বসন্তপবনে প্রেমছন্দ পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
11

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৫.
টিকলি রুমে ঢুকেই ধুপধাপ শাড়ি খুলতে শুরু করলো। টায়রা, নিভা বিছানায় আধশোয়া হয়ে গল্প করছিলো। ওরা টিকলির এহেন কান্ড দেখে বড় বড় চোখ করে তাকালো। নিভা বললো,

‘আরে আরে… আমাদের সামনে খুলছিস কেনো? আমরা কি দেখতে চেয়েছি কিছু? যাকে দেখানো দরকার…..

নিভার কথার ফুলস্টপ হওয়ার আগেই টিকলি চোখ পাকিয়ে তাকালো। দাঁত চেপে বললো,

‘এই অবস্থায় আমার হাতে লাত্থি খেতে চাস না।’

নিভা বিরবির করে বলে, ‘হাত দিয়ে আবার লাত্থি কীভাবে মারে?’

টিকলি শাড়ি খুলে ছুড়ে মারলো টায়রার মুখের উপর। টায়রা রেগে বলে,

‘হোয়াট দ্যা হেল! বড় জা বলে যা ইচ্ছে তাই করবি?’

টিকলি এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। নিভা কিছু মনে পরেছে এমন ভঙ্গিতে বলে,

‘ওহ টিকলি… তোর জন্য একটা গিফট আছে।’

টিকলি কপাল কুঁচকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো। নিভা উঠে বাবু হয়ে বসলো। হাসি হাসি মুখ করে বলল,

‘এই এপার্টমেন্ট’টা আমি তোর নামে লিখে দিয়েছি।’

টিকলির মেজাজ খারাপ ছিলো। নিভার কথা শুনে মেজাজের পাদর’টা তরতর করে বেড়ে গেলো। টায়রা ধীর গতিতে হাত তালি দিয়ে বলে, ‘ওওওহো…..!’

টিকলি কপালে তিন-চারটা ভাঁজ ফেলে বলে, ‘কেনো?’

‘তোর বিয়ের গিফট।’

টিকলির চোয়াল শক্ত হলো, ‘বিয়ের গিফট মানে? তোর এপার্টমেন্টে থাকছি বলেই তুই আমাকে দিয়ে দিবি।’

টায়রা একটু অবাক হলো। নিভা জোরপূর্বক হাসলো, ‘এভাবে বলছিস কেনো?’

‘তো কীভাবে বলবো? এটা তোর বাবা-মা তোর বিয়েতে দিয়েছে। তুই আমাকে এটা দিয়ে কি বুঝাতে চাচ্ছিস? তোর অনেক টাকা? অনেক বাড়ি-ঘর? আমি মাগনা থাকছি বলে আমাকে দান করে দিবি?’

নিভা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘দান করে দিচ্ছি মানে? কথাগুলো ভেবে-চিন্তে বল, টিকলি।’

‘ভেবে-চিন্তে কি বলবো, হ্যাঁ? কার বিয়েতে দেখেছিস যে তার বান্ধবী তাকে এপার্টমেন্ট গিফট করে?’

‘আমি করেছি। এখানে এতো হার্শ হওয়ার কি আছে? আমি তো নিজের ইচ্ছায় দিয়েছি।’

টিকলি নিভার চোখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তোর বাবা-মার থেকে পারমিশন নিয়েছিস?’

নিভা একটু থামলো। পরক্ষণেই বলল, ‘বাবা-মার থেকে পারমিশন নিতে হবে কেনো? আমি আমার ফ্রেন্ডকে গিফট করতে পারি না?’

‘না, পারিস না। তুই এটা দিয়ে বুঝাতে চাইছিস আমার কিচ্ছু নেই। আমি তোর দয়ায় বেঁচে আছি। আমি এতোদিন এতো পরিশ্রম করেছি এটার জন্য নয়, নিভা। আমি পরিশ্রম করেছি নিজ থেকে অর্জনের জন্য।’

‘বেশ, অর্জন করবি। এটাও থাকবে। তোর নিজের পরিশ্রমে অর্জন করাটাও থাকবে।’

‘তোরটার আমার কোনো প্রয়োজন নেই।’

‘বেশি বেশি করছিস তুই। সবকিছু তোর কথামতো করতে হবে।’

টিকলি গলার স্বর দুই ধাপ চড়িয়ে ফেললো, ‘অবশ্যই। আমার ব্যাপারে আমার মতামত নিয়ে কাজ করতে হবে। তুই আমাকে এপার্টমেন্ট’টা কেনো লিখে দিবি? তোর এপার্টমেন্টে মাগনা থাকছি বলে? আমি ফ্রিতে থাকতে চেয়েছিলাম?’

‘তুই বারবার একই কথা বলছিস।’

টিকলি আর নিভার মাঝে আরো বেশকিছুক্ষণ তর্কাতর্কি হলো। টায়রা দুজনকে কিছুতেই থামাতে পারলো না। অবশেষে অবিশ্বাস্য অদ্ভুত চোখে টিকলির দিকে চেয়ে থেকে নিভা বেরিয়ে এলো। টায়রা নিভার পেছন পেছন ছুটলো। টিকলি বিছানায় বসে পরলো দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে। হাতের মুঠোয় চাদর মুচড়ে ধরলো।

নিভার পেছন পেছন টায়রা যেতে লাগলো। ড্রইংরুমের শেষ মাথায় গিয়ে নিভার হাত’টা চেপে ধরে বললো,

‘নিভা, প্লিজ রাগ করিস না। তুই তো জানতি টিকলি রাগ করবে। এসব ও পছন্দ করে না। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একটা গোল্ডের কিছু কিনে উপহার দেই? ও সাথে সাথে ভ্রু কুঁচকে তেজ নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুই মাসে কত টাকা ইনকাম করিস?’

নিভা রাগের ঝাঁঝে হাত’টা ছাড়িয়ে নিয়ে রাহুলের দিকে গেলো। রুদ্ধশ্বাসে বললো,

‘আমার শরীর খারাপ লাগছে। বাসায় যাবো।’

রাহুল হতবাক গলায় বলল, ‘শরীর খারাপ লাগছে মানে? বমি পাচ্ছে?’

‘হাঁসফাস লাগছে ভারী শাড়ি-গয়না পরে। এক্ষুণি চলুন এখান থেকে। এতো মানুষে দম বন্ধ লাগছে।’

রাহুল নিভাকে ধরে পাশে অসহায় চিত্তে দাঁড়ানো টায়রার দিকে তাকালো একবার। এরপর বললো, ‘ঠিকাছে, চলো।’

,
টিকলির এপার্টমেন্ট ফাঁকা হয়েছে মিনিট পাঁচেক হলো। সেই যে দরজায় দোর দিয়েছে খোলার নাম নেই। টায়রা সবাইকে যাচ্ছেতাই বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস মনোয়ারা খান আসেননি। তা নাহলে টিকলির এমন আচরণে সে বেশ মনঃক্ষুণ্ন হতো। আদর এসে টিকলির দরজার সামনে দাড়ালো। ওই ঘরে টায়রা-আর্দ্র। টায়রা অগোছালো ঘর-দোর গুছিয়ে দিচ্ছিলো। আদর দরজায় নক করতে গিয়ে দেখলো দরজা খোলা। অনুমতির প্রয়োজনবোধ না করে দরজা ঠেলে নিঃশব্দে প্রবেশ করলো। অন্ধকার আচ্ছন্নে ভরপুর ঘরের শুভ্র পর্দা বারান্দা থেকে আসা উড়নচণ্ডী হাওয়ায় দোল দিচ্ছে। চন্দ্রশোভার উজ্জ্বল ধূসর আলোয় আদর দেখতে পেলো টিকলি খাটের পাশে নিচে বসে আছে হাটুতে মাথা রেখে। মুখটা বারান্দার দিকে ঘুরানো। পড়নে শুধুমাত্র ফুল হাতা ব্লাউজ আর পেটিকোট। আদরের পা থমকে গেলো। হৃদযন্ত্র দ্রুত গতিতে লাফালো। ভারী পা দুটো কোনোমতে নড়িয়ে নিঃশব্দে দূরত্ব রেখে বসলো সে। টিকলি মাথা না তুলেই প্রশ্ন করলো,

‘ওরা সবাই মাত্র চলে গেলো?’
‘হু।’
‘আপনি কি এখনি চলে যাবেন?’
‘হুম।’
‘আপনার বাবা-মা জিজ্ঞেস করবে না কিছু?’
‘হসপিটালে যাবো।’
‘ছুটি নেননি?’
আদর হাসলো। বললো, ‘ছুটি নিয়ে কি করবো?’
‘এই পোশাকেই যাবেন?’
‘না। আর্দ্র কাপড় এনেছে। পাল্টে যাবো।’
‘হসপিটালে ঘুমাবেন কোথায়?’
‘রেস্ট রুমে।’
‘নিভাও মাত্র চলে গেলো?’
‘না, অনেকক্ষণ আগে গিয়েছে। রাহুল বললো ওর নাকি শরীর খারাপ লাগছিলো।’
টিকলি উত্তর দেয় না। আদর টিকলির দিকে তাকালো না। তবুও ওর ভারী শ্বাসের শব্দ টিকলি অনুভব করলো। আদর প্রশ্ন করে,

‘কি হয়েছে আপনার?’
টিকলি মাথা নাড়ায়, ‘কিছু না।’
‘কিছুই না?’
‘আমি একটু বেশি বেশি করি।’
‘বুঝেন যখন তখন করেন কেনো?’
‘যখন করি তখন বুঝতে পারি না।’
‘সবার ক্ষেত্রেই এমন’টা হয়।’
‘আমার রাগ বেশি।’
‘এটাতে সহমত।’
টিকলি মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। ফর্সা উদরের উন্মুক্ত অংশে দৃষ্টি দিয়েও চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো আদর। বলল,
‘আজ বাসর রাত।’
‘হুম।’
‘বাসর রাতে বউকে কিছু উপহার দিতে হয়।’
‘আপনার না দিলেও চলবে। উপহার জিনিসটা আমি পছন্দ করি না।’
‘না দিলে সারাজীবন আপনি আমাকে খোটা দিবেন বিয়ের রাতে আপনাকে একটা সুতো পর্যন্ত দেইনি। এমনিতেই কিপ্টে তকমা লাগিয়েছেন।’

টিকলি শব্দবিহীন হাসলো। আদর শেরওয়ানির পকেট থেকে সেই স্বর্ণের চওড়া টিকলি বের করলো। টিকলি দেখে চিনতে পারলো। কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘দামী উপহারে আমার এলার্জি রয়েছে।’
‘একবার নাহয় নিলেন। ভবিষ্যতে নাতী-নাতনীদের বলতে পারবেন তোর দাদু বিয়ের রাতে আমাকে ইয়া বড় একটা টিকলি উপহার দিয়েছিলো কারণ আমার নাম টিকলি ছিলো।’

টিকলি আদরের দিকে চেয়ে হাসে। মন খারাপটা বসন্তের শেষ পবনের সাথে মিলিয়ে যেতে লাগলো,

‘আমার ভবিষ্যত নাতী-নাতনীর দাদুরই উচিত তাহলে এটা আমাকে পড়িয়ে দেওয়া।’

‘উচিত?’

টিকলি ঘুরে বসলো আদরের দিকে। মাথা এগিয়ে দিলো। ঝাপসা অন্ধকারে আদর টিকলির কপালে টিকলি পরিয়ে দিলো। রুপোলী আলোয় কপালটা ঝিকঝিক করলো। টিকলি হাসলো। ধরে দেখলো। আদর মুগ্ধ দৃষ্টিতে টিকলির দিকে চেয়ে রইলো। এ দৃশ্য দেখার জন্য ভীষণ তৎপর ছিলো সে। টিকলি কপাল থেকে টিকলি’টা খুলে আদরের হাতে দিয়ে বলল,

‘আপনার কাছে রেখে দিন। নাতী-নাতনী হলে চেয়ে নিবো।’

আদর কি বুঝলো কথাটা? তা নাহলে মাথা দুলিয়ে মেনে নিলো যে!

‘শাড়ি টাড়ি খুলে এই অবস্থা কেনো আপনার? আমাকে সিডিউস করার ধান্দা?’

টিকলি চোখ পিটপিট করে তাকায়, ‘আমাকে দেখে আপনি সিডিউস হচ্ছেন?’

‘একদম না। ডাক্তাররা মানুষের দেহ দেখে অভ্যস্ত। তারা যখন তখন সিডিউস হয়ে যায় না!’

টিকলি হতাশ গলায় বলল, ‘তবে তো আপনি অনুভূতিহীন।’

আর্দ্র-টায়রা চলে গিয়েছে। আদর কথা বাড়ালো না। এই দমবন্ধ ঘর থেকে দ্রুত উঠে চলে যেতে চাইলো। টিকলি পেছন থেকে বললো,

‘আপনি আজ এখানেই থাকুন। পাশের ঘরে।’

আদর উত্তর করলো না। পাশের ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় পাল্টে কপালে হাত রেখে চুপচাপ শুয়ে পরলো। অথচ চোখে এক ফোঁটা ঘুম ধরা দিলো না। এ ঘরে টিকলি বসে রইলো একইভাবে চাঁদের দিকে চেয়ে। সে জানে, তার দিকে এক নজরও পরিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে দেখেনি আদর। দেখলে হয়তো কোনোদিন ও ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরতে পারতো না।

চলবে❤️

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৬.
এরপরে চারদিন কারোর কোনো খোঁজ রইলো না। বৈশাখ পার হলো। কালবৈশাখী ঝড় এলো গেলো। কাঁচা, সবুজ মুকুল আম মাটিতে লুটোপুটি খেলো। ছেলেপেলেরা হৈহৈ করে তা কুড়িয়ে নিলো। জারুল গাছে ফুল এলো। গ্রীষ্মের তীব্র গরম ছুটলো। আঠালো গরমে তপ্ত পিচঢালা রাস্তায় চোখের উপর এক হাত রেখে ঘেমে নেয়ে একাকার হওয়া টিকলি চোখ মুখ কুচকে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো।

‘হ্যাঁ বলো, মা।’
‘এলি না তো?’
‘একটু ব্যস্ত আছি, মা।’
‘কতই ব্যস্ত থাকিস তুই? তোকে বিয়ের পরেরদিন থেকে বলছি জামাইকে নিয়ে একবার এসে ঘুরে যেতে। এতো জেদ তোর! তোর বাবা কত আশা নিয়ে বসে আছে! তুই এলে টায়রাও আসবে নয়তো আসবে না।’
‘আচ্ছা, মা। আমি দেখছি আজ যাওয়া যায় কিনা।’

ফোন কেটে গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকলি তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। একটা রিক্সা ডেকে উঠে বসলো। সেইদিন ভোর রাতে ঘুমানোর ফলে খুব বেলা করে ঘুম থেকে জাগলো টিকলি। উঠে দেখলো আদর চলে গিয়েছে। সেই বৈশাখের প্রথম দিনের পরে তাদের আর সাক্ষাৎ হয়নি। কথা হয়নি। বাবা-মা সেদিন থেকেই নতুন জামাই নিয়ে গিয়ে একবার ঘুরে আসতে বলছে। কাজের দোহাই দিয়ে সেদিকে আর এই কয়দিন পাত্তা দেয়নি টিকলি। রিক্সা শাহবাগের মোড় ছাড়িয়েছে। টিকলি আদরকে ফোন লাগালো।

অসময়ে অপ্রত্যাশিত মানুষের কাছ থেকে বার্তাহীন ফোনের ডাক শুনে আদর চমকে উঠলো। রোগীর কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে বাইরে এসে ফোন ধরতেই অপরপাশ থেকে কুশলাদি বিনিময় ছাড়াই হড়বড় করে বলে গেলো,

‘একটা ফেভার করেন প্লিজ। আমাদের বাসায় যেতে হবে আউট অফ ফর্মালিটি।’

আদর মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কবে?’

‘আজ গেলে সবথেকে ভালো হয়। নয়তো মা আমার মাথাটা চিবিয়ে খাবে।’

‘কখন?’

‘আপনি কখন ফ্রি থাকছেন?’

‘আপনার আমাকে কখন দরকার?’

‘রাত আট’টার মধ্যে হলে ভালো হয়।’

‘ওকে দেখছি।’

‘ধন্যবাদ।’ বলে টিকলি ফোন কাটলো।

,
বিয়ের পর এই প্রথম টায়রা বাপের বাড়িতে যাচ্ছে। যে কারণে যাওয়া হয়নি সেই উদ্দেশ্য অবশ্য হাসিল হয়েছে। টায়রা মিটিমিটি হাসলো। আর্দ্রকে বললো,

‘ফোন করুন না একবার ওদের!’

‘করেছিলাম। ভাইয়া মাত্র হসপিটাল থেকে বের হলো। টিকলিকে ওর অফিসের সামনে থেকে পিক করে নিবে।’

টায়রা, আর্দ্র বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো বাড়ির ভেতরটা ফুল দিয়ে সাজানো। বাইরে ছেড়ে বাড়ির ভেতরে লাইটিং করা। টায়রা হেসে লুটিয়ে পরলো। জিজ্ঞেস করলো না এইসবের কারণ কি! কারণ’টা সবার জানা দুই জামাই প্রথমবার এই বাড়িতে পা রাখবে আয়োজনে কমতি করলে চলবে নাকি? জামিলুর রেজা, শায়লা আক্তার জামাই আদরে সত্যি কোনো কমতি রাখলেন না। হরেক রকমের জামাই ভোজের সাথে জামাইদের জন্য নতুন কাপড়চোপড় সহ বেশ কিছু উপহারও বরাদ্দ করে রেখেছেন। দুই মেয়ের দুই ঘর ঝেড়ে মুছে চকচকে করে নতুন বিছানার চাদরও বিছিয়েছেন।

এরপ্রায় আধ ঘণ্টা খানেক বাদে আদর-টিকলি এলো। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই ভ্রু খানিক বেঁকে গেলো টিকলির। মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘রাহুল ভাইয়া আর নিভাকে বলোনি?’

‘বলেছি তো। নিভার নাকি শরীর ভালো যাচ্ছে না। তাই এলো না।’

বক্র ভ্রু খানা নিয়েই টিকলি আদরের দিকে ঘুরে নিষ্পাপ কণ্ঠে শুধালো, ‘আপনার গাড়ির চাবি’টা দেওয়া যাবে?’

আদর বুঝে উঠলো না। অবুঝ সুরে প্রশ্ন করলো, ‘হু?’

‘গাড়ির.. চাবি?’ আদরের হাতে ধরে থাকা চাবির দিকে ইশারা করে বললো টিকলি।

‘কেনো?’

আদরের হাত থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে বলতে থাকলো টিকলি,

‘দিন ভাই। খেয়ে ফেলবো না।’

বলেই চাবি নিয়ে পগারপার।

,
রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। চিকেনের গন্ধে ম ম করছে সারা ঘর। ভ্যাপসা গরমে নিভার অস্বস্থি হচ্ছে ভীষণ। রান্নাঘর থেকেই রাহুল ডেকে উঠলো,

‘নিভা, কিছু খাবেন?’

‘হুম। আইসক্রিম।’

‘যদি ঠান্ডা লাগে?’

এপাশ থেকে আর কোনো উত্তর আসে না। রাহুল আইসক্রিমের বক্স’টা নিভার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

‘অল্প খাবেন। বেশি খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে।’

নিভা বিরস মুখে আইসক্রিমের বাটি হাতে নিয়ে খেতে লাগলো। রাহুল নিভার পাশে বসে। বলে,

‘চিকেন পাস্তায় ঝাল বেশি দিবো নাকি কম?’

‘মাঝামাঝি।’

‘এতো মনমরা হয়ে আছেন কেনো বলুন তো? ফুপি ফোন দিয়ে যেতে বললো। তাও গেলেন না। সবার সাথে দেখা হলে ভালো লাগতো। টিকলির বিয়ের দিন থেকে কি হয়েছে আপনার? জ্বলন্ত নিভা হঠাৎ নামের অর্থ পূর্ণ করে নিভন্ত নিভা কীভাবে হলো?’

নিভা সে কথারও উত্তর দিলো না। শুধু আইসক্রিম ভরা মুখে রাহুলের দিকে ঘুরে একটু হাসি দিলো। ওদের ফ্রেন্ডশিপের একটা অপ্রকাশিত রুলস হলো কারোর সাথে কারোর কিছু হলে অন্য কাউকে বলে বেড়ানো হয় না। এরজন্য রাহুল ঠাওর করে হাজারবার জিজ্ঞেস করলেও নিভা চুপ থেকে মুচকি হাসি উপহার দিয়েছে।

রাহুল ওর বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে বউয়ের ঠোঁটে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছিয়ে দিয়ে নির্লজ্জের মতো শুধোয়,

‘চুমু খাবেন একটা?’

নিভা হেসে লুটোপুটি খায়। মাথা নাড়িয়ে না করে। রাহুলও হাসে বলে, ‘খান একটা! খেলে মন ভালো হবে।’

‘আপনার পাস্তা পুড়ে যাচ্ছে।’

সত্যি পোড়া পোড়া গন্ধ বের হয়েছে। রাহুল দৌড়ে গেলো। যেতে যেতে বলল, ‘আর এক চামচও খাবেন না।’

নিভা পর পর দুই চামচ আইসক্রিম মুখে পুরলো। মুখটা তেঁতো হয়ে আছে। মন মেজাজ বিচ্ছিরি! বিছানা কাঁপিয়ে ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। নিভা চেয়ে দেখলো না। টায়রা আজ শতবার ফোন করেছে ওই বাড়ি যাওয়ার জন্য। নিভা একদম যাবে না। কেনো যাবে সে? নিভা দেখেছে টিকলি সবসময় ওমন করে। সবসময় ওর মর্জি মতো চলতে হবে? আরো কারোর মতামতের গুরুত্ব নেই? সব বিষয় এই মেয়ে জটিল বানাবে শুধু!

ওইসময় কলিং বেল বেজে উঠলো। রাহুল গিয়ে দরজা খুললো। নিভা উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকার কালের ওর ঘরে পদার্পণ ঘটলো বিশিষ্ট ইগোওয়ালা মেয়েটার। নিভা চোখ ফিরিয়ে থমথমে মুখে বসে রইলো। রাহুল জিজ্ঞেস করলো,

‘কিরে? এই সময়ে তুই এখানে কেনো?’

টিকলির ত্যাড়া উত্তর, ‘কেনো? তোমার খুব সমস্যা হয়ে গেলো মনে হয়?’

রাহুল আমতা-আমতা করে কিছু বলতে চেয়েও এই কথার পৃষ্ঠে কিছু খুঁজে না পেয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। টিকলি এসেই নিভার কাবার্ড থেকে জামা-কাপড় বের করতে করতে বললো,

‘কেউ যেনো আর গাল ফুলিয়ে না থাকে।’

নিভার থেকে কোনো প্রতিত্তর এলো না। টিকলি থেমে দরজা’টা চাপিয়ে দিয়ে এসে নিভার সামনে মেঝেতে বসলো। ওর কোলে মাথা রেখে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

‘মামণি সরি মাম্মামকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। তোমার মাম্মা কে বলো মামণি’কে এইবারের জন্য স্পেয়ার করতে।’

নিভা পেটের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘বাবু, তোমার মামণি কে বলে দাও সরি এক্সেপ্টেড হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত গিফট এক্সেপ্টেড না হয়।’

টিকলি কপাল কুচকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো। বলল, ‘তোর ভীষণ জেদ!’

‘তোর আরো বেশি।’

‘ওকে। গিফট এক্সেপ্টেড হবে একটা শর্তে। তা হলো বাবু হওয়ার সময় তার মামণির তরফ থেকে তাকে এটা গিফট করে দেওয়া হবে।’

টিকলি হলো ঝড়ের মুখে স্থির আলোর ন্যায়। অভেদ্য মনুষ্য ছা একটা! নিভা কপাল কুচকে বলল,

‘তোর মতো ইস্পাতের ন্যায় কঠিন মনের মানুষ আমি আর দুটো দেখিনি।’

‘আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখ। এবার রেডি হ।’

দরজার ওপাশ থেকে তখন রাহুলের কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘এই দরজা বন্ধ করে কি করছিস তুই?’

টিকলি অতিষ্ঠ নয়নে তাকায় নিভার দিকে। উঁচু আওয়াজে বলে,

‘ইয়া আল্লাহ! তোমার বউকে খেয়ে ফেলছি না ভাই!’

বলে নিভাকে তাড়া দিলো, ‘রেডি হ তাড়াতাড়ি। সবাই না খেয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।’

নিভা রেডি হতে গেলো। রাহুল’কে দুই মিনিট পরিপূর্ণ ভাবে সময় দেওয়া হলো না। পরিপাটি হয়ে রেডি হওয়া তো দূরে থাক। রাহুলের বানানো পাস্তা কি আর নিভা ফেলে যাবে! বক্সে ভরে বগলদাবা করে তাও নিয়ে নিলো। গাড়িতে যেতে যেতে তিনজনে মিলে সাবাড় করলো। পৌঁছে সবাই একসাথে ডাইনিং এ বসে হাস্যালাপের কলধ্বনিতে মেতে উঠলো। শুধু অস্বস্থি নিয়ে বসে রইলো আদর। জামিলুর রেজার দিকে তাকালেই আদরের ভেতর’টা অপ্রকৃতস্থতায় জর্জরিত হয়ে পরে।

চলবে❤️

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৭.
বৈশাখ পেরিয়ে জৈষ্ঠ্যমাস এসেছে। আদরের সাথে শেষ দেখার দিন গিয়ে ঠেকেছে মাস খানেকে। এরমধ্যে একবার মনোয়ারা খান এসেছিলেন বার্তাহীন। দরজা খুলেই টিকলি হতভম্ব হয়ে মিনিট খানেক চেয়ে রইলো। এরপর একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলো। তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে টিকলি নিজের দিকে তাকালো। গায়ে ছেড়া, ফাঁটা একটা গেঞ্জি। যে গেঞ্জিতে হলুদের দাগ লেগে আছে। বাসার ন্যাকড়া বানানোর উপযুক্তও নয়। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন স্ন্যাকসের কাগজ। শোবার ঘরটায় কাপড়-চোপড় এলোমেলো। টিকলি সব কাপড় জড় করে ঠেলে আলমারিতে ঢুকালো। ড্রইংরুমের মেঝে’টা কোনোরকমে পরিষ্কার করে টিভি অফ করলো। গায়ের গেঞ্জি’টা খুলে ঝটপট একটা কুর্তি পরে ছয় মিনিটের মাথায় গিয়ে আবার দরজা খুললো।

মনোয়ারা খান আশ্চর্য হয়ে ভেতরে পা রাখলেন। ঘরদোরের হাল দেখে মুচকি হাসলেন। টিকলি সালাম দিয়ে ইতস্তত মুখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সোফা দেখিয়ে বলে,

‘বসুন, আন্টি।’

মনোয়ারা খান বসলেন। ঘুরে ঘুরে সব তাকিয়ে দেখলেন হাসিমুখে।

‘আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি, আন্টি।’

টিকলির চুল হয়ে আছে কাকের বাসা। ঠোঁটের পাশে লেগে আছে চিপসের গুড়ো। দৌড়ে চলে যেতে নিলেই মনোয়ারা খান তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিলেন। এ নিয়ে টিকলির সাথে তার মুখোমুখি দ্বিতীয়বার দেখা। টিকলি-আদরের প্রেমের সময়’টায় তিনি যেচে প্রথমবার দেখা করে টিকলিকে আদরের জীবন থেকে সরে যেতে বলেছিলেন। এই আবার নিজেই যেচে বড় ছেলের বউয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। মনোয়ারা খান টিকলির থুতনি ধরে শুধালেন,

‘তুমি আমার উপর রেগে আছো, মা?’

টিকলি জোরপূর্বক হাসে, ‘না তো।’

‘সত্যি?’

‘জি, আন্টি।’

‘তবে, মা না ডেকে আন্টি কেনো ডাকছো বারবার? আমি তোমার আরেকটা মা হই না?’

টিকলি চোখ তুলে তাকালো। সৌজন্যে হেসে ডাকলো, ‘ঠিকাছে। মা।’

মনোয়ারা খান ওর কপালে চুমু খেলেন। বললেন,

‘ভাগ্যিস না বলে এলাম। তা নাহলে তো আমার আসল বউমা’টা দেখাই হতো না।’

টিকলি লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে বলে, ‘আমি এমনিতে ম্যাসি পারসন না আসলে ছুটির দিন ছিলো তাই… ভাবছিলাম পরে পরিষ্কার করে নিবো… ঘরে কেউ থাকে না বলে গেঞ্জি পরি… হঠাৎ আপনি এসে পরেছিলেন বলে দরজা অটোমেটিক লাগিয়ে ফেলেছি। ইচ্ছে করে নয়।’

টিকলি কথা জড়িয়ে ফেললো। মনোয়ারা খান জোরে জোরে হেসে টিকলিকে বুকে টেনে নিলেন। টিকলি ভদ্র বাচ্চাটির ন্যায় তার বুকে পরে রইলো। বলল,

‘সরি, মা।’

‘সমস্যা নেই। আমি তোমার জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছি। তোমার কি পছন্দ তা তো জানি না। টায়রা যা বললো তাই নিয়ে এসেছি।’

এতে টিকলি কৃতজ্ঞে গলে গেলো। মনোয়ারা খানের সাথে একসাথে রাতের খাবারটা খেলো। অনেকক্ষণ গল্পগুজব শেষে রাত নয়টার দিকে মনোয়ারা খান চলে যেতে চাইলে টিকলি বলে,

‘এতো রাতে… থেকে যান?’

‘না, তোমার শশুড় রাগ করবে।’

‘তাহলে আমি পৌঁছে দিয়ে আসি?’

মনোয়ারা খান হাসেন, ‘নিচে আর্দ্র দাঁড়িয়ে আছে।’

‘ভাইয়া উপরে এলো না কেনো?’

‘কোর্ট থেকে আসার পথে আমাকে নিতে এসেছে। টায়ার্ড হয়তো। আসি মা?’

টিকলি মাথা নেড়ে সায় জানায়। ঠোঁট উল্টে বলে, ‘আবার কবে আসবেন? এরপরের বার থেকে যেতে হবে কিন্তু!’

মনোয়ারা খান জবাবে বললেন, ‘তুমি কবে যাবে? তুমি গেলেই তো হয়ে যায় মা! তিন বউ শাশুড়ি মিলে ওই তিন বেটাকে এমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরবো না…!

প্রতিত্তরে টিকলি মিষ্টি করে হাসি দিলো। মনোয়ারা খানের প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না।

সেইদিনের কথা মনে পরে টিকলি তাচ্ছিল্য হাসলো। কবে যাবে? কার জন্যে যাবে? যার জন্যে যাবে সে মাস খানেক হতে চললো টিকলির কোনো খোঁজ নেয় না। একটা সিংগেল মেসেজ পর্যন্ত করেনি। টিকলি যদি মরেও যায় ওর জানাজা পড়তে আসার সময়টুকুও হবে না বোধহয়। টিকলির রাগ নির্বাপিত হলো কলিং বেলের উপর। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো রাত এগারোটা বাজে। এতো রাতে কে এলো? টিকলি একবার মনে করার চেষ্টা করলো। না, টায়রা-আর্দ্রর আসার কথা নয়। ওদের সাথে আজ বিকালেই দেখা হয়েছে। নিভার প্রেগ্ন্যাসির জন্য এতো রাতে রাহুল কক্ষনো এলাও করবে না। তবে? নিরব? ডাঃ আরাফ?

নামটা মনে হতেই টিকলি নিজের মাথায় চাটি মারলো। অকস্মাৎ ডাঃ আরাফের নাম মাথায় এলো কেনো? কলিংবেল বিরতিহীন বেজে যাচ্ছে। টিকলি হাতে ঝাড়ু নিয়ে আস্তে করে উঠে দরজার পিপহোল দিয়ে দেখে আদর। টিকলি বিস্ময় নিয়ে দরজা খুললো। আদর জুতো খুলতে খুলতে মাত্রই বলতে যাচ্ছিলো,

‘দরজা খুলতে এতো সময় লাগে…

বলতে বলতে মাথা তুলে টিকলির হাতে ঝাড়ু দেখে ভ্রু কু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

‘এতো রাতে এসেছি বলে ঝাড়ু পেটা করবেন নাকি?’

টিকলি বিরবির করে বলে, ‘দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বর তাকে আমি ঝাড়ু পেটা করতে পারি? এতে তো ঝাড়ুর-ই অপমান হবে।’

আদর ঠিক শুনতে পায়নি, ‘সরি, কার অপমান হবে?’

টিকলি ক্লান্ত শ্বাস ফেলে ভেতরের ঘরে যেতে যেতে বলে, ‘দরজা ঠিকভাবে লক করে আসুন।’

,
আদর-টিকলি মুখোমুখি বসে আছে। আদর সোফায় বসে টিভির দিকে মনোযোগ রেখেছে। টিকলি বুকে হাত ভাঁজ করে কাউচে বসে আদরের দিকে সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে আছে।

আদর একটু বিরক্তি নিয়ে এবার জিজ্ঞেস করলো,

‘আর কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবেন? আপনার বাসায় খাবার নেই? গেস্ট এলে খাবার দিতে হয় জানেন না?’

টিকলি বিনাবাক্যে উঠে গিয়ে আদরের জন্য খাবার নিয়ে এলো। খিচুড়ি রান্না করেছিলো। সাথে একটা ডিম ভাজি আর লেবু কেটে এনে দিলো। একপাশে একটু আচারও দিলো। আদর তৃপ্তি নিয়ে চেটেপুটে খেলো। টিকলি তৃপ্ত নয়নে তা চেয়ে চেয়ে দেখলো। খেতে খেতে আদর এবার মুখ খুললো,

‘আমাকে দশদিনের জন্য খুলনা যেতে হবে।’

‘কবে?’

‘কাল।’

টিকলি বড় করে শ্বাস ফেলে কাউচে হেলান দিয়ে বলল,

‘তো? দশদিন আর এমন কি? একমাসে যখন কোনো খোঁজ-খবর নেই।’

আদর বললো না, ‘আপনি বোধহয় খুব খোঁজ নিয়েছেন!’ বরং দোষ’টা নিজের ঘাড়ে নিয়ে বলল,

‘সময় পাইনি।’

টিকলি অতিষ্ঠ চোখে তাকালো। গলার স্বর তিন ধাপ উচুঁতে তুলে বলল,

‘সময় পাননি, সময় নেই, আপনার সময়ের অভাব। এই আপনার সময় নেই কথা শুনতে শুনতে আমি ত্যক্তবিরক্ত। আমি মরলে তো আপনি আমাকে এক মুঠো মাটি দেওয়ার জন্যও সময় পাবেন না।’

আদর ডানে বামে মাথা ঝাঁকালো, ‘এটা একটা মিথ্যা কথা!’

টিকলি ভয়ানক চোখে তাকায়। আগুন গরম চোখে আদরের দিকে তাকিয়ে থাকার কালে আদরের খাওয়া শেষ হলো। হাত ধুয়ে এসে ধীর গলায় বলল,

‘আমি আজ এখানে থাকতে পারি?’

সেইমুহূর্তে টিকলির রাগ’টা বরফ গলা পানির ন্যায় গলে বেয়ে নদী হলো। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গেলো দশ বারোদিন প্রচন্ড তাপদাহ ছিলো। নিউজে দেখালো ঘূর্ণিঝড় তমুক আসছে। বজ্রপাতের ঝিলিকে চারপাশ আলোকিত হতে না হতেই লোডশেডিং হলো। ওরা দুজন চমকালো না। টিকলি কেবল মৃদু আওয়াজে শুধালো,

‘কেনো?’

‘এমনি। থাকতে ইচ্ছে হলো।’

টিকলি রুদ্ধশ্বাসে বলে, ‘থাকুন।’

‘থ্যাঙ্কিউ।’ বলে আদর পাশের ঘরটায় চলে যাচ্ছিলো। টিকলি ডেকে উঠলো। আদর পেছন দিকে ফিরে তাকালো। টিকলি থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি কি আমায় কিছু বলতে চান?’

আদর তড়িৎ বেগে মাথা নাড়ালো, ‘না। গুড নাইট।’

বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। দুনিয়া আলোকিত করে দেওয়া সেই আগুন গোলার শব্দে টিকলির বুকের স্পন্দনের শব্দ পাল্লা দিয়ে বেড়ে চললো। টিকলি নিজের ঘরের বিছানায় ঠেস দিয়ে মেঝেতে বসে বারান্দা গলিয়ে আকাশের ঝিলিক দিয়ে চির হয়ে যাওয়া দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে তার চোখ দুটো ভরে উঠলো। এরপর হাটুতে মুখ ঢেকে ঠুকরে কেঁদেই উঠলো।

এই রাতের আলো-আধাঁরের ধাধানো জ্বলকানিতে আদর কি পারতো না টিকলিকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে সরি বলতে? একটা বার অনুতপ্ত হলে… একটা বার টিকলিকে সরি বললে টিকলি সব ভুলে যেতো। বক্ষস্থলে আকড়ে ধরতো আদরকে। টিকলির উরঃস্থলে যে একটা আদর থেকেও নেই বলে বড্ড অভাব! বড়ো তৃষ্ণা!

চলবে❤️