#বছর_দুয়েক_পর
#দ্বিতীয়_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন
********
বিশাল বড় পুরাতন এক গুদাম ঘর।ঘরটির চারপাশ বিভিন্ন মালামাল আর ধুলোবালিতে পরিপূর্ণ।ধুলাযুক্ত মাকড়শার বিশ্ৰী কালচে জাল ঘরটির প্রতিটি কোনায় কোনায় বাজেভাবে ঝুলছে।ভাঙা কাঠের আসবাবপত্র গুলোও কেমন চিটচিটে।ঘরটির ভেতরের গুমোট গন্ধ এসে নাকে বাড়ি খাচ্ছে সেই সাথে উড়ন্ত ধুলাবালি হাঁচি কাশির সৃষ্টি করছে সমান তালে।পুব পাশের দেয়ালে থাকা মাঝারি আকারের ভ্যান্টিলেটর ফ্যান টা ঘটঘট শব্দ তুলে বিরামহীন ঘুরছে।কক্ষের উত্তপ্ততা কমানোর চাইতে অস্থিরতাই যেনো বেশি বাড়াচ্ছে এই বেহুদা শব্দখানা।গুদামটির জানালা বলতে ছোট ছোট দুটো ফুটো।সেই ফুটো দিয়ে দিনের আলো প্রবেশ করেনা বললেই চলে।দিন দুপুরেও ঘরটিকে আলোকিত করার জন্য কৃত্তিম বাতির প্রয়োজন হয়।আর বাতি বলতে সেই হলুদ আলোর ছোট তাপযুক্ত বাতি গুলো।এই বৃহৎ গুদামটিকে ঘর কম নরক ই বেশি মনে হচ্ছে।
ঘরটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিশেষ কোনো দরকার ছাড়া ভুলেও কেউ কখনো পা মাড়ায় না এখানে।
গুদামঘরের ছাদের উল্টোপিঠের হুকের সাথে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে মাঝবয়সী এক লোককে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।শরীরে তার অসংখ্য মা/রের চিহ্ন।শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় গভীর ক্ষ/ত।সেই ক্ষ/ত গড়িয়ে গড়িয়ে গাঢ় রঞ্জন বেরিয়ে শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে।দুই একটা মাছি এসে সেই জমাট বাঁধা র/ক্তে ভনভন করছে।
লোকটি হয়তো জ্ঞান হারিয়েছে।কারন এহেন অসহনীয় গরম আর ভয়ানক পরিস্থিতি তেও সে চোখ বুজে ঝুলে আছে নিশ্চিন্তে।
পাশেই স্টিলের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে দুই পা মেলে বসে আছে সুঠামদেহী এক যুবক।যুবকের গায়ের সাদা শার্ট খানা ঘামে ভিজে শরীরের সাথে সেটে রয়েছে।যার দরুন জিম করা শরীরের বলিষ্ঠ পেশিগুলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।ধবধবে ফর্সা ক্লিন সেভ মুখশ্রী তে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যুবকের সৌন্দর্য আরো হাজার গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।খাড়া নাকের ডগায় জমা মুক্তার ন্যায় ঘর্ম দানা অদ্ভুত সৌন্দয্যের সৃষ্টি করছে।কালো কুচকুচে মনির গভীর চাহনি যে কারো বুকের হৃদযন্ত্রের গতি বাড়াতে বাধ্য করবে।নিজের সম্মোহিত কালচে লাল ঠোঁট গুলো দাঁতের সাহায্যে কামড়ে ধরে হাতে থাকা লোহার পাইপ দিয়ে সমানে পাকা করা মেঝেতে স্বশব্দে ঠুকে যাচ্ছে।তবুও ঝুলে থাকা ব্যাক্তি নির্বিকার ।
এতো এতো হেয়ালিপনা যেনো সহ্য হলো না যুবকের।গলার মোটা গম্ভীর রাগী স্বরে আদেশ করলো
“ওর মুখে ফুটন্ত গরম পানি ছুড়ে মারো অভীক”
বসের আদেশ পাওয়া মাত্র নড়েচড়ে উঠলো অভীক নামের ঊনত্রিশ বছর বয়সী ছেলেটি।এরপর সামান্য কাচুমাচু করে বলে উঠলো
“মুখ পু/ড়ে যাবে স্যার”
“ওর জন্য প্রতিনিয়ত আমার হৃদয় পু/ড়ছে।এবার ভেবে দেখো কোনটার যন্ত্রনা বেশি”!
আর কথা বাড়ালো না অভীক।সে জানে তার বস কঠিন হৃদয়ের পুরুষ।তাই বলে এতোটা কঠিন এটা সে ভাবেনি।যদিও না ভাবার কিছুই নেই।এর চাইতেও ভয়ানক কান্ড ঘটাতে দেখেছে এই মানব কে সে।
“কি হলো সময় অপচয় একদম পছন্দ করিনা জানোনা?
ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে কেঁপে উঠলো অভীক।
“যা যা যাচ্ছি স্যার”
পাশেই আধভাঙ্গা ময়লাযুক্ত টেবিলের উপর ইলেকট্রিক কেটলিতে টগবগিয়ে পানি ফুটছে।সেই কেটলির সুইচ বন্ধ করে একটা স্টিলের মগে কিছু পানি ঢাললো অভীক।এরপর সেই মগে সামান্য ফু দি”তে দিতে এগিয়ে এলো।
অভিকের নড়বড়ে কাজকর্ম সবটাই পর্যবেক্ষণ করে লোহার ভারী পাইপটি ছুড়ে মারলো যুবক।আচানক ভয়াবহ বিকট শব্দে এক প্রকার লাফিয়েই উঠলো অভীক।
“এটা কি জামাই আদরের জায়গা ড্যাময়েট ?
“স্যার আপনার মতো অতোটা অমানবিক হতে পারছি না।
নিজের ক্রোধ চেপে রেখে বাঁকা হাসলো যুবক।এরপর বাজ পাখির ন্যায় ছো মেরে অভীকের হাত থেকে মগ খানা নিয়ে ঝুলিয়ে রাখা লোকটির মুখে পানি গুলো ছুড়ে মারলো।
মুহূর্তেই লোকটি চিৎকার করে উঠলো।সেই চিৎকার বদ্ধ গুদাম ঘরের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলে আরো ভয়াবহ শুনালো।নিজের দুই কান চেপে ধরে নোংরা দেয়ালের সাথে চিপকে দাঁড়িয়ে রইলো অভীক।
লোকটির চোখ খুলতেই যুবকের হাসি প্রশস্ত হলো সেই সাথে চেহারায় ফুটে উঠলো চূড়ান্ত ক্রুরতা।
লোকটির আধাপাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িযুক্ত গালে শক্ত হাতে চেপে ধরতেই ককিয়ে উঠলো লোকটি।চোখের সামনে জমতুল্য মানুষটিকে দেখে ভয়ে চরম ভাবে গলা শুকিয়ে উঠলো।পানি চাইবার সুযোগ না দিয়েই যুবক হিসিসিয়ে শুধালো
“বল কার কথায় এই কাজ করেছিস?
লোকটি কথা বলার পরিস্থিতি তেই নেই।তবুও নিজের মরুভূমির ন্যায় শুকনো গলা ফাঁকা ঢোক গিলে আঠালো লালা দিয়ে সামান্য ভিজিয়ে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠলো
“বি বি বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিচ্ছু জানিনা।জানলে এখানে ঝুলে ঝুলে মার খেতাম না”
মাঝবয়সী লোকটির এহেন অজানা উত্তর যুবকের মনঃপুত হলো না।।লোকটির সাদা কালো মিশেলের চুলের মুঠি চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো
“জানিস না যখন তবে এখানেই ঝুলে ঝুলে শুঁটকি হয়ে থাক।”
আর দাঁড়ালো না যুবক।গটগট পায়ে গুদাম ঘরের বাহিরে এসে লাল ঠোঁট গুলো গোল করে ফুঁস করে দম ছাড়লো।মন মেজাজ একদম বিতৃষ্ণায় ভরা।কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না।নিকোটিন এর ধোয়া ছাড়া এই বিতৃষ্ণা কোনো ভাবেই দূর হবে না।
ধীরপদে গুদামের দরজায় বৃহৎ তালা লাগিয়ে চোরের মতো বাইরে এলো অভীক।
“মনে হচ্চে আসলেই লোকটি কিছু জানে না স্যার”
কথাটি বলেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো অভীক।অভীকের এমন বোকা বোকা কথায় বিগলিত নিষ্প্রাণ হাসলো যুবক।এরপর সিগারেট এর ফিল্টারে লম্বা এক টান দিয়ে ঘন ধোয়া উড়িয়ে কঠিন ব্যারিটোন স্বরে বলে উঠলো
“ও সব জানে অভীক।আমি কখনো কোনো নিরীহ মানুষকে আ/ঘা/ত করিনা।
আর দাঁড়ালো না যুবক।নিজের বিলাসবহুল গাড়িতে উঠে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো।অসহনীয় গরমে মাথাটা প্রচন্ড ঘুরছে।
গুটি গুটি পায়ে অভীক এসে ড্রাইভিং সিটে বসে গেলো সেই সাথে গাড়ির এসি অন করে স্টার্ট দিয়ে সাইসাই গতিতে ছুটতে লাগলো।
“কোথায় যাবো স্যার?
মিনমিন করে শুধালো অভীক
“হোটেলে চলো আজ রাতের ফ্লাইটেই নিউইয়র্ক ফিরে যাবো।এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে ”
দুই চোখ বন্ধ রেখেই নিভু নিভু স্বরে বলে উঠলো যুবক।
নিজের মনে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে অভীক শুধালো
“এই লোকটির তবে কি হবে স্যার?
“ও খুবই জঘন্য এক অন্যায় করেছে অভীক।তার জন্য মৃ/ত্যু/ই শেষ ব্যবস্থা….শুকিয়ে কঙ্কাল হলে ইকবাল এসে নিয়ে যাবে।আর কিছু জিজ্ঞেস করো না প্লিজ”।
***********
“তুই তাহলে ধরেই নিয়েছিস ওই ম/রে যাওয়া ছেলের স্মৃতি বুকে নিয়ে বসে থাকবি তাইতো?
রাগী উচ্চস্বরে কথাটি বলে তাথৈ এর পানে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এরিক।
এরিকের এহেন গর্জনে নিশ্চুপ নির্ভয় রইলো তাথৈ।সে তার অবস্থানেই বহাল।কিন্তু তাথৈ এর এমন ঐদ্ধত্ব সহ্য হলো না এরিকের।পুনরায় হিসহিস করে বলে উঠলো
“ভালোয় ভালোয় রেইন কে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যা নইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম তাথৈ!ছেলে আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড।জন্ম বেড়ে উঠা দুই অস্ট্রেলিয়াতে।ফ্যামিলি হাই সোসাইটি মেইনটেইন করে।বড় বড় বিজনেস ম্যাগনেট দের সাথে তাদের উঠাবসা।টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই।যে ম/রে গেছে তাকে নিয়ে কিসের এতো আদিখ্যেতা
“আমি ভিয়ান কে ভালবাসি ভাইয়া।ভিয়ান কে সরিয়ে অন্য কাউকে মনে জায়গা দেয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়”
শক্ত কন্ঠে উত্তর জানালো তাথৈ।
তাথৈ এর উত্তরটা যেনো এরিকের মাথায় বজ্রপাতের ন্যয় ঠেকলো।দিকবিদিক ভুলে গাল পেঁচিয়ে ঠাটিয়ে এক চ/ড় মে/রে দিলো তাথৈকে।চড়ের তাল সামলাতে না পেরে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে ছিটকে পরে গেলো শীর্ন দেহের দুর্বল তাথৈ।এরিকের শক্ত হাতের চড়ে তাথৈ এর গালের চামড়া সহ যেনো উঠে এলো সেই সাথে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হলো।
কিন্তু বিন্দুমাত্র উঃ শব্দ পর্যন্ত করলো না তাথৈ।
হঠাৎ শব্দে রান্না ঘর থেকে ছুটে এলেন মেহেরিন চৌধুরী।মেঝেতে মুখ থুবড়ে তাথৈ কে পরে থাকতে দেখে দৌড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে এরিকের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠলেন
“একে বারেই মে/রে ফেল ওকে অমানুষ কোথাকার।ওতো এমনিতেই আধমরা হয়ে বেঁচে আছে তুই নাহয় ওকে পুরোপুরি মুক্ত করে দে এই যন্ত্রনা থেকে”
মেয়েকে ফ্লোর থেকে তুলতে তুলতে কেঁদে ফেললেন মেহেরিন চৌধুরী।তার পেটে ধরা ছেলে যে এমন জানোয়ার হবে এটা যেনো তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।সুযোগ পেলেই তাথৈকে মেরে বসে।
মা মেয়ের এহেন নাটক যেনো গায়ে আ/গু/ন ধরিয়ে দিলো এরিকের।মেহেরিন চৌধুরীর পানে আঙ্গুল তুলে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো
“তোমার মেয়ে তোমার লাই পেয়েই মাথায় উঠেছে মম।আবেগ দিয়ে লাইফ চলবে?অবুঝ বয়সের ভুল বুকে চেপে কতদিন বেড়াবে সে আমিও তা দেখে নেবো।সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে ঘি কিভাবে তুলতে হয় তা এই এরিক চৌধুরী ঠিক জানে।
আর দাঁড়ালো না এরিক।গলার টাই খানা টেনে খুলতে খুলতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।রোজ রোজ একই নাটক দেখতে দেখতে গায়ে ঘেন্না ধরে গেছে তার।
এরিক চলে যেতেই হাতে বরফ খন্ড নিয়ে দৌড়ে এলো চারু।
“আপা মনি আপনার গালডা ছুইলা গেছে গা।একটু বরফ ডইল্যা লন”
চারুর পানে তাকিয়ে মর্মাহত ফ্যাসফ্যাসে স্বরে তাথৈ বলে উঠলো
“হৃদয়ে যেই জখম হয়েছে তা কিভাবে সারবে চারু?
আর দাঁড়ালো না তাথৈ।ভিয়ানের ছবি জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদলে হয়তো বুকের কষ্ট গুলো কমবে।মানুষটাকে অনেক নালিশ জানানোর আছে।সে যাওয়ার আগে কেনো আমাকেও সঙ্গে নিলো না?
মেয়ের সাথে সাথে মেহেরিন চৌধুরী ও উপরে উঠতে চাইলেন।কিন্তু তাথৈ বলে উঠলো
“তুমি এসো না আম্মু।আমার একলা থাকতে ভীষন ভালো লাগে।পাশে কেউ থাকলেই বরং আমি সাফক্যাটেড হই।”
মেয়ের পানে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে তাথৈ এর হাত ছেড়ে দিলেন মেহেরিন।হাতের বাধন আলগা হতেই নিজেকে টেনে হিচড়ে চলতে লাগলো তাথৈ।
“আম্মা খালু জান রে কইয়া আপারে কোথাও পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন।একটু হাওয়া বদল হইলে ভালো লাগব তার”
ব্যাথিত স্বরে কথাটি বলে গলন্ত বরফের পানে দৃষ্টি দিলো চারু।চারুর কথাটা বেশ মনে ধরলো মেহেরিন চৌধুরীর।তিনি মনে মনে ঠিক করলেন সাইফ আজমী ফিরলেই তিনি মেয়েকে দূরে কোথাও পাঠাবেন কয়েক দিনের জন্য।
“এরিকের কালো ছায়া তোর জন্য খুবই অশুভ রে তাথৈ”
#চলবে