বড়ো আপা পর্ব-০৪

0
92

#বড়ো আপা
#পর্ব-৪
#শারমিন আঁচল নিপা

আমার শ্বাশুড়ি আমার শরীর থেকে তাদের দেওয়া সকল সোনার গহনা খুলতে নিচ্ছিল। আমি নমনীয় গলায় উনাকে জিজ্ঞেস করলাম

“মা এগুলো খুলছেন কেন?”

সোজাসাপটা উত্তর উনার

“এগুলো তুমি সামলাতে পারবে না। আর এগুলো আনজুমানের। আনজুমানের গহনা দিয়ে তোমাকে তুলে এনেছি। আনজুমানের গহনা তো আনজুমানকে দিতে হবে তাই না! আনজুমানের গহনা তো তোমার রাখা অন্যায় তাই না?”

আনজুমান আমার ননাসের নাম। আমি কিছুটা অবাক হলাম শ্বাশুড়ির কথা শুনে। কারণ ২০ ভরি স্বর্ণ বাবদ তারা ৫ লাখ টাকা কাবিন উসুল করেছে। যদি ৫ লাখ টাকা কাবিন তারা উসুল করে তাহলে তো এ স্বর্ণগুলো আমার থাকার কথা। আনজুমানের কেন হবে? বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য আমি জিজ্ঞেস করলাম

“মা আমার কাবিন যদি এ স্বর্ণবাবদ উসুল হয় তাহলে তো এটা আমার স্বর্ণ। আপুর তো না। যদি আপুর স্বর্ণই হবে তাহলে কাবিন তো উসুল দেওয়া ঠিক হয়নি। কাবিন তো আমার হক। আর আপনাদের এত বাড়ি, গাড়ি সব আছে আমাকে আলাদা করে গহনা কিনে দিলে তো টাকায় টান পড়ত না। এ এলাকায় এক নামে আপনাদের সবাই চিনে, জানে। তাহলে আমাকে এভাবে কেন ঠকানো হলো?”

আমার শ্বাশুড়ি আমার কথা শুনে কপাল কুচকালো। মুখ অবয়ব বুঝাচ্ছে তিনি খুব রেগে গেছেন। রাগী গলায় বলে উঠল

“এ লোভ কেন তোমার? বাপ জনমে তো দেখো নি এমন স্বর্ণ। তাই লোভ ছাড়তে পারছো না!”

“লোভ কেন হবে মা? এটা তো আমার অধিকার আর হক। আপনি কী জানেন না কাবিন উসুল করতে হয় যদি না স্ত্রী ক্ষমা করে। আমি তো আমার কাবিন বাবদ এগুলো পেয়েছি। তাহলে এগুলো তো আমারেই। আমার জিনিসে আমি চায়লে লোভী কেন হব?”

আমার এ কথা শুনে শ্বাশুড়ি আরও ক্ষেপে গেলেন। বিলাপ জুড়ে চিৎকার শুরু করলেন।

“দীপু রে কী অজাত, বেয়াদব আর লোভী মেয়ে বিয়ে করে এনেছিস? কথায় কথা কৈফিয়ত চায়। এই বুঝি বউয়ের দাসী হয়ে থাকার জন্য বিয়ে করলি। বেছে বেছে এ বেয়াদবটাকেই তোর পছন্দ হলো। দীপু রে…. শেষ জীবনে এ বউ তো পাতে ভাত দিবে না। যে লোভ তোর বউয়ের সব একাই ভোগ করবে। আর বাপের বাড়ি পাচার করবে। এজন্যই বলছিলাম জাতের মেয়ে কালো ভালো। বিয়ে করেছিস কুজাত পরিবারে। বয়স কম মেয়ে বিয়ে করিয়েছিলাম যা বলব তাই শুনবে। এই মেয়ে তো কথা শুনেই না, উল্টো কথা শুনিয়ে দেয়। কী আনলি রে পুত? আমার জীবনের কষ্টটা শুরু করলি রে পুত। তোরে ১০ মাস ১০ দিন পেটে ধরছিলাম রে পুত, আজকের এ দিন দেখার লাইগা।”

আস্তে আস্তে শ্বাশুড়ির বিলাপ বাড়তে থাকে। চিৎকারের আওয়াজ বাড়তে থাকে। আমি হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিলাম তাদের আচরণ দেখে। আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। এ জীবন তো আমি চাই নি। আমি চেয়েছিলাম একটা স্বাধীন, সুখী জীবন। যেখানে আমারও মতের মূল্য থাকবে। আর আমি তো অন্যায় কিছু বলছি না। তাহলে এমন করে কেন বলা হচ্ছে?

উনার চিৎকার শুনে ননাস, নানাসের জামাই ছুটে আসলো। ননাস কাহিনি না জেনেই কান্না জুড়ে দিয়ে বলল

“এই মেয়ে এসেছে একা সংসার করতে সবাইকে নিয়ে না, মা। তোমার সাথেও বেয়াদবি করেছে। মা ভাই এ মেয়ের জন্য মনে হয় আমাদের পর করে দিবে। এ বাড়িতে আর আমরা থাকতে পারব না মা। আমাদের জীবনটা শেষ করতেই এই মেয়ে এসেছে। আমাদের ভাইয়ের সাথে সংসার করতে নয় বরং কেড়ে নিতেই এ মেয়ে এসেছে।”

ননাসের জামাই তাতে আরও ঘি ঢেলে বলল

“ছোটো জাত বিয়ে করলে তো এমন হবেই। কতবার বলেছিলাম সুন্দর দেখে ভুলো না, বংশ দেখে বিয়ে করো। আমার বোনটাকে বিয়ে করলে আজকে এ দিন দেখতে হত না। শালা বাবু এখানেই করবে। রূপে ডুবে গেছে নাকি বাড়ির লোক কবিরাজ ধরে জাদুটোনা করেছে কে জানে। বড়োলোক ছেলে পেয়ে হয়তো কুফুরি করে বশ করেই বিয়ে করেছে। আর সংসারে এসেই সব হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।”

সবার চেঁচামেচি দেখে দীপক ছুটে আসলো এবার। এদিকে আমার নানাস আর শ্বাশুড়ি আহাজারি করতেই লাগল। আমার ননাসের জামাই তাদের স্বাত্বণা দিচ্ছে। মরা কান্না লেগে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি ভীষণ বড়ো ভুল করে ফেলেছি। যেটা করা আমার কাম্য নয়। এতটুকু সাধারণ কথায় এত জল গড়াবে কে জানত। দীপক এসেই সবাইকে প্রথমে ঝারি দিয়ে বলল

“তোমরা কন্না থামিয়ে বলো কী হয়েছে?”

ননাস আর ননাসের জামাই থেমে গেল। শ্বাশুড়ি কান্না গলায় আবেগী কণ্ঠে বলে উঠল

“বউ এর গয়না গুলো খুলতে বলছিলাম। এত ছোটো মেয়ে এত গহনা তো সামলাতে পারবে না। সে আমাকে বলতেছে এটা তার হক এটা খুলে সে দিবে না। এটা তার বাপের বাড়িতে রাখবে। কাবিনে উসুল দিয়েছিস বলে এটা নাকি দেওয়া যাবে না।”

গুরুজনের মুখে এত বড়ো মিথ্যাটা আমি মেনে নিতে পারলাম না। তাই আবারও মুখের উপর বললাম

“আপনার মা মিথ্যা বলছে। আপনার মা বলছে এ গহনাগুলো নাকি আপনার বোনের। আমি বলেছি যেহেতু এটা আমার কাবিনে উসুল দিয়েছে তাহলে গহনা গুলো তো আমার। আপুর কেন হবে? আপনার মা বলছে আমি লোভ করছি। আমি তাকে বলেছি নিজের জিনিসে কেউ লোভ করে নাকি। এতেই উনি কান্না জুড়ে দিয়েছেন। উনি যদি আমাকে বলত উনি গহনা গুলো তুলে রাখবেন তাহলে তো আমি দিয়ে দিতাম। আপার গয়না বলাতেই তো এত কাহিনি হলো।”

দীপক আমার কথা শুনে আমার মাথার তালুর কয়েকটা চুল ধরে বলল

“মা যদি বলে থাকে এগুলা আনজুমান আপার গয়হা তাহলে তাই। তোকে বিয়ে করে ভালো মন্দ খেতে পরতে দিব এটাই তো বেশি। আসার পর থেকেই আমার পরিবারকে অপমান করছিস। তোর রূপে ভুলে তোকে বিয়ে করে দেখছি চরম ভুল করেছি। আমার মা বোন যা বলবে তাই হবে। এ বাড়িতে যদি সবকিছুর উপর কারও অধিকার থাকে সেটা আমার মা আর বোনের। মনে রাখবি তোকে তাদের দাসী বানানোর জন্যই এনেছি। নাহয় এত গরীব ঘরে বিয়ে করতাম নাকি! এরপর আর কোনো কথা শুনলে মুখটা ফাটিয়ে দিব।”

কথাগুলো বলে তার হাতে মুষ্টিবদ্ধ তালুর চুলগুলো ছাড়ল। তারপর হনহনিয়ে বাইরে চলে গেল। এদিকে শ্বাশুড়ি বিজয়ের হাসি দিয়ে বলল

“আমার ছেলেকে তো কেড়ে নেওয়া এত সহজ না। বেশি কথা বললে আমরা একদম বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিব। এরপর দেখব কে বিয়ে করে। একে তো বাপের কিছু নেই তারপর ডিভোর্সী মেয়ে কে বিয়ে করবে?”

আমি নিশ্চুপ হয়ে কথা গুলো কেবল শুনছিলাম। একে একে আমার সকল গহনা খুলে নেওয়া হলো। সাদা শাড়ি পরেছি তার মধ্যে শরীরে গহনা নেই। আমাকে পুরো বিধবা লাগতেছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম কেবল। আমার ননাস ভেঙচি কেটে তার জামাইকে নিয়ে চলে গেলো। আমার শ্বাশুড়ি আর কিছু বলল না। মুখটা বাঁকা করে চলে গেল।

রুমে বসে আছি আমি। আজকে আমার বাসর ঘর। এ দিনগুলো নিয়ে মেয়েদের কত স্বপ্ন থাকে। বয়সে বড়ো একজনকে মেনে নিয়েছিলাম। সবাই বলেছিল বুড়ো জামাই হলে জামাই সোহাগী হবি। তবে বাস্তবতা অনেক কঠিন আর নিষ্ঠুর। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আমি কাঁদতে লাগলাম। গালটা টনটন করে ব্যথা করছে। তারচেয়ে বেশি ব্যথা করছে আমার বুকের ভেতর ছটফট করা প্রাণটা। শরীরটা আমার ঝিমিয়ে নেতিয়ে গেছে লাউয়ের ডগার মতো। লাউয়ের ভারে যেমন গাছ নেতিয়ে পড়ে তেমনি দুঃখের ভারে আমিও নেতিয়ে পড়েছি, তলিয়ে গিয়েছি।

হালকা ঘুম চোখে ঝেঁকে বসলো। দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসলো। দীপক ঘরে প্রবেশ করল। তার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। মুখ থেকে একটা বাজে গন্ধ আসতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম নেশা করে এসেছে। তাই আবারও সাহস খাটিয়ে বেয়াদবি করে বললাম

“আজকে আপনার আর আমার প্রথম রাত। এ রাতে যা করেছেন সেটা তো অন্যায় হয়েছে আমার সাথে। গায়ে হাত না তুলেও প্রতিবাদ, শাসন করা যায়। পরিবারের দিকে তাকিয়ে সবকিছু সইয়ে নিলাম। এখন তো আপনার এ অবস্থা দেখে আমি সইতে পারছি না। আপনি নেশা করে ঢুকেছেন ঘরে?”

আমি যেন কথাটা বলে ভীষণ ভুল করে ফেললাম। আর সে ভুলের মাসুল দিলাম অভিনব কায়দায়।

চলবে?

শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার