#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — চৌত্রিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
এত বছরের সাজানো-গোছানো সমস্ত প্ল্যান নষ্ট হওয়ার কারণে আচমকাই যেন শায়লা সুলতানা ভীষণভাবে অসহায় কিছু মুহূর্তকে উপলব্ধি করতে শুরু করলেন। তিনি টের পেলেন, গুটি পুরোটাই উলটে গেছে। মস্তিষ্ক তাঁকে তক্ষুণি সিগন্যাল দিল, মাহদিয়া সব জেনে গেছে, সব দেখে ফেলেছে। আর কোনো লুকোচুরি, আর কোনো নাটকীয়তার প্রয়োজন নেই। এবার যা হবে সব সামনা-সামনি। মুখোমুখি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। মেয়ের কথা শোনে তিনি নিজের ভুল বুঝা তো দূর, উলটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটালেন ঠোঁটে। পরক্ষণেই শক্ত গলায় বললেন,
-‘এই ‘সুখনীড়’-এর সুখ আমার চাই, দিয়া। হাতটা ছাড়। নয়তো খুব খারাপ হবে।’
এতদিন মায়ের দু’একটা চড়-থাপ্পড় খেয়েও বুঝতে পারেনি মাহদিয়া, স্বার্থে আঘাত লাগলে মানুষ যে উন্মাদ হয়ে উঠে। শায়লা সুলতানার আজকের এই সুর, চেহারা সবই তার প্রমাণ দিচ্ছে। নিজের মা’কে এই রূপে দেখতে বড্ড খারাপ লাগছে মাহদিয়ার। সবটুকু বিশ্বাসে কোথা থেকে যেন একদলা উড়ো থুতু এসে পড়ে সমস্ত বিশ্বাসকে নোংরা করে দিয়ে জঘন্য ও ঘৃণ্য এক অনুভূতির সামনে দাঁড় করাল তাকে। সে-ও মায়ের এই কথার উত্তরে হাতটা আরও শক্ত করে ধরে রেখে বলল,
-‘কী খারাপ হবে? মারবে? মারলে কী হবে জানো না? ফাঁ সি হবে, ফাঁ সি। সোজা ঝুলে পড়বে। আমি তোমার মেয়ে বলে, একটু মায়ার টানে, এখনও তোমাকে এখানে সহ্য করছি। কিন্তু আইন এসব মায়া-মমতার ধারেকাছেও যাবে না। একদম টপকে দিবে।’
-‘নিজের মাকে এইভাবে বলতে তোর বুক কাঁপছে না?’
-‘কেন কাঁপবে বোলো তো? পনেরো বছর ধরে আমার সাথে যা করেছ, সায়রা আন্টির সাথে যা করেছ, তার জন্য বুক কেঁপেছিল তোমার? মনে ভয়, মায়া, অনুশোচনা, অপরাধবোধ কিচ্ছু জন্মায়নি? মেয়ের ওপর যদি তুমি দিনের পর দিন এরূপ অত্যাচার করতে পারো, তবে মেয়েও সব সত্য জেনে-বুঝে বিবেককে শুদ্ধ রাখতে তোমাকে ত্যাগ করতে পারে। এতে সামান্যতম বুক কাঁপবে না আমার। কষ্টও হবে না। বরং মুক্তি পাব, শান্তি পাব। তোমার মতো জঘন্য মহিলাকে মা ডাকতে হবে না আর।’
মুখ যতই এত কঠিন কথা বলুক, মন তো জানে এই নারীর মাঝেই শান্তি, সুখ, বিশ্বাস, ভরসা সবকিছু। এক মা ডাকে সমস্ত অন্তরটায় প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায়। সারাদিনের সবটুকু ক্লান্তি, দুঃখ-কষ্ট সব লাঘব হয়ে যায়, মায়ের আঁচলের ছায়ায় ফিরে এলে। অথচ জেনে-বুঝে এই সুখের ও ভরসার আশ্রয় থেকে চিরদিনের জন্য সবটুকু বিশ্বাস, সুখ-শান্তিকে মুছে ফেলতে হচ্ছে। তবু শত চেষ্টায়ও মা’কে অস্বীকার যাচ্ছে না। যাবেও না। যে নারী জন্ম দেয়, লালন-পালন করে, তাকে কী করে অস্বীকার করা যায়?
শায়লা সুলতানা থেমে থাকতে না পেরে হাত মুচড়াতে শুরু করলেন। বললেন,
-‘বাড়াবাড়ি করছিস দিয়া, হাতটা ছেড়ে দে। তোর সাথে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। ঝামেলা নেই। তর্কও নেই। আমার সব ঝামেলা এই পরিবারের সুখশান্তি নিয়ে।’
মানুষ কতটা হিংসাত্মক মনোভাবাপন্ন হলে, অন্যের সুখ দেখে নিজের সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করে। অন্যকে পথে নামাতে, তার ক্ষতি করতে, দু’বার ভাবে না। বিবেককে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিজেকে স্বেচ্ছায় অন্যের শত্রু সাজিয়ে, অকারণ মানুষকে পথে বসানোর মতো এত হিংসা, এত লোভ, একটা মানুষের কী করে হতে পারে! ইনি মানুষ, না-কি অন্যকিছু! একজন সাধারণ মানুষ এত লোভী হয়? শায়লা সুলতানা আজ যেন লোভে অন্ধ হোননি, একেবারে মারাত্মক রকমের উন্মাদ হয়ে গেছেন। তার এই উন্মাদনা শিরায় শিরায় পৌঁছে গিয়ে মানুষ থেকে হয়ে উঠেছেন হিংস্র পশু। বনের বাঘ-সিংহও নিজের সন্তানদের মূল্য দিতে জানে। অথচ এই একজন নারী, যিনি নিজের জন্য সন্তানকে ব্যবহার করে এতদূর অবধি জঘন্য প্ল্যান সাজিয়ে এসেছেন। ঘৃণায় ভেতরটা ঘুলিয়ে আসছে মাহদিয়ার। এত ঘৃণা হচ্ছে যে, নিজেকে এই নারীর সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতেও তার বাঁধছে। চোখ তুলে তাকাতেও অসহ্য লাগছে। কী অদ্ভুত এক পরিস্থিতি এটা! না শ্বাস ফেলা যায়, না গিলে ফেলা যায়। জমাটবাঁধা মেঘের মতো সবটুকু নিঃশ্বাস গলার কাছে আটকে গিয়ে, তীব্র যন্ত্রণায় জর্জরিত করল তাকে। তবুও কণ্ঠে শীতলতা বজায় রেখে বলল,
-‘আমার সাথে দ্বন্দ্ব নেই, কিন্তু এত বছর তো তুমি আমাকেই ব্যবহার করেছ। বিবেক বলে কিছু আছে তোমার? নিজের মেয়ের সাথে কীভাবে এসব অন্যায়-অত্যাচার করছ তুমি?’
-‘কেন করব না? এই লোকটা তোর বাবাকে দিনের পর দিন খাটিয়ে মেরেছে। সঙ্গে থাকো, এটা কোরো, ওটা কোরো, এটা দ্যাখো, খেয়াল রাখো, এসব করে নিজের কেনা গোলাম বানিয়ে রেখেছে। আর মাস শেষে টাকা দিয়ে সব গোলামী উশুল করে দিয়ে বাহ্বা কুড়িয়েছে।’
-‘তো? চাকরি-বাকরি তো মানুষ এইভাবেই করে! করে না? টাকা কি এমনি আসে? থালা নিয়ে রাস্তায় বসলে আর ডলার পেয়ে গেলে! এমন চিন্তাভাবনা তোমার? কেউ তোমার উপকার করছে, তোমাকে উপার্জনের পথ দ্যাখিয়ে দিয়েছে, বিনিময়ে তুমি পাচ্ছ দু’হাত ভরা টাকা। একটা মানুষের শ্রমকে তুমি এত তুচ্ছ করে দ্যাখো কেন? শ্রম ছাড়া টাকা কে দিবে তোমায়? সম্পদ হবে কী করে? সব কি আকাশ থেকে খসে খসে পড়বে?’
-‘তোর বাবার উপার্জন করা টাকায় কি আর সংসারে সুখ মিলত? সেই তো আমাকে বাবার বাড়ি থেকে ধারকর্জ আনতে হোতো। আমার কত খারাপ লাগত। কতকিছু চাইতাম, কিছুই পেতাম না। সবসময় শুধু হাত ফাঁকা, হাত ফাঁকা।’
-‘তাতে কী হয়েছে মা? লজ্জায় নাক-মুখ কাঁটা গেছে? এখন লজ্জা হচ্ছে না? পরিবারে ঠিকমতো স্বচ্ছলতা ফিরে আসেনি দ্যাখেই তো বাবা দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে তো সব ঠিকঠাকই ছিল। যা চেয়েছ, তাই পেয়েছ। তারপরেও কেন তোমার এই রূপ?’
শায়লা সুলতানা শুধু হাসলেন। এই বাড়ি, এই সম্পত্তি, এই ‘সুখনীড়’, এটা তো তারমতো নারীর জীবনের একমাত্র চাওয়া। এটা পেতে গিয়ে যা কিছু করা দরকার, তিনি তো তা-ই করেছেন। এত বছরের অপেক্ষার অবসান যখন ঘটতে শুরু করল, তখনই মাহদিয়া সব জেনে গেল। এতে তাঁর আফসোস হচ্ছে না। নিজের উপর ঘৃণাও হচ্ছে না। বরং নিজের বুদ্ধির খেল দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন। কত নিখুঁতভাবে সায়রা করীমকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছেন তিনি। কত নিখুঁতভাবে কায়ছার সাহেবের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। আজ এত সহজেই তা ছেড়ে দিবেন। মোটেও না। দু’হাত ভরা সুখ নিয়ে তবেই তিনি ইতালি যাবেন। মনের ভেতরের সবটুকু লোভকে আবারও জাগিয়ে তুললেন তিনি। বললেন,
-‘তোকে মাথা ঘামাতে নিষেধ করছি। সর এখান থেকে। গিয়ে তৈরী হ। আজই বাড়ি যাব। কাল বিকেলের ফ্লাইটে ইতালি যাচ্ছি আমরা। সবকিছু কনফার্ম করে নিয়েছি আমি।’
মাহদিয়া ভীষণ চমকাল। এতদূর ভাবনা সাজিয়ে বসে আছেন তিনি! অথচ মেয়েকে কিচ্ছু টের পেতে দেননি। সে অবাক হলেও শান্তকণ্ঠে বলল,
-‘ভালো। তাহলে তুমি একাই যাও। আমি যাচ্ছি না।’
কথার ফাঁকে বেখেয়ালিতে মায়ের হাতটা ঢিলে করে ফেলেছিল মাহদিয়া, তক্ষুণি তিনি মেয়ের চুল টেনে ধরলেন। টানতে টানতে রুমের দিকে নিয়ে যেতে গেলে, কায়ছার সাহেব আটকাতে গেলেন। বললেন,
-‘ও’কে ছাড়ো শায়লা। খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছ তুমি!’
-‘ও আমার মেয়ে। যা খুশি করব। তুই নাক গলানোর কে?’
-‘এটা ওর শ্বশুরবাড়ি। এখানে তুমি যা খুশি তা-ই করতে পারো না।’
-‘একশোবার করব, তুই আমাদের মা-মেয়ের মাঝখানে আসবি না। দূর হ শয়তান।’
কথা শেষ করেই বয়স্ক মানুষটাকে ধা ক্কা মারলেন তিনি। কায়ছার সাহেব ছিঁটকে পড়লেন কয়েক হাত দূরে। এই মহিলার এমন জঘন্য রূপ দেখে তিনি সাময়িক সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কী করবেন, কিছুই যেন ভেবে পেলেন না। মাহদিয়াও এসব দৃশ্য সহ্য করতে পারল না। রাগে-দুঃখে মা’কে ধাক্কা মারতে লাগল। তবুও ছাড়াতে পারল না। উলটে তাঁর হিংস্রতা আরও বাড়ল। তিনি একাধারে চড়-থাপ্পড় মেরে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভেতর মেয়েকে আটকে রাখতে গেলেন। মা’কে ঠেলেঠুলে নিজেকে মুক্ত করে দু’হাতে কায়ছার সাহেবকে মেঝে থেকে টেনে তুলল মাহদিয়া। বলল,
-‘ব্যথা পেয়েছ বড়ো মামা? বোসো একটু, এক্ষুণি শাদাবকে কল করছি। তুমি চিন্তা কোরো না, ও আসলে মায়ের এই গলাবাজি থেমে যাবে।’
এতকিছুর পরও হাতের মুঠোয় নিজের ফোনটাকে কোনোমতে বাঁচিয়ে রেখেছিল মাহদিয়া। যেই ফোন করতে গেল, অমনি শায়লা সুলতানা সেটা কেড়ে নিয়ে একটা আছাড়ে দু’টুকরো করে ফেললেন। আবারও মেয়ের চুল ধরতে গেলে কায়ছার সাহেব সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন,
-‘তোমার সম্পত্তি লাগে, তুমি সব নিয়ে যাও। তবুও নিজের মেয়ের উপর এমন অত্যাচার কোরো না।’
মাহদিয়া চেঁচিয়ে উঠে বলল,
-‘খবরদার বড়ো মামা। ভুল করেও এত ভালো হবে না তুমি। কোনো সম্পত্তি দিবে না। এই মহিলাকে পুলিশে দেয়া উচিত। নাহার খালা, কোথায় তুমি? ছোটো মামাকে ফোন করেছ?’
মাহদিয়া নিচু হয়ে নিজের ভাঙা ফোনটা জোড়া লাগানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেল। নূরুন্ নাহার কোথায় যে গেলেন, তার আর কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফাঁক পেয়ে কায়ছার সাহেব নিজের ফোন থেকে ভাইকে কল করতে গেলেন। শায়লা সুলতানা পরিস্থিতি গরম ও বিপদের আশঙ্কা বুঝতে পেরে চোখ ঘুরিয়ে কী যেন খুঁজলেন। চট করে পেয়েও গেলেন কাছে। তিনি তখন আর হুঁশে নেই। পুরোটাই বেহুঁশ ও একদম কন্ট্রোলের বাইরে। কায়ছার সাহেব যখন ক্রমাগত ফোন কানে ঠেকিয়ে ওপাশের ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন, অমনি পাশে থাকা মাটির ফুলদানি হাতে তুলে, চোখ বন্ধ করে জোরসে একটা আঘাত করলেন কায়ছার সাহেবের মাথা বরাবর। একবার নয়, দু’বার, তিনবার। প্রথমবার ফুলদানি ভাঙল, তিনি সামান্য চোখ মেলে দ্বিতীয়বার ভাঙা অংশ দিয়ে আঘাত করলেন। তৃতীয়বারেই সারাঘর কাঁপিয়ে ‘মা’ বলে ভয়ানক এক চিৎকার দিলে মাহদিয়া। পরমুহূর্তেই রক্তাক্ত শরীর নিয়ে ঢলে পড়ল মেঝেতে। তার মাথার একপাশ আর আস্তো রইল না।
মেয়ের চিৎকার শোনে হুঁশে ফিরলেন শায়লা সুলতানা। চোখ খুলে ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে থমকে গেলেন। আদরের মেয়েটার মাথা ফেটে রক্ত পড়তে পড়তে পুরো মেঝে ভরে গিয়েছে। কায়ছার সাহেব হতভম্ব হয়ে কিছুটা দূরে টালমাটাল অবস্থায় পড়ে আছেন। কাকে মারতে গিয়ে, কাকে মেরেছেন এই জ্ঞানটা মাথায় ঢুকতেই তড়িঘড়ি মাহদিয়ার রক্তাক্ত শরীর কোলের ওপর তুলে নিলেন। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-‘দিয়া ওঠ। কথা বল মা। কী হলো তোর? আমি তোকে মারতে চাইনিরে মা। কী হয়ে গেল এটা? কী করে ফেললাম আমি? নিজের মেয়েকে…। দিয়া, ওঠ মা।’
ঝড়েরবেগে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল শাদাব। নূরুন্ নাহার তাকে ফোন করা মাত্রই সে রোগী রেখে রওনা দিয়েছিল। তাকে বলেছিল, ‘তুমি থানায় যাও, আমি বাড়ি আসছি।’ এতেই নূরুন্ নাহার আর ঘরে বসতে পারেননি। ছুটে গিয়েছেন থানায়। শাদাব আসতে যে এত দেরী হবে কে জানত! কম্পনরত হৃৎস্পন্দন নিয়ে যখন সে উপরের দিকে দৃষ্টি দিল, তখনই শুনল শায়লা সুলতানার আহাজারি। একমুহূর্ত দেরী করল না। পা চালিয়ে এসে তার ‘প্রাণবঁধুয়া’র এই রক্তমাখা শরীর দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য টের পেল, পুরো পৃথিবী দুলে উঠছে। বড়োছোটোর হিসেব ভুলে গেল। চারপাশে তাকিয়ে ভাঙা ফুলদানি দেখে ও শায়লা সুলতানার বিলাপ শোনে দু’হাতের সর্বোচ্চ শক্তিতে ওই মহিলাকে ধাক্কা মারল শাদাব। শায়লা সুলতানা চমকালেন। ঘাবড়ালেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু বলার আগেই মাহদিয়ার নেতিয়ে পড়া শরীরটা কোলে নিয়ে দ্রুতপায়ে বাইরের দিকে এগিয়ে গেল সে। পিছন পিছন ওই খারাপ মহিলাকে এগোতে দেখে চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘ওর যদি কিছু হয়, আপনাকে আমি পৃথিবীতে বাঁচতে দেব না।’
শায়লা সুলতানা কিছু বললেন না, বেহায়ার মতো শাদাবকে অনুসরণ করে এগোতে লাগলেন। বিরক্ত হলো শাদাব। বলল,
-‘ওখানেই থামুন। যদি আর এক’পা এগোন, জানে মে রে ফেলব। আপনি ওর মা, সেটা ভুলে যাব আমি।’
চোখের পলকে মাহদিয়াকে নিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা দিল শাদাব। জীবন হারানোর ভয়ে, পুলিশ কেইস ও ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে, শায়লা সুলতানা নিজের ভ্যানিটিব্যাগ চেক করে টাকা-পয়সার হিসাব দেখে নিজের পাসপোর্টটাও দেখে নিলেন। কায়ছার সাহেবের সাথে আর কোনোপ্রকার দ্বন্দ্বে গেলেন না। দৌড় দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে মাত্র বাইরের বারান্দায় আসলেন। অমনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। শুধু হায়দার সাহেবই নোন, তার সঙ্গে আজাদ সাহেবও দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁচার জন্য উপায় খুঁজে নিয়ে মায়াকান্না জুড়ে দিয়ে বললেন,
-‘তুমি এসেছ? বড়ো ভাইজান দিয়াকে মারতে মারতে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছেন। শাদাব ও’কে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে। আমিও যাচ্ছি। তুমিও তাড়াতাড়ি এসো।’
আজাদ সাহেব কিছুক্ষণ নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। এসেছিলেন, সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু আজ তিনি নিজেই সারপ্রাইজড। ভয়ানক সারপ্রাইজড। হায়দার সাহেব জানতেন, আজ মাহদিয়ার বাবা দেশে ফিরছেন। তাই তিনি নিজেই তাকে এগিয়ে আনতে এয়ারপোর্ট গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে সবকিছু তাকে খুলেও বলেছেন। একদিকে মেয়ে, অন্যদিকে স্ত্রী। কোথায় যাবেন তিনি? ‘সুখনীড়’-এ যে এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল, সেটারই বা কী প্রয়োজন ছিল! স্ত্রীর এই মায়াভরা কণ্ঠস্বর শোনে বললেন,
-‘খুব তাড়া না, হসপিটালে যাওয়ার?’
-‘ওমা! যাব না? দিয়া বাঁচবে কি-না কে জানে! এত বড়ো ফুলদানির আঘাত। মেয়েটা আমার সহ্য করতেই পারল না।’
-‘বড়ো ভাইজান খুব খারাপ তাই না? তুমি চিন্তা কোরো না। দিয়ার কিচ্ছু হবে না। শাদাব আছে তো।’
-‘ঠিক বলেছ। ছেলেটা বড্ড ভালো। আমি যাই এখন। দিয়া…।’
নাটক করতে আর ভালো লাগছে তাঁর। পালাতে পারলেই বাঁচেন। মাহদিয়াকে দেখতে যাওয়ার অজুহাতে পাশ দিয়ে যখন ‘সুখনীড়’-এর মূল প্রবেশদ্বারের কাছে এগোলেন, তখনই নূরুন্ নাহার পুলিশের একটা টিম নিয়ে হাজির হলেন। শায়লা সুলতানা রাগে কিড়মিড় করে বললেন,
-‘এই মহিলাটা শান্তি দিল না।’
নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে, পূণরায় নাটকীয় কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। দু’হাত জোর করে পুলিশের সামনে বসে গেলেন। বললেন,
-‘আমার মেয়েকে বাঁচান অফিসার। এই বাড়ির একটা মানুষও ভালো নয়। কেউ আমাদের ভালো চায় না। কিছুক্ষণ আগে এমদাদ কায়ছার আমার মেয়েকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে। আমি মেয়েকে দ্যাখতে হসপিটালে যাচ্ছি। বিশ্বাস না হলে আপনারাও আসুন।’
সুযোগ বুঝে দ্রুত পা চালালেন শায়লা সুলতানা। পিছন থেকে আজাদ সাহেব বললেন,
-‘একটু দাঁড়াও শায়লা।’
শায়লা সুলতানা তাড়া দিয়ে বললেন,
-‘না, না, দাঁড়ালে হবে কী করে? দিয়া হসপিটালে…।’
-‘দিয়া হসপিটালে, ওর সাথে শাদাব আছে। তুমি এখানে থাকো। ঘটনা কী ঘটেছে, বিস্তারিত বোলো আমাকে। শুনি। কোথা থেকে কী হোলো, জানতে হবে তো!’
বেকায়দায় ফেঁসে গেলেন শায়লা সুলতানা। এক্ষুণি পুলিশ আসার কী দরকার ছিল! এখান থেকে বের হতে না পারলে কীভাবে ফ্লাইট ধরবেন তিনি? এভাবে সামনে থেকে পালানোরও কোনো সুযোগ নেই আর। তাই পালানোর চিন্তা বাদ দিলেন। স্বামীর কথার উত্তরে বললেন,
-‘শাদাব ওর সম্পত্তি চাইতে এসেছিল। ভাইজান সেটা দিতে নারাজ। দিয়া জোরাজুরি করেছিল দ্যাখে, ফুলদানি দিয়ে ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন।’
-‘ওহ, ঘটনা এই?’
-‘হ্যাঁ। আমি এখন যাই…।’
পূণরায় যেতে চাইলেন তিনি। আজাদ সাহেব তাকে আটকিয়ে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-‘ও’কে নিয়ে যান অফিসার। আমি ও’র স্বামী হয়ে বলছি, আজকের পুরো দুর্ঘটনার মূল কালপ্রিট এই মহিলা।’
নূরুন্ নাহার এখানকার সব ঘটনা, আগের ঘটনা সবটাই থানায় গিয়ে পুলিশের সামনে বলেছেন। হায়দার সাহেব, আজাদ সাহেব দু’জনেই গাড়িতে থাকা অবস্থায় পুলিশের সাথে কথা বলেছেন। সবকিছু তারা জানলেও, এখানে কিছুক্ষণ আগে কী ঘটেছে কিছুই জানেন না। তবুও যে অভিযোগ এসেছে, তার ভিত্তিতে শায়লা সুলতানার হাতে হাতকড়া পরানোর অনুমতি দিলেন। নারী কন্সটেবল এগিয়ে এসে হাত ধরতেই শায়লা সুলতানা প্রতিবাদী কণ্ঠে বললেন,
-‘আমার কোনো দোষ নেই অফিসার। এরা সবাই মিথ্যে বলছে।’
পুলিশ অফিসার তাকে অভয় দিয়ে বললেন,
-‘মামলা যেহেতু হয়েছে, থানায় যেতে হবে আপনাকে। আগে আমাদের সাথে চলুন, নিজের মন্তব্য পেশ করুন। এরপর আমরা আপনার মেয়ের সাথেও কথা বলব। তার আগে ওনার শারিরীক কন্ডিশন কী, সেটা জানতে হবে।’
না গিয়েও উপায় নেই। এখন পালাতে গেলেই বিপদ হয়ে যাবে। ফেঁসে যাবেন। কিন্তু থানাতে গেলেও তো ঝামেলা! একটাই উপায়, মাহদিয়া। মেয়েটা তাড়াতাড়ি সুস্থ হলেই নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন তিনি। এরপর সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাবেন। একবার দেশ ছাড়লে, আর কে ফিরে আসে এখানে! ‘সুখনীড়’-এর এই ভয়ানক সুখের আর দরকার নেই তার। দরকার শুধু বেঁচে থাকার, শান্তিতে থাকার। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললেন,
-‘আগে আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলুন। আমার মেয়েকে একনজর দ্যাখে, তারপর থানায় যাব।’
***
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — পঁয়ত্রিশ
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
চাতকপাখির ন্যায় ছটফট করতে করতে হসপিটালে পা রেখে, অস্থির-অশান্ত মন নিয়ে দিশেহারার মতো নাড়িছেঁড়া ধনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন শায়লা সুলতানা। মাহদিয়াকে নিয়ে কোন হসপিটালে এসে উঠেছে শাদাব, এটা তিনি না জানলেও রওনা দেয়ার সময় হায়দার সাহেব পুলিশকে জানিয়ে ছিলেন। তাই পুলিশই স্থানীয় শহরের একটা প্রাইভেট ক্লিনিকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই হসপিটালে শাদাবের একজন ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে, যে ওইমুহূর্তে হসপিটালেই ছিল। এটা শাদাব জানত দেখে অন্য কোথাও আর যায়নি। ডক্টরকে ফোন করেই আগে অপারেশন থিয়েটার প্রস্তুত রাখতে বলেছে। মাহদিয়ার যা অবস্থা, তাতে ইমিডিয়েট মাথায় অস্ত্রোপচার না করলে, মেয়েটার জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। ভয়ে আতঙ্কে জমে যাওয়া শাদাব ডানে-বামে তাকায়নি। সোজা অপারেশন রুমে প্রবেশ করেছে।
তিন-চার ঘণ্টার লম্বা সার্জারী শেষ করে যখন সে তার বন্ধু পল্লবকে নিয়ে অপারেশন রুম থেকে বের হলো, তখনই শায়লা সুলতানাকে হা-হুতাশ করতে দেখে মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। তিনি তাকে খেয়াল করেননি, অ্যাপ্রোন ও মাস্কের কারণে মুখ ঢাকা ছিল তার। শায়লা সুলতানার চোখের আড়ালেই স্ট্রেচারটা অন্যদিকে পাস করে অজ্ঞান মাহদিয়াকে একটা কেবিনে শিফট করে দিল। সঙ্গে দু’জন নার্সকে সার্বক্ষণিক সেবার জন্য বসিয়ে রাখল। মাহদিয়ার খেয়াল রাখতে বলে, দুই বন্ধু মিলে বাইরে এলো। মুখের মাস্ক খুলে দু’জনেই ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছিল। এমন সময় ধুপ করে মেঝেতে বসে পড়লেন শায়লা সুলতানা। হাত জোর করে শাদাবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘আমার মেয়েটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও শাদাব। আমি আর কিচ্ছু চাই না। শুধু আমার মেয়েটাকে চাই।’
গর্ভের সন্তানকে মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে দিয়ে এখন আবার তাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন! দয়ামায়াহীন, বিবেকহীন এই নারীর আর্তনাদ তার হৃদয়ে পৌঁছাল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শায়লা সুলতানা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-‘মেয়েটা আমার বড্ড আদরের শাদাব। জেনে-বুঝে আমি ও’কে আঘাত করিনি। ভুলবশত হয়ে গেছে। আমি তো তোমার বাবাকে…।’
কথার মাঝখানে তাঁকে থেমে যেতে দেখে সন্দিহান চোখে তাকাল শাদাব। উনি মিনমিন স্বরে কিছু একটা বকে গেলেন। শাদাব তা স্পষ্ট শুনল না। তবে ওইটুকু অসম্পূর্ণ কথা সে বুঝ নিয়ে বিস্ময়ের সাথে বলল,
-‘আপনি বাবাকে মারতে গিয়েছিলেন?’
শায়লা সুলতানা নীরব রইলেন। শাদাব পাথর হয়ে গেল। একটা মানুষের এত জঘন্য রূপ দেখে তার রুচি হারিয়ে যাচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও। তবুও সমস্ত সত্যি জানতে কণ্ঠস্বর শক্ত করে বলল,
-‘আপনি নিজেকে মা দাবী করছেন কী করে? আপনার লজ্জা হচ্ছে না? একজন বয়স্ক মানুষকে মারতে গিয়ে নিজের মেয়েকে একেবারে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি ওর জ্ঞান না ফিরে, তাহলে…।’
-‘বলছি তো আমি, ইচ্ছাকৃত আঘাত নয় এগুলো!’
কথা বলতে ইচ্ছে হলো না শাদাবের, তাই এড়িয়েই গেল। পিছনে আজাদ সাহেবও ছিলেন। ‘সুখনীড়’-এ শুধু কয়েক মিনিট বসে কায়ছার সাহেবের সাথে কথাবার্তা বলেছেন। বাকি কথা পড়ে হবে বলে, মেয়েকে দেখতে হায়দার সাহেবকে সাথে নিয়ে হসপিটালে এসেছেন। এখন এখানে পৌঁছে, স্ত্রী ও শাদাবের মুখের কথা শোনে মেয়ের জন্য ভেতর কেঁদে উঠল তাঁর। শায়লা সুলতানার দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-‘তুমি যে একজন মা, সেটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার। সামান্য লোভ তোমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে আজ, বুঝতে পারছ কিছু? মেয়ের সামনে এই চেহারা নিয়ে দাঁড়াবে কী করে?’
শায়লা সুলতানা কোনো প্রতুত্তর করলেন না। পাশে থাকা চেয়ারে বসে একাধারে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। আজাদ সাহেব সোজা শাদাবের মুখোমুখি হয়ে তার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন। শাদাব স্বাভাবিকভাবেই সালাম দিল, ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল। এরপর মাহদিয়ার অবস্থা জানতে চেয়ে তিনি বললেন,
-‘খুব বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে ওর? জ্ঞান কখন ফিরবে কোনো আইডিয়া আছে?’
-‘আ’ম স্যরি আংকেল, আমি আপনাকে মিথ্যে আশা দিব না। ওর ব্রেইন ড্যামেজ হওয়ার আশঙ্কা আছে। যদিও অপারেশন সাকসেসফুল, তবে পুরো সুস্থতা নির্ভর করছে কত দ্রুত জ্ঞান ফিরছে এর ওপর। ছোটো ছোটো অসংখ্য মাটির টুকরো মাথায় গেঁথে গিয়েছে। বামপাশে ত্রিশটা সেলাই বসাতে হয়েছে। এত আঘাত ওর শরীরের চেয়ে মনকে প্রভাবিত করেছে বেশি। জ্ঞান ফিরলেও ধকলটা সামলাতে অনেক সময় লাগবে।’
একটামাত্র মেয়ে, তার শরীরের এই অবস্থা শোনে যথেষ্ট মুষড়ে পড়লে আজাদ সাহেব। শাদাব তাঁকে ধরে, চেয়ারে বসাল। ঠাণ্ডা মাথায় বুঝাল,
-‘ভেঙে পড়বেন না আংকেল। এইমুহূর্তে আপনাকেই ওর বেশি প্রয়োজন হবে। নিজেকে শক্ত রাখুন প্লিজ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরলে ‘আলহামদুলিল্লাহ্’। নয়তো অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কিচ্ছু থাকবে না।’
আজাদ সাহেব আচমকাই রেগে গেলেন। স্ত্রীর দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
-‘আমার মেয়েটার যদি কিছু হয়, তোমাকে বুঝিয়ে ছাড়ব সম্পর্কে ভাঙন টেনে আনার পরিণাম কী!’
শায়লা সুলতানা নিজেও যথেষ্ট ব্যথা পেয়েছেন মনে। তিনি তখন কায়ছার সাহেবকে নিশানা করেই ফুলদানিটা ছুঁড়েছিলেন। প্রথম আঘাতের পর যখন কায়ছার সাহেবকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলেন, তখনও নিশ্চিত ছিলেন, আঘাতটা ওনার শরীরেই পড়েছে। তাই কোনোদিকে না তাকিয়ে পরপর দুটো আঘাত দিয়ে সম্পূর্ণ ফুলদানিটাই ভেঙে ফেলেছিলেন। মাহদিয়া চিৎকার না দিলে তিনি হয়তো আরও মারতেন। মারতে মারতে মেরেই ফেলতেন আদরের সন্তানকে। কিন্তু এখন আর আফসোস করে কী হবে! মাহদিয়ার এই অবস্থার জন্য তো তিনি-ই দায়ী। এইমুহূর্তে পুলিশের কাছে ধরা পড়া নিয়ে তার যত ভয়, তারচেয়ে বেশি ভয় মেয়েকে হারানোর। কোল খালি হওয়ার যে যন্ত্রণা কী, সেটা তিনি এখনই টের পেয়ে গেছেন। ভবিষ্যতে মেয়েকে ছাড়া থাকা কঠিন হয়ে যাবে তারজন্য। কী করবেন, কিছু ভেবে পেলেন না। সোজা শাদাবের পায়ের কাছে বসে পড়লেন। কাকুতিমিনতি করে বললেন,
-‘আমার মেয়েটাকে বাঁচাও বাবা।’
শাদাবের রাগ হলো। প্রচণ্ড রাগ। এতটা আঘাত করে এখন আবার মেয়ের জন্য এই লোকদেখানো আহাজারির কোনো কারণ খুঁজে পেল না সে। শুধু চোখমুখ শক্ত করে বলল,
-‘মারতে পারলেন আপনি, বাঁচাতে পারবেন না? আমাকে কেন বলছেন? আমার হাতে আর কিছু নেই। যদি হায়াত থাকে তাহলে বাঁচবে, নয়তো না। আর যদি একবার ও সার্ভাইব করে, তাহলে চিরদিনের জন্য আপনার নাম ওর মন থেকে মুছে দিব আমি। কথাটা মনে রাখবেন…।’
শায়লা সুলতানা আরও বেশি ভয় পেলেন। ঘাবড়ে গেলেন। ওখানে বসেই মেঝেতে পড়ে মেয়ের জন্য বিলাপ করতে লাগলেন। এসব আর ভালো লাগল না শাদাবের। সে পুলিশের লোকজনের সাথে দেখা করার জন্য নিচে চলে এলো। সেখানে হায়দার সাহেব এতক্ষণ ওনাদের সাথে পারিবারিক এই ঝামেলা বিষয়ক সম্পূর্ণ ঘটনা তুলে ধরলেন। একেবারে ওদের বিয়ে থেকে শুরু করে, এ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। এতে যদি তাদের কেইসটা সামলাতে সুবিধা হয়!
***
রাত বারোটার দিকে অপারেশন হলেও ভোরের আলো ফোটার পরও মাহদিয়ার শিয়রের কাছে বসে রইল শাদাব। মাঝখানে শুধু তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ পড়ার সময় খানিকটা দূরে ছিল। এরমধ্যে দুই ব্যাগ রক্তও দিতে হয়েছে। শায়লা সুলতানা দূর থেকেই মেয়েকে দেখেছেন, ভেতরে আসার সাহস পাননি। শাদাব যেভাবে রেগে আছে, তাঁকে ধাক্কা মেরে বাইরে ফেলে দিতে পারে। তাই লোকলজ্জার ভয়ে, দূরে থেকেই অন্তরটা শান্ত করার চেষ্টা করলেন। আজাদ সাহেবও মেয়েকে একনজর দেখে সিজদায় বসে প্রার্থনা করছেন। ফজরের নামাজ শেষ করে যখন তিনি পূণরায় মাহদিয়াকে দেখতে ভেতরে ঢুকলেন, তখনও শাদাবকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ব্যান্ডেজযুক্ত মাথার দিকে তাকাতেই হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল তাঁর। তিনি সহ্য করতে পারলেন না। তৎক্ষনাৎ সরে পড়লেন। শাদাব ধীরস্থিরভাবে মাহদিয়ার মাথায় হাত রাখল। কপালের মাঝখানে আলতো স্পর্শে অধর ছুঁলো। চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরছে তার। কখনও ভাবেনি, এই মেয়েটার জন্য তার হৃদয় এত অশান্ত হবে। হারানোর ভয়ে বুক কাঁপবে। তখন দূরে ছিল, তাই তার না হলেও বেঁচে আছে, শান্তিতে আছে, এটাই তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল। কিন্তু এখন, তার সামনে থেকেও মেয়েটা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে, হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করতে পারছে না। মাহদিয়ার এত শখের এলোমেলো, কুঁকড়ানো, পরিপাটি চুলগুলোও আর নেই। সব চুল ফেলে দিতে হয়েছে। নয়তো মেডিসিন ব্যবহার করতে অসুবিধা হচ্ছিল, সেলাই করা যাচ্ছিল না। কতটুকু কেটেছে তা-ও বুঝা যাচ্ছিল না। সবকিছুর পরেও চঞ্চল মেয়েটাকে এইভাবে নিশ্চুপ অবস্থায় আর সহ্য করতে পারছে না। ভেতরটা ছটফট করছে। একটু চিৎকার করে কাঁদলে হয়তো শান্তি পেত, কিন্তু তা-ও পারছে না। নীরব আর্তনাদে বুক ফেটে যাচ্ছে তার।
বেশ খানিকক্ষণ পর পল্লব কেবিনে প্রবেশ করল। শাদাবকে বসে থাকতে দেখে বলল,
-‘কিছুক্ষণ বিশ্রাম নে ভাই, এভাবে বসে বসে নির্ঘুম রাত কাটালে তুই-ও অসুস্থ হয়ে পড়বি।’
অপারেশনের পর চলে গিয়েছিল পল্লব। সকালেই আবার ছুটে এসেছে। অসহায়, মলিন চেহারা নিয়ে বন্ধুর দিকে একনজর তাকাল শাদাব। তার নির্ঘুম রাতের চিহ্ন, স্পষ্ট ভেসে উঠেছে চোখে। তা দেখে আরও খারাপ লাগল পল্লবের। বলল,
-‘তুই একটু বোস, আমি ক্যানটিন থেকে নাশতা নিয়ে আসি। রাত থেকে না খেয়ে বসে আছিস নিশ্চয়ই।’
-‘কিছু লাগবে না এখন। ক্ষিধে নেই আমার। নাহার খালা খাবার পাঠিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে।’
-‘ক্ষিধে নেই বলে একেবারে না খেয়ে থাকবি? বোস একটু। ভারী কিছু খেতে হবে না। চা-বিস্কুট নিয়ে আসছি।’
সামান্য কিছু খাবার আনতে ক্যানটিনে ছুটল পল্লব। কিছু বলতে পারল না শাদাব। বাঁধা দিতেও পারল না। চোখদুটো জ্বলছে তার। দৃষ্টি তখনও মাহদিয়ার দিকে স্থির। একটা হাত তার হাতের মুঠোয় যত্ন করে আগলে নিয়ে গালে ঠেকিয়ে বলল,
-‘আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব আমি? একবার তো চোখ মেলে আমাকে দ্যাখো। একবার কথা বোলো আমার সাথে। নাম ধরে ডাকো। ঝগড়া কোরো। রাগ-অভিমান দ্যাখাও। জড়িয়ে ধরে কাঁদো। মারো, বকো, যা খুশি কোরো ভ্রমর, তবুও এইভাবে ঘুমিয়ে থেকো না।’
মাহদিয়া সেই নীরব আর্তনাদ শুনল না। বুঝল না। জানলও না, কেউ তার জন্য সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে, সিজদায় পড়ে কেঁদেছে। এত প্রার্থনা, এত ফরিয়াদ, সব বুঝি বিফলে যাবে? কেন জ্ঞান ফিরছে না মেয়েটার? আর কতক্ষণ এইভাবে থাকবে?
মাহদিয়ার জ্ঞান ফিরছে না দেখে পুলিশও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারছে না। তখন শাদাব তাদের অপেক্ষা করতে বলেছিল। কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া শায়লা সুলতানাকেও জোর করে থানায় নিয়ে যেতে পারছিলেন না। তাই কন্সটেবল ও দু’চারজন পুলিশ সদস্যকে পাহারায় রাখা হয়েছে। যারা প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহূর্তে শায়লা সুলতানার ওপর নজর রাখছিল। এখনও একবার কেবিনের কাছাকাছি এসে মাহদিয়াকে চেক করে গেছে। সবার এত অপেক্ষার মাঝেও নিশ্চুপে, নীরবে ঘুমোচ্ছে মাহদিয়া।
***
চব্বিশঘণ্টা পেরোবার প্রয়োজন পড়ল না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল চারটায় মধ্যেই একবার ব্যথাতুর শরীর অস্ফুটস্বরে ‘উহ্’ উচ্চারণ করে চোখ মেলে চারপাশে তাকানোর চেষ্টা করল মাহদিয়া। অল্প একটু তাকিয়ে আবারও নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুরোপুরি চোখ মেলে তাকাল। আবছা আলোর মতো চিরচেনা পুরুষের ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ দেখে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পারল না। উল্টাপাল্টা কীসব বিড়বিড় করতে করতে আবারও গভীরঘুমে ঢলে পড়ল। সেই ঘুম ভাঙল একদম রাত আটটার দিকে। ততক্ষণে জ্ঞান ফেরার পর, পরবর্তী ট্রিটমেন্ট চালিয়ে নিয়েছে শাদাব। ভয় ছিল, ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার। যেভাবে আঘাত লেগেছে, পঞ্চাশ শতাংশ ড্যামেজ হওয়ার আশঙ্কা ছিল। যা তার স্মৃতিশক্তির ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলতে পারত। সেরকম কিছু হয়নি দেখেই তৎক্ষনাৎ পরিষ্কার জায়গা দেখে শোকরানা সিজদাহ্ দিয়েছিল শাদাব।
ঘুম ভাঙার পর এবার স্পষ্টচোখে নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্বে শাদাবকে দেখতে পেয়ে আলতোভাবে সম্পূর্ণ মুখখানি ছুঁয়ে দিল একবার। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল সে হসপিটালে। কখন, কীভাবে এখানে এলো কিছুই মনে পড়ল না। শুধু মনে পড়ল, মাথায় আঘাত লেগেছিল। আলগোছে নিজের মাথায় হাত রেখেই চোখ বন্ধ করে নিল। বুঝে গেল, তার শখের চুলগুলো আর নেই। প্রচণ্ড কষ্ট হলো। কান্না পেল। সব ঘটনা একে-একে চোখের সামনে ভেসে উঠল। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
-‘আমি বেঁচে আছি কী করে?’
শাদাব মাথা নাড়ল। ভয় দূর করতে বলল,
-‘বাঁচতে হোতো তোমায়। আমাদের সবার জন্য। এখন কেমন লাগছে?’
-‘বেশ ভালো না।’
-‘ক্ষিধে পেয়েছে? কিছু খাবে?’
-‘পরে খাব। মা কোথায় শাদাব? আমি মায়ের সাথে একবার কথা বলতে চাই। মা কি ইতালি চলে গেলেন? টিকিট কনফার্ম করা ছিল তো।’
মাহদিয়ার সবকিছু মনে আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শাদাব। কপালে নির্ভরতার চুমু এঁকে বলল,
-‘তুমি একটু অপেক্ষা কোরো, আমি তোমার বাবা-মা দু’জনকেই পাঠাচ্ছি।’
আজাদ সাহেবের কথা শোনে মাহদিয়া চমকাল। বলল,
-‘বাবা চলে এসেছেন? জানেন আমি এখানে?’
-‘হ্যাঁ। গতকাল সারারাত তোমার জন্য কেঁদেছেন। প্রার্থনা করেছেন। পুরো চব্বিশ ঘণ্টা পর স্বাভাবিকভাবে কথা বলছ তুমি।’
-‘আর মা?’
-‘আছেন। বোসো, ওনাদের পাঠাই।’
-‘তুমিও এখানে থাকো।’
-‘ভয় পেও না। খুব বেশি দূরে যাব না।’
শাদাব বাইরে যাওয়ার পর আজাদ সাহেব ও শায়লা সুলতানা ভেতরে প্রবেশ করলেন। তিনজনকে নিজেদের মতো ছেড়ে দিয়ে বাইরে বসে রইল শাদাব। হায়দার সাহেবকে ফোন করে জানাল, মাহদিয়ার সুস্থতার কথা। তিনি একেবারে রাতের খাবার নিয়ে ফিরবেন, এটা জানিয়ে ফোন রেখে দিলেন। পুলিশের দু’জন কন্সটেবল এসে দেখল, মাহদিয়া সুস্থ শরীরে বসে আছে বেডে। পাশে তার বাবা-মা। সে দ্রুত নিজের ফোন বের করে থানায় জানিয়ে দিল।
***
শায়লা সুলতানা মেয়ের কাছাকাছি গিয়ে বসলেও মাহদিয়া মায়ের দিকে তাকাল না। সে আলতো করে আজাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে লাগল। তার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, মায়ের হাত থেকে কয়েকটা আঘাত পেয়েই তাকে এই অবধি আসতে হয়েছে। মেয়ের কান্না, কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না আজাদ সাহেব। স্ত্রীর ওপর রাগ বাড়ছে ক্রমশ। অথচ এটা হসপিটাল দেখে কিছু করতে পারছেন না। শুধু মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
-‘কেঁদো না মা। বাবা আছি তো এখন। তোমাকে কী বলেছিলাম আমি, একটু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে। আমি ফিরে এসে সব ঝামেলা শেষ করে নিতাম।’
-‘আমি তো চুপ ছিলাম বাবা। কিন্তু মা…।’
-‘আমি সব জানি। শুনেছি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তোমার মায়ের এই রূপটা আমার অজানা ছিল। জানলে তাকে এত বাড়তে দিতাম না।’
বাবা-মেয়ের কথার মাঝখানে কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন শায়লা সুলতানা। কিন্তু এখন আর পারলেন না। ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়ের মতো ক্ষ্যাপে গিয়ে বললেন,
-‘কী বাড়াবাড়ি করেছি আমি? তোমার জন্য, জীবনে সুখ পাইনি কোনোদিন। কী করেছ সারাজীবন? পরের গোলামী করেই দিন কাটিয়েছ। নিজের বুদ্ধির খেল দ্যাখিয়ে যখন ‘সুখনীড়’ সম্পূর্ণ দখল করতে যাচ্ছিলাম, তখনই দিয়া বাঁধা তৈরী করল। মেয়েকে কি আমি ইচ্ছে করে মেরেছি? আমি তো…।’
-‘তুমি চুপ থাকো মা, এখানে গলা ফাটিয়ে চিৎকার কোরো না। তোমার সাথে হিসাব-নিকাশ পরে হবে।’
-‘কোনো হিসাব-নিকাশের দরকার নেই আর। তুই সুস্থ আছিস এটাই অনেক। এখন ভালোয় ভালোয় ইতালি ফিরতে পারলেই হোলো।’
মায়ের এই কথা শোনে অসুস্থ শরীর নিয়েও তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটাল মাহদিয়া। আজাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরেই মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তোমার কি ধারণা আমি আর তোমার ফাঁদে পা দেব? জীবন থাকতেও না। এইযে বেঁচে ফিরেছি, এরজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে নতুনভাবে জীবন দেয়ার পাশাপাশি, জন্মদাত্রী মায়ের স্বরূপটাও দ্যাখিয়ে দিয়েছেন। এখন তুমি যদি আমাকে জানে মেরে ফেলে আমার লাশটাও টেনে নিতে চাও, তা-ও পারবে না।’
-‘দ্যাখ্ দিয়া, আমি জানি কাজটা ঠিক হয়নি। তখন বেহুঁশের মতো তোকে আঘাত করেছি। আমি ওই জানোয়ারকে…।’
কথার মাঝখানেই থেমে গেলেন শায়লা সুলতানা। আজাদ সাহেব তাকে ধমক দিয়ে বললেন,
-‘মুখে লাগাম টানো শায়লা, নয়তো খুব খারাপ হবে। বড়ো ভাইজানকে আর একটাও বাজে কথা বলবে না। মানুষটা যদি না থাকত, আজ এতদূর পৌঁছাতে পারতাম না আমরা। আমাদের যা অর্জন, যা উন্নতি, সবটাই ভাইজানের দেয়া দানে। এটা ভুলে গেলে চলবে না তোমার। যে মানুষ নিঃশ্বার্থে দান করে গেল, তাঁকেই কি-না তুমি মারতে চাইছিলে! গতকাল খুব তো বললে, বড়ো ভাইজান দিয়াকে মেরেছেন। নিজের সন্তানের চোখে দ্যাখে এসেছেন এতদিন, তাকে কীভাবে মারবেন? সবাই তো আর তোমার মতো লোভী, স্বার্থপর নয়!’
শায়লা সুলতানা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-‘হয়েছে থাক্। আর সাফাই গাইতে হবে না। আমি দিয়াকে নিয়ে ইতালি যাব, ব্যস…। এটাই ফাইনাল।’
এতকিছুর পরও শায়লা সুলতানার মাঝে অনুশোচনার ছিঁটেফোঁটাও দেখতে পেল না মাহদিয়া। এখনও তিনি গলা উঁচিয়ে কথা বলার মতো দুঃসাহস দেখাতে পারছেন বলেই অবাক হলো সে। বলল,
-‘তোমার না টিকিট কনফার্ম? তুমি চলে যাচ্ছ না কেন?’
শায়লা সুলতানা মুখভার করে বললেন,
-‘ফ্লাইট মিস হয়ে গেছে। তোর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম।’
-‘আধমরা বানিয়ে আবার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছিলে? এটা হাস্যকর শোনাচ্ছে না?’
-‘কতবার বলব, আমি তোকে ইচ্ছে করে মারিনি। ভুলে আঘাতটা তোর ওপর পড়েছে।’
-‘মোটেও সেটা নয়। আমি যদি বড়ো মামাকে না সরাতাম, তাহলে বয়স্ক মানুষটাকে তুমি মেরেই ফেলতে। এতক্ষণে থাকতে জেলে। আমি বলেই, এখনও গলাবাজি করতে পারছ।’
এতক্ষণ পুলিশ, জেল, জরিমানা এসবের চিন্তা ছিল না। শুধু চিন্তা ছিল, মেয়ের জ্ঞান ফিরে আসুক। এখন যখন জ্ঞান ফিরল, তখন মেয়ে তার সাথে স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছেই না। কেমন উল্টাপাল্টা আচরণ করে, মায়ের মনে আঘাত দিচ্ছে। সব হয়েছে শাদাবের জন্য। ওই ছেলেটার থেকে মেয়েকে কেড়ে নিতে পারলেই শান্তি পাবেন তিনি। কিন্তু কী করবেন? আর যে কোনো পথ নেই! কীভাবে মেয়েকে বাংলাদেশ থেকে ইতালি নিয়ে যাবেন? কী উপায় আছে? কোনো পথ খুঁজে পেলেন না তিনি। বললেন,
-‘তুই কি যাবি না বলেই পণ করেছিস?’
-‘স্যরি মা। যাওয়ার হলে তুমি যাও। এত ভুলের পরও তুমি অনুতপ্ত নও। তোমার সাথে কথা বলার রুচি, ইচ্ছে, আগ্রহ সবটাই হারিয়ে ফেলেছি আমি। যাও আমার সামনে থেকে।’
শায়লা সুলতানা সরলেন না। বসে বসে উপায় খুঁজতে লাগলেন, কীভাবে মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন! কিছুক্ষণ পর বললেন,
-‘তোর রুচি ফেরাতে কী করতে হবে আমাকে?’
মাহদিয়া ম্লানমুখে বলল,
-‘যাই কোরো, তোমার প্রতি আগের সম্মানটা আর ফিরে আসবে না মা। স্বার্থ ও লোভের কাছে মেয়ের প্রতি থাকা সবটুকু অধিকারকে তুচ্ছ করে দিয়েছ তুমি। এতকিছুর পরও তোমাকে চোখের সামনে সহ্য করছি, কয়েকটা কথা বলব বলে। চুপচাপ শুনবে, এরপর সিদ্ধান্ত নিবে। মানা, না মানা তোমার ব্যাপার। কিন্তু এরপর আর আমার ওপর কোনো দাবী তুমি রাখবে না।’
***
চলবে…