#বড়োজা
#Nadia_Afrin
২৫
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমি।
মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে।হঠাৎ ই ঘুম ভেঙে হুড়মুড়িয়ে উঠি।সামনেই দেখি পারভীন আপা বসে আছেন।
আমায় উঠতে দেখে মুচকি হেসে বলেন,”ঘুম ভেঙেছে?বেলা হয়েছে অনেক।খেয়ে নাও চলো।ফ্রেশ হও।তোমার ছেলেকে খাইয়ে দিয়েছি।বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে সে।
মেয়ে আমাদের এখানকার মেয়েদের কাছে।ওরা কোলে নিয়ে ওদের রুমে গেছে।তুমি খেয়ে মেয়েকে নিও।”
উঠলাম বিছানা ছেড়ে।হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেলাম।
পারভীন আপা আমায় নিয়ে বাইরে এলো।
এতিমখানা ঘুরেফিরে দেখতে লাগলাম।প্রতিটি ঘর ভীষণ সুন্দর ও সাজানো।
বড়ো বড়ো ঘরে ছোট করে করে বিছানা পাতা।প্রতিটি ঘরে বেশ কজন মেয়েরা থাকে।
এখানে বেশ কিছু শিফ্ট করা।
যেমন,ছেলেদের ক্ষেত্রে ছোট ছেলেরা এখানে থাকে।কতো বছর হলে যেন ওদের অন্য এতিমখানায় দিয়ে দেওয়া হয়।যেখানে শুধু ছেলেরাই থাকে।মেয়েরা ছোট থেকেই এখানে থাকে।
প্রাপ্ত বয়স্ক হলে সে যদি বলে বিয়ে করবে,তাহলে এতিমখানা থেকেই পাত্র দেখে বিয়ে দেওয়া হয়।মা-বাবা ছাড়া এতিম মেয়ে গুলোর বিয়েই বা দেবে কে!
অনেকে আবার বাহিরে পড়তে চায়।সুযোগ-সুবিধা পেলে তাদের পাঠানোও হয়।তবে এক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়।
এটাকে একপ্রকার মহিলা এতিমখানা বলে।
এতিমখানার পাশাপাশি এর ভেতরেই শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
বিভিন্ন সংস্থা থেকে বই সহ যাবতীয় যা লাগে লেখাপড়ায় তা পাঠানো হয়।
বেশ কিছু ফান্ড আছে সহযোগিতা করার জন্য।
বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্য আলাদা শিক্ষকেরা আছে।যারা কজন এখানেই থাকে,আবার কেউ কেউ বাইরে থেকে আসে।
যারা এখানে থাকে,মাস শেষে বেতন থেকে নির্দিষ্ট কিছু অর্থ খাওয়া ও থাকা বাবদ দিয়ে থাকেন।
এখানে মুসলিম-হিন্দু দুই ধর্মের মানুষই আছে।
ভীষণ মিশুক তারা।
দেখে মনে হয় একটা পরিবার।
কমবেশি সবার সঙ্গে পরিচিত হই আমি।
এতিমখানার বাইরের দিকটাও ঘুরে দেখি।পরিবেশ ভালো।
কথা-বার্তা,চাল-চলন থেকে শুরু করে আচার-ব্যবহার ভীষণ মার্জিত।
পারভীন আপা মানুষটা অমায়িক।তার বিষয়ে না বললেই নয়।
সবসময় একটা মার্জিত বেশে থাকেন তিনি।ওপর পদের হয়েও সবার সঙ্গে কী সুন্দর ভাব!
ছেলে-মেয়েদের নিজের সন্তানের মতো দেখেন।
আমার ছেলেকে ওখানে ভর্তি নেন তিনি।
উনার একার ওপর বেশি দায়িত্ব ছিল বিদায় আমায় কাজে নিয়েছিলেন তিনি সহকারি হিসেবে।সম্পূর্ন নিজ দায়িত্বে আমায় কাজে রেখেছেন।অর্থাৎ আমার কোনো দায়ভার এতিমখানার ম্যানেজিং কমিটি পালন করবেনা।
আমার বেতন থেকে শুরু করে যাবতীয় সব তিনিই দেখবেন।
প্রথম দিন এসেই ভীষণ ভালো লাগে আমার।
পারভীন আপা নিজে সব কাজ আমায় বুঝিয়ে দেন।তেমন কিছুই না,শুধু তার সঙ্গ দেওয়া।এটা-সেটা এগিয়ে দেওয়া ও সৎ পরামর্শ দেওয়া।
আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে সেদিন থেকেই কাজে নেমে পড়ি।
ছোট-বড়ো কোনো কাজই বাছি না।নিজের ঘর,নিজের মানুষ মনে করে সবটাই করি।
পারভীন আপার কাজ টুকু করে দিয়ে এটা-সেটা করতাম।কখনো সাফাই এ সাহায্য করি,কখনো বা রান্নায়।
আপা আমায় নিষেধ করে এসব না করতে।প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা লোক ছিল।তবুও আমি করতাম।ভালো লাগতো।
বলতাম,কাজে কোনো বড়ো-ছোট নেই।চোখের সামনে যা দেখবো উৎরে দেব।
এভাবেই ওখানকার প্রতিটি মানুষের প্রিয় হয়ে উঠি আমি।তন্নি অন্তপ্রাণ বলতে পারেন।
যেকোনো কাজে আমায় ডাকে তারা।খুশি মনে আমিও সাহায্য করে যাই সাধ্যমতো।
পারভীন আপার কাজের চাপ কমিয়ে দিয়েছিলাম অনেকটা।উনি শ্বাস কষ্টের রোগী ছিলেন।বেশি চাপ অথবা বেশি হাঁটাহাঁটি করলে শ্বাস কষ্ট বেড়ে যেত।
আমি ধীরে ধীরে তার সঙ্গে থেকে থেকে তার সকল কাজই বুঝে নিয়েছিলাম অল্প সময়ের মধ্যেই।
বাহিরে কাজগুলো আমি করে দিতাম বেশি।সবার বেতনের পরিমাণ নির্ধারণ,তা বুঝিয়ে দেওয়া,চেক আনা,নতুন কেউ এলে ফর্মালিটি পূরণ এসবই আমি করে দিতাম।
আপার ভরসাস্থল জিততে পেরেছিলাম আমি।
দিন এমনও গেছে,আপা অসুস্থ হয়ে বিছানায় থাকলে ওনার বদলে মিটিং আমি এ্যাটেন্ড করেছি আপার সহকারি হিসেবে।স্বল্প শিক্ষিত হয়েও বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে বসার সুযোগ পেয়েছি।সবই আপার দৌলতে।আমায় নিজ হাতে গড়েছেন তিনি।শেখার প্রতি আমার চাহিদা দেখে উনিও সাহায্য করেছেন।
আসলে মানুষ চাইলে সবই সম্ভব।প্রয়োজন শুধু ইচ্ছা শক্তির।
সম্পূর্ণ গল্পটি আমার পেইজে দেওয়া আছে।নাদিয়া আফরিন ইংরেজিতে লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন আমার পেইজ।
ফলো দিয়ে সম্পূর্ণ গল্পটি পড়ুন।
ফলো না করলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে এতিমখানায় কমিটির লোকেরা আসতো।নতুন ফান্ড থেকে শুরু করে,নতুন বাচ্চা,শিক্ষক,কর্মচারী ও সবকিছুর হিসাব নিতেন তারা।
সেখানেই আপার হয়ে সবটা আমি বলতাম।
আমার প্রতিটি কথা এবং কাজ কাগজে কলমে পরিষ্কার ছিল বিধায় তারাও আমার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল।
একমাসের মাথাতেই আমার চাকরি সেখানে পাকাপোক্ত হয়ে যায়।
আপার পাশের আসনেই আমার স্থান দেওয়া হলেও তাতে আমি রাজি হইনি।আমার মনে হয়েছে এতে আপার অসম্মান হবে।যদিও আপা চেয়েছে আমি তার আসনে বসি।সে অবসরে যাক।
কিন্তু আমি চাইনি এটা।বলেছি,আপার স্থানে আপাই থাকুক।তিনি যোগ্য এটারই।প্রয়োজনে তার কাজ আমি করে দেব।তবুও মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়ার মতো সে থাকুক।
কোনো বিপদে পড়লেই যেন তার কাছে ছুটে যেতে পারি আমি।আশ্রয় নিতে পারি তার কাছে।
আপা বলেছেন তিনি পাশে থাকবেন সবসময়।আমি এ’কাজের যোগ্য বলেই আমায় দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
আমি আমার সিদ্ধান্তে স্থীর।
আপাকে থাকতেই হবে।অন্যথায় আমি যেমন আছি তেমনই থাকবো।
আমার এই যোগ্যতা,দক্ষতা সবটাই তার জন্য।সে না পাশে থাকলে আমি কখনোই এতোদূর পৌঁছাতে পারতাম না।
আমার মতো মেয়েদের কাছে এ ধরনের চাকরি আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন।
সেখানে আমি কোনো সার্টিফিকেট ছাড়া শুধু মাত্র নিজের হাতের কাজ দ্বারা এটা অর্জন করেছি।
আমায় যিনি গড়েছেন তার স্থানে আমি যেতে পারবোনা কখনোই।সে থাকুক আমার গুরু হয়ে।
আমি তার ছায়াতলে আরো শিখতে চাই।
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমার কথা মেনে নেয় কর্তৃপক্ষ।
পারভীন আপার জুনিয়র পদে নিযুক্ত হই আমি।
মাস শেষে ভালো অঙ্কেরই টাকা পাই।আমার অবস্থা বিবেচনা করে এতোটাও ভাবিনি কখনো।
চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি।
খাওয়া ও থাকা খরচ বাবদ টাকা দিতে চাইলে আপা নিষেধ করে।
জোর করি আমি।সবার মতোই আমিও এই ছোট্ট এতিমখানার ভালোকাজের একটু ভাগিদার হতে চাই।
আমাদের মতো কর্মীদের বেতন দিয়েই এতিমখানায় বাজার-সদাই করা হতো।কমিটি থেকেও দিত কিছুটা।পুরো মাস বাচ্চাদের খাওয়ার টাকা এভাবেই ওঠানো হতো।
এমন সুযোগ পায় কজনে!
একটা মহৎ কাজে জড়িয়ে নিজেকে একটু ধন্য করতে চাই।
আমার জেদের কাছে হার মেনে আপাও রাজি হলো আমার প্রস্তাবে।
তবে খুব সামান্য অর্থই নির্ধারণ করা হয় আমার জন্য।
আমার চেয়েছিলাম আমার টাকার তিনভাগই দিয়ে দিতে।সেখানে আপা নেন একভাগ মাত্র।
তিনি নিজেই একটা ব্যাংক এ্যাকাউন্ট করে দেন আমার নামে।
বলে,মাস শেষে যে টাকা থাকবে এ্যাকাউন্টে রাখবে।তোমার দুটো বাচ্চা আছে।তাদের ভবিষ্যৎ এর কথা ভাবতে হবে।
সময় সারাজীবন একরকম যায়না।
সঞ্চয় করে রাখো।কাজে লাগবে।তোমার না লাগুক,বাচ্চাদের লাগবে।
ভালো কোথাও পড়াতে গেলে টাকার প্রয়োজন।তাই এখন থেকেই গোছানো শুরু করে দাও।
পুরো গল্পটি নাদিয়া আফরিন পেইজে দেওয়া আছে।ফলো দিয়ে পড়েনিন।
নাহলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
এছাড়াও আমার লেখা সব গল্প পাবেন আমার পেইজে।
অন্য কোনো গ্রুপে বা পেইজে আর গল্পটি পাবেন না।সুতরাং সম্পূর্ণ গল্প পড়তে এবং আপডেট পেতে মূল লেখিকাকে ফলো দিয়ে রাখুন।
সত্যিই এই মানুষটার কোনো তুলনা হয়না।রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও আমায় কতো আপন করে নিয়েছে।
আমার ভবিষ্যৎ চিন্তা করেন।
উনার মতো উদার মানুষ খুব কমই হয় পৃথিবীতে।যারা কিনা বিনা স্বার্থে মানুষের উপকার করে।
পারভীন আপা আর লতা আপার মাঝে বেশ মিল খুঁজে পাই আমি।দুজনেই মানুষ হিসাবে বড্ড ভালো।
সৃষ্টিকর্তা এদের ভালো রাখুক।সর্বদা সুখ- সাচ্ছন্দ্যে রাখুক।
এবার মনে হয় সৃষ্টিকর্তা সত্যিই আমায় ভীষণ ভালোবাসে।সব হারিয়ে কতো কী পেলাম আমি।যা হারিয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ পেয়েছে।একটা কথা শুনে সর্বদা বড়ো হয়েছি,আমার জন্য যা অমঙ্গলের,তা আমার যতোই প্রিয় হোক না কেন হারিয়ে যাবে।
আর যা আমার জন্য মঙ্গলজনক তা যেভাবেই হোক আমি পাবো।
এ কথার আজ প্রমাণ পেয়েছি।একসময় চেয়েছি ঐ বস্তিই যেন আমার সর্বস্র হয়।টিকে থাকতে চেষ্টা করেছি।
কিন্তু পারিনি।হয়ত তার চেয়ে ভালো কিছু বিধাতা আমার কপালে লিখে রেখেছেন।তাই ই হলো।
এমন একটা পরিবার তিনি আমায় দিলেন যেখানে আমায় মাথায় তুলে রাখে।যেখানে আমার সম্মান আছে।কদর আছে।
আর চিন্তা করতে হয়না কাল কী খাবো।কোথায় যাবো।
মনের আনন্দে থাকি আমি।আমার পাশে সবাই আছে।আমায় ভালোবাসার বহুত লোক আমি পেয়েছি।যারা অকারণেই আমায় ভালোবাসে।
সবচেয়ে বড়ো কথা একটা বোন পেয়েছি।লতা আপাকে হারিয়ে পারভীন আপাকে পেয়েছি।
তবে লতা আপাকে ভুলিনি কিন্তু।
আমার আজও মনে পড়ে তার কথা।মনে হলে পারভীন আপার কাছে গিয়ে বসে থাকি।তৃপ্তি পাই এতে।
বিশাল এই জীবনে কিছু মানুষের অবদান সত্যিই ভোলার নয়।যেমন, তটিনী,লতা আপা,চাচি।এদের আমি কখনো ভুলবোনা।ভুলতে চাই ও না।
এরা থাকুক মনের এক কোণে।দোয়া থাকবে মন ভরে।
এখানে এসেছি থেকে তেমন খরচই হয়না আমার।
থাকি এতিমখানায়।খাই ও সেখানেই।ছেলে এখানে এসে অনেকটাই ভদ্র হয়ে গেছে।আগের মতো আর বায়না,জেদ করেনা।আমার কথা শোনে।
ওকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ছিলাম একসময়।
বয়স হলেও পড়া মুখ দিয়ে ঠিক মতো আসতো না।বলতে পারেন ব্রেইন দূর্বল।
এখানে এসে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।বর্তমানে ক্লাসের ফাষ্টবয় আমার ছেলে।মুখস্ত বিদ্যা থেকে শুরু করে লেখাতে ভীষণ পারদর্শী।
এটাও হয়েছে এখানকার সবার কৃপায়।
বড়ো যেসব মেয়েরা থাকে ওরাই ছেলেকে একেক সময় একেকজন পড়াতো,লেখাতো।খেলার ছলে কবিতা মুখস্ত করায়।
কার্ড দিয়ে গণনা শিখিয়েছে।
ছেলে এখন পাকা মাথার হয়ে গেছে।এখন আর কাউকে লাগেনা পড়তে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজে নিজেই হোম ওয়ার্ক তৈরি করে।লেখাপড়ার প্রতি চাহিদা হয়েছে।
মেয়েকে নিয়েও আমার ভাবতে হয়না।এতিমখানার মেয়েরাই রাখে ওকে।ঘুরতে নিয়ে যায়।ঘুম পাড়ায়।কাঁদলে শুধু আমায় দেয় খাওয়ানোর জন্য।
বলতে পারেন সব দিক দিয়ে আরাম পেয়েছি আমি।
ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।টাইম মতো গোসল,খাওয়া সবই ওরা দেখে।
আসলে এই এতিমখানায় আমার মেয়ের বয়সি কোনো শিশু নেই।তাই ওকে পেয়ে সবাই ই ভীষণ আদর করে।
আমি শান্তি মনে নিজের কাজ করি।জানি আমার বাচ্চারা ঠিক থাকবে,বরং ভালোই থাকবে।
এখানকার মেয়েরা হাতের কাজ জানে।খুব সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করে জামা তৈরি করে।ওরাই সকলের জামা বানায়।
এসেছে থেকে এ অব্দি আমার মেয়ের জন্য প্রায় দশসেট জামা বানিয়ে দিয়েছে।
কতো ফুলের কাজ,রঙের কাজ করা জামা।
কী সুন্দর দেখতে!
জানেন,এতিমখানার সকলে আমায় ভীষণ লাকি মনে করে।
আমি আসার পর আরো নতুন ফান্ড এসেছে।নতুন বাচ্চারা এসেছে।
বেশ কিছু সংস্কারের কাজ ও হয়েছে।
আগে বাথরুমটা বেশ দূরে ছিল।ছোট ছেলে-মেয়েদের যেতে অসুবিধা হতো।বড়ো মেয়েরাও রাত-বিরাতে বের হতে ভয় পেত।কারণ বাথরুমের পেছনেই বিশাল পুকুর ও বাশঝার।
আমি এতিমখানার কমিটির সঙ্গে কথা বলি এ বিষয়ে।
মিটিং এ দরখাস্ত দেই।প্রথমে তেমন পাত্তা পাইনা।
পারভীন আপার পরামর্শে দরখাস্ত নিয়ে মেয়র চেয়ারম্যান সহ আরো বড়ো বড়ো খাতে ঘুরেছি।
সহজে কী যেতে পারি তাদের কাছে।
পিছে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়েছে।
আমি আশা ছাড়িনি।ধৈয্য ধরে থেকে ঠিক কার্যহাসিল করেছি।এতিমখানার কাজ শুরু হয়।
সাইটের একটি ভাঙা দেওয়াল সহ এতিমখানার সাথেই চারটি বাথরুম তৈরি হয়।
এই কাজটি যে আমি করতে পারবো তা কারো ধারণাতেই ছিল না।কেননা এই কাজের জন্য কমিটির লোকেরা ও পারভীন আপা নিজেও একসময় খাটাখাটনি করেছিল।কিন্তু কাজের কাজ হয়নি তখন।
আমি পেরেছিলাম।তাই আমায় কমিটির পক্ষ থেকে পুরষ্কার অব্দি দেওয়া হয়েছে।
যা সম্মান পেয়েছি তা আমার আজীবন মনে থাকবে।এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অর্জন ছিল।
পুরো গল্পটি নাদিয়া আফরিন পেজে দেওয়া আছে।ফলো দিয়ে পড়েনিন।
নাহলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
এখানে এসে কিন্তু আমার ছোট বেলার টিচার হওয়ার স্বপ্নটাও পূরণ হয়েছে।
ছোট বাচ্চাদের ক্লাস নেই আমি।সবসময় নয়।যখন কোনো টিচার অসুস্থ বা কোনো সমস্যায় থাকে তখন আমিই বাচ্চাদের পড়াই।
এই বাচ্চারা কিন্তু আবার বস্তির বাচ্চাদের মতো নয়।
এদের মাঝে খুবই ভদ্রতা-নম্রতা আছে।
অন্যসময় আমায় তন্নিমা বলে ডাকলেও শিক্ষক হিসেবে যখন ক্লাসে এসেছি তখন ম্যাম বলেই ভেকেছে অন্যসবার মতো।
বয়সে ছোট হলেও কোনো প্রকার দুষ্টুমি নেই ক্লাসরুমে।পড়ার সময় শুধু পড়া।
অযথা,অহেতুক কোনো কথা নেই।
যাকে যেটা জিজ্ঞেস করি সুন্দর করে উত্তর দেয়।
না বুঝলে দাড়িয়ে প্রশ্ন করে।এককথায় পড়াশোনার প্রতি ভীষণ সিরিয়াস ওরা।
ওদের দেখাদেখি আমার ছেলেটাও শিখেছে।
সবকিছু টাইম মতো করতে পারে।
কদিন যাওয়ার পর হঠাৎ আমাদের এক শিক্ষক গুরুতর অসুস্থ হয়ে বিছানাগত হয়ে গেলের।একপ্রকার চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো।
বাচ্চাদের তখন বার্ষিক পরিক্ষার আর কদিন মাত্র বাকি।ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হলাম আমরা।
এই অসময়ে ভালো টিচার কোথায় পাই?
যাকে-তাকে এই এতিমখানার টিচার করা যেত না।এতিম বাচ্চা দেখে অনেকে অবহেলা সহ পড়ানোতে তাল দিত না ঠিক মতে।আবার অনেকে বাচ্চাদের খামাখা ধমক,মা*র ও দিত সুযোগ পেয়ে।
তাই এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষক পরিচিত এবং দেখেশুনে আগে একমাস আচার-ব্যবহার লক্ষ্য করে নেওয়া হতো।
প্রতিটি শিক্ষক বাচ্চাদের তাদের নিজের সন্তানের মতো ট্রিট করতো।
ভালো একজন শিক্ষক আনা সময়সাপেক্ষ।
খোঁজ নিয়ে তেমন কাউকে পায় ও নি।এদিকে ক্লাস বাদ গেলে বাচ্চাদের ক্ষতি।
বাধ্য হয়ে আমিই নিয়মিত ওদের ক্লাস নেই পরিক্ষার আগের কদিন।যেহেতু আমার ধারণা ছিল এ বিষয়ে।
যথাসাধ্য চেষ্টা করি ওদের সাহায্য করতে।
পড়ানো বিষয়ে দূর্বল বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেই।হাতে-কলমে শেখাই।ভুল হওয়া বিষয় গুলো বারবার চেষ্টা করাই।
ঐবার পরিক্ষাতে ঐ বিষয়েই বাচ্চারা সবচেয়ে ভালো করে।একপ্রকার রেকর্ড ভাঙে।প্রতিটি বাচ্চাই এতো ভালো রেজাল্ট করে যে সবাই অবাক হয়।
পারভীন আপা আমায় প্রস্তাব দেন শিক্ষক পদটা নিতে।দু-ঘন্টার দুটো ক্লাস মাত্র।
আমাকেই পড়িয়ে দিতে বলেন।
প্রথমে আমি রাজি হইনি।কেননা ততোদিনে এতিমখানার বহু দায়িত্ব আমার ওপর।ভেবেছি সব একত্রে সামাল দিতে পারবো না।
ক্লাস গুলো আমি ভালোভাবে নিয়েছি ঠিক আছে,তবে তা একান্তই শখ হিসেবে।
প্রকৃত অর্থেই যদি শিক্ষক পদে আমি যোগদান করি কাধে বড়ো একটা দায়িত্ব পড়বে।
আমি কী পারবো সব সামলাতে?
এছাড়াও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা।যোগ্যতা নিয়ে নির্বাচন হয়।সেখানে আমি খুবই কম শিক্ষিত।কোনো ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট নেই আমার।
আপাকে বিষয়টা বললে তিনি বলেন,’যা তুমি পারবে সেটাই তোমায় দেওয়া হচ্ছে।এমন কিছুর অফার তুমি পাওনি যেটার যোগ্য তুমি নও।
এছাড়াও তুমি পরিক্ষা দিয়েছো।কদিন পড়িয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছো।আমরা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়,ভালোবাসার ও।
যেই ভালোবাসা তুমি ওদের দিতে পারছো,সেটা আর কেউ পারবেনা।
ভালোবাসা দিয়ে সব সম্ভব।
ওরা এতিম বাচ্চা।আমরা চাইলেই কিন্তু যেমন তেমন শিক্ষক আনতেই পারি।কিন্তু আনিনা কেন জানো?
আমরা চাই প্রতিটি শিক্ষক ওদের কাছে শিক্ষক কম মা-বাবা হোক।যিনি শাসন কম ভালোবেসে শেখাক।
এতিমের মনে কষ্ট দিয়ে কিছু করতে চাইনা আমরা।এতে পড়াশোনা না হলে না হোক।তবুও ওরা ভালো থাক।
আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।যথাসাধ্য আমরা তোমায় সাহায্য করবো।
আপার কথায় ভরসা পেয়ে শিক্ষক পদে নিযুক্ত হই।
বাংলা বিষয়ে পড়াই আমি।তাও ছোট বাচ্চাদের।
মনে খুতখুত থেকে যায় তবুও।ভাবি সঠিকটা শেখাতে পারছি কিনা।
আপাকে বলে একটা ট্রেইনিং সেন্টারে ভর্তি হই আমি।বাংলা বিষয়েই আরো জ্ঞান অর্জন সহ আরো কিছু শিখি সেখানে।
একটা সার্টিফিকেট ও পাই।
আমার বেতন ধরা হয়।
দুই কাজেরই ভালো অঙ্কের টাকা আসে।এ যেন সোনায় সোহাগা!
টাকা দিয়ে আমি আমার এতিমখানার জন্য বিভিন্ন জিনিস কিনতাম।কখনো পানির ফিল্টার,কখনো একাধিক জগ-গ্লাস সেট।
আপা ভীষণ বকা দিত আমায়।
বলতো টাকা গুছিয়ে রাখতে।আপার চাপে পড়েই টাকা গোছাতাম আমি।
এভাবেই বেশ কয়েক মাস পার হওয়ার পর ব্যাংকে আমার বেশ কিছু টাকা হয়।
আপা বলেন একটা ছোট জায়গা ক্রয় করে রাখতে।
আমি বলি,”জায়গা কিনে কী হবে?আমি কী এখান থেকে যাবো নাকি!
আমি সারাজীবন এখানেই আপনার কাছে,বাচ্চাদের কাছে থাকতে চাই।ওসব জায়গা-বাড়ির প্রয়োজন আমার নেই।আপনারা থাকলেই আমার চলবে।”
“আবেগী কথা বলোনা তন্নি।আমাদের সবার একটা বাড়ি আছে।এতিমখানা ছাড়াও একটা ঠিকানা আছে।তোমার কী আছে?
কাল যদি এতিমখানা না থাকে কোথায় গিয়ে উঠবে?
নিজের একটা ঠিকানা তৈরি করো।প্রতিটি মানুষের মাথার ওপর একটা ছাদের দরকার হয়।তোমার ও প্রয়োজন আছে।
ছেলে-মেয়ে নিয়ে সারাজীবন এখানেই থাকবে পারবে?
বুড়ো হলে কোথায় যাবে?
বাচ্চারা বড়ো হয়ে কিছু করতে চাইলে কোথায় নিয়ে উঠবে ওদের?
সুতরাং জমিটা কিনে রাখো।
নিজের জন্য না হোক বাচ্চাদের কথা ভেবে কিনে রাখো।”
ঐদিনই জমির বায়না দিয়ে আসি আমরা।
কিছু টাকা কম ছিল।আপা দিয়েছে।বলেছে ধীরে ধীরে শোধ করে দিতে।
জমির বায়না দিয়ে আসার পথে আপা বলেন,”পরেরবার বাড়ির কাজে হাত দেবে।সুন্দর একটা বাড়ি করবে।
আমার জন্য একটা ঘর রাখবে।
মাঝেমাঝে দু-বোনে গিয়ে সেই ঘরে বসে গল্প করবো।রাতে একসঙ্গে সবাই থাকবো ঐ ঘরে।”
আমি সায় দেই আপার কথায়।
আমার এই ছোট্ট জীবন একাধারে দুঃখ যেমন সয়েছি,সুখ ও পেয়েছি।
সুখটা হুট করে এলেও স্থায়ী হয়েছে।
ছেলে নিয়ে খুব কষ্ট করেছি একসময়।লোকের এঠো-বাসি অব্দি খেয়ে দিন পার করেছি।কতো জনের কটু কথা শুনেছি।
যেই আমি একসময় একটা কাজের জন্য লোকের দারে দারে ঘুরেছি সেই আমি আজ কতো বড়ো কাজে যুক্ত।
পেটের ক্ষিদে সহ্য করে দিনের পর দিন পার করেছি।সেই আমি আজ মাসে একবার করে ফকির খাওয়াই সম্পূর্ণ নিজ টাকায়।সঙ্গে দান-সাদকা তো আছেই।
এমনই এক বিকেলে রাস্তায় একটা ভিখারির দেখা পেলাম।
একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম।ফেরার পথে ভিখারীটা হঠাৎই আমার সামনে এসে দাড়ায়।কিছুটা ভয়ই পেয়েছি।
আমার হাতে তখন খাবারের বড়ো একটি ব্যাগ।এতিমখানার সব বাচ্চাদের জন্য সিঙ্গারা কিনে নিয়ে যাচ্ছিলাম।বাইরে গেলেই ওদের জন্য কিছু না কিছু কিনতাম আমি।ফিরে গিয়ে সবাই মিলে ভাগ করে খেতাম।
সেই ভিখারিটি টাকা চায় আমার থেকে।
ব্যাগ থেকে খুচরো পঞ্চাশ টাকা বের করে যেই না হাতে দেব ওমনি চেহারাটা ভালোভাবে নজরে আসে।
এটাতো আমার বড়ো ভাই।
তাকে দেখেই ‘ভাই’ বলে ডাকি আমি।
ভাই কিছুপল আমার দিকে তাকিয়ে চিনতে পারে।
আমি আর আগের মতো নেই।ভালো চাকরি করি।বাইরে যেতে হয়,মিটিং এ থাকতে হয়।
সুন্দর পোশাক পড়ি।গুছিয়ে চলি।আগের সেই এলোমেলো তন্নি আর নেই আমি।তাই হয়ত চিনতে পারেনি।
ভাই বলেন,”এটা কী তুই তন্নি?আমাদের তন্নি?”
আমি ‘হ্যা’ সূচক উত্তর দিতেই ভাই দেখি বিষ্ময়ে আমায় দেখছে।
বলি,”এ অবস্থা কেন তোমার?কী হয়েছে?রাস্তায় কেন তুমি?”
তিনি আক্ষেপের স্বরে বলেন,”তোর ভাবি পাশের বাড়ির প্রতিবেশি নিয়ে পালিয়েছে।
ছেলে-মেয়ে সবাই মায়ের সঙ্গে চলে গেছে।
আসলে সংসার অভাব লেগে গেছিলো।সবই আমার দোষে রে বোন।লোভে পড়ে সুখের সংসার ধ্বংস করেছি।
যেইখানে কাজ করতাম,মালিক পক্ষের অনেক টাকা চুরি করে পালিয়েছিলাম।তোর ভাবিও সঙ্গে ছিল।
কথায় আছেনা,পাপ বাপকেও ছাড়েনা।আমার হয়েছে তাই।পালিয়ে শহরে গেছিলাম।তোর ভাবি সেখানে পরকীয়া করে সব টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।
পথের ফকির বানিয়ে দিয়ে গেছে আমায়।
শহর থেকে গ্রামে ফিরে এলে মালিক ধরে পুলিশে দিয়েছিল।জেল খেটে বাহির হয়েছি।ছোটভাই আর জায়গা দিল না বাড়িতে।বের করে দিয়েছি।
কাজ খুঁজেছি পাইনি।
পেটের দায়ে তাই ভিক্ষা করেই খাই।”
“দেখলেতো ভাই,কর্মের ফল অবশ্যই ভোগ করতে হয়।
তোমার করুণ অবস্থার জন্য তুমি নিজেই দায়ী।সৎ পথে চললে এমন হতোনা।
সৎ পথে চলে জীবনে একটা সময় দুঃখ থাকলেও সুখ পাওয়া যায় একসময়ে।
শুধু ধৈর্য্যর দরকার।
তোমায় দেখে মায়া হচ্ছে।মানুষ তো আমি!
কাজ করবে?আমি একটা কাজ দিতে পারি।তবে সৎ ভাবে করতে হবে।যদি এদিক-সেদিক কিছু দেখি,আবারো পথে নামতে হবে।”
ভাই একগাল হেসে বলেন,”ঐসব আর হবেনা বোন।বউ বাচ্চার জন্য করেছিলাম সব।
দিন শেষে ওরাই যখন প্রতারণা করলো,তখন বুঝলাম পৃথিবীতে সবাই টাকার পাগল।
তুই কাজ দে।আমি করে খাই।বিশ্বাস রাখ।”
ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এতিমখানার দিকে এলাম।আমার বিষয়ে সবটাই বললাম।সব শুনে তিনি তো ভীষণ অবাক।
এক মুদিখানার দোকানে নিয়ে গেলাম।মূলত এই দোকানে একজন কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল।দোকানদার ভাই নিজেই বলেছিল আমায়।
পরিচিত কেউ থাকলে যোগাযোগ করিয়ে দিতে বলেছিল।
উনার দোকান থেকে জিনিস কিনি প্রায় প্রায়।সেই সুত্রেই পরিচয়।
ভাইকে কাজে রাখার কথা বললে রাজি হয় তিনি।
বেতন অল্প হলেও থাকা খাওয়া ফ্রী।
বড়োভাই কাজ পেয়ে মহা খুশি।
আমায় বার বার ধন্যবাদ জানায়।
আমি চলি আসি নিজ কাজে।বলে আসি মন দিয়ে কাজ করার কথা।
চাইলে আমি এই মানুষটাকে নিজের সঙ্গে রাখতে পারতাম আলাদা ব্যবস্থা করে দিয়ে।
এর মতো দশজনকে পালার ক্ষমতা আমি তন্নি রাখি।
কিন্তু রাখলাম না কেন জানেন?
আমি চাইনা অতীতের সঙ্গে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখতে।
অতীত যতোবার আমার জীবনে এসেছে কষ্টই পেয়েছি।
বহু কষ্টে সব ভুলেছি।নতুন করে শুরু করেছি।
এবার একটু ভালো থাকতে চাই।হই না তাতে একটু স্বার্থপর।
চলবে।