বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-৪৯

0
1044

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৪৯
#Esrat_Ety

চোখ মেলে আবিষ্কার করলো কেউ একজন তাকে আগলে ধরে রেখেছে। এমন ভাবে আগলে ধরে রেখেছে যেন আলো পালিয়ে যাবে, তাই সে তাকে ধরে রেখেছে। তার থুতনি ঠেকেছে আলোর মাথায়। নড়াচড়ার চেষ্টা করতে গিয়েও করে না আলো। নিচু স্বরে বলে,”শুনছেন,আমি চোর নই, ছেড়ে দিন, পালাবো না।”

সামিন সম্ভবত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আলো নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও ছাড়িয়ে নেয়না। বেশি নড়লেই ঐ লোকটা উঠে যাবে, জ্বা*লাতে শুরু করবে আলোকে।

অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছে না আলো। এখন রাত কত? ফজর হতে কত দেরী! হুট করে ঘুমটা ভেঙে যাওয়াতে মুশকিল হলো। রাতে আলোর যদি একবার ঘুম ভেঙে যায় তাহলে দু’চোখে আর ঘুম আসে না। একা একা কতক্ষন জেগে থাকবে এখন! আজান কেন দিচ্ছে না! ওঠার জন্য একটা বাহানা তো চাই!
হঠাৎ করে টের পেলো সামিন তাকে আরো শক্ত করে ধরে ফেলেছে। ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে ওঠে,”বাহানা খুজছো উঠে পরার? এখনো আজান দেয়নি । আরো আধাঘণ্টা পরে দেবে!”

আলো চ’ম’কে ওঠে। অবাক হয়ে বলে,”আপনি কিভাবে বুঝলেন? অন্ধকারে সময় দেখলেন কিভাবে?”

_ঘড়ির ঘণ্টার শব্দে, এখন সম্ভবত সাড়ে চার টা। যখন ঘণ্টা বাজছিলো তুমি ঘুমাচ্ছিলে।

_আপনি জেগে ছিলেন?

_হু।
আলো চুপ হয়ে যায়। সামিন বলতে থাকে,”স্ত্রী হবার ষষ্ঠতম শর্ত জানো আছিয়া?”

_না।
আলো অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়।

সামিন আলোর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”স্বামী ভালোবেসে আগলে ধরলে, আটকে রাখলে আনন্দের সাথে তার বুকে বন্দিনী হয়ে যাওয়া।”

_আমাকে বন্দিনী করেছেন?

_হু। তুমি বুঝতে পারোনি।

_বন্দিনী করে কি করবেন?

_ভালো বাসতে হাসতে জীবনটা অতিষ্ঠ করে দেবো তোমার।

অন্ধকারে সামিন দেখলো না লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া আলোর মুখটা। নিচু স্বরে আলো বলে ওঠে,”ওসব নেতারা প্রথম প্রথম একটু ঢ*প দেয়। এই করবো, সেই করবো, তারপর ক্ষমতায় গেলে নাকে সরিষার তেল লাগিয়ে ঘুমায়।”

সামিন ফিক করে হেসে ফেলে। কাছের মসজিদে আজান দিয়ে দিয়েছে। আজান শেষ হলে সামিন বলে ওঠে,”স্ত্রী হবার সপ্তম শর্ত শুনবে?”

_শুনবো। নামাজ আদায় করে শুনবো। আপনি কি অনুগ্রহ পুর্বক আমার গা থেকে আপনার আড়াই কেজির হাতটা সরাবেন মেয়র সাহেব? আপনার ভালোবাসার ওজন সইতে পারবো, ঐ হাতের নয়।

***
শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে দৌড়ে দৌড়ে কাজ করছে আলো। সবাই রান্নাঘরের দরজায় উঁকি দিচ্ছে। সিতারা আর ফুলির মা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রিতু চেঁচিয়ে বলে,”ভাবী পারবে না একা তুমি। আজ অনেকজন আসবে নাস্তা করতে, এতজনের খাবার তুমি একা একা কিভাবে তৈরি করবে?”

_পারবো আমি।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।

রিতু আর কথা বাড়ায় না, এই মেয়ে কারো কথা শোনার মেয়ে নাকি! অযথা কথা খরচ!

টেবিলে রুটির বাটি, সবজি, ডিমের পোচ সাজিয়ে রেখে আলো কোমর থেকে আঁচল সরিয়ে ডান কাঁধে টেনে দোতলায় চলে আসে। সামিন তখনও ঘুমাচ্ছে। আলো বিরবির করে বলে ওঠে,”রাতে ঢং করে জেগে থেকে এখন মটকা মে’রে ঘুমাচ্ছে।”

_ঢং করে জেগে থাকিনি।

আলো চ’ম’কে উঠে সামিনের দিকে তাকায়, সামিন চোখ বন্ধ করে বলতে থাকে,”বৌকে প্রথম জরিয়ে ধরে ঘুমানোর যে আনন্দ, সেই আনন্দে আমার ঘুমটাই কেটে গিয়েছে। তোমাকে এই অনূভুতি বলে বোঝাতে পারবো না আছিয়া, এই অনুভূতি বুঝতে গেলে তোমাকে পুরুষ হতে হবে।”

আলো চুপচাপ জানালার পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দেয়। বাইরের মিঠা রোদ এসে সামিনের মুখে পরে। আলো নিচু স্বরে বলে,”আপনার ছেলেরা এসে বসে আছে, আপনার সাথে নাস্তা করবে বলে, আর আপনি এখানে শুয়ে শুয়ে বাজে বকতে থাকুন।”

সামিন উঠে বসে। চোখ ডলে আলোর দিকে তাকায়। আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলে,”খুব চেষ্টা করছো চাল চলনে গিন্নি গিন্নি ভাব ফুটিয়ে তুলতে, কিন্তু হচ্ছে না। তুমি রিতুর কাছ থেকে কিংবা আমার শাশুড়ির কাছ থেকে ট্রেনিং নিও।”

আলো দাঁড়িয়ে থাকে, সামিন উঠে আলোর দিকে এগিয়ে এসে তার গালে একটা হাত বুলিয়ে বলে,”এখনও অনেক কিছু শেখা বাকি আছিয়া, গ্রো আপ!”
তারপর হুট করে আলোর কপালে একটা চু*মু খায়।

সিতারা এসে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,”আসবো ভাবী?”
_এসো।

আলো সামিনের থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে সিতারাকে আসতে বলে। সিতারা ঘরে ঢুকে মেঝের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। সে এসেছে ঘর ঝাড়ু দিতে। অবাক চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বলে,”এতো তুলা পরে আছে কেন ভাইজান পুরো ঘরে?”

প্রশ্নটি করে সে আলমারি খুলতে যায়। সামিন থামিয়ে দিয়ে বলে,”উহু, আলমারি খুলিস না সিতারা।”

_কেন ভাইজান?
_ওখানে একটা লা*শ পরে আছে।

গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন। আলো কপাল কুঁ’চ’কে সামিনকে থামিয়ে দিয়ে সিতারাকে বলে,”কিছুনা সিতারা আপা, মজা করছে। তুমি তোমার কাজ করো ‌।”

***
নাস্তার টেবিলে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সবাই সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে খুবই কৌতুহলী হয়ে। সামিন দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমাকে এভাবে কেনো দেখছিস?”

কেউ কোনো জবাব দেয়না।

সামিন রুটি ছি’ড়ে সবজি নিয়ে মুখে পুরে সবার দিকে তাকায়। এইবার সে বুঝতে পেরেছে সবাই খাওয়া রেখে কেনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন খাবারটা না পারছে ফেলতে,না পারছে গিলতে।
আলো রান্নাঘরে চলে যায়। সামিন মুখ থেকে খাবারটা ফেলে দিয়ে ছেলেদের গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”সবসময় তরকারিতে লবণ থাকতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও লেখা আছে তরকারিতে লবণ দিতেই হবে? লবণ ছাড়াও বেশ খাওয়া যায়।

তৌফ উ’শ’খু’শ করছিলো, হুট করে বলে ওঠে,”আপনি কেন থু’তু মে’রে ফেলে দিলেন ভাই!”

আলো আরো একবাটি সবজি নিয়ে এসে সবার মুখের দিকে তাকায় , অবাক হয়ে বলে,”খাচ্ছেন না কেনো আপনারা? সব তো সেভাবেই আছে!”

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি ওদের জন্য চা বানাতে বলো। ওরা এখন আর কিছু খাবে না।”

আলো বোকার মতো সবার দিকে তাকাচ্ছে। সবাই আলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে, তারপর উঠে লিভিং রুমে চলে যায়‌। আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন মৃদু হেসে বলে,”স্ত্রী হবার সপ্তম শর্ত হচ্ছে স্বামীর জন্য কিছু রান্না করলে,আগে নিজে লবণ চেখে দেখা।”

আলো হতভম্ব হয়ে বলে,”লবন বেশি হয়েছে?”

_তোমার মাথায় যেমন ব্রেইন নেই তেমন রান্নায়ও লবন নেই।
সামিন মজার ছলে ফিসফিসিয়ে কথাটি বলে চলে যায়।

***
টেবিলের ওপর স্তুপ করে রাখা আলোর বই। কোমরে হাত দিয়ে বই গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। সামিন গিয়ে পেছন থেকে আলোকে জরিয়ে ধরে বলে,”কি ব্যাপার! কি ভাবছো!”

_আজ কোন কোন ক্লাস বুঝতে পারছি না। ইউনিভার্সিটি যাবো।

_হিয়াকে ফোন করে জেনে নাও।

_ভালো বলেছেন, ওকেই ফোন করে দেখি।
আলো ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। সামিন দেখতে থাকে আলোকে। একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরেছে। চুলে একটা লম্বা বেনী। সামিন কাছে গিয়ে বেনী খুলে দেয়। আলো ফোন রেখে অবাক হয়ে সামিনকে বলে,”খুললেন কেনো?”

_খোপা বাঁধো।

_আচ্ছা আপনার কাজ নেই? আজ পার্টি অফিসে যাবেন না?

_যাবো। তোমাকে ইউনিভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে।

আলো চুলে খোঁপা বেঁধে নিতে নিতে বলে,”নামিয়ে কেনো দিতে হবে? আমি কি বাচ্চা? ইহানের বয়সী?”

_না তবে ইহানের মতো আদুরে আমার কাছে।

_আপনার আহ্লাদ দেখে আমার হাড় জ্বলে যাচ্ছে। ওসব আপনার ভাই-বোনদের সাথে দেখান। আমি একা একা যাবো ভার্সিটিতে, মোড়ের মাথায় নৌশিন আর শ্রাবনী অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

সামিন একহাত দিয়ে আলোকে আগলে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে,”এখন এমন ধুরছাই করছো তো! যখন থাকবো না তখন….!”

সামিনের মুখ চেপে ধরে আলো তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”কি হচ্ছে এটা? এতো জ’ঘ’ন্য টাইপের মজা কেন করতে হবে?”

সামিন আলোর হাত সরিয়ে নিয়ে হাসতে থাকে।

আলো আলমারি থেকে সামিনের পাঞ্জাবি বের করে বিছানার উপর রাখতে রাখতে বলে,”আজ ও বাড়িতে যেতে চাচ্ছি আমি ক্লাস শেষে। আজান আয়াতের গিফট গুলো দিয়ে আসবো।”

_হ্যা,যাবে। অসুবিধা কোথায়?

আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”আজ রাত টা দাদীর কাছে থাকবো। ফিরবো না এ বাড়িতে। দু’দিন থাকবো ওখানে ভাবছি! ”

সামিন আলোর দিকে তাকায় । আলো নিচু স্বরে বলে,”থাকবো?”

কয়েক মূহুর্ত সময় নিয়ে সামিন বলে,”কেনো থাকবে না! তোমার ইচ্ছে হলে অবশ্যই থাকবে। আমার কোনো অসুবিধা নেই।”

আলো ভেবেছিলো সামিন বলবে,সেও যেতে চায়। কিন্তু সামিন বলেনি। আলো ভাবলো হয়তো তার এখানে খুব কাজ আছে। নয়তো সামিন যেতে চাইতো।

সামিনের ফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। ইশমাম ফোন দিচ্ছে, ফোনটা রিসিভ করে বারান্দায় চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে মুখ হাসি হাসি করে ঘরে ঢোকে। আলো বলে,”হঠাৎ এতো খুশি?”

_ইশমাম আসছে।
আনন্দের সাথে বলে সামিন। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে অস্বস্তি।

সামিন হঠাৎ আলোকে বলে ওঠে,”এক মিনিট, দাঁড়াও তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।”

আলো দাঁড়িয়ে পরে। সামিন তার ফোন থেকে দু’টো মেয়ের ছবি বের করে আলোকে দেখিয়ে বলে,”দেখো তো, এই দু’টো মেয়ের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী?”

আলো অবাক হয়ে সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্ফুট স্বরে বলে,”কারা এরা?”

_আগে বলো।

আলো ছবি দুটোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা মেয়েকে দেখিয়ে বলে,”এই মেয়েটা।”

সামিন হেসে বলে,”ঠিক বলেছো, আমারও এটাই মনে হয়েছে। এটাই বেস্ট হবে ইশমামের জন্য।”

আলো অবাক হয়ে বলে,”ইশমামের পাত্রী?”

_হু, আরো কয়েকজন দেখেছি। এবার দেশে ফিরলেই ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেবো।

আলো আমতা আমতা করে বলে,”ওর পারমিশন না নিয়ে এভাবে মেয়ে দেখা ঠিক হচ্ছে? রে*গে যাবে যে আপনার ওপর!”

_আর কি করবো? সারাদিন দেবদাসের মতো ঘুরে বেড়াবে এটা দেখবো? কি জানি কোথাকার এক শাক*চুন্নীর পাল্লায় পরেছিল। কত ভালো ভাইটা আমার, খুব ভালোবাসতো ঐ শাক*চুন্নীকে, দেশে এসেছিলো আমাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেবে বলে, এসে দেখে শাক*চুন্নী বিয়ে করে নিয়েছে।

আলো চুপচাপ তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন বলতে থাকে,”আমার ঐ মেয়েটাকে একবার দেখার খুব ইচ্ছা। আমার ভাইকে রিজেক্ট করে বিয়ে করে নেয়! নিশ্চয়ই আরো বড়লোক ছেলে পেয়েছে, তাই বিয়ে করে নিয়েছে, আজকালকার মেয়েগুলো প্রচন্ড লোভী।”

আলোকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামিন তাকে কাছে টেনে নেয়, প্রসঙ্গ পালটে বলে,”কি হয়েছে? কি ভাবছো?”

_কিছুনা।
অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় আলো।

সামিন আলোর কপালে একটা চুমু একে দিয়ে পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে ঘর থেকে বের হয়। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আলো কখনোই এতো বড় সত্যিটা এই লোকটাকে জানতে দিতে চায় না, ভুল করেও না, সহ্য করতে পারবে না এই লোকটা।

***
সামিনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে পার্টি অফিসের সবাই খুশি হলেও খুশি হয়না জাবির। সে একপলক তাকিয়ে আবারও ফোন ঘাঁটতে থাকে। পার্টির জরুরী আলোচনায় আজ উপস্থিত নেই কবীর আলমগীর। সামিন এগিয়ে যেতেই জেনারেল সেক্রেটারি ইসহাক খাঁ বলে ওঠে,”এতো দেরী? আগে তো তোমাকেই আগে পেয়ে যেতাম মিটিং এ।”

সামিন ম্লান হেসে কিছু একটা বলতে যাবে তখনি জাবির পাশ থেকে বলে ওঠে,”কাউকে বেশি প্রশংসা করলে তার এভাবেই অবনতি হয় ইসহাক আংকেল।”

সামিন শীতল চোখে জাবিরের দিকে তাকায় , তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”তুই হঠাৎ এলি যে! মেয়ে নাচিয়ে সময় পাস পার্টির কাজ করার?”

ফোন রেখে জাবির সামিনের দিকে তাকায়। তারপর বলে ওঠে,” মামা তোকে একটু বেশি লাই দেয়। নিজেকে খুব যোগ্য মনে করিস!”

_ভুল বললি। আমি নিজেকে কিছুই মনে করি না। এটা তো জনগণের কাজ, তারাই আমাকে হয়তোবা কিছু একটা মনে করে তাই আমি মেয়র, আর তুই দলের ক্রীড়া সম্পাদক হয়ে দলের ফান্ড থেকে টাকা সরিয়ে বাজারী মেয়েদের মুজরা দেখিস! থাই*ল্যান্ড যাস!

জাবির কিছু বলতে যেয়েও পারে না, সামিনকে সে চেনে, এখানে তর্কাতর্কি করলে কিছুই হবে না উল্টো তার মুখোশ খুলে যাবে!

সামিন ইসহাকের দিকে তাকিয়ে বলে,”একজন মেয়রের অনেক কাজ থাকে আংকেল, ফান্ড থেকে কে কখন টাকা সরালো সেটা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করলে তো হবে না! সেসব করার জন্য পুলিশ আছে, সাংবাদিক আছে , তাদেরকেই কাজ টা করতে দিন না।”

ইসহাক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,”এতো গুলো টাকা সামিন। একেবারে দলের নাম ডুবে যাবে, বলছিলাম তোমার শশুর কে বলে একটু বুঝিয়ে নিউজ টা! এখন রিটায়ার্ড করেছে, কোথায় হজ্ব করতে যাবে। তা না করে এখনো খাটছে! ”

সামিন ইসহাকের দিকে তাকাতেই ইসহাক একটা ঢোক গিলে ফেলে। ঘুরে ঘুরে মিটিং এর প্রত্যেকটা লোককে একবার দেখে নিয়ে সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,”যে যে অকাজ টা করেছে, তাদের সবাইকে দাম দিতেই হবে। অকাজ টা করার আগে দ্বিতীয় বার ভাবা উচিত ছিলো।”

সামিন চলে গেলে জাবির বিরক্ত ভঙ্গিতে ইসহাকের দিকে তাকিয়ে বলে,”নিজেও খাবেনা, আমাদেরও খেতে দেবেনা। এটাকে দলে রেখে কত বড় ভুল করলেন তা আপনারা আর মামা খুব শিগগিরই বুঝতে পারবেন আংকেল। তখন না পারবেন গিলতে, না পারবেন উ*গ্রে ফেলতে।”

***
ফোনের দিকে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে আছে সামিন। মহারানীর কোনো পাত্তা নেই। অবশ্য বাপের বাড়ি গেলে মেয়েরা এমন করে। তখন স্বামী কে! স্বামী দিয়ে কি করে!
যাওয়ার সময় একবার সামিনকে যাওয়ার জন্য সাধলোও না। সামিন কি হ্যাংলা নাকি! প্রত্যেক বার সামিনই সেধে সেধে যাবে? কখনোই না। সামিন ইয়াসারের আত্মসম্মান আছে।

ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই সামিন ফোনের দিকে তাকায়, ভেবেছিলো আলোর ফোন। কিন্তু ফোন এসেছে সিম কোম্পানি থেকে। বিরক্ত ভঙ্গিতে সামিন মুখে চ কারন্ত শব্দ করে ।

সামিনের কোলে জামিলের ছেলে জাহিন। সে এসেছে জামিল আর হেনার বাড়িতে।

হেনা এসে জাহিনকে সামিনের কোল থেকে নিয়ে নেয়। সামিন ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ উ’শ’খু’শ করে আলোকে ফোন দেয়। ফোনটা রিসিভ করে আলো কানে ধরে চুপ করে থাকে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”খেয়েছো?”

_হ্যা। আপনি?

_খেয়েছি জামিলের বাড়িতে।

_কেমন আছে জামিল ভাইয়ের ছেলেটা?

_ভালো।

আলো চুপ হয়ে যায়। সামিন প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে। দু’টো রোমান্টিক কথা বলতে জানেনা এই মেয়ে। হয় চুপ করে থাকবে নয়তো এমন কথা বলবে যাতে সামিনের কলিজা পর্যন্ত পু*ড়ে যায়।
কয়েক মূহুর্ত পরে আলো বলে ওঠে,”কি হলো! চুপ করে আছেন যে।”

_কিছুনা। রাখছি।

সামিন ফোন কেটে দেয়। আলো চুপচাপ বসে আছে। এমন অদ্ভুত আচরণ করলো কেনো লোকটা!

কিছুক্ষণ পরে আবারও ফোন দেয় সামিন। আলো আবারও ফোন রিসিভ করে বলে,”কি হলো! বলবেন তো কি হয়েছে! এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন!”

_কিছু না রাখছি।

ফোন কেটে দেয় সামিন। আলোর এবার প্রচন্ড মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছে! কিছু বলছেও না, এমন উদ্ভট আচরণ করছে! শাশুড়ি মা এই লোকটাকে পেটে নিয়ে কি খেয়েছিলো! আপাদমস্তক পাগল একটা লোক!

সন্ধ্যা থেকে কিছুক্ষণ পরপর সামিন আলোকে ফোন দিচ্ছে। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিচ্ছে। আলো না পারছে বাপের বাড়িতে আসা কোনো অতিথিকে সময় দিতে, না পারছে একটু পড়াশোনা করতে। এমন ব্যাক্তিত্ববান মানুষের থেকে এমন উদ্ভট আচরণ মেনে নেয়া যায় না। একবার ইচ্ছা করলো ফোনটা সুইচ অফ করে দেবে, কিন্তু ঐ লোককে বিশ্বাস নেই, দেখা যাবে আব্বু আম্মুর নাম্বারে ফোন দিতে শুরু করবে!

কিছুক্ষণের জন্য ফোন দেওয়াটা থেমেছে। রাত তখন প্রায় বারোটা। আলোদের বাড়ির সবাই রাত দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পরে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। আলোর চোখ দুটোও বেশ লেগে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে ফোনটা বেজে ওঠে আবার ।

“হায় খোদা” বলে আলো ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরে বলে,”এখনো ঘুমাননি?”

সামিন চুপ করে আছে। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”আপনি কি কাল আসতে চাচ্ছেন মেয়র সাহেব?”

সামিন কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলে ওঠে,”দরজা খোলো। আমি এসে গিয়েছি।”

আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসে। ঐ পাগল লোকটার এমন আচরণে আলো একটুও অবাক হয়নি। চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে দ্রুতপায়ে হেটে গিয়ে সদর দরজা খুলে দেয়। সামিন আলোকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে কিছু না বলে সোজা হেটে আলোর শোবার ঘরের দিকে যায়। সদর দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে আলো সামিনের পিছু পিছু যায়।

ঘরে ঢুকে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পরে সামিন। আলো নিচু স্বরে বলে,”আগেই তো আসতে পারতেন! এতো ঢং করলেন কেন?”

_আমাকে তো কেউ দাওয়াত করেনি। আমি কি হ্যাংলার মতো চলে আসতাম? মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা হ্যাংলা?

_হ্যাংলার মতো আসেননি, কিন্তু চোরের মতো ঠিকই এসেছেন। পাড়ার কুকুর গুলো এজন্যই ঘেউ ঘেউ করছিলো, আপনাকে দেখে। চোর ভেবেছিলো ওরা আপনাকে।

সামিন চুপ করে থাকে। আলো সামিনের হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”গাড়ি কোথায়?”

_মোড়ের মাথায়।

_জামান কাকার গ্যারেজে রাখতে পারলেন না? এটা আপনাদের মতো ভিআইপি এলাকা না, কাল সকালে গিয়ে দেখবেন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু গাড়ির ভেতরে কিছু নেই।

_মেয়রের গাড়ি কেউ ধরবে না।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন।
তারপর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়।

আলো বিছানা ঠিক করতে করতে বলে,”অমন অদ্ভুত আচরণ করছিলেন কি জন্য? আপনার জন্য কাউকে সময় দিতে পারছিলাম না আমি। আপনি কি অবুঝ?”

_স্ত্রী হবার আট নাম্বার শর্ত হচ্ছে মিনিটে মিনিটে স্বামীকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা, সে কোথায় কি করছে। আমার দলের ছেলেদের দেখি, ওদের প্রেমিকা কিংবা বৌ রা ফোন দিতেই থাকে,দিতেই থাকে।

আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”আট নাম্বার শর্তের কথা জানতাম না, এরপর থেকে করবো।”

তারপর সামিনের হাত থেকে তোয়ালে টা নিয়ে আলো বলতে থাকে,”নিন, এবার দরজা বন্ধ করে শুয়ে পরুন। আমি আসছি।”

_আমি আসছি মানে?
অবাক হয়ে সামিন জানতে চায়। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি তো দাদীর কাছে থাকবো বলে এসেছি এক রাত। দাদীর ঘরে যাচ্ছি আমি।”

সামিন বাচ্চাদের মতো কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,”তো সারাদিন থাকোনি তুমি দাদীর কাছে? রাত বিরাতে ওনাকে অসুবিধায় ফেলার দরকার কি?”

আলোর ভীষণ হাসি পাচ্ছে সামিনের মুখের অবস্থা দেখে। সে হাসি চাপিয়ে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”তাকে সময় দিতে দিয়েছেন আপনি? সারাদিন ফোন দিয়ে দিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছেন। এখন ঘুমান। আমি আসছি।”

আলো সত্যি সত্যি চলে যায়। সামিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ দরজার দিকে। তারপর মুখ ভার করে বিছানায় শুয়ে পরে।

ঘর থেকে বের হয়ে দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে আলো শাড়ির আঁচল মুখে চেপে হাসতে থাকে। মেয়র সাহেবের ভোঁতা হয়ে যাওয়া মুখটা মনে করে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নেয়। বেশ হয়েছে! সন্ধ্যা থেকে হা’ড় জ্বালিয়ে খেয়েছে। এখন একটু শাস্তি পাক!

দীর্ঘসময় সময় কেটে যায়। সামিন পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঘরের বাতিটা জ্বলছে, দরজাও খোলা। কিছুক্ষণ পরে খট করে দরজা বন্ধ করার শব্দ হয়। সামিন ঘুরে তাকায় না। দুমিনিট পরে আলো এসে তার পাশে গুটিসুটি মে’রে শুয়ে পরে।

_এলে কেনো?
আলোর দিকে ঘুরে না তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে জানতে চায় সামিন। আলো নরম গলায় বলে,”দাদী বকে পাঠিয়েছে।”

সামিন কোনো কথা বাড়ায় না। আলো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”মজা করছিলাম, আমি দাদীর ঘরে যাই-ই নি।”

সামিন নিশ্চুপ। আলো উঠে বসে,বলে,”ঠিকাছে! আমি এবার সত্যি সত্যি যাচ্ছি।”

আলো বিছানা থেকে নেমে পরতে নিলে সামিন ঘুরে খপ করে আলোর হাত টেনে ধরে। আলো সামিনের দিকে তাকাতেই সামিন আলোকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে কপাল কুঁ’চ’কে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো কিছু বলার আগেই সামিন বলে ওঠে,”স্ত্রী হবার নবম শর্ত জানো? স্বামী কোনো কারনে রেগে গেলে তার রাগ ভাঙাতে হয়। রাগ না ভাঙিয়েই চলে যাচ্ছো?”

আলো চুপ করে কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”স্ত্রী হবার এতো এতো শর্ত। স্বামী হবার শর্ত নেই? স্বামীদের বুঝি সাত খু*ন মাফ! বুঝি কাবিনের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে দিলেই আর কোনো শর্ত থাকে না তাদের জন্য?”

কপালের কাছের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে আলোর। সামিন মৃদু হেসে চুল গুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”আছে তো। শর্ত আছে। তবে স্বামী হবার শর্ত একটাই। সেটা হলো সারাজীবন স্ত্রীকে আগলে রাখা, ভালোবাসা,আদর,যত্ন,আহ্লাদে। নিজের কাছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রাখা, মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে যাওয়া স্ত্রী ছেড়ে যেতে চাইলেও কখনোই তাকে যেতে না দেওয়া।”

এতটুকু বলে সামিন থামে , তারপর আবার বলে ওঠে,”স্ত্রীকে কখনোই বিছানার সৌন্দর্য মনে না করা, বরং স্ত্রীকে বিছানার কোলবালিশ মনে করা।”

শেষের কথাটা বলে সামিন হেসে ফেলে। আলো তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন হাসতে হাসতে আলোকে আগলে নেয়। আলো মিছিমিছি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় এই পাগল লোকটার থেকে। সামিন আলোকে আরো আগলে নিয়ে আলোর কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,”স্ত্রী হবার দশম শর্ত জানো আছিয়া? স্বামী যখন ভালোবাসতে চাইবে তখন তাকে ভালোবাসতে দেওয়া। নড়াচড়া না করা। তুমিও করবে না। চুপচাপ থাকো।”

কথাটি বলে সামিন তার বৌয়ের কপালে চু*মু খায়, তারপর বলে,” এই হচ্ছে মেয়র সাহেবের ভালোবাসা, দিয়েছে তার ভালোবাসার আছিয়ার কপালে।”

চলমান…..