#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩
৫.
ঘরে ঢুকে টিকলি হাতের ব্যাগ’টা ছুড়ে মারলো সোফায়। এপার্টমেন্ট’টা নিভার। নিভার বাবা-মা তার বিয়েতে উপহার হিসেবে দিয়েছে। এরপর নিভা বেস্টফ্রেন্ডকে উপহার হিসেবে থাকতে দিলো। এতোবড় এপার্টমেন্ট! মেঝে থেকে শুরু করে দেয়াল অবধি ঝাঁ তকতকে সুন্দর। ঘরের আনাচে-কানাচে শৌখিনতা, রুচিশীলতায় ভরপুর। টিকলি কাপড় ছাড়লো না। ফ্রেশ হলো না। পায়ের জুতা’টা খুলেই শুভ্র কাউচে শুয়ে পরলো। উপরের সিলিং’টার দিকে বহুক্ষণ বোধহীনের ন্যায় চেয়ে রইলো।
বিয়েটা করে যখন সে আদরের রাজ্যে রানী হয়ে পা ফেললো না তখন আর বাবার আদরের রাজকন্যা’টি হয়েও ঘরে ফিরলো না। তারা ছয়জন একসাথে পালিয়েছিলো। টিকলি, টায়রা দুই বোন আদর, আর্দ্র এই দুই ভাইয়ের সাথে। সাথে ছিলো মামাতো ভাই রাহুল। রুহুল হকের একমাত্র ছেলে। সেও পালালো ওদের বেস্টফ্রেন্ড নিভাকে নিয়ে। অনেকটা ঝড়ে বক মরার মতো। নিভা রাহুলকে পছন্দ করতো তা সবাই জানে। কিন্তু ওদের মধ্যে পালিয়ে বিয়ে করার মতো সম্পর্ক কোনোদিন তৈরি হয়নি। ওদের দুজনের বিয়ে করা তো দূরে থাক দুজন দুজনকে চিনেছেই তো হাতে গোনা কয়েকদিনে। টিকলি জানে, রাহুল টিকে আছে নিভার স্নিগ্ধতার টানে। ওর কোমল, তুলতুলে, মোলায়েম মন’টাকে নিয়ে রাহুল বেঁচে আছে। টিকলি এও জানে, রাহুল টিকলিকে ভুলেনি। যদি সত্যি ভুলতে পারতো, তবে এতোদিনে টিকলিও আদরকে ভুলে যেতো। যাক গে, সে সব বহু কাহিনি। ওসব টিকলি মনেও আনতে চায় না।
টিকলির মামা রুহুল হকের ছেলের বিয়েতে কোনো অমত ছিলো না। ছেলে যাকেই বিয়ে করুক ছেলে তার সুখী হোক। মা মরা ছেলে তার। সৎ মায়ের জ্বালায় এ জীবনে বহু কষ্ট করেছে। জীবনের অর্ধেক’টা সময়ের বেশি বাবা ছাড়া থেকেছে। ছেলের বিয়ের পর ছেলেকে তিনি একটি জমকালো নতুন ফ্ল্যাট উপহার দিলেন। বউ নিয়ে কোথায় থাকবে তা ভাবার আর প্রয়োজন নেই বিধায় রাহুল উপহার’টি সাদরে গ্রহণ করলো। এরমাঝে টিকলি একটি জীর্ণশীর্ণ ছাত্রী মেসে উঠলো। কিন্তু তার হাতে একটা টাকা পয়সা কিংবা এক সেট কাপড় অবধি ছিলো না। পরিচিত এক বান্ধবীর থেকে টাকা ধার করলো। তাতে বাধলো আরেক বিপত্তি, সেই বান্ধবী গিয়ে বলে দিলো নিভাকে। নিভা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। কাজেই প্রথম দিকে না মানলেও দিন পনেরো যেতেই আদরের মেয়েকে আদরের সহিত বুকে টেনে নিয়ে মেয়ের জন্য এ জীবনে যা কিছু জমিয়েছে তা বুঝিয়ে দিলেন। ব্যস! এরপর নিভার জোরাজুরিতে টিকলির দিন এতো আরাম-আয়েশে কাটছে। নিভা-ই খোঁজ’টা দিয়েছিলো নিরবের থেকে এই ইভেন্ট কোম্পানির। কথা বলা থেকে শুরু করে টিকলির সিভি ড্রপ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকও করেছে নিভা। নিভার নামখানা নিভা হলেও টিকলি নতুন জীবনের ‘জ্বলন্ত প্রদীপ’ সে।
টিকলি, টায়রা, নিভা পড়ছে গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে। থার্ড ইয়ারের শুরুর দিকে টিকলি একটা ইভেন্ট ফার্মে ৩ মাসের ইন্টার্নশিপ করেছে। তার সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, ডিজাইন, ভিজ্যুয়াল আর্ট, স্টোরিটেলিং সম্পর্কে ভালো আইডিয়া রয়েছে। মূলত ফার্স্ট ইয়ার থেকেই নিজের স্কিল ডেভেলপ করে গেছে।
টিকলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিলিং থেকে চোখ সরালো। রান্না করার ভেজাল নেই। ইভেন্ট থেকেই খেয়ে ফিরেছে। টিকলি উঠে বসে কাউচে এক পা তুললো। গলার স্কাফ খুলে ছুড়ে মারলো। ফ্রিজ থেকে একটা কোল্ড-ড্রিংকস বের করে আয়েশি ভঙ্গিতে চুমুক দিতে দিতে ফোনের নিউজফিড স্কল করতেই চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো।
আরাফ আর টিকলির ছবি কিছু সনামধন্য নিউজ চ্যানেলের পেজ থেকে পোস্ট হয়েছে। একেকজনের রংঢং মেশানো হরেকরকমের ক্যাপশন তাতে,
‘বাংলাদেশের গৌরব, মেধাবী ডাঃ আরাফ হোসেনের বুকে কে এই রহস্যময়ী নারী?’
‘৩৩ বছর বয়সী ডাঃ আরাফের বুকে পরলো এক তরুণী।’
‘তরুণ প্রজন্মের ক্রাশ অবিবাহিত ডাঃ আরাফের পায়ে লেগে শাড়ি খুলে গেলো এক যুবতীর।’
‘ডাঃ আরাফের কাছে ভোগান্তির শিকার কে এই মিষ্টি বালিকা?’
টিকলি টায়ার্ড হয়ে গেলো ক্যাপশনের ছ’টায়। মুখ হামলিয়ে পোশাক পালটে একটা ঢিলেঢালা গেঞ্জি পরলো। গেঞ্জির কাধে দু তিনটে ফোটা। একটা কালো রঙ্গের প্লাজু পরে সে ল্যাপটপ অন করে সিরিজ দেখতে বসলো। ১৬ টা এপিসোড। ৭ টা দেখেছে। এখন অবধি কাহিনীতে কোনো ইন্টারেস্ট-ই পাচ্ছে না। কিন্তু ইন্টারেস্ট পেলো নয় পর্ব থেকে। সারা রাত সিরিজ দেখে সকালে চোখের নিচে কালি ফেলে ঘুমোতে গেলো অথচ পরশুদিন ওর পরীক্ষা।
৬.
ভোরের ওই অরুণ বর্ণের রোদ’টা টায়রাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো। ফজরের আজান পেরিয়েছে মিনিট চল্লিশ হয়েছে। টায়রা এই ফাল্গুনের মিঠে পবনে রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে টিকলির পাঠানো লিংকে ঢুকে সবগুলো নিউজ পোর্টালের ক্যাপশনগুলো পড়ে হাসছিলো। একটা ছবিতে এসে ওর চোখদুটো থমকে দাঁড়ালো। যেখানে টিকলি’কে ডাঃ আরাফ ধরে আছে। আর আদর ভ্রু কুচকে, হতভম্ব, অগ্নিদৃষ্টিতে আরাফের দিকে চেয়ে আছে। টায়রা জুম করে ছবিটা দেখে বসন্তের প্রভাতের ন্যায় মুচকি হেসে ছবিটায় হাত ছু্ঁয়ালো। ওইসময় আর্দ্র এসে দাড়ালো বারান্দার দরজায়। টায়রা সেদিকে না তাকিয়েই বলে,
‘এই ভাদ্র, এদিকে আসুন। দেখে যান।’
আর্দ্র পা বাড়ায়। থমথমে মুখে বলে,
‘স্বামীকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়, ফুঁটা টায়ার।’
টায়রা আড়চোখে তাকিয়ে বলে, ‘বউকে বুঝি সম্মান দিতে হয় না?’
আর্দ্র টায়রাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ রেখে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বলে,
‘অবশ্যই। আমি তো আমার বউকে মাথায় করে রাখি।’
টায়রা হাসে। বিয়ে’র ছয় মাস পেরিয়েছে। অথচ টায়রা বাপের বাড়ি যায়নি। যোগাযোগ রেখেছে কিন্তু টিকলি যায় না বলে সে-ও আর সেদিকে পা বাড়ানোর কথা মুখে আনেনি। টায়রা আর্দ্রর বুকে পিঠ ঠেকায়। ছবি’টা দেখিয়ে বলে,
‘ভাইয়ার চোখের দিকে তাকান। মনে হচ্ছে সব ধ্বংস করে ফেলবে।’
আর্দ্র টায়রাকে আরেকটু গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘সামান্য অন্যের ছোঁয়াতে যদি সব ধ্বংস করে ফেলে তবে ওরা ভাবে কিভাবে একজন আরেকজনের নাম মুছে ফেলবে?’
‘কী জানি! এই রাগ-অভিমানের শেষ যে কোথায়!’
‘আচ্ছা। ওদের কথা বাদ দিন। আমার অপেক্ষার শেষ কোথায়?’
‘আপনার আবার কীসের অপেক্ষা?’
‘এইযে আমার বাসরের অপেক্ষা। আপনার বর’টা একটা বাসরের অপেক্ষায় শুকিয়ে যাচ্ছে অথচ আপনি চেয়ে দেখছেন না।’
‘উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না তো। দিন দিন তো ভুড়ি’টা সামনের দিকে এগুচ্ছে।’
‘হুয়াট? কি বললেন? আমার জিম করা শরীর। তবুও আমার বউ আকর্ষিত হয় না অথচ কত মেয়ে আমাকে দেখে সিটি মারে।’
টায়রা সেসব পাত্তা দেয় না। চোখ উল্টে বলে,
‘আমার কপাল ভালো যে আমার সুদর্শন স্বামী যাকে দেখে দিন রাত কচি ছেলে-মেয়ে সবাই সিটি মারে।’
‘ইশশ… আপনার চাপার উপর রেলগাড়ি যাবে।’
টায়রা আর্দ্রর গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পরে। আর্দ্র ওর কোমরে হাত রাখে। টায়রা ওর নাকে নাক ঘষে বলে,
‘হ্যাঁ। কারণ আমি আপনার চাপাবাজ ফুটা টায়ার।’
আর্দ্র ওমনি টায়রার ঠোঁট ছোঁয়াতে যায়। টায়রা মুখটা পেছন দিকে হেলে দেয়।
‘অন্তত একটা কিস তো করতে দিবেন!’
‘ব্রাশ করেছেন?’
আর্দ্র এই মূহুর্তে কপাল চাপড়ালো, ‘আনরোমান্টিক বউ। মনে রাখবেন, আমার ১৫ নাম্বার গার্লফ্রেন্ড এখনো আমার পথ চেয়ে কিন্তু।’
টায়রা গলা ছেড়ে দেয়। পাত্তাহীন গলায় বলে,
‘যান কিন্তু পরেরদিন যদি মিসেস মনোয়ারা খান তার আদরের ছোট ছেলের ডেড বডি খুঁজে পায় তাতে কিন্তু আমার কিছু করার নেই।’
আর্দ্র মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে টায়রার কোমর ধরে ওকে মাটি থেকে একটু উঁচুতে তুলে। টায়রা আর্দ্র দু কাধে হাত রেখে ভর করে পা নাচিয়ে বলে,
‘ফেলে দেবেন। নামান।’
আর্দ্র নামায় না সেভাবেই টায়রাকে ঘরে নিয়ে বিছানায় ফেলে। নিজের বুকে স্ত্রীর মাথাটা সযত্নে রেখে বলে,
‘কি আজব! সবসময় ঝগড়া করতাম আমরা। ভালোবাসার ছিটেফোঁটা ছিলো না অথচ বিয়ে করে বউয়ের প্রতি ভালোবাসা আমার উথলে পরছে। আর যাদের ভেতরে ভালোবাসার অভাব ছিলো না আজ তাদের সম্পর্কের হাড়ি শূন্য।’
টায়রা আর্দ্রর বুকের লোম ধরে মৃদু ভঙ্গিমায় টানতে টানতে বলে,
‘আপনি আর একটু অপেক্ষা করবেন? ভাইয়া-টিকলির আবার মিল হবে দেখবেন।’
আর্দ্র নিজেও তা বিশ্বাস করে। একবার নিজেকে ধৈর্য্যে রাখে কিন্তু পরক্ষণেই অধৈর্য্য হয়ে যায়। নিজের নিঃশ্বাস বুকের মাঝে চেপে টায়রার নাক টেনে আর্দ্র উত্তর দেয়,
‘হ্যাঁ, সেদিন আর এক সেকেন্ড দেরি করবে না আর্দ্র খান। বউয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পরবে। কারণ সে বউ পাগল।’
‘ইশশ…. মুখের কী ভাষা! বমি আসে শুনলে।’
‘মুখের ভাষা শুনেই বমি আসে। আর কিছু করলে তো আপনার বমি পরিষ্কার করতে করতে দিন যাবে।’
টায়রা আর্দ্রর এই কথা শুনে ঘর কাঁপিয়ে হাসলো। বলল,
‘ফাজিল একটা।’
চলবে❤️