বড়ো আপা পর্ব-০৬

0
83

#বড়ো আপা
#পর্ব- ৬
#শারমিন আঁচল নিপা

আপার নানী শ্বাশুড়ি আপার শ্বাশুড়ির কাছে এসে তড়িঘরি করে বললেন

“তোদের বউ তো ভালো না। রাতে নেশা করেছে। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নেচেছে। আমি মজা করে দীপুর রুমে উঁকি দিয়েছিলাম। দেখি বউ তো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নেশা করছে৷ আর দেখ রাতে জামাইয়ের সাথে থেকেও সাদা শাড়ি সাদায় হয়ে আছে। কোনো রক্তের দাগ নেই। এই বউ বিয়ের আগে অন্য কারও সাথে রাত কাটিয়েছে। না কাটালে দাগ কোথায় সাদা শাড়িতে। তোদের তো এজন্যই পই পই করে বলেছিলাম বউরে যেন সাদা শাড়ি পরাস। এখন বুঝতে পারছস তো। এ মেয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে।”

হুট করে শব্দ কানে আসলো। আবারও পেছন দিকে তাকিয়ে একই ভাবে কালো বিড়ালটাকে আসতে দেখে মিলিয়ে যেতে দেখলাম। কেন দেখছি এমন বারবার জানি না। চোখটা খুলে যাওয়ায় সে দৃশ্যটাও চোখ থেকে সরে গেছে। তাই খাতাটা আবারও পড়া শুরু করলাম। ঠিক যেখানে আমার স্মৃতিচারণ শেষ হয়েছে সেখান থেকেই। আপা লিখেছে..

নানীর কথা শুনে আমি একদম চুপসে গেলাম। বিয়ের প্রথম রাতে সাদা কাপড় পরানোর সঠিক কারণ আমার সামনে আসলো এ মুহুর্তে । তারা সতীর্থ প্রমাণ করতে চেয়েছে আমার রক্তক্ষরণের মাধ্যমে। অথচ তারা এটা জানে না অনেক মেয়েরেই রক্তক্ষরণ হয় না। কারণ ভারী কাজ, দৌঁড় ঝাপ করে সেটা অনেক আগেই চলে যায়। তবে আমি খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ আমার এমনটা হবার কথা না। কিন্তু আমি শুধু তাদের নোংরা কথা গুলো শুনছিলাম। বাবা, মায়ের সামনে এমনভাবে অপদস্ত হব বুঝতে পারিনি। নিজেকে একটা বন্দী দাসী মনে হচ্ছে। নানীর কথায় নানাস চোখ কপালে তুলে মাকে বলল

“মায়ই এমন দুশ্চরিত্রা মেয়ে গছিয়ে দিলেন। আপনার মেয়ে তো সতী নারী না। আমাদের মুখটা এভাবে পুড়ালেন। এত কলঙ্কীনি মেয়ে গছিয়ে তো মনে হয় হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। বড়োলোক বাড়ি পেয়ে আমার ভাইকে কুফুরি করে দুই নম্বর মেয়ে গছিয়ে দিয়েছেন তাই না? বাহ্ মায়ই পাক্কা খেলোয়ার আপনি। আবার মাফ চাওয়ার নাটক করছেন মা মেয়ে মিলে।”

ননাসের কথা শুনে বাবা উত্তর দিল

“অনন্যা একটু সোজাসাপটা কথা বলে ঠিক, তবে সে খারাপ মেয়ে না। আমার মেয়ের নামে এমন কোনো রটনা রটে নি। ঘটনাও ঘটেনি। ঘটলে তো আমরা জানতাম। আমার নেয়ের প্রেম ভালোবাসাও ছিল না। থাকলে তো ধরা পড়তই। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।”

বাবার কথা শুনে শ্বাশুড়ি তেড়ে গিয়ে বলল

“পোলা নিয়ে শুইলে কী আপনাকে জানিয়ে শুবে নাকি?এ মেয়ে তো সতীই না। অসতী একটা মেয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন। ভাগ্যিস মায়ের কথায় সাদা শাড়ি পরিয়েছিলাম। নাহয় তো এগুলো আড়ালেই থেকে যেত। আবার মেয়ে নেশাও করে। কী ভয়ানক মেয়ে গছিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ আমার পোলার কপালে কোন পাপের ফল হিসেবে এ মেয়ে দিছে আল্লাহ ভালো জানেন।”

এদিকে শ্বাশুড়ির কথা শুনে মা আমার কাছে এসে বলল

“এমনে আমাদের মুখ না পুড়াইলেও পারতি। কী দোষ করেছিলাম তরে পেটে ধরে? এত বি/গার তোর বিয়ের আগে শুইতে হলো? বলতি তোর বি/গার উঠছে আমরা বিয়া দিয়ে দিতাম। এহন বুঝতাছি তুই কেন প্রথমে বিয়েতে রাজি হচ্ছিলি না। তোর নাগরের লাইগা। তোরে জন্ম দেওয়ায় আমার পাপ। নাহয় এ দিন দেখতে হত না।”

আম্মার মুখে এ কথাগুলো শুনে আমি একদম চমকে গেলাম। রাতারাতি নিজের মায়ের বদলে যাওয়াটা আমি মানতে পারছি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে মা গিরিগিটির মতো রূপ পাল্টাচ্ছে। সেটা আমি কল্পনাতেও কল্পনা করতে পারছিলাম না৷ সবার কথায় এবার অপমানিত হয়ে সবার সামনেই গায়ের কাপড় খুললাম। শরীরে কেবল ব্লাউজ আর পেটিকোড পরা। এরপর শাড়ির ভাজের ভেতরে থাকা রক্তের দাগ দেখিয়ে বললাম

“এই যে আমার সতীর্থের প্রমাণ। আপনারা না জেনে, না বুঝে কত নোংরা কথা বললেন। আমি অসতী না। সকালে আর কোনো শাড়ি পাচ্ছিলাম না। এটাতেও রক্ত লেগে ছিল তাই রক্তটা ভাজে রেখেছিলাম যাতে করে বুঝা না যায়। চক্ষু লজ্জা তো আমার আছে তাই না। আর নানী আপনার এত বয়স হলো আপনার মতো মানুষ এ বয়সে অপবাদ দিলেন যাচাই না করেই। আরে রক্ত ক্ষরণ সব মেয়েদের হয় না। পড়াশোনা জানলে আপনাদের হাল এ হত না। আল্লাহ আপনাদের হেদায়াত দিক।”

কথাটা বলে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। শাড়িটা মুড়িয়ে রুমে আসলাম। ছুটকিও আমার পেছন পেছন আসলো। তাকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ কাঁদলাম। একটু শান্তি লাগছে। দুনিয়াতে এ অবুঝ বোনটাকেই আমার আপন মনে হচ্ছে। বাকিদের মনে হচ্ছে চরম স্বার্থপর। আমি রুমে আসার পরও আমার দোষ কমে নি। নানী জোরে জোরে বলে উঠলেন

“কত বেলাজ মাইয়া সবার সামনে শাড়ি খুইলা ফেলাইলো। আরে তুই সতী আমারে টেনে ঘরে নিয়েও তো শাড়ি খুলতে পারতি। সবার সামনে খুললি কেন। ন্যাং/টা মেয়ে মানুষ। আবার পড়ালেহার দৌড় দেহায়। পড়ালেহা করে তো বে/শ্যা হয়েছে। এ মেয়ে তো চরম বেয়াদব। ”

বাবা আর মা কেবল মাথা নীচু করে ছিল। আমার শ্বাশুড়ি এবার পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে বলল

“বাদ দিন বেয়াই, বেয়াইন। বিয়ে বাড়িতে এরকম একটু আধটু হয়েই। শুধু মেয়েকে বলে যাবেন যেন মুখের চাপা কমায়। তাহলেই টিকতে পারবে। আমরা সহজ সরল মানুষ। এসব তর্ক পছন্দ করি না। শান্তিতে থাকতেই ভালোবাসি। আপনার মেয়েকে আমি আনজুমান কে যে চোখে দেখি সে চোখেই দেখি। বাড়ির আশপাশ ঘুরে দেখুন। কত বড়ো বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিছেন দেখুন। আসলে আপনার মেয়ের রাণী কপাল তাই আমার ছেলের সাথে বিয়ে হয়ছে। কয়টা মেয়ের এ ভাগ্য হয়। আমার ছেলে নেহাত আপনার মেয়েকে পছন্দ করেছে তাই। যাইহোক আপনারা ঘুরে দেখেন। আমি একটু কাজে গেলাম। দুপুরে মেহমান আসবে। বউকেও তো সাজাতে হবে। দীপুকে ফোন দিতে হবে তৈরী হওয়ার জন্য। সে আবার একটু বাইরে গেছে।”

সেখান থেকে সবাই যার যার কাজে গেলেন। ছুটকি আমার পাশেই বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জানি না সে কী ভাবছে। তবে ওকে বলতে মন চাচ্ছে৷ বড়ো হয়ে তোর বোনের সাথে যারা অন্যায় করছে তাদের শাস্তি দিস। মন দিয়ে পড়াশোনা করে অনেক বড়ো হয়ে বিয়ে করিস বোন। তোর কপালে কী আছে আল্লাহ ভালো জানেন। তোকে আগলে ধরে বাঁচতে ইচ্ছা করে।

ঘরে দুজন মহিলা প্রবেশ করল শাড়ি আর গহনা নিয়ে। আমাকে সাজানোর জন্য। ছুটকি কে বের করে দিল তারা। আমাকে শাড়ি খুলে ঐ শাড়িটা পরাতে নিল তারা। তাদের চোখে আমার শরীরের দাগ গুলো পড়াতে হাসতে লাগল আর বলতে লাগল

“জামাইয়ের সোহাগ তো সারা শরীরে লেপ্টে গেছে।”

আমি আর বলতে পারছি না এটা সোহাগ না, বিক্ষত হওয়া যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা আমাকে প্রবল কষ্ট দিচ্ছে। আমি আর পারছি না সইতে। তারা শাড়ি পরিয়ে আমাকে সাজাতে নিলে গালে হাত দিয়ে বলল

“চরের দাগ নাকি আদরের দাগ। বউ তোমাকে কী তোমার জামাই মারছে?”

আমি কিছু বললাম না। এক ফোটা জল শুধু গড়িয়ে পড়ল। আমার এ জলটায় তাদের উত্তর দিয়ে দিল। তারা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল

“এজন্যই আগের দুটো বউ চলে গেছে দীপুর।”

সম্পর্কে তারা দুসম্পর্কের চাচী শ্বাশুড়ি হয়। ঢাকায় থাকে তারা। দীপকরাও আগে ঢাকা থাকত। গ্রামে এসেছে অনেকদিন হলো। তবে দীপক আগে বিয়ে করেছে এ ব্যাপারটা কেউ কখনও বলেনি। তাও আবার একটা না দুটো। আমার বুকে একটা মোচড় দিল। আমি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

“চাচী আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কী বলছেন? দীপক আরও বিয়ে করেছে মানে? দুই বউ চলে গেছে মানে?”

এরপর তারা যা বলল তা শুনে আমার শরীর হিম হতে শুরু করল। বৈদ্যুতিক শক যেন আমার শিরায় লেগে কাঁপুনি দিচ্ছে এমন অনুভূতি হচ্ছে।

কপি করা নিষেধ। অনুমতি ছাড়া কপি করলে এ বিরুদ্ধে আমি স্টেপ নিব।

চলবে?

শারমিন আক্তার
শারমিন নিপা