বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-৩৭

0
410

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — সাঁইত্রিশ (১)

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

আজ মাহদিয়ার ডিসচার্জের দিন। সায়রা করীম স্ব-শরীরে এসেছেন একমাত্র ছেলের বউকে সাথে করে নিয়ে যেতে। ‘সুখনীড়’-এ তিনি আর মাহদিয়াকে পাঠাতে চাইছেন না। এই কারণেই আজাদ সাহেবের সাথে সরাসরি কথা বলতেই বহু বছরের পুরনো কষ্টকে বুকে আগলে শ্রীমঙ্গল এসে পা রেখেছেন। সাথে শিহাব ও ইভানাও এসেছে। মাহদিয়ার এই অবস্থা দেখে বাচ্চা ছেলেটা পাশে বসে বেশ খানিকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। বারংবার নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে বলল,

-‘আমি যদি সুপারম্যান হতাম, তোমাকে এত কষ্ট পেতে দিতাম না, দিয়াপি। কেন আমি সুপারম্যান হতে পারলাম না?’

যার সাথে নাড়িরটান, সেই মা এক সপ্তাহ ধরে ইতালি বসে আছেন। নিশ্চিন্তমনেই আছেন। না কোনো ফোনকল, না কোনো ম্যাসেজ। দিনরাত চোখের পানি ফেলতে ফেলতে পিপাসার্ত পথিকের মতো ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে মাহদিয়া। একবার যদি মায়ের ফোন আসে। যদি একটা ম্যাসেজ আসে। কিন্তু না। শায়লা সুলতানা ফোন করেন না। জানতেও চান না, মেয়ে ভালো আছে কি-না। সুস্থ হয়েছে কি-না। দুঃখে মুখের হাসিও ঠিকঠাক আসে না তার। ওই কঠিন মুহূর্তে শিহাবের বাচ্চামো স্বরের এই কথাটা তাকে পুরোটাই নড়বড়ে করে দিল। যার সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই, নেই দীর্ঘদিনের কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক। সে তার কষ্টে কাঁদছে! অথচ গর্ভধারিণী মায়ের কোনো খোঁজ নেই। কান্নামাখা স্বরেই উত্তর দিল,

-‘তুমি তো সুপারম্যানই। এইযে, আমার কাছে এসেছ, আমার সাথে কথা বলছ, আমার দুঃখে কাঁদছ, এতেই তো প্রমাণ হয়, তুমি সাধারণ কেউ নও। সুপারম্যান তো তারাই, যারা অন্যের কষ্ট বুঝতে পারে, অন্যের জন্য কাঁদতে পারে। আমি তোমাকে দ্যাখেছি, ছুঁয়েছি, এখন ঠিক সুস্থ হয়ে যাব। সুস্থ হওয়ার পর দিনরাত আমরা ঝগড়া করব। আমি কিন্তু আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে রাখছি।’

ছোটো ছোটো হাত দিয়ে মাহদিয়ার চোখের পানি মুছে দিল শিহাব। বলল,
-‘কই সুস্থ হচ্ছ? তুমি তো দ্যাখি কেঁদে ভাসাচ্ছ। কষ্ট হচ্ছে খুব?’

মাহদিয়া ঝটপট চোখের পানি মুছে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-‘এইতো, কান্না শেষ। আর কাঁদব না। আমার সুপারম্যানকে পেয়ে গেছি না? তবে কীসের এত কষ্ট! যাদের কাছে তোমার মতো একজন সুপারম্যান থাকে, তাদের কোনো কষ্ট থাকতে নেই।’

-‘তাই? তাহলে আর কাঁদবে না। কাঁদলে তোমাকে দ্যাখতে খুব বাজে লাগে।’

শিহাব আদুরে স্বরে আরও অনেককিছু বকবক করল। মাহদিয়া শুনল। তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল। নিজেও নিজের দুঃখগুলো ভুলে দুষ্টুমিষ্টি খুঁনসুটিতে মেতে উঠল।

সায়রা করীম ও ইভানা কেবিনের ভেতরে থাকা আলাদা সোফায় আজাদ সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হায়দার সাহেব, আজাদ সাহেব দু’জনেই একসাথে আসলেন। ভেতরে প্রবেশ করে দুটো মানুষ ভীষণভাবে চমকালেন। আগের রূপবতী সায়রা করীম আর আগের মতো নেই। অনেক পালটে গেছেন। চেহারার উজ্জ্বলতা নেই। শরীর-স্বাস্থ্য আগের মতো নেই। মুখেও নেই চিরচেনা হাসি। সবকিছু যেন বিলীন হয়ে গেছে, বহু আগে। অনেকদিন পর বিশ্বস্ত ও ঘরের কর্ত্রীকে এমন বেশভূষায় দেখে হায়দার সাহেবের চোখদুটো জলে ভরে উঠল। তিনি কম্পনরত কণ্ঠে সালাম ঠুকলেন। বললেন,

-‘বাড়ির কথা কি একবারও মনে পড়ে না ভাবীজান? সবকিছু ভুলে বসে আছেন আপনি?’

সালাম শোনেই অবাক হয়েছিলেন সায়রা করীম। এরপর অভিযোগ শোনে মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন,
-‘কেন পড়বে না ভাই? খুব পড়ে। তুমি তো দ্যাখি আগের মতোই আছো। একদম পাল্টাওনি।’

-‘আর পালটানো…। সময় কতকিছু পালটে দিচ্ছে।’

-‘এখনও বিয়েশাদী কোরোনি কেন? আর কতদিন একা থাকবে?’

হায়দার সাহেব দুঃখ পেলেন। বলতে পারলেন না, ‘আপনার কাছেই তো দায়িত্ব দিয়েছিলাম ভাবীজান। আপনি সে-ই দায়িত্ব পালন না করেই চলে গেলেন! এতদূরে গেলেন যে, আমি হতভাগা একাই আপনার সমস্ত স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হলাম।’ মনের কথা মনে চেপে রেখে শুধু হাসিমুখে বললেন,

-‘বিয়ে করে কী হবে ভাবীজান? দিনশেষে আরও একটা ইতিহাস রচনা করব! আরও একজনের বিশ্বাস ভাঙব?’

-‘নিজের ওপর কনফিডেন্ট রাখতে হয়। নিজে সৎ থাকতে হয়। বিবেকবান, ধৈর্য্যশীল ও দায়িত্বশীল হতে হয়। তবেই তো কোনো তৃতীয় পক্ষ সম্পর্কে প্রবেশ করতে পারবে না। স্বেচ্ছায় সুযোগ দিলে তো তৃতীয় পক্ষ আসবেই।’

-‘আমার কথা বাদ দিন এখন। ওদের কথা ভাবুন। কী সিদ্ধান্ত নিলেন!’

ইভানা সোফা ছেড়ে মাহদিয়ার কাছে চলে গেল। মুরব্বিরা কথা বলছেন, বলুন। তার এখানে কাজ নেই। সায়রা করীম পাশের ফাঁকা জায়গায় আজাদ সাহেবকে বসার অনুমতি দিয়ে বললেন,

-‘সিদ্ধান্ত তো ওরা দু’জন নিবে। তাছাড়া, মেয়ের বাবা তো আজ সামনে আছেনই।’

আজাদ সাহেব নতমুখে বসে রইলেন। লজ্জায় কিছু বলতে পারছেন না তিনি। সায়রা করীম তার অনুশোচনামাখা চেহারা দেখে বললেন,

-‘ভাইজান, আপনি মেয়ের জন্য যা ভালো বুঝবেন, সেটাই করুন। আমি কোনো জোরজবরদস্তি করব না।’

তড়িঘড়ি সায়রা করীমের পায়ের কাছে পড়ে গেলেন আজাদ সাহেব। দু’হাতে জাপটে ধরলেন সায়রা করীমের পা। লজ্জা, সংকোচ, দ্বিধা, ভয় সরিয়ে বললেন,

-‘মাফ করে দিন ভাবীজান, অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে। আমি যদি জানতাম, শায়লা এমন একটা বিদ্রুপ কাজ করেছে আপনার সাথে, তবে কবেই ওকে আমি ডিভোর্স দিয়ে দিতাম।’

ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ নিয়ে সায়রা করীম নিজের পা সরিয়ে বললেন,
-‘পা ধরে লজ্জায় ফেলছেন কেন আমাকে? বসে কথা বলুন ভাইজান।’

পূণরায় মুখ নামিয়ে বসে রইলেন আজাদ সাহেব। সায়রা করীম বললেন,
-‘বোকার মতো কাজ করবেন না। ওটা আপনার সংসার। কারও জন্য নিজের সংসারে কেন ভাঙন আনবেন? শায়লা আপা নিশ্চয়ই তার ভুল বুঝতে পারবে। তবে একটা কথা বলি, আমি কোনোদিন কিছু মানুষের ভুল ক্ষমা করতে পারব না। যারা আমার সরলতার সুযোগ নিয়েছে, তাদেরকে তো কোনোভাবেই ক্ষমা করব না।’

শুধু সায়রা করীম কেন, আজাদ সাহেব নিজেও স্ত্রীর এই কাজকে কোনোদিন ক্ষমা করবেন না। তাইতো, গোপনে, মেয়ের চোখের আড়ালে কোর্টে গিয়ে ডিভোর্সের যাবতীয় ফর্মালিটিজ পূরণ করে এসেছেন। এবার শুধু নোটিশটা শায়লা সুলতানা অবধি পৌঁছানো বাকি। এরকম কালসাপকে বার বার সুযোগ দিতে নেই। একবারেই শা স্তি দিতে হয়। নিজের এই কাজ ও সিদ্ধান্তের কথা লুকিয়ে বললেন,

-‘ঠিকই বলেছেন ভাবীজান, কিছু মানুষকে কোনোদিন ক্ষমা করা উচিতই না। বিশেষ করে যারা ভুল করে অনুতপ্ত হয় না, তাদেরকে ক্ষমা কেন, ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দেয়াও ঠিক না।’

সায়রা করীম দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরনো আলাপ ছেড়ে, যে কারণে এত দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছেন, সেটা নিয়ে আলাপ তুলতেই বললেন,

-‘ভাইজান, এখন তো ওরা উপযুক্ত। দু’জনই চাইছে, সম্পর্কটাকে মর্যাদা দিতে। আজ যেহেতু আমি এসেছি, আমি চাই, দিয়াকে সাথে নিয়ে যেতে। আর আগামী সপ্তাহে, কাজী ডেকে আকদের ঝামেলা শেষ করতে। দিয়া পুরোপুরি সুস্থ হলে, রিসেপশন হবে।’

আজাদ সাহেব চুপ করে শুনছিলেন। তাঁর মনোভাব কী কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। সায়রা করীম আমতা-আমতা স্বরে বললেন,

-‘যদি আপনার আপত্তি থাকে, থাক্। কোনো জোরাজুরি নেই। আমি আসলে ও’কে আবার ‘সুখনীড়’-এ পাঠাতে চাইছি না।’

মাহদিয়ার যা শারিরীক অবস্থা, তাতে এই মুহূর্তে তার পারিবারিক সাপোর্ট, ভালোবাসাটা বেশি দরকার। যা ‘সুখনীড়’-এ থাকলে কোনোভাবেই পাবে না। শাদাবও চায় না, অসুস্থ মেয়েটাকে এখানে ফেলে রেখে সে এখান থেকে একাই চলে যাক। এমনিতেই এই এক সপ্তাহে নিজের সমস্ত কাজে বাঁধা পড়েছে। এখানে বেশিদিন থাকাটাও যুক্তির নয়। তাই যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনোভাবে মাহদিয়াকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়াটাই একমাত্র সমাধান। হয়তো ব্যাপারটা একটু ঝামেলার। তবে না নিয়েও উপায় নেই। এই সম্পর্কে আজাদ সাহেবের মতামতটা জরুরী দেখেই সায়রা করীম এতদূর ছুটে এসেছেন। আজাদ সাহেব নিজেও মেয়ের মনের অবস্থা বুঝেন। মেয়ে শাদাবের মাঝেই সুখ খুঁজে পাবে, এটা সে বুঝতে পেরেছে। তা-ই অন্যত্র যাওয়া তো দূর, শাদাব ছাড়া অন্যকিছু সে চিন্তাও করতে পারছে না। এত বছর মেয়েকে পবিত্র সম্পর্ক থেকে দূরে থাকতে দেখে, মেয়ের কষ্ট ও মানসিক অবস্থা বুঝে তিনি বাবা হয়ে এবার আর ভুল সিদ্ধান্ত নিলেন না। সায়রা করীমের সিদ্ধান্তকে সম্মান করে বললেন,

-‘মেয়ে বিয়ে দিলে, শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই মেয়ের আপনজন হয়ে উঠে। সেদিক থেকে আপনারা তো অনেক আগেই দিয়াকে নিজেদের একজন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। আমি নিজেও চাই না, দিয়া আর ‘সুখনীড়’-এ ফিরে যাক। ওখানে ও মানসিক সাপোর্টটা পাবে না। যদিও নাহার আছে। তবুও এইমুহূর্তে ওর আসলে আপনাকে আর শাদাবকে দরকার। আপনি ও’কে নিয়ে যেতে চাইলে, আমি বারণ করব না। বিয়ে নিয়েও আমার কোনো আপত্তি নেই। মেয়ের সুখটাই আমার কাছে বড়ো। ও সুখে থাকলেই আমি ভালো থাকব। তবে একটা কথা, মাঝেমধ্যে ওদেরকে গ্রামের বাড়িতে পাঠাবেন। আমি আর ইতালি ব্যাক করছি না। বাকিজীবনটা বাপদাদার ভিটেতেই কাটিয়ে দেব।’

সায়রা করীম চমকে গিয়ে বললেন,
-‘সেকী ভাইজান, কেন? ওখানে আপা একা…।’

-‘আমি ওর চিন্তা বাদ দিয়েছি ভাবীজান। অনেক আগেই যে কাজটা করা উচিত ছিল, সেটা দু’দিন আগে করলাম। হয়তো দেরী হয়েছে, তবুও যা করেছি ভালো করেছি।’

শাদাব ডিসচার্জের ফর্মে সই করে, বিল পেমেন্ট করছিল। পল্লবও পাশে দাঁড়িয়ে মাহদিয়ার শারিরীক, মানসিক দুর্বলতা সবটাই তার সাথে অকপটে আলোচনা করে যাচ্ছিল। এমন সময়, হসপিটালের মূল দরজা দিয়ে ভেতরে পা রাখলেন এমদাদ কায়ছার। মূলত তিনি মাহদিয়াকে দেখতেই এসেছেন। শোনেছেন, আজ সায়রা করীম এখানে এসেছেন পুত্রবধূকে নিয়ে যেতে। যদি একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পান, যদি একবার শিহাবের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পান, তবে হয়তো এতদিনের জমানো সবটুকু পাপ ও গ্লানি থেকে মুক্তি পেতেন। তিনি শাদাবকে লক্ষ্য করেননি দেখেই, একজন নার্সের কাছে জানতে চাইলেন, মাহদিয়া কত নম্বর কেবিনে আছে। শাদাব দু’হাত দূরে ছিল বলেই, গলার আওয়াজ শোনে পাশে তাকাল। ঝটপট বিল মিটিয়ে আলগোছে দূরে সরে পড়ল। একছুটে আসলো কেবিনে। পল্লব অবাক হয়ে বন্ধুর দৌড় দেখল শুধু। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না।

কেবিনে প্রবেশ করে সায়রা করীম ও শিহাবকে কিছু বলল না। হায়দার সাহেব ও আজাদ সাহেবকেও কিছু বলল না। সোজা ইভানার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘বাবা এখানে এসেছেন। আমি চাই না, মা-বাবা কেউ কারও মুখোমুখি হোক। কিছু একটা বলে, মা আর শিহাবকে নিয়ে সরে যাও এখান থেকে। ওই ভদ্রলোককে আমি সামলাব।’

সঙ্গে সঙ্গে শাদাবের মনের ভয়টা বুঝতে পারল ইভানা। এমদাদ কায়ছারকে দেখলে সায়রা করীম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন। রাগে, ক্ষোভে যা-তা ব্যবহার করতে পারেন। এটা বুঝেই শাদাব চাইছে না, এতগুলো বছর পর সায়রা করীম পূণরায় কোনো বিশ্বাসঘাতকের সামনে পড়ুন। মনে কোনো আঘাত পান। শত হলেও একটা সময় ওই মানুষকে ভালোবেসেছেন। এজন্যই এই লুকোচুরি। শিহাবকে ম্যানেজ করতে ইভানা তার হাত ধরে বলল,

-‘চলো না, সামনের ক্যানটিন থেকে কিছু খেয়ে আসি। খুব বেশি ক্ষিধে পেয়েছে আমার।’

শিহাব দ্বিরুক্তি করল না। তার একটু চক্কর দিতে পারলেই হলো। কিন্তু সে একা খাবে না-কি? মাহদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তুমি কিছু খাবে?’

শাদাব ঝটপট মাহদিয়ার পিছনে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ডে কিছু একটা বলে ফেলল। মাহদিয়া মুচকি হেসে বলল,
-‘তাইতো, আমারও ক্ষিধে পেয়েছে। তোমাকে পেয়ে ক্ষিধের কথা ভুলেই গিয়েছি। যাও, তুমি যা খাবে সেটাই নিয়ে এসো।’

সায়রা করীমকে ভুলানোর জন্য শাদাব নিজেই বলল,
-‘মা, তোমার দিয়ার কিছু দরকারী জিনিস লাগত। সামনে একটা শপিংমলও আছে। এখানকার জিনিসপত্র অনেক ইউনিক, সেটা তো তুমি জানো। কষ্ট করে কিছু শপিং করে নাও না, ভাবীও যেহেতু সাথে আছে।’

এই ঠেলাঠেলির কারণ তিনি বুঝতে না পারলেও, আন্দাজ করতে পারলেন গড়বড় কিছু একটা আছে। সন্দিহান চোখে তাকাতেই শাদাব ‘প্লিজ’ শব্দটা উচ্চারণ করল। কী লাগবে সেসব জানতে মাহদিয়াকে বললেন,

-‘তুমি-ই বোলো মা, কী লাগবে তোমার?’

কঠিন জালের ফাঁকে জড়িয়ে পড়ল মাহদিয়া। মা-ছেলের ইশারা, ইঙ্গিতের চাপে পড়ে সে দুঃশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইভানা এই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করতে বলল,

-‘খালামনি, আমি জানি ওর কী কী লাগবে। এসো যাই। আগে কিছু খেয়ে, তারপর ছুটিয়ে শপিং করব।’

কেবিন ছেড়ে বেরোবার আগে ঝটপট মায়ের মুখে একটা মাস্ক জড়িয়ে দিল শাদাব। সায়রা করীম এবার চোখ পাকিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পাজি ছেলেটা শুধু একগাল হাসি উপহার দিল।

***

-‘সায়রা…।’

করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে সিঁড়ির কাছে আসতেই বহু কাঙ্ক্ষিত ডাক কর্ণকুহরে পৌঁছা মাত্রই সাময়িক সময়ের জন্য দিশা হারিয়ে ফেললেন সায়রা করীম। ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকিয়েই চমকে গেলেন। ইভানা দু’পা সামনে হাঁটছিল। ‘সায়রা’ ডাকটা সে-ও শোনেছে। তবে বুঝতে পারল না, মুখ ঢেকে থাকা অবস্থাতেও কায়ছার সাহেব কীভাবে নিজের স্ত্রীকে চিনতে পারলেন। সে শুধু বিড়বিড় করল, ‘হলো না ভাই, হলো না। তোমার সব প্ল্যান জলে গেল।’ শিহাবের চোখে যেন এসব দৃশ্য না পড়ে, এজন্য খুব সতর্কতার সাথে সিঁড়ি পেরিয়ে ক্যানটিনের দিকে এগিয়ে গেল ইভানা। চালাকির সাথে টুপ করে শাদাবকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিল।

ডাক শোনেও না শোনার ভান ধরে আরও দু’সিঁড়ি নিচে নামলেন সায়রা করীম। পিছন থেকে কায়ছার সাহেব বললেন,
-‘একটু সময় হবে? কিছু কথা বলার ছিল তোমায়।’

সায়রা করীম আরও দু’সিঁড়ি এগোতেই কায়ছার সাহেব বললেন,
-‘ভেবো না, আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। চিনতে পেরেছি বলেই কথা বলতে চাইছি।’

সায়রা করীম জানেন, এমদাদ কায়ছার বহুবছর আগেই তার চোখের মায়ায় ডুবেছিলেন। সম্পর্কে প্রেম, ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়ার পর, প্রায়সময় কায়ছার সাহেব বলতেন, ‘তোমার এই চোখদুটো আমাকে ভীষণ টানে। ইচ্ছে করে জনমভর তাকিয়ে থাকি।’ করতেনও তাই। দিনে অসংখ্যবার একধ্যানে তাকিয়ে থাকতেন। মাঝেমধ্যে সায়রা করীম বিরক্ত হতেন। চোখ সরিয়ে ফেলতেন। কখনও কখনও নিজেও ডুব নিতেন, বিশ্বস্ত ওই চোখের চাহনিতে। আজ এত বছর পর, তাঁর চোখ দেখে কায়ছার সাহেব তাকে চিনে ফেললেও, সায়রা করীম কোনোভাবেই ওই পাষাণ ও কাপুরুষের চোখে চোখ রাখবেন না বলেই এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ওই কথাটা তাঁকে বাধ্য করল, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। তিনি সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। মুখের মাস্ক সরিয়ে খুব তীক্ষ্ণ ও রুক্ষস্বরে বললেন,

-‘স্যরি…। আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।’

-‘সায়রা…।’

এবার আহতস্বরে ডাক দিলেন কায়ছার সাহেব। সায়রা করীম হাসলেন। বললেন,
-‘আচ্ছা, তা কী বলবেন? কী বলার আছে আপনার? এতগুলো বছর পর, আপনার সব কথা আমি শুনব, ভাবলেন কী করে?’

কায়ছার সাহেব মনে অসংখ্য ব্যথা নিয়ে বললেন,
-‘আপনিআজ্ঞে করছ যে!’

-‘আপনার সাথে আমার তুইতোকারি কিংবা তুমি বলার মতো সম্পর্ক আর নেই। দীর্ঘ বছর ধরে আপনার সাথে আমার কোনোপ্রকার যোগাযোগও ছিল না। যেহেতু আপনি আমার অচেনা ও খুব বেশি কাছের কেউ নোন, তাই অচেনা মানুষকে আমি আপনি-ই সম্বোধন করি। বলতে পারেন, এখনও সম্মানের দিক থেকেই আমি আপনি সম্বোধন করছি। নয়তো এই সায়রা করীম, কোনো অ মানুষের জন্য তাঁর মূল্যবান সময় নষ্ট করে না।’

ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এরকম আঘাত সহ্য করার মতো মনোবল নেই কায়ছার সাহেব। অথচ দীর্ঘবছর আগে, এই নারীটির সাথে তিনি চরম দুর্ব্যবহার করেছেন। একটা সময়, সমস্ত লাঞ্চনা-অপমান মাথায় নিয়ে ‘সুখনীড়’ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল বাড়ির একমাত্র কর্ত্রী। যার হাত ধরে ‘সুখনীড়’-এ সুখ এসেছিল, সে-ই নারীটি আজও স্বামীসুখ থেকে বঞ্চিত। কিছু মিথ্যে অহমিকা ও তৃতীয় পক্ষ তাদের সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করে, বিশ্বস্ত নীড়টাকে কাঁচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। নয়তো সায়রা করীম কোনোদিন তার সাথে এত রুক্ষ্ণমেজাজে কথা বলতে পারতেন না। সবসময় সুরেলা পাখির মতো মোহময় সুরধ্বনিতে যে নারী তাঁর কানের কাছে প্রতিনিয়ত ঝুনঝুন শব্দ তুলতেন, আজ সে-ই নারী তাঁর দিকে ধনুক ছুঁড়ে মারতেও দু’বার ভাবছেন না। নিয়তি তাদের শুধু আলাদাই করেনি, চিরদিনের জন্য এক হওয়ার পথ থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছে। এখন তিনি শত চাইলেও ওই নারীর মুখ দিয়ে মিষ্টিমধুর কলরব আর শুনতে পারবেন না। এই আফসোস নিয়েই হয়তো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দমবন্ধ করা অনুভূতি বুকে আগলে দিন কাটাতে হবে! তবুও যদি ক্ষমা পাওয়া যায়, সেই আশায় এতগুলো ধারাল কথাকে সয়ে নিয়ে বললেন,

-‘ঠিকই বলেছ। আমি আসলেই একটা অ মানুষ। যে ভুল আমি করেছি, সেসব মানুষ করে না। অ মানুষেরাই করে। যাই হোক, ডাকলাম এইজন্য যে, যদি এতগুলো বছর পর তোমার থেকে ক্ষমা পাই, সেই আশায়। আমি অনুতপ্ত, এটা বলছি না। কিন্তু যেসব অন্যায় করেছি, সেসবের বোঝা বয়ে বেড়াতে পারছি না আর। একমাত্র ক্ষমা-ই পারে, আমার মৃত্যুটাকে সহজ করে দিতে। ক্ষমা করবে না আমায়?’

সায়রা করীম না চাইতেও হেসে ফেললেন। বললেন,
-‘ক্ষমা…। শব্দটা আজ এত বেশি লজ্জা পাচ্ছে, কী বলব বলুন তো? হবে না একদম। আপনাকে যদি আমি ক্ষমা করি, তাহলে আমার সমস্ত আত্মসম্মানবোধ মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে।’

-‘আমি জানতাম, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না। কিন্তু দুটো সন্তানের জন্য ‘সুখনীড়’-এ ফিরে এসো। চড়-লাতি যা পারো, দিও। তবুও ফিরে এসো। আরও একবার বিশ্বাস কোরো।’

সায়রা করীম তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
-‘কী জানেন তো, আপনাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম বলেই, আপনার হাত ধরে আমি নিজের বাবার ঘর ছেড়েছি। আপনার থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু আঘাত পেয়ে ‘সুখনীড়’ ত্যাগ করেছি। জীবন থেকে সুখের দু’দুটো অধ্যায় আমি হারিয়ে শেষবেলা আশ্রয় পেয়েছি, নিজের বোনের কাছে। ওইযে দুটো সুখের অধ্যায় আমার জীবন থেকে আপনি কেড়ে নিলেন, ওই পুরোটা সময় আমি একাই সাফার করেছি। শুধু আপনার জন্য আমি আমার বাড়িতে মুখ বাঁচিয়ে চলতে পারিনি। আপনার জন্য, অবুঝ বাচ্চাটা আমার ট্রিটমেন্টের টাকা জোগাড় করার জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল। আপনার দেয়া ভুল ঔষধের জন্য, শিহাব এখনও অন্য দশটা বাচ্চার মতো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়! এতসব ব্যথা ভুলে গিয়ে আমি ‘সুখনীড়’-এ ফিরব, এটা আপনি ভাবলেন কী করে? আমি কিন্তু চাইলেই পার‍তাম, দুটো বাচ্চার পিতৃত্বের দাবী আর পরিপূর্ণ হক্ব চেয়ে পূণরায় ‘সুখনীড়’-এ ফিরতে। কিন্তু ফিরিনি কেন জানেন? ওই নীড়ে বিশ্বস্ত যে মানুষ ছিল, সে-ই মানুষটাই বিশ্বাসে একদিন ছু রি চালিয়ে দিয়েছিল। ছু রিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল আমার সাজানো-গোছানো একটুকরো সুখ। এত অবজ্ঞা, অপমান নিয়ে ওখানে পা রাখাটা সহজ ছিল না। এখনও নয়। স্যরি…। আপনার এই অযৌক্তিক অনুরোধ আমি রাখতে পারছি না।’

-‘তুমি ওদেরকে বাবার আদর-শাসন থেকে বঞ্চিত করবে?’

বিস্ময়ে হা হয়ে গেল সায়রা করীমের মুখ। তিনি হতবাক কণ্ঠে বললেন,
-‘ওমা! বাবা! আপনি নিজেকে আমার সন্তানের বাবা দাবী করছেন! লজ্জা করছে না আপনার? পনেরো বছর আগে একটা নিষ্পাপ ভ্রুণকে হ ত্যা করার জন্য যে নির্যা তন আপনি আমার ওপর চালিয়েছিলেন, সেসবের পর ওই দুটো সন্তানের জীবন থেকে বাবা নাম এবং আপনি চিরদিনের জন্য না-ই হয়ে গিয়েছেন। আমার বাচ্চাদের আমি একা মানুষ করেছি। ওদের যেমন কোনো বাবা নেই, তেমন ওরা আপনার সন্তানও আর নয়। বাবা তো তারাই হয়, যারা জন্মের আগে থেকেই সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে নিতে জানে। আপনি তো সেটা করেননি। উলটে, এক সন্তানের জন্য অন্য সন্তানকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। যখন ওদের বাবার প্রয়োজন ছিল, তখন লা তি মে রে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ ওদের বাবার প্রয়োজন নেই, তা-ও দাবী নিয়ে এসেছেন! আপনার কথাগুলো এখন বড্ড ইলজিক্যাল ও হাস্যকর শোনাচ্ছে। প্লিজ, এসব আর আমার সামনে উচ্চারণ করবেন না।’

-‘তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছ, আমি ওদের বাবা।’

-‘এটাই আমার দুর্ভাগ্য জানেন! সব মুছে ফেললেও এই সত্যিটা মুছে ফেলতে পারছি না। একটা অ মানুষ যে ওদের বাবা সেটা ভাবলেই ঘৃণায় আমার শরীর জ্বলে উঠে।’

এত কথা, এত অপমান মাথায় নিয়ে শেষবারের মতো কায়ছার সাহেব সাহসের সাথে সায়রা করীমের হাত ধরে ফেললেন। বললেন,
-‘অনুরোধ করছি তোমায়, এতবড়ো অন্যায় তুমি আমার সাথে কোরো না। মানছি, আমি ভুল করেছি। তাই বলে দুটো বাচ্চা বাবার আদর-শাসন পাবে না?’

সায়রা করীম প্রচণ্ড রেগে গেলেন। হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘হাতটা ছাড়ুন।’

-‘আগে ক্ষমা কোরো। আমার সন্তানদের ফিরিয়ে দাও। তবেই ছাড়ব।’

-‘হাত ছাড়তে বলেছি আমি।’

-‘ছাড়ব না।’

-‘আপনার সাহস হয় কী করে আমার হাত ধরার?’

-‘সাহস নয়, অধিকারে ধরেছি। তুমি আজও আমার স্ত্রী।’

ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল সায়রা করীমের। ঘৃণায় সর্বাঙ্গ জ্বলসে যেতে লাগল। দু’বার চেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে ব্যর্থ হলেন। তৃতীয়বার আর সম্মান ও সম্পর্কের দিকে তাকালেন না। বাম হাতের সর্বোচ্চ শক্তিতে একটা আঘাত করলেন কায়ছার সাহেবের গালে। কায়ছার সাহেব পুরাই আহাম্মক বনে গেলেন। তড়িঘড়ি নিজের হাত সরিয়ে নিতেই সায়রা করীম ঘৃণাভরা কণ্ঠে বললেন,

-‘কীসের অধিকার? কে আপনার স্ত্রী? যাকে পনেরো বছর তৃতীয় ব্যক্তির কথায় নির্মমভাবে আঘাত করেছেন, আজ তাকে স্ত্রী বলতে বাঁধছে না আপনার? সম্মান নষ্ট হচ্ছে না? কোথায় ছিল অধিকার, যেদিন আমি পা ধরে বলেছিলাম ‘আমার বাচ্চাটাকে বাঁচতে দাও!’ কোথায় ছিল পিতৃত্ব, যেদিন চড়-লাতি মে রে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন? কোথায় ছিল আদর-শাসন, যেদিন একজন অসহায় নারীর ওপর ক্ষমতার বড়াই দ্যাখিয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিলেন? যে সন্তানকে আপনি নিজের সম্মানের পথের কাঁটা ভাবতেন, আজ তাঁকে নিজের বলতে লজ্জা হচ্ছে না? পিতৃত্বের দাবী নিয়ে এসেছেন আজ। উদার হতে এসেছেন। কাপুরষ, অ মানুষ, বেহায়া কোথাকার। এখনও মানুষ হতে শিখেননি। আগে মানুষ হতে শিখুন। তারপর বাহাদুরি দ্যাখান।’

-‘তুমি…।’

-‘ইনাফ। যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছি আমি। আর নয়। দুনিয়া এত সহজ নয় যে, এত জঘন্যতম অপরাধের পরও কেউ এসে হাত-পা ধরে মাফ চাইল, আমি দিলদরদী হয়ে তাঁকে মাফ করে দিলাম। সন্তানকে বাঁচাতে আমি যদি ঘর ছাড়তে পারি, তবে নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে আপনার মতো অ মানুষকেও ত্যাগ করতে পারি। পারলে ডিভোর্স লেটারটা পাঠাবেন। চিরদিনের জন্য একটা অ মানুষের নাম-নিশানাকে নিজের থেকে মুক্তি দেব।’

সায়রা করীমের যে এত রাগ, সেটা কায়ছার সাহেব আগে দেখেননি। দেখেনি শাদাবও। ইভানার ম্যাসেজ পেয়েই ভয়মিশ্রিত মন নিয়ে করিডোরে এসেছিল। ভেবেছিল, সায়রা করীম কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে তার অ মানুষ বাবাকে ক্ষমা করে দিয়ে আবারও ‘সুখনীড়’-এ চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করবেন। নিজের অহেতুক চিন্তায় নিজেই লজ্জায় পড়ে গেল শাদাব। মা’কে এতটাও দুর্বল ভাবা উচিত হয়নি। বরং দুটো সন্তান তাঁকে প্রতি পদে পদে অনেক সাহসী হিসেবে প্রমাণ করেছে। আজও তাই করল। তাইতো, মনের জোর থেকে একটা অ মানুষকে ইচ্ছামতো সাইজ করতে পেরেছেন। দূর থেকেই একঝলক হাসল। মায়ের ছুটে যাওয়া দেখল। গুটিকয়েক পা ফেলে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলো, সায়রা করীম এই জায়গা ত্যাগ করেছেন। সে কায়ছার সাহেবের দিকে মুখ ফিরিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলল,

-‘যাহ্, শেষরক্ষা হলো না? ওই নারী এখন আর দুর্বল নোন, মি. এমদাদ কায়ছার। এতটাও বোকা নোন। আপনি নিজেকে অতিচালাক ভাবতে পারেন। কিন্তু বুদ্ধিমান নারী, দ্বিতীয়বার কারও মিষ্টি মিষ্টি কথার ফাঁদে পা দিবে না। সব ভুলের ক্ষমা হলেও, বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা হয় না। কথাটা মনে রাখবেন।’

***

চলবে…

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — সাঁইত্রিশ (২)

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

সন্তানকে পাশে পেয়েও তাকে দু’হাতে বুকের কাছে আগলে নিতে না পারার এক অদ্ভুত শূণ্যতা ও যন্ত্রণাকে কেন্দ্র করে প্রতি সেকেন্ড, মিনিট চলে যাচ্ছিল। কায়ছার সাহেব ছেলের মুখে ভয়ানক ওই কথাটুকু শোনেও আজ সে কথার জবাবে সঠিক কোনো শব্দ, বাক্য খুঁজে পেলেন না। তিনি দাঁড়িয়ে থেকেই বুঝতে পারলেন, জীবনে আসলে তিনি ব্যর্থই। এত সম্পদ, এত অর্জন, এত সম্মান এসব কোনো কাজেরই না। কাজের যা কিছু ছিল, তা তো এক স্ত্রী ও দুটো সন্তানই। একজন মানুষের জীবনে আপন মানুষের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, এমন কী আছে এই পৃথিবীতে! কিছুই নেই। সম্পদ কখনওই চিরস্থায়ী সুখ দিতে পারে না। সুখ তো দেয় সন্তানের মুখ থেকে শোনা কাঙ্ক্ষিত ডাকটা। অথচ দীর্ঘবছর ধরে নিজের অহেতুক সম্মান ও অহমিকার কারণে আজ দুটো সন্তান বেঁচে থাকার পরও তাদের মুখ থেকে ‘বাবা’ ডাকটা তিনি শুনতে পাচ্ছেন না। এই এত সম্পদও তাঁর আজকের গোপন কষ্টটাকে একফোঁটাও কমাতে পারছে না। থেকে থেকে শুধু বাড়াচ্ছেই। অসহায় মুখ নিয়ে শাদাবের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। কিছু বলার মতো ভাষাও তাঁর জানা নেই। শুধু জানেন, তিনি পাপী। তিনি অপরাধী।

করিডোর থেকে কেবিনের দিকে এগোতে চাইছিল শাদাব। কায়ছার সাহেবের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার নেই। পা ফেলতেই পিছন থেকে তিনি বললেন,

-‘টোটোন…।’

গুনে গুনে মাত্র দু’পা এগিয়েছিল শাদাব। ডাক শোনেই পা থামিয়ে পিছনে তাকাল। বলল,
-‘বারণ করেছিলাম। ওই নামে আপনি আমাকে ডাকবেন না আর। তবুও…।’

-‘কী করব? অভ্যাস কি চেঞ্জ করা যায়?’

শাদাব চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ থেমে কায়ছার সাহেব নিজেই বললেন,
-‘একবার শিহাবের সাথে আমার কথা বলিয়ে দিবে? শেষবার। এরপর আর কোনোদিন তোমাদের কারও চোখের সামনে আসব না। ট্রাস্ট মি…।’

তিনি এমনভাবে বলছেন, যেন কত বিশ্বাসযোগ্য একজন মানুষ তিনি। অথচ কিছুই নয়। বিশ্বাসের ছিঁটেফোঁটাও তারমধ্যে নেই। না চাইতেও বড্ড হাসি পেল শাদাবের। ঠোঁট চেপে সামান্য হাসলও। বলল,

-‘কী বলবেন ও’কে?’

-‘একটু কথা বলতাম।’

-‘লাভ নেই। ‘ও’ জানে, আমাদের বাবা একজন বিশ্বাসঘাতক। অবুঝ হলেও, এই বিশ্বাসঘাতকতার সংজ্ঞাটা ‘ও’ খুব ভালো করেই বুঝে।’

-‘তুমি কি পুরনো কথা শেয়ার করেছ ওর সাথে?’

-‘লুকানোর কী আছে? সত্য জানার অধিকার আছে ওর।’

-‘তাইবলে, বাবার সম্পর্কে এরূপ কথা হজম করার মতো মানসিকতা হয়েছে ওর? সামলাতে পারবে?’

-‘সেই টেনশন তো আপনার হওয়ার কথা নয়! গর্ভবতী স্ত্রীর মানসিকতা বোঝার ক্ষমতা যার নেই, তার সন্তানের মানসিকতা বোঝার আগ্রহ জন্মাচ্ছে কেন? তা-ও এত বছর পর! আপনার কাছে তো আপনার সন্তানেরা মৃত। মৃত সন্তানদের নিয়ে এত আদিখ্যেতা করতে নেই।’

-‘তোমার বোঝা উচিত আমি ওর বাবা। আর কোনো সন্তান বাবা সম্পর্কে এমন কথা সহজে গ্রহণ করে নিতে পারে না।’

-‘কেন পারবে না? ওর জন্মের আগে থেকেই বাবা নেই। এটা গ্রহণ করা ওর জন্য সহজই। আমি আছি তো! জন্মের পর ওর প্রতিটা পদক্ষেপে মা-ভাই ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পাশে পেয়েছে। যেখানে বাবার কোনো আদর, স্নেহ, মায়া-মমতা কিচ্ছু নেই, সেখানে বাবার প্রতি ভালোবাসাটাও ওর থাকার কথা নয়। সম্মান-শ্রদ্ধা যতটুকু ছিল, তা মুছে গিয়েছে। এখন যা আছে, যতটুকু আছে, তা শুধু ঘৃণাই। জন্মের পর যখন ও’কে আমি দু’হাতে কোলে তুলে নিয়েছিলাম, সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আপনার ছায়াটাও আমি ওর জীবনে পড়তে দিব না। কিন্তু দুর্ভাগ্য। নিয়তি আমাকে এই কঠিন জায়গায় এনে দাঁড় করালোই। ঠেলে সরাতে পারছি না, আবার হজম করতেও পারছি না। আমি কোন পরিস্থিতিতে আছি, সেটা বোঝার মনও আপনার নেই। তাই প্লিজ, অনুরোধ করব, আপনি ওর সামনে আর আসবেন না। বাবার প্রতি সমস্ত সম্মান-শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে আমরা অনেক আগেই ‘সুখনীড়’-এর ওই বিশাল অহংকারের দ্বারে, দাফন করে এসেছি।’

কায়ছার সাহেব স্তব্ধ, অনড়, বাকরুদ্ধ। যে পরিস্থিতি আজ তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তার সম্পূর্ণ দায়ভার তাঁর নিজের। এরজন্য আফসোস নেই, তবে আছে সামান্য অপরাধবোধ। এইটুকুই আজ তাঁকে সন্তানদের সামনে আসার জন্য সাহসী করে তুলেছিল। অথচ তিনি ব্যর্থ। নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যর্থ। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব-কর্তব্য, দায়বদ্ধতা সবকিছু প্রকাশ করতে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা লুকানোর মতো জায়গারও আজ বড্ড অভাব। তবুও তিনি শিহাবের সাথে একবার কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। অপরাধীর ন্যায় নতমুখী হয়ে বললেন,

-‘একবার অন্তত শিহাবের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দাও। সত্যি বলছি, আজকের পর আর কোনোদিন আমি তোমাদের সামনে যাব না। কোনোপ্রকার দাবী রাখব না। শুধু আজই। শেষবার।’

-‘এত বছর পর, কেন আপনি ওর সাথে দ্যাখা করবেন? কী বলবেন ও’কে? বলতে পারবেন, আমি তোমার মা’কে অসুস্থ অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলাম? বলতে পারবেন, আমি তোমার ওপর অবিচার করেছিলাম? পারবেন এসব বলতে? পারবেন না। অহংকার যার রক্তে মিশে আছে, সে কোনোদিন নিজের ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করতে জানে না।’

-‘টোটোন আমি তোমাকে অনুরোধ করছি। একবার আমার মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা কোরো।’

কায়ছার সাহেব যে অনুতপ্ত সেটা তার আচরণেই স্পষ্ট। তবুও এই ধোঁকাবাজ মানুষ ও বিশ্বাসঘাতককে কোনোপ্রকার সুযোগ দেয়া উচিত হবে না আর। এতগুলো বছরের পুরনো যন্ত্রণাকে আবারও ক্ষতবিক্ষত করার কোনো মানে হয় না। শিহাব সব জানলেও তার মস্তিষ্ক সেসব কত সহজে গ্রহণ করেছে কে জানে! এখন অবধি ভাইকে ওসব বিষয় নিয়ে আর একটা কথাও জিজ্ঞেস করেনি। সব অতীত হলেও বাস্তব সত্য এটাই যে, বাবা নামক ব্যক্তি তাদের কাছে সবসময়ই মৃত। এখন যদি কায়ছার সাহেব তার কাছে বাবা হওয়ার দাবী নিয়ে যান, তখনই সমস্যা হবে। অবুঝ বাচ্চাটা কতটা সহজভাবে কায়ছার সাহেবের উপস্থিতি ও তার সাথে কথোপকথন গ্রহণ করতে পারবে এটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এজন্যই সে চায় না, শিহাব এই লোকটার সামনে এসে অযথাই দুর্বল হয়ে পড়ুক। অতীতের দুঃখ-যন্ত্রণা উপলব্ধি করে কান্নাকাটি করুক। বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা শাদাব নিজের রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা, নিয়ন্ত্রণ করে ঠাণ্ডা মাথায় বলল,

-‘আপনার মনের অবস্থার চেয়েও, ওর মনের অবস্থাটা দ্যাখা, বোঝা, বেশি জরুরী আমার কাছে। কারণ বয়স ও বুদ্ধির তুলনায় এখনও শিহাব বাচ্চা-ই।’

-‘আমার অনুরোধটাও রাখবে না?’

-‘দুঃখিত। সম্ভব হলো না।’

-‘ক্ষমা চাওয়ার উছিলায়ও কি নিজের বাচ্চাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারব না?’

-‘সেই অধিকার আপনি নিজেই হারিয়েছেন। বিবেককে খু//ন করে সম্মানকে প্রায়োরিটি দিয়ে স্বেচ্ছায় যাকে কুরা//বানী করেছেন, আজ তাকে জড়িয়ে ধরার মতো সাহস আপনার হচ্ছে কী করে, আমি বুঝি না। জীবনটাকে আপনি ছোটোখাটো একটা নাটক-সিনেমা ভাবছেন, তাই না? জীবন কোনো নাটক কিংবা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা নয়, জীবন হচ্ছে বাস্তবিক এমন এক উপলব্ধি, যেখানে গল্পের শেষ উল্লেখ থাকলেও সম্পূর্ণ গল্পটা ‘শুভ সমাপ্তি’র হয় না। জীবনের কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো চরিত্রের শেষ পরিণতি হয়, ‘দুঃখের সমাপ্তি’ দিয়ে। সব জীবনের শেষে যদি ‘ক্ষমা’ শব্দটাকে তুচ্ছ করে সমাপ্তিতে সুখ টেনে আনা হয়, তবে জীবনের এতগুলো বছরের লড়াইটা হালকা হয়ে যাবে। সবকিছু স্রেফ ‘ক্ষমা’ শব্দটার কাছে এসে মাথা ঠু//কে মরবে। জীবনটাকে নাটক-সিনেমার দিক দিয়ে বিচার করতে গিয়ে ভুলে যাবেন না, কিছু মানুষ জীবনের অন্তিম মুহূর্তে আসলেও ‘ক্ষমা’ শব্দটাকে প্রাধান্য দেয় না। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। এই কারণেই সব জীবনের সমাপ্তি সবসময় সুখের হয় না। মানুষকে আপনি যত খুশি বোকা ভাবতে চান, ভাবুন। কিন্তু সহজেই কাউকে আত্মসম্মানহীন ভাবতে যাবেন না। সবাই আপনার মতো অন্যের বুদ্ধি ঘাড়ে নিয়ে ব্যক্তিজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় না।’

***

বেড থেকে নিচে পা রাখতেই পুরো শরীর দুলুনি দিয়ে উঠল মাহদিয়ার। মাথা চেপে ধরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ল। ক’দিন ধরে শুয়ে-বসে দিন কাটাতে গিয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে তার। সেই সাথে শারিরীক ও মানসিক দুর্বলতা তো আছেই। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যে পায়ের উপর ভর দিয়ে হাঁটবে সেই শক্তিটুকু শরীরে নেই। মনে তো জোর নেই একদমই। আর কত কাঁদা যায়? কত সহ্য করা যায়? মা কেন ফোন করেন না একবারও? কেন জানতে চান না, মেয়ে ভালো আছে কি নেই? মেয়ের প্রতি সব দায়িত্ব থেকে কি তিনি স্বেচ্ছায় মুক্তি নিলেন? এত সহজেই মুক্তি! ইশ, উনি মা। মায়ের জন্য মন যে প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহূর্তে পুড়ে সেটা কি জন্মদাত্রী মা জানতে চাইবেন না? মায়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে মাহদিয়া। অথচ মায়ের খোঁজ নেই। আজাদ সাহেব মাহদিয়ার শরীরের ভারসাম্যহীন এই অবস্থা দেখে তড়িঘড়ি মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন,

-‘কী হয়েছে মা? শরীর বেশি খারাপ লাগছে?’

-‘তেমন কিছু না বাবা। একটু মাথা ঘুরছে।’

-‘তুমি বসে থাকো মা। নয়তো আমার হাত ধরে এসো। আমি তোমাকে নিচে নিয়ে যাচ্ছি।’

-‘কিন্তু ব্যাগপত্র…।’

-‘ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই গাড়িতে তোলা হবে। তুমি শুধু নিজেকে শক্ত রাখো।’

গুছিয়ে রাখা সবক’টা ব্যাগ ও কাপড়চোপড় যা কিছু এতদিন ব্যবহার করা হয়েছে সবকিছু একত্রে নিতে নিয়ে দেখলেন, বেশ কয়েকটা ব্যাগ ভারী হয়ে গেছে। মাহদিয়ার ঔষধপত্রের ব্যাগ আলাদা সরিয়ে সেগুলো হাতে নিয়ে নিচে নামলেন হায়দার সাহেব। বাকি যে ব্যাগগুলো ছিল, সেগুলো আজাদ সাহেব নিজের হাতেই নিলেন। তিনি মাহদিয়াকে বসতে বলে দরজার কাছে এগোতেই শাদাব কেবিনে প্রবেশ করল। আজাদ সাহেবকে বলল,

-‘আপনি কেন কষ্ট করছেন আংকেল? এসব তো আমি-ই নিয়ে রাখতাম।’

-‘অসুবিধা নেই বাবা। তুমি বরং দিয়াকে নিয়ে এসো। ও বলছে, মাথা ঘুরাচ্ছে।’

মাথা ঘুরানোটাই তো স্বাভাবিক। কম ঝড় কী গেল! মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরতে পারা মানুষের এখন শুধু সাপোর্ট দরকার। মনের জোর ও আপনজনদের সহমর্মিতাই তাকে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে। সাত-পাঁচ ভেবে সময় নষ্ট করল না শাদাব। ঝটপট মাহদিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুঃশ্চিন্তা কমিয়ে তাকে একটুখানি ভরসা দিতে কাঁধে হাত রেখে বলল,

-‘সারাক্ষণ কেন এত অকারণ ভাবনাকে মনে ঠাঁই দিচ্ছ? সব ঠিক হয়ে যাবে, ভ্রমর। কয়েকটা মাস মাত্র। এরপরই তুমি আগের মতো দৌড়াতে পারবে।’

মাহদিয়া ম্লানমুখেও হাসি ফুটানোর চেষ্টা করল। বলল,
-‘মা কেন কল করছেন না শাদাব? এত অপেক্ষা করছি!’

-‘অপেক্ষা না করে তুমি-ই কল করে নাও।’

-‘তুমি বলছ এই কথা? মা’কে কল করব?’

-‘কেন করবে না? মায়ের প্রতি তোমার টান তো মিছে নয়।’

-‘তুমি রাগ করবে না?’

-‘পাগল না-কি! আমি রাগ করব কেন?’

-‘মা এতকিছু করলেন! তারপরেও…।’

শাদাব ক্ষীণ হাসল। মায়ের থেকে সন্তানকে আলাদা করা সত্যিই কঠিন। শায়লা সুলতানাকে সে হয়তো কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না, কিন্তু সন্তানের মনে মায়ের জন্য যে টান, সেই টান সরানোর ক্ষমতা তার কোনোকালেই হবে না। মা সবসময় মা-ই হয়। মায়ের সাথে অন্যকারো তুলনা একদমই চলে না। অতি সন্তর্পণে এই কথার জবাব সে এড়িয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে দুটো হাতেই মাহদিয়াকে পাঁজাকোলে তুলে শেষ একবার পুরো কেবিনটায় চোখ বুলিয়ে নিল। বিশ্বস্ত মানুষটাকে কাছে পেয়ে, মাহদিয়া নিজেও তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। নিঃশব্দে বুকে মাথা ঠেকিয়ে কণ্ঠ নামিয়ে বলল,

-‘তুমি কোনোদিন পালটে যেও না শাদাব। বিশ্বস্ত মানুষের দুটো রূপ সহ্য করার মতো, ধৈর্য্যশক্তি, মনোবল, সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছি। তুমি যদি পালটে যাও, নির্ঘাত মৃত্যু হবে।’

হাঁটার গতি কমিয়ে মাহদিয়ার অভিমানী মুখটা ভালোমতো পরখ করল শাদাব। ধীরস্থিরভাবে বলল,
-‘বিশ্বাস শব্দের ওজন জানো কতটুকু? ওই একটা শব্দ কতটুকু ভারী আন্দাজ করতে পারো? বিশ্বাস শব্দের ওজন এতটাই ভারী হয় যে, ওই একটা শব্দের ওপর ভর দিয়েই গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। বিশ্বাসের ওপর ভর দিয়েই সম্পর্কে তৈরী হয়, শ্রদ্ধা-সম্মান, এমনকি ভালোবাসাও। যে সম্পর্কে বিশ্বাসের ওজন অনেক কম, সেই সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী। সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী করতে বিশ্বাসের ওজন ভারী করতে হয়। তবে হ্যাঁ, সেখানে অন্ধবিশ্বাসকে ঠাঁই দেয়া যাবে না। তুমি আমাকে বিশ্বাস কোরো, কিন্তু অন্ধবিশ্বাস কখনওই নয়। আমার ওপর বিশ্বাস রাখলে, তোমার গোটা জীবন আমি সুখে ভরিয়ে দিতে পারব, কিন্তু অন্ধবিশ্বাস; এটা তোমার ও আমার মধ্যে সুক্ষ্ণ একটা দেয়াল তৈরী করে দিবে। কাউকে এতটা অন্ধবিশ্বাস করা উচিত নয়, যতটুকু অন্ধবিশ্বাস সম্পর্কের মধ্যে থাকা অনুভূতিকে হালকা করে দিতে পারে। ততটাই বিশ্বাস করা উচিত, যতটুকু বিশ্বাসে সম্পর্ক হয় আজীবন নির্ভরতার, বিশ্বস্ততার ও ভালোবাসার। পারবে তো আমাকে আমৃত্যু বিশ্বাস করতে?’

মাহদিয়া নির্ভার হাসল। মনে মনে কিছু একটা প্রার্থনা করে, আশ্বস্ত চোখের পলক নাড়িয়ে আলগোছে অধর ছুঁইয়ে দিল প্রিয়তম’র চিবুকে। পরপর দুটো চুমু এঁকে দিয়ে বলল,

-‘জীবন খুব ছোট্ট ও ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সবচেয়ে সেরা অর্জন হচ্ছ তুমি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি দ্যাখেই, নিজের গন্তব্য সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছি।’

***

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, শপিং করার উদ্দেশ্যেই মলে ঢুকেছিল শিহাব। বেশকিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষ করে নাচতে-নাচতে বাইরে আসছিল সে। ইভানা তখনও বিল পেমেন্ট করতে ব্যস্ত ছিল। তাকে ও মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোন ফাঁকে যে শিহাব বাইরে চলে এলো, কেউ টেরই পেল না। গাড়ির কাছে আসার আগেই কেউ তার মুখে হাত দিয়ে বেশ খানিকটা দূরে সরিয়ে নিল। প্রথমে হাত-পা ছুঁড়লেও পরক্ষণেই ছাড়া পেয়ে কায়ছার সাহেবকে দেখে চোখ পাকিয়ে তাকাল শিহাব। রাগ দেখিয়ে বলল,

-‘আপনার সাহস তো কম নয়, আপনি আমাকে টেনে এনেছেন। যদি ভাইয়ার চোখে এসব পড়ত, ঘু//ষি দিয়ে নাক ফা//টি//য়ে দিত।’

কায়ছার সাহেব অসহায় চোখে শিহাবকে দেখলেন। দুটো হাত ধরে, মাটিতে হাঁটুভেঙে বসে পড়লেন। আদুরে বাচ্চার হাতে চুমু খেতেই টান মেরে নিজের হাত সরিয়ে নিল শিহাব। বলল,

-‘এখন এত আদর দ্যাখাচ্ছেন কেন? মা’কে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার সময় কোথায় ছিল আপনার আদর?’

বড্ড অসহায় অবস্থায় পড়ে গেলেন কায়ছার সাহেব। অবুঝ বাচ্চাটার কাছে নিজের অপরাধের সীমা-পরিসীমা ব্যাখ্যা করতে হবে! এটা কত লজ্জার, অপমানের। বাচ্চাটাকে একটুখানি আদর করার লোভে সব লজ্জা-অপমানকে ভুলে গেলেন তিনি। বললেন,

-‘তখন তো আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বাবা। খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। খারাপ না হলে কোনো বাবা তার সন্তানের সাথে এমনতর অন্যায় করতে পারে? পারে না। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?’

শিহাব নিজেও একরোখা মেজাজে বলল,
-‘আমি আমার মা’কে ভালোবাসি। আমার মা-ই আমার জন্য উত্তম আদর্শ।’

একটা অবুঝ বাচ্চার নিকট থেকে এরচেয়ে কঠিন শব্দ, বাক্য আশা করা যায় না। মা’কে ‘ভালোবাসি’ এইটুকু দিয়ে শিহাব নিজেকে যতখানি প্রকাশ করল, তাতে কায়ছার সাহেব নিশ্চিত হয়ে গেলেন, তিনি কোনোদিনও ক্ষমা পাবেন না। অবুঝ হলেও, কী সুন্দরভাবে মা’কে সেরা স্থানে বসিয়ে দিল বাচ্চাটা। তিনি যে আর কিছু বলবেন, সেই মুখটাও রইল না। তবুও একগুঁয়ের মতো জানতে চাইলেন,

-‘তুমি নিজের বাবার কাছে ফিরতে চাও না?’

-‘কে আমার বাবা? আমার তো কোনো বাবা নেই।’

কায়ছার সাহেব হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শিহাবের দিকে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইতিউতি চোখ ঘুরিয়ে মা ও ভাইকে খুঁজছে। তিনি শেষবারের মতো নিজের মধ্যে থাকা সবটুকু অহংকারকে দূরে ঠেলে দিয়ে বললেন,

-‘কে বলেছে তোমার বাবা নেই? আমি-ই তো তোমার বাবা।’

-‘তাই বুঝি? বাবারা এমন হয়? নিষ্ঠুর? খু//নী? বাবারা কত্ত ভালো হয়। আমি বইতে কত পড়েছি। একজন বাবা কতটা চমৎকার মনের মানুষ হোন। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই দ্যাখিনি, জানেন।’

-‘এখন থেকে দ্যাখবে। আমি একজন চমৎকার বাবা হব। যাবে আমার সাথে?’

-‘দূর। আপনি কেন আমার বাবা হবেন? আমার বাবা তো সে-ই কবেই মা//রা গেছে। আমি দ্যাখিওনি তাঁকে। দ্যাখার আগ্রহও নেই আর। মৃত মানুষকে তো আর দ্যাখা যায় না। বাবা বলে ডাকাও যায় না।’

কায়ছার সাহেব দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললেন,
-‘বিশ্বাস কোরো, আমি-ই তোমার বাবা।’

শিহাব ঠোঁট উলটে হাসল। ডানে-বামে চোখ ঘুরিয়েই শাদাবকে দেখতে পেয়ে চিৎকার দিল,
-‘ভাইয়া, এইদিকে একটু এসো।’

মাহদিয়াকে মাত্রই সিটে বসিয়ে রাখছিল শাদাব, এরমধ্যেই কাছেপিঠে শিহাবের গলা শোনে চমকে গেল। শপিংমল থেকে বেশ খানিকটা দূরে শিহাবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গলার পানি শুকিয়ে গেল তার। কোনোকিছুই আর ভাবতে পারল না। একছুটে ভাইয়ের কাছে আসলো। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে মা ও ভাবীকে খুঁজল। না পেয়ে বলল,

-‘এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?’

-‘উনি বাবা সাজতে এসেছিলেন।’

ভয়ে, আতঙ্কে জমে গেল শাদাব। পূণরায় সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে এমদাদ কায়ছারকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। না পেলেও তার ভয় কমল না। বলল,

-‘কোথায় উনি?’

-‘তোমাকে ডাক দিতেই ভয়ে দৌড় দিয়েছেন।’

-‘মা আর ভাবী কোথায়?’

-‘শপিংমলেই আছে। বিল পেমেন্ট করছে।’

-‘তুমি বাইরে আসলে কেন?’

-‘আমি তো তোমার কাছে যাব বলেই আসলাম, মাঝখান থেকে ওই খারাপ লোক আমাকে এইখানে টেনে আনল। ওনার নামে ছেলেধরার মা//ম//লা করা উচিত। ভীষণ খারাপ ওই লোক।’

-‘খারাপ কিছু করেছেন উনি?’

-‘সাহস আছে না-কি ওনার? বলেছি, তুমি দ্যাখলে ঘু//ষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে দিবে।’

শিহাবের কথা শোনে হেসে ফেলল শাদাব। দু’পা হেঁটে এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখল, বেশ কয়েক হাত দূরে কায়ছার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। এইদিকেই তাকাচ্ছেন বার বার। চোখেমুখে কত তৃষ্ণা, কত ব্যকুলতা। এসব তাকে ছুঁয়েও গেল না। শিহাবের হাত ধরে তাকে গাড়িতে নিয়ে বসাল। সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে বলল,

-‘বসে বসে দিয়াপির সাথে গল্প কোরো। ভাইয়া এক্ষুণি মা আর ভাবীকে নিয়ে আসছি।’

একটা মানুষ এত নির্লজ্জ হয় কী করে ভেবে কূল-কিনারা খুঁজে পায় না শাদাব। এতকিছুর পরেও, এতবার ঘৃণার বুলি শোনানোর পরও স্ত্রী ও সন্তানের জন্য আজ তিনি মায়া বাড়াতে এসেছেন! ক্ষমা পাওয়া কি এতই সোজা? সামান্য একটা শব্দের কাছে, এত বছরের কষ্টকে সে তুচ্ছ করে দিবে? মোটেও নয়। মা ও ভাইয়ের জন্য এই শহর সে একবার ছেড়েছিল, প্রয়োজনে আবার ছাড়বে। ছাড়লে এবার আর শহর নয়, গোটা দেশকে ছেড়ে যাবে। মা, ভাই ও নিজের প্রাণপ্রিয় ‘ভ্রমর’কে নিয়ে চিরদিনের জন্য এমদাদ কায়ছারের জীবন থেকে দূরে চলে যাবে। অনেক দূরে যাবে। যতদূর গেলে ‘সুখনীড়’ ও ভয়াবহ অতীত জীবন থেকে হারিয়ে যায়। ততদূরেই যাবে।

***

চলবে…