বড়োজা
Nadia_Afrin
৭
খালার সঙ্গে ঝামেলা হয়ে বাড়ি তো ছেড়েছি।এবার যাব কোথায়?
খালা যা ক্ষেপেছে তাতে আর এক ঘন্টাও আমায় থাকতে দেবেনা।
আমার জন্য জরিমানা হয়েছে এনার।পারলে এবার আমায় খু*ন করেন তিনি।
বাড়িতে আর দশটা মিনিটও টিকতে দেবেন না।
চিন্তায় হাত-পা অবশ লাগছে আমার।
এর মাঝে ছেলে দৌড়ে এলো কাছে।
হাত ধরে বলল,”আম্মু বাড়িতে কী মা*রা*মা*রি হয়েছে?
এতো মানুষ কেন?
আমাদের কী পুলিশ ধরবে?
চলো ঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি,তাহলে আর পুলিশ ধরবেনা।”
“কিছু হয় নি বাবা।পুলিশ কেন ধরবে?
আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি।
আমরা আজ এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব আবার।
নতুন বাড়ি যাব।”
ছেলে আমার মহাখুশি।
খালার আচরণে বাচ্চাটাও বিরক্ত ছিল ভীষণ।
বলল,”ভালো হবে।
চলো চলে যাই।উনি শুধু আমার খাবার লুকিয়ে খেয়ে নেয় আবার আমাকে দিতেও চায়না।ঝাল ঝাল ভাত দেয়।মাছ দেয়না।চিকেনের মাংস দেয়না।হাড় খেয়ে আমাদের দেয়।ওগুলো কী আমি খেতে পারি বলো?আমি তো একটা বাচ্চা।
আমরা আমাদের বাড়ি যাই চলো।
বাবার রাগ কমে গেছে মনে হয়।আমাদের খুঁজে না পেলে বাবা কষ্ট পাবে।
চলো বাড়ি যাই।
আমরা আবার নরম নরম বিছানায় গরম গরম খাবার খাব।”
আসলে ছেলেকে মাঝেমধ্যে বিছানায় খাওয়াতাম।
ছোট বাচ্চা তো!
ছেলেটাকে বোঝাতেই পারছি না ঐ বাড়ি আর আমাদের নেই।ওর বাবার সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।আমরা চাইলেই ওখানে যেতে পারব না।
আমার করুণ অবস্থা।নত মুখে সকলের মাঝে দাড়িয়ে আছি।
লোকগুলো চলে গেছে।মহিলারা সব আছে এখনো।
খালার অতীতের দোষগুণ দিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত তারা।
সবজি যে কেটে দিত সেই মহিলা যার নাম লতা।ডাকি আপা বলে।সে এগিয়ে এলো।
বলল,”কী ভাবলে?কোথায় যাবে?
স্বামীর বাড়িতে তো ঠাই নেই।
বাচ্চা দুটো নিয়ে এবার কোথায় যাবে?
গাছ তলায় তো থাকতে পারবে না।”
আমার বড্ড অসহায় লাগল।মাথায় কিচ্ছু আসছিল না।হতাশ হয়ে পড়ি।
সকলের সম্মুখেই কেঁদে ফেললাম শব্দ করে।
উৎসুক সকলের দৃষ্টি এবার আমার নিকট।আমায় নিয়েই ফিসফিস করছে তারা।
ভালো কথাই বলছে অবশ্য।আমার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করছে।
মহিলা আবারো বলল,”কান্না বন্ধ করো।কান্না করলেও কেউ তোমায় দয়া করবেনা।
নিজের স্বামীই যখন চোখের জলে গলেনি,অন্যের আশা করোনা।
তোমার জীবন অনেক কঠিন।নিজেকে সব পরিস্থিতির জন্য শক্ত রাখতে হবে।
কান্না করে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করোনা অন্যের সামনে।
হাসির খোড়াক হবে এতে।
আমার কথা শোনো,এক বস্তি আছে।চাইলে থাকতে পারো।ধনীদের ভাষ্যমতে ওটা বস্তি।কিন্তু আমাদের কাছে স্বপ্নের নীড়।
ওখানে আমিও থাকি।আমাদের মতো অসহায়ের জন্যই ঐ স্থান। যানজট ছাড়া একটি জায়গা।
মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হবে,তবে শান্তি পাবে।সুখে-দুঃখে সবাইকে পাশে পাবে।
ওখানে হিংসা নেই,অহংকার নেই।নেই কারো ধন-দৌলদ।
সবাই এক।মিলেমিশে গড়াগড়ি করে থেকে যাই।
তুমি গেলে বলো,সব ব্যবস্থা করে দেব আমি।”
আমি চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে তাকালাম।
ওখানে আরো কজন বস্তির মহিলা ছিল।
তারাও সঙ্গ দিল আমার।
হাতে হাতে ধরাধরি করে ঘরের সব জিনিস ও আমার মেয়েকে নিয়ে বের হলাম।
পায়ে হাঁটা পথ।
খুব বেশি দূরে নয়।যেতে যেতে কথা হলো সকলের সঙ্গে।সেখানের পরিবেশ,চালচলন,জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানলাম।
বড়ো বড়ো ইমারত নেই সেখানে।বড়ো পেশার মানুষও নেই।দিন-রাত খেটে খাওয়া মানুষ আছে।রক্ত ঘাম করা পরিশ্রমী আছে।
কারো স্বামী রিক্সা চালক,কেউ বা মিস্ত্রি।কেউ কেউ আবার হোটেলে কাজ-বাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করে।
জরিমানা নেওয়া সেই লোকগুলোও ঐ বস্তিরই।
অবশেষে পৌঁছালাম বস্তিতে।।
নিচু একটা এলাকা বলতে পারেন।
চারপাশ ঘিরে অনেক ভাঙা বাড়ি।
প্লাষ্টিক কাগজ,জং ধরা টিনের অসংখ্য বেড়া সেখানে।
বাড়ি বলাও যাবেনা।শুধু ঘর।ছোট্ট ছোট্ট ঘর।
মাঝখানে একটা মাঠ মতো।
ওখানে ছোট বাচ্চারা খেলছে।একপাশে বড়োরা গল্প করছে।
দুজন মহিলা দেখলাম চালের গুড়ো শুকাচ্ছে।
ঢালান মতো রাস্তা পার হয়ে নিচে নামলাম।
সেই লোকগুলোকেও দেখলাম কিসের যেন ফর্দ করছে।
তারা আমার নিকট এগিয়ে এসে বলল,”এখানে আসলে?
ভালো করলে।আমাদের বোন হয়ে থাকবে।
তোমার কোনো দুঃখ নেই।
আমরা সবাই তোমার আপন।”
মনে মনে ভরসা ও সাহস পেলাম।
আমি পারব।
পারব জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে।
আমায় দেখা মাত্র ভিড় জমতে শুরু হলো।
দল বেধে নারী-পুরুষ ও বাচ্চারা এগিয়ে আসছে।
এক মহিলা চেচিয়ে বলল,”কুটুম এনেছি।
আজ থেকে ও আমাদের সঙ্গে থাকবে।”
সবাইকে দেখলাম খুশি।
এরা এতো সহজে মানুষকে আপন করে নিতে পারে।
নতুন মানুষ,সবাই ই একটু বেশিই নজর দিচ্ছে।
লতাকে আপা বলে ডেকেছি আমি।
লতা আপা সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল,”এই মেয়েটার ঘর নেই।
স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে।মা-বাপ নেই।
আপন বলতে দুটো বাচ্চা শুধু আছে।
আমি যেখানে সবজি কাটি ও বাড়ির গিন্নিটাকে তো চেনই।
এক নাম্বারের শয়তান।
ওর বাড়িতে মেয়েটা ভাড়ায় ছিল।
চরম জুলুম করে আজ তাড়িয়ে দিয়েছে।
তাই নিয়ে এলাম।
ওকে একটু জায়গা দাও সবাই।বেচারা অভাগি।
বাচ্চাদুটোকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
আমরা একটু মায়া না করলে হয়ত কখন দেখব ছেলে-মেয়ে নিয়ে রাস্তায় ম*রে প*ড়ে আছে।”
পুরো গল্পটি নাদিয়া আফরিন পেইজে দেওয়া আছে।ফলো দিয়ে পড়েনিন।
নাহলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
এছাড়াও আমার লেখা সব গল্প পাবেন আমার পেইজে।
ওখানকার সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমার সঙ্গ দিল।
আমি তখন মাথা নিচু করে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছি।মেয়েটা কোলে।ছেলে ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে চারপাশ দেখছে শুধু।
এক ছোট ছেলে এসে আমার ছেলের হাত ধরে বলল,”তোমরা এখানে থাকবে?
আমরা এক সঙ্গে খেলব।”
একজন মধ্য বয়সি মহিলা বলল,”তুমি মা কোনো চিন্তা করবেনা।
আমরাই আজ থেকে তোমার পরিবার।
হইহই করে রাখব তোমায়।”
আমার মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করল অনেকে।
চুমু খাচ্ছে,নাম জিজ্ঞেস করছে।
কতো কদর করছে।
নিম্নবিত্তের এই মানুষদের আচরণে আমি মুগ্ধ হচ্ছি।সত্যি বলতে জন্মের পর আমার ছেলে-মেয়ে তার পরিবারের কাছ থেকেও এতো আদর পায়নি।সবাই শুধু অবহেলায় করে গেছে বাচ্চা দুটোকে।
এরা অচেনা -অজানা মানুষগুলো কী সুন্দর আপন করে নিয়েছে।
আমি সকলকে উদ্দেশ্য করে বলি,”আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
আমার এই বিপদে আমার পাশে কেউ ছিল না।যাদের আমি একসময় সাহায্য করেছিলাম তারাও আমার দিকে ফিরে তাকায় নি।
অথচ আপনারা যারা আমার চেনা না জানা না,তারা আমায় আপন করে নিলেন।
আমি সর্বক্ষণ আপনাদের জন্য দোয়া করব ও মনে রাখব।”
তারা সন্তুষ্ট হলো আমার কথায়।
আমায় নিয়ে একটা ছোট্ট দোকানের ব্রেঞ্চে বসায়।
পানি খেতে দেয়।
গ্লাস হাতে নিয়ে দেখি পানির মাঝে হলুদ নোংরা ভাসছে।
সম্ভবত ছেকে পানি পান করেনা এরা।
আমি খুব সামান্য একটু পানি খেলাম সৌজন্যের খাতিরে।
এবার আমার থাকার ঘরের পালা।
এখানে যারা আছেন সবারই একটা দুটো করে ঘর।
যা তাদের নিজেদের লাগে।
আলাদা করে গেস্টরুম বা এক্সটা ঘর থাকেনা।
থাকবেই না কী করে!
দিন এনে দিন খায়।ওতো আধুনিকতা নেই।
দু-বেলা খেতে পেলেই খুশি।নেই কোনো বিশেষ চাহিদা।
এদিকে মেয়েটা আমার কাঁদছে খাওয়ার জন্য।
একবার থামিয়েছি বুকে নিয়ে হেলেদুলে।
এবার আর থামছে না কান্না।
বিপাকে পরলাম।
এতো মানুষের ভিড়ে খাওয়াই কীভাবে?
কাউকে বলতেও পারছিনা।
লতা আপা বুঝতে পারে বিষয়টি।সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে,”মেয়েটাকে নিয়ে তো এলাম।
এবার থাকতে দেই কোথায়?
দুধের বাচ্চা নিয়ে কতোক্ষণ আর বসে থাকবে?”
সবাই নিজেদের মাঝে কথা বলতে লাগল।
তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে আমার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করার।
কিন্তু পারছেনা।
নিজেকে কেমন যেন অবিবেচক মনে হলো।
আমার জন্য এতো গুলো মানুষ চিন্তায় পড়ে গেছে।
চুপচাপ বসে রইলাম আমি।
এক বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এলো আমার নিকট।
মাথায় হাত দিয়ে বলল,”তুমি আমার ঘরে থাকবা মা।
আমার দুইটা ঘর।একটায় আমি আর আমার অসুস্থ নাতি থাকি।অন্যটা খালি থাকে।তুমি ঐটায় থাকবা।
আমি তোমায় যত্নে রাখব।কোনো অসুবিধা হবেনা।
তুমি চলো আমার সঙ্গে।”
আমি খুশি মনে বলি,”অবশ্যই যাব চাচি।আপনি আমায় আশ্রয় দিতে চেয়েছেন এর জন্য কৃতজ্ঞ আমি।
তবে ঘর ভাড়াটা যদি একবার বলতেন!”
আমার কথায় উপস্থিত সকলে সহ সেই চাচিও হাসছে।
আমি বোকা বনে গেলাম।
হলো টা কী?
চাচি বলল,”এসব ভাড়া টাড়া বুঝিনা।এখানে এসব নেই ও।
তুমি আমার ঘরে এমনিতেই থাকবা।
আমায় শুধু মাথায় তেল দিয়া দিবা মাঝে মাঝে।
এটাই তোমার ভাড়া।”
সত্যি বলতে এদের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম বারবার।
কত্তো সহজে আমায় মেনে নিল।
এনাদের অর্থবিত্ত নেই।তবে শান্তি আছে জীবনে।
আমি ছেলে,মেয়ে নিয়ে চাচির বাড়ি গেলাম।
উনার নাতিটাকে দেখলাম উঠোনের রোদে বসে আছে।
যা বুঝলাম,মেয়েটা প্রতিবন্ধি।
ঘরের দরজা খুলে দিল সে।
বেশ পরিষ্কার ঘরটি।একটা চকি আর আলনাও আছে।
ছোট্ট একটা ঘর।লাইট ফ্যান ও আছে।
ঘরটা দেখেই আমার তৃপ্তি হলো।মানুষ বয়স্ক হলেও পরিষ্কার বেশ।
চকিতে একটা পুরোনো কাথা বিছিয়ে রাখা।
সেখানে আমার জিনিসপত্র রেখে গেল সকলে।
চাচি বলল,”তুমি মা তোমার মন মতো করে গুছিয়ে নাও।
আমার ঘরে তেমন জিনিস নেই।গরীব মানুষ কিনা!
তবে এ চকি,আলনা ব্যবহার করতে চাইলে করো।
পড়েই থাকে এগুলো।কেউ ব্যবহার করলে যত্নে থাকবে।”
“এটা আমার কাছে অনেক বড়ো পাওয়া চাচি।কজন মানুষ নিজের ঘর ছেড়ে দেয় অন্যকে থাকতে!
আপনি অনেক বড়ো মনের মানুষ।”
“হয়েছে মা থাক।
আর বলতে হবে না।চলো তোমার বিছানা পত্র বিছিয়ে দেই।মেয়েটা খাবে।খাইয়ে শান্ত করো।
মুখগুলো শুকনো লাগছে তোমাদের।
খাওনি মনে হয়।
দাড়াও আমার ঘর থেকে ভাত এনে দেই।”
তিনি একটি থালাতে করে ভাত আনে।সঙ্গে দু-পিছ মাছ ভাজা।
আমার ছেলের হাতে খাবার দেয়।জগে করে পানি এনে দেয়।হাত ধুইয়ে কাঁটা বেছে দেয়।
ছেলে তৃপ্তি করে খাবার খায়।
আমি ততক্ষণে বিছানা বিছিয়ে নিয়েছে।
আলনায় কাপড় ভাঝ করেছি।
চাচি আমায় খেতে বলে ঘরে যায়।
পাশের ঘর থেকে একটা মাঝারি টিনের বাক্স এনে দেয়।
জং ধরা,পাতলা একদম।
“এই বাক্সটা ঘরে রেখে পরিষ্কার করে মুছে কাপড় রেখে দাও।
আমার রাখার মতো কিছু নেই।ঘরের এক কোণে ফেলে রেখেছিলাম।তোমার তো অনেক কাপড়।
সব রেখে দাও।তালা দিয়ে রাখবে।
কিছু দুষ্টু বাচ্চা আছে,ঘরে ঢুকে খোজাখুজি করে।
বোঝই তো,বস্তি এটা।তাই ওতো ভদ্রতা নেই।”
আমি বাক্স নিয়ে খুশি মনে তাকে কিছু টাকা সাধলাম।
সে নেয় না।আমায় উপকার করতে পেরেই নাকি তিনি খুশি।
মেয়েকে আগে শান্ত করে ঘর গুছিয়েছি।
কাথা কম্বল সহ বেশ কিছু জামা ও টাকাগুলো বাক্সে রেখেছি।
তালা চাচি লাগিয়ে দিয়ে চাবি আমায় দিয়েছে।
এরপর খেয়েছি আমি।
আসার পর খালার বিষয়ে অনেক কথাই শুনেছি আমি।
এখানকার অনেকেই খালার কাছে কাজ করেছে।
কাজ শেষে পারিশ্রমিক ঠিক মতো দিতেন না তিনি।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিতেন,তাও পয়সা করে।
সামান্য টাকা নিয়েও ঐ মহিলা কিপটামি করতেন।
লোককে বিনা পয়সায় খাটাতে পছন্দ করতেন।
খালার এক মেয়ে আছে।মেয়েটার সঙ্গে নাকি খালার সম্পর্ক একদমই ভালো নয়।
কারণ খালা তার মেয়ের জামাইকে ভীষণ অযত্ন করতেন।
বছর বাদে বেড়াতে এলেও খেতে দিতেন না ঠিক মতো।কোনো বেলা ভাত-ভর্তা,কোনো বেলায় বা ডাল।
জামাই মাছ-মাংস কিনে আনলে রান্না করে দিতেন।
মানে নিজে খাবে কিন্তু অন্যকে খাওয়াবে না।জামাই পরের ছেলে তাই তাকেও খাওয়াতে চাইতেন না তিনি।
এসব কথা এক মহিলা বলেছেন আমায়।তিনি খালার বাড়িয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন।তাই এসবের সাক্ষিও আছেন।
সব গুছিয়ে হাত-মুখ ধুই আমি।
একটু পরেই কজন মহিলা এসে আমায় নিয়ে যায়।আজ এই পাড়াতে অনুষ্ঠান।
মাংস খিচুড়ি রান্না হবে।খালার টাকা দিয়ে সবাই আমোদ করবে।
রান্নার বাজার শেষ ইতিমধ্যেই।
মহিলারা দেখলাম পেয়াজ-রসুন কাঁটছে বাটছে।
এখানকার সবাই মিলেমিশে থাকে।
আমায় বলল চাল ধুয়ে দিতে।
মেয়েকে একজনের কোলে দিয়ে চাল ধুয়ে দিলাম।
দুজনে মসলা দিয়ে চাল মাখলো।
অনেক রান্না হবে আজ।বস্তির সকলে খাবে।
পানি দিতে গেলে দেখি টিউবওয়েল থেকে পানি এনেছে।পানির মাঝে হলুদ বর্ণের আয়রন ঘুরছে।
আমি নিষেধ করি দিতে।
বলি,”এই পানি সরাসরি খাবারে দেবেন না।দেখুন ভেতরে কতো নোংরা।
বাচ্চারা এই খাবার খেলে অসুস্থ হতে পারে।
পানিটা বিশুদ্ধ করে নিন।”
লতা আপা বলে,”কীভাবে করব?
আমাদের কাছে মেশিনপত্র নেই।”
আমি বুদ্ধি খাটিয়ে একটা বড়ো ধোয়া ওরনা আনতে বলি।
তারপর সেই ওরনার চারপাশে চারজনকে ধরতে বলি।
কিছু বালি ভিজিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে ওরনার ওপর রাখি।
কিছু ইটের টুকরোও ধুয়ে বালির ওপর দেই।
ওপরে আবার বালি-ইট দেই।
এরপর পানির বালতি উঠিয়ে ধীরে ধীরে পানি ফেলে ছেঁকে নেই।
এতে করে দলা বাধা নোংরা গুলো ইট-বালিতে আটকে যায়।
সবাইকে দেখাই।
তারা খুশি হয়।
আমার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে।
ছাঁকা পানি আবার ফুটিয়ে নিয়ে খিচুড়িতে দিতে বলি।
এতে করে পানি রোগমুক্ত ও হয়,আবার চালটাও ফোটে তাড়াতাড়ি।
রান্না শেষে সবাই যে যার বাড়ি থেকে থালা এনে খাবার নেয়।
আমার আর ছেলের থালা চাচি এনে দেয়।
মাটিতে গোল হয়ে বসে সবাই।
বাচ্চারা একপাশে বসে।আমার ছেলেও বসে তাদের সঙ্গে।
খিচুড়ি বেড়ে দেয় প্লেটে।
সকলে তৃপ্তি নিয়ে খায়।
আমি চাচির পাশে বসে খাই।মনে বড্ড শান্তি অনুভব হয়।
আমি আর একা নই।আমার সঙ্গে পুরো একটি বস্তির মানুষ আছে।
পেট ভরে খেয়েছি আমি।এতো স্বাধ।যেন অমৃত।
খাওয়া শেষে একলোক এসে একহাড়ি ভর্তি খিচুড়ি আমায় দেয়।বলে,”তোমার জন্যই খেতে পারলাম।
তুমি যদি প্রতিবাদ না করতে আমরা সুযোগ পেতাম না।
তাই এই খাবারগুলো তোমার।রাতে ছেলে আর চাচিকে নিয়ে খেও।”
আমরা খাবার নিয়ে ঘরে ফিরি।
আজ খুব সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে আমার। আগুনে জ্বলতে থাকা মনটা যেন শান্ত হয়েছে এক নিমিষেই।
রাতে চাচির সঙ্গে একসঙ্গে খাই।
দুজন মিলে অনেক গল্প করি।
রাত বাড়ে।ছেলে ঘুমিয়ে কাঁদা।চাচি বিদায় নিয়ে ঘর ছাড়ে।
এই মানুষটা ভীষণ ভালো।সহজ-সরজ।
এক নাতি নিয়ে থাকেন।
উনার নাকি এক ছেলে ছিল।ছেলে ও বউমা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলে মেয়েটাকে নিজ সন্তানের মতো লালন-পালন করেছেন তিনি।
কিন্তু দূর্ভাগ্য!মেয়েটাও অসুস্থ।
বোধ-বুদ্ধি নেই,সারাদিন শুধু বসে থাকে।খাইয়ে দিলে খায়,না দিলে নাই।
ওর নাম মিম।
চাচি আর মিমের দিন বেশ ভালোই কাঁটে।
ছোট্ট একটা দোকান আছে।সেই দোকান চালিয়েই চাচির সংসার।
ওদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকলে আমার চলবেনা।
দুজন মানুষকে চালানো কম কথা নয়।এদের অফুরন্ত নেই।নিজের একটা বিবেক পালতে হবে।
এক বেলা খেয়েছি বলে প্রতিবেলার আশায় থাকতে পারিনা আমি।
আমার হাত-পা আছে,শক্তি আছে।খেটে খেতে পারব।
আমি কেন অন্যের ঘাড়ের বোঝা হয়ে হীন মনমানষিকতার পরিচয় দেব?
চাচি বয়স্ক মানুষ,উনার নাতিটাও অসুস্থ।
আমার বিপদে বন্ধু হয়ে পাশে থেকেছেন।
আমারই উচিৎ উনাদের দেওয়া।
আমি চেষ্টা করব যথাসাধ্য।
যদি একটা কাজ পাই তো চাচিকে সহযোগিতা করব।
ঘর ভাড়া নিচ্ছেন না উনি।মায়া করে থাকতে দিয়েছেন।
আমিও মায়া করব।
ভালো-মন্দ যাই রাধি,দিয়ে খাবো উনাকে।
কাল থেকে রান্না করে খাবো ভেবেছি।হাড়ি-পাতিল আছে।নেই শুধু থাল-বাটি চামচ।
কাল একপাক বাজারে গিয়ে সবজি,চাল-ডাল আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে আনব।”
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি সেই খেয়াল নেই।
রাত বারোটা নাগাদ আমার ফোনে কল এলো।
প্রথমবারে রিসিভ করতে পারিনি ঘুমে।
দ্বিতীয়বার কানে গেল শব্দ।ফোন হাতে নিতেই দেখলাম,অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে।
রিসিভ করে সালাম দিতেই এক পুরুষ কন্ঠ বলে উঠল,”আমি রাশেদ বলছিলাম।ফ্যাক্টারি থেকে কল করেছি।আপনি কদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করছিলেন কাজের খোঁজে।
এরপর তো আপনি আর এলেন না।আমিও আপনার নাম্বার হারিয়ে ফেলেছিলাম।আজ খুঁজে পেলাম তাই এখনই কল করলাম।এজন্য দুঃখিত।
আপনি যদি কাজটি করতে ইচ্ছুক হন তাহলে পরসুদিন এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন।
একটা ফর্ম পূরণ করে কাজ ফাইনাল করতে হবে।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম।
উনি কল কেঁটে দিলেন।
কাজটা ভীষণ প্রয়োজন ছিল আমার।
সত্যি বলতে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম কারণ উনি কাজ দেওয়ার কথা বললেও পড়ে আর কল দেয়নি।
ভেবেছিলাম হবে না হয়ত।
ভাগ্য আমার সহায় আছে।
খালার হাত থেকেও মুক্তি পেলাম,কাজ টাও পেলাম।সেই সঙ্গে এতো ভালো মানুষজন পেলাম।
এবার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখেই দিন কেঁটে যাবে আমার।
আর কোনো কষ্ট থাকবে না।না খেয়ে থাকতে হবেনা।
ছেলের মুখে দু-বেলা খাবার তুলে দেব।
স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।কিছুটা সঞ্চয় করব।বস্তির মানুষদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।
চোখে স্বপ্ন অনেক আমার,কিন্তু সাধ্য কম।
(রিয়েক্ট বেশি চাই।যারা পড়বেন অন্তত একটি করে লাইক করে যাবেন।