বসন্তপবনে প্রেমছন্দ পর্ব-৪+৫

0
13

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০৪.
‘খান বাড়িতে’ সকালে নাস্তার জন্য টেবিলে বসতেই টায়রা-আর্দ্রর মধ্যে হুলুস্থুল কান্ড বেঁধে গেলো। মনোয়ারা খান তা অতিষ্ঠ চোখে দেখে যাচ্ছেন। তিনি এখন আর ছেলে-ছেলের বউয়ের অযাচিত ঝগড়া দেখে বিস্মিত হন না। গালে হাত দিয়ে হাপুসনয়নে চেয়ে ঝগড়া দেখেন। ওদের দু মিনিটের জন্য মিল হলে পাঁচ মিনিটের তর্ক লাগে। তেমন বড়-সড় কোনো ইস্যু কিন্তু এর পেছনের কারণ থাকে না। এই ধরুন, একদম হাসতে হাসতেই ভালো কথার মাঝে ওদের ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। তো আজকে সকালের ঝগড়া’টা লেগেছে পড়া নিয়ে। প্রথমে খুঁচিয়েছে আর্দ্র,

‘একটু তো পড়াশোনাও করতে পারেন।’

ওমনি টায়রা ভ্রু কুচকে চাইলো। তার ‘পড়াশোনা’ শব্দটায় বিশাল এলার্জি। তা যদি হয় আবার আর্দ্রর মুখ থেকে তবে তো কোনো কথাই নেই। আর্দ্র বলে,

‘টিকলির’টা দেখে নকল করে আর কয়দিন পার করবেন? পরীক্ষা চলছে অথচ একটা ঘন্টার জন্য বই নিয়ে বসতে দেখি না।’

‘আপনাকে দেখিয়ে দেখিয়ে পড়বো?’

‘পড়তে বসলে তো দেখাবেন!’

‘চুপ থাকুন। আপনার প্যানপ্যান ভালো লাগছে না।’

আর্দ্র খেতে খেতে বলে, ‘ভালো না লাগলে কিছু করার নেই। ফেল্টুস ছাত্রীর জায়গা এ বাড়িতে হবে না।’

টায়রা ওমনি শাশুড়ির দিকে ভ্রু বক্র করে তাকায়,

‘জায়গা হবে না, মা?’

মনোয়ারা খান বাধ্য শাশুড়ির মতো মাথা নেড়ে বলেন,

‘আলবাৎ হবে। ও কে বলার?’

টায়রা আর্দ্রর দিকে চেয়ে চোখ মুখ কুচকে হাসে। আর্দ্র বলে,

‘সারাদিন শুধু বসে থাকা, টাইম টু টাইম খাওয়া আর ফোন টেপা। টিকলিকে দেখুন তো! দেখে শিখুন।’

‘আপনি আমাকে খাওয়ার খোটা দিলেন ভাদ্রর বাচ্চা?’

‘হ্যাঁ।’

‘বেশি করেছি। আপনার’টা খাই? নিজে সারাদিন কি করেন? খেয়ে দেয়ে পেট মেলে দিয়ে শুয়ে থাকা, খেলা দেখা আর আমার পেছনে লাগা।’

আর্দ্র কি কম? বলে,

‘আমিও বেশ করি।’

‘আজকে রাতে আমি আপনার ঘরে কিছুতেই থাকবো না।’

‘তাতে আমার বয়েই গেলো!’

এক দু কথায় ঝগড়ায় তখন বাড়ি মাথায়। মনোয়ারা খান হতাশ শ্বাস ফেললেন। এর মাঝে টায়রা সোফা থেকে কুশন নিয়ে মারলো আর্দ্রর দিকে ছুড়ে। কুশন ক্যাচ ধরলো আদর। আলতো হাতে টায়রার দিকে আবার ছুড়ে মেরে টেবিলে বসতে বসতে বলল,

‘তোরা বড় হবি না?’

মনোয়ারা খান ছেলের প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলেন,

‘আর বলিস না! এই দুজনের প্রেমের কোনো গন্ডি নেই… শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি কিচ্ছু মানছে না… বাবু, সোনা, জান বলে একজন আরেকজনের কোলে বসে থাকে ড্রইংরুমেই… আবার এই খুন্তি-যুদ্ধ শুয়ে হয়ে যায়।’

মায়ের কথায় আদর উত্তর করলো না। মাথা নিচু করে খেলো। কিন্তু আর্দ্র-টায়রার মাঝে কি আর কোনো শরমের বালাই আছে? ওরা দুজন নিঃশব্দে চোখে চোখে, ঠোঁটের ইশারায় দুজন দুজনকে ব্যঙ্গ করে গেলো। আদর এও শুনলো টায়রা ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে আর্দ্রর সাথে এক রুমে আজ রাতে কিছুতেই থাকবে না। আদর জানে, কাজ শেষে বহু রাতে বাড়ি ফিরে দেখবে আর্দ্র ওর ঘরে বিছানার এক কোণে ঘুমিয়ে আছে। সপ্তাহে এ ঘটনা তিন, চার বার ঘটা বাধ্যতামূলক।

খাবার খেয়ে উঠতেই নিভার আগমন ঘটলো। বিয়ের পর খালার বাসায় আর সময় করে আসা হয় না নিভার। রাহুল নিভাকে পৌঁছে দিয়ে ব্যাংকে চলে গিয়েছে। নিভা এসে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলো। আদর সোফা থেকে ব্লেজার হাতে নিতে নিতে নিভার মাথার চুল এলোমেলো করার ন্যায় হাত বুলিয়ে দিলো। সৌজন্যে নিভা হাসলো। আদর বাড়ির বাইরে পা রাখার আগেই নিভা জোরে জোরে বলল,

‘টায়রা, আমি আজ একটু টিকলির কাছে যাবো। যাবি?’

আদর কিছুই হয়নি এমন তারায় সেন্টার টেবিলের উপর থেকে গাড়ির চাবি নিলো। এ ঘটনা নতুন নয়! আদরকে শুনিয়ে শুনিয়ে টায়রা-নিভা টিকলিকে নিয়ে কথা বলে। টায়রা অতি উৎসাহের সহিত বলল,

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’

আর্দ্র ওমনি খেঁক করে উঠে, ‘পরশুদিন না পরীক্ষা? আর তুই পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে আমাদের বাড়িতে কি করিস?’

টায়রা পাত্তা না দিয়ে নিভার পাশে বসতে বসতে বলে, ‘আপনার কি?’

‘নিজেরাও পড়বে না। আমার বোন’টাকেও পড়তে দিবে না। ফেইল ফেইল! সব ফেইল!’

বলে রাখা ভালো, আর্দ্র টিকলিকে আমার বোন বলে মাঝেমধ্যে সম্বোধন করে। নিভা কণ্ঠে আরেকটু উচ্ছ্বাস ঢেলে আদরকে আড়চোখে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘টিকলির কোমরে হাত রাখা ওই ডাক্তার’টা কি হ্যান্ডসাম দেখেছিস? নাম কি রে?’

আর্দ্র বিরবির করে বলে, ‘কি অশ্লীল! ছ্যাহ!’

টিকলির কোমরে হাত রাখা? এটা কোনো সম্বোধন হতে পারে? আদর হাতের মুঠো শক্ত করলো। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেলো। মেঝের সাথে পা দুটো সুপার গ্লু এর ন্যায় আটকে গেছে। আদর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই দুই বোকা মেয়ের কথা শুনছে। টায়রা নিভাকে উত্তর দেয়,

‘আমি জানি না। ভাইয়া বলতে পারবে। ভাইয়া ওই ডাক্তার’টার নাম কি?’

আদর কোনো উত্তর দেয় না। আর্দ্র ভাইয়ের মতিগতি বুঝতে পেরে টায়রাকে চোখ রাঙানি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘ছবি দেখেছো, নিউজ দেখেছো অথচ ডাক্তারের নাম দেখোনি, গণ্ডমূর্খ।’

ওমনি টায়রা ওর কমন ডায়লগ দেয়, ‘এই, আপনি চুপ থাকুন।’

নিভা ছবি খানা বের করে টায়রাকে দেখাতে দেখাতে বলে,

‘কিন্তু যাই বলিস ওদের দুজনকে কিন্তু একসাথে খুব সুন্দর লাগছে। একদম কাপল! আদর ভাইয়া থেকে ছবিটা নষ্ট করে ফেলেছে।’

আদর টেবিলের উপর ‘ঠাস’ শব্দ করে গ্লাস’টা রাখলো। এরপর গটগট করে হেটে চলে গেলো। ভাই যেতেই নিভা বুকে চেপে রাখা নিশ্বাস টুকু বাতাসে মেলে দিয়ে বলল,

‘আত্মা হাতে নিয়ে এই কথা বলছিলাম।’

টায়রা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে,

‘তোরে যে তুলে আছাড় মারেনি এই বেশি।’

,
গাড়িতে বসে আদর গাড়ি স্টার্ট করলো না ফোন’টা বের করে একে একে নিউজপোর্টাল গুলোয় ঢু মারলো। নিউজ যে হয়েছে ও সেটাই জানে না। কাল রাতে এসেই ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পরেছিলো। আর সকালে এই কাহিনী জানতে পারলো! আদর স্টেয়ারিং টা এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে আরেক হাতে ফোন স্ক্রল করে গেলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত কিছু পড়লো। সময়ের সাথে সাথে ক্রোধের পাল্লা ভারী হতেই রোষাগ্নি হয়ে সে পরিচিত এক নাম্বারে ডায়াল করলো,

‘হ্যালো।’

‘কালকে ইভেন্টের আমার একটা অপ্রত্যাশিত ছবি বিনা পারমিশনে পোস্ট হয়েছে। ওগুলো একটু দেখো।’

‘ডাঃ আরাফ হোসেন এবং ওই সুন্দরী মেয়ের ছবিটা?’

আদর রুদ্ধশ্বাসে রাগ গিলে বলে, ‘হ্যাঁ।’

‘পাশেই যে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন?’

‘হ্যাঁ? আরো বিশ্লেষণ করবে?’

‘সরি, স্যার। কিন্তু ছবির মালিক তো এখনো কিছু বললো না।’

‘আশ্চর্য! আমি মালিক বলছি তাতে হচ্ছে না?’

‘কিন্তু স্যার, এই ছবিতে তো আপনি গৌণ। ওরা হচ্ছে মূখ্য কাপল….

‘রফিক……..।’

আদরের গর্জনে রফিকের কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। সে ভয়ে ভয়ে বলে,

‘সরি, স্যার।’

‘গৌরবের সম্মাননার ম্যানেজমেন্ট কে ফোন দিয়ে বলো আমার কথা। ইমিডিয়েটলি যেনো পদক্ষেপ নেয়। দুই ঘন্টার ভেতরে সব ছবি যেনো সরানো হয়।’

‘ওকে, স্যার।’

আদর ফোন কেটে মুখ ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে বড় বড় নিশ্বাস নিলো। ঠোঁটে তর্জনী আঙ্গুল রেখে উদাসীন তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ গেলো সিটে পরে থাকা ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা কালকের ভাইরাল টিকলির সেই ছবিটার দিকে। আদর দেখলো! যেনো বহু জনম দেখে না! তৃষ্ণার্ত চোখে দেখতে দেখতে ফোন’টা হাতে নিলো। এরপর বহুদিন বাদে গ্যালারিতে ঢুকলো। পুরোনো কতসব স্মৃতি মলিন হয়ে আদরকে ধরা দিলো। আহাজারি করে বললো আদরকে ‘আমাদের সজীব করো’। আদর হাত বুলিয়ে দেয় ছবিগুলোতে। কবে এতো মলিন হলো? আদর টেরই পেলো না! আদর বুঝে আদতে এই আহাজারি ওই জড় বস্তুর নয়। এ আর্তনাদ আদরের চিত্তের! তার অন্তঃকরণ শরীর হীম করা কণ্ঠে কেবল বলে,

‘আমি আপনাকে কক্ষনো ক্ষমা করবো না, টিকলি।’

আদর তবুও চেয়ে রয় যতক্ষণ চোখের পাতা না পরে। আহ! হৃদপিণ্ডটা খুবলে খাচ্ছে রে ওই ডাকিনী!

চলবে❤️

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০৫.
‘আজ ফাগুণি পূর্ণিমা রাতে চল পালায়ে যাই।
চাঁদের নৌকায় চেপে দূর কোনো দ্বীপে রঙ মেখে যাই।
আজ ফাগুণি পূর্ণিমা রাতে চল পালায়ে যাই।’

ফাগুনের আগুন রৌদ্র পরশ গায়ে মেখে টায়রা নিভা গুণগুণ করতে করতে টিকলির এপার্টমেন্টে ঢুকলো। টিকলি তখন পড়ছিলো। ওদের দেখে বইটা শব্দ করে বন্ধ করে ভ্রু টান টান করে তাকিয়ে বলল,

‘তোকে না আমি পড়তে বলেছি?’

‘তুই পড়ছিস তো।’

‘কাল তোকে কিচ্ছু দেখালে তো!’

টায়রা সে কথায় পাত্তা দেয়না। টিকলি এই কথা প্রতি পরীক্ষার আগে বলে। ড্রইংরুমের মেঝেতে কুশনের উপর বসে সেন্টার টেবিলে বই রেখে টিকলি পড়ছিলো। টায়রা, নিভা গিয়ে টিকলির দু পাশে বসলো। টিকলি কানে হাত গুজে বইয়ের দিকে তাকিয়ে নিভাকে প্রশ্ন করে,

‘তোর জামাই কই? বউ যে পড়া বাদ দিয়ে আকাশে উড়ছে তা দেখতে পাচ্ছে না?’

‘না রে অন্ধ হয়ে গেছে। ঠিকমতো আমাকেই দেখে না। পুরোনো হয়ে গেছি তো। প্রথম প্রথম সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতো আর এখন দিনে একবার ঠিকমতো তাকায় না।’

‘সেম কষ্ট, দোস্ত।’ দুঃখী মুখ করে টায়রা নিভার সাথে হাই ফাইভ দিলো। টিকলি নিরস গলায় বলে,

‘তোর আর কষ্ট! সারাক্ষণ ঝগড়া করিস। আবার আমার ভাইটাকে কাছে যেতে দিস না। দুইদিন পর পর আমার কাছে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে।’

টায়রা মুখ হামলালো। নিভা চোখ বড় বড় করে তাকায়। কণ্ঠে অবাকতা ঢেলে বলে,

‘শ্যাষ! আর্দ্র ভাইয়ার লজ্জা সরম তো একবারে খায়ে দিছস রে, টায়রা।’

‘অনেক নামীদামী কাজ করেছি রে। কয়জন পারে জামাইয়ের সরম খাইতে? তুই পেরেছিস?’

টিকলি আগ্রহ হলো এই পর্যায়ে। লোক দেখানো কানে হাত গুঁজে রাখা হাত দুটো বের করে চোখে উৎফুল্লতা নিয়ে নিভার কাধে নিজের কাধ দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে নিচু স্বরে বললো,

‘এই আসলেই, তোরা বাসর করেছিস? হ্যাঁ? হ্যাঁ?’

নিভা তো আর টায়রার মতো নির্লজ্জ না তাই স্বাভাবিক ভাবে নিভা লজ্জায় মুখে হাত রাখে। টায়রা, টিকলি জোরাজুরি করে। নিভা আঙ্গুল ফাঁক করে এক চোখ বের করে বলে,

‘করেছি। চুপ থাক এবার।’

টিকলি, টায়রা ঘর কাঁপিয়ে এক সুরে বলে উঠলো, ‘ওহহোওও….!’

নিভা লজ্জায় লাল-নীল হয়ে উঠে চলে এলো জানালার কাছে। টিকলি টায়রার সাথে একযোগে হাসতে হাসতে পেছন থেকে নিভার দিকে চেয়ে রইলো। রাহুল টিকলিকে এখনো মন দিয়ে বসে আছে কি নেই সেই হিসেবে টিকলি যেতে চায় না। কিন্তু এই মিষ্টি মেয়েটাকে রাহুল যে সম্মানে..যে শ্রদ্ধায়.. যে আদরে রেখেছে তা নিভার চোখে মুখে ঝিলিক দিয়ে উঠে। স্বামীর সোহাগ বুঝি নারীদের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অলংকার? এইযে টায়রা! হাতে স্বর্ণের চিকন চুড়ি, নাকে ছোট্ট একটা নাকফুল, গলায় স্বর্ণের চেইন, কানে ছোট্ট দুল… কী সুন্দর ছোট্ট পুতুল পুতুল একটা স্বর্ণ বউ। যার মাথায় সারাদিন বুদ্ধিরা গিজগিজ করে কীভাবে আর্দ্রকে তর্কে পরাজিত করবে। শুধু নেই টিকলির! মাঝখান থেকে সবাই ভালো রইলো। সবার সব কিছু হলো। কিছু হলো না শুধু টিকলির। খাতায় একটা বড় শূন্য এক কোণায় পরে রইলো।

তখনি টায়রা জোরেসোরে বলল, ‘এই টিকলি অনলাইন থেকে ছবিগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নেই দেখ।’

টিকলি নিভা দুজনেই চেক করলো। ছবিগুলো সত্যিই নেই। টিকলি মনোযোগ দিয়ে তখনো ফোন ঘাটছে। নিভা আড়ালে টায়রাকে ইশারায় কিছু বলে। টায়রা টিকলিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,

‘আমি সিউর এটা ভাইয়ার কাজ।’

ওমনি টিকলির হাত’টা থমকে গেলো। কতক্ষণ নিরবে বসে থেকে ফোনটা আলগোছে রেখে উঠে চলে গেলো রান্নাঘরে। সেদিকে তাকিয়ে টায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। টায়রা টিকলির থেকে বছরখানেকের ছোট। তারা বেড়ে উঠেছে একসাথে। পড়েছে এক ক্লাসে। দুজন দুজনকে নিজ মনের কথাগুলো নিগড়ে দিয়েছে সেই ছোট থেকে। কিন্তু কি হলো কে জানে টিকলির বুকের একটা বিশাল পাথরের নিচে হঠাৎ ওর কষ্টগুলো চেপে রাখা শুরু করলো।

______________________
টিকলি আদরের শুরুটা হয়েছিলো বছর খানেক আগে খুবই বিচ্ছিরি ভাবে তর্ক-বিতর্ক দিয়ে। দুজনের বাসা থেকে বিয়ের জন্য পারিবারিক ভাবে জোর করে পাঠানো হয়েছিলো একটা রেস্টুরেন্টে। বৃষ্টিশেষে এক প্রেম প্রেম গন্ধ নিয়ে ছন্দ’টা প্রথম কেটেছিলো টিকলি-ই,

‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আই এম প্রেগন্যান্ট।’

অপরিচিত মেয়ের মুখে প্রথম দেখায় এহেন কথায় আদর থমকে গিয়েছিলো। ভ্রু কুচকে বলেছিলো, ‘সেটা আপনার বাবা-মাকে জানান। আমার কতটুকু সময় নষ্ট করলেন। চেম্বার ফেলে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।’

আদরের আরো কতশত ঝাড়ি! টিকলি রাগে নাক ফুলিয়ে নিরবে সেসব সহ্য করেছে। এরপর আদর একটু ক্ষান্ত দিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘কয় মাস প্রেগন্যান্সির?’

টায়রার ভাষায় মাথামোটা, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধী’টা নার্ভাসনেসে উত্তর দিয়েছিলো, ‘প..পনেরো দিন।’ সাথে এও বলেছে সে তার বয়ফ্রেন্ডকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু তার বয়ফ্রেন্ড এক মাস ধরে লাপাত্তা তাই বাবা-মাকে কিছু বলতে পারছে না। আদর সেসব নিয়ে কত মজা উড়িয়েছে! বলেছে,

‘পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। ডেলিভারি পেইনের মেয়ে হলে না কথা ছিলো!’

‘আপনি তো ভারী অসভ্য!’ টিকলির সে কি রাগ! অপারগ কণ্ঠস্বর!

আদরও আরো এক ধাপ তেজ নিয়ে বলে, ‘আমি অসভ্য? আমি কি আপনার মতো ১৫ দিনের প্রেগন্যান্সি নিয়ে ঘুরছি?’

এক কথা দু কথায় বহু ঝগড়া। সেই ঝগড়া থেকে একজন আরেকজনকে হৃদয় নিংড়ে গালিগালাজ করে বাড়ি ফিরে চলে এলো। আদরের বাবা টিকলির বাবাকে ফোন দিয়ে নানান কথা শুনালো প্রেগন্যান্ট মেয়েকে গছিয়ে দিচ্ছিলো বলে। তারপর দুই পরিবারের মধ্যে সম্বন্ধ কাট হয়ে পেস্ট হলো শত্রুতা। কে কার আগে নিজেদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে পারে এই প্রতিযোগিতায় নেমে পরলো।

নতুন উদ্যমে বাবা-মায়ের এই বিয়ে নামক উটকো ঝামেলার চাপে পরে টিকলি টায়রাকে আর আদর আর্দ্রকে বগলদাবা করে ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাসে বাড়ি থেকে একই সময়ে পালালো। পালিয়ে চারজনের ডেস্টিনেশন হলো নিঝুম দ্বীপ। সেই নিঝুম দ্বীপের এক নিঝুম দিনে ওদের প্রেম’টা আচমকা না বলে কয়ে এসেছিলো। ফিরে আসার পর শত কান্নাকাটি, হৃদয় ব্যথা সব একশেষে যখন আবার একে অপরের সাথে দেখা হলো। ওরা আঁকড়ে ধরলো দুজন দুজনা’কে। সবকিছু উপেক্ষা করে, ধরণীতে ভূ-কম্পন লাগিয়ে ওরা প্রেম করলো ধুমিয়ে। তারপর একদিন রাহুলের সাথে টিকলির বিয়ে ঠিক হলো। তখন নিভা রাহুলকে ভালোবেসে ফেলেছে। আদর অন্য মেয়েকে এক বাক্যে বিয়ে করবে না বলে জানিয়ে দিলে আজিম খান আর্দ্রর বিয়ে ঠিক করলেন খালাতো বোন নিভার সাথে। টিকলি জোরপূর্বক বিয়ের আসরে বসার আগ মূহুর্তে যেই নিজের সাথে একটা অঘটন ঘটাতে যাবে ওমনি রাহুল ঠিক পটের অধিনায়কের মতোন নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিলো। বিলিয়ে দিলো সেই ছোট্ট থেকে ভালোবাসার টিকলিকে। আর্দ্র আর টায়রাও তখন নিজেদের ঝগড়ার বর্ণময় দুনিয়া ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এলো। নিভা বিয়ের আসর থেকে আর্দ্রর সাথেই পালিয়ে চলে এলো রাহুলের কাছে। রাহুল মেয়েটাকে তখন গ্রহণ করলো ঠিক তবে বহু অধিকার না দিয়ে। এই পরিবারের দ্বন্ধে সে রাতে একই প্রহরে ওরা ছয়জন পালালো একই সাথে। তারপর? তারপর কি হলো? আর্দ্র-টায়রার বিয়ে হলো, নিভা রাহুলের বিয়ে হলো কিন্তু শেষে গিয়ে আদর টিকলির বিয়ে কেনো হলো না?

সেসব ভাবার সময় নেই টিকলি-আদরের। ওরা সেই বর্ণিল রকমারি আলোকসজ্জা ছেড়ে ব্যতিব্যস্ত নিজেদের সাথে। আদরের কত কাজ! সামনে সে মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করছে। সেসব নিয়ে কত দৌড়াদৌড়ি আবার চেম্বারে বসা, সরকারি হাসপাতালের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া, মেডিকেল কলেজে সপ্তাহে ২-৩ টা লেকচারার হিসেবে ক্লাস নেওয়া। বহু কাজ!

আদর, ওর বন্ধু আসিফ, সেলিম রায়হান, রাকিব ইসলাম এবং আরো বেশকিছু বিশেষ ডাক্তারদের উদ্যোগে ASHDI ফাউন্ডেশন থেকে ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে সিলেটে একটা মেগা মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। এই সংস্থার চেয়ারম্যান সেলিম রায়হান। আদর, আরাফ এবং রাকিব ট্রাস্টি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের কিছু কান্ট্রি এবং যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অংশগ্রহণ করবেন। আদরের আজ কলেজে ক্লাস নেওয়ার ডেইট। সকাল ৮ টায় ক্লাস ছিলো। ক্লাস থেকে ফিরে এসে সে চেম্বারের চেয়ারে বসে বড় করে নিশ্বাস ফেললো। হাতে একদম সময় নেই। হ্যাং হয়ে যাওয়া মাথাটা ঝাড়া দিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো। এরমাঝে ফোনটা আপনস্বরে বেজে উঠলো।

চলবে❤️