারই নড়বড়ে। এতটাই নড়বড়ে যে, এই সেতু মজবুত করতে গেলে দু’জনকেই রাতদিন এক করে সম্পর্কের কথা ভাবতে হবে। অথচ ভাগ্য ওদের কারও সহায় হচ্ছে না। তীরে এসে তরী ডুবে যাচ্ছে। সম্পর্ক কাঁচানোর প্রবল ইচ্ছেশক্তি থাকার পরও, নিয়তির কাছে ওরা যেন কাঠের পুতুল হয়ে আছে একেকজন। চাইলেও কিছু করতে পারছে না। ভালোবাসলেও সেই ভালোবাসার জোর দিয়ে একসাথে থাকতে পারছে না। ভাগ্যের ওপর যদি সবকিছু ছেড়ে দেয়, তবে কী হবে এই সম্পর্কের পরিণতি? মাহদিয়ার দৌড়ের পানে তাকিয়েই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিড়বিড় করলেন,
-‘কিছু স্বার্থপর মানুষের জন্য আজ দুটো নিষ্পাপ মনের ভালোবাসা হেরে যাচ্ছে। খোদা, তুমি ওদের সহায় হও। ওদের সম্পর্ককে কবুল করে নাও। একমাত্র তুমি-ই পারো কোনো মিরাকল ঘটাতে।’
রিসোর্টে পৌঁছে, রিসেপশনিস্টের কাছে যাওয়ার আগেই জাইমার সাথে দেখা হয়ে গেল মাহদিয়ার। তাকে এত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে অবাক হলো জাইমা। চেহারার ভাবভঙ্গি দেখে আঁৎকে উঠে বলল,
-‘একী ভ্রমর! দুর্ঘটনা ঘটল কী করে? সুস্থ শরীরে বাড়ি গিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরলে! শিহাবও অসুস্থ হয়ে গেল। কী হয়েছে বোলো তো?’
ঘনঘন নিঃশ্বাস নিল মাহদিয়া। কোমরে হাত দিয়ে অশান্ত চোখ নিয়ে চারপাশে তাকিয়ে পরিচিত মুখ দেখতে না পেয়ে বলল,
-‘শিহাব এখন কোথায় আপু? ওদের কারও সাথে দ্যাখা হয়েছে তোমার?’
-‘মাত্র পনেরো মিনিট আগেই ‘ছাতক’-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল ওরা। কিন্তু তুমি এত অস্থির কেন এটা বোলো? দ্যাখি বোসো একটু। শান্ত হও।’
হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদলে, নিজেকে দশ-বারোটা চড় থাপ্পড় মেরে, রক্তাক্ত করে ফেললেও বোধহয় অপরাধবোধ কমবে না। কী বোকা বোকা কাজ করল এইটা? তারজন্যই হাসিখুশী একটা সকাল, আচমকাই কান্নায় রূপ নিল। শান্ত হওয়া তো দূর, নিজের এই বোকামির জন্য টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে অকারণ বকবক করতে করতে নিজেকে হাজারটা গালি শোনাল মাহদিয়া। জাইমা পাশে বসে বোতল থেকে পানি ঢেলে দিল গ্লাসে। কাঁধে হাত রেখে বলল,
-‘এত অস্থির হয়ো না। কী হয়েছে আমাকে বোলো?’
-‘আমাদের সম্পর্কটা জোড়া লাগবার নয় আপু! নিজের বোকামির জন্য আবারও ও’কে হারিয়ে ফেললাম। এতটাই বেখেয়ালি ছিলাম যে, ঠিকানাটা অবধি চাইতে ভুলে গিয়েছি। আমার দোষেই শিহাব আজ অসুস্থ।’
জাইমা তাকে পানি খাওয়াল। শান্তস্বরে বলল,
-‘শিহাবের এরকম হয় মাঝেমধ্যে। জটিল সিচুয়েশন ও সামলাতে পারে না। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার মতো ব্রেইন ওর তৈরী হয়নি এখনও। হয়তো এমনটা হওয়ার ছিল। এরজন্য নিজেকে দোষী ভেবো না। ও সুস্থ হয়ে যাবে। তুমি তোমাদের সম্পর্কের কথা ভাবো। কীভাবে তাকে স্বাভাবিক করবে, সেসব চিন্তাভাবনা কোরো।’
মাহদিয়া হতাশ গলায় বলল,
-‘ওর দেয়া অপশনের চাপে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি আপু। বুঝতে পারছি না, কাকে রেখে কাকে চাইব! জীবনে মায়ের মূল্য যতখানি, যতখানি ঋণ, সেসবই তো শোধ করতে পারব না কোনোদিন। বিচ্ছেদ কী করে টানব মায়ের সাথে?’
জাইমা তার দুঃখ বুঝতে পারল। হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ ছুঁয়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘স্নেহ-মায়া-মমতার চেয়ে একজন মায়ের কাছে যখন স্বার্থসিদ্ধির জন্য সন্তান ও তার বৈবাহিক সম্পর্ক একটা ছোট্ট মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, তখন ঋণ শোধের প্রশ্ন কেন আসবে ভ্রমর? মানছি, তোমার মা তোমাকে ভালোবাসেন। তোমাকে আদর-যত্ন দিয়ে লালন-পালন করেছেন। কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। সবকিছুর মাঝে তোমার প্রতি শুধু মায়ের ভালোবাসাটা লুকিয়ে ছিল না রে বোকা, তুমি ছিলে তার লোভ, স্বার্থ ও বড়ো হওয়ার পথের এক এবং একমাত্র রাস্তা।’
জাইমার এই কথায় অবাক হওয়ার বদলে খুব রাগ হলো মাহদিয়ার। রাগান্বিত স্বরে ফুঁসফুঁস করে বলল,
-‘কাউকে না জেনে তার সম্পর্কে অভিযোগ করাটা মোটেও শোভনীয় নয় আপু। আমার মা’কে তুমি কতটা চিনো?’
-‘তোমার মা’কে তুমি কতটা চিনো ভ্রমর?’
মাহদিয়া চমকাল। রাগ সরে গিয়ে কপালে পড়ল দুঃশ্চিতার ভাঁজ। সন্দেহ জাগল মনে। আসলেই কি মা’কে সে চিনে? কতটা চিনে? চোখে বিস্ময় ও কৌতূহল। মনে প্রচণ্ড ভয়। জাইমার পুরো কথা বুঝতে না পেরে কিছুটা আমতা-আমতা স্বরে বলল,
-‘মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?’
মাথা ঠাণ্ডা রাখল জাইমা। শান্তশিষ্ট মেজাজে ধীরকণ্ঠে বলল,
-‘তোমার মা’কে আমি যতটুকু চিনি, শাদাব যতটুকু চিনে, তার অর্ধেকও তুমি চিনো না।’
নিজের জায়গায় স্থির ও পাথর হয়ে গেল মাহদিয়া। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
-‘কী বলতে চাইছ তুমি? দ্যাখা নেই, কথা নেই, কেউ কী করে আমার মা’কে আমার চাইতেও বেশি চিনতে পারে?’
আহা! মায়ের প্রতি সন্তানের এই ভালোবাসাটুকু দেখে মুগ্ধ হলো জাইমা। প্রতিটা মা ও সন্তানের সম্পর্কই তো এমন হওয়ার উচিত। বিশ্বাসের, ভরসার, সহমর্মিতার। অথচ কারও কারও মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক শুধু স্বার্থের জন্যই। মাহদিয়ার বেলায়ও সেটাই ঘটেছে। বোকা মেয়েটা জানেও না, চোখের দেখায় যা সে ভালোবাসা হিসেবে দাবী করছে, আদৌ সেসব তার মায়ের ভালোবাসা নয়! কেবল একটুকরো ছলনা মাত্র। মাহদিয়ার মনের ভেতরের অবস্থা ও তার জীবনের পরবর্তী দুর্ঘটনা ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘আমি কথাগুলো তোমাকে বলতাম না। কিন্তু বলব এই কারণে, তোমরা দু’জন-দু’জনকে ভালোবাসো। সম্পর্কটার মূল্যায়ন কোরো। অথচ ভাগ্য তোমাদেরকে বার বার দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমার কথাগুলো বিশ্বাস করবে কি-না সেটা তোমার মন-ই ভালো বুঝবে। যদি এরপরও তুমি বুঝতে না পারো, সম্পর্ক নিয়ে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে না পারো, তবে আমি বলব শাদাবের জীবন থেকে তোমার দূরে সরে যাওয়াই উত্তম। তুমি ছাড়া ও ভালো ছিল, ভালো থাকবেও।’
জাইমার কনফিডেন্ট লেভেল দেখে অবাক হলো মাহদিয়া। কী এমন কথা, যা জানার পর ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া তারজন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে! সে চোখেমুখে বিস্ময়ের পাশাপাশি আগ্রহ জাগিয়ে তুলে বলল,
-‘তুমি এতটাই নিশ্চিত যে, তোমার কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য? আই মিন, সব কথাই আমার মনে সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য করবে!’
ঠোঁট চেপে হাসল জাইমা। বলল,
-‘বোকা বোকা চিন্তাভাবনা মাথা থেকে সরাও। আর আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। তোমারই ভালো হবে।’
***
শিহাবের জন্মের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে তখন। পারিবারিক সাপোর্ট ও হাসি-আনন্দে পিছনের অধ্যায়টুকু ভুলে যেতে পেরেছেন সায়রা করীম ও শাদাব। কিন্তু কোথাও যেন অতীত দুটো মানুষের অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছিল। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে শাদাব যখন ধীরে ধীরে কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে যৌবনে পা রাখল, তখন থেকেই অতীতের সোনালী দিনগুলো তাকে পোড়াতে লাগল। পরিবার থেকে দূরে যাওয়াতে তখন নোকিয়া ফোনের সিম পালটে দিতে হয়েছিল তাকে। ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল ওই সিম। ফলে সিমে থাকা বেশ কয়েকটা নম্বর হারিয়ে যায়। শায়লা সুলতানার সাথে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। মনের ভেতর ছোট্ট একটুকরো অনুভূতি জেগে উঠে শাদাবের। অনুভূতিটাকে চিরদিনের জন্য নিজের করার লোভে মরিয়া হয়ে যায় সে। দিশেহারা হয়ে শায়লা সুলতানার নম্বর খুঁজে। কোত্থাও নেই। সিম নেই, নম্বর নেই, কোনো খোঁজখবর নেই। শায়লা সুলতানা নিজে থেকেও কোনোদিন যোগাযোগ করতে পারেননি। শেষমেশ নূরুন্ নাহারের মাধ্যমেই যোগাযোগের একটা ছোট্ট রাস্তা পায় শাদাব। তার দেয়া নম্বরের মাধ্যমে ফোন করে ইতালি। প্রথমদিন শায়লা সুলতানা ও সায়রা করীম খুব চমৎকারভাবে কথোপকথন চালিয়ে যান। শিহাবের বেশ কয়েকটা ছবিও পাঠানো হয়। তিনি বেশ খুশিও হোন এতে। কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহ থেকেই ঝামেলা শুরু হয়। শাদাব ফোন দিয়ে জানতে চায়,
-‘আন্টি একবার ভ্রমরকে দেয়া যাবে? দু’মিনিট কথা বলব ওর সাথে।’
শায়লা সুলতানা হাসিমুখে বলতেন,
-‘ও তো স্কুলে বাবা। ফিরলে আমি নিজে কল দিব।’
ব্যস। সপ্তাহ কেটে যেত। মাস যেত। কোনো রিটার্ন কল আসত না। শাদাব অপেক্ষা করতে করতে আবারও ফোন দিত। বলত,
-‘ব্যস্ত না হলে ভ্রমরকে একবার ফোনটা দিন না আন্টি!’
শায়লা সুলতানা বার দু’য়েক মাহদিয়াকে ডাকতেন। বলতেন, ‘দিয়া তাড়াতাড়ি আয়, টোটোন ফোন করেছে’। কিন্তু কাছেপিঠে কোথাও মাহদিয়ার গলার আওয়াজ শোনা যেত না। কয়েক মিনিট পর তিনি বলতেন,
-‘ও খেলছে বাবা। পরে ফোন কোরো?’
এভাবে আরও এক সপ্তাহ কেটে যেত। পূণরায় শাদাব কল দিত। তিনি শোনাতেন,
-‘দিয়া ওর বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে আছে।’
হতাশা ঘিরে ধরত শাদাবকে। ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারত না। সারাক্ষণ বুক চিনচিনে এক ব্যথা নিয়ে দিনের পর দিন কেটে যেত। ক্লাসের সবাই তাকে না বুঝলেও বন্ধুবান্ধবরা বেশ কয়েকজন জানত, সে বিবাহিত ব্যাচেলর। জাইমা তার পানসে মুখ দেখে জানতে চাইত,
-‘কী রে? মন খারাপ কেন?’
-‘এত চেষ্টা করি বড়ো আপা! একটাবার ভ্রমরের সাথে কথা হয় না। ও কী আমায় ভুলে গেল?’
চোখদুটো ভরে উঠত তার। জাইমা তাকে সান্ত্বনা দিত। শাদাব হাল ছাড়ত না। কয়েকদিন পরপরই ফোন করত। একদিন বিরক্ত হয়ে শায়লা সুলতানা বলেন,
-‘দিয়া তোমার সাথে কথা বলতে চায় না বাবা। টোটোন নামে কাউকে চিনে না। ভুলে গেছে।’
-‘আমি বিশ্বাস করি না আন্টি! একবার ওর হাতে ফোনটা দিন। প্লিজ…!’
কাতর গলায় ফোন কানে ঠেকিয়ে অপেক্ষা করত শাদাব। শায়লা সুলতানা কোনোভাবেই ফোনটা মেয়ের কাছে দিতেন না। এভাবে শাদাবের এমবিবিএস শেষ হয়। বড়ো হওয়ার পর, বুঝ হওয়ার পর সে পূণরায় কল দিয়ে মাহদিয়ার সাথে কথা বলতে চায়। শায়লা সুলতানা তখন তাকে বিদ্রুপ করে বলতেন,
-‘তোমার হাতে আমি আমার মেয়েকে দিব না বাবা। ভুল করেছি বিয়ে দিয়ে। আমার ওইটুকুন মেয়ে! কী বুঝে এসব বিয়ের। ছলেবলে কৌশলে তোমরা আমার মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছ।’
শাদাব চমকাত। বিস্মিত স্বরে জানতে চাইত,
-‘এসব কী বলছেন আন্টি? আইনত ও আমার স্ত্রী। বয়স কম হলে কী হবে, আমি ও’কে যথেষ্ট মর্যাদা দেব।’
-‘ঘর নেই, বাড়ি নেই, তার আবার বউ পালার শখ! কেনরে বাবা, এত শখ কেন? রাস্তায় বসে ভিক্ষা করতে পারো না? দ্যাখো, ওখানেও তো কত রাস্তার মেয়েরা ঘুরে বেড়ায়। তাদের একজনকে ধরে এনে বিয়ে করে সংসার কোরো। ভুল করেও আর জীবনে তুমি এখানে ফোন করবে না। তোমার মতো ঘরবাড়িহীন, বাপের পরিচয়হীন, ফকির-মিসকিনের কাছে আমি আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারব না।’
ইন্টার্নশিপ শুরু হয় শাদাবের। তবুও সে থেমে থাকে না। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকেই ইতালি ফোন দেয়। লাভ হয় না। একটা সময় সেই নম্বরে আর যোগাযোগ করা যায় না। নিজের জন্য, সম্পর্ক বাঁচানোর জন্য, বহু চেষ্টা করে শাদাব। পূণরায় নূরুন্ নাহারের মাধ্যমে নতুন নম্বর আনায়। ফোন দেয়ার পরই তিনি ব্লক করে দেন। শাদাব সিম পালটায়। আবার কল দেয়। আবার কথা বলতে চায়। কিন্তু শায়লা সুলতানা অনড়। ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তিনি তার আসল রূপ দেখিয়ে দেন। সায়রা করীমের এত বড়ো ক্ষতি করার পরও শাদাব চেয়েছিল, মাহদিয়াকে গ্রহণ করে নিতে। এরজন্যই তার যত চেষ্টা, যত গালমন্দ শোনা। সবশেষে উচ্চতর শিক্ষা ও পরিপূর্ণ ডাক্তার হওয়ার জন্য পাঁচ বছরের জন্য কানাডায় পাড়ি জমায় শাদাব। সেখানে গিয়েও যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। শায়লা সুলতানার গালি, বকা, নানানরকম অপমানজনক কথা শোনেও দাঁত কামড়ে সেসব সহ্য করে শুধু মাহদিয়ার সাথে একবার কথা বলতে চাইত। ব্লক করলেও অন্য নম্বর দিয়ে ঠিকই যোগাযোগ করত। অথচ তার ‘ভ্রমর’ না কোনোদিন খোঁজ পেয়েছে, আর না কোনোদিন জানতে পেরেছে, একটা মানুষ দিনরাত তার জন্য দেশের এককোণে প্রতিনিয়ত ছটফট করেছে শুধু সম্পর্কটা বাঁচানোর জন্য। শেষমেশ একদিন তো শায়লা সুলতানা বলেই ফেললেন, ‘দিয়ার অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হয়েছে। তুমি তাকে ভুলে যাও।’ বিশ্বাস করেনি শাদাব। কিন্তু ফেলে দিতেও পারছিল না। শায়লা সুলতানা যেভাবে তাকে অপমান করেছেন, তাতে বেশ স্পষ্ট তিনি আর মেয়েকে শাদাবের হাতে তুলে দিবেন না। তার ঘরবাড়ি নেই, টাকা-পয়সা নেই, যা আছে সব অন্যের দয়াদাক্ষিণ্য! তার মন শুধু বার বার বলছিল, ‘একবার ফিরে এসো ‘ভ্রমর’।’ ফেরা হয় না। ‘ভ্রমর’ আসে না। অপেক্ষাও ফুরোয় না। সময়ের সাথে সাথে কতকিছু পালটায়, কিন্তু শাদাব পাল্টায় না। তার বক্ষপিঞ্জিরায় চঞ্চল ‘ভ্রমর’ রোজ আপনসুরে ডানা ঝাপটে তাকে অনবরত ডাকতে ডাকতে পাগল করে দেয়।
কথা শেষ করে মাহদিয়ার দিকে দৃষ্টি ফেলল জাইমা। মেয়েটা নীরবে গাল ভাসিয়ে কাঁদছে। মায়ের এই রূপ এমনিতেও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। এখন আরেক রূপ জেনে ভেতর আর আস্তো রইল না। বিশ্বাস ভাঙার পাশাপাশি তিলতিল করে জমানো এতদিনের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাটুকু একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করল। সে কান্নামাখা কণ্ঠে বলল,
-‘যা বললে সব সত্যি আপু?’
-‘একফোঁটাও মিথ্যে নয় ভ্রমর। সবটাই শাদাব আমাদের সাথে শেয়ার করেছে। নিজের সুখ, কষ্ট সবকিছু।’
নূরুন্ নাহারকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাড়ানো। তাকে বার বার দেশে আসতে নিষেধ করা। সম্পর্কটাকে তুচ্ছ বুঝানো। সবকিছুই আজ বুঝিয়ে দেয়, শায়লা সুলতানা কখনওই চাননি, মাহদিয়া আর দেশে ফিরে আসুক। সম্পর্ককে মূল্য দিয়ে চিরদিনের জন্য এখানেই থেকে যাক। শাদাবের এত ফোনকল, এত কাকুতিমিনতির সুর, সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে মা হয়ে তিনি মেয়েকে দীর্ঘ বিচ্ছেদের যন্ত্রণা উপভোগ করিয়েছেন। আজ সবকিছু জেনে ও বুঝে একটাই কথা মনে হচ্ছে তার। মা তাকে শুধু ব্যবহার করেছেন। তাদের সম্পর্কে থাকা পবিত্র সিলমোহরটাকে গুটি সাজিয়ে সম্পত্তির দখলদারি পেতে চাইছেন। ইশ, তার মায়ের মন এত নোংরা! এত নোংরা মনের মানুষের কোলে তার জন্ম? ওই মানুষটাকে ঘিরে তার এত শ্রদ্ধা, এত ভালোবাসা! কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে মাহদিয়ার। ভেতরটা বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণায় ক্রমাগত ছটফট করছে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। না পেরে টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মাহদিয়া। বিড়বিড় করল,
-‘আমার এতদিনের বিশ্বাস নিয়ে তুমি এইভাবে খেললে মা? দুটো মানুষকে এইভাবে দূরে সরিয়ে দিলে? শুধু তোমার জন্য আমরা আজ বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। এত কষ্ট দিয়েছ তুমি আমাদের! সামান্য সম্পত্তির জন্য নিজের মেয়েকে দাবার গুটি বানিয়ে ফেলেছ। তোমার এই জঘন্য রূপের বিস্তার কতটুকু মা! এতটুকু? না-কি এরচেয়েও জঘন্য? আমার তো ভাবতেই খারাপ লাগছে, এই তোমাকে আমি এত ভালোবাসি!’
তখনও স্থির হতে পারছে না মাহদিয়া। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। শাদাবের ঠিকানা নেই, ফোন নম্বর নেই। নিজেকে তার বড্ড উদ্ভ্রান্ত মনে হচ্ছে। সে ক্রমশ কেঁদেই যাচ্ছে। কান্নাই যেন এখন তার সব সময়ের সঙ্গী। জাইমা তাকে কাঁদার সুযোগ দিল। ভাববার সময় দিল। বেশ খানিকক্ষণ পর মাহদিয়া স্বাভাবিক হলে বলল,
-‘যা সিদ্ধান্ত নিবে, অবশ্যই ভেবে নিও। আমি বলছি না, তুমি তোমার মা’কে ছেড়ে দাও। আমি শুধু বলব, একটু ভেবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সুন্দর জীবনের জন্য এগোও।’
মাহদিয়া কান্না মুছল। ফোন বের করে শাদাবের নম্বরে ডায়াল করল। তখনও তা সুইচড অফ। হারানোর কষ্টে সে ভেঙে গেল পুরোটাই। অসহায় কণ্ঠে বলল,
-‘ওর সাথে যোগাযোগের কোনো অপশন নেই আপু। ফোন তো বন্ধ।’
হাত বাড়িয়ে তার ফোনটা টেনে নিল জাইমা। ঝটপট একটা নম্বর তুলে দিল। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে কলম ও কাগজ বের করে কয়েক লাইনে একটা ঠিকানা লিখে মাহদিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল। আলতো হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। কীভাবে কী করবে, তা আর আমি বলব না। এখন যা করার তোমাকেই করতে হবে। হয় বাঁচাও, নয় মারো। দুটোর মধ্যে একটা করে, দীর্ঘ বিচ্ছেদের এই সম্পর্কটাকে কঠিন যন্ত্রণা থেকে মুক্ত কোরো।’
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — উনত্রিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
আধশোয়া হয়ে দু’চোখ বন্ধ করে আছে শিহাব। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল ও ব্যথাতুর। হাত-পা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যথায়। এক হাতে ক্যানোলা লাগানো। স্যালাইন চলছে। প্রেশার ফল করার পাশাপাশি শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে। রিসোর্টে টানা কয়েকবার প্রথমে বমি-ই করেছে। পেটের ভেতরের প্রত্যেকটা চামড়ায় যেন ব্যথা বসে আছে এখন। শরীরের এই অবস্থার কারণে পুরোপুরি ঘুমায়নি আবার জেগেও নেই। চোখ বন্ধ করে ভাইয়ের সান্নিধ্য ও সেবাযত্ন উপভোগ করছে সে। শাদাব তার পাশে বসে একাধারে তাঁর সিনিয়র ও সিলেট মেডিক্যালের স্বনামধন্য সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলছে। শিহাবের জন্মের পর থেকে এই ডাক্তারের তত্বাবধানে ট্রিটমেন্ট হচ্ছে তার। নিজে ডাক্তার হলেও শিহাবের মেন্টাল কান্ডিশনের কারণে যেকোনো সময় এই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় তাকে। আজও যখন পুরো বিষয়টা খুলে বলল, সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে একটা সাজেশন দিলেন। কীভাবে পুরো ব্যাপারটা শিহাবের সাথে পজেটিভভাবে প্রকাশ করবে, তার মন ও মস্তিষ্ককে ফ্রেশ হয়ে কোনোপ্রকার প্রেশার না দিয়ে, ঘটনা সম্পৃক্ত সমস্ত আলাপ-আলোচনা খোলাখুলিভাবেই উপস্থাপন করতে বলবেন। এরপর থেকেই দুঃশ্চিন্তায় পাগল পাগল লাগছে তার নিজেকে। কায়ছার সাহেব ও মাহদিয়াকে ঘিরে পুরো সত্যতা কীভাবে হজম করবে, কতটা প্রভাব ফেলবে তার মনে, এটা ভেবেই অস্থির হয়ে আছে শাদাব। তবে ডাক্তার এটা বলেছেন,
-‘যদি শিহাব নিজে থেকে জানতে চায়, তবেই তুমি সত্য প্রকাশ করবে। ওর রি’অ্যাক্ট দ্যাখবে। তারপর পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলবে। অন্যথায় ওর কাছ থেকে জোরপূর্বক কিছু জানতে চেয়ো না, নিজে থেকেও কিছু বোলো না। পুরো ব্যাপারটা এখনও ওর কাছে অস্পষ্ট। আপাতত বিশ্রামে থাকুক, একটু সুস্থ হলে তারপর ওর শারিরীক উন্নতি বা অবনতি আমাকে জানিও।’
সায়রা করীম রুমে এসে শিহাবের মাথার কাছে বসলেন। শাদাব অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে মিনমিন স্বরে বলল,
-‘স্যরি…।’
সায়রা করীম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-‘ফ্রেশ হয়েনে। আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবি? আমি আছি ওর পাশে।’
ঝটপট পায়ে নিজের রুমে চলে গেল শাদাব। শিহাবের চুলের ফাঁকে আঙুল নাড়াতেই চোখ মেলে তাকাল শিহাব। হাসিমুখে বলল,
-‘মনে হচ্ছে কতদিন পর তোমাকে দ্যাখেছি।’
অসুস্থ বাচ্চার মুখে আহ্লাদী কথা শোনে মনমরা মুখ নিয়েও সামান্য হাসলেন সায়রা করীম। মুখ নামিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
-‘আমিও তো আমার আদরের বাচ্চাটাকে অনেকদিন পর দ্যাখছি। ট্যুরে গিয়ে কেউ অসুস্থ হয়? মায়ের চিন্তা হয় না?’
শিহাব নড়েচড়ে মায়ের কোলের কাছে মাথা নামিয়ে আদরভরা কণ্ঠে বলল,
-‘এরপর থেকে নিজের খেয়াল রাখব। তুমি আর চিন্তা কোরো না। আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি কত স্ট্রংবয় তুমি জানো না?’
কত স্ট্রং সেটা পরিবারের সবাই ছাড়া আর কে জানে! মনের ভেতর এসব দীর্ঘশ্বাসের গল্প লুকিয়ে রেখে মুখে হাসি টেনে সায়রা করীম বললেন,
-‘একদম। আমাদের ছোটোন অনেক স্ট্রং। তারমতো স্ট্রংবয় আর হয়-ই না। এজন্যই সে অতিদ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।’
মা-ছেলের গল্পের মাঝখানেই শাদাবের পুরনো নোকেয়া ফোনটা বেজে উঠল। কয়েকবার বাজতে বাজতে লাইন বিচ্ছিন্ন হলো। ছেলের ফোন ধরার অভ্যাস তাঁর নেই, তাই সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন। চার থেকে পাঁচবার রিংটোন বাজার পর তিনি বুঝতে পারলেন, ওপাশের ব্যক্তি অধৈর্য্য। রিসিভ না করা পর্যন্ত থামবে না। হয়তো দরকারী ফোন। শিহাবকে বালিশে শুইয়ে রেখে দরজার সামনে গেলেন তিনি। মুখ বাড়িয়ে শাদাবকে ডেকে বললেন,
-‘টোটোন ফোন বাজছে তো বাবা। এদিকে একবার আয়।’
ততক্ষণে পরনের পোশাক পালটে টি’শার্ট, ট্রাউজার পরে হাতে এক কাপ কফি নিয়ে শিহাবের রুমে প্রবেশ করল শাদাব। সেন্টার টেবিল থেকে ফোন হাতে তুলে নিল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল অচেনা নম্বর। পরিচিতরা ছাড়া এটার নম্বর কেউ জানে না। প্রথমে মনে হলো রং নম্বর হবে হয়তো। পরক্ষণেই ভাবল, রং নম্বরে এতবার কল আসে না। বেখেয়ালি হলে মানুষ এক থেকে দুইবার কল দিবে। বার বার দিবে না। কফিতে চুমুক বসিয়েই রিসিভ করে কানে ঠেকাল ফোন। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন গলায় পরিচিত এক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
-‘শিহাব ঠিক আছে? সুস্থ আছে? কী করছে এখন? বিশ্বাস কোরো শাদাব, আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি এরকম কিছু হবে। তখন মা’কে আটকানোর জন্যই একটু ভুল থেকে এরকমটা হয়ে গেছে।’
কট করে লাইনটা কেটে দিল শাদাব। ফোন সাইলেন্ট করে কফি হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। সবকিছু বিষাক্ত মনে হচ্ছে তার। জীবনের সুর, ছন্দ, তাল, সে-ই কবেই হারিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে বেঁচে থাকাটা অনর্থক মনে হয়। এত কেন হাহাকার থাকবে জীবনে? এত কেন কষ্ট ও যন্ত্রণা থাকবে? কেন কারও জীবন পুরোপুরি সুখের হয় না? রাগ ও অভিমানের কারণেই পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাইছিল শাদাব। কিন্তু পারল না। অনবরত ফোনের কম্পনরত শব্দের কারণে রুম থেকে সায়রা করীম বললেন,
-‘কে ফোন করছে বার বার? জরুরী কিছু হয়তো। রিসিভ কর টোটোন।’
শাদাব জবাব দিল না। নির্বিকার ভাব নিয়েই কফি পান করতে লাগল। বিরক্ত হলেন সায়রা করীম। ফোন হাতে নিয়ে উঠে এলেন। শাদাবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-‘ওভাবে লাইন কেটে দিলি কেন? কে এতবার কল করছে?’
-‘কেউ না।’
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন সায়রা করীম। দেরী না করে নিজেই ফোন রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে আবারও একইভাবে মেয়েলী স্বরে ভেসে এলো,
-‘শাদাব আ’ম স্যরি।’
তিনটে শব্দের এই পরিপূর্ণ বাক্যতেই বুঝে ফেললেন, ওপাশের মেয়েলী স্বরটা কার। তিনি ছেলের মনের অবস্থা বুঝে ধীর ও স্পষ্টকণ্ঠে বললেন,
-‘ওর মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ। ফুলে ফেঁপে আছে একদম। যেকোনো সময় ফেটে যাবে।’
ওপাশে মাহদিয়া টাস্কি খেয়ে বসে রইল। মুখে হাত দিয়ে চোখদুটো বড়ো বড়ো করে তাৎক্ষণিক দু’দিকে নাথা নাড়ল। তীব্র অনুশোচনা ও অপরাধবোধ থেকে বলল,
-‘আন্টি…। আমি বুঝতে পারিনি শিহাব এত অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি ও’কে যথেষ্ট সেইফে রাখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু…।’
কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল মাহদিয়ার। অল্পতেই চোখ দিয়ে আষাঢ়ের ঝুমঝুম বর্ষা নেমে এলো। পূণরায় কাতর গলায় বলল,
-‘আমায় ক্ষমা করে দাও, আন্টি…।’
মাহদিয়ার অনুতাপের সুর এক মায়ের পাথর মনকে নিমিষেই গলিয়ে দিল। তিনি তার দুঃখ বুঝে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
-‘আমি বুঝতে পেরেছি মা। কেউ জেনে-বুঝে অন্যায় করে না। পরিস্থিতি সবসময় তো এক থাকে না। কখনও কখনও একটু বেশি-ই জটিল হয়ে যায়। মন খারাপ কোরো না। ওর মেজাজ ঠাণ্ডা হোক, নিজে থেকেই কল করবে।’
মাহদিয়া বুঝল, সায়রা করীমও অতি সুক্ষ্মভাবে তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন। শাদাব যে নিজে থেকে আর একটা কলও করবে না, এটা সে নিশ্চিত। তাই চেয়েছিল, কথা বলে রাগটা ভাঙিয়ে নিতে। একবার যদি ক্ষমা চাইবার সুযোগ না দেয়, তবে এই কঠিন মনে পূণরায় নিজের জন্য টান জন্মানোর কোনো সুযোগই সে পাবে না। নিজেকে খোলসের ভেতর রাখতে রাখতে বাধ্য হয়েই গতকাল একটু কাছে এসে প্রকাশ করেছিল, সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা। আবারও যদি খোলসের ভেতর সে ঢুকে পড়ে, তাহলে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর মতো কোনো পথই সে খোলা পাবে না। সায়রা করীমের ইঙ্গিত বুঝতে পেরেও ফোন রাখতে ইচ্ছে হলো না তার। কিছুটা থেমে থেমে বলল,
-‘শিহাব এখন কেমন আছে আন্টি?’
-‘ভালো আছে। আর কিছু বলবে মা?’
-‘না না আন্টি। আর কিছু বলার নেই। শিহাবের কথা জানার জন্যই ফোন করেছিলাম। রাখছি।’
ফোন রেখে রুম ছেড়ে বেরুলো মাহদিয়া। হাঁটতে হাঁটতে পুলসাইডে এসে কিটকটে বসল। আবছা আলোয় সুইমিংপুলের ঢেউখেলানো পানির দিকে তাকিয়ে রইল। গত দু’দিন আগে এখানেই চমৎকার কিছু মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিল সে। সম্পর্কের প্রতি সবটুকু ভালোবাসা, বিশ্বাস অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিল। খুব কাছে থেকে দেখেছিল একটা শক্ত মনের মানুষকে। যে গোপনে মনের কোণে ভালোবাসা জমিয়ে রেখেও কোনোদিন প্রকাশ করতে পারেনি। না পাওয়ার বেদনায় একাকী ছটফট করেছে। এখনও করছে। এই মান-অভিমান, এই দূরত্ব বোধহয় আসবারই ছিল! তাদের এই সম্পর্ক এখনও নড়বড়ে ও প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তা ভাঙনের দিকেই একেকধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। নয়তো খুব করে কাছে আসার আগেই কেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এসে সাজানো-গোছানো মনবাগিছা একদম তছনছ করে দিল!
***
-‘প্লিজ শাদাব, একবার কল রিসিভ কোরো। তোমার সাথে জরুরী কথা আছে আমার।’
ছোট্ট একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে, পুলসাইডে বসেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে মাহদিয়া। কপালে ব্যথার জায়গায় টনটন করছে। কোনো পেইনকিলার খাওয়ার সময়-সুযোগ পায়নি। এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল বৃষ্টিতে ভেজা, আজকের এই ধাক্কা, ক্ষুধার্ত পেট ও মনের এই দিশেহারা অবস্থাতে বেহাল দশা হয়েছে তার। উঠে দাঁড়ানোর একফোঁটা শক্তি শরীরে অবশিষ্ট নেই আর। তা-ই বসে বসে খোলা আকাশে জ্বলে ওঠা মিটিমিটি তারা গুনছে। তার অপেক্ষাকৃত মনকে চমকে দিয়ে ফোন বেজে উঠল। ভাবল শাদাবের ফোন এসেছে। কিন্তু না। তার ফোনের স্ক্রিনে বাবা নামক সম্বোধনটা জ্বলজ্বল করছে। অশান্ত, অস্থির মন নিয়েই ফোন রিসিভ করল। সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল। মেয়ের গলায় যে তেজ নেই এটা শুকনো গলার ফোনালাপেই বুঝে ফেললেন আজাদ সাহেব। বললেন,
-‘শরীর খারাপ মা? তোমার গলার আওয়াজ কেমন যেন শোনাচ্ছে!’
-‘না বাবা। আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার।’
-‘ম্যাসেজ পাঠিয়ে কিছু একটা সাহায্য চাইছিলে। কী হয়েছে বোলো আমাকে?’
সর্বোচ্চ শক্তি ও ধৈর্যের মাধ্যমে নিজেকে শক্ত রাখল মাহদিয়া। বলল,
-‘শাদাবকে খুঁজে পেয়েছি বাবা। আমি চাইছি, এখানেই থেকে যেতে। তুমি কী বলো? এখানে থাকা কি ভুল হবে আমার?’
আজাদ সাহেব স্পষ্ট বাক্যে উচ্চারণ করলেন,
-‘একদমই নয়। ভুল কেন হবে? তুমি যদি মনে কোরো, তুমি শাদাবের কাছে ভালো থাকবে, সম্পর্কটা ভুল নয়, সে যোগ্য স্বামী। পারফেক্ট না হোক, অন্তত বিশ্বস্ত। তবে আমার কোনো আপত্তি নেই মা।’
-‘তুমি এত সহজে রাজি হয়ে যাচ্ছ বাবা? তোমার কি মনে হয় না, আমার আরেকটু ভেবে এগোনো উচিত? কিংবা এই দেশ থেকে চিরদিনের জন্য দূরে চলে গিয়ে ভিনদেশী কাউকে বিয়ে করে সুখী হওয়া উচিত?’
-‘জীবন সাজাতে গেলে, দেশী কিংবা ভিনদেশী দিয়ে মানুষকে বিচার করতে নেই মা। সঙ্গী বাছাই করতে হয়, মনুষ্যত্ব দ্যাখে। সুন্দর, স্বচ্ছ ও পবিত্র মন দ্যাখে। এখানে দেশী-ভিনদেশী কোনো পয়েন্ট নয়। পয়েন্ট হচ্ছে, সম্পর্কটা বিশ্বস্ত ও ভরসার কি-না সেটা বোঝা।’
-‘তুমি বলতে চাইছ, শাদাব খুব বিশ্বস্ত একজন মানুষ!’
-‘ভাবীজানকে আমি যতটা চিনেছি, শাদাবকেও ততটাই চিনেছি। দীর্ঘ বছর যোগাযোগ না থাকলেও এটা নিশ্চিত যে, শাদাব ভালো মানুষ হতে পেরেছে। এমন গুণী মায়ের সংস্পর্শে থাকলে কোনো সন্তান খারাপ হয় না, হতে পারে না। তবুও যদি তোমার মনে কোনো কিন্তু থাকে, তুমি ভেবে দ্যাখতে পারো।’
-‘থ্যাংক য়্যু বাবা। থ্যাংক য়্যু সো মাচ্। তুমি দেশে ফিরছ কবে? আমি চাই, তুমি নিজে আমাকে শাদাবের হাতে তুলে দাও।’
-‘ঠিক আছে। দ্যাখছি, টিকিট পাওয়া যায় কি-না। আমার মা আমাকে পাশে চেয়েছে, আমি আসব না? শীঘ্রই আসব মা। শীঘ্রই আসব।’
অনেকদিন পর মন কিছুটা হালকা হলো মাহদিয়ার। মা তাকে না বুঝলেও বাবা বুঝেছেন, সম্পর্কটাকে মূল্য দিতে বলছেন, এইতো অনেক। ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হওয়া উচিত ছিল তার, কিন্তু নিজের মায়ের অমন জঘন্য মুখখানি মনে হওয়াতেই সমস্ত সুখ ধুপ করে নিভে গেল। মনের উঠোন জুড়ে মন খারাপের বৃষ্টি নামল। ঝুমবৃষ্টি তাকে একাই ভাসাল, ডোবাল, যন্ত্রণা দিল। কাউকে কিছু বলতেও পারল না, নিজের যন্ত্রণাটুকু লুকাতেও পারল না। মাথা হেলিয়ে বসে রইল কিটকটে। কখন যে দুর্বল শরীরখানি নেতিয়ে পড়ল পুরোটাই, টেরই পেল না মাহদিয়া। রাত বাড়ল, অন্ধকার গাঢ় হলো, রিসোর্টের সব টুরিস্ট ঘুমিয়ে পড়ল। সে একাকী একটা মেয়ে অবচেতন শরীর নিয়ে পড়ে রইল পুলসাইডে। কেউ দেখল না, জানল না, খোঁজও নিল না।
***
বাচ্চাদের নিয়ে সকালের সোনামাখা রোদ্দুর ছুঁয়ে দেখতে ও শরীরে চনমনে ভাব ফিরিয়ে আনতে হাঁটতে বেরিয়েছে জাইমা। এদিক-ওদিক হেঁটে পুলসাইডে এসে থমকে গেল তার দৃষ্টি। এলোমেলোভাবে কিটকটে শুয়ে আছে মাহদিয়া। ছুটে গেল সামনে। গায়ে হাত রেখেই চমকে গেল। শরীরের উত্তাপ বলে দিচ্ছে, জ্বর নেহাৎ কম নয়! দু’হাতে তাকে স্বাভাবিকভাবে বসিয়ে, অগোছালো চুল সরিয়ে মৃদুস্বরে ডাকল,
-‘ভ্রমর, এ্যাই ভ্রমর। ওঠো। এখানে কি ঘুমোনোর জায়গা?’
মাহদিয়া শুধু ‘হু’ উচ্চারণ করে আবার মাথা হেলিয়ে দিল। জাইমা ভয় পেয়ে গেল তার এই অবস্থা দেখে। হাতের আন্দাজে জ্বর ঠাহর করে বিড়বিড় করল, ‘ইশ, কী বেহুঁশের মতো ঘুমোচ্ছে দ্যাখো। ওর কী দোষ! গর্দভ ছেলেটা ওর সাথেই কেন এত রাগ দ্যাখাচ্ছে!’ রাতে সে দেখেছিল, মাহদিয়া অবিরত শাদাবকে কন্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওপাশের মানুষটা পাথর যে পাথরই। একবারও নড়ল না। ম্যাচিউরিটি থাকলে কী হবে, শারিরীক ও মানসিক ধাক্কাটা মাহদিয়া নিতে পারছে না। শরীরের চেয়ে মনে প্রভাব পড়ছে বেশি। তবুও মেয়েটা চাইছে, সম্পর্কটাকে বাঁচাতে। তার এই একপাক্ষিক এগিয়ে যাওয়া, ধৈর্য ও মনোবল দেখে মুগ্ধ হলো জাইমা। অসুস্থ মাহদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বুলিয়ে আবারও ডাকল,
-‘ভ্রমর, ওঠো। রুমে গিয়ে ঘুমোও। ঔষধ খাও। রাতেও তো কিছু খাওনি বোধহয়। শাদাবটা যে কী…। এত রাগ কীভাবে পুষে রাখে পুরুষ মানুষ! বুঝি না বাপু।’
কোনোমতে টেনেটুনে চোখ মেলল মাহদিয়া। সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল। পুরো মাথা ভার হয়ে আছে তার। শরীর দুলছে। থরথর করে কাঁপছে। জাইমা তাকে শক্ত করে ধরে বলল,
-‘আমি এগিয়ে দিচ্ছি, এসো। এখানে কেন ঘুমাচ্ছিলে?’
মাহদিয়া চারপাশে তাকাল। পুলসাইডে নিজেকে আবিষ্কার করে চমকে উঠল। তৎক্ষনাৎ কিটকটে থাকা ফোন হাতে নিয়ে কললিস্ট চেক করল। কোনো কল আসেনি। ম্যাসেজেরও রিপ্লাই আসেনি। রাতের কথা মনে পড়তেই চোখ ভিজে উঠল। শরীর তো দুর্বল ছিলই, এবার আরও দুর্বল হলো। সামনের দিকে পা ফেলবার আগেই বসে পড়ল আগের জায়গায়। বলল,
-‘আমি এখানেই ঠিক আছি আপু। মাথা দুলছে আমার। রুম অবধি যেতে পারব না।’
-‘এটা কী করে হয়? অসুস্থ শরীর নিয়ে এখানে কেউ এইভাবে ঘুমোয়? যদি খারাপ কিছু হোতো? কষ্ট করে পা ফেলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি। অল্পকিছু খেয়ে, ঔষধ খাওয়ার পরপরই একটু বিশ্রাম নিবে।’
মনে জোর এনে, জাইমার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল মাহদিয়া। গুটি গুটি পা ফেলে এগোলো। পিছনে থাকা বাচ্চাদুটো নিজের মাকে উদ্দেশ্য করে হাঁটতে লাগল। জাইমা একবার বাচ্চাদের দিকে নজর দিল। বলল,
-‘ইনা, মিনা পিছনে না হেঁটে সামনে এসে হাঁটো।’
ওরাও তাই করল। সামনে এসে হাঁটতে লাগল। জাইমা বহু কষ্টে মাহদিয়াকে নিয়ে রুম অবধি এসে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল আগে। ইন্টারকম তুলে সামান্য কিছু নাশতা অর্ডার করল। বাচ্চাদের বসিয়ে রেখে ঝাটপট নিজের রুমে এসে জ্বরের ঔষধ নিল। ছোটোখাটো একটা ফাস্টএইড বক্স সাথে থাকে জাইমার। যেকোনো ভ্রমণে, যেকোনো জায়গায় তৎক্ষনাৎ প্রয়োজন হলে হাতের নাগালেই যেন প্রয়োজনীয় ঔষধটা পেয়ে যায়, এজন্যই এই ব্যবস্থা।
মাহদিয়ার কাছে এসে দেখল, মেয়েটা একাধারে চোখের জল ফেলছে আর বিড়বিড় করছে,
-‘আমার বোধহয় মরে যাওয়াই উচিত। মা-ও মুক্তি পাবে, শাদাবও মুক্তি পাবে। আমার জীবনে দু’জনেরই প্রয়োজন। অথচ তাদের জীবনে আমার কোনো প্রয়োজনই নেই। আমি তো দু’জনার জন্য দিনকেদিন বাড়তি ঝামেলা হয়ে যাচ্ছি। মৃত্যু দাও খোদা, তুমি আমার মৃত্যু দাও।’
জ্বরের তোপে এসব ভুলভাল বকছে মাহদিয়া। জাইমা সেসব কথা কানে নিল না। ছোট্ট একটা বালতির মধ্যে পানি এনে মাথায় ঢালল। টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছিয়ে, খুব সাবধানতা অবলম্বন করে পরনের নষ্ট হওয়া পোশাক পালটে দিল। ওয়েটার খাবার নিয়ে আসলে, অল্পস্বল্প স্যুপ ও কড়া এককাপ কফি খাওয়াল। না চাইতেও জাইমার এই সেবাশুশ্রূষাটুকু বড্ড ভালো লাগল মাহদিয়ার। ঔষধ খেয়ে কৃতজ্ঞতাচিত্তে তাকিয়ে বলল,
-‘থ্যাংক য়্যু আপু। তোমাকে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি।’
জাইমা হেসে ফেলল। বলল,
-‘আমি তো ভাবলাম, জ্বরে তোমার টালমাটাল অবস্থা। এখন তো দ্যাখছি, তুমি দিব্যি সেন্সে আছো! শরীরটা কি একটু হালকা লাগছে এখন?’
-‘হ্যাঁ। আগের চেয়ে ভালো। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, এই কারণেই বোধহয়। গতকালও কোনো ব্যথার ঔষধ খাইনি। সুযোগ পেয়ে জ্বর বাবাজি ঘাড়ে চড়ে বসেছেন।’
-‘এখন একটু বিশ্রাম নাও। পরে আবার আসব। কিছু দরকার পড়লে কল করতে ভুলো না।’
***
রাত থেকে শাদাবের মনের ওপর দিয়ে ছোটোখাটো ঝড় যাচ্ছে। সে নিজের মেজাজ কন্ট্রোল করার জন্যই তখন কল রিসিভ করেনি, কথা বলেনি। কারণ, রাগটা একদম কড়া ছিল। যখন-তখন যা খুশি বলে ফেললে মাহদিয়াই তাকে ভুল বুঝত। এই কারণে, অকারণ যেন মেয়েটার ওপর চোটপাট করার সুযোগ না তৈরী হয় সেজন্যই ফোনে কথা বলাটা এড়িয়ে গেছে। কিন্তু সায়রা করীম এতে ভীষণ আহত হয়েছেন। মাহদিয়ার কথা শোনেই বুঝেছেন, মেয়েটা মনের ওপর আর জোর দিতে পারছে না। কিছু বলতে চেয়েও খুব সুন্দরভাবে কথা ঘুরিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে, শুধু শাদাবের নীরবতা দেখে। এরপর থেকেই একাধারে ছেলেকে বকছেন তিনি। বার বার বলছেন,
-‘টোটোন, তুই ওর সাথে অন্যায় করছিস। মেয়েটা অপেক্ষা করছে, একবার ফোন কর। কিছু বলার থাকলে বল। কেন শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছিস? ওর তো কোনো দোষ নেই! এটা হওয়ার ছিল, তা-ই হয়েছে।’
কিন্তু না। শাদাব নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়েই-নি। অনড় থেকেই যন্ত্রণাময় এক নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। ঘুম ভাঙার পরই জাইমা আবার আরও একটা দুঃখজনক বার্তা পাঠিয়েছে। এটা শোনে সায়রা করীম থেকে থেকে আগুনের ফুলকির মতো রাগে ফুঁসছেন। পারছেন না শুধু এতবড়ো ছেলের গায়ে হাত তুলতে। শাদাবও বকাঝকা শোনে একটা সময় নরম হয়ে শিহাবকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে নিজের রুমে এলো। কললিস্ট থেকে মাহদিয়ার নম্বর বের করে ডায়াল করে সেটা রিসিভের অপেক্ষায় রইল। দু’বার রিংটোন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ হলো সেটা। তবে কোনো আওয়াজ আসলো না। বার তিনেক হ্যালো-হ্যালো বলেও কাঙ্ক্ষিত রমণীর থেকে কোনো শব্দ পেল না শাদাব। বেশ খানিকক্ষণ পর নীরব হয়ে উপলব্ধি করল, অভিমানী মেয়ের গাঢ় নিঃশ্বাস ও ফুঁপানির শব্দটাকে। বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যেতে লাগল তার। কণ্ঠ নামিয়ে ডাকল,
-‘ভ্রমর…। শুনতে পাচ্ছ?’
কাঁদোকাঁদো গলায় ভেসে এলো,
-‘না। ভ্রমর শুনতে পায় না।’
-‘কেন? কানে তালা দিয়েছে?’
-‘তালা নয়, তুলো দিয়েছে।’
-‘বেশ, এখন তাকে তুলো সরিয়ে মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনতে বোলো।’
-‘তোমার কোনো কথা-ই আমি শুনব না।’
-‘জেদ কোরো না ভ্রমর। অনুরোধ করছি…।’
-‘গতকাল আমিও তো কতবার করে অনুরোধ করলাম, রেখেছ আমার কথা? কত সহজেই ইগনোর করেছ।’
এ পর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাদাব। বলল,
-‘মেজাজটা আউট অব কন্ট্রোল ছিল, ভ্রমর। যা-তা বলে ফেলতাম। আমি তোমায় ইগনোর করিনি শুধু নিজের জন্য কিছুটা সময় স্পেস চেয়েছি।’
-‘হ্যাঁ। সেই ফাঁকে আমার মনের আঙিনায় ঝড়তুফান বয়ে গেল।’
-‘ভুল তো তুমি করেছিলে ভ্রমর। ছোটোনকে না নিয়ে গেলে…।’
-‘সেটাই। সেইজন্য শাস্তি দিচ্ছ। দাও। যত পারো শাস্তি দাও। আমার কপালটাই তো এমন। যাদের ভালোবাসি, তারা-ই কষ্ট দেয়।’
-‘আচ্ছা, আর কষ্ট দেব না। এবার কি শুনবে?’
মাহদিয়া জবাব দিল না। ফুঁপিয়েই গেল। শাদাব বেশ খানিকক্ষণ তার নীরব আর্তনাদ শোনে আস্তেধীরে বলল,
-‘আই ক্যান ফিল য়্যুওর পেইন।’
এইটুকু শোনেই মাহদিয়ার কান্না বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-‘কিচ্ছু বোঝো না তুমি। কিচ্ছু জানো না। মা…।’
-‘শান্ত হও, ভ্রমর। ঠিক একই পরিস্থিতি আমিও সামলে এসেছি। এইসব জটিল পরিস্থিতি সামলানোর মতো ধৈর্যশীল মেয়ে তুমি নও। এই কারণেই আমি তোমাকে সব কথা বলতে চাইনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ, অভিযোগ দিয়েছ, তবুও আমি নীরব থেকে গিয়েছি।’
-‘কিন্তু এখন! এখন কী করা উচিত আমার? আমার প্রতি মায়ের এতদিনের দায়িত্ব-কর্তব্য-ভালোবাসাকে কীভাবে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিই? আমি আর পারছি না শাদাব। বিশ্বাস কোরো, নিজেকে আমার একটা নাচের পুতুল মনে হচ্ছে। ইচ্ছামতো একটা মানুষ আমাকে ব্যবহার করেছে, অথচ আমি কিচ্ছু টের পাইনি। সামনে কোনো পথও দ্যাখছি না। সব অন্ধকার মনে হচ্ছে আমার।’
-‘তোমাকে জোর করার মতো পরিপূর্ণ অধিকারও আমার নেই, ভ্রমর। তা-ই আমার কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা তোমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারছি না। আমি তোমার কতটুকু আপন সেটা জানি না, তবে খুব যে পর এটাও নয়। শুধু এইটুকু বলব, যদি নিজেকে তুমি আমার কাছে নিরাপদ ভাবতে পারো তবেই ফিরে এসো, নয়তো নিজের মায়ের কাছে থেকে যাও।’
মাহদিয়া শুনল। বুঝল। নীরব থেকে ভাবল। ইচ্ছে করেই আজাদ সাহেবের দেশে ফেরার কথা গোপন রাখল। কতক্ষণ চুপ থেকে আবেগঘন কণ্ঠে ডেকে বলল,
-‘শাদাব, আই মিস য়্যু।’
একচিলতে হাসি ফুটল শাদাবের ঠোঁটে। বলল,
-‘অসুস্থ হয়ে পড়লে কেন? নিজের যত্ন নিতে শিখো, ভ্রমর। কাছেপিঠে চেনা-পরিচিত কেউ নেই, কে দ্যাখবে তোমায়?’
-‘দূর। একগ্লাস মিষ্টি শরবতের সাথে তুমি একমগ লবণ পানি মিশিয়ে দিলে। এটা কেমন কথা হলো? কে বলেছে আমি অসুস্থ? তোমার গলা শুনেছি এখনই আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গিয়েছি। একটুপর নাচতেও পারব।’
প্রিয়জনের সান্নিধ্য কিংবা তার থেকে একটুখানি ভরসা পেলে অসুস্থ মানুষও রোগাক্রান্ত শরীরে শক্তি ফিরে পায়। এতক্ষণ মনে যত যন্ত্রণা ছিল, শাদাবের এক নিমিষের নরম কিছু বাক্য, কিছু কথা তার মনের সব অসুখ সারিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে এখন তার অসুস্থ ভাবতে ইচ্ছে করছে না। এজন্যই ফটফট করে উত্তর দিল মাহদিয়া। শাদাব বলল,
-‘সত্যিই কি তাই, আমার গলার আওয়াজ তোমার সুস্থ হওয়ার মাধ্যম?’
-‘পুরো তুমিটাই তো আমার হৃদরোগের একমাত্র শক্তিশালী ঔষধ।’
-‘যদি এক হতে না পারি? তোমার হৃদরোগের ঔষধ যদি তিনবেলা তোমাকে সার্ভিস দিতে না পারে? যদি ভাগ্য সহায় না হয়? কী হবে ভ্রমর? থাকতে পারবে আমায় ছাড়া?’
-‘ভয় দ্যাখাচ্ছ?’
-‘না। ভয় পাচ্ছি।’
-‘এত সাহসী ও শক্ত মনের মানুষ হয়েও তুমি এত ভয় পাও, শাদাব?’
উত্তর দিতে পারল না শাদাব। শুধু বিড়বিড়াল, ‘আমার ভয় তো তোমাকে ঘিরে, ভ্রমর। তোমার একটা ভুল সিদ্ধান্তে আমাদের সব স্বপ্ন ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। তোমাকে এত কাছে পেয়েও কেন হারিয়ে ফেলছি বার বার? কেন অদৃশ্য এই দূরত্বটা আজও শেষ করতে পারছি না দু’জনের কেউ?’ সব কথা বলা যায় না। সে-ও বলতে পারল না। চুপ করে রইল। মাহদিয়া আগ্রহী শ্রোতার মতো জানতে চাইলে,
-‘আবার কবে দ্যাখা হবে?’
-‘যেদিন ভাগ্য সহায় হবে!’
শাদাবের এই হেয়ালি কথা ভালো লাগল না মাহদিয়ার। কণ্ঠে রাগ-অভিমান জমিয়ে বলল,
-‘তুমি দ্যাখা করতে চাও না?’
-‘শুধু দ্যাখা নয়, আর যদি মুখোমুখি হই তবে কঠিন এক শাস্তি দিব তোমায়!’
অল্পবিস্তর ভয় পেল মাহদিয়া। বলল,
-‘কী শাস্তি?’
মেঘ ঘোরঘোর কণ্ঠে ভেসে এলো,
-‘কঠিন শাস্তি। খুব বেশি কঠিন। সহ্য করতে পারবে তো, ভ্রমর?’
***
চলবে।