বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-৪৮

0
1144

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৪৮
#Esrat_Ety

আলো মাথা নিচু করে রেখেছে। সে জানেনা আর কিভাবে,কতটা আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয়। নিজের সমস্ত লাজুকতা ঠেলে সরিয়ে রেখে স্বামীর হাতে চু*মু খেয়েছে হ্যাংলার মতো। চু*মু খেয়ে ধন্যবাদ জানানো! এটা তো ঐ মেয়র সাহেবের কাছ থেকেই শিখেছে সে।
সাহস করে চু*মু টা তো খেলো। কিন্তু ঐ পুরুষটির চোখে চোখ রাখার সাহস তার নেই।

সামিন অবাক হয়ে আলোর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজের ডান হাতের পিঠে তাকায়। তার চোখে মুখে বিস্ময়।

আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। মনে মনে চেঁচিয়ে বলছে,”পেয়েছেন তো ধন্যবাদ? এবার যান, যান এখান থেকে মেয়র সাহেব।”

সামিন যেন লাজুক লতা আছিয়ার মনে মনে দেওয়া ধমক শুনতে পেলো। ধীরপায়ে হেটে সে কেবিন থেকে বের হয়। আলোকে নিয়ে যাওয়া হয় সা*র্জারি রুমে। সামিন ডান হাতটাকে উঁচু করে ধরে পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে বোকার মতো,ঐ পা*ষণ্ডী আছিয়ার থেকে এতোটাও আশা করেনি সে।

“কি দেখছো হাতে সামিন? হাতে কি হয়েছে?”

নাফিসার ডাকে সামিনের ঘোর কাটে। নাফিসা তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”না আন্টি, কিছু না।”

ওয়েটিং রুমে বসে আছে সবাই।
বৌয়ের থেকে প্রথম চু*মু পেয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা।

***
“কি করছো!”
পেছন থেকে রিতুকে জরিয়ে ধরে ইলহাম বলে ওঠে। রিতু নিচু গলায় বলে,”ভাবীর সা*র্জারি হলো কিনা জানতে ফোন দিয়েছি ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া ফোনটা ধরছে না।”

_কথা হয়েছে আমার। সা*র্জারি হয়েছে।

রিতু ইলহামের দিকে তাকায়। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”জানেন ভাইয়া আর ভাবীকে একসাথে দেখতে কত যে ভালো লাগে আমার! হৃদয়টা প্রশান্তিতে ভরে যায়। যখন ভাবী ভাইয়াকে ছেড়ে চলে গেছিলো তখন ভাইয়ার উদাস মুখটা দেখে খুব কষ্ট পেতাম। ভাইয়া ভাবীকে খুব ভালোবাসে। আগে জানতাম পুরুষ মানুষ ভালোবাসতেই জানে না। কিন্তু ভাইয়াকে দেখে ধারণা বদলে গেলো, পুরুষের ভালোবাসা ভ*য়ানক সুন্দর। ভাইয়া ভাবীকে যতটা ভালোবাসে ভাবী কখনোই অমন করে ভালো বাসতে পারবে না ভাইয়াকে।”

রিতুর কথা শুনে ইলহাম তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঐ সুন্দর, মায়াবী দুটি চোখের দিকে তাকালেই ইলহামের মনের মধ্যে তীব্র অনুশোচনা হয়। নিজের নিন্দিত দিন গুলোর কথা সে নিজেই ভুলতে পারে না। এই মেয়েটা কত সহজে ভুলে গিয়েছে। অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে ঘুম থেকে তুলে অত্যা*চার, রিতুকে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলা , রিতুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে মিলিত হওয়া, কথায় কথায় অপমান করা, বাপ তুলে গালি দেওয়া, ভোগ*বস্তুর মতো ব্যাবহার করা। এতো জ’ঘ’ন্য দিনগুলোর কথা কিভাবে মেয়েটি ভুলতে পেরেছে! নাকি কখনো ভোলেনি!

রিতু ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হলো? কি ভাবছেন?”

ইলহাম মাথা নাড়ায়। রিতুকে টে’নে নিজের কাছে নিয়ে কানের লতিতে চু”মু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”পুরুষ ভালোবাসতে পারে কিনা জানিনা, তবে আমি জানি নারীর ভালোবাসা সুন্দর, ভ*য়ানক সুন্দর। আমার কাছে এমন একটি নারী আছে, আমি পেয়েছি। যার ভালোবাসার তল খুঁজে বের করা আমার মতো পুরুষের সাধ্য নয়।”

***
“তোমার ভাই এবং ভাবীকে ভীষণ সুন্দর লাগছে ইশমাম। এদের দেখে মনে হচ্ছে মেইড ফর ইচ আদার!”

শার্লিনের কথায় ইশমাম ম্লান হাসে। ইশমামের ফোনে তার সব বন্ধুরা আলো আর সামিনের ছবিটা দেখছে। ইশমামের মুখে সবাই এতো শুনেছে সামিনের কথা তাই তার বৌ দেখতে সবাই খুবই আগ্রহী।

ক্যান্টিন আপাতত ফাঁকা। তারা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এ্যালেক্স ছবি দেখায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না,সে শীতল চোখে তার বেস্টফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশমাম ঠান্ডা গলায় বলে,”তুমি এভাবে কি দেখছো এ্যালেক্স? ”

এ্যালেক্স একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”মারিয়া তোমাকে ডেটের অফার দিয়েছে। তুমি রাজি কেনো হচ্ছো না? সে তোমাকে খুবই পছন্দ করে, ডেটে তো যেতেই পারো!”

_আমি ইন্টারেস্টেড নই এ্যালেক্স।

_তাহলে কিসে ইন্টারেস্টেড তুমি? এভাবে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোয়? কেনো ঝেরে ফেলছো না মেয়েটাকে নিজের মন আর মস্তিষ্ক থেকে।

_শাট আপ এ্যালেক্স! এমন কিছুই নেই। এমনটা ভাবাও আমাদের ধর্মে গর্হিত পাপ। সে আমার ভাবী। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। ভাইয়া তাকে কতটা ভালোবাসে জানো? তাদের একসাথে দেখতেই আমার শান্তি।

_ওকে তাহলে অন্য মেয়েদের সাথে ডেটে যেতে কি সমস্যা?

ইশমাম নিচু স্বরে বলে,”হবে না। হবে না আমার দ্বারা। সম্ভবত কখনোই হবে না।”

***
“এই আছিয়া! গল্প শুনবে?”

আলো পিট পিট করে তাকাচ্ছে। চোখের পাতা মেলে রাখতে পারে না কয়েক মুহূর্তের বেশি। সামনে ক’জন মেয়র সাহেব? দুজন নাকি তিনজন? এতো গুলো মেয়র সাহেব দিয়ে সে কি করবে! একটা মেয়র সাহেবই জীবনটা তেজপাতা করে দিলো! এতগুলো সে সামাল দেবে কিভাবে!

সামিন ঝুঁকে আলোকে দেখছে, নিচু স্বরে বলে ওঠে,”তুমি হাসছো কেনো? মাথা কি পুরোপুরি ন*ষ্ট হয়ে গিয়েছে?”

আলো ম্লান হেসে বলে,”দেখছিলাম আমার সামনে তিনজন মেয়র সাহেব। আর দুজন কোথায় গেলো!”

সামিন একটা চেয়ার টেনে বসে। আলো ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”ভ*য় পেয়েছিলে?”

_নাহ।
মৃদুস্বরে বলে ওঠে আলো। পরপর বলে,”আপনি কিভাবে ঢুকলেন? চব্বিশ ঘন্টার আগে তো কেউ ঢুকতে পারবে না।”

_চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে পঁচিশ ঘন্টা হতে চলেছে মহারানী।

আলো অবাক হয়ে যায়। সামিন বলতে থাকে,”কোথাও কোন অসুবিধে হচ্ছে?”

আলো মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,”ঐ দাগগুলো আর দেখতে পাবো না তো?”
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকটা উ*ৎকণ্ঠা মেয়েটার কন্ঠে, বেশ ভুগিয়েছে ক্ষ*তর দাগগুলো। সামিন আলোর একটা হাত ধরে বলে,”কিছুটা থেকে যাবে! তারজন্য নেক্সট ইয়ার আরো একবার আসবো ভাবছি। তবে যেটুকু পুনর্গঠন হয়েছে তাতে যেসব টিস্যু শক্ত হয়ে গিয়েছিলো তার স্বাভাবিক সঞ্চালন হবে।”
আলো চুপ করে থাকে, তারপর বলে ওঠে,”ঐ নার্সটার সাথে কথা হয়েছিলো? খুব সুন্দর করে কথা বলে তাইনা? আমার মতো গালি*গালাজ করে না!”

সামিন হেসে ফেলে। তারপর বলে,”স্ত্রী হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে স্বামীকে কথায় কথায় সন্দেহ করা। তুমি আমার উপযুক্ত স্ত্রী হতে পারবে আছিয়া। বুঝতে পেরেছি আমি।”

আলো ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তারপর বলে ওঠে,”কি বলুন তো! পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই। এরা কখন পল্টি খাবে এরা নিজেরাও আগে ভাগে জানে না। কার প্রতি কখন মন উঠে যায়, কাকে মনে ধরে যায় তা বলতে পারে না এরা! তাই এদের সন্দেহের উপর রাখলে এরা চাপে থাকে।”

সামিন মৃদু হেসে আলোর নাক টিপে দেয়। তারপর নরম গলায় বলে,”পল্টি খাওয়া? সেটা কি জানি না তো আছিয়া। আমি সেই যে একটা মায়াবী নারীতে আটকে গিয়েছি এখন আমার নিজেকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তুমি আমার এমন হাল না করলেও পারতে!”

আলো নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। সামিন বলতে থাকে,”কলেজের প্রোগ্রামের সেই দিনটার কথা মনে আছে? আমার বুকে সেইফটি পিন ফু*টিয়ে দিয়েছিলে তুমি দস্যি মেয়ে!”

আলো ম্লান হাসে। সামিন বলতে থাকে,”আচ্ছা আমাদের বাচ্চারা যখন আমাদের বিয়ের গল্প জানতে চাইবে তখন নিশ্চয়ই এটা বলা যাবে না যে আমি তাদের মাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছি। আমার ইমেজ ন*ষ্ট হয়ে যাবে বাচ্চাদের কাছে।”

_তাহলে বলে দেবেন আমাদের পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিলো। আপনার বাড়ি থেকে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল ঘটক আমাদের বাড়িতে। আপনি আপনার চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে গিয়ে আমাকে দেখেছেন। আপনাদের বাড়ির মেয়েরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার চুল লম্বা কিনা দেখেছে, আমার নখ কেমন দেখেছে, আমি ট্যা*রা কিনা দেখেছে। এসব বানিয়ে কিছু একটা বলে দেবেন।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।

_না না,সেটা কিভাবে হয়, পারিবারিক ভাবে বিয়ে! বাচ্চারা শুনলে ব্যাকডেটেড ভাববে।

আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেসে ফেলে। তারপর অপলক সামিনকে দেখতে থাকে। বাচ্চাদের কাছে কি জবাব দেবে ভেবে লোকটা কি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পরে গিয়েছে! কি অদ্ভুত একটা লোক। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”তাহলে মিথ্যা প্রেমের কাহিনী বলবেন।”

_সেটা ঠিক বলেছো! বলবো, তোমাকে প্রথম দেখায় আমি প্রেমে পরে গিয়েছি। কি ভীষণ মিষ্টি যে ছিলে তুমি। দিন রাত তোমাকে নিয়ে ভাবতাম, তারপর আমি একদিন তোমাকে অনেক ভদ্রভাবে প্রেমের প্রস্তাব দেই। আর তুমিও রাজি হয়ে যাও সাথে সাথে…..!

এই পর্যন্ত বলে সামিন থামে, তারপর বলতে থাকে,”আমি আর বানাতে পারছি না গল্প। তুমি একটু হেল্প করো।”

আলো হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসছে। হাত সরিয়ে জবাব দেয়,”তাড়াহুড়ো করতে হবে না। ধীরে সুস্থে বানান গল্প। আমাদের বাচ্চা নেই।”

_এখন নেই,হতে কতক্ষন?
স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে সামিন।

আলোর গাল লাল হয়ে যায় লজ্জায়। মুখ ঘুরিয়ে সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটা ভীষণ বাড়াবাড়ি করে। মুখে লাগাম নেই এই লোকটার!

***
মাত্র সাতদিন দিন হয়েছে আলো ক্লিনিকে ছিলো, দুই দফায় সা*র্জারি হয়েছে। অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে কতবছর ধরে সে ঐ মেডিসিন দেয়া কেবিনটাতে ছিলো। মনটা পুরো বি*ষিয়ে উঠেছিল।
হোটেলের এই ঘরটা কিছুটা শান্তিনীড়ের ঘরটার মতো, একটা হোম সুইট হোম ফিল পাওয়া যায়। বিছানায় বসে আলো একটা লম্বা শ্বাস নেয়। সামিন আলোর ব্যাগপত্র যায়গামতো রেখে তার দিকে ঘুরে তাকায়। আলো দৃষ্টি জানালার বাইরে দিয়ে রেখেছে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন রাতের পর থেকে অনবরত খুব বৃষ্টি হচ্ছে সিটিতে।

সামিন আলোর কাছে এগিয়ে যায়। আলো ঘুরে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”বৃষ্টি থামছে না কেনো!”

_তা তো আমি জানি না।

আলো আবারও মাথা ঘুরিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে। তারপর বলে,”এখানে আর কতদিন থাকতে হবে? আমার আর ভালো লাগছে না।”

_অনেকের ক্ষেত্রে একাধিকবার সা*র্জারির প্রয়োজন পরে, যাদের মুখমণ্ডল পু*ড়ে যায়, তোমার হয়নি, আমরা খুব শিগগিরই ফিরবো। দুই একদিনে।

আলো চুপ করে থাকে।

সামিন বলে,”কফি খাবে?”

_আপনি বানিয়ে খাওয়ালে খাবো।
আলো লাজুক হাসি হেসে বলে।

সামিন কফি বানাতে বানাতে বলে,”খুব অলসতা ঢুকেছে শরীরে তাই না? বাংলাদেশ নিয়ে গিয়ে সব বের করে দেবো। সকাল থেকে রাত শুধু সংসারের কাজ করবে তুমি। প্রথম থেকে যত ফাঁকি দিয়েছো, সবকিছু ওভার টাইম করে পুষিয়ে দেবে।”

আলো হেসে সামিনের দিকে তাকায়, মৃদু স্বরে বলে,”এ কদিন আপনি খাওয়া দাওয়া ঠিকভাবে করেননি।”

সামিন কিছু না বলে কফি বানাতে মনযোগী হয়ে ওঠে। আলো উঠে দাঁড়ায়। রুম টা পুরো অগোছালো হয়ে আছে। বিছানার ওপরে কিছু শপিং ব্যাগ। সেগুলো হাতে তুলে নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”এসব কি? আবার শপিং!”

_আমি করিনি। সেদিন নাফিসা আন্টিকে যে গিফট দিয়েছিলে তার জন্য রি*টার্ন গিফট পাঠিয়েছে।

আলো কৌতুহলী হয়ে শপিং ব্যাগ থেকে গিফট টা বের করে। সামিন দুহাতে দুটো কফির মগ নিয়ে এগিয়ে আসে।
গিফট দেখে আলো রানীর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো। সামিন হতভম্ব হয়ে আলোর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো লজ্জায় নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছে না, নড়াচড়া তো দূরের কথা!

হাত থেকে নাইটিটা পুনরায় শপিং ব্যাগে ভরে চুপচাপ বিছানায় রেখে দেয় আলো। সামিন বিরবির করে বলে,”এসব আমি কিনিনি বিশ্বাস করো।”

আলো চুপ করে নিজের একটা শাড়ি বের করে ওয়াশ রুমে ঢোকে। সামিন নিজের হাতের কফির মগ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ বোকার মতো। তারপর চেঁচিয়ে ওঠে,”কফিটা খেয়ে তারপর লজ্জা পেতে!”

***
দীর্ঘসময় ধরে আলো শাওয়ার নিয়ে তারপর ওয়াশ রুম থেকে বের হয়। সামিন বিছানা থেকে শপিং ব্যাগগুলো সরিয়ে রেখেছে। কফির মগ দুটো টেবিলের ওপর রাখা।

বিছানা ঠিকঠাক করে সামিন জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখে, বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে আলোকে দেখে সে থমকে যায়। হালকা গোলাপী রঙের শাড়িতে, ভেজা চুলের লাজুক মুখটা বড্ড টানছে সামিন কে।

আলো একপলক কফির মগের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় সামিনকে বলে,”নতুন করে বানিয়ে দেই?”

সামিন কোনো কথা বলে না। চুপচাপ আলোকে দেখছে। বাইরে বি*দ্যুৎ চ*মকাচ্ছে। সামিন বিরস মুখে সেদিকে তাকায়। কি সুন্দর, ভ’য়ং’ক’র রোমান্টিক আবহাওয়া। এটা হচ্ছে বৌকে বুকে জরিয়ে নিয়ে ঘুমোনোর আবহাওয়া। কিন্তু তাতে তার কি, ঐ মেয়েটা তো ভুল করে তার বুকে আসে, স*জ্ঞানে নয়‌।

আলো ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি ফুটতে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ সামিনের মাথায় একটা দু*ষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়। আজ ঐ আছিয়া তাকে আবারও জরিয়ে ধরবে! কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে হেসে নিয়ে বেশ শব্দ করে বলে ওঠে,”তেলাপোকা।”

আলো ঘুরে তাকায় সামিনের দিকে। সামিন ভাবলো, হয়তো এক্ষুনি আছিয়া এসে তার বুকে হু*মরি খেয়ে পরবে। কিন্তু সে গুড়েবালি । আলো পা থেকে ঘরে পরার চপ্পল খুলে হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,”কোথায় তেলাপোকা?”

সামিন আলোর দিকে বিরসমুখে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,”কোথায় তেলাপোকা?”

কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”স্ত্রী হবার দ্বিতীয় শর্ত হলো তেলাপোকার কথা শুনলে ছুটে এসে স্বামীকে জরিয়ে ধরতে হয়, হাতে চপ্পল তুলে নিতে হয়না।”

আলো সামিনের দিকে তাকায়। সবটা বুঝতে পেরে হাত থেকে চপ্পল ফেলে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। মনে মনে বলতে থাকে,”ওভাবেই মাথা নিচু করে রাখো আছিয়া। আমার দিকে ভুল করেও তাকাবে না। আমি ভ’য়ং’ক’র কিছু করে ফেলবো তবে, কোনো পবিত্র অ’প’রা’ধ! ”

আলো যেন সামিনের ব্যাকুলতা শুনতে পেলো, সে চোখ তুলে তাকায় না সামিনের দিকে। আলোর অনেকটা কাছে গিয়ে সামিন ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,”ভয় হচ্ছে? ভয় পাওয়ার কিছু নেই আছিয়া, আমাদের বাসর হবে বাংলাদেশে, আমার নিজের ঘরে, এই সিঙ্গাপুরে নয়। সবকিছু সাজিয়ে হবে আমাদের বাসর। আমার ঘরটাকে সাজিয়ে এবং আমার বৌটাকেও।”

আলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের শাড়ির আঁচল চেপে ধরে রেখেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছটফটে এই পুরুষটি তাকে কথা শুনিয়ে লজ্জা দিয়ে মে*রে ফেলবার পরিকল্পনা করছে সম্ভবত।

সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”উহু, চোখ নামিয়ে রাখো। চোখ তুলে তাকাবে না আজ।”

আলো চোখ নামিয়ে রাখে। সামিন কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”একটা গান শুনবে?”

আলো চুপ করে থাকে। সামিন ফিসফিসিয়ে গাইতে শুরু করে,
“ওগো, তোমার আকাশ দুটি চোখে, আমি হয়ে গেছি তারা,
এই জীবন ছিলো, নদীর মতো গতি হারা।”

আলো আবারও সামিনকে থামিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বলে,”খুব বাজে গান করেন আপনি।”

সামিন হেসে ফেলে। চুপচাপ আলোকে কিছুক্ষণ দেখে ইলেকট্রিক কেটলির সুইচ অফ করে রাখে। তারপর মৃদু স্বরে আলোকে বলে,”কফি খেতে হবে না। চুপচাপ নিজের বিছানায় গিয়ে চাদর টেনে শুয়ে পরো। ভুল করেও আমার দিকে তাকাবে না। একদমই না।”

আলো বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে ওপাশ ফিরে,গায়ে চাদর টেনে।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সামিন বিরক্ত ভঙ্গিতে জানালার দিকে তাকায়,এই বৃষ্টি শেষ হচ্ছে না কেনো! অদ্ভুত।

***
“ঐ মেয়েটা আপনার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?”

সামিন ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে আলোর দিকে তাকায়। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”স্ত্রী হবার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে বোকা বোকা কথা বলে স্বামীর মাথার খু*লি গরম করে দেয়া। যেটা তুমি খুব ভালোভাবে করতে জানো। ঐ মেয়েটা আমার দিকে কেনো তাকিয়ে আছে কেনো তা আমি কি করে জানবো? ওকে জিজ্ঞেস করো।”

আলো মুখ ভার করে ফেলে। সামিন ম্যাগাজিন রেখে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হয়েছে? সমস্যা কোথায়? মুখ ভার করে ফেললে কেনো?”

আলো ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,”স্ত্রী হবার চতুর্থ শর্ত হচ্ছে স্বামী ধ*মক দিয়ে কথা বললেই তার সাথে আর কথা না বলা, যেটা আমি অনেক ভালো করে করতে পারি। দেখবেন?”

সামিন হেসে ফেলে। আলোর হাত মুঠি করে ধরে বলে,”না দেখতে চাই না। মাফ করুন। আচ্ছা বলছি, ঐ মেয়েটা আমার দিকে ওভাবে কেনো তাকিয়ে আছে, আসলে ও আমার প্রাক্তন। তাই আমাকে দেখে ওর পুরনো দিনের কথা সব মনে পরে গিয়েছে।”

আলো সামিনের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন হাসতে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”স্ত্রী হবার পঞ্চম শর্ত হচ্ছে স্বামী যখন চুপ করে থাকতে বলবে, স্ত্রী তখন চুপ করে থাকবে। এখন তুমিও চুপ করে থাকো। প্লেনে ওঠার পর থেকে আজগুবি সব প্রশ্ন করেই যাচ্ছো। এখন থামো, আমরা একটু পরে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবো।

***
ঘরে ঢুকে আলো চারদিক ভালো করে দেখতে থাকে। ঘরটাকে আজ অন্যরকম লাগছে। নতুন রং করানো হয়েছে, আসবাবপত্র এদিক সেদিক করা হয়েছে।

ইশিতা পেছন থেকে বলে,”দেখছো কি ভাবী! ”

আলো মাথা ঘুরিয়ে বলে,”ঘরটা এমন রং করা হয়েছে কেন? আগের রং টা তো একেবারে নতুন ছিলো।”

_কি জানি! ভাইয়া ফোন করে মেজো ভাইয়াকে বলেছে ঘরটা রং করিয়ে রাখতে।

আলো অবাক হয়ে সবকিছু দেখতে থাকে, আগের থেকে বেশ ভালো লাগছে ঘরটা।

নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে ইশিতাকে বলে,”তোমার গিফট পছন্দ হয়েছে?”

ইশিতা মাথা নাড়ায়। আলো নিচু স্বরে বলে ওঠে,”তোমার ভাইয়া কোথায় গিয়েছেন? বাড়িতে ঢুকে পাঁচ মিনিটও বসলেন না।”

_ভাইয়া কোথায় গিয়েছে এটা এখনো আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে কেন? উল্টো আমারই তো তোমাকে জিজ্ঞেস করার কথা ভাইয়া কোথায় গিয়েছে।

আলো চুপ করে থাকে। ইশিতা বলে,”ভাইয়া পার্টির মিটিং এ গিয়েছে। জরুরি আলোচনা।”

_দুপুরে ফিরবেন না?

_সেটা তো জানি না। তুমি জিজ্ঞেস করো।

_আমি?

_হ্যা তুমি।
আলোর দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে ইশিতা আবারও বলতে থাকে,”অনেক তো ভাইয়ার পরীক্ষা নিলে, এখন তুমিও পরীক্ষা দাও, তুমি বৌ হিসেবে কতটা উপযুক্ত।”

আলো লাজুক মুখটা নামিয়ে রাখে। ইশিতা আলোর ফোন থেকে সামিনের নাম্বার ডায়াল করে বলে,”এই নাও। কথা বলো।”

দুইবার রিং হতে সামিন ফোনটা রিসিভ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”বলো।”

_কোথায় আপনি?

_মিটিং এ।

_দুপুরে ফিরবেন না?

_না রাতে ফিরবো, দুপুরে এখানে খাবো। বিকেলে প্রেসক্লাবে যেতে হবে। রাতেও সম্ভত খেয়ে আসবো।

আলো কি বলবে আর, বুঝতে পারছে না। তার মাথায় আসছে না। ইশিতা আলোর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”ভাইয়াকে বলো আমি আপনাকে খুব মিস করছি। আমার মনটা কেমন করছে।”

আলো ইশিতাকে চোখ রাঙানি দেয়। ইশিতা মুখে ওড়না চেপে হাসছে।

সামিন আলোর ফোন পেয়ে অসম্ভব খুশি হয়েছে,কিন্তু অনেক সিনিয়র পার্সন আশেপাশে রয়েছে তাই একটু ভালো করে কথাও বলতে পারছে না, শুধু মুখে হু হা করে যাচ্ছে।

আলো বলতে থাকে,”ইশিতা আপু আপনাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে বলেছে, একসাথে ক্রিকেট ম্যাচ দেখবে।”

_আর তুমি? তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলবে না?
সামিন জানতে চায়।

আলো ঠান্ডা গলায় বলে,
_না, আমি তো ক্রিকেট খেলা দেখিনা।

সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”ঠিকাছে, তোমার ইশিতা আপুকে বলে দিও আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো, আর তোমার ইশিতা আপুর বড় ভাবীকেও বলে দিও সে যেনো গোলাপী রঙের শাড়িটা পরে থাকে।”

আলোর মুখটা লাল হয়ে যায় লজ্জায়। ইশিতা আড়চোখে তাকিয়ে বলে,”কি বলেছে? ভাইয়া আই লাভ ইউ বলেছে?”

আলো মাথা নাড়ায়।

_তাহলে?

_বলা যাবে না।
অস্ফুট স্বরে বলে আলো ছুটে ঘর থেকে বের হয়।

***

পার্টির মিটিং শেষ করে কবির আলমগীর সামিনকে কাছে ডাকে। সামিন গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসতেই কবির আলমগীর বলে ওঠে,”সরকারি ফান্ড সিন্ডি*কেটের ব্যাপারটা বানোয়াট, তোমার শশুর মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিউজ লিখছেন।”

_বানোয়াট নাকি সত্যি সেটা তো উনি লেখেননি, উনি তো খবরটা তুলে ধরেছেন আংকেল, জনগণের মুখে যা শুনেছে। স্কুল টা অনেক বছর ধরে নির্মাণাধীন পরে আছে।

_খুব শশুর ভক্ত হয়েছো দেখছি! এতে যে তুমিও ফেঁসে যেতে পারো সেটা জানো? নেবে তুমি অপবাদ? দলের সুবিধা নিলে কিন্তু দলের অপবাদও মাথা তুলে নেবার সাহস থাকতে হয়।

সামিন কবীর আলমগীরের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”প্রথমত উনি শুধু আমার শশুর নয়, একজন সাংবাদিক। দ্বিতীয়ত, আমি এমন কোনো কাজ করিনি যাতে আমি ফেঁসে যাবো। তৃতীয়ত, দল করলে দলের অন্যায় সমর্থন করার মতো ছেলে আমি নই আংকেল।

কবীর আলমগীর সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে‌ । ছেলেটা বরাবর বেপরোয়া, এখন যদি এর খামখেয়ালির জন্য পার্টি ফেঁসে যায় সেটাই কবীর আলমগীরের ভ*য়। সে নিচু স্বরে বলে,”আরে, অন্যায় সমর্থন করতে কে বলেছে তোমাকে? তুমি শুধু তোমার শশুর কে বলবে অযথা এতো লেখালেখি যাতে সে না করে। এতে কত শত্রু তৈরি হয় বলো তো।”

সামিন ম্লান হাসে, তারপর বলে,”আমি আছি। শত্রু হলে আমি উ*প্রে ফেলতে জানি আংকেল। এটা বিশ্বাস করেন তো? আপনি অযথা চিন্তা করবেন না, অন্যায় তো আর আপনি করেননি।”

***
কলিং বেলের আওয়াজে রিতু দরজা খুলে দেয়। সামিন হাসি দিয়ে বলে,”ইহান ঘুমিয়েছে?”

রিতু মাথা নাড়ায়। সামিন এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আলোর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। আলো লিভিং রুমে নেই। নিশ্চয়ই খেয়ে দেয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আসলে সামিন একটু বেশি বেশি আশা করে ফেলছে ঐ মেয়েটার থেকে। নিজের মাকে যেমন দেখে আসছে, রিতুকে যেমন দেখে আসছে তাতে সে ভেবেছিলো বৌ মানুষ বুঝি এমনই হয়। আলোর মতো অলস বৌ যে পৃথিবীতে থাকতে পারে তা সে বুঝতে পারেনি।

রিতু সামিনের হাতের শপিং ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি এটাতে?”

সামিন মুচকি হাসে। রিতু হেসে বলে,”বুঝেছি! ভাবীর জন্য!”

সামিন লাজুক মুখটা নিয়ে উপরে চলে যায়। ছোটো ভাই-বোন গুলো এভাবে লজ্জা দিলে সে কোথায় যাবে!

ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে বিছানায় কেউ নেই। তাহলে সম্ভবত বারান্দায়। জোরে জোরে শব্দ করে আলমারি খুলে টিশার্ট বের করে। শব্দ করে ওয়াশ রুমের দরজা খোলে। আলো রানীর কোনো পাত্তা নেই।

আলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিলো,আজ আকাশে এতো বড় একটা রূপালী চাঁদ! শব্দ পেয়ে সে বুঝতে পেরেছে সামিন এসেছে। কয়েক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সে হেঁটে নিচতলায় চলে যায়। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে সামিন বারান্দায় উঁকি দেয়, বারান্দায় কেউ নেই। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে আলো দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা গ্লাসে মিন্ট লেমন।

সামিন আলোর হাতের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে বলে,”মুখে ছু*ড়ে মারবে নাকি!”

আলো হেসে ফেলে। সামিন গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দেয় তাতে। আলোকে একপলক দেখে নিচু স্বরে বলে,”ইশিতার বড় ভাবীকে গোলাপী রঙের শাড়ি পরতে বলা হয়েছিলো।”

আলো অন্যদিকে ফিরে বলে,”আপনি বললেই সে শুনবে কেনো?”

সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,”ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাবেন না? ইলহাম ভাইয়া আর ইশিতা আপু অপেক্ষা করছে আপনার জন্য দোতলার লিভিং রুমে। আপনি যান, আমি ঘুমিয়ে পরছি। দরজাটা চাপিয়ে রেখে যাবেন।”

সামিন কিছুক্ষণ আলোকে দেখে দরজার কাছে যায়। তারপর দরজার সিটকিনি তুলে ঘুরে দাঁড়ায়।

আলো মাথা নিচু করে রেখেছে। সামিন আলোর দিকে এগিয়ে যায়, তারপর নিচু স্বরে বলে,”দোতলার লিভিং রুমে আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে বসে নেই। আমার জন্য সম্ভবত দোতলার দক্ষিণ পাশের এই ঘরটাতে কেউ অপেক্ষা করেছিলো।”

আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,”মিথ্যা কথা। কেউ অপেক্ষা করে ছিলো না।”

_কেউ ছিলো না?
সামিন আলোর দিকে খানিকটা ঝুকে জিজ্ঞেস করে।

আলো মাথা নাড়ায়। সামিন বলে ওঠে,”ঠিকাছে। আমি লিভিং রুমে যাচ্ছি। আজকের ম্যাচটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে হবে‌‌ । তুমি ঘুমিয়ে পরো।”

সামিন ঘুরে দাড়াতেই আলো তার হাত টেনে ধরে। ঘাড় ঘুরিয়ে আলোকে দেখে, মাথা নিচু করে রেখেছে। সামিন বলে,”কথায় কথায় মাথা নিচু করে ফেলো কেন?”

_আপনি তো এটাই পছন্দ করতেন, আপনার বৌ মাথা নিচু করে থাকবে।

সামিন হাসে। বিছানা থেকে একটা শপিং ব্যাগ আলোর হাতে দিয়ে বলে,”এটা পরে আসো। তোমার পছন্দের লাল শাড়ি।”

আলো কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগটা নিয়ে নেয়। সামিন অবাক হয়ে বলে,”এভাবে কাপছো কেন!”

আলো এক ছুটে শাড়িটা নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়। সামিন চুপচাপ বসে থাকে। কিছু সময় পরে আলো শাড়িটা পরে বের হয়। শব্দ পেয়ে সামিন ঘুরে তাকাতেই থ’মকে যায়। আলো ওয়াশ রুমের দরজার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এগোনোর মতো শক্তি যেন সে খুজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে সামিন তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়, আলোর কাছে এসে নিচু স্বরে বলে,”কোলে তুলতে হবে?”

আলোর ইচ্ছা করছে এই লোকটাকে খুব করে ব*কে দিতে। ইচ্ছে করে লজ্জা দিচ্ছে আলোকে। সামিন আলোর নীরবতা দেখে বাঁকা হাসি হেসে আলোকে পাঁজা কোলা করে তুলে নেয়। আলো জমে যায় এক অদ্ভুত অনুভূতিতে। চোখ তুলে মানুষটার দিকে তাকাতে পারছে না সে।
বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আলমারি খুলে আলোর গয়না গুলো এনে আলোকে নিজের হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,”আমি অনেক ভালো বৌ সাজাতে পারি। দেখবে তুমি নিজেই নিজের থেকে চোখ সরাতে পারবে না।”

_তা কজন বৌ সাজিয়েছেন যে এতো ভালো অভিজ্ঞতা?
নিচু স্বরে বলে আলো।

সামিন হাসে। আলোর গলায় একটা হার পরিয়ে দেয়। আলো বলতে থাকে,”এতো দেরী করে ফিরলেন যে!”

_তোমাকে দিয়ে একটু অপেক্ষা করাতে ইচ্ছে হলো।

_আমার বয়েই গিয়েছে আপনার জন্য অপেক্ষা করতে। ঘুম আসছিলো না দেখে পুর্নিমার চাঁদ দেখছিলাম।

সামিন কয়েক পলক আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। আলো বলে,”কোথায় যাচ্ছেন?”

_একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি আছে।

আলমারি খুলে কোলবালিশ বের করে একটা কাঁচি দিয়ে কেটে সমস্ত তুলা বের করে ফেলে। আলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ক্ষনবাদে বলে ওঠে,”এসব কি করছেন? মাথা ঠিক আছে আপনার?”

_তুমি বুঝবে না,এটা আমার জীবনের চরম শত্রু। সামিন ইয়াসার মির্জা শত্রুর শেষ রাখে না। এটাকে কে*টে টুকরো টুকরো করার আমার অনেক দিনের ইচ্ছা আছিয়া,তুমি বাঁধা দিও না।

কোলবালিশ টাকে ছিন্ন*ভিন্ন করে আলমারির মধ্যে ছুড়ে ফেলে রাখে। আলো হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। এই লোকটা এতো পাগল কেনো!

সামিন গিয়ে আবারও আলোর মুখোমুখি বসে। আলো অস্ফুট স্বরে বলে,”আপনি পাগল!”

_তুমি বানিয়েছো।

মুগ্ধ চোখে আলোকে দেখতে থাকে সামিন। আলো নিচু স্বরে বলে,”আজকের চাঁদ টা খুব সুন্দর। দেখবেন?”

সামিন নকল হাই তোলার ভান করে বলে,”আমার অত ফালতু সময় নেই। আগে নিজের চাঁদটাকে দেখি।”

আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সামিন দীর্ঘসময় তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”এতোটা সুন্দর না হলেও পারতে। আমার বুকে যন্ত্রনা হচ্ছে খুব।”

আলো মাথা নিচু করে ফেলে। সামিন আলোর হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে হাতে চু*মু খায়।

যত সময় যাচ্ছে আলোর হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে,ভ*য় হচ্ছে,খুব পানির তৃষ্ণা পাচ্ছে।

বাতির কৃত্রিম আলোয় আলোর মুখটা আরো বেশ কিছুক্ষণ দেখে সামিন ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়।
আধো অন্ধকারে আলো টের পেলো তার স্বামী তাকে বুকে টেনে নিয়েছে। সে টের পেলো এখন তার কোন ভয় করছে না। বরং নিজেকে খুবই নিরাপদ মনে হচ্ছে এই বুকে।

সামিন ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,”ভালোবাসি আছিয়া।”

আলো নিশ্চুপ। সামিন বলতে থাকে,”তুমি ?”

আলো কোনো সাড়া দেয়না না। সবকিছুর জবাব যে মুখে দিতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। সামিন তাকে বুক থেকে আলগা করে উঠে গিয়ে খোলা জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আসে। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”অন্ধকার করে দিলেন যে!”

আলোকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে সামিন ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,”অন্ধকার কোথায়? আমার কাছে তো আমার আলো আছে।”

আলো কিছু বলে না আর, সামিন বলতে থাকে,”এই রাত টা একান্তই আমার। আমি চাইনা তোমার ঐ স্টুপিড ধূসর রঙের চাঁদটা তার আলো দিয়ে আমাকে বিরক্ত করুক। আজ আমি কারো বিরক্ত মেনে নেবো না। কেউ নাক গলাবে না আমাদের মাঝে। কাউকে বরদাস্ত করবো না আমি, ঐ পূর্নিমার চাঁদ কেও না।”

আলো তখনই চুপ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সে টের পায় সে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে তার স্বামীর ভালোবাসায়। পুরুষালি প্রতিটা স্পর্শে শুধু কামনা নয় বরং মিশে আছে একজন স্ত্রীর প্রতি একজন স্বামীর স্নেহ,দরদ,সম্মান এবং সীমাহীন ভালোবাসা।

চলমান……..