বড়োজা
পর্ব ৮
Nadia_Afrin
বস্তির মানুষ গুলোর ভালোবাসা পেয়ে অবিভূত আমি।নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতি মনে হয়েছে।
রাতে শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি।
ঘুম যখন ভাঙে সবে সকাল হতে শুরু করেছে।
উঠে বাইরে আসি আমি।ছেলে-মেয়ে দুটোই ঘুমে তখনও।
বাইরে এসে দেখি চাচি কোরআন তিলাওয়াত করছে।
বিষয়টি বেশ ভালো লাগে আমার।
মানুষ বয়স্ক,এখনো কোরআন তিলাওয়াত করতে পারে।
সত্যিই কোরআন তিলাওয়াত করলে চোখের জ্যতি বাড়ে।
আমি চাচির পাশে বসে তিলাওয়াত শুনি অনেকক্ষণ।মনে প্রশান্তি বয়ে যায়।কী মধুর তিলাওয়াত উনার!
তিলাওয়াত শেষে চাচি ঘরে যায়।দোকান খোলে।
ঘর-উঠোন ঝাড় দেওয়া শেষ উনার।
আমিও নিজের ঘরটা ঝাড় দিয়ে নেই।
চাচি এঠো বাসন বের করে টিউবওয়েলের কাছে রাখে।
আমি মেজে দিতে চাই।তিনি নিষেধ করে।
বলেন,”ছোট মেয়ে তোমার।ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।সকাল সকাল পানি হাতিও না।
ও কটা থালা-বাটি আমি নিজেই মেজে নিতে পারব।”
আমার মেয়ের নিজের দাদিও কখনো একথা বলেনি।সকাল হলেই সব করতে বলত আমায়।
উনারা ঘুমিয়ে থাকত।
বাড়ির কাজ শেষে রান্না করে তাদের ডাকতে হতো।
মেয়ের ঠান্ডা লেগেই থাকত এ কারণে।
আকাশকে বলেছি কবার।
সে বলেছে,কাজ করলে শরীর ভালো থাকে।
শীতের সকাল ঠান্ডা পানি নেড়েনেড়ে আমার নিজেরই সর্দি হতো।দুধের বাচ্চাটাও কষ্ট পেয়েছে কতো।
আনমনে এসব ভাবছিলাম আমি।
চাচি বাসন ধুয়ে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
একটু দূরেই শুকনো পাতা সহ লাকড়ি রাখা।সম্ভবত শুকোতে দিয়েছে।
ওখান থেকেই এনে এনে মাটির চুলোর কাছে রাখছে।
বয়স্ক মহিলার বারবার ওঠা বসা সমস্যা হচ্ছে।হাটুতে ভর দিয়ে উঠছে।
আমার চোখে পড়ে বিষয়টি।তাকে বসতে বলে নিজেই লাকড়ি পাতা এনে দিই।
চাচি চুলোতে আগুন দেয়।ভাতের হাড়ি বসায়।
চুলোটা তার দোকানের পাশেই।রান্না করতে করতে দোকান পাহারা করছেন তিনি।
আমি মুখ ধুয়ে ঘরে যেতে নেব এমন সময় ডেকে বলেন,”তোমার ছেলে ছোট মাছ খেতে পারে?
আলু,পেয়াজ দিয়ে ঝোল করলে খেতে পারবে?”
“পারবে।একটু মেখে দিলেই খেয়ে নেবে।
তবে আপনার এসব ঝামেলায় জড়াতে হবেনা।
আর একটু বেলা উঠলেই বাজারে যাব আমি।চাল,ডাল,মসলা আর কিছু সবজি কিনে আনব।”
চাচি বলে,”সে আনবেক্ষণ।যেতে যেতে বেলা হয়ে যাবে।বাজারের দোকান খুলবে তো আগে।
সকালে খাবে আমার কাছে।
ছোট ছেলেটা এতোক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারবেনা।তুমিও বেকায়দার মানুষ।নিজে না খেলে মেয়েকে খাওয়াবে কী?
না খেয়ে বাজারে গিয়ে শেষমেষ মাথা ঘুরে পড়ে যেও না।আমি বাবা তোমায় কোলে করে নিয়ে আসতে পারব না।”
চাচির কথায় আমি এবং চাচি দুজনেই হেসে উঠি।
মানুষটা বড্ড ভালো।
সম্পূর্ণ গল্পটি আমার পেইজে দেওয়া আছে।নাদিয়া আফরিন ইংরেজিতে লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন আমার পেইজ।
ফলো দিয়ে সম্পূর্ণ গল্পটি পড়ুন।
ফলো না করলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
আমি বলি,”খেতে পারি তবে একটা শর্তে।
আমি একটা কাজ পেয়েছি।কাজের টাকা দিয়ে একদিন মাংস আনব।
মাংস-ভাত রান্না করব।সেদিন আপনি আর লতা আপা সারাদিন আমার কাছে খাবেন।
আমি নিজ হাতে রেধে-বেড়ে খাওয়াবো আপনাদের।এটা আমার খুব ইচ্ছা।”
চাচি আলু ছিলতে ছিলতে বলে,”পরে ভাবা যাবে ওসব।
এখন ঘরে যাও।মেয়ের কাছে গিয়ে শুয়ে আর একটু ঘুমিয়ে নাও।
রোদ হলে বেড়িও।
তোমার ওপর অনেক ধকল গেছে।বিশ্রামের দরকার।
আমি রান্না হলে ডেকে দেব।খেয়ে বাজারে যাবে।”
“ওটাতো হবেনা চাচি।আপনি বয়স্ক মানুষ।আপনি কষ্ট করে রান্না করবেন আর আমি ঘরে শুয়ে বেলা অব্দি ঘুমাব?
এটা কখনো হয় নাকি?
আপনি যান,নিজে হাত-মুখ ধুয়ে মিমকে ধুইয়ে দিন।দোকানটা একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে নিন।
পরিপাটি থাকলে বেচাকেনা ভালো হয়।”
“তা তো হয়ই রে মা।সময় পাই কই।
একা হাতে রান্না,নিজের কাজ,নাতিটার সব করে দেওয়া,আবার দোকান ও দেখা।
হাপিয়ে উঠি।বয়স তো কম হলোনা।
তবুও করি কষ্ট করে।কাজ না করলে খাব কী?
অসুস্থ নাতিটাকে নিয়ে আমার যতো চিন্তা।ওকে দু-বেলা গরম ভাত দিতে না পারলে মনে শান্তি হয়না মা।
তুমি এসে আমার উপকারই হলো।তোমার মতো একটা মেয়ে গর্ভে ধরতে পারলে নিজেকে খুব বড়ো মনে করতাম।”
আমি হাসি মুখে বলি,”আপনার মেয়েই আমি।আমার জন্য আপনি যা করেছেন,আপন মা থাকলেও করত কিনা সন্দেহ।”
চাচি কিঞ্চিৎ হেসে উঠে দাড়ায়।
দোকান ঘরে যেতে যেতে বলে,”ভাতটা একটু নরম রেখো মা।মিম শক্ত ভাত খেতে পারেনা।
নরম হলে তোমার বাচ্চা ছেলেটাও পেট ভরে খেতে পারবে।”
আমি তার কথা মতোই কাজ করি।
ভাত রান্না করে আলু পেয়াজ কুচি করে কাটি।
মাছ ধুয়ে নেই ভালো করে।চাচি মসলাসব দিয়ে যায় আমার হাতে।মন মতো রাধতে বলে।শুধু একটু ঝাল কম।
আমি সবজি দিয়ে মাছ মেখে সুন্দরমত রান্না করি।চাচি একটু পর পর এসে খোঁজ নিয়ে যায়।কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চায়।
পুরো গল্পটি নাদিয়া আফরিন পেইজে দেওয়া আছে।ফলো দিয়ে পড়েনিন।
নাহলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
এছাড়াও আমার লেখা সব গল্প পাবেন আমার পেইজে।
এর মাঝে মিমকে উঠিয়ে ফ্রেশ করে দেয়।
আমার ছেলেও ঘুম ভেঙে বাইরে আসে।চাচি ওকেও মুখ ধুইয়ে দেয়।
রান্না শেষ হওয়ার একটু আগে আমার মেয়ে উঠে পড়ে।উঠেই গগনবিদারী চিৎকার।
চাচি দৌড়ে ঘরে যায়।মেয়েকে কোলে নিয়ে আমার কাছে আসে।
বলে,”ওকে খাইয়ে দিয়ে মুখটা মুছে দাও ভেজা কাপড় দিয়ে।
তরকারিটা আমি দেখছি।”
একটা বসার টুল এনে দেয় আমায়।
মেয়েকে খাইয়ে দেই বসে।
মুখ মুছে দেই।সকাল হলেই বাচ্চাদের মুখ মুছে দিতে হয়।
চাচি তরকারি নেড়েচেড়ে নুন দেখে নামিয়ে নেয়।
মিমকে আগে খাইয়ে দিতে বলি।বেচারা অসুস্থ একটা মেয়ে।
আমার ছেলেটা আবার বিছানা গোছাচ্ছে তখন।
ছোট থেকেই নিজ বিছানা,বইপত্র গোছানো শিখিয়েছি আমি।
বাচ্চাদেরকে সাবলম্বি করতে হয়।নিজের কাজ নিজে করা শেখাতে হয়।যাতে চলার পথে কারো ভরসায় না থাকতে হয়। হোচট না খেতে হয়।
মিমকে খাওয়ানো শেষ করে চাচি বাইরে আসে।উঠোনে তখন হালকা রোদ এসেছে।
শিতল পাটি বিছিয়ে দেয় মাটিতে।ততক্ষণে মেয়েকে খাইয়ে,পরিষ্কার করে আমি নিজেও মুখ ধুয়ে নিয়েছি।মেয়ে খেয়ে আবার ঘুমিয়েছে।ঘরে শুইয়ে দিয়েছি।
ছেলেকে চাচি নিজেই ডেকে আনে।ঘর থেকে থাল বের করে।
পাতে পাতে গরমভাত বেড়ে দেয়।তরকারি দেয়।
একসঙ্গে খাই আমরা।
দোকানে কাষ্টমার আসে।খাওয়া ছেড়ে চাচিকে যেতে হয় বারবার।
আমি বলি,”খাবারের থালা নিয়ে দোকানে বসেই খেতে।এতে বারবার উঠতে হবেনা।
খাবার পাতে বারবার উঠতে নেই।”
চাচি বলেন,”সে তো আমি দোকানে বসেই খাই আর বেচাকেনা করি।আজ তোমাদের সঙ্গে খাব বলে এখানে বসেছি।
তোমাদের রেখে দূরে খাওয়াটা কেমন দেখায়!
নতুন মানুষ তোমরা,লজ্জা পেয়ে পেটভর নাও খেয়ে পার।
এজন্য এখানে খাচ্ছি।”
“আপনি আমার পর নয় চাচি।আপনার কাছে আমার লজ্জা নেই।প্রয়োজনে চেয়ে নিয়ে খাব।
যে ভালোবাসে,তার কাছেই তো আবদার সাজে বলুন।
আপনি দোকানে গিয়ে নিশ্চিন্তে খান।
আমি এখানে খাচ্ছি।যা লাগে নিয়ে খাব।”
চাচি যাওয়ার সময় জোর করে আমার পাতে ভাত ও তরকারি উঠিয়ে দিয়ে যায়।
খাওয়া শেষ করে বাসনগুলো মেজে দেই।
চাচি দোকানে বসে থাকে।
আমি ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে তাকে বলতে আসি।তিনিও আমার সঙ্গে বাজারে যেতে চায়।আমি নিষেধ করি।
সংসারের যাবতীয় জিনিস কিনব আমি।দেখে শুনে দামাদামি করে কিনতে হবে।ঘুরতেও হবে অনেক।
সময়ের ব্যাপার।দোকানে কাকে বসিয়ে যাবে এতোটা সময়?
এছাড়াও বস্তির মানুষগুলোর ও কষ্ট হয়ে যাবে।দিন এনে খাওয়া মানুষ গুলো রান্নার ফাকে ফাকে এসে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিয়ে যায়।
পুরো বস্তিতে একটি মাত্র দোকান।এর ওপরেই সকলে নির্ভরশীল।
তাই যেতে মানা করেছি।
বাজার আমি চিনি।ছেলেকে নিয়ে নিজেই কিনতে পারব সব।
বেড়িয়ে গেলাম।পথে দেখা হলো লতা আপার সঙ্গে।
আজ তার কাজ নেই।বাসা বাড়িতে কাজ করেন তিনি।আজ নাকি ছুটি।
লতা আপা চুলোয় ভাত দিয়েছে তখন।
আমায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাইরের যেতে দেখে প্রশ্ন করে,”কোথায় যাও তন্নি?”
“বাজারে যাই আপা।নতুন সংসার শুরু করছি,বাজার-ঘাট করতে হবে তো নাকি!”
তিনি আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,”ওকেও নিয়ে যাচ্ছ?”
“হ্যা আপা।ওকে আর কোথায় রেখে যাই?
ফিরতে সময় লাগবে।ওতোক্ষণ না খেয়ে থাকবে কী করে?
এজন্য নিয়ে যাচ্ছি।
পরিবেশ বুঝে কোনো বাড়ি গিয়ে বরং খাইয়ে দেব।”
লতা আপা ঘরে যায়। বোরখা পড়ে বের হয়।আপার তিন ছেলে-মেয়ে।মেয়েটা মেজো।ছোট ছেলে আমার আলিফের বয়সি।আর একটা ছেলের বয়স দশ বছর।লতা আপার স্বামী রিক্সা চালক।
আপা তার মেয়েকে ডেকে বলে,”তরকারি নামিয়ে ঘরে রেখেছি।ভাতটা হয়ে এসেছে প্রায়।
দেখিস।হাড়ি ঘরে নিস।
আমি একটু তোর তন্নি খালার সঙ্গে বাজারে যাচ্ছি।
মেয়েটা কোলের বাচ্চা নিয়ে বাজারে যাচ্ছে।সব একসাথে কিনে আনতে পারবেনা।”
আমি কিছু বলার আগেই আপা আমার ছেলের হাত ধরে সামনে এগোয়।
অগত্যা আমিও পথ চলি।যদিও উপকার হবে এতে।
সত্যিই একা একা সব কেনা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যেত।
রিক্সা নিয়ে চারজন কোনোমতে বসলাম।
ছেলে ওপরে বসেছে।
বাজারে পৌঁছে সর্বপ্রথম একটা হাড়ি কড়াইয়ের দোকানে গেলাম।
ভাবি হাড়ি দিয়েছে দুটো,কড়াই একটাও দিয়েছে।
ঢাকনা দিতে পারেনি।
সেগুলোই কিনতে হবে আজ।
দোকানে ঢুকে বেছে বেছে তিনটি ঢাকনা নিলাম।
ভাতের হাড়ির জন্য দু-পিঠ সমান ঢাকনা।
তরকারি আর কড়াইয়ের একটু ভিন্ন।
সঙ্গে তিনটি চামচ ও নিয়েছি।
ঐ দোকানেই দেখলাম প্লেট বিক্রি করছে।কিনতে চাইলাম।কিন্তু দাম বেশি।
তাই আর কেনা হলোনা।
ঢাকনা,চামচ কিনেই বেড়িয়ে এলাম।
অন্য দোকানে গেলাম।
এখানে এসে বিপত্তি হলো।সেট সহ প্লেট,গ্লাস বিক্রি করে।একটা দুটো কেনার উপায় নেই।আরো কদোকান ঘুরেও দেখি একই অবস্থা।
বাধ্য হয়ে ছয়টা করেই কিনতে হলো।দুটো বাটিও নিয়েছি।
স্টিলের নিলে দাম হয়ত একটু কম পেতাম।
ছেলে আবার স্টিলের গ্লাসে পানি খেতে পারে না।ছোট থেকে কাঁচের অথবা প্লাষ্টিকের গ্লাসে খেয়ে বড়ো হয়েছে।তাই স্টিলে ঠোঁট কেটে যায়।
ফুটপাত থেকে সবজির ঝুড়ি কিনেছি বড়ো দুটি।
পেয়াজ,রসুন,আদা,মরিচ রাখার জন্য ছোট আরো দুটি ঝুড়ি নিতে হয়েছে।আসলে সব একত্রে রাখলে পচে যায় দ্রুত।মরিচটা আলাদা রাখলে বেশকদিন খেতে পারব।
এ কটা জিনিস কিনতেই প্রায় হাজার টাকা শেষ আমার।
মসলা রাখার জন্য একটা বক্সমতো কিনেছি।
এবার এলাম সবজি বাজারে।আগুন বরাবর দাম সবজির।
কিনতে তো হবেই।বেঁচে থাকতে হলে কিনে খেতে হবেই।
বেশ ক ধরনের সবজি নিয়েছি।কেজি খানিক করে নিয়েছি।এক দোকান থেকে কয়েক পদের কিনলে দাম দু-পাঁচ টাকা করে কম ধরে।
এছাড়াও বাজারটাও দূরে।বারবার রিক্সা ভাড়া দিয়ে আসা সম্ভব নয়।তাই একটু বেশি করেই নিয়েছি সব।
বাসন,সবজি কেনা শেষে চাল কিনতে গেলাম।কেজি পাঁচেক নিয়েছি চাল।সামান্য ডাল। পোয়া খানিক করে মসলা কিনেছি।তেল,নুন ও নিয়েছি।
চাল রাখার জন্য একটা ছোট ড্রাম মতোও কিনেছি।সেই সঙ্গে ডাল রাখার একটা কৌটা।
এবার বাড়ি ফেরার পালা।
ছেলে তখনই বায়না ধরে মাছ কিনবে।
আমি যতো ওকে বোঝাতে চাই ও আরো জেদ করে।
বাধ্য হয়ে মাছের দোকানে গেলাম।
দেখি সবই বড়ো মাছ।মাঝারি গুলো নাকি বিক্রি হয়ে গেছে।
একটা মাছ দাম করি। ৫২০ টাকা চায়।
আমি অবাক হয়ে লতা আপার দিকে তাকাই।
আপার কোলে আমার মেয়ে।
আপাও আলিফকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।এটা ওটার লোভ দেখিয়ে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।কিন্তু ছেলে নাছড়বান্দা।
মাছ কিনে তবেই সে বাড়ি যাবে।
উপায় না পেয়ে ঐ মাছটাই নিলাম।
একটা দিনই তো।ছেলে-মেয়ের জন্যই তো টাকা-পয়সা।
বাজার শেষে বের হয়ে দুটো পাউরুটি কিনি।এক হালি কলা কিনি।আপাকে একটা পাউরুটি আর দুটো কলা দেই খেতে।তিনি খেতে চায়না।আমি জোর করি।
বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়।সকাল থেকে না খেয়ে মানুষটা।
আমার জোড়াজুড়িতে খেয়ে নেয় আপা।
আমিও একটা কলা খাই।ছেলে পাউরুটি খায়।কলা যেতে যেতে খাবে নাকি।
রাস্তায় দাড়িয়ে আছি ভ্যানের জন্য।আমার একহাতে চাল ও মাছ।অন্যহাতে বাসনপত্র।
লতা আপার কাছে আমার মেয়ে ও সবজির ব্যাগ।দুজনেরই হাত বন্ধ।
আমার ছেলে তখন কলা খাচ্ছে দাড়িয়ে।এমন সময় একটা বড়ো গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে যায়।গাড়ির কাঁচ খোলা ছিল।
ছেলে ‘বাবা বাবা’ বলে চিৎকার করে গাড়ির পেছনে ছোটে।
আসলে ঐ গাড়িতে আকাশ বসা ছিল।ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল সে।
ছেলে তাকে দেখে নিয়ে পেছনে দৌড়েছে।
আটকানোর মতো সুযোগ পাইনি আমি।পেছন ডেকেছি।কিন্তু শোনেনি বাচ্চাটা।বাবাকে কাছে পাওয়ার আনন্দে ছুটেছে সে।
বাবার ছোঁয়া পায়নি সে।একটু দূর যেতেই পড়ে গেছে ছেলেটা।
ভাগ্যিস মাটির ওপর পড়েছে।রাস্তায় পড়লে কেঁটে যেত পাথরের সঙ্গে।
ভাবছেন হয়ত, আকাশ দেখেনি আমাদের।
না।সে দেখেছে ঠিকই।ছেলের কন্ঠও শুনেছে।এমনকি জানালা দিয়ে মাথা বের করে রাগী চোখে তাকিয়েছেও আমাদের দিকে।
কিন্তু পাত্তা দেয়নি।নিজের সন্তানের মূল্যও নেই ওর কাছে।
নিচে ব্যাগ রেখে ছেলের কাছে দৌড়ালাম আমি।কোলে তুলে নিলাম।ছেলেটা কাঁদছে।বাবার কাছে যেতে চায়।
আমি অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেলের কান্না থামাই।নিয়ে আসি।
লতা আপা কিছুই বোঝেনি।
প্রশ্ন করে,”উনি কে তন্নি?আলিফ বাবা বলে দৌড় দিল কেন?
ওর বাবা হলে থামার কথা ছিল।ডিভোর্স হয় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে।সন্তানের সঙ্গে তো নয়।”
“ওটাই ওর বাবা।উনি আমাদের সবাইকেই ত্যাগ করেছে।নতুন বিয়ে করে সুখেই আছে।
ঐ অমানুষটার জন্যই আজ আমাদের এমন দষা।”
লতা আপা জবাব দেয়না কোনো।
এরপর ভ্যান নেই একটা।
রিক্সাতে সব আটবেনা।
ভ্যানে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই।মেয়ে আমার একবারও কাঁদেনি এর মধ্যে।
বস্তিতে ফিরে ঘরে আসি।
মেয়েকে খাওয়াই আমি।লতা আপা চাল-ডাল গুলো ঢেলে সবজি সব গুছিয়ে দেয়।
কয়েক আটি শাক নিয়েছি আমি।
মসলা গুছিয়ে দিয়ে সব টিনের বাক্সের ওপর রেখে যায়।
লতা আপা আমায় বলে,”চলো আমার ঘরে দু-মুঠ খেয়ে আসবে।
রাতে নিজে রেধে খেও।”
আমি বলি,”বাজার যখন করেছি রান্না করেই খাই।
বেশি কিছু করব না আজ।ভাত রান্না করে মাছের ঝোল করব।
মা-ছেলেতে এতেই হয়ে যাবে আমাদের।
কিন্তু চুলো নেই আমার।
চাচির চুলোতে না’হয় একবেলা রাধলাম।কাল মাটি কেঁটে চুলো বসিয়ে নেব।
জ্বাল দেওয়ার মতো কিছু নেই।আশেপাশে কারো বাড়ি লাকড়ি বিক্রি করে আপা?
করলে কিনে আনতাম।”
“বাজার-সদাই করতে গিয়েই তো টাকা অনেক শেষ করলে।এবার নতুন করে লাকড়ি কিনে আনতে গেলে আরো খরচ হবে।
এক চেয়ে ভালো আমি কটা জ্বালানি দিয়ে যাই ওসব দিয়ে আজকের রান্না শেষ করো।কাল থেকে গাছ বাগানে লাকড়ি -পাতা কুড়িয়ে এনে চুলোয় দেবে।
এটা শহর নয় যে সব কিনে আনতে হবে।
রান্নার জ্বালানি আমরা কুড়িয়েই জোগাড় করে ফেলি।
আশেপাশে অনেক গাছ-গাছালির বাগান আছে।
রাতে শুকনো পাতা,ডাল পড়ে থাকে।সকালে ওগুলো এনে জড়ো করে রাখি এক কোণে।সারাদিন সেগুলোই চুলোর মুখে দেই।
তুমিও তাই করবে।
পরিশ্রম না করলে সুখ পাবেনা।
একটা ভালো কাজ পেলে না’হয় কিনে নেবে সব।
আপাতত কুড়িয়েই রান্না করো।
দুজনের পেট চললেই হলো।”
লতা আপা কিছু শুকনো লাকড়ি দিয়ে যায়।
সঙ্গে আমার ছেলেকে নিয়ে যায়।বলে,তুমি বড়ো মানুষ।না খেয়ে থাকতে পারবে।
ও বাচ্চা।ও পারবেনা।তাই ওকে আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
আমি মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চাল হাড়িতে নেই।
চাচি আসে এমন সময়।দোকানে খরিদ্দার থাকায় এতোক্ষণ আসতে পারেনি তিনি।
এসেই বলে,”অনেক কিছু কিনে এনেছ দেখছি।
এতো এনে টাকা ফুরানোর কী দরকার ছিল?এমনিতেই অভাবের মাঝে তুমি।
চাল কটা আমার ঘর থেকে নিলে হতো না?
মসলা আমার কৌটা থেকেই নিতে।দুজন মানুষের রান্নায় কতোই বা মসলা লাগত!”
বললাম,”এমনিতেই আপনার কাছে অনেকটা ঋণই আমি।আর ঋণ বাড়াতে চাইনা।
তাছাড়াও এভাবে কয়দিন?
আপনারও সংসার আছে।
নিজে কিনে এনেছি এটাই ভালো হয়েছে।বেশ কদিন খেতে পারব।”
চাচি দুপুরের খাবারটাও খেতে বলে তার ঘরে।আমি এবার রাজি হইনা কোনোমতেই।
তিনি আবারো বলেন,”ঠিক আছে।খাবে যখন না,তো দাও তোমার কাজ একটু এগিয়ে দেই।
তুমি মসলা কেঁটে বেটে নাও।
আমি মাছ কেঁটে ধুয়ে দেই।তাড়াতাড়ি রান্না হলে খেয়ে নিতে পারবে দ্রুত।”
চাচি উঠোনে বসে মাছ কাঁটে আমি একটা সিল-পাটা এনেছি।চাচির এটা নেই।কাঠের ওপর পাথর দিয়ে কীভাবে যেনে ছেচে খায় মসলা।
মসলা বেটে নিয়ে চুলোর কাছে এলাম।ভাত হয়ে গেছে।নামালাম হাড়ি।কড়াই বসাই চুলোতে।
ততক্ষণে মাছ কাঁটা শেষ।
মাছ ধুয়ে আমায় দিয়ে দোকানে গেলেন তিনি।
আমি কপিছ মাছ ভাজি করে রান্না করলাম।
চাচি এসে বলল,”বাকি মাছ গুলো দাও ফ্রিজে রেখে আসি চিহ্ন করে।
সব তো একবারে খেতে পারবেনা।
আমাদের বস্তির শেষে এক বাড়ি আছে।আমরা ওটাকে বড়ো বাড়ি বলি।উনার বাড়ি একটা ফ্রিজ আছে।সেখানেই মাছ-মাংস রাখি আমরা।
দাও তোমারটাও রেখে আসি।
ভাঙাচোরা ঘর আমাদের।বেড়াল ঢুকে কখন খেয়ে নেবে বুঝবেই না।”
রেখে আসতে বললাম চাচিকে।
পলি ব্যাগে ভরে নিয়ে গেল তিনি।
ছেলে এলো তখন।ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে আলিফকে।
ও এসেই আমার গলা জড়িয়ে ধরল।
কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,”জানো আম্মু,ঐ আন্টি আমায় পেট ভরে ভাত খাইয়েছে। উনারা শুধু ঝোল আলু রান্না করেছিল।আমি গিয়েছি দেখে ডিম ভেজে ভাত দিয়েছে।
সঙ্গে তার ছেলেকেও দিয়েছে।
আমি বেশি খেতে চাইনি।জোর করে খাইয়েছে।বলেছে এই দুবার খেলে বড়ো হয়ে যাব।
অনেক ভাত খেয়েছি আমি।
দেখো আমার পেটটা গোপালের পেট হয়ে গেছে।”
ছেলের কথা শুনে হাসি আমি।
বাচ্চা মানুষের বাচ্চা বাচ্চা কথা সব।
রান্না শেষ করে ঘরে আসতে আসতে মাগরিবের আজান হয়ে যায়।
আমি চাচিকে ডেকে এক বাটিতে তিনপিছ মাছ সহ একটু ঝোল লতা আপাকে দিয়ে আসতে বলি।
চাচি দিয়ে আসে।
এরপর তাকেও দু-পিছ মাছ সহ ঝোল ও ভাত দেই।চাচি তরকারিটা নেয় শুধু।
বলে,”ভাত আমার ঘরেই আছে।অল্প একটু চাল এনেছ।ভাত আমায় দিতে হবেনা।”
মাছটা নিয়ে খায় উনি।
আমিও ছেলেকে নিয়ে তৃপ্তি করে খাই।
চাচি খাওয়া শেষে আমার ঘরে আসে।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”এমন লক্ষি মেয়ে তুমি।খুব সংসারি।সোনার টুকরো সন্তান তোমার।
স্বামী কেন ছেড়ে দিল?
তোমার সংসার ভাঙলো কী করে?”
আমি ধীর স্বরে বলি,”আমার বড়োজার কারণে।”
(আস্তে আস্তে আসল দিকে যাচ্ছি আমরা।একটু ধৈর্য্য ধরুন সকলে আর আজকে পর্বে সকলের রিয়েক্ট চাই,, যারা পড়বেন।
চলবে,,,,