বড়ো আপা পর্ব-২৩+২৪

0
113

#বড়ো আপা
#পর্ব-২৩
#শারমিন আঁচল নিপা

কিন্তু অফিসার মাহিদ বলে উঠলেন

” এ কাবিন নামা সত্য। আর উনিই অনন্যা। দুজনের হাতের ছাপ মিলে গেছে। দীপক সাহেব অনন্যা মরেনি। সে বেঁচে আছে। আর এটাই আসল কাবিননামা। সে সময় আপনারা কোন মেয়েকে অনন্যা বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন এটা আমার জানা চাই। আমি অবশ্যই পুরনো ফাইল খুলব।”

আনজুমান, অফিসার মাহিদের কথা শুনে হা করে আছে। আনহারি আনজুমানকে বলে উঠল

“হা করে থাকিয়েন না, মশা ঢুকে পড়বে।”

আনজুমান তার ঠোঁট দুটো গুটিয়ে নিল। আনজুমানের স্বামী এখনও রান্না ঘরে । ভয়ে সে এদিকে আর আসছে না। আনজুমানের মতো আমার ভেতরটাও কেঁপে উঠল। তার মানে আনহারিই অনন্যা। আমি কী বলব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। অফিসার মাহিদ দীপক ভাইয়াকে আবার বলল

“যেহেতু প্রমাণ হয়েই গিয়েছে এই মেয়ে অনন্যা। সেহেতু এ বাড়িতে সম্মান মতো থাকার অধিকার তার আছে। আর আপনারা তালাক দেওয়ার ডকুমেন্টস যেহেতু দেখাতে পারছেন না সেহেতু আইন অনুযায়ী এখনও আমরা ধরে নিব আপনাদের তালাক হয়নি। এ বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে কোনো পদক্ষেপ নিলে সরাসরি আমার কাছে যাবেন। আর অনন্যার যদি এখানে থাকা অবস্থায় কিছু হয় তাহলে সেটার জন্য কঠোর জবাবদিহি আপনাদের করতে হবে। আজ আমি উঠলাম পরে আবার দেখা হবে।”

অফিসার মাহিদ চলে গেলেন। যাওয়ার সময়টায় আমার ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল জোড়বদ্ধ কোনো জিনিসকে আলাদা করা হচ্ছে। যাদের আলাদা করাতে এক পক্ষ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, আরেকপক্ষ মুক্তি পাওয়ার নেশায় খুশি হচ্ছে।

অফিসার মাহিদ চলে যাওয়ার পর আনহারি রুমে প্রবেশ করল৷ আমি এবার আনহারির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই কী এটা অনন্যা? যদি অনন্যা হয় তাহলে আনহারির হাতের ছাপের সাথে কীভাবে ম্যাচ হলো? আর যদি আনহারি হয় তাহলে অনন্যার হাতের ছাপের সাথে কীভাবে ম্যাচ হলো? দুটো আলাদা মানুষ, আলাদা জায়গায় জন্ম। তাদের সবকিছু তো এভাবে মিলে যাওয়ার কথা না। আমার তাকিয়ে থাকা দেখে আনহারি বলে উঠল

” আমার সাথে অনন্যার ফিংগার প্রিন্ট কীভাবে ম্যাচ হয়েছে সেটাই ভাবছো তো? আমি অনন্যা কি’না আবার মনে প্রশ্ন ঝেঁকে ধরেছে তো?”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম

“প্রশ্ন তো অনেক কিছুই আছে। সব প্রশ্নের উত্তর তো মিলছে না। আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো আপনি সত্যিই অনন্যা নাকি আনহারি?”

“আমি আনহারি। অনন্যাকে আমি চিনতাম না। অনন্যা সম্পর্কে জেনেছিলাম লন্ডনে একজন ছেলের মুখে। আমার বাসায় আমার একটা পেইন্ট করা ছবি দেখলে না? অথবা তুমি যে আমাকে পেইন্ট করা ছবি দেখিয়েছিলে তোমার বোনের মনে আছে?”

“হ্যা আছে তো। একই পেইন্টের ছবিটা আপনার বাসায় দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। সে ছবিটার কাহিনি তো আপনাকে আমি বলেছিই। কিন্তু কোনোভাবেই আমি রহস্যের গোলক ধাঁধা থেকে বের হতে পারছি না। আমাকে একটু বলুন আপনি কে? বারো বছর আগে কে মারা গেছে, আবার দুই বছর আগে কে মারা গেছে? সব মিলে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে হরর ফিল্মের রহস্যের গোলকে আমি আটকে গেছি। কেউ কাট ও বলছে না আর আমি এ রহস্য থেকে বেরও হতে পারছি না।”

“রিলাক্স হও। ঐটা অনন্যার ছবি। আমি এ ছবিটা দেখেছিলাম লন্ডনের একটা ছবি প্রদর্শনীতে। সেখানে অনেক ধরণের ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছিল। আর চড়া দামে সেগুলো চায়লে কেউ কিনতে পারত। এ ছবিটা সেখানের বেস্ট ছবি হিসেবে ঘোষিত হয়। আমি সে জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। নিজের ছবি ঐ জায়গায় দেখে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। এটা কী করে সম্ভব তাই ভাবছিলাম। একদিকে ভালো লাগছিল অপর দিকে রাগও লাগছিল। কারণ পারমিশন ছাড়া আমার ছবি প্রদর্শন করায়। আমি সেখানে ক্লেইম করি বিষয়টি। সাথে সাথে ছবির আর্টিস্টকে আনা হয়৷ উনার নাম বিভোর। দেখতে আট দশটা সাধারণ ছেলের মতো। খুব একটা লম্বা নয়। আবার আহামরি সুন্দর নয়। তবে সুদর্শন। জানো তো সুন্দর আর সুদর্শনের মধ্যে বেশ তফাৎ আছে। ছেলেটি দেখতে বেশ মানানসই ছিল।

উনি আসার পর আমাকে দেখে চমকে যান। আমি উনাকে দেখা মাত্রই সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম

” আমার পারমিশন ছাড়া আমার ছবি কেন প্রদর্শন করেছেন? আমার পারমিশন ছাড়া আমার ছবি অঙ্কন করাও তো আপনার অপরাধ।”

তখন সে জানায় সে অনন্যা নামের একটি মেয়ের ছবি একেঁছে। ছবিটি তার বাল্যকালের এক বন্ধুর। সে তাকে ভীষণ পছন্দ করত। সে ভালোবাসার ব্যকুলতার জন্যই এ ছবিটি সে এঁকেছে। সে তার ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্যই ছবিটা এখানে এনেছে।

বিষয়টি একদম আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তখন সে তাদের স্কুলের কিছু ছবি দেখায় আর সেটাতে অনন্যাও উপস্থিত ছিল। সে সময় মাকে কল দিয়ে বিষয়টি জানালে মা জানায় আমার কোনো জমজ বোন নেই। আমি দেশের বাইরে জন্ম নিই। কারণ আমার মায়ের অবস্থা বেশ জটিল ছিল। তাই চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে রাখা হয়। তখন এটাই ভেবে নিয়েছিলাম একরকম দেখতে সাতজন মানুষ হয় এখানে তো মাত্র একজন পেলাম। আরও পাঁচজন বাকি৷ সেখান থেকে অনন্যার গ্রামের বাড়ির নাম জানি৷ আর সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে না আমি কীভাবে গ্রামের নাম জানলাম? সেখান থেকেই জেনেছিলাম তবে তোমাকে বলা হয়নি৷ প্রথমে তোমাকে বিষয়টি বলিনি কারণ অনেক কিছুই জড়িয়ে ছিল এখানে। আমি আগে সত্যতা বুঝতে চেয়েছিলাম। আজকে তোমার পেরেশানি দেখে বললাম। আমার খুব ইচ্ছা ছিল অনন্যার সাথে দেখা করব৷ তবে যখন দেশে আসলাম তখন অনন্যা মারা গেছে৷ এরপর থেকে আমার দেশের বাইরেই বেশিরভাগ সময় কেটেছে।

এরমধ্যে দেশে আসি। আসার পর আমার এক্সিডেন্ট হয়। এক্সিডেন্ট হওয়ার পর আবার দেশের বাইরে যাই। এবং দেশের বাইরে থেকে ফিরে এসে জানতে পারি নিজের বাবায় আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। জীবন অনেক কিছু শেখায় ফিয়না৷

রহস্যকে উপভোগ করতে শেখো। এই যে আনহারি নাকি অনন্যার যে রহস্যটা তোমার মনে ঝেঁকে বসেছিল সেটা তো এখন দূর হলো? আস্তে আস্তে সকল রহস্যের পর্দা ফাঁস হবে।

তবুও কিছু ধোঁয়াশা আমাকে ধরে বসলো। তাহলে দুই বছর আগে কে মারা গেল? আর চাচার দোকানে ৫ বছর আগে কে গিয়েছিল? অনন্যা আনহারির বাইরেও কী কোনো সত্ত্বা আছে যেটা আমার চোখ আড়াল করে যাচ্ছে। আমি আবারও বলে উঠলাম

“আপার সাথে আপনার এত মিল কীভাবে? আর অনন্যার ফিংগার প্রিন্টের সাথেই বা ম্যাচ হলো কী করে? আর ঐ ছেলেটি কে ছিল? তার এ নাম ছাড়া কী আরও নাম ছিল। তার কী কোনো ছবি আছে?”

আনহারি হালকা দম নিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

“খেলার ময়দানে সব গোপন ফাঁস করতে নেই ফিয়না। দেয়ালেরও কান আছে। খেলা শেষ হলে নাহয় জানিয়ে দিব ফিংগার প্রিন্ট কীভাবে ম্যাচ হলো। আর ঐ ছেলেটির নাম আমার জানা নেই। আমি কেবল ঐ সময় ঐ ছবিটি অনেক দাম দিয়ে সেখান থেকে কিনেছিলাম। এরপর তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি৷ হয়তো সে এই যোগাযোগের পথটা বন্ধ করে দিয়েছে। যাইহোক প্রসঙ্গ পাল্টাই এবার। আমি যাই, দেখে আসি আনজুমানের হাসবেন্ড কেমন পায়েস বানিয়েছে।”

কথাটা বলে আনহারি রুম থেকে বাইরে গেল। আনজুমানের মেয়ে তখন বের হলো। আনজুমানের মেয়ে একটা কাগজ নিয়ে খেলছিল। ময়েটির নাম তরী। হঠাৎ করে আনহারির চোখ পড়ে সে কাগজের দিকে। আনহারী কাগজটা তরীর হাত থেকে নেয়। তরী বেশ শান্ত বাচ্চা হওয়ায় কাগজ না ফিরিয়ে দেওয়ার জেদ ধরেনি। আনহারি কাগজটা হাতে নিল। আমি রহস্যের গন্ধ পেয়ে আনহারির কাছে আসি। আনহারি কাগজটা হাতে নিয়ে লক্ষ্য করল এটা একটা রিপোর্ট। রিপোর্টটা দীপকের। আর দীপক কেনোদিন বাবা হতে পারবে না এটা তারেই রিপোর্ট।

রিপোর্ট টা দেখার পর আমার ভেতরটায় এত জোরে অজানা একটা আঘাত হানা দিল যেটা সইতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছ। দীপক যদি কখনও বাবা হতে না পারে তাহলে বড়ো আপার পেটে কার সন্তান ছিল? এটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে এ আনহারি অনন্যা নয়। তাহলে যে মারা গেছে সে অনন্যা। তাহলে অনন্যা কী করে প্রেগনেন্ট ছিল?

#বড়ো আপা
#পর্ব-২৪
#শারমিন আঁচল নিপা

আমার ভেতরটায় কেমন জানি বিষাদের সুর বেজে উঠছে। আপার কোনো অবৈধ সম্পর্ক আছে ভাবতেই কেমন যেন গা সিউরে উঠছে। আনহারি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল

“অনন্যা তো অন্তঃসত্ত্বা ছিল তাই না? কিন্তু এ রিপোর্টে তো স্পষ্ট লেখা দীপক কখনও বাবা হতে পারবে না।”

আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। শরীরটা কাঁপছে ভীষণ। অসাড় লাগছে একদম। ভাঙা গলায় জবাব দিলাম

“আপার পেটের বাচ্চা নষ্ট করেছিল। তবে আপার জীবনে দুলাভাই ছাড়া আর কেউ ছিল না। আপা কোনো খারাপ কাজে জড়িত ছিল এটা আমি মানতেই পারছি না। এ রিপোর্ট টা দেখার পর আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে আপু৷ আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে কোনো একটা পাথর আমার বুকে চেপে আছে।”

আনহারি আমার দিকে তাকাল। আমার চোখ বেয়ে সে সময়টায় পানি বাহিত হচ্ছিল। ভেতরের কষ্টটা চোখ বেয়ে জড়ছিল। আমার চোখ দুটো মুছে দিয়ে বলল

“হয় ময়না তদন্তের রিপোর্টে সমস্যা ছিল। নাহয় তোমার আপার সাথে এমন কিছু ঘটেছে যেটা আমাদের আড়ালে চলে যাচ্ছে।”

আমি এবার জোরে কেঁদে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলাম

“তাহলে কী আপা রেপের শিকার হয়েছে? আপার জীবনের আরও কষ্ট জানার বাকি আমাদের? আপার জীবনের কষ্টের দাবদাহ কি পরকালে কমেছে? শুনেছি আত্মহত্যা যারা করে তারা জান্নাত পায় না। তবে আল্লাহ যদি চান তার বান্দাকে ক্ষমা করবেন, তাহলে সে জান্নাত পাবে। আপাকে কী আল্লাহ জান্নাত দিয়েছে? আপা এত কষ্ট করে গেল দুনিয়ায়, পরকালে কী শান্তি পেয়েছে?”

আনহারি আমার কান্না আর কথা শুনে মুখ চেপে ধরে বলল

“আবেগে গা ভাসিও না। দেয়ালেরও কান আছে। চুপ থাকো প্লিজ। সব প্রশ্নের উত্তর সময় মতো পাওয়া যাবে। আপাতত নিজেকে সামলাও। তুমি ঘরে যাও। ”

আমি ঘরে চলে আসলাম। তবে আমার মন থেকে বিষয়টিকে কোনোভাবেই সরাতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে আপার কী তাহলে সত্যই চারিত্রিক কোনো সমস্যা ছিল? আমার চোখ বেয়ে অজোরে পানি বেয়েই চলেছে।

বাইরে আনহারি আনজুমানের স্বামীকে জটলা বলে সম্বোধন করে ডাকছে। নামটা বেশ ভালোই দিয়েছে। এখন থেকে নাহয় আনজুমানের স্বামীর সম্বোধন জটলা বলেই হবে। জটলা তড়িগড়ি করে আনহারির সামনে আসলো। আনহারি কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল

“আমার পায়েস হয়েছে?”

আনহারির এ স্বভাবটাও বড়ো আপার মতো। আচ্ছা কোনোভাবে এমন তো নয় বারো বছর আগে যে মারা গেছে সে আনহারি। আর আনাহারি যেহেতু মর্ডান সুসাইটিতে জন্ম নিয়েছে তাই হয়তো কারও সাথে সম্পর্ক করে কনসিভ করেছিল আর সেটা এবরশনও করায়। হয়তো কোনোভাবে আনহারি আর অনন্যার মধ্যে উলট পালট হয়। আর এদিকে আনহারিকে অনন্যা ভেবে শত্রুপক্ষ খু’ন করে। আর অনন্যা বেঁচে যায়। আর অনন্যা সেখানে আনহারি হয়েই থেকে যায়।

এসব ভেবেও আমার ভাবনা আবার উল্টো মোড় নেয়। কারণ আনহারি অনন্যা হলে অন্তত আমাকে একটা বার হলেও বলত। আমাকে লুকিয়ে তার তো কোনো লাভ নেই। সকল প্রশ্ন, চিন্তা, রহস্য যেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। চায়লেও আমি এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। গা টা বেশ গরম হয়ে গেছে মুহুর্তেই। জ্বর আসবে বলে মনে হচ্ছে।

এদিকে জটলা আনহারির কথা শুনে পায়েস নিয়ে আসলো। আর আনহারি জটলার পায়েস নিজে মুখে না দিয়ে জটলাকে বলল

“আমি তো মুখে পায়েস দিব না। তুই আগে দে। না জানি কী মিশিয়ে দিয়েছিস পায়েসে। আমি তো পরখ না করে খাব না।”

জটলা মুখ বাকিয়ে বলল

“রান্না করেছি এটাই অনেক। এখন আবার খেতে পারব না। খেলে খা, না খেলে না খা।”

আনহারি রেগে চটে গিয়ে বলল

“তুই খাবি না তোর ঘাড়ে খাবে। এ প্লেট এখন শেষ করবি। নাহয় পুলিশ এনে অভিযোগ দিব এ প্লেটে বিষ মিশিয়ে আমাকে খাওয়াতে চাচ্ছিস।”

জটলা একদম বেঁকে বসেছে যে খাবে না। সে এটা জেদ ধরেই করছে বুঝা যাচ্ছে৷ আনহারিও কম যায় না। অফিসার মাহিদকে আবার কল দিল। অফিসার মাহিদ আসবে শুনে আমার অস্থির মনটা একটু শান্ত হলো। একটু শীতলতা মনটায় স্পর্শ করে গেল।

জটলাকে সোফায় বসিয়ে রেখেছে। আনহারিও সোফায় বসে আছে। মিনেট বিশের মধ্যে অফিসার মাহিদ চলে আসলো। এসেই বেশ রসাত্মক সুরে বলল

“আমি তো আপনাদের পারিবারিক ড্রামায় পড়ে গেলাম। এত বার থানা থেকে এ বাসায় আসতে হচ্ছে কী আর বলব। এক কাজ করুন এ বাসায় আমাকে থাকার ব্যবস্থা করুন। আমি নহায় এ বাসায় থেকে আপনাদের পারিবারিক ড্রামা দেখি।”

অফিস মাহিদের কথা শুনে আমি একটু হাসলাম। এ মানুষটাকে দেখলে আমার ভীষণ আপন লাগে। মনে হয় আমার অস্থির মনটায় একটু সুখের ছন্দ হয়ে এ মানুষটায় আসতে পারে। আনহারি বেশ রেগে বলল

” এটা আপনার ডিউটি। দায়িত্ব তো আপনাকে পালন করতেই হবে। আর এই যে জটলা আমাকে বিষ খাইয়ে মারতে চায়ছে। তাই আপনাকে নিয়ে আসলাম।”

জটলা বেশ উচু গলায় বলল

“আমি একদম কিছু করিনি। এ মেয়েটা আমাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। আমাকে দিয়ে জোর করে পায়েস বানিয়েছে। এখন বলছে খেতে। যে সময় যাচ্ছে এখন পায়েস খাওয়ার রুচি আমার জাগছে না। এ জন্যই এত কাহিনি। আমি পায়েস বানিয়েছি আমাকে কেন খেতে হবে। তোর যদি সন্দেহ হয় তুই খাবি না। শুধু শুধু এত নাটকের তো দরকার নাই।”

অফিসার মাহিদের উপস্থিতিতে সবাই চলে আসলো ড্রইং রুমে। এবার আপার শ্বাশুড়ি রেগে গিয়ে বলল

“এই ডাইনিটা আসার পর থেকে জ্বালাচ্ছে। আমাদের জীবনটা খেতে এসেছে। জামাই বাবাজি পায়েস বানিয়ে দিয়েছে এটাই তো অনেক বড়ো বিষয়। অফিসার মাহিদ সাহেব একে দয়াকরে এ বাসা থেকে বের করার ব্যবস্থা করুন। টাকা পয়সা যা লাগে দিচ্ছি।”

অফিসার মাহিদ এবার একটু চটে গিয়ে বললেন

“আমি কী ঘুষ খাই নাকি? মুখ সামলে কথা বলুন। আইন যা বলে সেভাবেই কাজ করতে হবে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা সন্দেহ এসেছে যেহেতু এত ঘুরিয় পেঁচিয়ে না নিয়ে একজন পায়েস খেলেই তো প্রমাণ হয়ে যায়। ”

আপার শ্বাশুড়ি এবার রেগে গিয়েই পায়েসের বাটিটা নিয়ে কয়েক চামচ পায়েস খেয়ে নিল৷ তারপর গড়গড় করে বলল

“আমার কী কিছু হয়েছে? এ ডাইনি শুধু শুধু বদনাম করছে আমাদের।”

আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম পায়েসে কিছু নেই। কারণ এত অল্প সময়ে পায়েসে কিছু মেশানোর মতো অবস্থায় তারা ছিল না৷ অফিসার মাহিদ এবার আনহারির দিকে তাকিয়ে বলল

“শুধু শুধু এসব ব্যাপারে পুলিশ কল দিবেন না। পুলিশের অনেক কাজ থাকে। আপনাদের পারিবারিক ড্রামা সব তে পুলিশ এসে মেটাবে না। স্বাভাবিক বিষয়গুলোকে এত বড়ো করবেন না।”

কথাগুলো শেষ করতেই আনহারি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে আপার শ্বাশুড়িকে দেখাল। আপার শ্বাশুড়ি মাটিতে ঢলে পড়েছে। মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। জটলা এবার সেখানে আপার শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে চমকে গেল। জোর গলায় বলল

“এটা কী করে সম্ভব? আমি তো পায়েসে কিছু মেশায়নি। মেশালে তো আমি আম্মাকে খেতে দিতাম না। ”

আনহারি এবার মাহিদের প্রশ্নের উত্তরে বলল

“আমি এমনি এমনি কাউকে ডাকি না যথেষ্ঠ কারণ ছাড়া। এবার প্রমাণ হলো তো?”

অফিসার মাহিদ জটলাকে জিজ্ঞেস করল

“আপনি যদি না মেশান আর কে মেশাতে পারে? পায়েসের বাটি রেখে কী কোথাও গিয়েছিলেন?”

“আমি এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে রান্না করে নিজ হাতে পায়েস নিয়ে আসি। কোথাও যাই নি। আমার হাতে বাটি রেখে পায়েসে কী কেউ কিছু মেশাতে পারবে। এ অনন্যা নয় এ অনন্যার ভূত। হয়তো ভূত হয়ে সে কিছু মিশিয়েছে।”

ধরাধরি করে আপার শ্বাশুড়িকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। আর পায়েসটা নেওয়া হলো ল্যাবে টেস্ট করার জন্য।

আমি শুধু ভাবছিলাম হচ্ছেটা কী? সবকিছুর বাইরে কিছু একটা ঘটছে যেটা আমার চোখকেও আড়াল করে নিচ্ছে। কারণ আনহারি রান্না ঘরে এর মধ্যে যায়নি যে, পায়েসে কিছু মেশাবে। আর জটলার পক্ষেও এত তাড়াতাড়ি কিছু মেশানো সম্ভব নয়।

আমি ক্লান্ত মনে বসে আছি। প্রশ্নরা সব আমাকে ঘিরে ধরেছে। কখন যে সময় কেটে গেল বুঝতে পারিনি।

সকাল ১১ টা বাজে। হাসপাতাল থেকে খবর আসে আপার শ্বাশুড়ি কোমায় চলে গিয়েছে। আর ল্যাব থেকে যা খবর আসে তা শুনে আমি একদম চমকে উঠি। সত্যিই কী এটা সম্ভব?

শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার