বছর দুয়েক পর পর্ব-১৭+১৮

0
927

#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_১৭
#সারিকা_হোসাইন

******
মাথার উপরের তীক্ষ্ণ তেজ নিয়ে কিরণ বিলাচ্ছে ঝকঝকে সূর্যটা।অত্যাধিক ভ্যাপসা গরমে বার বার শরীর গুলিয়ে উঠার উপক্রম।প্যাচপ্যাচে ভেজা গাছটার মগ ডালে সমানে কিছু কাক কা কা রব তুলে ভয়ংকর বিশ্ৰী ভাবে ডেকে চলেছে।রোদের উত্তাপে মনে হচ্ছে রাতের দিকে তুমুল বর্ষণ হবে।বর্ষাকালে প্রকৃতির খেলা বুঝা বড় দায়।এই তেজী রোদ তো এই ভারী বৃষ্টি।

বৃদ্ধ রহমান গাড়ি থেকে নেমে ইকবালের বাড়ির প্রধান ফটকে পায়চারি করতে করতে তাথৈ এর প্রতীক্ষা করতে লাগলো।মেয়েটার প্রতি তার আলাদা একটা টান রয়েছে।এই বাড়িতে পঁচিশ টি বছর কাটিয়েছে রহমান।সাইদ আজমীর বিশ্বস্ত ড্রাইভার ছিলো রহমান।হঠাৎই কিভাবে কি থেকে কি হয়ে গেলো বৃদ্ধ রহমান আজো ভেবে পায় না।শুধু কি তাই?এইজে সাইফ আজমী মেয়েটার উপর এতো এতো নির্দয়তা দেখাচ্ছে এর পরিত্রাণ কোথায়?সামান্য একটা ড্রাইভার হয়ে বড় লোকের ব্যাক্তিগত বিষয়ে মাথা ঘামালে তার ধড় থেকে দেহ আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু চোখের সামনে প্রতিনিয়ত মেহেরিন আর তাথৈ এর আহাজারি সে সহ্য করতে পারছে না।এর সাথে নতুন যোগ হয়েছে ভিয়ান নামক যন্ত্রনা।কেনো এই লুকোচুরি রহমান সব জানে।শুধু সময়ের অপেক্ষায় দিন গুনে চলেছে রহমান।এইযে কিছুক্ষন আগেই সে দেখেছে ইকবালের ব্যাক্তিগত ড্রাইভার কামরুল তার গাড়িতে করে ভিয়ান কে নিউইয়র্ক এর উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু এটা দেখেও বৃদ্ধ রহমান তাথৈ এর থেকে চেপে গিয়ে এখানে কিছু না জানার ভাঙধরে বসে আছে।রহমান জানে তাথৈ আর ভিয়ানের সাক্ষাৎ কতোটা ভয়ানক ব্যাপার হবে।ছেলেটার জীবন পুনরায় বিপন্ন হতে চাইবে।এদিকে তাথৈ আর মেহেরিন?
সাইফ আজমী কি তার শকুনি চোখের নজর এই মা মেয়ের উপর দিবে না?অবশ্যই দেবে।যেই সম্পদ একমাত্র তাথৈ এর নামে উইল করে দিয়ে গিয়েছে সাইদ আজমী তা কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে সাইফ আজমী?

হঠাৎই দুম করে খোলে গেলো ইকবালের বাড়ির প্রধান দরজা।এলোমেলো বিধস্ত শরীরে বল হীন জীর্ণ মানুষের ন্যয় কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে এলো তাথৈ।নিজের ধ্যন ভঙ্গ করে মেয়েটার পানে কাতর দৃষ্টি দিলো রহমান।মেয়েটার শরীরে হাড্ডি আর ফ্যাকাশে চামড়া ব্যাতিত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।মিষ্টি সুশ্রী চেহারা খানা মলিনতা ছেয়ে নিয়েছে আরো বছর দুয়েক আগে।মেয়েটার প্রাণটা যায় যায় অবস্থা।তবে কিসের এই বেঁচে থাকা?

আর ভাবতে পারেনা রহমান।সবকিছু জেনেও না জানার ভান করা বড়োই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।তবুও দক্ষতার সাথে প্রতিনিয়ত দুটো বছর ধরে অভিনয় করে চলেছে রহমান।এখন আবার সে পটু অভিনেতায় পরিণত হয়েছে।সাইফ আজমীর নাকের ডগা দিয়ে অভিনয় করে সত্য কে মিথ্যায় প্রমাণিত করে এই রহমান।কিন্তু তাকে ধরবে সাধ্যি কার?রহমান হাসে না একুশটি বছর ধরে।যেদিন সাইফ আজমীর নৃশংস পতন হবে ওইদিন তৃপ্তি নিয়ে হাসবে রহমান।সাঈদ আজমী মৃত্যুর আগে অনেক দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে এই রহমান কে।সেগুলো তো পূরণ করতে হবে নাকি?

“বাড়ি ফিরে চলো রহমান চাচা”

অস্ফুট গোঙানি সুরের কান্নায় আবারো ধ্যান ছুটলো রহমান ড্রাইভার এর।মুখে কিছু উচ্চারণ না করে বাধ্য দাসের ন্যয় গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্ট্রাট করে গাড়ি হাঁকালো।জানতে পর্যন্ত চাইলো না ভেতরে কি হয়েছে!
এই কান্না দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে রহমান।প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেয়েছে।এখন অবশ্য এসব কান্না কাটি রহমান কে আর দুর্বল করতে পারেনা।এসব কান্না রহমানের প্রতিশোধ স্পৃহা জাগায়।মাঝে মাঝেই রহমানের ইচ্ছে জাগে নেশায় বুদ হয়ে থাকা সাইফ আজমীর ছেলেকে নিয়ে খাদে পড়ে যেতে।কিন্তু সাইফ আজমীর শেষ পরিণতি দেখার জন্য তা আর হয়ে উঠে না।

********
এমিরেটস ফ্লাইটে নিজের বিজনেস ক্লাস সিটে চোখ বুজে বসে আছে ভিয়ান।রহমানের গাড়িতে তাথৈ এর আলুথালু অবস্থা বেশ পীড়া দিয়েছে তার মনে।মেয়েটা সাংঘাতিক রকমের চালাক।আরেকটু হলেই দফারফা সাঙ্গ হতো।কিন্তু হৃদয়ের কাছে এতো তাড়াতাড়ি হার মানতে রাজি নয় সে।একবার বেখেয়ালি পনায় যেই ভুল হয়েছে দ্বিতীয়বার সেই ভুল করা যাবেনা।সমস্যা কে মূল সমেত উৎপাটন করলে তবেই হবে মধুর মিলন।কিন্তু আপাতত যন্ত্রণার কাছে কিছুতেই মাথা নোয়ানো যাবেনা।দরকার পড়লে মনকে কঠিন শাসনে বাধবে সে।একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিন জন মানুষের জীবন জড়িত রয়েছে।ভিয়ান কিছুতেই মেহেরিন আর তাথৈকে কোনো রূপ বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলতে পারবে না।আর তাথৈকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে।যেই মানুষটা তার জীবনের সমস্ত কিছু উজাড় করে একমাত্র মেয়েকে উপহার দিয়ে গিয়েছে সেই জিনিস হকদার ব্যতীত অন্য কেউ ব্যবহার করবে এটা ভিয়ান মানবে কেনো?আর মানুষটা যদি হয় একান্ত আপনজন তবে তো কথাই নেই।যাকে এতোদিন বাবা হিসেবে দিনের পর দিন ঘৃণা করে গিয়েছে তাথৈ মানুষটার প্রতি আরো কয়েক ধাপ ঘৃণা বাড়াতে তাথৈকে অবশ্যই জানতে হবে সেই মুখোশধারী আসলেই তার বাবা নয়।তার বাবা একজন সৎ ভদ্রলোক ছিলেন এটা তাথৈ না জানলে অবশ্যই উনার আত্মা কষ্ট পাবে।যদিও তাথৈ সব কিছু জানার পর খুব করে ভেঙে পড়বে কিন্তু তাকে তার আসল পরিচয় তো জানতে হবে নাকি?ভাঙা তাথৈকে খুব করে সামলে নিতে পারবে ভিয়ান।

মুহূর্তেই তাথৈ এর ভেঙে পড়ার কথা মাথা চাড়া দিতেই তাচ্ছিল্য হাসলো ভিয়ান সেই সাথে চিকচিক করে উঠলো কুচকুচে কালো গভীর মনি দুটো।নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিয়ে বলে উঠলো

“আর কত ভাঙবে একটা মানুষ?ভেঙে পরা কি আদৌ বাকি আছে?যেই ক্ষত বছর দুয়েকের ব্যবধানে দগদগে হয়েছে সেটাই তো উপশম করতে ঢের সময়ের প্রয়োজন।।তবে বাকি ক্ষত সারবে কিভাবে?

আকস্মিক ফ্লাইট এনাউন্সমেন্টে চিন্তা ছেড়ে বেরিয়ে এলো ভিয়ান।খুব সুন্দর সুশ্রী কণ্ঠে এয়ার হোস্টেস এসে সকল প্রকার ডিভাইস এর নেট কানেকশন বন্ধ করার জন্য মিষ্টি হাসি সহিত অনুরোধ জানালো।কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ একে ফোনের ফ্লাইট মোড চালু করে সামনে থাকা ছোট টেবিল টায় ছুড়ে ফেলে আয়েশ করে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে চিন্তা ভাবনা মুক্ত হতে চাইলো।কিন্তু তার কি ফুসরত আছে?

“যেই মানবীকে হাজারো আঘাতে জর্জরিত করে নির্দয়ের মতো ছুটে এসেছে এখানে সে কি করছে এখন ইকবালের ওতো বড় বাড়িতে?ইকবাল কি তাকে সামলে নিতে পেরেছে নাকি মেয়েটা আবার ভেঙে পড়েছে?

********
গাড়িতে জীবন্মৃত মানুষের ন্যয় সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে আছে তাথৈ।এখন আর সে কাঁদছে না।ঝলমলে সিল্কি চুল গুলো জট পাকিয়ে রয়েছে পুরো মাথা জুড়ে।চোখের জল গুলো শুকিয়ে ইতোমধ্যে চটচটে হয়ে রয়েছে।ঠোঁট দুটো বেশ শুষ্ক।মনে হচ্ছে টান লাগলেই ফেটে র*-ক্ত ঝরবে।কিন্তু এসব এখন মোটেও গায়ে মাখছে না সে।তাথৈ মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।আজ বাসায় ফিরে নিজের জীবনের ইতি ঘটাবে সে।এই দুর্বিষহ জীবন আর মেনে নেয়া যাচ্ছে না।ভিয়ান কে মনে পুষে এরিকের কথা মতো রেইন কে বিয়ে করা মোটেও সম্ভব নয় তার পক্ষে।যেই মন একজনের জন্য বিশেষভাবে উন্মাদ হয়ে কঠিন ভালোবাসায় চূড় হয় সেই মনে অন্যকারো নাম নিয়ে ভাবনা আসাই পাপ।

হঠাৎই কঠিন ব্রেক কষলো রহমান।আকস্মিক ব্রেকের ঝাকুনিতে সিট থেকে ছিটকে সামনের সিটের সাথে বাড়ি খেলো তাথৈ।মৃদু অস্ফুট ককিয়ে উঠে চারপাশে তাকাতেই হুড়মুড় করে গাড়ির দরজা খুলে প্রবেশ করলো কালো পোশাকধারী শক্ত পোক্ত দেহের এক লোক।ইতোমধ্যে তাদের কেউ একজন রহমানের মাথায় সজোড়ে আঘাত করে দিয়েছে।স্টিয়ারিং এ উপুড় হয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে রয়েছে রহমান।তাথৈ কোনো কিছু বুঝার আগেই পোক্ত দেহের লোকটি টেনে হিচড়ে তাথৈকে গাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে এলো।লোকটির পানে তাকিয়ে বেশ ভীত হলো তাথৈ।সেই সাথে তেজী কন্ঠে শুধালো আপনারা কারা?

লোকটি তাথৈ এর প্রশ্ন বুঝলো কিনা কে জানে?কিন্তু তার হাতের সজোড় চড়ে নিজের জ্ঞান হারালো তাথৈ।মুহূর্তেই ধরণী হলো অন্ধকার, মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ছোট শীর্ন দেহের তাথৈ। অবচেতন তাথৈ মুখ থুবড়ে পরে রইলো কালো পোশাকধারী লোকটির পায়ের কাছে।

তাথৈ এর পানে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফুঁস করে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো লোকটি।এরপর পকেট হাতড়ে নিজের বাটন ফোন খানা বের করে ডায়াল করলো কাঙ্খিত নম্বর।বার দুয়েক রিং হতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ফোন তুললো ওপাশের ব্যক্তি

“কাজ হয়ে গেছে স্যার।কোথায় পাঠাতে হবে মেয়েটিকে?

লোকটির মুখের সুখবর শুনে প্রশস্ত হলো ওপাশের ব্যাক্তির পাতলা ঠোঁট জোড়া।সিগারেটে লম্বা ফুঁক দিয়ে শূন্যে ধোয়া উড়িয়ে অমায়িক হাসলো।এরপর হাতে থাকা পেপার ওয়েট টা সামনে থাকা টেম্পার্ড গ্লাসের টেবিলে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে উঠলো

“ওকে আমার গোপন বাংলো তে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।আজ রাতেই ওকে চিরতরে এই দেশ ছাড়া করবো আমি।অনেক জ্বালিয়েছে।এবার একটু শান্তিতে থাকতে চাই।

কথা গুলো বলে রাগে চোখ মুখ কুঁচকে ফোনের লাইন কেটে সুইভেল চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলো।এরপর জোরে জোরে কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো।সেই হাসি বদ্ধ কামরায় তুমুল গর্জনের ন্যয় লাগলো।

“এবার কি হবে তোর তাথৈ শেহতাজ?দেখলি তো কিভাবে তোকে পাকড়াও করলাম?একটা কাকপক্ষী ও টের পেলো না আর পাবেও না।এমনিতেই তো মরে গেছিস।এবার না হয় আরেকবার ম*-র।চিন্তা করিস না তোর মাকে ঠিক সামলে নেবো আমি।তোর সব কিছু হবে আমার ।লাক্সারিয়াস লাইফ আমার যে খুব পছন্দ।

কথা গুলো বলতে বলতে রাগে হিংস্র হয়ে উঠলো আগন্তুক।নিজের ক্রোধ সংবরন করতে না পেরে হাতে থাকা বিয়ারের ক্যান দেয়ালে ছুড়ে মারলো।অর্ধেক খাওয়া বিয়ার দেয়ালে বাড়ি খেয়ে মেঝেতে পরে ফেনা তুলে উপচে উঠলো।সেই উবলানো ফেনার পানে তাকিয়ে আগন্তুক বলে উঠলো

“কোনো ভাবে এখানে আসার চেষ্টা করলে একদম জ্যন্ত পুঁ*-তে দেবো।দুদিন ধরে বাড়ির বাইরে কাটাচ্ছি মনে হচ্ছে জাহান্নামে আছি।সব তোর জন্য হয়েছে।তোকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না।”

********
নিজের রান্না শেষ করে সারা বাড়ি তাথৈকে খুঁজে চলেছে মেহেরিন।কিন্তু তাথৈ কোথাও নেই।মেয়েকে না পেয়ে কপালে চিন্তার সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো সেই সাথে কু ডেকে উঠলো চঞ্চল মনে ।বাড়ির বাইরে বেরিয়ে রহমানের তালাশ নিতেই জানা গেলো তাথৈ তাকে নিয়ে কোথাও একটা গিয়েছে।হঠাৎই বাড়ির ল্যান্ডলাইনের টেলিফোন বেজে উঠলো।মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলো মেহেরিন।রিং কেটে যাবার আগ মুহূর্তে খপ করে ধরে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো

“আপনাদের বাড়ির ড্রাইভার গুরুতর অবস্থায় হসপিটালে ভর্তি।মাথায় কেউ তাকে আঘাত করেছে বলে মনে হচ্ছে।পুলিশি কেইস বুঝতেই পারছেন।আপনাদের যে কারো একটা সিগনেচার লাগবে তাই যদি একটু হসপিটালে আসতেন!

মহিলার সুশ্রী কথা মেহেরিনের কানে গেলো না।বাকি কথা শোনার আগেই কান থেকে খসে পড়লো টেলিফোন খানা।প্যাচানো তারের সহায়তায় ঝুলে রইলো মেঝে ছুঁই ছুঁই করে।কিন্তু সেসব তাকিয়েও দেখলো না মেহেরিন।শুধু সজল চোখে বিরবিড়িয়ে আওড়ালো

“আমার মেয়েটা তাহলে কোথায়?হসপিটাল থেকে রহমানের কথা বললো তাহলে আমার মেয়ের নাম বললো না কেনো, ,?তাথৈ আর রহমান কোথায় গিয়েছিলো তবে?আমার অসুস্থ বাচ্চাটার কি হলো?

আর দাড়ালেন না মেহেরিন।বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড চারুকে কোনো মতে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।

“একমাত্র রহমান ই বলতে পারবে তাথৈ কোথায়!”

#চলবে

#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_১৮
#সারিকা_হোসাইন

*******
সূর্যের উত্তপ্ততা ছাদ ফুঁড়ে মাথায় এসে লাগছে যেনো।চারিধারে গমগমে তপ্ত বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে।কৃষ্ণচূড়া গাছটা লাল রঙা ফুলে ছেয়ে যেনো আগুন ঝড়াচ্ছে।বর্ষাকালে এমন তপ্ত রোদের কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফিনাইলের উটকো গন্ধে চোখ মুখ কুঁচকে বসে রইলো রহমান।মেহেরিন চৌধুরীর জন্য তার অধীর অপেক্ষা।ইচ্চে করছে স্যালাইন এর সু*-ই মেডিসিন, ব্যান্ডেজ সব কিছু ছুড়ে ফেলে বাইরে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে।কিন্তু বৃদ্ধ নড়বড়ে শরীর সায় দিলো না।মাথা ভর্তি ব্যান্ডেজ নিয়ে হসপিটাল বেডের হেড বোর্ড এ বালিশে আধশোয়া হয়ে পুনরায় হসপিটালের বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় নজর বুলালো রহমান।

মিনিট পাঁচেক গড়াতেই উন্মাদের ন্যায় দৌড়ে মেডিসিন টেবিলের সাথে হোঁচট খেলো মেহেরিন।সামান্য আর্তনাদ করতেই বাইরের দৃষ্টি ফেলে অপরাধী চোখে মেহেরিনের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো রহমান।নিজেকে সামলে শক্ত কন্ঠে মেহেরিন শুধালেন

“আমার বাচ্চা কোথায় রহমান ভাই?আপনারা এতো সকাল সকাল গিয়েছিলেন ই বা কোথায়?

মেহেরিনের প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে গেল বৃদ্ধ ড্রাইভার।শুস্ক ঠোঁট জোড়া আঠালো লালা দিয়ে অল্প ভিজিয়ে বলে উঠলেন

“মামনি হঠাৎই ইকবাল এর বাসায় যাবার জন্য জেদ শুরু করে।খুব বিধস্ত লাগছিলো সেই সময় তাকে।তাই আমি কিছু না ঘাঁটিয়ে বরাবরের মতোই ওই বাসায় তাকে নিয়ে যাই।

কথা গুলো বলে কিছুটা দম নিলো রহমান।অসুস্থ শরীর এতো কথার চোট বোধ হয় কুলাতে পারছে না।মাথাটা প্রচুর ঝিম ঝিম করছে।কিন্তু মেহেরিন আরো উত্তরের আশায় দৃষ্টি কাটকাট করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন রহমানের মুখের দিকে চেয়ে।
মেহেরিনের পানে না তাকিয়েই বৃদ্ধ রহমান পুনরায় বলতে আরম্ভ করলো

“ইকবালের বাসা থেকে আমরা ফিরছিলাম আধ ঘন্টা পরেই।কিন্তু মাঝ পথে দুটো কালো গাড়ি আর একটা ট্রাক আমাদের গাড়ি আগলে দাঁড়ায়।আমি গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গাড়ি স্লো করতেই কালো পোশাকধারী চারজন লোক নেমে আসে।গলার আওয়াজ এ মনে হচ্ছিলো বয়স খুবই কম।কিন্তু তাদের চেহারা দেখতে পাইনি আমি।এলোপাতাড়ি ভাবে তারা আমাকে আঘাত করতেই আমি ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে হসপিটালে আবিস্কার করি।নার্স বা ডক্টর কেউ তাথৈ মামনির কথা বলতে পারছে না ম্যাডাম।

আর কিছু শুনতে চাইলেন না মেহেরিন।একটা নার্স ডেকে রহমানের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে হনহন করে হসপিটাল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।এই কাজ কে করেছে সেসব তার খুব ভালো করেই জানা।এজন্য তিনিও এর শেষ দেখতে চান।সাইফ আজমীর পতন না দেখে কিছুতেই এই বাড়ি ছেড়ে এক পা নড়বেন না তিনি।তবে তার আগে ওই বাস্টার্ড এরিক কে চূড়ান্ত এক শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন বলে ভেবে রেখেছেন।
নিজের হ্যান্ড পার্স থেকে দামি মোবাইল খানা বের করে দ্রুত হাতে ডায়াল করলেন সাইফ আজমীর নম্বর।একবার রিং হতেই ফোন তুললেন সাইফ আজমী।হ্যালো বলার আগেই ভয়ানক শাসানোর স্বরে মেহেরিন বলে উঠলেন

‘আমার মেয়েকে যদি ভালোয় ভালোয় ফেরত না দেয় তোমার ঐ বাস্টার্ড ছেলে তাহলে এর পরিণাম কতোটা নৃশংস হবে তোমরা বাপ ছেলে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না।তোমার সেক্রেটারি সেলিনা কিন্তু ঠিক আমার রূপ জানে।তাই নয় কি?

হঠাৎ ফোন কলে মেহেরিনের এহেন বিধ্বংসী রূপ সাইফ আজমিকে নাড়িয়ে দিলো।এরিক কি করেছে সেই প্রশ্ন শুধাবার আগেই খট করে লাইন কেটে পুলিশ স্টেশনের দিকে গাড়ি হাকালেন মেহেরিন।

********
ধবধবে সাদা সফেদ তুলতুলে বিছানায় মুখ থুবড়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তাথৈ ।এই পৃথিবী সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই।তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কেও সে কিচ্ছুটি জানেনা।সে কোথায় আছে,কোথায় যাচ্চে বা কে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এসব কিছুও তার অজানা।সে শুধু জানে ঘুম ফুরালেই নরক তুল্য দিন বা রাতের সূচনা হবে তার জীবনে।ভিয়ান ছাড়া প্রতিটা ক্ষন তার কাছে জাহান্নাম।

বিশাল আকাশ চিড়ে উড়ে চলেছে ফ্লাইং প্রাইভেট জেট।গন্তব্য তার সুদূর অস্ট্রেলিয়া।একটা সামান্য কঙ্কাল সার দেশি মেয়ের মধ্যে কি এমন আছে যার জন্য এখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যেতে হবে তার সমীকরণ কিছুতেই মেলাতে পারছে না জেট ক্যাপ্টেন উইলিয়াম।অবশ্য এসব জেনে বুঝেও তার লাভ নেই।টাকা ওয়ালা বাবার বখে যাওয়া সন্তানদের ইচ্ছে গুলো একটু বেশি ই পশ।তারা তাদের মনের খেয়াল খুশি অনুযায়ী চলে ।টাকা বা মানুষ কোনোটাকেই তারা সেভাবে মূল্যায়ন করে না।আর সুন্দরী মেয়ে মানুষ তো তাদের মনোরঞ্জনের খোরাক মাত্র।আজ এই মেয়ে তো কাল রাতে সেই মেয়ে।এসব দেখতে দেখতে অবশ্য সে এই দু বছর অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।একজন ক্যাপ্টেন হয়েই যদি উইলিয়াম এতো এতো নোংরামির সাক্ষী হয় তবে যিনি তার প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে তার কি খবর?

মাস শেষে উইলিয়াম এর একাউন্ট এ ঢুকে মোটা একটা এমাউন্ট।এতেই সে বেশ হ্যাপি।তার মালিক কোথায় কি করছে এসবে তার কি আসে যায়?কিন্তু না চাইতেও বিদেশি উইলিয়াম এর অদ্ভুত রকমের এক মায়া কাজ করছে বাংলাদেশি মেয়েটার প্রতি।এই প্রথম উইলিয়াম এর মন বার বার বলে উঠছে মেয়েটার উপর দুস্টু দৈত্য টার ভয়ানক থাবাযুক্ত হাতটা না লাগুক।ঈশ্বর যেকোনো উপায়ে তাকে বাঁচিয়ে নিক।অনেক মেয়ের লাইফ তো হেল হলো এবার নাহয় এসব কিছুর সমাপ্তি ঘটুক।নিজের মনের এমন উদ্ভট কল্পনায় বেশ করে নিজের উপরই অবাক হলো উইলিয়াম।শেষমেশ মনের এসব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে ককপিটে ব্যস্ত হবার প্রয়াস চালালো।

ঘন্টা দুই গড়াতেই একজন লেডি সার্ভেন্ট কে দিয়ে কিছু খাবার পাঠানোর ব্যাবস্থা করলো উইলিয়াম।পূর্ব থেকেই তাকে শিডিউল বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।রোবোটিক ম্যানের মতো তাকে বিনা দ্বিধায় সেই কাজ গুলো কমপ্লিট করতে হবে।সামান্য হেরফের হলেই হার্ড পানিশমেন্ট।যেচে পরে শাস্তি কামাই করতে চায়না সে।আর মেয়েটার প্রতি অজানা দরদ কেনো কাজ করছে বার বার তার ও ব্যাখ্যা নেই।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুম ছুটলো তাথৈ এর।সারা শরীরে অসহনীয় ব্যথা।মনে হচ্ছে কেউ তাকে বেঁধে রেখেছে।মাথাটা ভো ভো শব্দে ঘুরে চলেছে।পিটপিট চোখে চারপাশে নজর বুলাতেই বিছানা ছেড়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে।সকালের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।মুঠো পাকানো হাত টা চোখের সামনে মেলে ধরতেই লম্বা চকচকে কালারিং চুলটা হৃদয় মুষড়ে দিলো।কেন জানি চুলটাকে ফেলে দিতে ইচ্ছে হলো না তার।অজানা মায়া আর ভালোবাসা দুই ই ঘিরে ধরলো তাকে।পুনরায় হাতের মুঠোয় সেই চুলটাকে বন্দি করে দ্বিতীয়বার কক্ষের চারপাশে নজর বুলালো।ঝকঝকে পাঁচ তারকা হোটেলের কক্ষের মতো বিশাল একটি গুছানো রুম।সে যে কিডন্যাপ হয়েছে এটা ভালোই বুঝেছে সে।

“কিন্তু কে করেছে এই কাজ?বাবা নাকি ভাইয়া?আর আমাকে কিডন্যাপ করেই বা কি লাভ?

নিজের বাপ ভাই এর এহেন নোংরামি আর পূর্বকৃত আচরণ মনে পড়তেই দুচোখ ফেটে জল আসতে চাইলো তার।কিন্তু কঠিন ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলো।
সেতো এমনিতেই আজ মরে যেতো, এতো এতো যন্ত্রনা নিয়ে বাঁচা যায় নাকি?মৃত্যু তো সকল অবস্থাতেই কষ্টকর।হোক সেটা স্বেচ্ছায় বা প্রাকৃতিক।কিন্তু অসহায় মেহেরিন এর কথা ভেবে দম বন্ধ হয়ে এলো তাথৈ এর।

“আমাকে নিশ্চয় পাগলের মতো খুঁজে চলেছ তাই না আম্মু?তোমার হাতের খিচুড়ি আর গরুর মাংস টা আর খাওয়া হলো না।কিন্তু একটা জিনিস ভালোই হয়েছে।ভিয়ানের কাছে যাবার পথ সুগম হয়েছে।কিন্তু পৃথিবী ছাড়ার আগে তোমার মুখটা দেখা হলো না।তোমাকে খুব মিস করবো আম্মু।বাবা আর ভাইয়া আমাকে খুব কষ্ট দিয়ে মারবে তাই না?যেভাবে ভিয়ান কে মেরেছে!

আপন মনে নানাবিধ ভাবনা ভাবতেই শর্ট স্কার্ট আর কোট পরিহিত এক সুন্দরী মেয়ের আগমন হলো তার কক্ষে।টকটকে লিপস্টিকে জড়ানো ঠোঁট দুটো অমায়িক হেসে উঠলো তাকে দেখে।ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে ইংরেজি ভাষায় বলে উঠলো

“ডিড ইউ স্লিপ ওয়েল ম্যাম?

মেয়েটির প্রশ্নে তাচ্ছিল্য হাসলো তাথৈ।এরপর আহত স্বরে চিকচিকে সজল চোখে শুধালো

“হ্যাভ আই বিন ব্রট হেয়ার টু স্লিপ?

তাথৈ এর পাল্টা খোঁচানো প্রশ্নে মেয়েটি আর কোন উত্তর জানালো না।শুধু অল্প হেসে ফুড ট্রলি তে থাকা খাবার গুলো টেবিলে সার্ভ করে মিহী কন্ঠে বলে উঠলো

“এনজয় দ্যা ফুড”

মেয়েটি চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই তাথৈ পুনরায় শুধালো

“হুয়ার আর ইউ টেকিং মি?

মেয়েটি মাথা নিচু করে উত্তর করলো

“অস্ট্রেলিয়া, রেইন প্যালেস।

আর কিছু শুধানোর প্রয়োজন মনে করলো না তাথৈ।সব কিছু আয়নার মতো ঝকঝকে হয়ে গেলো তার কাছে মুহূর্তেই।শেষপর্যন্ত এরিক আর সাইফ আজমী নিজেদের চূড়ান্ত জঘন্য রূপ দেখিয়েই দিলো তাকে।এভাবে সরিয়ে দিলো?কিন্তু কেনো?

*********
পেরিয়ে গিয়েছে দুটো দিন।পুলিশ সকল জায়গায় খবর নিয়ে কিচ্ছুটির হদিস পায়নি।কোনোরূপ প্রমান ব্যতীত এরিক কে এরেস্ট করাও সম্ভব নয়।বিধস্ত মেহেরিন ক্লান্ত চোখে সাইফ আজমীর পানে তাকিয়ে শ্লেষত্বক স্বরে বলে উঠলো

“ভাইয়ের মেয়ে হয় তোমার সে।আপন রক্ত।কিভাবে করলে এই কাজ?একটুও বুক কাপলো না?রক্তের চাইতেও টাকা -পয়সা ধন,সম্পদ বড়?মেয়ের মতো আদর যত্ন করেও তো সব আদায় করতে পারতে।সব কিছু কেড়ে নিয়ে মেয়েটাকেও কেড়ে নিলে?

মেহেরিনকে শান্তনা দেবার ভাষা বহু আগেই হারিয়েছে সাইফ আজমী।কিন্তু তাথৈ এর কিডন্যাপ হবার ব্যাপারে সে কিছুই জানেনা।এরিকের সাথে তার এসব বিষয়ে কোনো কথাও হয়নি।কিন্তু এসব মেহেরিন বিশ্বাস করবে না এটা সাইফ আজমী খুব ভালো করেই জানেন।যেখানে তার পুরোটাই মিথ্যে আর হিংস্রতা দিয়ে ঢাকা সেখানে এসব কথা মেহেরিনের কাছে অমূলক ঠেকাই স্বাভাবিক।তাই নিজ বাড়িতে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন সাইফ আজমী।তাকে না জানিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত কেনো এরিক নিয়েছে এটার জবাব অবশ্যই চাইবে সে।

ইতোমধ্যে তাথৈ এর নিখোঁজ হবার খবর ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।অর্কের কাছে এই খবর শোনা মাত্র নিজের বাড়ি থেকে খালি পায়ে হেটেই উদ্ভ্রান্তের ন্যয় দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে মৌটুসী।যেই মেয়েটিকে ছোট দুগ্ধ পোষ্য শিশুর ন্যায় দুটো বছর ধরে আশার আলো দেখিয়ে এতোটা দূর নিয়ে এসেছে তারা দুই ফ্রেন্ড মিলে সেখানে কিছুতেই সে হারাতে পারে না।
নিজের খেয়ালে হারিয়ে ট্যাক্সি বা রিক্সা ভাড়া করতেও ভুলে গিয়েছি মৌটুসী।বন্ধু হয়ে বন্ধুর এহেন নিষ্ঠুর পরিণতি সহ্য করা যায় নাকি?
এদিকে নিজের কাজে বাইকে করে বাইরে বেরিয়েছে ইকবাল।এ দুদিন ঠান্ডা জ্বরে দুনিয়ার আলো বাতাস দেখা হয়নি।পেন্ডিং কাজ গুলোও সহযোগী দের দিয়ে করানো হয়েছে।কাজের দৌড় কতটুকু নিজ চোখে একবার দেখা চাই।নিজের কাজ নিজে করতেই বেশি পছন্দ করে ইকবাল।অন্যকে দিয়ে করানো কাজের মধ্যে কোন আনন্দ নেই।যদি হয় সেটা মানুষ জ*-বা*-ই তাহলে তো আরো কথা নেই।

চলতে চলতে হঠাৎ মৌটুসী কে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে ইকবালের।বাইক এর গতি ধীর করে ভালো করে বুঝার চেষ্টা করে সে ঠিক দেখছে নাকি ভুল?
মাথা থেকে হেলমেট খুলতেই আলুথালু মৌটুসী নজর কাড়লো।পছন্দের মানুষের এমন বেহাল দশা হৃদয় কাঁপিয়ে তুললো ইকবালের।বাইক স্ট্যান্ডের উপর দাঁড় করিয়ে দৌড়ে মৌটুসীর সামনে এসে দাঁড়ালো ইকবাল।ইকবাল কে দেখে সামান্য দাঁড়ালো মৌটুসী।হাঁপানোর কারনে ভালো করে শ্বাস টাও টানতে পারছে না সে।আহত স্বরে ইকবাল শুধালো

“এমন বিধ্বস্ত লাগছে কেনো তোমাকে মৌ?কিছু হয়েছে?

ইকবালের আদুরে স্বরে বুক ভেঙে কান্না পেলো মৌটুসীর।নিজেকে কোনো মতে নিয়ন্ত্রণ করে কাঁপা মোটা ভাঙা কন্ঠে বলে উঠলো

“তাথৈকে দুদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না ইকবাল ভাই।রহমান চাচাকে আহত করে কেউ ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।মেহেরিন আন্টি থানায় কেস ফাইল করেছেন।কিন্তু দুদিনেও ফলাফল শূন্যের খাতায়।

তাথৈ নিখোঁজ হয়েছে কথাটা ইকবালের মাথায় বজ্রপাতের ন্যায় ঠেকলো।মৌটুসী কে কিছু বুঝতে না দিয়ে ফট করে বলে উঠলো

“এভাবে হেটে যেতে অনেক সময় লেগে যাবে তোমার।আমার সাথে এসো।এক্ষুনি নামিয়ে দিচ্ছি।

কোনো প্রকার ফর্মালিটি না দেখিয়ে বাধ্য বাচ্চার ন্যয় ইকবাল কে অনুসরণ করে বাইকে উঠে বসলো মৌটুসী।দুজনেরই গন্তব্য সাইফ আজমীর চৌধুরী নিবাস।

********
বিশাল এক ক্যাফেটেরিয়ার পুরোটাই নান্দনিক লাইটস আর তাজা ফুলে সাজানো হয়েছে।আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় হওয়ায় নিউইয়র্ক এ ভরপুর সামার চলছে।থেকে থেকেই দখিনা হাওয়া এসে ফুলের সুবাস গুলো চারিধারে ছড়িয়ে দিচ্ছে।ভিয়ানের কিং এন্ড কুইন ক্যাফেটেরিয়া টি নিউইয়র্ক শহরের প্রত্যেকটা মানুষের নখদর্পণে।খাবার এবং পরিবেশ দুই ই যে কারোর মন কাড়তে যথেষ্ট।সেই কিং এন্ড কুইন ক্যাফেটেরিয়া তেই ভিয়ান তার নতুন বিদেশি ক্লায়েন্ট কে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং যত আয়োজন সব তাকে ঘিরেই।ব্যস্ত ভিয়ান নিজের সমস্ত কাজ ফেলে সজকের দিনটি সেই অতিথির জন্য বরাদ্দ করেছে।রেখেছে নিজের দরকারি ফোনটাও সাইলেন্ট মোডে।নিজের আতিথেয়তায় এক বিন্দু কমতি রাখতে নারাজ সে।

“ওদিকটার কি খবর অভীক?সব কিছু গুছানো আছে তো নাকি?

সেক্রেটারি অভীক মুখে প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে বুক ফুলিয়ে বলে উঠলো
“আপনি কোন চিন্তা করবেন না স্যার।সব কিছু ঠিক ঠাক।সে নিজেই আপনার সাথে ডিল করার জন্য হাত বাড়াবে।বিশ্বাস না হলে নিজ চোখে দেখে নিবেন।

অভীকের কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলো ভিয়ান।আজ পর্যন্ত কারো কাছে নত হয়নি সে।এমনকি বিজনেস ডিলিং এও বড় বড় কোম্পানি তার কাছে এসেছে।এই ধারাটাই আজিবন ধরে রাখতে চায় সে।নিজের জৌলুস দেখিয়ে বরাবর টপে থাকাই তার ধাঁচ।ওয়ার্ল্ড এর প্রত্যেকটা কোনায় তার নাম রোশনাই করতে চায় সে।এজন্য অবশ্য কম পরিশ্রম করতে হয়নি তাকে।তাহলে মিষ্টি ফল উপভোগ করতে ক্ষতি কোথায়?

সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে উপস্থিত হলো কাংখিত অথিতি।ভিয়ানের পাঠানো দামি রোলস রয়েস গাড়ি থেকে অধিক সম্মানের সাথে নামানো হলো তাকে।ভিয়ানের আতিথেয়তায় খুশি হয়ে প্রশস্ত হাসলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি গড়নের সুদর্শন পুরুষটি।অমায়িক হেসে ভিয়ানের পানে পেশীবহুল ফর্সা হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো

“হেই ডিস ইজ আয়াজ আমির,নাইস মিটিং ইউ”

যুবকের হাতের পানে তাকিয়ে কিছুটা ভ্রু কুচকালো ভিয়ান।পুরো হাতটা নখের আঁচড় আর ছোট ছোট দাঁতের কামড়ের দাগ।কিছু জায়গায় ওয়ান টাইম ব্যান্ডেড এইড ও দেখা যাচ্ছে।অদ্ভুত এই যুবকের অদ্ভুত হাত টা শকুনি নজরে পরখ করে সামান্য হ্যান্ডশেক করে ভিয়ান অল্প হাসলো

“সেইম টু ইউ”

#চলবে