#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — ত্রিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
কণ্ঠে যদি কেউ সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে বলে, ‘শাস্তি দিবে’ তবে এই শাস্তি মাহদিয়ার জন্য পরম পাওয়া হবে। শাস্তি যত কঠিনই হোক, বিনিময়ে সে শাদাবকে সামনে পাবে, দেখতে পাবে, কাছে পাবে এইটুকুই তার শান্তি। শাদাবের দেয়া সবটুকু শাস্তিকে সে ভালোবাসা হিসেবেই দু’হাত ভরে আগলে নিবে। এমনকিছু আবেগী কথা দিয়ে ফোনের ইতি টানলেও, লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থম মেরে বিছানায় বসে রইল মাহদিয়া। সে ভেবেই পাচ্ছে না, শাদাব তাকে কী শাস্তি দিবে। পনেরো বছর আগে একবার যখন শাদাব তার সবগুলো মাটির খেলনা ভেঙে ফেলেছিল, সে-ও তার শোধ তুলতে রাগে, জিদে, বাঁদরামি করে শাদাবের রুমে গিয়ে সমস্ত কাপড়চোপড় মেঝেতে ফেলে তারওপর লাফিয়ে লাফিয়ে নৃত্য করেছিল। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে রুমে এসে মাহদিয়াকে তার সমস্ত শার্ট-প্যান্টের ওপর গড়াগড়ি খেতে ও নাচতে দেখে মেজাজ নষ্ট হয়ে গেল শাদাবের। সে টুপ করে রুমে ঢুকে বাচ্চা মেয়েটার কান মলে দিয়েছিল। টেনেটুনে বেশ ব্যথা দিয়ে বলেছিল,
-‘তোমার এতবড়ো সাহস। আমার কাপড়চোপড় নষ্ট করছ। আজ আমি কোনো নালিশ দিব না। সোজা তক্তা দিয়ে পেটাব। দাঁড়াও একটু…।’
চারপাশে তাকিয়ে মারার মতো কোনোকিছুই পায়নি শাদাব। মাহদিয়া ততক্ষণে পুরো বিছানার চাদর, বালিশের কভার, কাঁথা নিচে ফেলে দিয়ে, তোষক বিছানার একপাশে সরিয়ে সবকিছুর সাথে একদফা ধস্তাধস্তি করে, শুধু তক্তার ওপর উঠে ধুমধাম শব্দে নাচতে শুরু করেছিল। তার এই নাচানাচি দেখে ও নিজের রুমের এই বেহাল দশা দেখে রাগ আরও বেড়ে গিয়েছিল শাদাবের। সে খুঁজে খুঁজে রুমের দরজার পিছনে থাকা ঝাড়ু এনে ধুম করে মেঝেতে কয়েকটা আঘাত করে বলেছিল,
-‘যা কিছু এলোমেলো করেছ, সব পরিপাটি কোরো। নয়তো তোমার মাথার সব চুল আমি ন্যাড়া করে দেব।’
মাহদিয়া ভেঙচি কেটে পুরো রুমজুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। বলেছিল,
-‘ধরতে পারলে তবে তো ন্যাড়া করবে মোটকু। দৌড়াতেও তো পারো না ঠিকমতো।’
এইবলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল সে। শাদাবও ঘাড়ত্যাড়া। সহজে ছাড়বে না। সে রেগেমেগে এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে ভয় দেখিয়ে বলেছিল,
-‘রুম গোছানো শেষ না করলে আজ এই ঝাড়ু দিয়ে তোমাকে উরাধুরা ক্যালাব।’
-‘ছিঃ। তুমি এত খারাপ? আমাকে ঝাড়ু দিয়ে মারবে?’
-‘না না, মারব কেন? ঘাড়ে দু’চারটে পেত্নী আছে না? ওইগুলোই তাড়াব। শুরু কোরো। নয়তো দিলাম…।’
শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ঝাড়ু দিয়ে মাহদিয়াকে আঘাত করার মিথ্যে ভান করল শাদাব। ভয়ে বাচ্চা মেয়েটা দিল চিৎকার। ঘরশুদ্ধ লোক শাদাবের রুমের সামনে। সবাই তাকে আটকাতে চেষ্টা করছেন। অকারণ চেঁচামেচি বন্ধ করতে বলছেন। শাদাবও সবাইকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে নির্বিকার ভাব নিয়ে বসে বসে মাহদিয়াকে জ্বালাতে লাগল। উপায়ন্তর না পেয়ে অবুঝ বাচ্চাটা একটা একটা করে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা সবকিছু ঠিকঠাক করতে লাগল। শাদাবের এই বাড়াবাড়ি রকমের রাগ দেখে ছেলেকে থামাতে সায়রা করীম দ্রুত ছুটে এসে বলেছিলেন,
-‘টোটোন, ও বাচ্চা মানুষ। ছেড়ে দে ও’কে। কেন এমন করছিস ওর সাথে?’
শাদাবও চোখমুখ রাঙিয়ে বলেছিল,
-‘ও বাচ্চা? মোটেও না মা। ও হচ্ছে শ্যাওড়াগাছের শাঁকচুন্নি। নিজে জংগলের ভূত দ্যাখে মানুষকেও তারমতো ভাবে। দ্যাখো, কী করেছে রুমের! এই রুমে মানুষ থাকবে কী করে? থাকবে তো ওর মতো কয়েকটা লেজবিশিষ্ট ঝুলন্ত হনুমান।’
রাগে পিত্তি জ্বলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল মাহদিয়ার। কাছে এসে ধাক্কা মেরেছিল শাদাবকে। বলেছিল,
-‘নিজে কী হ্যাঁ? হাতি কোথাকার। খেয়েদেয়ে কাজ পায় না, সারাক্ষণ আমার পিছনে লাগে। দিব একটা!’
-‘তুমি দিবে আর আমি ছাড় দিব? ঝাড়ু দ্যাখেছ, ঝাড়ু? এইটা দিয়ে দেব একদম। একেবারে ভূত-প্রেত সব তাড়াব।’
মাহদিয়া গা ফুলিয়ে তাকাত। সুযোগ বুঝে পালাতে চাইত। কিন্তু পথ খুঁজে পেত না। তার এই তিড়িংতিড়িং লাফঝাঁপ দিয়ে পালানোর ধরন দেখে শাদাব তাকে ধরেবেঁধে রুমের ভেতর আটকে রেখে বলেছিল,
-‘রুম পুরোটা না গোছালে মে রে ফেলব একদম। এতগুলো কাপড় নষ্ট করেছ। ওগুলো পরিষ্কার করা কত কষ্টের জানো? ভূতের ভূত একটা। মনটায় চায় দেই লা ত্তি।’
এরপর মায়ের হাতের দুটো চ ড় খেয়েছিল শাদাব। মার খেয়ে সে থেমে যায়নি বরং মাহদিয়াকে দিয়ে জোরপূর্বক রুমের কাজ করিয়েছে। একদিকে মা তাকে মারছেন, অন্যদিকে সে মাহদিয়ার ওপর রাগ ঝাড়ছে। পরিস্থিতি গরম দেখে সেদিন এলোমেলো হাতে পুরো ঘরটা গোছাতে বাধ্য হয়েছিল মাহদিয়া। বিছানা পরিষ্কার করে সবকিছু ঠিকমতো রেখে ফ্লোরে থাকা কাপড়চোপড় বাথরুমে নিয়ে ভিজিয়ে পুরো রুম ঝাড়ু দিয়ে নোংরা সরিয়ে তবেই মুক্তি পেয়েছিল। কাপড় ধোয়ার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল নূরুন্ নাহারের কারণে। তিনি-ই তাকে আগলে নিয়ে শাদাবকে বলেছিলেন,
-‘বাচ্চা মানুষ আর কত কাজ করবে! এইবার ও’কে ছেড়ে দাও টোটোন। তোমাদের যন্ত্রণায় আর পারা গেল না। দুটোই এক গোয়ালের গোরু। দুটোকে একসাথে বেঁধে দেয়া উচিত।’
সেদিন নূরুন্ নাহার শুধু মুখ ফসকেই বলেছিলেন ওই কথা, এর দু’দিন পরই যে তার কথাটা সত্যি হবে ভাবেননি কেউ! ঝগড়ুটে দুটো বাচ্চাকে একসাথে বেঁধে দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সম্পর্কটাকে পরিপূর্ণভাবে আগলে রাখার মতো জ্ঞানবুদ্ধি কারোরই হয়নি দেখে আজও দু’জনে দু’প্রান্তে অবস্থান করছে। তখন তাদের সম্পর্ক সাপেনেউলে হলেও এখন পর্যাপ্ত বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসার। তবুও নিয়তির কাছে দু’জনেই অসহায়।
বসে বসে মাহদিয়া এসবের ফাঁকফোকরেই আবিষ্কার করল, শাদাব তাকে এরকম কিছুই শাস্তি দিবে। যেভাবে বলল, ‘কঠিন শাস্তি’, না দিয়ে শান্ত হবে না এই ছেলে। শাস্তির কথা ভেবেই ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল মাহদিয়া। বিড়বিড়াল,
-‘শাস্তি! চুল টানাটানি করা, হাড়ি-পাতিল ভাঙা, অযথাই দৌড় দেওয়ানো, টেডিবিয়ার নষ্ট করে দেয়া, ঘরের কাজ করানো, এসব ছাড়া আর কী শাস্তি দিবে তুমি আমায়? শাস্তি যা-ই হোক, তোমার দেয়া সবটুকু শাস্তিকে ফুলের মালা বানিয়ে সারাজীবন গলায় ঝুলিয়ে রাখব।’
তখন আলগোছে তার হাতটা গলার কাছে এসে থেমে গেল। আলতো হাতে সেই পুরনো লকেট ছুঁয়ে দিল সে। তাতে দুটো হাতের ছবি। ছবিতে দুটো হাত পাশাপাশি, কাছাকাছি থাকলেও বাস্তবে দুটো হাত ও দুটো মানুষ অনেক দূরে। একেবারে দৃষ্টিসীমা ও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
***
অসুস্থ শিহাবকে দেখতে তার আদরের খালামনি এসেছেন। সাথে নায়রা ও ইভানাও এসেছে। নাবহান নিজেই তাদেরকে নামিয়ে দিয়ে ভার্সিটিতে চলে গেছে। বলেছে, আজ আর বাসায় ফেরার দরকার নেই। এখানেই যেন থেকে যান সবাই। মূলত শিহাবের জন্যই থাকা। সে কাছের মানুষ দেখলে ও তাদের আদরযত্ন পেলে একটু বেশি-ই হাসিখুশি থাকবে। লম্বা ঘুম শেষ করে চোখ মেলে মাথার ওপর একটা আদুরে হাতের স্পর্শ পেল শিহাব। ইভানাকে দেখেই প্রাণখোলা হাসি দিল। দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘তুমি কখন এসেছ?’
-‘বেশ কিছুক্ষণ আগে। ফ্রেশ হও, আমরা একসাথে নাশতা করব। আজ আমি তোমার পছন্দের দারুণ সব খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছি। কতদিন তোমাকে খাইয়ে দিই না বোলো? মিস করছিলাম ভীষণ! তুমি কি আমাকে একটুও মিস কোরোনি?’
-‘খুব মিস করেছি। জানো, ওখানে আমার একটা বন্ধু হয়েছে। ভীষণ কিউট কিউট একটা বন্ধু। আমার দিয়াপি।’
এইরে, ভুল হয়ে গেল! মাহদিয়ার কথা মনে হতেই খুশির সাথে সাথে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল শিহাবের। গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবল। ইভানার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘দিয়াপি খুব রাগ করবে না? বিদায় নিয়ে আসিনি।’
ইভানা তার এলোমেলো চুলে হাত নেড়েচেড়ে বলল,
-‘মোটেও রাগ করবে না। দিয়া জানে তো, ছোটোন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। অসুস্থ বাচ্চাদের ওপর কেউ রাগ করে? একদম করে না। নাশতা শেষ করে তুমি নিজেই তাকে কল করে নিবে। হবে না?’
-‘ইয়েস! হবে। চলো, চলো, নাশতা করি।’
দুর্বল শরীর নিয়ে বিছানা ছাড়ল শিহাব। ইভানার হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের কাছে এলো। সবাইকে একসাথে দেখে পিছন থেকে নায়রার চুল টেনে ধরে বলল,
-‘কী স্বার্থপররে বাবা! আমাকে রেখেই খেতে বসে গেলে। ধুত্তোরি, ওর প্লেটে খাবার দিল কে?’
নায়রার প্লেটে তখন ভুনাখিচুড়ি ছিল। সে নিজেই খাবার পরিবেশন করছে। কাজের মেয়েটাও সাহায্য করছে। তবে এখনও কেউ খেতে বসেনি। এরমধ্যেই শিহাব তার প্লেটটা টেনে নিল নিজের কাছে। চেয়ারে বসে ইভানাকে বলল,
-‘ভাবী, তুমি খাইয়ে দাও। এই রা ক্ষ সীটা সব খাবার শেষ করে ফেলবে।’
নায়রা রেগেমেগে তাকিয়ে বলল,
-‘খেতে আর পারলাম কই? আমার প্লেটটাই তো নিয়ে নিলি।’
শিহাব বিস্মিত চোখে চেয়ে বলল,
-‘এটা তোমার প্লেট? কই, নাম বের কোরো!’
অসহায় চোখমুখ বানিয়ে অন্যপ্লেটে খাবার সাজাতে লাগল নায়রা। শিহাব এবার ইভানাকে বলল,
-‘ভাবী দ্যাখো তো, এখানে কোথাও নায়রা-পায়রা লেখা আছে কি-না? আমি তো দ্যাখতে পাচ্ছি না। প্লেটের মাঝেও মালিকানা দ্যাখাতে এসেছে। হিংসুটে কোথাকার।’
শিহাবের এমনতর কথা শোনে সবাই হাসলেন। কিন্তু হাসতে পারল না নায়রা। সে গাল ফুলিয়ে বলল,
-‘বুঝি না ভাই, আমি তোর কোন জনমের শত্রু? দুনিয়ার সবার সাথে তুই ভালো ব্যবহার করিস্ আর আমার সাথেই পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করিস্। এমন করলে আর আসব না দ্যাখিস্।’
আদূরে হাতে নায়রাকে জড়িয়ে ধরল শিহাব। বলল,
-‘কেন আসবে না? একশোবার আসবে। তুমি তো জানোই, তোমার সাথে ঝগড়া না করলে আমি শান্তি পাই না।’
-‘হয়েছে খা এবার। ভাব দ্যাখাতে হবে না আর।’
-‘তো কী করব বোলো? এই বাড়িতে আমার কোনো ঝগড়ার সাথী নেই। তোমরাও দূরে। সবসময় আসতে পারো না। একা একা ভালো লাগে না আমার। কেউ একজন না থাকলে কার সাথে সময় কাটাব আমি? সারাক্ষণ কি আর পড়ার টেবিলে মুখ ঠেকিয়ে রাখা যায়?’
শিহাবের দুঃখে ব্যথিত হলো ইভানা। যখন তাদের এই হাসিখুশি পরিবারে সে বউ হয়ে আসে, তখন শিহাব ছয় বছরের অবুঝ, দুষ্টু এক বাচ্চা। ওইটুকু সময় থেকে ইভানা ও নায়রা তার সবসময়ের সঙ্গী। শাদাব মাঝখানে দেশের বাইরে ছিল। ইভানার বিয়ের বয়স ছিল তখন ছ’মাস মাত্র। সেই সময় থেকে ইভানাই বেশিরভাগ সময় শিহাবকে আগলে রেখেছে। তার সাথে খেলেছে, সময় কাটিয়েছে, পাশে থেকে ভরসা দিয়েছে। আজ বাচ্চাটা একা। পরিবারের সবাই পাশে থাকলেও তার মনে আনন্দ কেউ। কেউ একজনের শূণ্যতা তাকে পোড়াচ্ছে। চঞ্চল বাচ্চাটাও গুটিয়ে যাচ্ছে চরম অভিমানে। ইভানার বড্ড খারাপ লাগল। সে শিহাবকে বুঝানোর জন্য বলল,
-‘চিন্তা কোরো না। খুব শীঘ্রই তোমার একজন ঝগড়ার সাথী আসবে। আমরা সবাই এবার কোমরবেঁধে টোটোনের জন্য বউ খুঁজতে নামব।’
চোখ চকচক করে উঠল শিহাবের। বলল,
-‘সত্যিই? আমার একজনকে পছন্দ। যদি চাই, এনে দিবে? তুমি বললে ভাইয়া বারণ করবে না আর। বোলো আনবে?’
ইভানা চমকে গিয়ে বলল,
-‘ওমা তাই? তুমি এরমধ্যেই চয়েস করে ফেলেছ? নাম কী তার?’
শাদাব এতক্ষণ নীরব শ্রোতা হলেও ভাইয়ের এই কথায় চমকাল। তার আবদার জানত, কিন্তু পছন্দ তো জানে না। সে চিন্তিত মনেই উত্তর শোনার অপেক্ষায় রইল। শিহাব আড়চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। চোখাচোখি হতেই চোখ ছোটো করে কোনো এক অজানা কারণে গাল ফোলাল শিহাব। ইভানার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘এসো কানে কানে বলি। শুধু তোমাকেই বলব, আর কাউকে বলব না।’
ইভানা কান এগিয়ে দিল। শিহাব চুপিচুপি তাকে কিছু একটা বলল। প্রথমে চমকালেও তার বলার ধরন শোনে হেসে ফেলল সে। শাদাবের দিকে সন্দিহান মন নিয়ে তাকিয়ে বলল,
-‘যখন আমি বললাম, এক কাপ কফি বানিয়ে দেয়ার জন্য হলেও ব্যক্তিগত মানুষ দরকার, তখন তো আমার কথা এড়িয়ে গেলে। এখন কোথায় পালাবে, শাদাব? বিয়ে তোমাকে করতেই হবে। আজ না হোক কাল, ছোটোনের ঝগড়ার সাথী এই বাড়িতে আসবেই আসবে।’
বড়োসড়ো একটা বিষম খেল শাদাব। বিয়ে কয়বার করে মানুষ? একবারই তো! তার যা পরিস্থিতি, তাতে বিয়ে করা বউকে আবার বিয়ে করতে হবে। বাচ্চা মেয়েটা বড়ো হয়ে গেছে। এখন সে শুধু বউ হওয়ার উপযুক্তই হয়নি, প্রচণ্ডরকমের বিশ্বস্ত হয়ে গেছে। সেইসাথে মনের ঘর পুরোপুরি দখল করে বসে আছে। তারজন্য হলেও বিয়ের মালা আবারও গলায় পরতে হবে। পরুক অসুবিধা নেই, কিন্তু শিহাবকে কীভাবে সামলাবে? পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে খুব চালাকির সাথে চেয়ার ছাড়ল শাদাব। হাসিমুখে বলল,
-‘থ্যাংক য়্যু ভাবী। চমৎকার একটা আইডিয়া দিয়েছ।’
বুঝতে পারেনি, এমন ভান ধরে তাকিয়ে রইল ইভানা। শাদাব বলল,
-‘ওইযে, কফির কথা বললে! কফি দরকার। খুব দরকার।’
-‘মানে? কিছুই তো বুঝলাম না। কীসের কফি, কার কফি?’
-‘বুঝতে হবে না। আপাতত ছোটোনকে সামলাও। আমার হসপিটালে যেতে হবে। দেরী হচ্ছে।’
***
জ্বর নামার পর রিসোর্টের বাইরেই হাঁটাহাঁটি করছিল মাহদিয়া। ‘সুখনীড়’-এ যেতে ইচ্ছে করছে না তার। ওখানে নূরুন্ নাহার নেই, শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, সারাক্ষণ এক গুমোটবাঁধা ভাব আর ঝগড়াঝাটি। এসব একদম লাগে না তার। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতেই রিসোর্টে থেকে গেছে। শাদাবের সাথে কথা হওয়ার পর থেকে মনটাও বেশ হালকা। চাপ নেই যদিও বেশি তবুও নিজের মায়ের এই রূপ তাকে ক্ষণে ক্ষণে পোড়াতে লাগল। একটা মানুষ তার সাথে এমন করল, তা-ও সামান্য সম্পত্তির জন্য, সেই হিসাবটাই মিলাতে পারছে না মাহদিয়া। নিজের প্রতি মায়ের স্নেহ-মমতার পাশাপাশি প্রতারণা ও মিথ্যে ধারণাটুকু বারে বারে কঠিন যন্ত্রণা হয়ে বিঁধছে বুকে। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি কীভাবে মিলবে, এটাও ভেবে পায় না সে। তার অপেক্ষা আজাদ সাহেবের ফিরে আসার। ওই একটা মানুষের ফিরে আসাতেই সবকিছু স্বাভাবিক হতে পারে। যদিও এটা তার ব্যকুল মনের ধারণা। তবুও মনে ভয়! সব ঠিক হবে তো? সম্পর্ক জোড়া লাগবে তো? পবিত্র সম্পর্কটাকে এইভাবে বিলীন হয়ে যেতে দেখতে পারছে না মাহদিয়া। শাদাব তারওপর অত্যাচার করেনি, কোনোপ্রকার জোরজবরদস্তি কিংবা সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশিও বাড়াবাড়ি করেনি, মনে কোনোপ্রকার বিষবার্তা ঢুকায়নি, শুধু বলেছে ‘ভেবে সিদ্ধান্ত নাও।’
একমাত্র তার সঠিক সিদ্ধান্তই পারে দুটো মানুষের মধ্যে থাকা অদৃশ্য দেয়ালটা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। এই কারণেই ভয় পায় মাহদিয়া। শেষ পর্যন্ত পারবে তো সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে? শাদাবকে হারাতে হবে না তো? এরকম কিছু হলে যে পাগল হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না! আবার মা! মা’কেও কীভাবে ত্যাগ করবে? সবকিছু অস্বীকার করলেও মায়ের সাথে যে নাড়িরটান আছে, সেটা কী করে অস্বীকার করবে? মা খারাপ হলেও, মায়ের মনোভাব খারাপ হলেও ওই মা’ই তাকে দশমাস, দশদিন গর্ভে রেখেছেন। বুকে আগলে মানুষ করেছেন। অসুস্থ হলে সেবাশুশ্রূষা করেছেন। এগুলো তো চাইলেও অস্বীকার করা যায় না। এইসব ঋণও শোধও করা যাবে না কোনোদিন। এই কঠিন পরিস্থিতি সামলে ওটার উপায় কী, ভেবে পায় না মাহদিয়া। বড্ড একা লাগে তার। এলোমেলো লাগে। অসহায় লাগে নিজেকে। চারপাশটা রংহীন, সুখহীন মনে হয়। কেবলই মনে হয়, জীবনটা তার বৃথা। আসলেই বৃথা। যার জীবনে এমন মা আছেন, তার জীবনে সুখ কী? কেউ নিজের সন্তানের ক্ষতি চায়? এতদিন সে কায়ছার সাহেবকে বিবেকহীন জানত, এখন জানে নিজের মা-ও সেই একই পথের পথিক। যাদের কাছে স্বার্থের আগে সন্তান কিছুই না। যারা সবসময় সবার আগে নিজেকেই সর্বসুখী দেখতে চায়। এসব ভাবতে গিয়েই কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে আসে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাঁদবে কেন? মায়ের এতদিনের ভালোবাসার রূপকে মিথ্যে ধরে নিয়ে কাঁদবে? না-কি মায়ের প্রতি সবটুকু বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার কারণে কাঁদবে? নিজেকে আজ তার সর্বশূণ্য ব্যতীত কিচ্ছু মনে হচ্ছে না। শুধুই মনে হচ্ছে, তার চারপাশে যা কিছু আছে, কিচ্ছু সত্য না। সবকিছুই মরিচীকা, মিথ্যে, মোহ, ছলনা।
তার কষ্টগুলো একটু বেড়ে গেল, ক্ষতস্থান আরও বেশি রক্তাক্ত হলো, যখন বড়ো অসময়ে শায়লা সুলতানার নম্বর থেকে ফোন আসলো। রিসিভ করবে না ভেবেই, অভিমান করে বসে রইল। রিংটোন বাজার মাঝখানে কয়েবার ফোন কেটেও দিল। তবুও তিনি থামলেন না। একাধারে ফোন দিয়েই গেলেন। বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করল। ভালোমন্দ কোনোকিছু জানতে চাইল না, শুধু বলল,
-‘তুমি কি আমাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দিবে না? কেন বিরক্ত করছ? কী চাও তুমি? আ ত্মহ ত্যা করি? শে ষ করে দিই নিজেকে? বার বার লাইন বিচ্ছিন্ন করছি দ্যাখেও কি বুঝতে পারছ না, এইমুহূর্তে আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি না? একটু তো শান্তি দাও আমায়!’
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল মাহদিয়া। এই নারীর সাথে কোনোদিন খারাপ আচরণ করেনি সে। অথচ আজ। সম্পর্কের সুতোটাই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে কেবল কিছু লোভ-লালসা, মিথ্যে অভিনয় ও ছলনা তাদের সম্পর্কে প্রবেশ করেছে দেখে। মেয়ের এমন ব্যবহারে রীতিমতো বিস্মিত শায়লা সুলতানা। মনে ব্যথা পেলেন কি-না সেটা তার কণ্ঠস্বর শোনে বোঝা গেল না। মাহদিয়ার গলার কঠোর এই আওয়াজের জবাবে তিনি খানিকটা আহাম্মক বনে গিয়ে বললেন,
-‘তুই আমার ওপর রেগে আছিস কেন? এইভাবে তো কথা বলিসনি কোনোদিন! কেউ কিছু বলেছে তোকে? কারও মুখ থেকে কিছু শোনে মায়ের ওপর অবিশ্বাস, অভিমান করিস না মা। লোকের কথায় তুই নিজের মা’কে অবিশ্বাস করবি?’
কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে গেল মাহদিয়া। বোঝার চেষ্টা করল, আসলেই সে পরের কথায় নিজের মা’কে ভুল বুঝছে কি-না। কথাটা শাদাব নিজে বলেনি, আবার কোনো প্রমাণও নেই, শায়লা সুলতানা মা হয়ে মেয়ের সাথে এমনটা করবেন? এটাও এখন ভাবিয়ে তুলল তাকে! তবে এটা নিশ্চিত, মা চাননি সে দেশে ফিরুক। সায়রা করীম ও শাদাব সম্পর্কেও ভুল ধারণা মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই নিয়ে মায়ের সাথে মুখোমুখি আলোচনা করার দরকার আছে। নয়তো দুটো মানুষের মাঝখানে আসা দূরত্ব আর শেষ হবে না কোনোদিন! কিছু কিছু সমস্যার সমাধান একেবারে মুখোমুখি আলোচনার মাধ্যমে হওয়াই শ্রেয়! নয়তো দুটো সম্পর্কের দিকের সুতোই নড়বড়ে হওয়ার চান্স আছে। একটা মানুষ কীভাবে মা ও স্বামীর মধ্যে একজনকে বেছে নিবে? এত সহজেই কি দুটো সম্পর্কের একটাকে অস্বীকার করা যায়? শায়লা সুলতানার কথাতে সরাসরি কিছু বলল না মাহদিয়া। শুধু বলল,
-‘তুমি আমাকে যতটা বোকা ও অবুঝ ভাবো, ততটা বোকা কিংবা অবুঝ আমি নই মা। নাহার খালার ওপর যে মিথ্যে অভিযোগ তুমি দিয়েছ, তাতেই তোমার প্রতি সব সম্মান নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার। আমি ভেবেও পাচ্ছি না, কেউ সামান্য সম্পত্তির জন্য কেন নিজের বিবেককে এত সস্তা করবে!’
-‘তুই আমাকে ভুল বুঝছিস দিয়া। এই সম্পত্তির ওপর আমার কোনো লোভ নেই।’
-‘তাহলে যে দলিলটা আমি ছিঁড়ে ফেলতে পারলাম, সেটা তুমি কেন ছিঁড়লে না? উলটে ওখানে সাইন করতে যাচ্ছিলে!’
-‘আমি ভাইজানকে কত বারণ করেছি, কিন্তু…।’
-‘কিন্তু তা-ও তুমি বড়ো মামাকে বুঝাতে পারোনি। তাইতো?’
-‘হ্যাঁ। একদমই তা-ই।’
-‘তারমানে তুমি নিশ্চিত ছিলে যে, বড়ো মামা তোমাকে ওই সম্পত্তিটা একসময় দিয়েই দিত?’
-‘মানে? উনি আমাকে না দিলেও ওই সম্পত্তি নাহার দখল করে নিত!’
-‘সম্পত্তি দখল করে নেয়া এত সহজ মা? যদি এত সহজ হোতো, দেশে আইন-আদালত কিচ্ছু তৈরী হোতো না। মানুষ জোরজবরদস্তি করে একে-অন্যের সম্পত্তি ভোগদখল করত। কেউ কিচ্ছু করতে পারত না। নাহার খালার ওই সম্পত্তির ওপর কোনো লোভ নেই। থাকলে এতদিনে খালা সবকিছু দখল করে নিতেন। বিনা বেতনে পরের জন্য খেটে মরতেন না।’
-‘কী বলতে চাইছিস তুই?’
-‘এটাই যে, ওইটুকু সম্পত্তির জন্য তুমি তোমার মেয়েকেও ছাড়োনি।’
-‘তোর মাথা পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। ওই জানোয়ারকে আমি ছাড়ব না। আমার মেয়েকে কেড়ে নিতে চাইছে সে! খু ন করে ফেলব ও’কে আমি।’
-‘আহা…। অকারণ ও’কে কেন খু ন করতে যাবে তুমি? আমাকে কোরো। মারতে তো বাকি রাখোনি। অলরেডি অর্ধেক মে রে ফেলেছ মা…। ফাঁ সির দ ড়ি গলায় ঝুলিয়ে অপেক্ষা করছ, কখন মৃত্যুটা আসবে।’
শায়লা সুলতানা অসহায় বোধ করলেন। পরিস্থিতি একেবারে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি মেয়েকে থামাতে বললেন,
-‘তুই বিশ্বাস কর দিয়া, এটা টোটোনের একটা অভিনয় মাত্র। ও তোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চায়।’
-‘সেই অধিকার ওর আছে মা। যদি পরিপূর্ণ দাবী নিয়ে আসে, তুমি-আমি কেউ-ই ও’কে ফিরিয়ে দিতে পারব না। আইনত আমি ওর স্ত্রী। এই সত্য কোনোদিন মিথ্যে হয়ে যাবে না।’
-‘তাইবলে তুই ওর কাছে চলে যাবি? মা’কে ছেড়ে দিবি তুই?’
-‘কেন? ছাড়া তো স্বাভাবিক! তুমিও তো তোমার মা’কে ছেড়ে বাবার কাছে চলে এসেছিলে। তুমি পেরেছ, বৈবাহিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে নিজের মায়ের কাছে পড়ে থাকতে?’
-‘তুই অকারণ কথা প্যাঁচাচ্ছিস দিয়া!’
-‘আমার কথা তোমার ভালো লাগছে না? অযৌক্তিক কিছু বলেছি?’
-‘তুই নিজের মায়ের দিকে অবিশ্বাসের আঙুল তুলছিস। আমার তো ভাবতেই খারাপ লাগছে, তুই আমাকে সন্দেহ করছিস! ছিঃ।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাকে সন্দেহ করব না। তুমি বড়ো মামাকে বোলো, ওই সম্পত্তি যেন তিনি ওদের দুই ভাইয়ের নামে লিখে দেন। আর আমাকেও শাদাবের হাতে তুলে দাও। যদি এই কাজটা করতে পারো, আমি তোমাকে একফোঁটাও সন্দেহ করব না। তুমি যখনই চাইবে, আমি তোমার কাছে চলে আসব। ঠিক আছে?’
হ্যাঁ বা না কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলেন শায়লা সুলতানা। মাহদিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন হালকা করার চেষ্টা করল। জানে, তার মা এই কাজটা করতে পারবেন না। যদি পারতেন, সামান্য সম্পত্তির সুতো ধরে পনেরো বছর ধরে নিজের পেটের মেয়ের সাথে অন্যায় করতেন না। একটা মানুষের এত লোভ কেন? এই লোভ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোনো ধারণা আছে তার? তিনি যে সারাজীবনের জন্য মেয়ের কাছে ছোটো হয়ে যাচ্ছেন, অপরাধী হয়ে যাচ্ছেন, এটা কি খেয়াল করছেন না? মেয়ে অবুঝ বলে চোখে ধুলো দিয়েছিলেন, এতদিন। এখন আর পারবেন না। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কোনো ভুল সিদ্ধান্তও নিবে না সে। যখন একটা অপশন তাকে নিতেই হবে, তখন সবকিছু যাচাই করে তবেই নিবে। মনে মনে জটিল এক ভাবনা সাজাল মাহদিয়া। বিড়বিড় করল,
-‘নিজেকে তুমি কীভাবে নির্দোষ ও সৎ প্রমাণ কোরো, আমিও দ্যাখব মা। যদি তোমার মধ্যে কোনো মিথ্যে না থাকে, তবে তুমি নিজেই এই সম্পর্কটা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করবে। আর যদি তা নয়, যদি ওদেরকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার মতো জঘন্য মানসিকতা দ্যাখাও, তবে দিনশেষে আমি তোমাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হব। তুমি আমার মা, এই সত্য ভুলে থাকা যেমন কঠিন, তেমনই কঠিন তোমাকে ঘৃণা করে বেঁচে থাকাটাও। আমি তোমায় সারাজীবন ভালোবেসে বাঁচতে চাই মা। তোমার প্রতি আমার সবটুকু শ্রদ্ধাকেও বাঁচিয়ে রাখতে চাই। দয়া করে আমার মনে আর কোনো আঘাত তুমি দিও না।’
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — একত্রিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
গত দু’দিন ধরে শিহাবকে খুব মনোযোগ দিয়ে নোটিশ করছেন সায়রা করীম। তাঁর বোন ও ছেলেমেয়েরা যতক্ষণ এই ঘরকে হাসি-আনন্দে রেখেছিল, ততক্ষণ শিহাব খুব স্বাভাবিক, চঞ্চল ও উৎফুল্ল মেজাজে ছিল। তবে এই আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে তারমধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন। সে পড়তে বসছে কিন্তু মনোযোগ পড়ার দিকে একদমই নেই। শুধু শুধু খাতার পৃষ্ঠাকে আঁকিবুঁকি করে নষ্ট করে দিচ্ছে। বাগানে খেলতে গেলেও ফুটবল হাতে নিয়ে কাঠের ঘরে গিয়ে বসে থাকছে। খেতে বসলেও সারাক্ষণ মনমরা ভাব নিয়ে বসে থাকে। কী খাবে, কতটুকু খাবে, মাছ খাবে না-কি মাংস খাবে, এই নিয়ে কোনো বাছবিচার করছে না। সামনে যা দিচ্ছেন সেটাই প্রয়োজনমতো নিয়ে, একা একা খেয়ে উঠে যাচ্ছে। বাড়তি কিছু লাগলেও চাইছে না। কখনও কখনও গেমস্ খেলতে বসেও সারাক্ষণ কম্পিউটারের স্ক্রিনে কী যেন টাইপ করে। টাইপ করে, মুছে। আবার টাইপ করে আবার মুছে। রাত গভীর হওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। শাদাব যতক্ষণ বাইরে থাকে, ততক্ষণ একবারও ফোন দিয়ে তার সাথে কথা বলে না। নয়তো প্রতিদিন সকাল-বিকাল দু’বার ভাইকে ফোন করত আগে। কিছু লাগলে ফেরার পথে নিয়ে আসতে বলত। অথচ এখন এসব কিছুই করছে না। সারাক্ষণ গম্ভীরমুখে বসে বসে কী যেন ভাবতে থাকে। ছেলের এই মনমরা ভাবটা নিতে পারছিলেন না তিনি। তাই আজ শাদাব ফিরতেই তাকে বললেন,
-‘ওর কিছু একটা হয়েছে। নয়তো রোজকার নিয়মে এত পরিবর্তন কেন?’
শিহাবের মনে যে সেদিনের ঘটনা সামান্য হলেও প্রভাব ফেলবে, এটা শাদাব বুঝেছিল। কিন্তু কী দেখে, কতটুকু প্রভাব পড়ছে এটা বুঝতে সময় লাগছিল তার। হসপিটাল থেকে ফিরে মায়ের মুখ থেকে এই কথা শোনে দুঃশ্চিন্তা বাড়ল আরও। বলল,
-‘রাতে খেয়েছে কিছু?’
-‘হ্যাঁ খেয়েছে। কিন্তু খাওয়ার পর আর আমার কাছে আসেনি। রুমেই বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, আর কিছু প্রয়োজন কি-না। ‘লাগবে না’ বলে মুখ ফিরিয়ে নিল।’
অ্যাপ্রোন ও হ্যান্ডব্যাগ রেখে দ্রুত শিহাবের রুমে প্রবেশ করল শাদাব। ক’দিন ধরে সে শিহাবের সাথেই রুম শেয়ার করে। কিন্তু সমস্যা একটাই, প্রতিদিনের মতো গলায় ঝুলে ঝুলে কোনোকিছু আবদার করে না। বড়ো ভাইয়ের ফেরার অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়ে। বিষয়টা তাকেও ভাবাচ্ছিল, কিন্তু সরাসরি কিছু বলতেও পারছিল না। রুমে প্রবেশ করেই দেখল শুয়ে শুয়ে একপাশ দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে কী যেন দেখছিল সে। দূর থেকেই বলল,
-‘রাতের খাওয়া শেষ তোমার? চলো, ভাইয়ার সাথে আবার খাবে।’
সঙ্গে সঙ্গে ফোনের সাইট বাটনে ক্লিক করে আলো বন্ধ করে দিল শিহাব। ফোন রেখে দিল বালিশের সাইডে। শাদাবের দিকে তাকিয়ে মুখে জোরপূর্বক হাসি ধরে রেখে বলল,
-‘তুমি খেয়ে নাও। আমার ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে। বেশি খেলে শেষে মোটা হয়ে যাব।’
শাদাব পাশে এসে বসল। দু’হাতে ভাইকে টেনে তুলে বলল,
-‘বাড়ুক। ক্ষতি নেই। অল্প একটু খেলে কিচ্ছু হবে না। ক’দিন ধরেই দ্যাখছি, তুমি আমাকে ইগনোর করছ। আমি বাইরে থাকলে ফোন করছ না। লাঞ্চ করেছি কি-না এ-ও জিজ্ঞেস কোরো না। কখন ফিরব, তা-ও জানতে চাও না। এতে কি ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে না?’
অসহায় মুখ বানিয়ে শিহাবও বলল,
-‘আমিও কষ্ট পেয়েছিলাম, যখন বুঝেছি তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ!’
শিহাবের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে ভেতরটা বুঝবার চেষ্টা করল শাদাব। ‘সুখনীড়’-এ যাওয়াটাই যে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন। অবুঝ বাচ্চাটার মনে কোন কোন সত্য এসে পড়েছে কে জানে! নিশ্চিত হতে শাদাব তাকে ধোঁয়াশা রেখে বলল,
-‘কী মিথ্যে বলেছি, সেটা বুঝতে পেরেছ?’
-‘হ্যাঁ! পেরেছি। ওই বাড়ির ডিজাইন আর এই বাড়ির ডিজাইন এক। ওই বাড়ির গেটে লেখা ছিল, চাচ্চু ও বাবার নাম। আই মিন, ইরফান হায়দার আর এমদাদ কায়ছার।’
-‘তুমি বুঝলে কী করে, ওই এমদাদ কায়ছার নামের মানুষটাই আমাদের বাবা। ওখানে তো অন্যকারও নামও হতে পারে। অন্য মানুষও হতে পারে।’
হাত বাড়িয়ে নিজের ফোনটা টেনে আনল শিহাব। গ্যালারিতে প্রবেশ করে ক্যামেরা ফোল্ডারের প্রথম ছবিটা স্ক্রিনে মেলে ধরিয়ে দিল ভাইয়ের হাতে। ছবির দিকে তাকিয়ে যতখানি চমকাল শাদাব, তারচেয়ে বেশি অবাক হলো শিহাবের বুদ্ধির কথা ভেবে। আগ বাড়িয়ে কিছু না বলে কৌতূহল মনে জানতে চাইল,
-‘তুমি এটা কোথায় পেয়েছ?’
-‘দিয়াপির রুমে।’
-‘অনুমতি ছাড়া কারও জিনিস ধরতে নেই, এটা ভুলে গেছ?’
-‘না। অ্যালবামের উপরে লেখা ছিল, ‘হ্যাপি ফ্যামিলি’। ওই আগ্রহ থেকেই ধরেছি।’
-‘এটা কার জানো?’
-‘হবে কেউ একজনের।’
ম্লানমুখে জবাব দিল শিহাব। সে এখনও নিশ্চিত নয়, অ্যালবামটা কার। তার দিয়াপির না-কি তার ভাইয়ের। শিহাবের বলার ধরন দেখেই মুচকি হাসল শাদাব। ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘এটা কী প্রমাণ করে?’
গাল ফুলিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল শিহাব। ঠোঁটমুখ ফুলিয়ে মুহুর্তের মধ্যেই কেঁদে ফেলল। ঠেলেঠুলে শাদাবকে সরিয়ে দিয়ে ধুম করে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। শাদাব অবাক হলো। নিচু হয়ে শিহাবের মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
-‘সোজা হয়ে বোসো। বলছি। অকারণ কাঁদছ তুমি।’
-‘মোটেও কাঁদছি না আমি। যাও তুমি।’
-‘যাব। কিন্তু তোমাকে নিয়ে।’
-‘কোত্থাও যাব না আমি। ঘুমাব এখন।’
-‘কোথায় ঘুমাচ্ছ তুমি? অকারণ মাথায় চাপ সৃষ্টি করছ। ভেতরে কোনো প্রশ্ন আটকে না রেখে আমাকে বোলো, কী জানার আছে তোমার!’
-‘আমার কিছু জানার নেই। আমি বুঝে গিয়েছি সব।’
-‘হ্যাঁ! বুঝেছ। কিন্তু আমাকে দায়ী করছ। খারাপ ভাবছ। ভুল বুঝছ। অথচ আমি যা করেছি, শুধু তোমার জন্য করেছি। তোমাকে ভালো ও সুস্থ রাখতে করেছি। আমি চাইনি, আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা তোমার সাথে হোক। আমি যেসব দিন পিছনে ফেলে এসেছি, তার প্রভাব তোমার ওপর পড়ুক, এসব চাইনি দ্যাখেই সবকিছু থেকে তোমাকে দূরে রেখেছি।’
শাদাবের কথা শোনে সোজা হয়ে বসল শিহাব। কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে থাকা ছবিটা দেখল। একদম তার দিয়াপি যে স্টাইলে চুল বাঁধে, সেরকমই একটা মেয়ে। একদম আদুরে চেহারা। ছোট্ট একটা বিয়ের বেনারসি পরনে। মনে হচ্ছে, পুতুল বউ। পাশেই শাদাবের কৈশোর বেলার ছবি। ফোন রেখে সে বিছানা ছাড়ল। ওয়ারড্রবের ওপর থেকে পুরনো একটা অ্যালবাম আনল। যেখানে তার শৈশব ও শাদাবের কৈশোরের ঠিক ওই চেহারারই ছবি আছে। অ্যালবাম সামনে এনে পুরনো ছবি ও ভাইয়ের চেহারা মিলিয়ে বলল,
-‘এটা তুমি, তাইতো?’
শাদাব মাথা নাড়ল। মাহদিয়ার বউ সাজের ছবিটা দেখিয়ে বলল,
-‘এটা দিয়াপি?’
এবারও উপরনিচ মাথা নাড়ল শাদাব। শিহাব সবকিছু সরিয়ে শাদাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘সেদিন যখন জানতে চাইলাম, দিয়াপির সাথে তোমার কী সম্পর্ক, তখন কেন বলেছিলে আপি তোমার কেউ হয় না? কেন আমাকে সত্যিটা বোলোনি? বললে আজকে আমি এত কষ্ট পেতাম না ভাইয়া।’
অবুঝ বাচ্চাটা তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে, এটা মানতে পারল না শাদাব। দু’হাতে ভাইকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলল। বলল,
-‘ভাইয়া তোমায় কষ্ট দিতে চায়নি ছোটোন। পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল, সব সত্য গোপন রাখতে।’
-‘কিন্তু কেন? কেন ভাইয়া? কেন আমরা একসাথে নেই? কেন চাচ্চু আর বাবা আলাদা?’
পরক্ষণেই বলল,
-‘ওই খারাপ লোকটাই আমাদের বাবা তাই না?’
শাদাব চমকাল। শিহাবের চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল,
-‘খারাপ লোক?’
ছবিতে সায়রা করীম, এমদাদ কায়ছার, শায়লা সুলতানা, নূরুন্ নাহার, ইরফান হায়দার সবারই ছবি ছিল। সব ছবি দেখে ও এমদাদ কায়ছারের চেহারা মিলিয়েই শিহাব নিশ্চিত হয়েছিল, ওই লোকটাই তার বাবা। এমদাদ কায়ছারের একটা ছবি আজও তার মায়ের কাছে আছে। বহু পুরনো! কোথা থেকে, কীভাবে, কেন সায়রা করীম ছবিটা নিজের কাছে রেখেছেন সেটা প্রথমে জানত না শিহাব। শাদাবই ভাইকে একদিন বলেছে, ওটা তাদের বাবার ছবি। ওই ছবি নিয়ে অনেক কৌতূহল ছিল তার মনে, ‘সুখনীড়’-এ গিয়ে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল তার কাছে। বুঝে গেল, ওটা বাবার ছবি বলেই মা সেটা আগলে রেখেছেন। ওই ছবিটা তিনি হারাতেও দেন না। লুকাতেও দেন না। নিজের কাছেই রাখেন। কিন্তু তিনি জীবিত কীভাবে? তাঁর তো মৃত হওয়ার কথা! এটাই তার ছোট্ট মাথায় ঢুকছিল না। তার দুঃখ ছিল, শাদাব তাকে মিথ্যে বলেছে, সব সত্যি লুকিয়েছে, এই একটা জায়গাতেই। তবে সে এটা বুঝে গিয়েছিল, ওই লোকটা তার ভাইকে সহ্য করতে পারছিলেন না। সেদিনের ঘটনা মনে পড়তেই ভাইয়ের প্রশ্নের নিশ্চয়তা দিয়ে বলল,
-‘হ্যাঁ। উনি তোমার গলায় ছু রি বসাতে চাইছিলেন। উনি আমাদের বাবা হয়ে এমন কথা কেন বললেন? কেন নিজের সন্তানকে তিনি মেরে ফেলবেন?’
গভীর করে শ্বাস টানল শাদাব। ধীরস্থিরভাবে বলল,
-‘পনেরো বছর আগেই উনি আমাদের জীবন্ত মে রে ফেলেছেন। ওনার কাছে আমরা যেমন মৃত, আমাদের কাছে উনিও তেমন মৃতই।’
এই জটিল কথার প্যাঁচ শিহাব বুঝল না। মনে অসংখ্য প্রশ্ন, দুঃখ, ব্যথাবেদনা আগলে নিয়ে বলল,
-‘এমনটা কেন?’
-‘ওই বাড়িটা মায়ের সুখের ঠিকানা ছিল। বাবা-মায়ের লাভ ম্যারেজ। পালিয়ে বিয়ে করার পর নানাবাড়ির লোকজনের সাথে মায়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সমস্ত সম্পত্তি ও অধিকার থেকে মা’কে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু দিনশেষে, মা ওই ‘সুখনীড়’-এ সুখের দেখা পেয়েছিলেন। একটা পরিপূর্ণ সুখের সংসারে একদিন ছদ্মবেশী ভালো মানুষের আগমন ঘটে। মূলত সে ছিল খারাপ ও লোভী একজন মানুষ। যার বিষাক্ত ছোবলে ‘সুখনীড়’-এর সমস্ত সুখে বিষ ছড়িয়ে পড়ে সব সুখ মুহূর্তের মধ্যেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।’
শিহাবের আগ্রহ যেমন বাড়ল, তেমনই ভয়ও হলো। সে বিস্মিত চোখে বলল,
-‘এরপর? ওই খারাপ লোক কী করেছিল?’
-‘মায়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে তোমার দিয়াপিকে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছিল।’
-‘তারপর? তোমরা আলাদা হলে কী করে? বিয়ে হলে তো দিয়াপির আমাদের সাথে থাকার কথা?’
-‘তার ভিসা তৈরী ছিল, তাই সে ইতালি চলে গিয়েছিল। সে যাওয়ার পরই ‘সুখনীড়’-এর সুখ হারিয়ে যেতে লাগল।’
-‘কেন?’
-‘তুমি তখন মাকে জানিয়েছিলে, পৃথিবীতে আসছ। সেই সুখে মা আত্মহারা হলেও, মায়ের সুখ নষ্ট করার জন্য ওই ছদ্মবেশী, লোভী মানুষটা ছলেবলে কৌশলে বাবার কানে বিষ ঢুকিয়ে দেয়। সম্মান ও অহমিকার খোলসে আটকা পড়ে বাবা তোমাকে মে রে ফেলতে চান। মাকে চড়-লাতি মারেন। উল্টাপাল্টা ঔষধ খাওয়ান। তবুও মা চাইছিলেন, তুমি সুস্থ শরীর নিয়ে পৃথিবীতে আসো। কিন্তু একদিন, আমি বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দ্যাখি, বাবা মা’কে মারতে মারতে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ‘সুখনীড়’-এর রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন। নাহার খালা অনেক চেষ্টা করেছেন আটকানোর, কিন্তু পারেননি। ওই দৃশ্য দ্যাখার পর আমি সহ্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই মা ও তোমাকে বাঁচাতে, সঙ্গে সঙ্গে ‘সুখনীড়’ ত্যাগ করি। অসুস্থ মা’কে নিয়ে পুরোটাই রাস্তায় বসে গিয়েছিলাম। কিন্তু তবুও, বাবা নামক পাষাণ মানুষটা আমাদের একবার ফেরায়ওনি। উলটে আমাকে বলেছিল, যদি মা’কে ত্যাগ করে তাকে গ্রহণ করে নিই, তবেই আমি ‘সুখনীড়’-এ আশ্রয় পাব। আমার বিবেক আমাকে বার বার বাঁধা দিচ্ছিল। পারিনি, অসুস্থ মা’কে একা রাস্তায় ফেলে দিতে! সেদিন থেকে ‘সুখনীড়’ আমার কাছে জাহান্নাম হয়ে গেছে। আর ওই মানুষটাকেও মৃত মেনে নিয়েছি। যার কাছে সন্তানের মূল্য নেই, অসুস্থ স্ত্রীর মূল্য নেই, তিনি কীসের বাবা? কার বাবা? আমাদের কোনো বাবা নেই। কেউ নেই।’
শক্তপোক্ত মনের মানুষটাকে এইভাবে ডুকরে কাঁদতে দেখে দিশেহারাবোধ করল শিহাব। নিজের ভুল বুঝতে পারল। ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরও দ্বিগুণ হলো। দু’হাতে নিজেও ভাইকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে কাঁদল। শাদাব তার মাথায় হাত রেখে বলল,
-‘এরপরও যদি তোমার মনে হয়, ভাইয়া তোমাকে মিথ্যে বলে ভুল করেছে, তবে তুমি আমাকে যে শাস্তি দিবে সেটাই আমি মাথা মেতে নেব। তবু নিজেকে এভাবে চারদেয়ালের ভেতর বন্দী করে রেখো না। মা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন, তোমার এই পরিবর্তন দ্যাখে।’
শিহাব নিজের চোখের মুছল। শাদাবের চোখটাও মুছে দিল। অ্যালবাম, ফোন সবকিছু রেখে বলল,
-‘চলো ভাত খাব। তখন খুব অল্পই খেয়েছি। এখনও ক্ষিধে রয়ে গেছে আমার।’
ভাইয়ের কথায় স্বাভাবিক হয়ে মুহূর্তেই হেসে ফেলল শাদাব। চট করে তাকে কোলে তুলে নিল। ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে বলল,
-‘রাগ কমেছে এবার?’
-‘আমি রাগ করিনি। একটু…কষ্ট পেয়েছি।’
-‘এসব কথা আর মনে করবে না। সবসময় তুমি এটা ভাববে, পৃথিবীতে তোমার কেউ না থাকলেও মা ও ভাইয়া আছে। যারা তোমার প্রতিটা দুঃখে দুঃখিত হয়, সুখে সুখী হয়। তাই নিজেকে হাসিখুশি রাখবে। কখনও কোনো প্রশ্ন মনে জাগলে, ঝটপট জিজ্ঞেস করে ফেলবে। লুকোবে না। মাথায় চাপ দিবে না। আমি সবসময় তোমার সাপোর্টার ছিলাম, আছি, থাকবও। এইজন্য অহেতুক কিছু কথার জন্য আমার ওপর থেকে বিশ্বাস হারাবে না। আমি আগেই বলেছিলাম, এই পৃথিবীতে তোমাকে ও মা’কে আমি যতটুকু ভালোবাসি, ততটুকু ভালো আর কাউকেই বাসি না। আজও বলছি। সারাজীবন বলব।’
শিহাব মুখভার করে ভাইয়ের গালে চুমু খেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘স্যরি। আর হবে না।’
-‘ঠিক আছে। এবার থেকে পড়াশোনাতে খুব করে মনোযোগ দিতে হবে। এ্যাক্সাম শেষ হলেই আমরা কাশ্মীর যাব। এটা কিন্তু ফাইনাল।’
খাবার টেবিলে বসে দুই ভাই একসাথেই রাতের খাবার খেল। সায়রা করীম পাশে বসে দেখলেন। দূর থেকেই দুই ভাইয়ের মান-অভিমান পর্ব দেখেছিলেন তিনি, নিশ্চিত ছিলেন শাদাব ম্যানেজ করে নিতে পারবে, তা-ই আর সামনে যাননি। খাবার শেষে শিহাব খুব শক্ত করে সায়রা করীমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো না?’
আদুরে বাচ্চাটার কপালে চুমু খেলেন তিনি। বললেন,
-‘বাসি তো। সন্দেহ আছে?’
-‘একদমই নেই। আমার জন্য অনেক কষ্ট হয়েছে তোমার। সবকিছু হারিয়েছ।’
-‘হারিয়ে যাক। যা কিছু আত্ম-অহমিকার তা হারিয়েই যাক। কোনো আফসোস নেই। আমি তো আমার বাচ্চাটাকে পেয়েছি। তাতেই খুশি। করুণাময়ের নিকট আর কোনো চাওয়া নেই আমার।’
শিহাব এটা শোনে আবেগাপ্লুত হয়ে গেল। সে-ও মাকে খুশি করতে বলল,
-‘আমার মা পৃথিবীর সেরা মা। তোমায় খুব ভালোবাসি মা।’
বহুদিন পর বুকভরে শ্বাস নিলেন সায়রা করীম। আদরের বাচ্চাটাকে বুকের ভেতর আগলে ধরে বসে রইলেন। সব ত্যাগ করেছিলেন বলেই তো কোল ভরে উঠেছিল তার। নিষ্পাপ ভ্রুণ হত্যার অভিশপ্ত দায় সারাজীবন ভয়ে বেড়ানোর চেয়ে কিছু অহংকারী সুখ ত্যাগ করাই শ্রেয়। তিনি তা সাহসের সাথে ত্যাগ করতে পেরেছিলেন বলেই, আজ গর্বিত মা হতে পেরেছেন। একজন নারীর সমস্ত স্বার্থকতা তো এখানেই, বিশুদ্ধ মা হয়ে ওঠা।
মা’কে ছেড়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল শিহাব। শাদাবও ভাইয়ের কাছে এলো। ফোন হাতে নিয়ে বার বার মাহদিয়ার নম্বরে ডায়াল করতে গিয়েও ফিরে আসছিল সে। শাদাব সেটা দেখতে পেয়ে বলল,
-‘কী? কথা বলবে?’
-‘হ্যাঁ, কিন্তু কেমন জানি লাগছে!’
-‘এটা কেমন কথা? আজ কি নতুন কথা বলবে তার সাথে?’
-‘না। কিন্তু সম্পর্কটা নতুন হবে। তাই…।’
আমতা-আমতা শুরু করল শিহাব। শাদাব হেসে ফেলল। নিজেই ফোন বের করে মাহদিয়ার নম্বরে ডায়াল করে ধরিয়ে দিল ভাইয়ের হাতে। রিসিভ হওয়ার পর সালাম দিল শিহাব। মাহদিয়া খানিকটা সময়ের জন্য বিষম খেয়ে বসল। সালামের জবাব দিয়ে জানতে চাইল,
-‘কেমন আছো?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
-‘একদমই ভালো নেই। ছোটোনকে খুব মিস করছি। কিন্তু সে তার দিয়াপিকে ভুলে গেছে। তিনদিন হয়ে গেল, অথচ একবারও মিসডকল কিংবা ছোট্ট একটা ম্যাসেজও করল না।’
-‘মোটেও ভুলেনি। ছোটোন খুব অসুস্থ ছিল তো, তাই যোগাযোগ করতে পারেনি। কিন্তু তুমি তো আমাকে কল করতে পারতে, কেন কোরোনি?’
মনের ওপর কত ঝড়ঝাপটা যাচ্ছে সেটা তো আর অবুঝ বাচ্চাকে বলা যায় না। খুব গোপনে নিজের বর্তমান পরিস্থিতি এড়িয়ে গেল মাহদিয়া। বলল,
-‘আমিও তো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তাই ফোন করতে পারিনি।’
‘হুম’ বলে উপরনিচ মাথা দুলাল শিহাব। এরপর কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল। এই মেয়েটা তার ভাইয়ের বউ, তার ঝগড়ার সাথী, অথচ ঠিকঠাক কথাই বলতে পারছে না সে। লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে। শাদাব পাশে বসে দু’জনার কথোপকথন শুনছে কিন্তু কিছু বলছে না। মিটিমিটি হাসছে। একটা সময় শুনল, শিহাব তার আদরের দিয়াপিকে বলছে,
-‘তুমি আমাদের বাড়িতে কবে আসবে?’
এই কথায় মন পাড়ায় তুফান শুরু হলো মাহদিয়ার। সেদিন জাইমা ঠিকানা দিলেও, সে সাহস নিয়ে ওই ঠিকানায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এখনও সম্পর্ক দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। শাদাব নিজে তাকে ওই বাড়িতে নিয়ে না গেলে, তার যাওয়ার স্বাদটাও অপূর্ণ থেকে যাবে চিরদিন। জোর করে তো আর অধিকার নিয়ে চলে যাওয়া যায় না। সামাজিক স্বীকৃতির দরকার হয়। এই স্বীকৃতি তাদের সম্পর্কে কবে আসবে এটা ভাবলেই কষ্ট বেড়ে যায় তার। নড়বড়ে এই সম্পর্কটা দিনদিন তাকে চিতার আগুনে পোড়াচ্ছে অথচ কোনো সমাধান মিলছে না। শাদাব যে কেন এগোচ্ছে না, এটাই বুঝতে পারে না মাহদিয়া। বড্ড অভিমান জন্মায়। রাগ হয়। কষ্ট হয়। তবুও নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। এই ক’দিন শাদাবের সাথে তার যা একটু কথা হয়েছে, সেটা কেবল দুই থেকে তিন মিনিটের ছোট্ট কথোপকথন। হসপিটাল শেষে বাড়ি ফিরে সময় পেত না শাদাব। লম্বা কথোপকথনের ফলে তার নির্ঘুম রাত কাটবে এইভেবে মাহদিয়া নিজেও অকারণ কথা বাড়াত না। ঘরের সবার কথা ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে ঝটপট ফোন রেখে দিত। অথচ মন সবসময় আঁকুপাঁকু করে গোটা একটা নির্ঘুম রাত শুধু রাতজাগা পাখি হয়ে কিচিরমিচির করতে। তা আর হয়ে উঠে না।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মন হালকা করল মাহদিয়া। বলল,
-‘আমি ওখানে কেন যাব?’
-‘কেন আসবে না? তুমি তো এখানেই আসবে।’
-‘তাই…? কিন্তু কেন? ওখানে আমার কে আছে?’
-‘আমি আছি। ভাইয়া আছে। মা আছে। আমরা সবাই আছি।’
-‘কিন্তু ওখানে যেতে হলে তো আমাকে সম্পর্কের বৈধ সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে হবে। সেটা আমি কোথায় পাব?’
হিসাব বুঝল না শিহাব। দিয়াপি তার ভাইয়ের বিয়ে করা বউ। হোক বয়স কম, বউ তো। স্বামীর বাড়িতে আসতে আবার বৈধ সার্টিফিকেট কী লাগে! বুঝতে না পেরে বলল,
-‘কীসের সার্টিফিকেট?’
-‘বুদ্ধু। এমনি-এমনি কী করে যায়?’
-‘এমনি-এমনি আসবে কেন? তুমি তো আসবে এই বাড়ির বড়ো বউয়ের পরিচয়ে।’
দ্বিতীয়বার বিষম খেল মাহদিয়া। মুখে হাত দিয়ে বসে রইল। বেশ খানিকক্ষণ পরও কোনো আওয়াজ করল না। শিহাব বলল,
-‘কী হলো? ভুল কিছু বললাম? তুমি তো আমার দিয়াপি নও, আমার ভাবী হয়ে এই বাড়িতে আসবে। এখন বোলো, কবে আসবে? আমি কিন্তু ভীষণ ঝগড়ুটে। ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয় না।’
শিহাবের কৌতুক শোনে হাজারও মন খারাপের মাঝে খিলখিল করে হেসে ফেলল মাহদিয়া। বলল,
-‘তুমি আমার সাথে ঝগড়া করবে?’
-‘অবশ্যই করব। সারাদিন করব।’
-‘তাহলে তোমার ভাইয়াকে বোলো, খুব তাড়াতাড়ি এসে যেন তোমার দিয়াপিকে সে এখান থেকে নিয়ে যায়। সে না আসলে তো আমি যেতে পারছি না।’
তাদের সম্পর্কে যে বিশাল ঝামেলা ও টানাপোড়ন আছে এটা এখনও বোধগম্য হয়নি শিহাবের। তাই সে বলল,
-‘ভাইয়াকে পাঠাতেই হবে? না পাঠালে তুমি আসতে পারবে না?’
-‘কী করে আসব? দু’দিক থেকে দুটো ভিলেন আমাকে আটকে রেখেছে। চাইলেও ছুটে যেতে পারছি না। তোমার ভাইয়া এসে ভিলেনদের শাস্তি দিয়ে তারপর আমাকে নিয়ে যাবে। তখন দিয়াপি সবসময়ের জন্য তোমার ঝগড়ার সাথী হয়ে যাবে।’
গম্ভীরমুখে কী যেন ভাবল শিহাব। বলল
-‘ভিলেনকে শাস্তি দিতেই হবে?’
-‘হ্যাঁ। কারণ ওরা অন্যায় করেছে।’
-‘তাহলে ওদেরকে আমি-ই শাস্তি দিব। তুমি একদম চিন্তা করবে না। ঢিশুম-ঢাশুম ফাইট করে ছোটোন তোমাকে শীঘ্রই এখানে নিয়ে আসবে দ্যাখো।’
শিহাব এমনভাবে বলল, যেন সে অনেক ফাইট জানে। তার এইসব বাচ্চামো কথাবার্তা শোনে মাহদিয়া হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এমন ঘর কাঁপানো হাসি শোনে শিহাব গাল ফুলিয়ে বলল,
-‘একদম হাসবে না। যা বলছি সত্যি।’
-‘আচ্ছা। বিশ্বাস করলাম। তুমি শীঘ্রই এসো, আমি অপেক্ষায় থাকব।’
‘ওকে, গুড নাইট’ বলে ভাইয়ের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিল শিহাব। বলল,
-‘আর সময় নষ্ট কোরো না। তুমি খুব তাড়াতাড়ি গিয়ে দিয়াপিকে নিয়ে এসো। ভিলেন নিশ্চয়ই খুব খারাপ। নয়তো দিয়াপি কেন আসবে না?’
-‘একদমই তাই। ভিলেন খুব খারাপ। তুমি ঘুমোও, ভাইয়া আসছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসব।’
শিহাব বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল। শাদাব ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় গেল। একটা শান্তির ঘুমের জন্য হলেও মাহদিয়ার সাথে দু’মিনিট কথা বলা দরকার। নয়তো অভিমানী মেয়েটা সারারাত ছটফট করবে। তার ঘুমটাকে স্বস্তি দিতে একটুখানি সময় তো দিতেই হবে। এ-ও বলতে হবে, আগামীকাল সে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছে ‘কঠিন শাস্তি’র সামনে তার ‘ভ্রমর’-কে দাঁড় করাতে।
***