#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০৮.
আকাশে বাঁকা চাঁদ। টিকলির অন্ধকার ঘরটায় ঠিকরে পরছে তার আলো। রৌপ্য চন্দ্রের কী ভীষণ মিষ্টি শোভা! সেই চাঁদির ধাতুর রশ্মি গায়ে মেখে টিকলি বারান্দায় আনাড়ি হাতে কোনোমতে প্যাচিয়ে শাড়ি পরে বসেছিলো। ওরা চলে গেছে মিনিট ত্রিশেক হবে। এরমাঝে টিকলির ভীষণ ইচ্ছে করলো শাড়ি পড়তে। সে পড়েছে একটা চাঁদের শাড়ি। শুভ্র- নীল মিশেল জমিনে চাঁদপটের বিবি সেজে বসেছে। টিকলি হাটুর উপর মাথা রেখে বৈরী নিশানাথ কে এক দৃষ্টিতে দেখছিলো।
টিকলি আশি পার্সেন্ট সিউর আদর থাকবে সেই ইভেন্টে। কিন্তু সিউর হয়েও কিছু করার নেই। সে বহু কষ্ট করেছে ম্যানেজারকে বোঝানোর জন্য। কিন্তু ম্যানেজারের এক কথা তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিলে ওরা আমাদের কোম্পানিকেই এই ইভেন্টের কাজ দিবে না। বলির পাঠা সাজিয়ে টিকলিকে পাঠানো হচ্ছে একরকম। আচ্ছা? তাতেই বা কি? এর আগেও তো দেখা হয়েছে এবারও নাহয় হলো! টিকলি একবার প্রসন্ন চিত্তে নয়ন ভরে নাহয় দেখলো সেই সুন্দর মুখখানা! তাতে কি পৃথিবীর গায়ে ফোস্কা পরে যাবে…. টিকলি যদি নির্লজ্জ চোখে একবার এক মূহুর্তের জন্য আদরের দিকে তাকায়?
টিকলি তার ভাবনা শেষ করে ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ওতো ভাবতে পারবে না। সে কাজে যাচ্ছে। কারোর অন্ন নিশ্চয়ই ধ্বংস করতে যাচ্ছে না। বারান্দা থেকে ঘরের দিকে যেতেই টিকলি শাড়ি পায়ে বেজে পরে যেতে নিলো। দরজা ধরে কোনোরকম নিজেকে সামলে ঘরে এসে এলোমেলো শাড়ি খুলে ছুড়ে মারলো একদিকে। গায়ে শুধু ব্লাউজ আর টাউজার পরে ল্যাপটপ খুলে বসলো। কালো মেঘ চাঁদকে আড়াল করতেই আকাশ গর্জন দিয়ে উঠলো। বৃষ্টি আসবে। টিকলি ওর জানালা গলিয়ে উঁকি দিলো বাইরে। জটলা পাঁকা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চোখ মিশিয়ে টিকলির হঠাৎ মনে পরলো ভালোবাসার যাত্রায় আদরের প্রথম অগ্রসর,
‘In the end of the rain, love is beginning.’
আদর বলেছিলো বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ। তারপরই না ওদের জীবনের সবথেকে সুন্দর পাঁচ’টা মাস এসেছিলো!
_______________________
আদর ওর ক্যাম্পের জন্য বেরিয়ে গেলো পাঁচদিন আগেই যেহেতু বাইরের দেশ থেকেও বিভিন্ন চিকিৎসকরা থাকবেন। সিলেটে গিয়ে ক্যাম্পের যাবতীয় আয়োজন নিখুঁত, সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা চাই। কোথাও ফাঁকফোঁকর থাকা কাম্য নয়। রিফা, আসিফ, আসিফের এসিস্ট্যান্ট আরো কিছু জুনিয়র ডাক্তার সবাই ওরা একসাথেই গেলো। ক্যাম্পের দিন রিফা খেলো এক রাম ধমক। ক্যাম্পের মাঝে রিফা এসে আদরকে গোপনে জানালো পর্যাপ্ত গ্লাভস এবং স্যানিটাইজার নেই। ধারণাতীত রোগী! জিনিসপত্র শেষ হওয়া তো দূর টান টান হয়ে যাবে বলেও ধারণা ছিলো না আদরের। কিন্তু এই মধ্যপর্বে এসে এসব ম্যান্ডেটরি জিনিস শেষ? মানে’টা কি? একটা রাম ধমক দিয়ে আদর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘তোমাকে আসার সময় বারবার বললাম। ভালোমতো সবকিছু চেক করে নেও। প্রয়োজনের থেকে বেশি নেও। কালকেও আমি ওষুধপত্র চেক করে ঢাকা থেকে এক্সট্রা নিয়ে আসলাম। তুমি এসব একটু দেখতে পারলে না? ঠিকমতো কাজই যদি করতে মন না চায় কাজ করো কেনো?’
আদরের ধমকে রিফা কেঁপে উঠে দু’পা পিছিয়ে গেলো। মাথা নিচু করে বললো,
‘সরি, স্যার। আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি।’
আদর পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায়,
‘কি ব্যবস্থা করবে তুমি? এখান থেকে সিলেট মেইন শহর যেতে কতক্ষণ লাগে তুমি জানো? দুই ঘণ্টা। যেতে-আসতেই চার ঘণ্টা যাবে। তুমি বলো আমি এখন কি করবো? চেয়ারম্যান স্যার শুনলে আমাকে কি বলবে কোনো আইডিয়া আছে তোমার? এই প্রথম নিজের উদ্যোগে এতো বড় ক্যাম্প আয়োজন করেছি। তোমার উপরে ভরসা করাটাই আমার ভুল।’
রিফার চোখ ছাপিয়ে কান্না এলো। ওমনি আদরের হুশিয়ার,
‘এই, ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবে না একদম। আশেপাশে কত মানুষ দেখছো না? স্যার জানতে পারলে এই মূহুর্তে তোমার চাকরি নট করে দিবে। ভলান্টিয়ার পাঠিয়ে দেও যাও কুইক।’
রিফা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। আসিফ তখনি হন্তদন্ত দৌড়ে আসছিলো আদরকে বলার জন্য যে স্যানিটাইজার প্রায় শেষের দিকে। আসিফের সাথে আলোচনার মূহুর্তে আরাফ কে ওদের দিকে আসতে দেখলো। এই ক্যাম্পের চিকিৎসক হিসেবে আরাফেরও ডাক পরেছে। আসিফ সৌজন্যে হেসে আরাফকে বলতেই আরাফ হেসে ওর আর আদরের কাধ চাপড়ে বলল,
‘আরে চিন্তা করো না। সিলেট তো আমার শহর। আমার চেনা-পরিচিত আছে। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি ওরা পাঠিয়ে দিবে। তোমাদের দুই ঘণ্টা সময় কম নষ্ট হবে। তোমাদের কয় গাড়ি লাগবে সেটুকু বলো।’
আদর বড় একটা ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলো। বড় করে শ্বাস নিয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
‘থ্যাঙ্কিউ, স্যার।’
আরাফ জুনিয়রদের মুখে স্যার শুনে অভ্যস্ত তবুও আদরের মুখে স্যার ডাক শুনে কৌতুক করে বলে,
‘আরে বাচ্চা, স্যার ডেকো না। নিজেকে বয়স্ক মনে হয়। আমি তোমার থেকে বেশি বড় না। মোটে ৩ বছরের। তার থেকে ভাইয়া বলে ডেকো।’
আদর মাথা দুলিয়ে হেসে আরাফের সাথে গলা মেলায়।
____________________
একটা মিনি বাসে করে ‘Moments and more’ এর ঢাকা ব্রাঞ্চ থেকে ১৬ জনের একটা টিম সিলেট যাচ্ছে। সিলেটের ব্রাঞ্চ’টা নতুন। কাজেই দক্ষ এমপ্লয়ি কম। এই হিউজ ইভেন্ট নিয়ে ম্যানেজার এর মাথা ব্যথার শেষ নেই। টিকলি বিরক্তি চোখে-মুখে লেপ্টে অনিচ্ছায় যাচ্ছে। ওরা ২৫ তারিখ রাতে রৌনা হলো। স্বাভাবিক ভাবেই দুইদিন আগে রৌনা হওয়া আবশ্যিক। কাজ কিছুটা ঢাকা থেকেই ডিরেকশন দিয়ে গুছানো হয়েছে। এখন শুধু উপস্থিত থেকে জায়গায় জিনিস জায়গা মতো সাজানো হবে। প্ল্যানিং, এরেঞ্জমেন্ট সব কনফার্ম।
টিকলি বসেছে দুই সিট নিয়ে। ওর পাশের সিটে কারোর বসার পারমিশন নেই। কাজের বেশ খ্যাতি কোম্পানিতে ছড়িয়ে আছে বলে আর অল্পদিনে প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র হয়ে গিয়েছে বলে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না। টিকলি জানালায় মাথা ঠেস দিয়ে হাওয়ায় চুল চোখে মুখে ভাসিয়ে একদৃষ্টিতে গুমট রাত্রির আধাঁরে তাকিয়ে ছিলো। রাস্তার সাথে বাসের চাকার ঘর্ষণ…… বাতাসের গাঢ় ঝাপটার সাথে শো শো শব্দ…. টিকলির পাশের খালি সিট। টিকলি কি মিস করছে কাউকে?
টিকলি নিজের মনেই বলে, ‘নাহ। মিস করার কেউ নেই।’
তখনি আকাশ থেকে টুপ করে পড়া স্বর্ণের থলির ন্যায় টিকলির কোলে টুপ করে পরলো চিপস, জুসের প্যাকেট। টিকলি চোখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলো নিরব দাঁত কেলিয়ে সিটের উপর দু’হাতের উপর থুতনি রেখে তাকিয়ে আছে,
‘বাইরে তাকিয়ে কি দেখছিস?’
‘তোর বউ দেখলাম। ভূত-বউ। দেখবি?’
‘না।’
‘কেনো?’
‘কারণ আমি মানুষ। মানুষ ভূত দেখতে পারে না। ভূতেরাই ভূত দেখতে পারে।’
টিকলি সিট থেকে একটু উঠে নিরবের মাথায় কিল বসালো। নিরব মাথা চুলকে তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। একটুপর ঠোঁট উলটানো কান্নামো স্বরে বলল,
‘এই টিকলি? আমাকে তোর পাশে বসতে দিবি?’
‘কেনো? কি সমস্যা?’
‘আরে এই শালা রবিন একটু পর পর আমার কাধে মাথা রাইখ্যা ঘুমায়। যন্ত্রণা সহ্য হয় বল তো? একটা মেয়ের মাথা হলে নাহয় আদর যত্নে বরং বুকে রেখে দিতাম।’
‘আহারে! তোর বুকে যাতে কষ্ট না হয় তাই তোর পাশে ছেলে বসেছে রে।’
‘তোর পাশে বসতে দে।’
‘যেখানে বসেছিস সেখানেই চুপচাও বসে থাক নাহলে লাথি মেরে জানালা দিয়ে ফেলে দিবো।’
টিকলি সামনে ঘুরলো। পেছন থেকে নিরব অনেকবার অনুরোধ করে গেলো সেসব না শোনার জন্য কানে হেডফোন গুঁজলো। হেডফোনে বাঁজছে সেই সাথে টিকলির ঠোঁটে গুনগুন করে ভেসে আসছে,
“ও মেঘ ও মেঘ রে তুই যা না উড়ে
আমার বন্ধু থাকে যে শহরে
ও মেঘ ও মেঘ রে তুই বলিস বন্ধুরে
আমি আজও ভালোবাসি যে তারে।”
সেই গানের বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে টিকলির বুকটা ভীষণ বিচ্ছিরি ভাবে ফাঁকা লাগলো। ও মিস করছে! ওর বেহায়া নির্লজ্জ মন আদর’কে খুব মিস করছে। এই পাশের সিট’টা কেনো ফাঁকা? আদর কেনো বসে নেই ওতে? টিকলির চোখের বন্ধ পাতা নিগড়ে জলের একটা অপ্রত্যাশিত ধারা গাল বেয়ে নেমে গেলো। টিকলির মোলায়েম হৃদয় কেঁপে কেঁপে বলল,
“কোথাও ভ্রমণে যাকে তুমি নিবৃত্তে বেখেয়ালে কল্পনায় রাখো…পাশের সিটের সে ব্যক্তির শূন্যতা যদি তোমায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে… তবে তুমি জেনে নাও তাকে তুমি আকাশ-কুসুম ভালোবাসো।”
চলবে❤️
#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০৯.
সিলেটের শীত ভাব’টা পুরোপুরি কাটেনি। ভোরের কুয়াশা গায়ে মেখে ফুল হাতা গেঞ্জি গায়ে আদর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো। মিনিট কতক পর পেছন থেকে আর্দ্র জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ভাইয়া, তোমাকে অনেক মিস করেছি।’
আদর নাক’টা ফুলিয়ে পেছন দিকে কনুই দিয়ে আর্দ্রর পেটে মেরে দিলো। আর্দ্র মুখ ফুলিয়ে পেট ধরে বসে পরলো। আদর পেছন ঘুরে বলে,
‘তোকে কতবার বলেছি আমার সাথে ড্রামা করবি না, বেয়াদব।’
আদর আবার ঘুরে কফিতে চুমুক দেয়। ক্যাম্প সম্পন্ন হয়েছে সুষ্ঠু ভাবে। আর্দ্র-টায়রা, রাহুল-নিভা ওরা সবাই সিলেট এসে পৌঁছেছে কালকে। কিন্তু মুসিবত হলো আসার পর থেকে ওরা কোথাও নড়েনি। একটু আশেপাশে ঘুরে রুমে ঢুকে বসে থাকছে। তাদের এক কথা আদরকে ছাড়া ঘুরবে না। আদরের আজ সন্ধ্যায় ইভেন্ট। এহেন অবস্থা দেখে আদর বলেছে কাল সবাই মিলে ঘুরতে যাবে। আর্দ্র আদরের হাত ধরে ছোট্ট বাচ্চাটির মতো ঝুলে পরলো,
‘ভাইয়া তোমার সাথে আমাদের ইভেন্টে নিয়ে চলো।’
আদর ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়, ‘নিয়ে চলো মানে? এটা কি হাতের মোয়া যে যখন তখন টুপ করে গিলে ফেলবি? যেতে চাইলেই যাওয়া যাবে?’
আর্দ্র নাছোড়বান্দা, ‘প্লিজ ভাইয়া। কাল থেকে বন্ধ হয়ে বসে আছি। নিয়ে গেলে কি হবে?’
‘থাপ্পড় খাওয়ার আগে আমার চোখের সামনে থেকে যা। ইনভাইটেশন কার্ডে স্পষ্ট লেখা, ‘Only for invitee.’
আর্দ্র থমথমে মুখে সরে আসলো। মূলত আর্দ্র যেতে চাইছে টিকলির জন্য। আর্দ্র সন্দেহের বশে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছে টিকলি আজকের এই ইভেন্টের আয়োজনের জন্যেই সিলেট এসেছে এবং ইভেন্ট শেষে রাতেই রৌনা হবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর্দ্রর মূল উদ্দেশ্য টিকলির এই যাত্রা পন্ড করা। আর্দ্র বুঝতে পারলো, ইভেন্টে আদরের গেস্ট হয়ে ওদের ৪ জনের যাওয়া সম্ভব নয়। আয়োজক হয়তো আদরকে না বলবে না কিন্তু বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখাবে।
__________________________
ঢাকার বাইরে কাজ করা টিকলির এই প্রথম। তার একটু নার্ভাস লাগছে। না, সেটা কাজের জন্য নয়। নিজের কাজের প্রতি তার অগাধ কনফিডেন্স আছে। কিন্তু কথা হলো ডাঃ আরাফ এসে বসে আছেন বিকাল থেকে। ঠিক বসে আছেন নয় টিকলির আশেপাশে দিয়েই ঘুরঘুর করছেন। টিকলি ঠিকমতো কাজে কন্সেন্ট্রেট করতে পারছে না। সে যারপরনাই বিরক্ত। এরমাঝে ফোনটা তার স্বরে বেজে উঠতেই টিকলি ফোন ধরে দিলো এক ঝাড়ি,
‘কাজের মাঝে ফোন দেস কেনো?’
টায়রা, নিভা একসাথেই ছিলো। সিলেট এসে ওরা দেখা করতে চাইলেও টিকলি দেখা করেনি। কারণ টিকলি এও জানে আদর ওদের সাথে রয়েছে। আদর আজকের ইভেন্টে এটেন্ড করবে নাকি করবে না তা টিকলি সিউর জানে না তবে টায়রা শুধু এটুকু বলেছে আদর মেডিকেল ক্যাম্পের জন্য সিলেট এসেছে। টিকলি ফোন কানে ধরেই নিরব’কে দাঁত চেপে বললো,
‘স্টেজ ম্যানেজার, কাজ তাড়াতাড়ি করুন। আপনার কোমর সোজা করতেই যদি একদিন লাগে তাহলে কাজ রেখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান।’
নিরব ওর বাঁকা কোমর সোজা করে দাঁড়ালো। কাজ করতে করতে একটু স্ট্যান্ড আপ এক্সারসাইজ করছিলো। কোমর’টা টানা দিচ্ছিলো। তাও এই মহিলার সহ্য হয় না। নিরব আড়চোখে টিকলির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘সত্যি গিয়ে ঘুমাবো?’
‘একটা লাত্থি দিয়ে তোকে সিলেটের পাহাড় থেকে ফেলে দেবো। অসভ্য, অলস, বর্বর।’
টিকলির গালাগালে টায়রা-নিভা কানে হাত গুঁজলো। টিকলি এবার ফোনের মাঝে ধমকে বলল,
‘কি বলবি বল?’
টায়রা-নিভা যা বলার জন্য ফোন করেছে তা বললে টিকলি ফোনের মাঝেই ওই দুটোর গর্দান নিয়ে নিবে।
‘কিছু না। কাজ কর। রাখি।’
বলে ফোন কেটে দিলো। মূলত টায়রা-নিভা বলতে চেয়েছিলো টিকলি যেনো আজই ঢাকা ফিরে না যায়। যেহেতু বলতে পারলো না সেহেতু তারা অন্য মতলব খুঁজতে লাগলো।
আরাফ ওইমুহূর্তে টিকলির মুখোমুখি পরলো। সালাম দিয়ে সৌজন্যে হেসে বলল,
‘কেমন আছেন?’
বেলা ডোবার পূর্ববর্তী সময় তখন। আরাফ এসেছে নাহলেও ঘন্টা খানেক হবে। অথচ ভাবখানা দেখো যেনো টিকলিকে খেয়ালই করেনি। এখন চোখে পরলো দেখে কথা বলছে। টিকলিও বিনিময়ে হাসি উপহার দিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?’
‘মোটামুটি। আপনার কাজ ভীষণ সুন্দর। আপনার কোম্পানিকে আমি পারসোনালি আপনার নাম মেনশন করেছি।’
‘জি। সে জন্যেই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। আপনি এতো আগেই চলে এসেছেন….?’
টিকলি কৌতূহল থেকে প্রশ্ন করে। আরাফ ঠোঁট মেলে উত্তর দেয়,
‘ওহ, একচুয়েলি আজকের অনুষ্ঠানের ছোট খাটো একজন আয়োজক আমি। তো আরো যারা সিনিয়র আয়োজক রয়েছেন তারা বললেন ইভেন্টের কাজ একবার চেক করে দেখে যেতে। আমি এক্ষুণি চলে যাবো।’
আরাফ কখন যাবে না যাবে টিকলি তা জানতে চায়নি। তবুও শুনলো। আরাফের সাথে টুকটাক আরো কথা হলো। আরাফ যখন চলে যাবে তখন টিকলি মৃদু স্বরে বলল,
‘ডাঃ আরাফ হোসেন, গেস্টদের মধ্যে কি ডাঃ আদর খানও রয়েছেন?’
টিকলি প্রশ্ন’টা অবচেতন মনেই করে ফেললো। ওর জানার কোনো দরকার ছিলো না। ইভেন্ট শুরু হলে তার চোখ তাকে অবশ্যই তা দেখাতো। তবুও প্রশ্ন’টা গলা ঠেলে বেরিয়ে এলো।
আরাফ থেমে দাঁড়িয়ে বলল,
‘অবশ্যই। হি ইজ ওয়ান অফ আওয়ার চিফ গেস্টস।’
টিকলি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে আরাফকে বিদায় জানালো। খুবই প্রাঞ্জল মানুষ। আচার, ব্যবহারে মনে হলো না তিনি এতো বড় একজন ডাক্তার। খুবই সাদামাটা চলন-ফেরন। অনাড়ম্বর তার চেহারা তবুও আভিজাত্যপূর্ণ। টিকলি কাজে নেমে পরলো আবার।
,
আদর, আসিফ এবং সাথে তাদের এসিস্ট্যান্ট রিফা, নিতু। ওদের দুইজনের গাড়ি একসাথেই এসে থামলো কনভেনশন হলের সামনে। রিফা, নিতু গিয়ে আদর, আসিফের জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালো। আদর আসিফের সাথে ক্যাম্পের কিছু ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করতে করতে ভেতরের দিকে এগোচ্ছিলো।
‘তুই কি আজ রাতেই ঢাকা ব্যাক করছিস, আসিফ?’
‘হ্যাঁ, আর বলিস না আম্মা আবার মেয়ে দেখেছে। সেই মেয়ের সাথে কাল বিকাল ৫ টা বাজে দেখা করতে যেতে হবে। ৫ টা মানে ৫ টাই।’
‘বিয়ে’টা করছিস না কেনো?’
‘মনমতো তো মেয়েই পাচ্ছি না রে। ভালো মেয়ের এতো অভাব আজকের দিনে।’
আদর মাথা দুলিয়ে হেসে বলে, ‘মেয়েদের সংস্পর্শে সারাজীবন সাঁতার কেটে এই বয়সে এসে তোর চোখে ছানি পরে গিয়েছে। কম তো আর প্রেম করিসনি।’
‘ওমন একটু আধটু লাইফ এঞ্জয় সবাই করে।’
আসিফ আদরের কাধ থাপড়ে বলে। আদর বেখেয়ালে বলে,
‘লাইফ এঞ্জয়? এগুলোকে এঞ্জয় বলে? ঘেন্না লাগে না এতোগুলো মেয়ের সংস্পর্শ?’
‘প্রথম প্রথম একটু লজ্জা লাগতো পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তোর মতো নিরামিষ হয়ে কয়জন থাকে? মেয়ে ফ্রেন্ড অবধি নেই তোর। একটা প্রেমের বিরহে তোর যা অবস্থা!’
আসিফ বলেই জিহ্বা কাটলো। আদর চোখ তুলে আসিফের দিকে তাকালো। আসিফ সাথে সাথে বিপন্ন গলায় বলে উঠে,
‘সরি সরি। ভুল হয়েছে। ওই কথা আর তুলবো না।’
আদর থমথমে মুখে সামনের দিকে আরেক পা এগুতেই চোয়ালের পেশি শক্ত হয়ে উঠলো। রগ ভেসে উঠলো কপালে। ওই মূহুর্তে সে যেমন স্তম্ভিত নারীটির উপস্থিতি নিয়ে… চমকপ্রদের সাগরে ডুবে তার পা দুটো যেমন মাটির সাথে সুপার গ্লু এর ন্যায় আটকে পরলো… তেমনি চোখ দুটোও স্থির হলো গিয়ে সামনের মানবী’তে। চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে উঠলো। এই রমণীর আরাফের সাথে ওতো হাসি কীসের? দেখো হাসতে হাসতে গলে পরছে যেনো! আদর বিরবির করে বলল,
‘এতো হাসির মতো কি বলেছে?’
আসিফ প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলে, ‘হু? দাঁড়িয়ে পরলি কেনো?’
উত্তর দেওয়ার বদলে আদর অবচেতন, বেখেয়ালি, উদাসীন মনে তখন প্রশ্ন করে বসলো খানিকটা শব্দ করেই। সেই শব্দ গিয়ে কানে লাগলো টিকলির। সে স্তব্ধ হৃদয়ে ঘুরে তাকিয়েছে বহু আকাঙ্ক্ষার… প্রমত্ত পুরুষটির দিকে। এরপর চার চোখ একত্রিত হলো দুটো হৃদপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গিয়ে একইসাথে… একইসুরে বেজে গেলো অহর্নিশ।
প্রশ্ন’টা ছিলো,
‘যে শাড়ি পড়তে চলতে যানে না, সে মেয়ে মানুষ শাড়ি কেনো পরবে রে, আসিফ?’
অথচ টিকলি আজ শাড়ি পরেনি। আসিফ হতভম্ব চোখে তাকালো।
চলবে❤️
#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১০.
আরাফ এগিয়ে এসে আদরের সাথে হাত মেলালো। গলার সাথে গলা মিলিয়ে পিঠ থাপড়ালো। আদর চোখ সরিয়ে নিয়েছে। টিকলি তখনো এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আসিফের চোয়াল ঝুলে পরেছে বুক পর্যন্ত। এতোক্ষণে টিকলির চেহারা ভালোমতো অবলোকন করে ধরতে পেরেছে ব্যাপার’টা। আদর আসিফের হা করে থাকা মুখটা বন্ধ করে দিলো এরপর ভারী পায়ের কালো সু জোড়ায় শব্দ তুলে টিকলির নাকের ডগা দিয়ে দাপটের সাথে হেটে চলে গেলো। আসিফ, আরাফও আদরের পিছে পিছে দৌড়ে গেলো।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে ঘন্টা খানেক হবে। একের পর এক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যে আদরের মনোযোগ নেই। সে গভীর চিন্তায় রয়েছে। একটু আগেই সে স্টেজে উঠে সংক্ষেপে নিজের স্পিচ দিয়েছে এবং স্পিচ দিতে দিতে খেয়াল করেছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা টিকলির পাশে একটি ছেলে দাঁড়ানো। বেশ কাছাকাছি। হলের একদম শেষ মাথায় টিকলি আর নিরব দাঁড়ানো। নিরব তখন পা দুটো আপ ডাউন করে বলে,
‘এইখানে খারায়ে কি করতাছি আমরা বাল? পা দুইটা ব্যথা হয়ে গেলো। শালা গোপাল ভাড় ম্যানেজার তো ঠিকই পেট’টা নেড়ে দিয়ে চ্যাগায়ে চেয়ারে বইসে আছে। মরণ শুধু আমাদের।’
কথাটা খারাপ বলেনি নিরব। আজ সারাটাদিন ওরা একটু বসার পর্যন্ত সময় পায়নি। এখন আবার ম্যানেজার এখানে দাড় করিয়ে রেখেছে। যদি কোনো সমস্যা হয়! আবার ডিরেক্টরও এসেছে। ওরা সবাই এক পা নড়তে পারছে না। উপরন্তু একটু পরেই ৬-৭ ঘন্টার জার্নি করে শরীরটাকে চালের বস্তার ন্যায় জোরপূর্বক টেনে-হিচড়ে ফিরে যেতে হবে। টিকলির মাথা ভনভন করে ঘুরে উঠলো। নিরবের সাথে সহমত পেষণ করে ঠোঁট কেলিয়ে দাঁতগুলো বের করে বলে,
‘চল। চাকরি ছেড়ে দেই?’
‘তারপর কি ভিক্ষা করবো? তুই ছাড়লে ছাড়। হাসি বন্ধ কর ছেমড়ি।’
টিকলি ওমনি নিরবের পিঠে ধুম করে একটা কিল বসিয়ে চোখ পাঁকিয়ে বলে,
‘তুই কাকে ধমকাস? মায়ের জাত কে ধমকাতে আছে, মূর্খ পুরুষ? মেয়েদের সাথে কথা বলতে হয় কোমল হৃদয়ে….।’
টিকলি চোখ বন্ধ করে ভঙ্গি করে বলে। নিরব মুখ বিকৃতি করে এদিক সেদিক তাকিয়ে হাই তুলে। এরপর স্টেজের দিকে চোখ যেতেই ভ্রু’দ্বয় টান টান হয়ে যায়। নিরব মুখের সামনে হাত রেখে মুখটাকে আড়াল করে আড়চোখে আদর’কে দেখতে দেখতে বলে,
‘দেখ, তোর আশিক কেমনে তাকায় আছে!’
টিকলি যারপরনাই বিরক্ত হলো। নিরবের মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘আশিক আবার কি?’
টিকলি মুখোমুখি দূর স্টেজের আদরের দিকে তাকায়। বলে,
‘কোথায় তাকিয়ে আছে? আমি তো দেখতে পারছি না।’
‘তুই তো মনের চোখ দিয়ে দেখছিস। আসল চোখ দিয়ে দেখ। ভাবখানা এমন যে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু মাল’টার চোখ’টা আসলে তোর উপর।’
টিকলি নিরবের কথা কানেই তুললো না। ওখানেই সে একটু হাটাহাটি করলো। ম্যানেজার জুস খাচ্ছে। তা দেখে নিরব দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলে,
‘ইচ্ছে করছে ভুড়ি’টা গেলে দেই। দেখ কেমন বিচ্ছিরি ভাবে জুস খাচ্ছে! মনে হয় বাপের জন্মে খায় নাই। ওই দেখ দেখ! স্ট্র তো পুরা চেটে সাবাড় করে দিলো রে গোপাল ভাড়’টা। স্ট্র সহ গ্লাস’টা বোধহয় ওর ওই ভুড়িওয়ালা ড্রামের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলবে।’
টিকলি বায়ুভর্তি মুখ ফুলিয়ে হেসে দিলো। শব্দবিহীন হাসতে হাসতে পেট ধরে ফেললো।
সেই থেকে আদরের মাথা নষ্ট। বিরবির করে বলল,
‘এই মহিলার নতুন বাতিক হয়েছে নাকি? সবার সাথে ওতো হাসাহাসি কীসের তার?’
‘হ্যাঁ? কি বললি?’ আসিফ অবুঝ বদনে আদরের মুখের কাছে কান’টা নিয়ে যায়। আদর সোফার হাতলে কনুই রেখে মুখে হাত রেখে ভাবছিলো। ভাবমূর্তি’টা বজায় রেখেই আসিফের দিকে নজর দিলো। ভ্রু উঁচালো। আসিফের কানসহ মাথাটা তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিলো। আসিফ জিজ্ঞেস করলো,
‘আমার স্পিচ’টা কেমন হয়েছে?’
আদরের সেই একই স্বর, ‘তোর স্পিচ ছিলো এখন? শুনিনি।’
আসিফের মনঃক্ষুণ্ন হলো। নিজের সিটে ব্লেজার টান টান করে ঠিকভাবে বসতে বসতে বলল,
‘বন্ধু নামের কলংক। আমি তোর স্পিচ’টা কত মনোযোগ দিয়ে শুনলাম! একদম ব্রেনে গেঁথে রেখেছি। জিজ্ঞেস করলে হরহর করে বলে দিতে পারবো আর তুই শালা আমি স্পিচ দিতে গিয়েছি সেটাই দেখোস নাই?’
আদর আসিফের ভাঙা হৃদয়ের দিকে বিশেষ কর্ণপাত করতে পারলো না। কারণ তার ফোনের ভাইব্রেশন তখন তার বুক নাড়িয়ে দিচ্ছে। সে ফোন কানে ধরে ছোট্ট করে বলল,
‘হুম?’
‘ভাইয়া আই মিস ইউ।’ আর্দ্রের কণ্ঠে আদর চুইয়ে চুইয়ে পরলো। আদর চোখ উল্টে ঠোঁট গোল করে অতিষ্ঠের একটা নিশ্বাস ছেড়ে নিচু কণ্ঠে বলে,
‘তুই আমার বোন হতে গিয়ে ভাই হয়ে গিয়েছিস বুঝলি? কেমনে কি ভাই? মেয়ে মানুষও এতো ড্রামা জানে না।’
‘ভাইয়া সত্যি আই মিস ইউ।’
‘ন্যাকামো করবি না একদম। কোন দরকারে ফোন দিয়েছিস ঝেড়ে কাশ?’
‘তোমার ইভেন্ট কয়টায় শেষ হবে ভাইয়া?’
আদর ভ্রু কুঁচকায়, ‘কেনো? কি মতলব?’
‘তুমি সবসময় আমাকে নিয়ে নেগেটিভ ভাবো কেনো?’
‘কারণ তুই আগাগোড়া একটা নেগেটিভ।’
‘আচ্ছা। মেনে নিলাম। বড় ভাই নেগেটিভ স্কয়ার হলে ছোট ভাই তো একটু আধটু নেগেটিভ হবেই।’
‘একদম কানের তিন আঙ্গুল নিচে থাপ্পড় খাবি।’
‘সাথে সাথে আম্মুকে ফোন দিবো আমি।’
‘দিস।’
‘কয়টায় শেষ হবে?’
‘কি দরকার জানার আগে সেটা বল।’
আর্দ্র হতাশ শ্বাস ফেলল। বলল, ‘আমরা একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম। কনভেনশন হলের আশেপাশেই আছি। রিসিভ করতাম তোমাকে।’
আদরের কণ্ঠ নরম হলো, ‘কিন্তু দেরি হবে তো। রাত ১১ টা বাজবে হয়তো।’
‘নো প্রবলেম। আমরা ঘুরাঘুরি করবো, ডিনার করবো, তারপর আবার ঘুরাঘুরি করবো।’
‘আচ্ছা। আমি ফোন দিবো। তখন আসিস।’
,
‘ফাইনালি ইভেন্ট শেষ! উফফ……!’
টিকলি সিলেটের শীতল বসন্তের মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। কী ভীষণ দম বন্ধকর পরিস্থিতির মাঝে যে ছিলো বাপরে বাপ! টিকলি ব্যায়াম করার ন্যায় হাত দুটো উপরে তুলে ডানে বামে কোমর টানা দিলো। ওই অবস্থাতেই আদরের বেরিয়ে যাওয়া দেখলো। পেছন পেছন রিফা। ওমনি টিকলির ভ্রু দ্বয় কুচকে গেলো। এই সিলেটের ইভেন্টেও এই মেয়ে? এটা কে? আদরের পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট নাকি? বাব্বাহ! মেয়ে এসিস্ট্যান্ট রেখেছে আবার? ভালোই তো উন্নতি হয়েছে। হোক! তাতে টিকলির কোনো যায় আসে না।
মনের উপরে নিজের ঠাঁট বজায় রেখে টিকলি বললো ঠিক তার কোনো যায় আসে না আদতে তার যায় আসছে। ঘুরেফিরে চোখদুটো গিয়ে ভিড়ছে ওই মানব-মানবীর দিকে। দেখো দেখো! কীভাবে আদরের ব্লেজার হাতে নিয়ে পেছন পেছন যাচ্ছে বউ এর মতোন! টিকলি ওমন ভ্রু কুচকে গোয়েন্দা নজরে তাকিয়ে থাকার কালেই আদরের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। টিকলির সেই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করলো। চোখ সরিয়ে হাত দুটো নামিয়ে কোমর সোজা করে বিরবির করে বলল,
‘দুশমন চোখ।’
এরমাঝে হারে রে রে.. করে কোথা থেকে যেনো আদর-টিকলির পারসোনাল ডাকাতের বংশ চলে এলো। চারিপাশে হুল্লোড় পরে গেলো আর্দ্র, টায়রা, নিভার কলধ্বনিতে। টিকলি এড়িয়ে চলে যেতে ধরছিলো কিন্তু টায়রা, নিভা গিয়ে খপ করে ধরে ফেললো। সে নাক ফুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,
‘ডাকাতের দল।’
রাহুল আদরের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। আর্দ্র গিয়ে নিরবের সাথে ভাব জমালো। ওরে বাপরে! সে কি ভাব! দুজনের ক্যাটাগরি তো সেম। নিভা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘একদম খাপে খাপে।’
টায়রা উচ্চস্বরে হাসে। টিকলি বলে,
‘আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
আর্দ্রর সাথে সাথে লাফানো উত্তর, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে মানে?’
‘ফিরতে হবে না?’
‘এই মূহুর্তে কোথাও ফিরছো না তুমি।’
আর্দ্র তার রায় জানিয়ে দেয়। কিন্তু টিকলি কি আর সোজা পাত্রী? আর্দ্রর রায়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সে লাগেজ নিয়ে হেটে যায়। নিরবের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয়,
‘তাড়াতাড়ি আয়।’
আর্দ্রও টিকলির পেছন পেছন যায় বুঝাতে বুঝাতে। টিকলি সেসব কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করে না। টায়রা-নিভা এবার নিরব’কে ওদের সাথে ঘুরার প্রস্তাব দেয়। নিরব দোনা-মোনা করে টিকলির দিকে তাকিয়ে ওদের দিকে অসহায় চোখে তাকায়। টিকলি বাসে উঠবে ওই মূহুর্তে আর্দ্র দু’হাত জোড় করে হাটু ভেঙে বসে পরে। কান্নার অভিনয় করে বলে,
‘প্লিজ, সোনা বোন আমার।’
টিকলি তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে। আর্দ্র’কে উঠিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলে,
‘কি করছেন, ভাইয়া?’
আর্দ্র ছলছল চোখে তাকায়। ওরে কী নাটক! পাঠক যদি সেই মেলোড্রামা একবার দেখতে পারতো। পুরাই কমেডি শো!
‘আমার হানিমুন’টা এভাবে নষ্ট করে দিয়ো না, টিকলি। আমার এখনো বাসর হয়নি। তোমার বোন’কে বুঝিয়ে প্লিজ আমার হানিমুন ট্রিপ’টা সার্থক করো।’
টিকলির কান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো। এমন বেহায়া আর বাসর পাগল মানুষ এজনমে আর দুটো দেখেনি সে। তখন নিরবও কাচুমাচু হয়ে নিচু কণ্ঠে বলে,
‘এসেছি যখন তখন ঘুরেই যাই। বাপের জন্মে যদি আর না আসতে পারি? হায়াত-মউতের কথা তো বলা যায় না।’
টিকলি হতাশ শ্বাস ফেললো। আর্দ্র আস্তে করে টিকলির লাগেজ হাতে নিয়ে কুর্নিশ জানিয়ে টিকলিকে সামনে পা রাখতে ইশারা করলো। টিকলি অসহ্য চোখে তা দেখে বিরবির করে পা বাড়ালো, ‘বাসর পাগল ছেলে। ড্রামাবাজ একটা!’
টিকলি নিরবের মুখের উপর ওর ভ্যানিটি ব্যাগ ধরিয়ে দিলো। অন্যসময় হলে নিরব চেঁচিয়ে উঠতো কিন্তু এই মূহুর্তে ব্যাগ’কে বগলদাবা করে সে টিকলির পিছু পিছু ছুটে গেলো এসিস্ট্যান্টের ন্যায়। আদর বুকে আড়াআড়ি ভাবে হাত বেঁধে গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। রাহুল বলল,
‘সবাই তাহলে গাড়িতে উঠি?’
সবাই হৈহৈ করে গাড়িতে উঠলো। আদর ড্রাইভিং সিটে। টায়রা পেছনে গিয়ে বসতে বসতে বলল,
‘টিকলি তুই সামনে বয়।’
নিভা হেসে কুটিকুটি হয়ে উত্তর করে, ‘টিকলি বয় না গার্ল।’
চলবে❤️