বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
1170

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২৬
#Esrat_Ety

ট্রিটমেন্ট চলছে ইলহামের। রিতু,ইশিতা,সামিন, ইশমাম পালা করে গিয়ে হসপিটালে থেকেছে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

একসপ্তাহ পরে ইলহাম পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক। ইলহাম সামিনের মুখোমুখি হয়নি। সামিন ও জুঁইয়ের বিষয়ে ইলহামের সাথে কোনো কথা বলেনি। সে অপেক্ষা করছে ইলহামের সুস্থতার জন্য। এর একটা হেস্তনেস্ত সে অবশ্যই করে ছাড়বে!

একটা গ্লাসে খানিকটা ফলের রস নিয়ে রিতু ঘরে ঢোকে। ইলহাম বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো। রিতু বিছানায় একপাশে বসে হাতের গ্লাসটা ইলহামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এটা খেয়ে নিন।”

ইলহাম একপলক রিতুর হাতের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”আমার থেকে এটা তোমার বেশি প্রয়োজন। তুমি খেয়ে নাও, তারপর আমার জন্য নিয়ে এসো।”

রিতু না’ছো’ড়’বা’ন্দা মেয়ে। সে গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরে রেখেছে। ইলহাম হাসি দিয়ে গ্লাসটা নিয়ে অর্ধেকটা খেয়ে গ্লাসটা রিতুর দিকে দিয়ে বলে,”তুমি খেয়ে নাও বাকি টা।”
রিতু মাথা নাড়ায়।
ইলহাম বলে,”কেনো? আমার উচ্ছিষ্ট খেতে তো আগে অসুবিধা হয়নি। এখন খেতে চাইছো না কেনো? খুব আত্মসম্মান হয়েছে? বড় ভাবীর মতো হতে চাইছো?”

রিতু ইলহামের দিকে একপলক তাকিয়ে গ্লাসটা খালি করে রেখে দেয়। তারপর নিচু স্বরে বলে,”প্রায় দশ বারো দিন ধরে আপনি হসপিটালে। এর মাঝে ঐ মেয়েটার সাথে আপনার একদিনও দেখা হয়নি। আগে তো প্রতিদিন দেখা না করে থাকতে পারতেন না। আপনি চাইলে বাড়িতে ডেকে নিন মেয়েটাকে। ভাইয়াকে আমি বুঝিয়ে বলবো।”

ইলহাম হেসে ফেলে। নিচু স্বরে বলে,”তোমার মতো স্ত্রীর স্বপ্নই তো পুরুষরা দেখে। নিজের স্বামীর প’র’কী’য়া’র মতো জ’ঘ’ন্য অ’প’রা’ধ’কে কতটা সাপোর্ট করছো।”

রিতু চুপ করে থাকে। ইলহাম দুর্বল হাতে রিতুকে টে’নে আস্তে আস্তে নিজের কাছে নেয়। রিতু পাথরের মতো হয়ে থাকে। ইলহাম রিতুর নিচু করে রাখা মাথার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমাকে ঘৃ’ণা করো, রা’গ দেখাও, কাঁ’দো। এমন পাথরের মতো হয়ে থেকো না। এসব আমাকে ক’ষ্ট দেয় রিতু।”

রিতুর ঠোঁট কাঁ’প’ছে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,”ভাইয়েরা বিয়ে করে যার যার সংসার নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরলো, বাবা জমিজমা চাষ করে খায়। মা বাড়িতে অসুস্থ। তাকে সপ্তাহে হাজার হাজার টাকার ওষুধ খাওয়াতে হয়। আমাকে ছেলেরা রাস্তাঘাটে উ’ত্য’ক্ত করতো দেখে বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পরলো।হঠাৎ বাড়িতে আপনাদের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হলো। বাবা তো হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলো। এমপি পুত্র, ছেলে দেখতে শুনতে ভালো, বাবাকে মোটা অংকের টাকাও দেওয়া হবে। নিজের ইচ্ছে না থাকলেও বাড়ির পরিস্থিতি দেখে চুপ করে থাকি। বিয়ের ঠিক আগে আগে জানতে পারি ছেলের স্বভাব চরিত্র ভালো না,তার নামে মা’ম’লা আছে। পিছিয়ে যেতেই পারতাম। হঠাৎ মা আরো অসুস্থ হয়ে পরে, বাবা এসে আমার হাত ধরে খুব কাঁদলেন। আমি বাধ্য মেয়ের মতো কবুল বললাম। বিয়ের প্রথম রাত থেকে আমার জীবনের একটা য’ন্ত্র’না’ম’য় অধ্যায় শুরু হলো। স্বামী হিসেবে আমি কখনো স্বামীকে পাইনি। পেয়েছি একজন ধ’র্ষ’ক, একজন প্রভু, একজন অ’ত্যা’চা’রী শা’স’ক’কে। সবটা নিজের নিয়তি মেনে নিজেকে আপনার চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম আপনার মন পেতে,আমার প্রতি আপনাকে একটু দয়াশীল বানাতে। কিন্তু আমি ব্যার্থ হয়েছি।”
এ পর্যন্ত বলে রিতু থামে। ইলহাম তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিতু একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”আমার প্রথম সন্তান ছেলে হওয়ায় আমি ভীষণ খুশি হয়েছি, আমার পেটে যে আছে, আমি চাইবো সেও ছেলেই হোক। কারন, আমার নানী বলতো বাবার কর্মফল কখনো কখনো তার মেয়েরা ভোগ করে। আপনি আমার সাথে যা যা করেছেন তা নিজের মেয়ের সাথে হতে দেখলে আপনি সহ্য করতে পারবেন না ইলহাম মির্জা। তাই আপনার ছেলেই হোক।”

রিতু কথাটি বলে অঝোর ধারায় কাঁ’দ’তে শুরু করে দেয়। ইলহাম রিতুকে চুপচাপ দেখতে থাকে। সে কি করবে? এই মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে? নাকি মেয়েটিকে কাছে টেনে নেবে? কিভাবে কা’ন্না থামাবে মেয়েটির?

কাঁদতে কাঁদতে রিতুর হিচকি উঠে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিয়ে উঠে একটা ট্যাবলেট আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে ইলহামের দিকে দিয়ে বলে,”এটা খাওয়ার সময় হয়েছে।”
ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে ট্যাবলেট টা নিয়ে মুখে দিয়ে পানি খেয়ে নেয়‌। তারপর বলে,”এখানে বসো।”

রিতু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইলহাম ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”বসো রিতু।”

রিতু ধীরে ধীরে বসে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আমার ব্যার্থতা, এতো সুন্দরী হয়েও আপনাকে আমি মুগ্ধ করা তো দূরের কথা নিজের প্রতি আপনার মনে মায়া জন্মাতেই পারিনি। এতো বছর সংসার করার পরেও কত সহজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন আমাকে তা’ড়ি’য়ে দেবেন। অথচ আমাকে দেখেন, জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন না,আপনি একজন অ’ত্যা’চা’রী , তবুও আপনার সাথে তা’লা’ক হবার কথা কল্পনা করলেই বুকটা হু হু করে উঠছে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভেজা দুটো চোখ তুলে ইলহামের দিকে তাকায় রিতু, কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,”ধর্মে তো অনুমতি আছেই, আপনি চাইলে ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলতে পারেন। আমি আপনাকে অনুমতি দিয়ে দিলাম। তবুও আপনার দোহাই লাগে আমাকে তা’ড়ি’য়ে দেবেন না আপনি। আমি মুখে যতই বলি বাচ্চাটা হলে চলে যাবো, কিন্তু আমি নিজেকে চিনি ইহানের বাবা, আমি পারবো না। আমি পারবো না। এর থেকে আপনি আমাকে মে’রে ফেলেন।”

কাঁদতে কাঁদতে ইলহামের পায়ে পরে যায় রিতু। ইলহাম উঠে রিতুকে ধরে। আজ এই মেয়েটির চোখের কা’ন্না তার করা সমস্ত অ’প’রা’ধে’র পরিমাণ তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ইলহাম রিতুকে বুকে টেনে নিয়ে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”আচ্ছা ঠিকাছে। এসব পরে দেখা যাবে। আগে তুমি ঠিক হও। যা করছো, তাতে আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে। ঠিক হও রিতু।”

রিতু কান্না থামাতে পারছে না। ইলহাম তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। রিতুর কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আমার বাচ্চা না, আমাদের বাচ্চার ক্ষতি হবে রিতু।‌ কান্না থামাও। এবার কান্না থামাও।”

***
খেতে খেতে সামিন একপলক ইশমামের দিকে তাকায়। তারপর বলে,”মেসেজে বললি কিছু বলতে চাস। এখন বল‌।”

খাবার টেবিলে তারা পাঁচ জন। সামিন,আলো, ইশমাম, ইশিতা এবং পরী।

ইশমাম সামিনের কথায় মাথা তুলে তাকায় সামিনের দিকে তারপর প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,”অর্গানাইজেশন থেকে ডেকেছে আমাকে‌। তিন মাসের জন্য যেতে হবে ভাইয়া। আমি যেতে চাচ্ছি।”

সামিন খাওয়া রেখে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোও ইশমামকে দেখে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”অসম্ভব! তুই গেলে আর আসবি না। তোকে যেতে দেবো না।”

_ভাইয়া তুমি কি জানো তুমি বাচ্চাদের জেদ করছো? আমি এখানে আজীবন থাকার জন্য আসিনি।
_জানি,এসেছিলি প্রেমের টানে,আমাদের জন্য আসিসনি। সেই মেয়েকে তো পেলি না। এখন তুই আমেরিকাতেও যেতে পারবি না। বাড়ির ব্যাবসা দেখবি।

ইশমাম রেগে যায়। কপাল কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছে। সামিন বলতে থাকে,”আচ্ছা ঠিকাছে। যাবি তিনমাসের জন্য। যাওয়ার আগে বিয়ে করতে হবে। করবি? বল রাজী! ফুয়াদের কাজিন খুবই চমৎকার একটি মেয়ে।”

ইশমাম টেবিলে চা’প’ড় দিয়ে বলে,”বিরক্তিকর ভাইয়া। তুমি সবসময় তোমার সব সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারো না! বলেছি তো বিয়ে করবো না আমি।”

সামিন ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”করবি তুই বিয়ে।‌ আমি আজই ফুয়াদের সাথে কথা বলছি। দেবদাস হয়েছিস তুই? আলতু ফালতু মেয়েদের জন্য ক’ষ্ট পাচ্ছিস।”

আলো ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম একপলক আলোকে দেখে ভাইকে বলে,”আলতু ফালতু মেয়ে না ভাইয়া। এভাবে বলবে না। অসম্ভব রকমের ভালো একটি মেয়ে।”

আলো দ্রুত হাত ধুয়ে উঠে পরে। এখানে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে,সে চলে যায়।

সামিন বলে,”বেশ মেয়েটা অসম্ভব রকমের ভালো। আমি ওর চেয়ে কয়েকগুণ ভালো মেয়ে এনে দেবো তোকে।”

ইশমাম দাঁতে দাঁত চে’পে পানির গ্লাস আঁ’ক’ড়ে ধরে বসে থাকে। ভাইয়ার সাথে রা’গ’টা সে দেখাতে পারছে না তাই রাগটাকে হজম করার চেষ্টায় আছে সে।

সামিন বলে যাচ্ছে,”বিয়ে করবি। তুই অবশ্যই বিয়ে করবি।”

প্রচন্ড জে’দে হাতের মুঠোয় থাকা গ্লাসটাকে ভে’ঙে ফেলে। সামিন সহ সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। টপটপ করে র*ক্ত ঝরছে ইশমামের হাত থেকে।

সামিন কিছুক্ষণ পর চেঁচিয়ে ওঠে,”ছোটো!”

ইশিতা উঠে ইশমামের হাত ধরে। পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”শিগগিরই তোর ফার্স্ট এইড বক্স টা নিয়ে আয়।”

পরী উঠে চলে যায়। সামিন প্লেটে হাত ধুয়ে ছুটে আসে ইশমামের কাছে। ইশমাম দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”আমি বিয়ে করবো না ভাইয়া।”

সামিন ভীত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”আচ্ছা। বিয়ে করতে হবে না। শান্ত হ তুই। শান্ত হ।”

***
হাত ড্রেসিং করিয়ে দিতে দিতে পরী একপলক ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কপাল কুঁচকে আছে। পরী বেশ অবাক হচ্ছে। এই রামগরুরের ছানাও প্রেম করতো! তাও আবার মজনুর প্রেম! প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে আর বিয়েই করবে না বলে শপথ নিয়েছে। অদ্ভুত!
পুরো ব্যাপারটায় পরীর খুব হাসি পাচ্ছে। যে মেয়েটা একে ছেড়ে দিয়েছে সে ভালো কাজই করেছে। এই লোকের সাথে বিয়ে হলে দুইদিন সংসার করতে পারতো কি না সন্দেহ! বেশ করেছে মেয়েটা!

“তুমি হাসছো কেনো?”

ইশমাম পরীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। পরী থতমত খেয়ে ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম গম্ভীর কন্ঠে বলে,”হাসছো কেনো তুমি একা একা?”
_কই না তো।
পরী ইশমামের হাতে ব্যা*ন্ডে*জ করে দিতে দিতে বলে।

_আমি স্পষ্ট দেখলাম তুমি হাসছিলে।

পরী উঠে দাঁড়ায়। ইশমাম বলে,”তোমার মাথায় নির্ঘাত কোন সমস্যা আছে। আজ নিশ্চিত হলাম।”

পরী চুপচাপ তার ফার্স্ট এইড বক্স উঠিয়ে ইশিতার ঘরের দিকে যায়। এই লোকটা কবে যে আমেরিকা যাবে কে জানে। ভয়ংকর একটা লোক!

***
জুঁইয়ের নাম্বার থেকে অনবরত ফোন আসছে। ইলহাম কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ফোনটা রিসিভ করে। জুই বলতে থাকে,”হ্যা! হ্যালো। আচ্ছা ফোন কেনো ধরো না আমার?”

_আমি অসুস্থ জুঁই। ফোন ধরতে দেরী হতেই পারে ।
_দেরী? বুঝলাম, বৌ কাছে আছে। তো বৌকে যখন ছাড়তেই পারছো না তাহলে আমায় রেখে কি লাভ? ছেড়ে দাও আমাকে। তুমি তোমার ঐ হার হাবাতে বৌ আর বাচ্চাদের নিয়ে থাকো।

ইলহাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। জুঁই বলতে থাকে,”সরি। রাগ উঠে গিয়েছিলো তাই বললাম। আচ্ছা তোমার ভাইয়ের সাথে সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করেছো?”

ইলহাম মৃদু স্বরে বলে,”আমার সম্পত্তি দিয়ে তোমার কি?”
_আমার কি মানে। কদিন পরে আমি তোমার ওয়াইফ হবো। অবশ্যই আমার কিছু।

_কে বলেছে তুমি আমার ওয়াইফ হবে?
ইলহাম ঠান্ডা গলায় বলে।
জুঁই চেঁচিয়ে ওঠে,”মানে?”

_মানে আমি বিবাহিত। আমার একটা ছেলে আছে। এবং আমার স্ত্রী আবারো সন্তানসম্ভবা।
_ইলহাম তুমি এসব কি বলছো? কতদিনের সম্পর্ক আমাদের!

_ওটা সম্পর্ক নয়। অ’প’রা’ধ। অ’প’রা’ধ বয়ে বেড়ানো ঠিক না।
_ইলহাম!
_আচ্ছা ঠিকাছে। সাফ সাফ কথা বলি চলো। আমার সব একাউন্ট ভাইয়া বন্ধ করে দিয়েছে। নিজের বৌ বাচ্চা নিয়ে আমার তার ঘা’ড়ে উঠে খেতে হবে। এমতাবস্থায় তোমাকে যদিও বিয়ে করি তোমাকেও কিন্তু আমার মতো ভাইয়ার দয়ায় থাকতে হবে। বলো পারবে? আমার ভাইয়াকে তুমি চেনো। তুমি পারবে?

জুঁই চুপ করে থাকে। ইলহাম বাঁকা হাসি হাসে, তারপর বলে,”তুমি হচ্ছো ভেসে আসা মেঘ জুঁই। আমার এখন আ*ত্ম*হ*ত্যা করতে ইচ্ছে করছে এটা ভেবে যে আমি রিতুর মতো একটা মেয়েকে ফেলে রেখে তোমার মতো স্বা*র্থ*প*র মেয়ের মধ্যে শান্তি খুঁজতে গিয়েছিলাম।”

***
সারাদিন শুয়ে বসে থাকতে থাকতে শরীরটা আরো খারাপ হতে শুরু করেছে। ফোনটা দূরে ছু*ড়ে মেরে ইলহাম বিছানা থেকে নামে। একটু হাঁটাহাঁটি করা প্রয়োজন। ঘর থেকে বেড়িয়ে দোতলার লিভিং রুমে ‌এসে সে দাঁড়িয়ে পরে সে। সামিন ইহানকে কোলে নিয়ে দেয়ালের জয়নুল আবেদীনের পেইন্টিং নিয়ে বিশদ আলোচনা করছে ইহানের সাথে।‌ মাথা ঘুরিয়ে ইলহামকে দেখতে পেয়ে সে কপাল কুঁচকে চলে যেতে নেয়। ইলহাম ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। মাথা নিচু করে ভাইয়ের হাত ধরে বলে,”সরি ভাইয়া!”

সামিন ইলহামের দিকে তাকায়, তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে,”আমাকে সরি বলছিস কেনো? আমি তোর বৌ?”

ইলহাম চুপ করে থাকে। সামিন বলতে থাকে,”তুই চব্বিশ টা বিয়ে করলেও আমার কি। আমার কিছুই না। যে মেয়েটির কিছু। তার কাছে গিয়ে মাফ চা।”
কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে সামিন বলে ওঠে,”এসব নাটক যদি সম্পত্তি পাওয়ার জন্য হয় তাহলে জেনে রাখ, কিচ্ছু পাবি না তুই। আমি বাবাকে দিয়ে তোর সবকিছু ইহানের নামে করে দিচ্ছি। তুই কিছু পাবি না।”

ইলহাম ভাইয়ের হাত ধরে বলে,”লাগবে না আমার কিছু। আমার শুধু বৌ বাচ্চা লাগবে। আর কিছুই লাগবে না!”

***
“এটা কি?”
হাতের প্যাকেট টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে ইশিতা। শান্ত তার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। বলে,”খুলে দেখো।”

ইশিতা প্যাকেটটা খুলে বেশ অবাক হয়ে যায়। তার একটা পোর্ট্রেট বাঁধিয়ে রাখা। ইশিতা চোখ বড় বড় করে বলে,”কে করেছে? তুমি?”

_না,আমার অত সময় কোথায়।

ইশিতা একপলক শান্তর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। তারপর বলে,”খুব পছন্দ হয়েছে আমার।”

শান্ত ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”মনে হচ্ছে আমি কোনো অষ্টাদশীকে দেখছি। এতো ফা’ল’তু একটা জিনিস দেখেও কেউ এভাবে মুগ্ধ হয়? অদ্ভুত মাথামোটা মেয়ে তুমি। আমার যায়গায় আজ একটা বা*ট*পা*রে*র হাতে পরলে এতদিনে নিজেকে আর খুঁজে পেতে না।”
ইশিতা মুচকি হাসে। তারপর বলে,”ঠিক তা না। আমার একটা চোখ আরেকটা চোখ থেকে একটু ছোট। সেটা তুমি খেয়াল করেছো, অবাক হচ্ছি আসলে।”

শান্ত ইশিতার কাছে এসে বলে,”তাই নাকি! কই দেখি! আমি তো জানতাম না। আমি তো ভুল করে ভুলটা করে ফেলেছি।”

ইশিতা বলে,”হুম। একটা চোখ একটু বড়, আরেকটা একটু ছোট।”

গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ হতেই চ’ম’কে ওঠে দুজন। পার্কের বেঞ্চিতে বসেছিল এতক্ষণ। ইশিতা ঘুরে তাকাতেই দেখে সামিনের গাড়ি। লাফ দিয়ে উঠে দাড়ায় সে।

সামিন গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশিতা কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একটা ঢোক গিলে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আজকে আমি শে*ষ! তুমি এখান থেকে কে*টে পরো।”
শান্ত ইশিতার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে,”কেনো? কে*টে পরবো কেন? পরিচিত আমরা,কথা বলতেই পারি!”

_তুমি ভাইয়াকে চেনো? মা*র*তে মা*র*তে মে*রে*ই ফেলবে তোমাকে। তুমি কে’টে পরো। আমি কিছু একটা বুঝিয়ে বলে দেবো। যাও।

শান্ত যায়না। সামিন গাড়ি থেকে নেমে এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। একপলক ইশিতা এবং শান্তর দিকে তাকিয়ে শান্তকে বলে,”তোমাকে ইহানকে পড়ানোর জন্য ঠিক করা হয়েছিলো, ইশিতাকে নয়।”

শান্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা আমতা আমতা করে বলে,”ভাইয়া হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো তাই…”

_হঠাৎ দেখা? তাও এই পার্কে?

_ভাইয়া….!

_বাড়িতে চল।
সামিন খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে কথাটা।

বাড়িতে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বোনের সাথে চেঁ’চা’মে’চি শুরু করে দেয় সামিন। দোতলার লিভিং রুমে বসে ইশিতা কাঁ’দ’ছে। এমন উঁচু গলায় কখনো ভাইয়া তার সাথে কথা বলেনি,ব’কে’নি। সামিন ইশিতার মুখোমুখি বসে পরে, তারপর তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”বুদ্ধি একেবারেই চলে গিয়েছে তোর? ঐ ছেলেটাকে চিনিস তুই ঠিকভাবে? ওর পরিচয় জানিস ঠিকভাবে? কদিনের পরিচয়ে এতদূর? তুই তো টিনেজার মেয়েদের থেকেও ইমম্যাচিওরড।”

_ভাইয়া,ও খুব ভালো, শিক্ষিত,ভদ্র!

_হ্যা ভদ্র বলেই তো তোকে ঐ সব পার্কে নিয়ে যায়।

_আমি ওকে ওখানে ডেকেছি ভাইয়া।

_খুব পার্ক চিনেছো তুমি। এক চ’ড় মারবো।

চেঁচিয়ে বলে সামিন বোনের দিকে এগিয়ে যায়। ইশিতা কেঁ’পে ওঠে।

_হ্যা মা’রু’ন‌। থামলেন কেনো মা’রু’ন।

পেছন থেকে বলে ওঠে আলো। চেঁচামেচির শব্দে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। সামিন তার দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,”মারুন। যেখানে যেখানে জোর খাটাতে পারবেন না তাদের সবাইকে মে’রে দিন। এটা তো সামিন ইয়াসারের রাজ্য। এখানে থাকতে হলে তার জো’র জু’লু’ম মানতে হবে।”

ইশিতা ভেজা চোখ নামিয়ে বসে আছে। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”ভাই বোন কথা বলছি,তুমি ভাষণ না দিয়ে যাও।”
_লজ্জা করে না? এতবড় একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলেন ভাইয়ের অধিকারে।

_ আমার বোন। আমি যা খুশি করবো। ওরকম পার্কে আমার বোনকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। এবাড়ির কোনো মেয়ের আজ পর্যন্ত অমন পার্কে যাওয়ার প্রয়োজন পরেনি। দিনকে দিন বে’য়া’দ’ব হচ্ছে।

ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে যায় নিজের ঘরে। সামিন একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে উঠে নিজের ঘরে যায়। আলো তার পিছু পিছু যায়।

_ভাবেন কি আপনি নিজেকে? আপু কত কষ্ট পেয়েছে আপনার আচরণে দেখেছেন?
_পাক। অমন একটা ছেলেকে বোনের পাশে মেনে নেবো?
_খারাপ কি? শিক্ষিত,ভদ্র,দেখতে শুনতে ভালো, আপনার কেনো পছন্দ হচ্ছেনা? কারন আপনাদের বাড়ীর ছেলেদের মতো গু’ন্ডা মা’র’কা’টা’রি নয় বলে?

সামিন আলোর দিকে তাকায়। তারপর বলে,”ছেলেটা এই শহরের স্থানীয় নয়। এইসব মফস্বল থেকে উঠে আসা ভার্সিটির ব্যাচেলর ছেলেরা পরিকল্পনা করে নিজের ভোলাভালা চেহারা দেখিয়ে, গান শুনিয়ে বড়লোকের মেয়ে পটিয়ে নেয়। এসব অহরহ হচ্ছে আশেপাশে। তারপর নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যাবহার করে।”

_আর আপনারা? আপনারা কি করেন ইয়াসার মির্জা? একটা মেয়ের অমতে তাকে তুলে এনে বিয়ে করে ব্যাবহার করেন‌ । হয়ে যান স্যা’ডি’স্ট। ওই ছেলে গুলো আর আপনাদের মধ্যে তো কোনোই পার্থক্য নেই।

সামিন আলোর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”মুখ সামলে কথা বলো আলো। স্যা’ডি’স্টে’র মানে বোঝো তুমি? একেবারে আজেবাজে কথা বলবে না।”

_বলবো। কারন আপনারা অমনই। রিতুর সাথে তো তাই হয়ে এসেছে।

_আমি স্যা’ডি’স্ট? আমার কোন আচরণে তোমার মনে হয়েছে আমি ওমন? বলো, জবাব দাও।
চেঁচিয়ে ওঠে সামিন।

_আপনিও ওমনই।

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাতের কনুই ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে দাঁত খিচিয়ে বলে,”এই মাত্র যেটা বললে,সেটা ফিরিয়ে নাও আলো‌। প্রথম এবং শেষ বারের মতো বললাম।”

আলো সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে,”নেবো না। আবারো বলবো, এই মির্জা বাড়ির ছেলেরা স্যা*ডি*স্ট।”

ধৈর্য্যর বাঁধ গিয়েছে সামিনের। আলোকে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে তেজী কন্ঠে বলে,”স্যা*ডি*স্ট আমরা? তাইনা?”

আলো মাথা ঘুরিয়ে তাকায় সামিনের দিকে। সামিন বলে,”ঠিকাছে আমি স্যা*ডি*স্ট। স্যা*ডি*স্ট কাকে বলে আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি আলো।”

আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সামিন গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। আলো নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত আলোকে দেখে একটা একটা করে শার্টের বোতাম খুলতে থাকে। শার্ট টা খুলে দূরে ছু*ড়ে মেরে আলোর দিকে এগিয়ে যায়। বিছানায় আলোকে চেপে ধরে নিচু স্বরে কিন্তু গলায় তেজ নিয়ে বলে,”এবার বলো! সাহস থাকলে আবার ঐ শব্দটা উচ্চারণ করো আলো!”

আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”স্যা*ডি*স্ট। আপনি স্যা*ডি*স্ট।”

সামিন আলোকে দেখছে। মেয়েটা নিজেকে সামিনের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টা করছে না। ঠিক একটা জড়বস্তুর মতো পরে আছে, নিস্তেজ হয়ে। হঠাৎ করে তার চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে।
সামিনের বুকে সুক্ষ্ম য*ন্ত্র*না হয়। এভাবে সে কখনোই তার স্ত্রীকে পেতে চায় না। আলো একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”থেমে গেলেন কেন? আমি তো কোনো বাঁধা দিচ্ছি না। এসবই তো আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য যত্নবান স্বামী হবার নাটক করার তো কোনো দরকার ছিলো না। জোর করে নিয়ে নিতেন। আচ্ছা আপনাকে জোর করতে হবে না। আমি নিজেই দিচ্ছি।”

কথাটি বলে আলো কাঁপা কাঁপা হাতে বুকের উপর থেকে নিজের শাড়ির আঁচল সরিয়ে দেয়। সামিন আলোর হাত ধরে ফেলে। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”কোনোভাবেই না ইয়াসার মির্জা। না আমার সাথে ভালো স্বামী হবার নাটক করে, না আমাকে জো*র জবরদস্তি করে, কোনো ভাবেই আপনি আমার মন পাবেন না। অভিনন্দন আপনাকে, আপনি একটা মেয়ের শুধুমাত্র শরীরের দ*খ*ল*দা*র হতে চলেছেন, মনের নয়।”

কথাটা বলে কা*ন্না*য় ভে*ঙে পরে আলো। তারপর বলে,”কিচ্ছু ভুলিনি আমি। সেদিনের সেই রাত, আমার ভাইদের গলায় ছু*রি ধরা, আমার বাবা হার্টের রো*গী, কিছুদিন আগেই তার একটা এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছিলো, তাকে কষ্ট দেয়া, আমার মায়ের অসুস্থ হয়ে যাওয়া, আমাকে কি*ড*ন্যা*প করা।‌ কিছু ভুলিনি। একটা গোটা রাত আমি ছট’ফট করেছি আ’তং’কে এটা ভেবে যে অচেতন অবস্থায় আমার সাথে উলটো পাল্টা কিছু হয়েছিলো কি না। নিজের স’তী’ত্ব নিয়ে একটা মেয়ের অনূভুতি আপনি বোঝেন? আমি কখনো আপনাকে আমার মন দেবো না, কোনোদিন আপনার প্রতি আমার অনুভূতি বদলাবে না। যা করতে চান করুন।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে আলো। সামিন বেশ কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে আলোর শাড়ির আঁচল তুলে দেয় তার বু’কে। তারপর তাকে ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে। আলো বিছানায় পরে থাকে চুপচাপ। সামিন উঠে নিজের শার্ট উঠিয়ে পরে নেয়। আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে বিছানায় একপাশে বসে পরে সে। পাঁচ মিনিটের মতো চুপচাপ থেকে হঠাৎ বলে ওঠে,”আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে। কিন্তু আমি হার মেনে নিলাম আলো। তুমি কাল সকালে ও বাড়িতে চলে যেও। তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম‌।”

চলমান…..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২৭
#Esrat_Ety

“অদ্রিতা।”
ইশমামের ডাকে আলো দাঁড়িয়ে পরে পেছনে ফিরে তাকায়। ইশমাম তার দিকে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বলে,”সত্যিই চলে যাচ্ছো?”

আলো কিছু সময় ইশমামের দিকে তাকিয়ে থেকে ম্লান হেসে বলে ওঠে,”ভালো থেকো ইশমাম।”
ইশমাম তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।

“তুমি চলে যাচ্ছো পঁচা মেয়ে?”
ইহান অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে আলোকে। আলো ম্লান হেসে ইহানের দিকে এগিয়ে যায়। ইহানের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলে,”হ্যা ভালো ছেলে। আমি চলে যাচ্ছি।”

_আর কখনো আসবে না?
_নাহহ,কখনো না।
দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে আলো।

সামিন মাথা তুলে আলোর দিকে তাকায়। নিচতলার লিভিং রুমে বাড়ির সবাই এসে জমায়েত হয়েছে। আলো ঘুরে ঘুরে সবাইকে একপলক দেখে নেয়। রিতু এগিয়ে গিয়ে নরম গলায় বলে,”ভাবী! ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ। একটা সুযোগ তো দিন তাকে নিজেকে প্রমাণ করার। অনুরোধ করছি আপনার কাছে।”

আলো শুকনো হাসি হেসে রিতুর সেকথার জবাব না দিয়ে তার হাত দুটো ধরে, রিতুর চোখে চোখ রেখে বলে,”রাগের মাথায় তোমাকে প্রচুর কটু কথা শুনিয়েছি রিতু। মাফ করে দিও। তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে রিতু, সবাইকে এতো ভালোবাসা দিও না। একটু ভালো নিজেকেও বাসো। কেমন? তুমি ভালো থেকো। তোমার পেটে যে আছে, সে জন্মালে এই আগন্তুকের আদর দিয়ে দিও।”

রিতু শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলো ঘুরে ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা এসে আলোকে জরিয়ে ধরে। আলো বলে,”আমি তোমাকে সত্যিই খুব মিস করবো আপু।”

ভাইয়ের প্রতি অভিমান থাকার পরেও ইশিতা আলোর গাল দুটো ধরে আদুরে গলায় বলে,”আরেকটু কি ভাবা যেতো না ভাবী?”

আলো বলে,”ভাবী না ইশিতা আপু। আমাকে আলো বলো তুমি।”

এমন সময় জামিল এসে শান্তিনীড়ের সদর দরজায় দাঁড়ায়। সামিন ধ’ম’কে’র সুরে বলে,”তোকে এই শরীর নিয়ে আসতে নিষেধ করেছিলাম না?”

জামিল তার ইয়াসার ভাইয়ের কথায় জবাব না দিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে আসে। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। জামিল বলতে থাকে,”ভাবী। সবকিছু তো আমার জন্য হয়েছে। আপনি আপনার জুতা খুলে আমাকে দুইটা দেন। আপনার বাবা মাকেও দিতে বলবেন। কিন্তু আমার ভাইকে ছেড়ে দিয়েন না। ভাই আপনাকে সত্যি খুব ভালোবেসে ফেলেছে ভাবী। সে কষ্ট পাচ্ছে। তাকে একবার সুযোগ দিন ভাবী।”

_জামিল!
চেঁচিয়ে ওঠে সামিন।
আলো জামিলের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। লিভিং রুমে ইমতিয়াজ মির্জা এসে দাঁড়িয়েছে। আলো একবার ইমতিয়াজ মির্জার দিকে তাকিয়ে ইশমাম এবং ইলহামের দিকে তাকায়। তারপর ঘুরে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”তালাকের ব্যাপারটা দ্রুত দেখবেন……”

সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। পাশ থেকে ফুয়াদ বলে,”আলো,একটা সুযোগ দাও বোন। সামিন খুব ভালোবাসে তোমাকে।”

আলো অস্ফুট স্বরে বলে,”আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি প্রথমদিন ভাইয়া। আমাকে মাফ করে দিয়েন।‌ ভালো থাকবেন।”

জামিল এসে আলোর পথ আগলে দাঁড়ায়,”ভাবী! কথা তো শোনেন আমার। আমি ভাইয়ের অপরাধকে কোন মতেই যাস্টিফাই করছি না ভাবী। সে অবশ্যই অ’প’রা’ধ করেছে। কিন্তু এখন সে সত্যিই আপনাকে ভালোবাসে। একটু কনসিডার করেন ভাবী।”

_আমার পথ ছাড়ুন জামিল ভাই।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।

সামিন জামিলের দিকে তাকিয়ে ধ’ম’কে ওঠে,”পথ ছাড় ওর জামিল। যেতে দে ওকে।”

জামিল শুকনো মুখে সরে দাঁড়ায়। আলো এগিয়ে যেতে থাকে সদর দরজার কাছে। পরী আর পোনা চাচা দাঁড়িয়ে আছে। আলো হেসে পরীর গাল ছুঁয়ে পোনার দিকে তাকিয়ে বলে,”ভালো থাকবেন পোনা চাচা।”

পোনা নরম গলায় বলে,”থেকে যাও বড় বৌমা। সবটা দুর্ঘটনা হলেও তুমি একটা হীরা পেয়েছো মা তাকে এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না।”

আলো কিছু না বলে হাঁটতে থাকে। সামিন আলোর পিছু পিছু যায়। পোর্চের নিচে এসে দাড়াতেই দেখে দলের ছেলেরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ আলোকে দেখে বলে,”থেকে যান না ভাবী। কি হয় একটু মেনে নিতে?”

সবাই সবুজের কথা শেষ না হতেই বলে ওঠে,”থেকে যান ভাবী। দোহাই আপনার।”

আলো তাদের কিছু না বলে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি আসছেন কেনো? আমি রিকশা নিয়ে চলে যাবো।”

“তুমি আমার বাউন্ডারির মধ্যে আছো আলো। তারমানে তুমি আমার রেসপনসিবিলিটি। তোমাকে রাহাত দিয়ে আসবে আমার গাড়িতে।”

কথাটা বলে গাড়ির চাবি রাহাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”তোর ভাবীকে……….সরি,ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আয়।”

রাহাত একপলক সামিন এবং আলোর দিকে তাকিয়ে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে গেইটের কাছে চলে যায়। আলো ধীরপায়ে রাহাতের পিছু পিছু যায়। সামিন অপলক দেখতে থাকে সে দৃশ্য। গেইটের কাছে গিয়ে আলো দাঁড়িয়ে পরে। আলো ঘুরে সামিনের দিকে তাকিয়ে আবারো তার দিকে আসতে থাকে। তৌফ খুশি হয়ে বলে,”ভাবী মনে হচ্ছে যাবে না ভাই।”

সামিন তাকিয়ে আছে। আলো এসে সামিনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তারপর তার হাত থেকে সামিনের মায়ের বালা দুটো খুলে সামিনের হাতে দিয়ে বলে,”আপনাদের বাড়ীর বড় বৌয়ের জিনিস। আপনার ভবিষ্যৎ বৌকে দেবেন।”
বালা দুটো দিয়ে দ্রুতপায়ে হেটে গেইটের বাইরে চলে যায়। গাড়িতে উঠে বসতেই রাহাত গাড়ি স্টার্ট করে। কয়েক মূহুর্ত পরে গাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে যায়। সামিন একপলক গেইটের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে তার মায়ের বালা দুটোর দিকে তাকায়।

রনি সামিনের দিকে এগিয়ে এসে তাকে অবাক চোখে দেখতে থাকে। সামিন রনির দিকে তাকিয়ে বলে,”কি? কি দেখছিস?”

_এতো সহজে যেতে দিলেন ভাই?

সামিন বাঁকা হাসি হাসে। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখতে থাকে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন হাতের বালা দুটোর দিকে একবার তাকিয়ে রনিকে বলে ওঠে,”বুঝলি রনি, তোর ভাবী কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। ওকে এই কয়টা দিন দেখে রাখিস!”

ফুয়াদ অবাক হয়ে বলে,”মানে?”
সামিন ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি সামিন ইয়াসার মির্জা। আমার বৌকে আমি ছেড়ে দেবো? ভাবলি কি করে তোরা। ধূর!”

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। সামিন সবাইকে উপেক্ষা করে গা ছাড়া ভঙ্গিতে হেলেদুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে সোজা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

লিভিং রুমে দাড়িয়ে থাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
***
ড্রাইভ করতে করতে রাহাত একপলক মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছু সময় পরে রাহাত বলে ওঠে,”ভাবী!”
_আপনাদের ভাইয়ের কীর্তন গাইতে শুরু করবেন না রাহাত। আমি ফেলে এসেছি তাকে, অনেকটা দূরে চলে এসেছি তাকে ফেলে। এখন আর কিছু শুনতে চাচ্ছি না।
রাহাত আলোর দিকে তাকায়। কিছু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”আপনি খুবই নি’ষ্ঠু’র ভাবী।”

_হ্যা। আর আপনারা খুব ভালো। যুবতী মেয়েকে কি’ড’ন্যা’প করে তাকে একটা ক্রি’মি’না’লে’র শ’য্যা’স’ঙ্গী বানিয়ে দেন। আপনারা খুব ভালো রাহাত।

রাহাত আর কোনো কথা বলে না, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ তো তার নেই। আসলেই তো তারা অ’প’রা’ধ করেছিলো।
তবুও সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”ভাইয়ের চোখে আপনার জন্য শুধু ভালোবাসা না সম্মান দেখেছি আমরা ভাবী, এত বছর ধরে ভাইকে দেখছি কখনো কোনো মেয়ের জন্য এতটা উতলা হতে ভাইকে দেখিনি ভাবী। আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি ভাইয়ের কাছে ফিরে যান।”

_গাড়ি থামান রাহাত।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো। রাহাত আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”কেনো ভাবী?”
_আমাদের বাড়ি এসে গিয়েছে। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?

রাহাত সামনের দিকে তাকিয়ে ব্রেক কষে দেয়। আলো রাহাতের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”আবার যদি কখনো নিজের প্রিয় ভাইয়ের জন্য কোনো মেয়েকে তুলে আনতে যান তাহলে নিজের মা বোনের কথাটা একবার ভেবে নিবেন রাহাত। ভালো থাকবেন।”

আলো কথাটি বলে বাড়ির গেইটের ভেতরে চলে যায়। রাহাত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গাড়ি স্টার্ট করে।‌

কলিং বেল টিপে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আলো। আজান এসে দরজা খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মূহুর্ত। তারপর একটা বি’ক’ট চি’ৎ’কা’র দেয়। রেহেনা ছুটে এসে থ’ম’কে দাঁড়িয়ে যায়। আলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আলো মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,”এক সপ্তাহ পর ফেরার কথা ছিলো। ইয়াসার মির্জা দয়া করে এক সপ্তাহ আগেই আমাকে ছেড়ে দিয়েছে মা।”

রেহেনা ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পরে আলো মাকে ছেড়ে সোজা হেটে আতাউর আলমের ঘরে ঢোকে। আতাউর আলম মেয়েকে দেখতে পেয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে, তার কোনো ভাবান্তর নেই । আলো দৌড়ে গিয়ে বাবার গায়ে ঝাঁ’পি’য়ে পরে। কিছুক্ষণ পরে ভেজা দুটো চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার মেয়ে মুক্তি পেয়েছে আব্বু।”

***
ঘরে ঢুকে বিছানায় চিৎ হয়ে, হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে সামিন। কিছু সময় শূন্যে তাকিয়ে থেকে উঠে বসে বিছানার ওপর থেকে তার মায়ের হাতের বালা দুটো তুলে নেয়। বেশ মানিয়েছিলো আলোর হাতে বালা দুটো। অহংকারী,তেজী, মাথামোটা, গলাবাজি করা মেয়েটি ফেলে রেখে চলে গেলো নিজের জিনিস। বোকা মেয়েটা জানেই না এভাবে নিজের পরিচয় ফেলে রাখা যায়না।
সামিন উঠে গিয়ে নিজের আলমারি খুলে একটা বক্স বের করে আনে। বক্সে কিছু গয়না ছিলো, যেগুলো আলোর মা আলোর জন্য গড়েছিলো। সামিন বালা দুটো সেই বক্সটাতে তুলে রাখে‌ । এগুলো সব ঐ তে’জী মেয়েটার। আবার যখন সামিন তার বৌকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে, সেদিন ভালোবাসাবাসির রাতে এগুলো নিজের হাতে পরিয়ে দেবে তার বৌকে।

ফুয়াদকে দেখে সামিন ম্লান হেসে বক্সটা তুলে রাখে। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে ফুয়াদ। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি চলছে মাথায়? কি করবি?”
_সাধনা।
হাসতে হাসতে বলে সামিন‌।

_তাতে যদি কাজ না হয়?
_তাহলে আবার তুলে আনবো তারপর আবার চলে গেলে আবার সাধনা করবো তাতে কাজ না হলে আবার তুলে আনবো তারপর আবার চলে গেলে আবার সাধনা করবো তাতেও কাজ না হলে আবার তুলে আনবো….

_থাম থাম থাম।
ফুয়াদ চেঁচিয়ে ওঠে।

সামিন উচ্চশব্দে হাসতে হাসতে বলে,”মোটকথা ওর জন্ম হয়েছে আমার কাছে বন্দী হবার জন্য আর আমার জন্ম হয়েছে ওকে তুলে আনবার জন্য।”

_তোর কাহিনী দিয়ে একটা দূরদান্ত ড্রামা সিরিজ বানানো যাবে। লোকজন যেটা দেখে তোকে আর আলোকে গা’লা’গা’ল দেবে। তাদের মাথা খা’রা’প করার জন্য।

সামিন হাসতে থাকে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে,”একটু গললো না ঐ আছিয়া। তুই ভাবতে পারিস? কি দিয়ে গড়েছে ওকে?”

***
ভাতের লোকমা তুলে মেয়ের সামনে ধরে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে রেহেনা। আলো হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,”ভালো লাগছে না খেতে আম্মু ,নিয়ে যাও।”

আলোকে খুবই কাহিল দেখাচ্ছে। একটু পর পর পানি খাচ্ছে শুধু।

রেহেনা প্লেট সরিয়ে রেখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই ঠিক আছিস তো? এমন লাগছে কেনো?”

_ও কিছু না আম্মু। কিছুটা দুর্বল লাগছে শুধু।

আলো উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”ঘরে এক কাপ লেবু চা দিয়ে যাবে আম্মু?”
রেহেনা মাথা নাড়ায়। আলো নিজের ঘরে চলে যায়। দীর্ঘ দিন পরে নিজের সেই চির চেনা ঘরটাতে ঢুকে আলো বেশ শান্তি পায়। কিছুক্ষণ ঘুরে পুরো ঘরটাকে দেখে আলো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পরনে এখনো ঐ লোকটার দেয়া শাড়ি। আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তার আলমারি থেকে এক সেট সালোয়ার কামিজ বের করে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গোসল সেরে নেয়। শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দেখে রেহেনা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আলো চায়ের কাপ টা উঠিয়ে একটা চুমুক দেয়। রেহেনা আমতা আমতা করে বলে,”তখন তোর বাবার সামনে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তোকে এমন লাগছে কেনো দেখতে?”
_কেমন লাগছে?
আলো তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে। রেহেনা নিচুস্বরে বলে,”তোর এই মাসে পি’রি’য়’ড হয়েছিলো?”

_হু কেনো?
_না মানে, পেটে বাচ্চা এলো কি-না…

আলো তার মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,”আমাদের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি আম্মু‌।”

রেহেনা অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো নিচু স্বরে বলে,”উনি কিছু করেনি আমার সাথে।”

_বিয়ের দুমাস হয়ে গিয়েছে। কিছুই হয়নি তোর সাথে?

আলো না সূচক মাথা নাড়ায়। রেহেনা বেশ অবাক হয় কথাটি শুনে।

***
“ভাইয়া আসবো।”

_আয়।

ইশমাম ভেতরে ঢুকতেই সামিন উঠে বসে। সে ইশমামের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”হাতের ব্যাথা সেরেছে? তুই একটা অদ্ভুত মানুষ, তোর ভাবীর মতো। ঐ মেয়েটাও কখন কি করে ফেলে বোঝা মুশকিল। নিজেও জানে না আসলে। কখনো বই ছুড়ে মা’রে,বই দিয়ে বারি মা’রে, মিন্ট লেমন ছুড়ে মা’রে, বাচ্চাদের মতো থুতু দেয়, আমার পাঞ্জাবি টুকরো টুকরো করে কে’টে ফেলে।”
কথাটা বলে সামিন একা একা কিছুক্ষণ হেসে নেয়। ইশমাম ম্লান হেসে তার ভাইয়ের পাশে বসে। তারপর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ঐ অদ্ভুত মেয়েটাকে পেয়ে গেলে খুশি হবে খুব?”

সামিন হাসি থামিয়ে মাথা নিচু করে বলে,”সব কিছু পেয়ে গিয়েছি,এমন অনূভুতি হবে।”

ইশমাম চুপ করে তার ভাইয়াকে দেখে। তারপর বলে,”আমি চলে যাচ্ছি ভাইয়া।”

_সবাই চলে যাচ্ছিস। যাবিই তো, আমি সবাইকে জোর জবরদস্তি করি। খা’রা’প মানুষ।

ইশমাম ভাইকে দেখে। সামিনের কন্ঠে এক রাশ হতাশা। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে সে। ইশমাম পাশে বসে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ।

***
মোট ষোলো হাজার তিনশ ছয় টাকা। পঞ্চম বারের মতো টাকা গুলো গুনে নেয় আলো। বরাবর সে টাকা পয়সা গুনতে অদক্ষ।
টাকা গুলো মুঠির মধ্যে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এই টাকা গুলো সে টিউশনি করিয়ে জমিয়েছিলো একটা নতুন ফোন কিনবে বলে। ইউনিভার্সিটিতে পা দেওয়ার সাথে সাথে আতাউর আলমের থেকে হাতখরচা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল আলো। সে বরাবর আত্মনির্ভরশীল মেয়ে হতে চেয়েছিলো। পেরেওছিলো। মাঝখান থেকে একটা ঝড় এসে সবটা ওলটপালট করে দিলো,সবটা!

তবে আলো নিশ্চিত,অতি দ্রুত সবটা গুছিয়ে নিতে পারবে সে। সেই আত্মবিশ্বাস আলোর আছে।
সকাল থেকে আলোর মধ্যে একটা ব্যাস্ত ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাবার সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে নিজে কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আতাউর আলম মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে কিছুটা অস্বাভাবিক লাগে তাকে, আগের মতো নেই কিছুই। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করেন। অবশ্য কত বড় একটা অপারেশন হয়েছে,এমন আচরণ করা স্বাভাবিক।

“যাচ্ছিস কোথাও?”

আলো গলায় ওড়না দিয়ে ঘুরে তাকায় রেহেনার দিকে। রেহেনা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে দেখেছে।

কলেজ ব্যাগ টা কাঁধে উঠিয়ে ক্যাবিনেট থেকে স্লিপার বের করতে করতে বলে,”হু। ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি।”

_কলেজ যাচ্ছিস?

_ওমা,অবাক হচ্ছো কেন? আমি যে স্টুডেন্ট এটা ভুলে গেলে?

রেহেনা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,”পড়াশোনা টা চালিয়ে যেতে চাই। সাথে টুকটাক কাজ করবো‌। আব্বুর অবস্থা দেখে যা বুঝলাম, আমি ছাড়া এই সংসারের গতি নেই।”

রেহেনা কোনো কথা বলে না। আলো চলে যায়। ও ঘর থেকে আতাউর আলম ডাকছে। রেহেনার কানে সে ডাক পৌঁছায় না। কপালে তার চিন্তার রেখা। সবটা কি আদৌও আগের মতো করা সম্ভব? একজন মা হিসেবে তার কি করা উচিৎ? মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয়া? নাকি সমাজের বাঁকা কথা যাতে শুনতে না হয় সেজন্য মেয়েকে সবটা মানিয়ে নিতে বলা? কোনটা?

***

“কি বুড়ি? তুমি সকাল সকাল চলে এলে?”
গম্ভীর কন্ঠে কথাটি বলে সামিন ঢোকে তার পার্টি অফিসের সামনের টং-য়ের দোকানটায়।

_তোর দাদা আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। কি আর করি বল!

সামিন মৃদু হেসে একটা বেঞ্চিতে বসে পরে। তার সামনে রয়েছে প্রায় সত্তর বছর বয়সী দুজন বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা। সামিন মজার ছলে বলতে থাকে,”দু’জনেই প্রত্যেক মাসে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছো তবুও তোমাদের টাকার লোভ গেলো না। এই দোকানের কি দরকার? এতো টাকা নিয়ে যেতে পারবে কবরে? কাউকে যে দিয়ে যাবে সে উপায় তো নেই,তারা তো তোমাদের খোজ নেয় না।”

মনা বিবি হেসে বলে,”তোকে দিয়ে যাবো সব।”

_আমার তোমাদের ওসব খুচরা পয়সার দরকার নেই। আমার অনেক টাকা!

_জানি তোর অনেক টাকা, তা তুই এই দোকানে চা খেতে আসিস কেনো? ঐ যে ঐ সাহেবদের ইটের দালানে যা।

শাহজাহান মিয়া সামিনের দিকে এক কাপ চা বানিয়ে দেয়। কাপে চুমুক দিয়ে সামিন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। লোকজন তাকে অবাক হয়ে দেখে। একজন মেয়র এভাবে টিনের ছাপড়া দেওয়া দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছে এটা বেশ অবাক করা একটা দৃশ্য। এসব দৃশ্য নির্বাচনের আগে আগে দেখা যায়, পরে নয়।

মনা বিবি নিচু স্বরে বলে,”তোর বৌ কেমন আছে?”

_বৌ চলে গেছে।

_ভেগে গিয়েছে নাকি? কার সাথে?

_ভেগে যায়নি, চোখের সামনে থেকে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে ‌।

_রাগ করে? কি করেছিস?

_অনেক কিছু তোমরা বুঝবে না।

_তোর মতো মানিকের ওপর রাগ করে চলে যায়? কেমন মেয়ে মানুষ?

_অদ্ভুত মেয়ে মানুষ দাদী। অদ্ভুত মেয়ে মানুষ।

সামিন চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো ভাবে হেটে অফিসের গেইট দিয়ে ঢোকে। আজ একটা মানববন্ধন আছে প্রেসক্লাবের সামনে। তার আগে দলের ছেলেদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা জরুরি। অফিসে ঢুকে দেখে সবাই অলস ভঙ্গিতে বসে আছে, কেউ কেউ মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যাস্ত।

সামিন নিজের চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে বসতে বসতে বলে,”কিছু মাছি এনে মা’র’তে পারতি। এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে ভালো লাগে না।”

তৌফ উঠে দাঁড়ায়। সামিন তার দিকে না তাকিয়ে একটা কাগজ দেখতে দেখতে বলে,”আপডেট বল।”

তৌফ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,”কোনটার?”

_তোর ভাবীর, আমার বৌয়ের।

_ভাবী চারঘন্টা আগে নিউ মার্কেটের বনি টেলিকম থেকে একটা নতুন মোবাইল ফোন কিনেছে এবং সাথে একটা সিমকার্ড। সেখান থেকে বের হয়ে তাদের কলেজের সামনে পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে একটা বান্ধবীর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করেছে, তারপর তাদের বাড়ির সামনের একটা ডিসপেনসারির দোকান থেকে আপনার শ্বশুরের জন্য কিছু ওষুধ নিয়েছে। এবং সবশেষে একটু আগে বাড়িতে ঢুকেছে। ওহহ হ্যা ভালো কথা, বাড়িতে ঢোকার আগে কুকুর দেখে ভ’য় পেয়ে দৌড়াতে গিয়ে একবার উষ্ঠা খেয়ে পরে গিয়েছিলো।

সবাই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে তৌফের শেষের কথাটা শুনে। সামিন ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে তাকায় সবার দিকে। সবাই চুপ হয়ে যায়। তৌফ বলতে থাকে,
_তার পরনে ছিলো একটা লাল রঙের সালোয়ার কামিজ, মুখটা ছিলো শুকনো। দেখে মনে হয়েছে সকালে নাস্তা করেনি।

সামিন তৌফের কথায় তার দিকে তাকিয়ে বলে,”বাহ! তুই তো একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস! এবার আমার বৌয়ের নাম্বার টা এনে দে।”

তৌফ তৎক্ষণাৎ তার ফোনটা বের করে সামিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দাঁতের পাটি মেলে বলে,”কাঁচা কাজ করি না ভাই!”

***
দুমিনিট বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বইটা বিছানার উপরে ছুঁড়ে মারে আলো। সবকিছু তার কাছে নতুন মনে হচ্ছে। কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এই ইয়ারের ফার্স্ট ইনকোর্স এক্সাম টাই দিতে পারলো না সে। মার্কস টা না পেলে মুশকিল। কিছুক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে। এখন এমনিতেও পড়া হতো না। তার চেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো হয়। বসার ঘর থেকে পাশের বাড়ির দু’জন ভদ্রমহিলার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইনিয়ে বিনিয়ে আলোর ব্যাপারেই আলোর মায়ের কাছে বলছে তারা। জানতে চাচ্ছে আলো কদিনের জন্য এসেছে। বিরক্তিতে আলো কপাল কুঁচকে ফেলে। ইচ্ছে করছে ভদ্রভাষায় কিছু কটু কথা শুনিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। কিন্তু আলো দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। একেবারে ডি’ভো’র্স পেপারে সাইন করে সবাইকে মাইকিং করে জানিয়ে দেবে সে। এখন কিছুদিনের অপেক্ষা।

ঘুম পাচ্ছে খুব। প্রায় ঘুমিয়েও গিয়েছিলো। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আলো বেশ অবাক হয়। তাকে কে ফোন দেবে! কেউ তো তার নতুন নাম্বার জানেই না। রং নাম্বার ভেবে প্রথম বার ফোন টা রিসিভ করে না সে। দ্বিতীয়বারের সময় ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে বলে,”হ্যালো কে বলছেন?”

সামিনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত নারীকন্ঠটি শুনে।কন্ঠে সেই চিরাচরিত তেজ। এমন ভাবে হ্যালো বলছে পুরো শহর শুনতে পেয়েছে বোধ হয়। কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে সে বলে ওঠে,”হ্যালো….”

আলোর হাত কেঁ’পে ওঠে। ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে কিছুটা সময় সে নেয়। তারপর বলে,”কে বলছেন?”

_আমি তোমার ফে’রা’উ’ন আছিয়া।

আলো নিশ্চুপ হয়ে যায়। সামিন বলতে থাকে,”কেমন আছো?”

_আপনি আমার নাম্বার পেয়েছেন কিভাবে?

সামিন হেসে ফেলে। হাসি থামিয়ে বলে,”কেনো বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করছো আলো? তোমার ফোন নাম্বার পাওয়া কোনো ব্যাপার আমার কাছে?”

_কি চাই আপনার? আবার কি?

_আপাতত কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই।

_ইয়াসার মির্জা।

_হ্যা বলো আছিয়া।

আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”আপনার লোকজন আমাকে ফলো করে, আপনি মাঝরাতে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেন, এর মানে টা কি? আপনি কি ভুলে গিয়েছেন সবটা শেষ হয়ে গিয়েছে?

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাঁকা হেসে বলে,”শেষ হয়নি আছিয়া। সবটা শুরু হতে যাচ্ছে।”

_মানে?

_মানে অপেক্ষা করো, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে‌। তোমার মতো মাথামোটা মেয়ের ধীরে ধীরে বোঝাই ভালো!

_চরিত্রের দিক থেকে আপনি শুধু ক্রি’মি’না’ল না। একটা নির্লজ্জ মানুষও আপনি জানেন?

_হুম জানি। আমি নির্লজ্জ, আর তুমি ত্যা’ড়া। একজন ত্যা’ড়া মানুষকে কাবু করতে একটা একজন নির্লজ্জ মানুষ দরকার পৃথিবীতে। আমরা একেবারে পারফেক্ট কম্বিনেশন আছিয়া।

চলমান…..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২৮
#Esrat_Ety
আজকের পর্বটা অনেক বড় তাই সবাইকে সরাসরি ফেসবুক থেকে পড়ার পরামর্শ রইলো, ফেইসবুক লাইট থেকে পড়তে অসুবিধা হতে পারে।

“আজ আবার নতুন সিমকার্ড? দুদিন আগেও তো নিলি। ঘনঘন সিমকার্ড চেঞ্জ করছিস কেনো!”
হিয়া আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো ফোনটা ব্যাগে ভরে থমথমে মুখ নিয়ে বলে,”একটা অ’স’ভ্য, নির্লজ্জ লোক খুব বিরক্ত করে‌। অনেক বেশি বেহায়া সে।”

_তো দুলাভাইকে বল। মেয়রের বৌকে ডিস্টার্ব করে। কত বড় সাহস! মেরে ঠ্যাং ভে’ঙে দিক।

আলো শুকনো মুখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হিয়াকে বলে দেবে সেই লোকটা ইয়াসার মির্জা নিজেই?

হিয়া কথা বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করে।‌ আলোও গুটি গুটি পায়ে হিয়ার পিছু পিছু হাটে। কন্ঠে অভিযোগের সুর তুলে হিয়া বলে ওঠে,”একটা বার আমাদের জানাতে পারলি না ভাইয়ার কথা? বেশ অবাক হয়েছি তোর আর ইয়াসার ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনে। মানে হুট করে? কিভাবে? বলছিস না কেনো কিছু?”

আলো আমতা আমতা করে বলে,”ওসব বাদ দে। পড়ার কথা বল। অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিস তাই না তোরা? আচ্ছা শ্রাবণী কেন আসে না? ওর কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে?”

হিয়া মুখ মলিন করে বলে,”আর বলিস না।‌ অনেক ঝামেলার মধ্যে আছে ও। ওদের বাড়ি প্লাস দোকান ঘরটা দখলের চেষ্টা চলছে। ওর বাবা ছোটাছুটি করে অসুস্থ হয়ে পরেছে। সবটা ওকেই দেখতে হচ্ছে।”

আলো অবাক হয়ে বলে,”পুলিশ কি করছে? পুলিশের কাছে যায়নি?”

_টাকা দিয়ে আইন কিনে নিয়েছে দখলদাররা। কিছু করার নেই। ওদের মাথার ওপর শক্ত কোনো হাতও নেই। আতাউর আংকেল যে কিছু করবে সে তো দুমাস ধরে আংকেল অসুস্থতার জন্য গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে এসব ঝু’ট ঝামেলা থেকে।

আলো মাথা নিচু করে শুনতে থাকে হিয়ার কথা। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে সে বাবার কথা শুনতেই।

_এই আলো! এই!
হিয়া আলোকে ধাক্কা দেয়। আলোর ঘোর কেটে যেতেই “হু” বলে সাড়া দেয়। হিয়া বলে,”কি ভাবছিলি?”

_কিছু না, বল।

_শ্রাবনীর কথা বলছিলাম। আচ্ছা আলো, তোকে একটা কথা বলতে চাই। কিছু মনে করবি নাতো ?

_না। মনে করবো কেনো। বল।

হিয়া আমতা আমতা করে বলে,”তুই ইয়াসার ভাইয়াকে বলে দেখবি যাতে সে শ্রাবনীদের বিষয়টা একটু দেখে দেয়? আমি নিশ্চিত সে দেখলেই হবে!

হিয়ার কন্ঠে অনুরোধের সুর। আলো অবাক চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, কিছু সময় পরে বলে,”আমি?”

_হ্যা তুই। তুই বৌ, তাই ভাইয়া তোর কথাটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। শ্রাবনীর বাবা অসুস্থ শরীর নিয়ে যেতে চেয়েছিল ভাইয়ার কাছে শুনেছি। প্লিজ তুই একটু দেখ! প্লিজ প্লিজ প্লিজ!

হিয়া আলোর হাত ধরে ফেলে। আলো ঘামতে থাকে। সে কিভাবে ঐ লোকটার কাছে অনুরোধ করবে! কিভাবে!

***
“আমরা কত দ্রুত বড় হয়ে গেলাম তাই না ছোটো?”

ড্রাইভ করতে করতে সামিন ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে কথাটা। ইশমাম মাথা নিচু করে বসে আছে। নরম গলায় বলে,”তোমার কন্ঠে আমার প্রতি রাগ ভাইয়া। তুমি শুধু শুধু রাগ করছো। আমি ফিরে আসবো।”

সামিন ম্লান হাসে। তারপর বলে,”রাগ? আমার তো উলটো টা মনে হচ্ছে ছোটো। আমার তো তোর প্রতিটা আচরণে মনে হচ্ছে তুই কোনো কারনে আমার উপর রেগে আছিস অথবা আমি তোকে কষ্ট দিয়েছি।”

ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকায়। স্টিয়ারিংয়ের ওপর রাখা সামিনের বাম হাতের ওপর আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,”ধূর! তুমি বেশি বেশি ভাবো ভাইয়া।”

_তুই সবসময় অন্যায় কাজ অপছন্দ করিস। আলোর বিষয়টা নিয়ে তুই আমার উপরে রাগ? আমি জেদের বশে সবসময় ঝামেলা করি বলে?

ইশমাম চুপ করে থাকে। তারপর বলে ওঠে,”ঝামেলা করো, আবার সবটা ঠিক ঠাকও তো করে নাও। তাই রাগ নেই।”

***
“আপনার নাম।”
_অদ্রিতা আলো।

লোকটা বাতাসের বেগে আলোর নামটা লিখে ফেলে রেজিষ্ট্রার খাতায়।
তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”বিবাহিতা?”

অজান্তেই আলোর মুখ থেকে বেরিয়ে যায় কথাটা,”জ্বি।”

তৎক্ষণাৎ আলো নিজেকে শুধরে নিয়ে বলে,”জ্বি না।”

_একবার জ্বি, আরেকবার জ্বি না। মানে কি?

পেছন থেকে হিয়া বলে,”বিবাহিতা। ও বিবাহিতা। আসলে কদিনের জন্য বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে তাই সব খেয়ে বসে আছে।”

কথাটি বলেই দুষ্টুমির ছলে আলোর মাথায় গাট্টা মে’রে দেয় সে। লোকটা একটা ফরমে আলোর নাম ঠিকানা তুলতে থাকে। তারপর বলে,”স্বামীর নাম?”

আলো ঘামছে। হিয়াটা তাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। সে আমতা আমতা করে বলে,”বাবার নাম দিলে কি সমস্যা?”

_স্বামীর নাম সামিন ইয়াসার মির্জা। এই শহরের মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা।
হিয়া বলে দেয় দ্রুত। লোকটা হা হয়ে আলোর দিকে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থাকে। ইয়াসার মির্জার বৌ এসেছে তাদের কাছে! আলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে ওঠে,”তোমাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেনো দেখেছি।”

“খুব ফেমাস মেয়ে। চেনা চেনা লাগতেই পারে। যেখানে যায় নিজের র’গ’চ’টা স্বভাবের জন্য একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে আসে, কিছুদিন আগে টিভিতেও উঠেছিলো। আপনি সম্ভবত দেখেন নি। আপনি তাড়াতাড়ি ফরমটা দিন আংকেল। অফিস তো বন্ধ হয়ে যাবে।”

লোকটা আমতা আমতা করে বলে,”ইয়াসার মির্জার বৌ এসেছে স্টুডেন্ট লোনের জন্য এপ্লাই করতে!”

আলো লোকটার দিকে স্থির দৃষ্টি দেয়। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে,”কেনো? আমার জন্য নিষেধ আছে রাষ্ট্র থেকে? আমাকে লোন দেওয়া যাবেনা?”

_ঠিক তা না। আপনার স্বামীর তো অনেক টাকা…..

হিয়া বলে ওঠে,”প্রবলেম কি আংকেল? স্বামীর টাকা তো কি হয়েছে? একটা মেয়ে নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হতে চাইলে সে পারে না? জানেন আমার বান্ধবীর খুব আত্মসম্মান। আর এজন্যই তো ইয়াসার ভাইয়া ওকে পছন্দ করেছে। ওর মতো মেয়ে হয় না।”

_তুই চুপ করবি??
হিয়াকে থামিয়ে দিয়ে আলো লোকটার দিকে তাকায়। তারপর নরম গলায় বলে,”আংকেল প্লিজ। আমার খুব দরকার টাকা টা।”

লোকটা মৃদু হাসে। তারপর কাগজপত্র গুলো আলোর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে,”তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে মেয়ে। আমি তোমার কথাটা মাথায় রাখবো।”

***
সামিনের দিকে একবার ঘুরে তাকিয়ে তৌফ দলের কাছে এসে চুপচাপ বসে পরে। সামিন ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কথা বলছে। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরনে, চোখে সানগ্লাস, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে। টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে, রাশভারী পুরুষালি গলায় চমকপ্রদ কিছু বাক্য দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারদের মুগ্ধ করছে এই তরুণ মেয়র।

তৌফ দলের ছেলেদের বলে,”ভাইকে দেখছেন আপনারা? একেবারে নায়কের মতো। মনে হচ্ছে এখানে সিনেমার শুটিং চলছে, ভাই তার ডায়লোগ দিচ্ছে।”

রাহাত সামিনের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,”এতো সুন্দর, এতো উপযুক্ত স্বামী রেখে যে মেয়ে তেজ দেখিয়ে চলে যায়, সে মেয়ে মেয়েই না,সাধু সন্ন্যাসীর লেভেলে চলে গিয়েছে।”

আরাফ উঠে বলে,”ও কি সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে নাকি? মাথার তার ছিঁড়ে গিয়েছে অনেক আগেই। মনে নেই ওর কর্মকান্ড? ভাইকে এসে হুট করে চ’ড় মারা, রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের অপমান করা। কেউ পাগল না হলে ছাত্রনেতার সাথে এমন করে?”

_এই তুই “ও” বলছিস কাকে? ভাই শুনলে একটা আ’ছা’ড় মারবে তোকে।
চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে রাহাত। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কথা বলে ওদের দিকে এগিয়ে আসে।

তৌফ আনমনে গান গাইতে শুরু করে,”প্যাহেলি প্যাহেলি বার মোহাব্বত কি হে,কুছ না সামাঝ মে আয়ে মে কেয়া কারু,

ইশ্ক নে মেরি এ্যাছি হালাত কি হে,কুছ না সামাঝ মে আয়ে মেয়ে কেয়া কারু।”

সামিন এগিয়ে এসে তৌফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”কি হয়েছে তোর? কি গাইছিস এটা?”

_হিন্দি গান ভাই, এর অর্থ হচ্ছে, “প্রথম প্রথম বার ভালোবেসে ফেলেছি, কিছু বুঝতে পারছি না আমি কি করবো। মন আমার এমন হাল করলো, কিছু বুঝতে পারছি না আমি কি করবো!”

সামিন তৌফের দিকে শীতল চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,”অর্থ বুঝেছি আমি। কেনো গাইছিস এটা? আমাদের দলটাকে তোর গানের পালা মনে হয়? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে গান গাই আমরা?”

তৌফ মাথা নাড়ায়। সে ভীষণ ঘা’ব’ড়ে গিয়েছে ভাইয়ের ধ’ম’কে।

সামিন চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”কাজ শেষ আমার। বয়েজ কলেজে যাবি? কতদিন হারুন চাচার টং-য়ের দোকানের চা খাইনা। ফুয়াদকেও ডেকে নে। আর ওখানের ফুটবল টিমকে খবর দে। মন ভালো নেই আমার।”

_ইশমাম ভাইয়ের জন্য মন খারাপ?

সামিন কিছু না বলে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”বাইক স্টার্ট কর।”

আজ সামিন গাড়ি নিয়ে আসেনি। হাই ওয়ে-তে মোট ষোলো টা বাইক সাই সাই করে চলছে। সামিন রাহাতের পেছনে বসেছে। সবাই বয়েজ কলেজের সামনে গিয়ে বাইক পার্ক করে। ফুয়াদ আগে থেকেই গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। দলবল নিয়ে হারুনের দোকানে ঢুকে পরে সামিন‌।

চা খেতে খেতে সবুজকে বলে,”আমি কত বাজে মেয়র দেখেছিস? জনসেবা রেখে এখানে আড্ডাবাজি করছি। ব’খা’টে’দে’র মতো বাইকে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”

ফুয়াদ সামিনের হাবভাব দেখেই বুঝেছিলো সামিনের মন খারাপ। কিছুক্ষণ যেতেই সে আমতা আমতা করে বলে ওঠে,” তোর কি মন খারাপ?”

সামিন কিছু বলে না। ফুয়াদ বলে,”কি হয়েছে নতুন করে?”

_নতুন করে কিছু হয়নি। সারাদিন ভাবীর জন্য মন খারাপ থাকে আর এখন ইশমাম ভাইয়ের জন্য।
কন্ঠে সামিনের প্রতি সহানুভূতি সবুজের। সামিন সবুজের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,”বেশি কথা বলবি না। আমি সারাদিন মন খারাপ করি তোর ভাবীর জন্য? কি ধরনের কথা এগুলো?”

ফুয়াদ হাসতে হাসতে বলে,”তোর মতো পুরুষ এগুলো স্বীকার করবে না জানি। তাহলে তোর পৌরুষ চলে যাবে।”

সামিন চুপ হয়ে যায়। তারপর কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,”সত্যি কথা বলতে মিস করি ওকে। ওর পাগল পাগল আচরণ গুলোকে।”

তৌফ বলে,”ভাবী কে একটা ইমোশনাল মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিন ভাই। মেয়ে মানুষের মন গলাতে এইসব “ভং চং” কথা বার্তা অনেক কাজে দেয়।‌”

সামিন তৌফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভং চং কথাবার্তা মানে?”

_এই ধরেন। কবিতা বা গানের দুইটা লাইন । যা একেবারে একটা মেয়েলোকের হৃদয়ে গিয়ে লাগবে। সারাদিন চিল্লাচিল্লি করে এদের কাছে মার্কেট পাওয়া যায় না,তবে এইসব “ভুগিচুগি” কথাবার্তায় এরা পটে যায়। আমিও আমার গার্লফ্রেন্ডকে এভাবে পটিয়েছি।

সামিন কিছুক্ষণ বোকার মতো তৌফের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ফোনটা তৌফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”লিখে দে অমন একটা মেসেজ।”

তৌফ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”ছিঃ ছিঃ ভাই। ভাবীর মেসেজ আপনি নিজের হাতে টাইপ করেন। আমি বলে দিচ্ছি।”

সবাই খুবই আগ্রহী হয়ে দেখতে থাকে তৌফ আর সামিনের কর্মকাণ্ড। তৌফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”লেখেন, যেদিন আমি হারিয়ে, বুঝবে সেদিন বুঝবে।”

সামিন লিখতে থাকে,”যেদিন আমি হারিয়ে যাবো, বুঝবে সেদিন বুঝবে।”

তৌফ বলতে থাকে,”অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে।”

সামিন লিখে ফেলে। তারপর তৌফের দিকে তাকিয়ে বলে,”লাইন দুটো সুন্দর। কার লেখা?”

তৌফ বলে,”কি জানি, জসীমউদ্দীন নয়তো কাজী নজরুল ইসলাম।”

রাহাত বলে,”জসীমউদ্দীনেরই হবে। কাজী নজরুল বিদ্রোহ করে কুল পেতো না এসব “ভুগিচুগি” কথাবার্তা লিখতো কখন?”

ফুয়াদ সামিনের ফোনটা নিয়ে বলে,”দেখি গুগলকে জিজ্ঞেস করে দাড়া।”

সামিনের ফোনটা হাতে নিয়ে ফুয়াদ কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে সামিনের দিকে তাকায়। হতভম্ব হয়ে সামিনকে বলে,”এসব কি লেখা তোর সার্চ হিস্ট্রিতে? কিসব জানতে চেয়ে বেড়াতি এসব! স্ত্রীর মন জয় করার উপায়!
বৌয়ের উপর রাগ উঠলে তা নিয়ন্ত্রণ কিভাবে করে!
স্ত্রীর সাথে কিভাবে কথা বলা উচিত!”

পড়তে পড়তে ফুয়াদ উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। তার হাসি থামছেই না। সামিন থাবা মে’রে ফোনটা কেড়ে নিয়ে থমথমে মুখ নিয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে ফুয়াদ বলে,”বেচারা গুগল কে তো বেশ অত্যাচার করেছিস এই ক’দিন।”

সামিন তার দলের ছেলেদের সামনে লজ্জায় পরে যায়। ফুয়াদ বলে,”কিছু শিখতে পেরেছিস?”

তৌফ বলে ওঠে,”ভাই মেসেজ টা পাঠিয়ে দিন ভাবীর নাম্বারে। দেখবেন একটু হলেও মন গলবে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। তমাকে এটা লিখেই পটিয়েছি আমি।”

সামিন কিছুক্ষণ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”তমা আর আতাউর আলমের মেয়ে অদ্রিতা আলো এক হলো? এই মেসেজ পাঠালে তোর ঐ ভাবী কি লিখবে জানিস? লিখবে জাহান্নামে যান। মিলিয়ে নিস। দরকার নেই। বাদ দে, বাদ দে।”

তৌফ জোর করে সামিনের ফোনটা নিয়ে বলে,”ধূর ভাই! কিছু হবে না এমন। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি মেসেজ টা।”

_না তৌফ।
_হ্যা ভাই।
_তৌফ পাঠাস না।

তৌফ দাঁত বের করে বলে,”পাঠিয়ে দিয়েছি ভাই!”

***
মেসেজের টুং টুং আওয়াজে বই থেকে চোখ সরিয়ে মোবাইল টা হাতে নেয় আলো।

“যেদিন আমি হারিয়ে যাব বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে।”

সামিন ইয়াসারের নাম্বার দেখে আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নতুন নাম্বার টাও জেনে গিয়েছে লোকটা! লোকটা যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। আর কত সিমকার্ড চেঞ্জ করবে আলো!
মেসেজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলো তার উত্তর টাইপ করতে থাকে।

সামিনের ফোনে নোটিফিকেশনের টুং টাং আওয়াজ হয়। সবাই কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সামিন আলোর নাম্বার দেখে খুশি হয় কিন্তু পরক্ষনেই মেসেজটি দেখেই তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ফুয়াদ বলে,”কি লিখেছে আলো?”

সামিন থমথমে মুখ নিয়ে বলে,”লিখেছে Go to hell!”

ফুয়াদ ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। অবশ্য সে জানতো আলো এমন কিছুই বলবে।‌ তৌফ বলে ওঠে,”ভাই আপনি তো বলেছিলেন ভাবী লিখবে জাহান্নামে যান কিন্তু ভাবী লিখেছে Go to hell, আপনার কথা পুরোপুরি মিলে নাই ভাই।”
সামিন শীতল চোখে তৌফের দিকে তাকায়, তারপর রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই ওর কানের নিচে একটা ঠাঁটিয়ে চ’ড় মেরে দে তো।”

কিছুক্ষণ বিরক্ত হয়ে বসে থাকে আলো‌। আবার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। শ্রাবনীর নাম্বার দেখে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করে কানে ধরে।

ফোনটা কানে চেপে ধরে আলো চুপ করে আছে। ওপাশ থেকে শ্রাবনীর কান্নার শব্দ আসছে। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আলো বলে ওঠে,”কাকার কি অবস্থা?”

_আছে। খুবই ভেঙে পরেছে বাবা।

আলো আমতা আমতা করে বলে ওঠে,”আমাকে কি করতে হবে?”

_তুই একটু ইয়াসার মির্জাকে বলে দেখনা। আমি জানি সে পারবে। তার অনেক ক্ষমতা।

আলো অস্বস্তিতে পরে যায়। শ্রাবনীকে কিভাবে মানা করে দেবে সে! কিন্তু ঐ লোকটাকে আলো কি বলবে! এমনিতেই লোকটা আলোর পিছু ছাড়ছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা চিন্তা করে আলো তারপর শ্রাবনীকে আশ্বস্ত করে নিচু স্বরে বলে,”আচ্ছা। তুই রাখ। আমি দেখছি। তোকে জানাবো।”

***
কলিং বেলের আওয়াজ আলো পেয়েছে। বিছানায় অলস ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে একটা বইয়ে মুখ গুঁজে ছিলো সে। একেবারেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। দুমিনিট পরে নিচু গলায় রেহেনাকে ডেকে বলে,”মা কে এসেছে?”

“আমি”
ইশিতার গলার আওয়াজ পেয়ে আলো হকচকিয়ে উঠে বসে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। আলোর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইশিতা। তার মুখ হাসি হাসি।
বিছানা থেকে ওড়নাটা তুলে গলায় পেঁচিয়ে ইশিতার দিকে ছুটে যায় আলো। ইশিতার হাত ধরে আনন্দিত গলায় বলে,”তুমি!”

ইশিতা হেসে বলে,”খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করলাম তোমাদের বাড়ি।”
আলো ইশিতাকে টেনে এনে নিজের বিছানায় বসিয়ে দেয়। ইশিতা আলোকে কয়েক মুহূর্ত দেখে বলে,”সালোয়ার কামিজে তোমাকে ভালো লাগে না ভাবী।”
আলো ইশিতার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে নিচু স্বরে বলে,”ভাবী ডেকো না আমায়।”
ইশিতা হাই তুলে বলে,
_ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত তো ডাকতেই পারি।

আলো বিছানার একপাশে বসে। ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”রিতু কেমন আছে?”
_খুব একটা ভালো নেই। সারাদিন বমি হতে থাকে।

_তোমাদের দু’জনকে খুব মিস করি।
_আদৌও করো? মনে তো হয়না আমার।

আলো ম্লান হাসে। ইশিতা বলতে থাকে,”আর কাউকে করো না?”
_আর কাউকে করার কথা আপু? কেনো এসব অযৌক্তিক কথা বলছো।

ইশিতা চুপ করে থাকে।‌ আলো বলে,”এভাবে এসো মাঝে মাঝে। আমার ভালো লাগবে।”

ইশিতা আলোর কথার জবাব না দিয়ে বলে,”বাড়িটা একেবারে আগের মতো হয়ে গিয়েছে। তুমি চলে এসেছো, ইশমামও আমেরিকা চলে গিয়েছে। আবার সেই আগের রূপ। সময় কাটে না আমার। তাই খুঁজতে খুঁজতে তোমার কাছে এলাম।”

_ইশমাম চলে গিয়েছে?
আলো জানতে চায়। ইশিতা মাথা নাড়িয়ে বলে,”গত পরশু।”

আলো আর কথা বাড়ায় না। প্রসঙ্গ পালটে বলে,”শান্ত ভাইয়া কেমন আছে?”

_ভালো।
_সব ঠিক আছে? আর কিছু বলেছে তোমাকে তোমার ওই গুণধর ভাইয়া?

ইশিতা মাথা নাড়িয়ে বলে,”ভাইয়া আমার সাথে কথা বলে না সেদিনের পর থেকে।”

***
হুট করে ব্রেক ক’ষে দিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ ফেলে সামিন। কিছুক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। সাগর তার নিজের গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সামিন এগিয়ে গিয়ে দাঁত খিচিয়ে সাগরকে কুৎসিত একটা গা’লি দেয়। সাগর মুচকি হেসে বলে,”মেয়রের মুখে এসব গালি মানায়?”

_সর এখান থেকে। এটা তোর বাপের রাস্তা না।
ধ’ম’কে ওঠে সামিন।

সাগর হেসে ফেলে,বলে,”কোনটা আমার বাপের তা আমি ভালো করেই জানি। শুনলাম তোর বৌ চলে গিয়েছে বাপের বাড়ী! এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে চলে গেলো? শা’লা তোর সাথে আসল জিনিস নেই নাকি!”

কথাটা বলে খিক খিক করে হাসতে থাকে সাগর। সামিন শীতল চোখে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাগর হাসি থামিয়ে বলে,”সমস্যা নেই। আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। তুই আর আমি তো একই।”

সামিন সাগরের কলার ধরে চেঁচিয়ে ওঠে,”একেবারে জিভ টে’নে ছিঁ’ড়ে ফেলবো বা’স্টা’র্ড!”

সাগর সামিনের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলে,”দুই কোটি টাকা উসুল করবো আমি তোর থেকে। যেভাবে হোক ইয়াসার মির্জা।”

কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলে,”অবশ্য তোর বৌকে আমার কাছে দিলে একটু চিন্তা ভাবনা করে দেখতাম….”

কথাটি বলে সাগর শেষ না করতেই সামিন সাগরের নাক বরাবর একটা ঘু’ষি মে’রে দেয়। সাগর নাক চেপে ধরে মাথা ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। সামিন দৃঢ় ভাবে বলে,”তোর সাথে কথা অপচয় করে লাভ নেই। আমি ক্ষে’পে গেলে এই দেশে ভিক্ষা করেও খেতে পারবি না এই কথাটা শুধু মাথায় রাখিস।”

সামিন গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করে। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়।

মেজাজ যথেষ্ট বিগ’ড়ে রয়েছে তার। পার্টি অফিসের সামনে গাড়ি থামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢোকে। ছেলেরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যেদিন সামিনের মেজাজ গরম থাকে সবাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। আজ সম্ভবত সেই দিন। কোনো কথা বললেও দুবার ভেবে কথা বলতে হবে আজ।

***
সামিন ইয়াসারের পার্টি অফিসের সামনে সিএনজি থামে। আলো তার দুইপাশে বসে থাকা হিয়া এবং শ্রাবনীর দিকে তাকায়। তারা শুকনো মুখে আলোর দিকেই তাকিয়ে আছে। আলো বেশ ঘা’ব’ড়ে আছে। সারাদিন যাকে সে তুলোধুনো করে এখন কিনা তার কাছেই হেল্প চাইতে এসেছে সে। এর থেকে লাঞ্ছনার আর কি হতে পারে!
সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে তিনজন নেমে পরে। ধীরপায়ে হেটে ইয়াসার মির্জার পার্টি অফিসের গেইটের ভেতরে প্রবেশ করে এদিকে ওদিকে তাকায়।

রাহাত চুপচাপ বসেছিলো। সে আলোকে খেয়াল করেনি। মাথা নিচু করে ফোনে কিছু দেখছিলো।

“রাহাত!”
অবাক হয়ে রাহাত মাথা তুলে তাকায়। আলোকে দেখে তার মুখ হা হয়ে গিয়েছে। আলো কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে,”আপনার ভাইয়ের সাথে দরকার ছিলো। তার একটা এপয়েনমেন্ট পেতে পারি?”

রাহাত উঠে দাঁড়িয়ে যায়। বাকি ছেলেরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
হতভম্ব ভাব কাটিয়ে রাহাত বলে ওঠে,”ভাই আপনার জন্য অলটাইম ফ্রী। চলুন আমার সাথে।”

_ভাই।

রাহাত ডাকতেই সামিন ধ’ম’কে’র সুরে বলে ওঠে,”বলেছি আগামী একঘন্টায় কেউ আসবি না এখানে।”

_ভাই ভাবী এসেছে।

_কোন ভাবী? আমার কোনো ভাবী নেই।

_ভাই আমাদের ভাবী।

সামিন কিছু কাগজ দেখছিলো। রাহাতের কথায় মাথা তুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

রাহাত পেছনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাবী আসুন।”

সামিন উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ধীরপায়ে হেটে আলো সামিনের অফিসে ঢোকে। তার পেছনে হিয়া এবং শ্রাবনী।

আলো একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয়। সামিন এখনও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আলো নিচু স্বরে বলে,”আমি এখানে একজন মেয়রের কাছে এসেছি। আপনার সাথে কিছু দরকার ছিলো।”

আলোর কথায় সামিনের ঘোর কেটে যায়। সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ঠান্ডা গলায় বলে,”ঠিকাছে। আগে বসো।”

হিয়া এবং শ্রাবনী সামিনকে সালাম দেয়। সামিন সালামের উত্তর দিয়ে ওদেরকেও বসতে বলে।

সামিন রাহাতের দিকে তাকায়। রাহাত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”বলো। কি সমস্যা তোমার।”

আলো কাট কাট ভাবে বলে,”সমস্যা আমার না। সমস্যা আমার বান্ধবীর।”

সামিন শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি শ্রাবনী না? শ্রাবনী দাস। সুজন দাসের মেয়ে? ভালো গান করো।”

শ্রাবনী মাথা নাড়িয়ে বলে,”জ্বি ভাইয়া।”

_কি সমস্যা তোমার?

_ভাইয়া আমার বাবার দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলেরা জোর পূর্বক আমাদের বাড়ি দখল করেছে, সাথে আমাদের দোকান ঘরটাও , যেটা আমাদের পরিবারের একমাত্র ইনকাম সোর্স ছিলো। এমতাবস্থায় পুরো পরিবার নিয়ে খুব বিপদে পরে আপনার কাছে এসেছি।

_পুলিশের কাছে গিয়েছিলে? সুজন কাকা কোথায়?

শ্রাবনী মাথা নেড়ে বলে,”গিয়েছিলাম। বহুবার। আমাদের থেকে টাকাও নিয়েছে অনেক কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আর বাবা অসুস্থ। তাই আমিই আলোকে রিকোয়েস্ট করে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। ”

সামিন শ্রাবনীর কথা শুনতে শুনতে আলোর দিকে তাকাচ্ছে বারবার। আলো তার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।
সামিন চোখ সরিয়ে নিয়ে শ্রাবনীকে বলে,”এটা লিখন দাসের কাজ? যে লিখন দাসের ডান হাতে ছয়টা আঙ্গুল?”

শ্রাবনী মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,”বিপদের মাঝ সমুদ্রে পরেছি ভাইয়া। পাশে কেউ নেই, না আছে একটা ভাই। ওরা অনবরত আমাদের চার বোনের ক্ষতি করবার থ্রেট দিয়ে যাচ্ছে।”

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”হুম বুঝলাম। আচ্ছা আমি বিষয়টা দেখবো। জমির দলিল কোথায়?”

_বাবার কাছেই।

সামিন মাথা নাড়িয়ে বলে,”আঙ্গুল টা বাঁকা করতে হবে। তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। আর তোমাদের বোনদের কিছু হবে না। দুশ্চিন্তা করো না।”

আলো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফেলে। নিজে একটা মেয়ে উঠিয়ে নেওয়া লোক হয়ে অন্য মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে,কি হাস্যকর! খুব হাসি পাচ্ছে আলোর। সামিনের চোখে তা পরে যায়। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,”খুব ভালো গান করো তুমি। গত বছর শুনেছিলাম। জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হয়েছিলে। তোমরা সব বান্ধবীরাই বেশ গুনী দেখছি। কেউ কারাতে জানো,কেউ গান‌। আর তুমি কি জানো?”
হিয়ার দিকে তাকিয়ে সামিন বলে। হিয়া হেসে বলে,”আমি শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন নষ্ট করতে জানি ভাইয়া। আমি ওদের মতো গুনী নই।”

সামিন হেসে ফেলে। তারপর শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার গান শুনেছি। তোমার বান্ধবীর কারাতে এখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি।”

আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন প্রসঙ্গ পালটে বলে,”কি খাবে বলো? ঠান্ডা কিছু আনতে বলি?”

হিয়া মাথা নাড়িয়ে বলে,”না না ভাইয়া। আমাদের ক্লাস আছে আমরা উঠি।”

সামিন বাঁধা দিতে গিয়েও দেয়না। দেখে আলো সবার আগে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আছে।

শ্রাবনী কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে বলে,”ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করতে চাইবো না ভাইয়া।”

সামিন হাসে। তারপর বলে,”দুদিনের মধ্যে ঝামেলা শেষ করে দেবো আমি। চিন্তা করো না।”

হিয়া বলে,”আসি ভাইয়া?”

_হ্যা। তোমরা গিয়ে নিচে দাঁড়াও। তোমাদের বান্ধবী পাঁচ মিনিট পর যাচ্ছে।

আলো বলে,”মানে টা কি?”

হিয়া আলোর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,”চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক এখানে। আমরা নিচে আছি।”

আলো বেড়িয়ে যেতে চাইলে হিয়া ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে নিচে চলে যায় শ্রাবনীকে নিয়ে।

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো একপলক দেখে চোখ সরিয়ে নিয়ে কপাল কুঁ’চ’কে বলে,”কি? কি সমস্যা?”

সামিন ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বলে,”আমার কাছে তো তুমি এসেছো! আমি তো যাইনি। সমস্যা তো তোমার।”

_সমস্যা আমার বান্ধবীর। আমি একজন মেয়রের কাছে এসেছি।

_মেয়রের কাজ তো এগুলো নয়। এগুলো একটা গুন্ডার কাজ। আমি তো গুন্ডা। গুন্ডার কাছে আসতে আপনার আত্মসম্মানে বাঁধলো না আছিয়া?

আলো ক’ট’ম’ট করে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”হ্যা। গুন্ডা দেখেই এসেছি। এবার দয়া করে কাজ টা করে দিয়েন। এসব তো আপনি ভালোই পারেন।”

আলো চলে যেতে নিলে সামিন আলোর হাত টেনে ধরে। টেনে একেবারে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। আলো কিছুটা ঘা’ব’ড়ে যায়। অস্ফুট স্বরে বলে,”আপনি আমাকে হ্যা’রা’স করছেন ইয়াসার মির্জা।”

সামিন আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,”তুমি তো নিজেই এসেছো হ্যা’রা’স হতে।”

_আমি কিন্তু চেঁচাবো। আপনার গায়ে হাত তুলবো বলে দিলাম।

_চেঁচাও। গায়ে হাত তোলো। তোমার কি’ল ঘু’ষি আমার কাছে কাতুকুতুর মতো লাগে।

আলো চেঁচাতে পারে না। কেনো পারে না সে নিজেও জানে না। সামিন আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিচুস্বরে বলে,”সালোয়ার কামিজে বিশ্রী লাগে তোমাকে। শাড়ি পরবে। আর এভাবে কিশোরী মেয়েদের মতো দুটো বেনী করেছো কেন চুলে? বয়স কমানোর চেষ্টা? খোঁপা করবে।”

_আপনি আমাকে যেতে দিন।
_তোমার বান্ধবীদের থেকে পাঁচ মিনিট নিয়েছি। মাত্র দু মিনিট হয়েছে। আর তিনমিনিট পরে ছেড়ে দেবো।

আলো বুঝতে পারছে সে নিজের পা নাড়াতে পারছে না। সামিন আলোর ঘাবড়ে যাওয়া মুখটা দেখে মুচকি হাসে। তারপর কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”এতো বড় উপকার করবো তোমাদের? কি দেবে বিনিময়ে?”

_আপনার ছেলেদের নাস্তা-পানির ব্যাবস্থা করে দেওয়া হবে। এর বেশি তো কিছু দেওয়ার নেই। সবটা তো বোঝেন।

_ওসব তো ওরা পাবে! আমি কি পাবো?

আলোর অস্বস্তি বেড়ে যায়। সে দূরে সরে যেতে চাইলে সামিন আবারো তার হাত ধরে টেনে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,”আজ সকাল থেকে মেজাজ টা প্রচুর গরম ছিলো। তুমি এসে ঠান্ডা করে দিলে। তার জন্য তোমাকে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই আছিয়া।”

কথাটা বলে সামিন বাঁকা হাসি হাসে। আলো কিছু বুঝে ওঠার আগে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পরে। আলো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীর একটুও নড়ছে না। সামিন কিছু কাগজ উল্টে পাল্টে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। যেন এই মাত্র কিছুই হয়নি। কিছু সময় পরে আলোর দিকে না তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,”পাঁচ মিনিট শেষ হয়েছে। যাও।”

চলমান……