বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-৫৫

0
1054

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৫৫
#Esrat_Ety

লাইব্রেরীতে চুপচাপ বসে আছে ইশমাম। তার সামনে একটা কফির মগ। অর্ধেকটা পরিমান কফি রয়েছে মগে যা কিছুক্ষণ আগেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, খাওয়ার অযোগ্য। কিন্তু ইশমাম ডান হাতে মগটা তুলে নিয়ে চুমুক দেয়।
তার চোখ মুখের কোনো ভাবান্তর নেই। অবশ্য কিছুক্ষণ আগে তার সাথে যা ঘটে গিয়েছে এতে এই ঠান্ডা কফি তার গলা দিয়ে দিব্যি নেমে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগের ঘটনায় আলোকপাত করা যাক। ইশমামের জন্য পছন্দ করে রাখা পাত্রী পালিয়ে গিয়েছে, এটা ইশমামের জন্য একটা স্বস্তির খবর হলেও ইয়াসার মির্জার জন্য একটা দুঃসংবাদ। ইশমাম খবরটা পেয়েই লাইব্রেরীতে ঢুকে বসে থাকে বই হাতে নিয়ে। সামিন একটু আগে লাইব্রেরীতে এসে ইশমামের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে কাশি দিয়ে ইশমামের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। ইশমাম বই সামনে থেকে সরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়।

সামিন নড়েচড়ে বসে বলে ওঠে,”তোর সাথে একটা কথা ছিলো।”

_দুইটা বলো।

_কিছু মনে করিস না। মেয়ের পরিবারও জানতো না মেয়ের সম্পর্ক আছে কোনো ছেলের সাথে।

ইশমামের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌছায়। ভাইয়া এমন করে কথা বলছে যেন ইশমাম বিয়ে ভাঙার কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে!

সামিন ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে তার জবাবের অপেক্ষায়। ইশমাম ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”কিছু মনে করিনি। ইটস অলরাইট।”

সামিন চুপ হয়ে যায়। ইশমাম বুঝতে পারছে তার ভাই শুধুমাত্র এটা বলার জন্য আসেনি, তাই নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে,”বলো? আবার কি? আরেকজনকে দেখতে যেতে হবে? কাকে? আমি যাবো। এখন যাও এখান থেকে।”

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”পরীকে তোর কেমন লাগে ইশমাম?”

ইশমাম হতভম্ব হয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বলতে থাকে,”তোর জন্য পরীকে পছন্দ করেছে তোর বড় ভাবী ‌।”

ইশমাম দ্বিতীয় বারের মতো আবাক হয়। অবাক চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে,”বড় ভাবী?”

_হু। আমারও খুব পছন্দ পরীকে। এসব কথা আগে মাথায় আসলে কখনোই এখানে সেখানে পাত্রী দেখে বেড়াতাম না। তুই যদি আপত্তি না করিস তাহলে আমি পোনা চাচার সাথে কথা বলি? দেখ এখন তোর যদি মনে হয় পোনা চাচা এ বাড়ির কেয়ারটেকার তাহলে আমার আর কিছুই বলার নেই, আমি পোনা চাচাকে কখনোই কেয়ার টেকারের মতো দেখিনি তুই জানিস, সে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, বাবার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। কখনোই তাকে আমি ঐ চোখে দেখিনি। বাবাও না ।”

ইশমাম ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”এতো ফরমালিটি করে কথা বলছো কেনো? পোনা চাচাকে আমিও ওই চোখে কখনও দেখিনা। যে লোকটার কাঁধে চড়ে বড় হয়ে ওঠা তাকে ঐ চোখে দেখবো?”

_তাহলে আমি কথা বলবো পরী আর তোর ব্যাপারে? চাইবো তোর জন্য পরীর হাত? অমন ভালো মেয়ে, মেধাবী, ভদ্র। তোর বড়ভাবীর নাকি বেশ মনে ধরেছে পরীকে।

ইশমাম ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,”বড় ভাবীর বেশ মনে ধরেছে?”

_হু।

_তোমারও বেশ মনে ধরেছে?

_হু।

_ঠিকাছে, তুমি আর বড়ভাবী যা ভালো মনে করো। তোমরা খুশি হলে আমারও ভালো লাগবে। এখন যাও আমি বই পরছি।”

ইশমাম সামিনকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাতের বইটার পাতা ওল্টাতে থাকে।

সামিন ভাইয়ের থেকে মৌন সম্মতি পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ সে ছুটে যায় পরীর কাছে।

ইশমাম সেই থেকে লাইব্রেরী ঘরে বসে আছে ভাবলেশহীন হয়ে। ঠান্ডা কফিটা পুরোটাই গিলেছে, তাকিয়ে থেকেছে হাতের বইটার দিকে অনর্থক। একবার পরীর কথা ভাবলো সে, ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে? ঐ অদ্ভুত মেয়েটাকে? সামিনের কাছে আপত্তি জানালে অবশ্যই সামিন ইশমামের কথা শুনতো। কিন্তু কি লাভ! পরী না হলে অন্যকেউ , অন্যকেউ না হলে অন্যকেউ। আর কত! এভাবে আর কত!
কারো পায়ের আওয়াজে ইশমাম মাথা তুলে তাকায়। ভেবেছিলো ভাইয়া এসেছে, পুনরায় বইয়ের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলে ওঠে,”বললাম তো আমি রাজি। আবার এলে কেনো। যাও।”

“আমার আপনার সাথে কথা ছিলো।”

পরীর গলার আওয়াজে ইশমাম চ’ম’কে উঠে তাকায়। সে এই মেয়েটাকে একেবারেই আশা করেনি। পরী মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশমাম নড়েচড়ে বসে বলে,”বলো।”

“এই বিয়েতে আমি রাজি নই। ভাইয়াকে প্লিজ বুঝিয়ে বলবেন একটু আপনি? আমার আপত্তি জানানোর সাহস নেই ভাইয়াকে।”

ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে বোকার মতো। কিছু সময় পরে নিচু স্বরে বলে,”আচ্ছা ঠিকাছে বলবো। যাও।”

পরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইশমাম বলে,”কি হলো যাও!”

_আপনি কি কিছু মনে করেছেন?

_মনে কেনো করবো? তুমি একজন শিক্ষিতা এবং প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। ভাইয়া ভাবীর খেয়াল খুশিতে তোমার জীবন চলতে পারে না। আমি ভাইয়াকে বুঝিয়েই বলবো, তুমি যাও।

পরী যায়না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলে ওঠে,”আপনার মধ্যে কোনো খুঁত নেই। যেকোনো মেয়েই আপনাকে স্বামী হিসেবে পেতে চাইবে। দয়া করে এই প্রত্যাখ্যান আপনি অপমান হিসেবে নিবেন না।”

ইশমাম খুব ভালো করে পরীকে দেখতে থাকে। অসম্ভব রকমের সুন্দরী এই মেয়েটাকে এখন যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক লাগছে। কথাবার্তা বলছে বড় মেয়েদের মতো। আচরণ স্বাভাবিক এবং সহজাত। কোনো ধরনের ন্যাকামী নেই সংলাপে। ইশমামের খুবই আগ্রহ জাগে মেয়েটি কেনো তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তা জানতে । লাজুক এবং নমনীয় দেখতে মেয়েটির কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে? থাকতেই পারে। জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও ইশমাম মুখ ফসকে বলে ফেলে,”বয়ফ্রেন্ড আছে?”

পরী মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে দেয়। ইশমাম বলতে থাকে,”বেশ। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। এটা বিয়ে করার সময়ও নয়। ভাইয়াকে ম্যানেজ করবো‌।”

“আমি আসলে কারো জীবনে শান্তনা পুরস্কার হিসেবে থাকতে চাইনা।”
ইশমামের কথা শেষ না হতেই পরী বলে ওঠে। ইশমাম কপাল কুঁচকে বলে ওঠে,”শান্তনা পুরস্কার? হোয়াটস দ্যাট?”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরী নিচু স্বরে বলতে থাকে,”প্রথম প্রেম হচ্ছে একজন পুরুষের কাছে একটা ট্রফির মতো। যেটা জিতলে নিজের জন্ম সার্থক মনে হয় তাদের কাছে আর হারলে জীবনে যতই বিকল্প নারী আসুক না কেনো, তারা মনে করে ওটা তাদের শান্তনা পুরস্কার। আমি কোনো শান্তনা পুরস্কার হয়ে থাকতে চাই না কোন পুরুষের কাছে।”

ইশমাম পরীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। মেয়েটার বয়স কত! বাইশ কি তেইশ বছর! তার থেকে চার-পাঁচ বছরের ছোটো। কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান তার হয়েছে,বোঝাই যাচ্ছে।

পরী ইশমামকে হাসতে দেখে মাথা তুলে তাকায় ইশমামের দিকে। ইশমাম হাসতে হাসতে বলে,”অনেক বড় বড় কথা বলতে পারো দেখছি! আচ্ছা যাও ভাইয়া আর ভাবীকে আমি খুব করে বলে দেবো তোমাকে যাতে শান্তনা পুরস্কার না বানানো হয়। তুমি অবশ্যই ট্রফি হবে কারো না কারো লাইফে, যে তোমাকে পেয়ে ধন্য হয়ে যাবে, ট্রফির মতো সাজিয়ে রাখবে তোমাকে, তোমার অনুভূতিকে। এখন যাও। মন দিয়ে পড়াশোনা করো।”

_ভাইয়া যদি জানে আমি আপনাকে রিজেক্ট করেছি তবে ভাইয়া খুব কষ্ট পাবে,আমি কোনো অবস্থাতেই ভাইয়াকে কষ্ট দিতে চাইনা…
আমতা আমতা করে বলে ওঠে পরী।

_ঠিকাছে যাও, ভাইয়াকে বলবো আমার তোমাকে পছন্দ হয়নি।

পরী চুপচাপ ইশমামের ঘর থেকে বের হয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সে ঘুরে আবারও ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম তার দিকে তাকিয়ে ছিলো, ম্লান হেসে পুনরায় বই হাতে নেয়। পরী দ্রুতপায়ে হেটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

ইশমাম বই হাতে নিয়ে মুচকি হাসে । যতটা ন্যাকা মনে হয়েছিলো ততটা ন্যাকা নয় এই মেয়েটা।

***
সামিনের চেঁচামেচিতে পরীর ঘুম ভেঙে যায়। এই সপ্তাহে সে হোস্টেলে যায়নি। ইশিতার অনুরোধে বাড়িতেই ছিলো। অবশ্য সামিন বরাবর তাকে ধমকাতো বাড়িতে না থেকে হোস্টেলে কেন থাকে সেজন্য। চেঁচামেচির আওয়াজ টা আসছে ইশমাম মির্জার ঘর থেকে। ঘরের বাইরে আলো ইরফানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল টা মুখে দিয়ে খুব মজা করে চুষছে ছোটো প্রান টা। আলো সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও তার কান শুনছে দুই ভাইয়ের কথোপকথন।

পরী ইশিতার ঘর থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়‌।

ইশমাম ল্যাপটপে কিছু একটা টাইপ করে যাচ্ছে। সামিনের দিকে সে মাথা তুলে তাকায় না। সামিন গলার স্বর উঁচু করে বলতে থাকে,”প্রথমে কেনো রিজেক্ট করলি না? আমি যখন পরীর সাথে কথা বলে সব ঠিক করে ফেলেছি তখনই কেনো রিজেক্ট করলি? এখন আমি পরীকে,পোনা চাচাকে কি জবাব দেবো? তুই কেন করছিস এমন ইশমাম!”

_তোমার কোনো জবাব দিতে হবে না। আমি পোনাচাচা আর পরীর কাছে মাফ চেয়ে নেবো।
কি-বোর্ডে টাইপ করতে করতে ঠান্ডা গলায় বলে ইশমাম। সামিন কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ইশমামের হাত থেকে ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ছু’ড়ে মারে।

ভাঙচুরের আওয়াজে পরী কেঁ’পে ওঠে। মানুষটা তার জন্য এতো কথা শুনছে ভাইয়ার। পরী ঠিক করলো সে ভাইয়াকে সত্যিটা বলে দেবে, ইশমামকে সে রিজেক্ট করেছে, ইশমাম নয়।

ইশমাম চুপচাপ বসে আছে। তার যে একটা ল্যাপটপ ভেঙে গিয়েছে সেদিকে তার কোনো হেলদোল নেই। সামিন কয়েক মুহূর্ত ইশমামের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

ঘরের বাইরে বেরিয়ে পরীর সামনে পরে যায় সামিন,পরী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, একপলক পরীকে দেখে সামিন নিজের ঘরে চলে যায়,আলো ইশমামের ঘরের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইরফানকে কোলে নিয়ে সামিনের পিছু পিছু চলে যায়।

পরী ইশমামের ঘরের বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইশমাম বিছানার ওপরে চুপচাপ বসে থাকে, তার দৃষ্টি ভাঙা ল্যাপটপের দিকে।

***
ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে এগারোটার ঘরে। পরী হাতের বইটা পাশে সরিয়ে রেখে ইশিতার দিকে তাকায়। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে শান্তর সাথে কথা বলছে সে। এদের কথা ফুরাতেই চায়না। পরী বুঝতে পারে না,এরা এতো কি কথা বলে সারাদিন, কোথা থেকে খুঁজে পায় এতো কথা? তিনদিন পরে শান্ত ভাইয়া ইশিতা আপুকে অনুষ্ঠান করে নিজের বাসায় নিয়ে যাবে। তার অফিসের কাছেই দুই বেডরুমের চমৎকার দেখতে একটি ছোটো ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে শান্ত। সেদিন শান্তিনীড়ে এসে আলো আর পরীকে নিয়ে গিয়েছিলো ফ্ল্যাট সাজাতে। আলো আর পরী খুব সুন্দর করে ইশিতার নির্দেশ মতো গোটা ফ্ল্যাট সাজিয়ে দিয়ে এসেছিলো।

ওড়নাটা উঠিয়ে গাঁয়ে জরিয়ে নিয়ে পরী পশ্চিমের টানা বারান্দার দিকে যায়। হঠাৎ তার মনে হলো ইশমাম সেখানে আছে। দরজা ঠেলে দেখতে পেলো তার অনুমান ঠিক, ইশমাম দাঁড়িয়ে আছে। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই পরীকে দেখে আবারও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তার হাতে একটা সিগারেট, এবং আজ সে সিগারেটটা পা দিয়ে পি’ষে দেয়না। হাতে ধরেই দাঁড়িয়ে থাকে। পরী ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশমাম চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে পরী বলে ওঠে,”সরি! আমার জন্য আপনাকে এতো গুলো কথা শুনতে হয়েছে। ভাইয়া রা’গ করে আছে আপনার উপর আমার জন্য। আপনার সাথে কথা বলছে না!”

ইশমাম ম্লান হাসে, তারপর বলে,”ঐ লোকটা আমার ভাইয়া। দেখবে কাল সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ফল কেনো খাচ্ছি না বলে বকাঝকা করছে।”

পরী মাথা নিচু করে মৃদু হেসে বলে,”আপনার জীবনে ভাইয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাইনা?”

_মনে করো ভাইয়াই আমার জীবন, আমার জুতার ফিতে বেঁধে দেওয়া থেকে শুরু করে আমার সব দোষ নিজের মাথায় নিয়ে বাবার কাছে বকা শোনা, মায়ের হাতে মা’র খাওয়া, সবসময় আমাকে, আমাদের আগলে রেখেছে। এবাড়ির সবার জীবনই সামিন ইয়াসার মির্জা কেন্দ্রিক।

_আমার আর বাবার জীবনও কিছুটা ভাইয়া কেন্দ্রিক। ভাইয়া শুধু আমাদের দিয়েই গিয়েছেন, প্রতিদানে কখনও কিছু চায়নি, আজ ভাইয়াকে একপ্রকার ঠকিয়েছি আমি তাইনা?

প্রশ্নটি করে পরী ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম দুমিনিট চুপ করে থেকে বলে,”ছোটো মানুষ এতো কিছু মাথায় নিতে হবে না। ভাইয়া তোমাকে যা যা দিয়েছে তার বিনিময়ে ভাইয়া আর তার পরিবারকে ফ্রিতে চিকিৎসা দিও। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার এক্সাম কবে?”

_নেক্সট মান্থে।

_প্রস্তুতি ভালো? না মানে তোমাকে সব ধরনের বাঁদ’রামি করতেই দেখা হয়, শুধুমাত্র একাডেমিক বই ধরতে দেখিনা।

পরী হেসে ফেলে। হঠাৎ করে তার মনে হলো,তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা অবিকল ইয়াসার মির্জার মতো। একটুও রামগরুরের ছানা নয়।

ইশমাম একপলক পরীর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। পরী রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে বলে ওঠে,”আপনার প্রাক্তন অনেক সুন্দরী ছিলো?”

ইশমাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”হু।”

পরী চুপ হয়ে যায়। ইশমাম বলে ওঠে,”সৌন্দর্য বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দুধরনের । বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথা যদি বলি, তার গায়ের রং টা একটু চাপা ছিলো। আর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের কথা যদি বলি তবে তার মন ছিলো একেবারে সাদা, কোনো ভেজাল নেই, ফকফকা। তোমার গাঁয়ের রং-এর মতো ফকফকা।”

পরী ইশমামের কথায় খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে। ইশমামের কাছে পরীর বাচ্চাসুলভ আচরণ হঠাৎ করে বিরক্তিকর লাগছে না। যেন পরীকে হাসাতে পেরে তার নিজেরই খুব ভালো লাগছে।

পরী হাসি থামিয়ে চুপ হয়ে যায়। ক্ষণবাদে পরী বলে ওঠে,”তাকে মিস করেন?”

ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”অন্যের স্ত্রীকে মিস করবো কেনো? আমাকে কি তোমার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের নিব্বা মনে হয়? আমি যথেষ্ট বাস্তববাদী একজন লোক। বাস্তবতাকে খুব সহজে হজম করে নেই, তোমার কোনো ধারণা নেই! সে সবসময় একটা রেসপেক্টের যায়গা হয়ে থাকবে আমার কাছে। আর কিছুই নয়।”

পরী চুপ করে থাকে, হঠাৎ করে এই লোকটার কথা শুনতে খুব ভালো লাগছে তার। আগে কত হেসেছে লোকটার দেবদাসের মতো অবস্থা নিয়ে, এখন পরী নিজের কাছে নিজেই বেশ লজ্জিত।

ইশমাম চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”তা তুমি কখনও কাউকে পছন্দ করোনি?”

পরী মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে বলে,”করেছিলাম আমার এক ক্লাসমেটকে। তেরো দিনের জন্য পছন্দ করেছিলাম। প্রথমে আমাকে ইয়াসার মির্জার আপন বোন ভেবেছিলো, তাই একটু ঘুরঘুর করেছিলো আমার পিছু পিছু। পরে যেই শুনেছে আমি কেয়ারটেকারের মেয়ে, কে’টে পরেছে!”
হাসতে হাসতে বলে পরী।

ইশমাম পরীর দিকে তাকায়। তারপর বলে,”তোমারও মনের মানুষ ছিলো? তো এখন তো এটা বলাই যায় তুমিও তোমার হাজবেন্ডকে শান্তনা পুরস্কার হিসেবে দেখবে। আমাদের যদি বিয়ে হতো তাহলে আমরা দুজন দুজনের শান্তনা পুরস্কার হতাম। কি আশ্চর্য!”

পরী হেসে ফেলে। ইশমাম দীর্ঘ সময় পরীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”আচ্ছা যাও। ঘুমাও। তোমার জন্য অনেক শুভকামনা,আশা করি জীবনে এমন একজন সঙ্গী পাও,যে তোমাকে ট্রফি হিসেবে দেখবে,কোনো শান্তনা পুরস্কার হিসেবে নয়।”

_আপনিও এমন কাউকেই খুঁজে পাবেন। আশা করি।
অস্ফুট স্বরে বলে পরী বারান্দা থেকে চলে আসে। আসার সময় ঘুরে সে আবারো একপলক ইশমামকে দেখে। রেলিং ধরে ওদিকে ফিরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।

***
সামিন একটু নড়তেই আলো টের পেয়ে যায় সামিন ঘুমায়নি। হাত বাড়িয়ে বেড সাইডের বাতি জ্বেলে আলো উঠে বসে। সামিন কপালে হাত দিয়ে শুয়ে ছিলো, আলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”ঘুমাওনি?”

আলো সামিনের কাছে এগিয়ে বসে তার কপাল থেকে হাত সরিয়ে দেয়। একটু ঝুঁকে সামিনের চুলের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে মাসাজ করে দিতে দিতে বলে,”মাথা ধরেছে খুব? এজন্য বুঝি জেগে আছেন? ডাকলেন না কেনো?”

সামিন হেসে আলোর ডানহাত টেনে হাতের পিঠে চু’মু খায়। তারপর নিজের গালে আলোর হাতটা বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”কি অবস্থা করেছো নিজের। কেমন অসুস্থ লাগছে তোমাকে। আমার দোষ, এতো ব্যস্ততায় তোমার একটু খেয়াল রাখতে পারিনা। সামনে ইলেকশনের চাপ, এজেন্সির কাজ, দলের কাজ, ভাই-বোনকে সময় দিতে গিয়ে তোমাকে খুব কম সময় দিয়ে ফেলি আমি। তুমি কি রা’গ করো? ”

আলো হেসে ফেলে, তারপর বলে ওঠে,”এই সবকিছু আপনার জীবনের অংশ। এদের প্রাপ্য সময়টুকু আপনি অবশ্যই দেবেন। আমি কেন রাগ করবো? তাছাড়া আমি কি ছোটো বাচ্চা যে আমার খেয়াল রাখতে হবে?”

সামিন উঠে বসে। আলোকে বুকে টেনে নিয়ে বলে,”না তুমি ছোটো বাচ্চা নও। শুধুমাত্র মা বাবার আদরের দুলালী, আমার শশুর বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউর আলম দুই বেলা আমাকে ফোন করে নালিশ করছে তুমি তাদের ঠিকমতো ফোন করে কথা বলো না। এমনটা কেনো হচ্ছে?”

_মিথ্যা কথা, সন্ধায় আব্বুর সাথে কথা বললাম। ওনারা আপনার কাছে বানিয়ে বলছে।

সামিন আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”একটু ফ্রি হলেই ও বাড়িতে নিয়ে যাবো তোমাকে। ঠিকাছে?”

আলো মাথা নাড়ায়। সামিন বলতে থাকে,”আলোদের শুরুতে আন্ডারস্টিমেট করা হয়,আলোরা কিন্তু খুব ভালো বৌ হয়। ”

আলো হাসে। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”ভালো বৌ কিনা জানিনা, তবে বুঝতে পারছি আমার শিকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে এই বাড়িতে, একটু একটু করে জরিয়ে যাচ্ছি আমি, আমার অস্তিত্ব এই বাড়ির প্রত্যেকটা ইটের সাথে মিশে যাচ্ছে।”

সামিন দুমিনিট আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে আরো নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে। সামিনের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে আলো দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে হঠাৎ টের পাচ্ছে, তার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। ইদানিং সে ভালো করে লক্ষ্য করেছে,সামিন তাকে কাছে টানলেই তার খুব অস্বস্তি বোধ হয়। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত অবসন্ন লাগে, রাজ্যের অবসাদ ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু এর সঠিক কারন সে জানে না, জানলে সামিনকেও ব্যখ্যা করতে পারতো। অবশ্য সামিন কখনোই আলোর অনুমতি ব্যতীত আলোকে গভীর ভাবে স্পর্শ করে না। কখনোই নিজের পুরুষ মনের ইচ্ছাটাকে বড় করে দেখে না, আলোর অনুভূতি পড়ার চেষ্টা করে আগে, কিভাবে যেন এই লোকটা আলোকে পড়ে ফেলে খুব সহজেই।
আলোর অস্বস্তি টের পেয়ে সামিন থেমে যায়। শক্ত বাহুডোর থেকে আলোর পাতলা ফিনফিনে শরীরটা আলগা করে আলোর চোখে চোখ রাখে।
স্বামীকে উপেক্ষা করার অপরাধবোধে ভুগছে আলো। তার চোখের দৃষ্টি সেটাই বলছে। সামিন তাকে ভুগতে না দিয়ে কপালে প্রগাঢ় এক চুম্বন এঁকে দেয়। আবেশে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে আলো। সামিন এমন ভাবে বালিশে শুইয়ে দিয়েছে তাকে যেন আলো কোনো ছোটো বাচ্চা, আলোকে সন্তর্পনে রাখা উচিত,নয়তো তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।

সামিনের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আলো। প্রতিদিন কি একটা লোকের প্রেমে পড়া যায়? অনুভূতির এমন নিয়ম আছে নাকি? তাহলে হয়তো আলো প্রতিদিন এই মানুষটার প্রেমে পরে। যত দিন যাচ্ছে,আলোর অস্তিত্ব মিটিয়ে দিয়ে এই মানুষটা যে তার কথাবার্তা, চালচলন, জীবনবোধ দিয়ে আলোকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছে এই মানুষটা জানে না। সামিন সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র পুরুষ যে একজন সঠিক মানুষ হয়ে ভুল সময়ে, ভুল ভাবে আলোর জীবনে প্রবেশ করেছে। চেষ্টা করছে স্ত্রীর প্রতি নিজের সর্বোচ্চ ভালোবাসা,যত্ন, বিশ্বস্ততা ঢেলে দিতে।

আলোকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সামিন নরম গলায় বলে,”জালাবো না আজ, ঘুমাও।”

আলো লাজুক হাসি হাসে। সামিন বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরে। দু’জনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সামিন হঠাৎ বলে ওঠে,”বুকে আসতে চাচ্ছো আমার?”

আলো দ্বিতীয় বারের মতো লজ্জা পায়। সে কখনোই নিজে থেকে সামিনের বুকে মাথা রাখে না,এই কাজটা সামিনই করে। আজ খুব ইচ্ছে করছিলো আলোর সামিনের বুকে মাথা রাখতে। সামিন কিভাবে যেন টের পেয়ে গেলো।

আলোকে টেনে আলোর মাথাটা নিজের বুকে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিচু স্বরে বলে ওঠে,”তোমার এক্সাম শেষ হলেই আমরা একটা বেবী নেবো, আর তোমার কোনো কথা শুনবো না আমি। আমার বেবী লাগবে।”

আলো চুপ করে থাকে,সে তার স্বামীর হৃদস্পন্দন শুনতে ব্যস্ত। সামিন আলোকে বলে,”ইশমাম খেতে গিয়েছিলো টেবিলে?”

_হু।

_খেয়েছে ঠিকমতো?

_হু।

_কি একটা কান্ড করে ফেললাম আলো, রাগের মাথায় ল্যাপটপ টা ভেঙে ফেললাম। ও দীর্ঘদিন যাবত একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলো। সব নষ্ট করে দিলাম।
কন্ঠে অনুশোচনা নিয়ে বলে সামিন।

আলো স্বাভাবিক গলায় বলে,”আমার হঠাৎ মনে হলো পরী মেয়েটা বেস্ট হবে। সেজন্যই বলেছিলাম। প্লিজ দুই ভাই ঝামেলা করবেন না আর। আপনাদের ঝামেলা দেখতে একটুও ইচ্ছে করে না আমার। ওর যদি ইচ্ছা না থাকে তাহলে আর দরকার নেই মেয়ে দেখার।”

_ঠিক বলেছো। বড় হয়ে গিয়েছে না। আমার পছন্দে শার্ট কেনে বলে কি আমার পছন্দে বিয়ে করে নেবে! কি অদ্ভুত আমি।

আলো বলে,”বাদ দিন। কাল ছোট ভাইয়ের কাছে সরি বলে ওকে একটা ল্যাপটপ কিনে দিবেন। একটু বেশিই বকাবকি, চেঁচামেচি করেন আপনি। পরে তো ঠিকই ওদের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দেন।”

কিছুক্ষণ আলো বকবক করে চুপ হয়ে যায়,সামিন ভারি নিঃশ্বাস ফেলছে, ঘুমিয়ে পরেছে সে। আলো অন্ধকারে সামিনের বুক থেকে মাথা তুলে সামিনের কপালে ছোট করে একটা চু’মু একে দিয়ে আবারও স্বামীর বুকে মাথা রাখে।

***
বারংবার অলোর নাম্বার থেকে ফোন আসছে। সামিন ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলো। কিন্তু ফোনটা টেবিলের ওপর রাখা ছিলো,তাই স্ক্রিনে আলোর “Aachiaa” নামটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। মিটিং এ কথা বলতে বলতে না চাইতেও চোখ যাচ্ছে ফোনটার দিকে।

তৌফ রনির পেটে খোঁচা মে’রে ফিসফিসিয়ে বলে,”এখন ভাইকে কিছু বললেই তো আমাদের চিবিয়ে খাবে। সবসময় বলতো বৌ বাড়িতে রেখে আসতে। এখন নিজেই বৌয়ের যন্ত্রণায় অস্থির।”

সামিন কথা থামিয়ে তৌফের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”কি বললাম এতক্ষণ,বলতো?”

তৌফ থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে,”শিক্ষা, শান্তি,প্রগতি। তিনটা আমাদের মূলনীতি।”

দলের সবাই উচ্চশব্দে হেসে ওঠে।
সামিন চোখ রাঙানি দিয়ে আবারও আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পরে।
আজ সামিন দলের ছাত্রনেতার পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করেছে রাহাতকে। সাধারণ সম্পাদক রনি।
সেজন্য আজ পার্টি অফিসে ছোটোখাটো একটা গেট টুগেদার এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সামিন দলের ছেলেদের উদ্দেশ্য বক্তৃতার মাধ্যমে তাদের সবাইকে সবার দায়িত্ব পুনরায় বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

বক্তৃতার শেষ অংশে সামিন বলে ওঠে,”তো এটাই সবাই মনে রাখবে, শিক্ষা,শান্তি,প্রগতি। তিনটাই আমাদের মূলনীতি। এই তিনটা মূলনীতিকে সামনে রেখে আমরা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবো এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। এবং আমি আশাবাদী,আমি যেভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি, তোরাও দিবি।”

সবাই মাথা নাড়ে। সামিন বক্তৃতা শেষ করেও খুবই ইনফরমাল ভাবে বলতে থাকে,”এখন তোদের উদ্দেশ্যে কিছু সতর্কতা মূলক কথা, বড় ভাই হিসেবে বলতে চাই। যারা এখনো অবিবাহিত আছিস,যেমন রাহাত,আরাফ, রনি তারা আমার কথাটা মাথায় রাখবি। মন দিয়ে দলের কাজ করবি। শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি, শুধুমাত্র এই তিনটাই আমাদের মূলনীতি। কোনো মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করা আমাদের মূলনীতি নয়। তো যদি নিজে জীবনে শান্তি নিয়ে বাঁচতে চাও তাহলে ভুলেও অমন কাজ করবে না বাছাধনেরা।”

সবাই চুপ করে আছে। সামিন এইবার ফোনটা হাতে নেয়‌ । আলোর নাম্বার থেকে সতের টা মিসড কল। আজ সামিনকে রিমান্ডে নিয়ে তিনঘন্টার জিজ্ঞাসাবাদ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে তা সামিন বেশ টের পাচ্ছে।
তাই আগেভাগেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে শাওনের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের বাইকের চাবি দিয়ে বলে,”যতীন কাকার ফুলের দোকান থেকে এক্ষুনি গিয়ে একটা ফুলের মালা বানিয়ে নিয়ে আয়। বেলী,কদম, বকুল, রজনীগন্ধা যেকোনো একটা হলেই হবে। শিগগিরই।”

তৌফ বলে ওঠে,”ভাই কদম ফুল এই সিজনে পাবেন না, আর পেলেও কদম ফুল দিয়ে মালা হয়না।”

_আরে কথার কথা!
তারপর শাওনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”যা এক্ষুনি।”

সবুজ শাওনকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”দাড়া। আমার থেকেও টাকা নিয়ে যা।আমার জন্য ও নিয়ে আসবি।”

সবুজের দেখাদেখি বিবাহিত সবাই শাওনের হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে ফুলের মালা আনতে নির্দেশ দেয়।

শাওন বোকার মতো হাতের টাকা গুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। আর কতদিন এভাবে বড় ভাইদের বৌয়ের জন্য ফুল কিনতে হবে! তার একটা প্রেম হচ্ছে না কেনো!

সাংগঠনিক কাগজপত্র গুলো গুছিয়ে নিয়ে সামিন টেবিলের লকার খুলে সেগুলো রেখে দিতে গিয়ে একটা প্যাকেটে চোখ যায় তার। প্যাকেট টা হাতে তুলে নিয়ে সেটার ভেতর থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে রাহাতের দিকে তাকায়। রাহাত সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”ওও এইটা। এইটা তো ভাবীর সেই ফোনটা ভাই। মনে নেই? আপনিই নিজেই তো রেখেছিলেন।”

সামিনের মনে পরে যায়। সে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে। রাহাত বলতে থাকে,”এটা তো একটা ডেডবডি এখন। দিন ফেলে দিচ্ছি।”

সামিনের হঠাৎ মনে পরে যায়,আলো সেদিন এটার ভেতরে থাকা সিমকার্ডের কথাই বলছিলো। ফোনের ভেতর থেকে সিমকার্ড টা বের করে সামিন নিজের ফোনে ঢুকিয়ে নেয়। তখনই শাওন ফুলের মালা নিয়ে এসে পরে, রজনীগন্ধার মালা।

রাহাত বলে ওঠে,”ভাই মেঘ ডাকছে। আপনি গাড়ি আনেননি আজ। ভিজে যাবেন। আপনি যান। আমি আরাফ আর রনি কিছুক্ষণ ক্যারাম খেলে অফিস বন্ধ করে যাবো।”

সামিন উঠে পরে, দেরী করলে বৃষ্টিতে পেয়ে বসবে আজ। রিমান্ড তিনঘন্টার বদলে সারারাত চলবে তাহলে। আগে ভাগে উঠে পরাই ভালো।
ছেলেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামিন বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করে।

***
দরজা খুলতেই আলোর থমথমে মুখটা দেখে একটা বড়সড় ধাক্কা খায় সামিন। মুখটা অমাবশ্যার রাতের মতো অন্ধকার করে রেখেছে।

সামিন ভেতরে ঢুকতেই আলো দরজা বন্ধ করে চুপচাপ ডাইনিং রুমে চলে যায় টেবিলে খাবার সাজাতে।
সামিন ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। সে মহাচিন্তায় পরে গিয়েছে, এখন যদি আলোকে বলে সে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে তাহলে বিশ্বযু’দ্ধ লেগে তো যাবেই সাথে নিজেও খাবে না। তার কি করা উচিৎ! দলের ছেলেদের সাথে পেটপুরে বিরিয়ানি খেয়েছে,পেটে আর যায়গা নেই কোথাও!
তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে বিরবির করে বলে,”বুদ্ধি দিয়ে কাজ করো সামিন। কিছু একটা বুদ্ধি বের করো।”

খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে আলো তার জন্য থমথমে মুখে অপেক্ষা করছে। সে একটা চেয়ার টেনে বসে না খাওয়ার বাহানা দিতে যাবে তখনই দেখতে পায় টেবিলে সরষে ইলিশ। যবে থেকে আলো জেনেছে সামিন সরষে ইলিশ পছন্দ করে তখন থেকে বৃষ্টি দেখলেই আলো এটা তার জন্য রাধবে। সামিন আলোর মুখের দিকে তাকায়, মেয়েটার জন্য মায়া হচ্ছে খুব। এখন যদি শোনে সামিন খাবে না তাহলে খুব কষ্ট পাবে। সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে প্লেটে সামান্য কিছু ভাত তুলে নেয়।

আলো দু পিস মাছ তুলে দিয়ে নিজেও চুপচাপ খেতে শুরু করে। এখন অবধি একটা শব্দও সে উচ্চারণ করেনি সামিনের সাথে।

সামিন মাছ খুঁটে মুখে দিয়ে আড়চোখে আলোর দিকে তাকায়। পেটে একদমই যায়গা নেই সামিনের। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
আলো দুই লোকমা ভাত মুখে দিয়ে হাত ধুয়ে উঠে পরে। সামিন মাথা তুলে আলোর দিকে তাকায়। আলো নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”নাটক করতে হবে না। খেতে না চাইলে উঠে পড়ুন।”

সামিন হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ায়। নরম গলায় বলে,”আমি তখন মিটিং এ ছিলাম আলো। রাগ করো না আছিয়া, সেজন্য ফোনটা ধরিনি।”

আলো চুপচাপ টেবিল পরিষ্কার করে দোতলায় উঠতে থাকে। সামিন পিছু পিছু এসে বলে,”ও আছিয়া। আর দেরী করবো না। সবসময় এমন করি বলো?”

আলো ঘরে ঢোকে, সামিন ডাকতেই থাকে,”আছিয়া! শোনোনা, প্লিজ শোনো না।”

আলো কোনো জবাব না দিয়ে বিছানা ঠিক করে দেয়। সামিন চুপচাপ আলোকে কিছুক্ষণ দেখে পেছন থেকে শক্ত করে জাপ্টে ধরে আলোর গালে চুমু খেতে থাকে,আলো হাত পা ছুড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু অমন বলশালী পুরুষের সাথে পেরে ওঠার মতো শক্তির কিছুটা ঘাটতি যে রয়েছে তার নারী কায়ায়। সামিন এক নাগাড়ে অনেকগুলো চু’মু দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে, তারপর বলতে থাকে,”শান্ত হও আমার বাঘিনী! শান্ত হও।”

আলো তীব্র রাগে ফুঁ’সছে। সামিন ধীরে ধীরে আলোকে ছেড়ে দিয়ে বেড সাইডের টেবিলের ওপর থেকে রজনীগন্ধার মালাটা এনে আলোর খোঁপায় লাগিয়ে দেয়। আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। সামিন আলোকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলে,”ভুল করেছি, বরাবরের মতো শাস্তি মাথা পেতে নেবো। ”

_দরকার নেই তো। আপনার যা ইচ্ছে করুন। বাঁধা দিচ্ছে কে!

_আচ্ছা যা ইচ্ছে করবো তো। আগে একটু শান্ত হও।

আলো ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলে,”পারফেক্ট! পারফেক্ট একেবারে! এই তো আগের ফর্মে ফিরেছো। তোমাকে এভাবেই বেশ মানায়।”

হুট করে আলো হেসে ফেলে। সামিন বলে,”এইতো হেসে ফেললে। এখন যাও। আমাদের দুজনের জন্য দুই কাপ কফি নিয়ে এসো। ব্ল্যাক কফি। কফি খেয়ে আজকের কৃতকর্মের জন্য খুব ভালোভাবে, আয়োজন করে মাফ চাইবো আমি। যাও। প্লিজ যাও আছিয়া!”

কয়েক মূহুর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আলো ঘর থেকে বের হয়। সামিন দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হেসে বিছানায় ধপ করে বসে পরে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সাই সাই করে বাতাস বইছে। জানালা থেকে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভেতরে পরছে। সামিন উঠে জানালা বন্ধ করে দেয়।

বিছানা থেকে ফোনটা তুলে হাতে নিতেই আলোর সিম কার্ডটার কথা মনে পরে যায়। ফোনের লক খুলতেই টুং টাং আওয়াজে একটার পর একটা মেসেজের নোটিফিকেশন আসতে শুরু করে। সামিন বেশ অবাক হয়ে যায়। নয়শো বাহাত্তর টা অপঠিত বার্তা। যা বিগত কয়েক মাসে হয়তো সিমকোম্পানি থেকে এসেছে বন্ধ হয়ে পরে থাকা এই নাম্বারটিতে। সামিন নোটিফিকেশন গুলো ডিলিট করার জন্য আঙুল চালাতেই একটা নাম্বার দেখে থ’মকে যায়। সেই নাম্বার থেকেই অসংখ্য মেসেজ করা হয়েছে আলোকে।

সামিন ভাবলো সে ভুল দেখছে। তাই ফোনটা চোখের সামনে তুলে ধরে নাম্বারটা ভালো করে দেখে‌।

তার হাত কাঁ’পছে। দৃষ্টি ইনবক্সে জমে থাকা মেসেজ গুলোতে নিবদ্ধ।

বাইরে ঝড় উঠছে, প্রকৃতিতে তান্ডবলীলা চালানোর মতো শক্তিশালী ঝড়, ঝড় উঠছে একজন মানুষের মনেও। কে জানে প্রকৃতি ঝড়ের তান্ডব সইতে পারবে কিনা, কে জানে সেই মানুষটা সইতে পারবে কিনা, কে জানে!

চলমান……