#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১৭.
ধরার বুকে চৈত্রের খরায় রুপোলী মেঘের ঝালর কেটে আচমকাই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এলো। আকাশের কোনো ডাকাডাকি নেই। ওয়েদার ফোরকাস্টে বৃষ্টি আসার কোনো নামগন্ধ নেই। গগণতলে কালো মেঘের বিস্তার নেই। চারিদিকে ঝিলমিলে রোদ চুইয়ে পরছে। সেই সাদা ঝিকমিকে রোদ্র চুয়ানো বৃষ্টিতে কনে দেখার এক ফালি সরু সোনালী আলোয় টিকলির মুখখানা স্বর্ণবর্ণ হয়ে উঠলো। মনে পরলো, প্রেমপবনের বিদায় হয়ে গেছে বহুদিন হলো। ব্যস্ত শহরের অলিতে-গলিতে একফোঁটা অবসরের ফাঁকফোঁকর না রেখে ওরা ব্যস্ত হয়ে গেলো পুরোদস্তুর।
অলস দুপুরে অন্যরা ভাতঘুম দেয় কিন্তু টিকলি দিচ্ছে কাজঘুম। সামনে ল্যাপটপ খোলা। তারপাশে ফোনটা পিজরাপোলের আসামীর ন্যায় পরে থাকা। টিকলির মাথার কাছে রিমোট পরে আছে অযত্নে। টিভি চলছে জিরো ভলিউমে। বার্তাবিহীন ঘুমে সে ঢলে পরেছে সফেদ কাউচে। পাঁচমিনিটের জন্য ন্যাপ নিতে গিয়ে পেরিয়ে গেছে ৪৫ মিনিট। ফোনটা অত্যন্ত কর্কশ স্বরে না বেজে উঠলে এ যাত্রায় টিকলির আর বাঁচা সম্ভব হতো না। হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে ফোন ধরে সে বলল,
‘জি, স্যার।’
‘স্যার? ম্যাডাম ডাক।’
টায়রার কণ্ঠে টিকলি কপালে হাত রেখে দম নিলো। সে ভেবেছিলো পেটমোটা ম্যানেজার’টা ফোন দিয়েছে এখনো ডকুমেন্ট সাবমিট করেনি বলে। এক ঘন্টা টাইম দেওয়া হয়েছে। হাতে আছে আর মাত্র পনেরো মিনিট। টিকলি শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘুমুঘুমু কণ্ঠে বলল,
‘এবার আমি রিজাইন করবোই রে। এই পেটকুর আন্ডারে থাকলে এ জীবনে আমার দুঃখের আর কোনো শেষ হবে না।’
‘তুই তোর দুঃখ নিয়ে আছিস। আর এদিকে আমাকে ওরা পশু পাখি বানিয়ে ফেলছে।’
‘তোর প্যানপ্যান শুনার কোনো মুড নেই আমার এই মূহুর্তে। ফোন রাখ।’
টিকলির বিরক্তি মাখা কণ্ঠকে টায়রা তেমন পাত্তা দিলো না,
‘জানিস আজকে ওই ভাদ্র আমাকে কুকুর ডেকেছে।’
টিকলি টান টান হয়ে বসলো এবার। আগ্রহী গলায় শুধালো,
‘তাই নাকি? তোর জামাইয়ের বুকের পাটা বড় হচ্ছে। ইউ শ্যুড বি প্রাউড। কীভাবে ডাকলো?’
পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলা মনোয়ারা খানের কাছে তার ত্রিবর্ণ বিগল জাতের ছোট্ট কুকুরটি রেখে গেছেন একদিনের জন্য। সাদা,কালো, বাদামি মিশেলে গায়ের বর্ণ। ছোট, দুষ্টু প্রকৃতির এই কুকুরের লম্বা কান, মিষ্টি মুখাবয়ব। টায়রা সারাবেলা ওর সাথে খেললো। সন্ধ্যার দিকে আর্দ্র যখন বাড়ি ফিরে স্বভাবত টায়রাকে ডেকে গেলো তখন এই কুকুর ছুটে এসে ঘেউ ঘেউ করা শুরু করলো। আর্দ্র অকস্মাৎ ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে ভীত কণ্ঠে বলে উঠে,
‘তুমি কে? আমি আমার বউকে ডাকলাম তুমি এলে কেনো? ওর জাত চিনলে কীভাবে?’
টিকলি পানি খাচ্ছিলো। টায়রার ক্রন্দরযুক্ত ভঙ্গিমার স্বরে বলা কথা শুনে মুখ থেকে পানি বের করে হেসে উঠলো। টায়রা বোনের কাছে কোনো ফায়দা না পেয়ে আক্রোশে ফোন কেটে দেয়।
____________________
বিকালের মিটিং এ টিকলি জানতে পারলো ওদের কোম্পানি আজ ‘Lifecare Memorial Hospital’ এর সাথে বিভিন্ন ধরনের সেমিনার/কনফারেন্স আয়োজনের জন্য এক বছরের চুক্তিতে সাইন করবে। টিকলির মাথায় যেনো গোটা আসমান ঝুরঝুর করে ভেঙে পরলো। বজ্রাহতের ন্যায় নির্বাক স্তব্ধ মনিতে স্ট্রেইট বসে রইলো। কোনো নড়াচড়া নেই। নিরব ফিসফিস করে বলল,
‘মাথার উপরে ঠাডা পরলো?’
টিকলি কটমটে দৃষ্টিতে তাকায়। বিশাল বড় লম্বা টেবিলে বিশ জনের মিটিং বসেছে। মিটিং শেষে টিকলি ম্যানেজারকে ধরলো,
‘স্যার, আমাদের ইভেন্ট কোম্পানির নাম এটা দিলে কেমন হয় ‘Event company for just Hospital’.’
ম্যানেজার ভ্রু কুচকে তাকায়। টিকলি নাক ফুলিয়ে বলে,
‘এই ডক্টর রিলেটেড ছাড়া আর কোনো কাজ নেই? আমি এই টিমে জয়েন হতে পারবো না। আপনি অন্যজনকে রিপ্লেস করুন।’
ম্যানেজার তেমন পাত্তা দিলেন না, ‘বাজে কথা না বলে প্রিপেয়ার হও। তোমাকে এই টিমেই থাকতে হবে।’
‘স্যারর…!’
‘তোমার কিছু বলার থাকলে ডিরেক্টর এর সাথে গিয়ে কথা বলো। আমার সাথে কোনো কথা নেই।’
বলে ম্যানেজার চলে আসতে লাগলেন। টিকলি পেছন থেকে বলল,
‘আমি রিজাইন করবো আজকে।’
‘ওকে। টক টু ডিরেক্টর।’
‘স্যার….।’
সাইন সিরেমোনি হলো লাইফকেয়ার হসপিটালের Chief Executive Officer বেলাল চৌধুরীর সাথে ‘Moment and more’ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ডিরেক্টর রেজাউল করিমের। সেলিব্রেশন হলো। কেক কাটা হলো। হাত তালি হলো। টিকলি বলহীন অনিচ্ছায় হাত তালি দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কারণ এই হসপিটালের নিউরোসার্জন ডাঃ আদর খান।
,
সবশেষে ক্লান্ত শরীরে রাত নয়টায় যখন টিকলি ঘরে ফিরলো ড্রইংরুমের উপস্থিত মানুষগুলোকে দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেলো। পা দুটো মেঝের সাথে আটকে রইলো। অবাকতায় সামনে চেয়ে থাকলো একদৃষ্টিতে বহুক্ষণ। দুরুদুরু বুকে সে ধীর পায়ে এগিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। সাত’টা মাস পর বাবার মুখ দেখছে সে। বাবার কণ্ঠ শুনছে। বাবাভক্ত টিকলি বাবার অতি আদরের, যত্নের মেয়ে। সে আলগোছে বাবার বুকে মাথা রেখে চোখের পাতা বন্ধ করলো। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে পরে গেলো চৈত্রের তাপের ন্যায় উষ্ণ দু’ফোটা জল। জামিলুর রেজা মেয়েকে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠেন। পাশে বসা টায়রা, শায়লা আক্তার সজল চোখে দেখে প্রশান্ত চিত্তে হাসেন। টায়রা বলে,
‘এ্যাহ! সব আদর শুধু ওকেই? আমি ফেলনা? মা, তুমি আমাকে আদর করো।’
শায়লা আক্তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন বুকের মাঝে। কত্তদিন পর তার পরিবার একসাথে হলো। জামিলুর রেজা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘বাড়ি চল, মা।’
টিকলি হাসে। বলে, ‘বাবা, তুমি শুকিয়ে গেছো।’
‘যাবি না?’
টিকলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরক্ষণেই মিষ্টি করে হেসে বলে,
‘যাবো না কেনো? অবশ্যই যাবো। এখানে সবকিছু গোছানো, বাবা। সবকিছু সাজিয়ে নিয়েছি। হঠাৎ করে মুভ অন করতে গেলে একটু প্রবলেমে পরে যাবো।’
জামিলুর রেজা বুঝমানের মতোন মাথা নাড়ালেন। ক্ষীণ আওয়াজে বললেন,
‘আমি আজিম খানের সাথে দেখা করেছি।’
টিকলির ভ্রু’দ্বয়ে কুঞ্চন দেখা গেলো। সম্পর্কে বেয়াই হয়। দেখা করতেই পারে। এটা এতো ঘটা করে বলার কি আছে? তবুও টিকলি বলল,
‘ভালো করেছো, বাবা।’
‘তোরা যখন সিলেটে ছিলি তখন।’
‘কেনো?’
‘দেখ মা, আমার জেদ তো তোর থেকে বড় নয়। আমার সন্তানের জীবন কি তুচ্ছ? একমাত্র আমাদের দম্ভের জন্য তোদের জীবনের কতগুলো সময় নষ্ট হলো। আমি দুঃখিত, মা।’
টিকলি মা আর বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না, বাবা।’
‘আমরা তোর আর আদরের বিয়ে ঠিক করেছি। এখন তো তোর আর আপত্তি নেই। তুই তো চেয়েছিলি আমাদের দোয়া নিয়ে বিয়ে করতে? জীবন’টা নতুন করে শুরু কর, মা। এই বুড়োদের কথা শুনে অভিমান করতে আছে বল?’
টিকলি সে প্রশ্নের উত্তর দিলো না। সে চোখ তুলে পূর্ণদৃষ্টি ফেললো টায়রার উপর। যার অর্থ ‘এসবের মানে কি? তোর কাজ? তুই সব জানতি?’ বোনের দৃষ্টি দেখে টায়রা মায়ের পেছনে লুকালো।
_____________________
আদর সবে O.T শেষ করে বের হলো। দীর্ঘ তিন ঘণ্টার অপারেশন। নিজের জন্য বরাদ্দ চেম্বারে ঢুকে সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। পানি খেলো। ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ঢললো। হাত পায়ে টানা দিলো। এরমধ্যে রিফা দরজায় নক করে ঢুকলো,
‘স্যার, আপনার জুস।’
‘ধন্যবাদ।’
রিফা চলে আসতে নিচ্ছিলো তখনি আদর ডেকে উঠলো,
‘রিফা।’
‘জি, স্যার।’
‘তোমাকে আমার হয়ে আর কাজ করতে হবে না।’
‘কেনো স্যার? আমি কি কোনো ভুল করেছি?’
‘না। তোমার জন্য অনেক প্রেশার হয়ে যায়। অফিশিয়ালি আমার পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট হয়ে থাকার দরকার নেই।’
রিফা করুণ চোখে তাকালো আদরের দিকে। উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে পরলো। বাইরে আসতেই মা ফোন দিলো,
‘রিফা, তোর জন্য একটা দারুন সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে সরকারি চাকরি করে। বয়স ৩২। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো। বাবা উকিল। এবার অন্তত দেখ ছেলেটাকে।’
‘ঠিকাছে মা।’
চলবে❤️
#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১৮.
বাবা-মার চোখের আড়ালে টায়রার হাত শক্ত ভাবে চেপে ধরে রুমে ঢুকিয়ে ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো টিকলি। ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলে উঠলো,
‘এইসব তোর কাজ?’
‘আমার কাজ কীভাবে হবে? আমি তো তোর সাথেই….।’
ছুটে আসা আগুনের ফুলকির ন্যায় টিকলির রাগের ধমকে টায়রার কথা আর শেষ হয় না। কেঁপে উঠে সে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে।
‘হ্যাঁ নাকি না?’
টায়রা ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে অসহায় চোখে বলে, ‘আমি কিছু করিনি তো!’
‘এক থাপড়ে সব দাঁত ফেলে দেবো, বেয়াদব। এরজন্য আমার এক কথায় বাসরের জন্য রাজি হয়েছিলি তুই? আর এদিকে আমি হিসাব মেলাতে পারছিলাম না তোর এতো সহজে সবকিছু মেনে নেওয়ার।’
টায়রা কোনো উত্তর করে না। চুপচাপ আলাভোলা মুখে দাঁড়িয়ে থেকে পা দিয়ে ফ্লোরে খুটতে থাকে। টিকলি বড় করে শ্বাস নিয়ে চোখ কুচকে বলে,
‘কবে থেকে চলছে এসব প্ল্যান?’
‘জানি না।’
‘তুই বলবি না?’
টিকলির বড় বড় চোখ করা হুমকিতে টায়রা দাঁত খিচে বলে,
‘বলছি। এরকম করিস না। ভয় লাগে।’
‘নাটক না করে বল বা*ল।’
‘মাস খানেকের মতো হবে। মা একদিন ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বলছে, বাবা নাকি তোর ছোটবেলার ছবিগুলো দেখছিলো। দেখতে দেখতে টলমলে চোখে দরজা আটকে রুমে বসে থাকে মারও তোর জন্য খারাপ লাগছে। পরে আমি মাকে বলেছিলাম তোর সাথে আদর ভাইয়ার বিয়েটা আবার ঠিক করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মা হয়তো এই কথা বাবাকে বলেছিলো। তারমধ্যে আমরা সবাই একসাথে সিলেট গিয়েছি শুনে বাবা ভেবেছে তোর আর আদর ভাইয়ার মধ্যে এখনো সম্পর্ক আছে। পরিবারের কথা ভেবে তোরা এগুচ্ছিস না। তাই বাবা আমার শশুড়ের সাথে দেখা করেছে।’
টিকলি আক্রোশে চোখ মুখ বন্ধ করে টায়রার গালে ঠাস করে একটা চর মেরে হুংকার দিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘আমি তোদের সাথে সিলেটে থাকতে চেয়েছিলাম?’
টায়রা চর খেয়ে গালে হাত রেখে টলমলে চোখে ফ্লোরের দিকে চেয়ে ডানে বামে মাথা নাড়ায়। টিকলি মাথার চুল খামচে ধরলো। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে খাটে গিয়ে বসলো। হাত ধরে টেনে বসালো টায়রাকেও। টায়রার মাথাটা নিজের বুকে নিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘ওইদিনের ওই কথাগুলোর জন্য সে আমাকে একবারো সরি বলেনি। ওর মধ্যে কোনো অনুতপ্ত বোধের চিহ্ন নেই। বাবাকে ছোট করে দিলি আবার।’
টিকলি গলা’টা ধরে এলো। বুকে পাথর বেঁধে স্তব্ধ হৃদয়ে বলে উঠলো,
‘আদর আমাকে ভালোবাসে না, টায়রা। আমার জীবনে এরচেয়ে বড় কোনো দুঃখ নেই। এরথেকে ব্যর্থ আর কোনো শব্দ নেই।’
টিকলি সিলিং এর দিকে মুখ করে বেহায়া চোখের জলগুলো ঠেসেঠুসে আবার চোখের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে টায়রাকে চুমু দিয়ে গালে খানিকটা আদর করে ওকে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ড্রইংরুমে জামিলুর রেজা, শায়লা আক্তারের উচ্ছ্বাস শোনা যাচ্ছে। চোখে মুখে প্রফুল্লতা দুই মেয়েকে পেয়ে। টিকলি সেই উৎফুল্লতা মন ভরে চেয়ে দেখলো। আজ রাতে ওরা সবাই টিকলির কাছেই থেকে যাবে। টিকলি মৃদু স্বরে নিজের রক্তক্ষয়ী বুক’কে জানান দিলো,
‘কি হতো যদি এই পরিবর্তন’টা আরো আগে আসতো?’
,
খান বাড়িতে বহুদিন বাদে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। খাবার টেবিলে আজিম খান আদরের জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের বাবা-ছেলের মাঝে মতের মিল কোনোকালেই ছিলো না। উপরন্তু ছেলের পছন্দের মেয়ের বিপক্ষে গিয়ে দেখা গেলো বিগত সাত মাস থেকে তাদের একসাথে খাবার টেবিলে বসা তো দূর মুখদর্শনটুকু পর্যন্ত হয় না। মায়ের ফোন পেয়ে অনিচ্ছায় আদর বাড়ি এলো দশটার দিকে। খেতে খেতে কিসব কথা বলার জন্য নাকি তাকে ডাকা হয়েছে। সে ঘন্টাখানেকের জন্য বাড়িতে এলো। চেয়ারে বসতে বসতে আড়চোখে বাবাকে দেখে নিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘কি হয়েছে তাড়াতাড়ি বলো। এক ঘন্টার সময় নিয়ে এসেছি আমি। অলরেডি দশটা বিশ বাজে।’
বাপ যে এখানে আছে তা ছেলে বেমালুম ভুলে গেছে। বাপের সাথে কোনো কুশল বিনিময় নেই। সালাম-কালাম নেই। এলো। হাত মুখ ধুলো। মাকে ক’টা খাবার দিতে বললো। খেতে খেতে তাড়া দিতে শুরু করলো। একটা বেয়াদব, বেপরোয়া ছেলে। শুধু কি একটা? তার বউয়ের পেট থেকে বের হওয়া দুটোই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেপরোয়া, বেহায়া দুটো ছেলে। অকালকুষ্মাণ্ড! অপদার্থ!ছোট’টার তো লাজ লজ্জার বালাই নেই আর বড়’টার দেহে, প্রাণে কোথাও কোনো ভয় ডরের ছিটে ফোঁটা নেই। সেই সাথে আজিম খানের বউয়ের পেট থেকে বের হওয়া এই দুই ছাগলের মধ্যে একটা মিল হলো- দুটোর মধ্যেই কোনো আদব-কায়দার বালাই নেই। দেখো দেখো কেমন বেয়াদব ছেলে! বাপ বসে আছে সামনে আর একজন ফোন গুতিয়ে খাচ্ছে আরেকজন মাথা নিচু টপাটপ করে খেয়ে যাচ্ছে। যেনো এই জগৎ দুনিয়ায় এই মুহূর্তে ওই খাওয়া ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বিষয় নেই। আজিম খান স্ত্রীর দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন। বিনিময়ে মনোয়ারা খান ফিরতি ইশারা দিলেন। আজিম খান চোখ পাঁকিয়ে দেখে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ নামক খাওয়া থেকে মুখ তুলে আদর অতি সাধারণ ভাবে প্রশ্ন করলো,
‘কিছু বলবে?’
আজিম খান অপ্রস্তুত হলেন। আমতাআমতা করে থমথমে মুখে উত্তর দিলেন, ‘না।’
‘তাহলে মায়ের চোখে চোখে কথা বলা বন্ধ করো। এতো কথা থাকলে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বলো।’
‘বেয়াদব ছেলে।’
মনোয়ারা খান ছেলেদের প্রতি কারোর হামকি ধামকি বরদাস্ত করেন না। তিনি মুখ টানা মেরে বললেন, ‘তোমারই তো ছেলে।’
‘তুমি চুপ থাকো, ছেলে পাগল মহিলা। তোমার পেট থেকে বের হয়েছে দেখেই এরকম বেয়াদব হয়েছে। আমার পেট থেকে বের হলে কোনোদিনও এতো অসভ্য হতো না।’
আর্দ্র কিটকিটিয়ে হেসে উঠে বলে, ‘আব্বু, আমি তোমার পেট থেকে বের হয়েছি? নাহলে এতো ভদ্র বাচ্চা কি করে হলাম?’
‘ভদ্র না ভাদ্র?’ আদর খেতে খেতে উত্তর দেয়। আর্দ্র চিৎকার করে উঠে,
‘ভাইয়া…… এমনিতে আমার বউ বাড়িতে নেই এই শোকে খাওয়া দাওয়া ভুলে গেছি। তুমি আবার মনে করিয়ে দিলে? এখন তো আমার খাবার আর গলা দিয়ে নামবে না, আম্মু।’
আর্দ্র মুরগীর রানে বড় করে কামড় দিয়ে ছিড়ে নিলো। আজিম খান কপাল কুচকে দেখে বলেন,
‘ও বলে আমার পেট থেকে বের হয়েছে। ছ্যাহ!’
আদর পানির গ্লাস হাতে নেয়। মনোয়ারা খান তাতে পানি ঢেলে দেন। পানি খাওয়া শেষ করে রয়েসয়ে আদর বলে,
‘চলো, বাবা। তোমাকে জাদুঘরে রেখে আসি সাথে তোমার ছোট ছেলেকেও। ব্রেকিং নিউজ হবে বাপের পেট থেকে ছেলে বের হয়েছে। এতোদিনে এই গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছে। বড় ছেলে তাদের সংরক্ষণ করে জাদুঘরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
‘চুপ থাকো। অসভ্য সব।’
আদর হাত ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুছে নিলো। বাবার মুখোমুখি চেয়ার নিয়ে বসে বলল,
‘তোমার হাতে আর মাত্র বিশ মিনিট সময় আছে। কিছু বলতে চাইলে বলতে পারো। নাহলে আমি রুমে গেলাম।’
আজিম খান বিরক্তির চোখে তাকালেন। কি খেয়ে যে এগুলোকে জন্ম দিয়েছিলেন মনোয়ারা খান। দুটোই তাকে চাপের মুখে রাখতে উস্তাদ। আজিম খান নড়েচড়ে বসলেন,
‘টিকলির বাবার সাথে দেখা হয়েছে।’
আদর ভ্রু কুচকায়। আর্দ্র ভাইয়ের কানে ফিসফিস করে,
‘ডালমে কুচ কালা হে ভাইয়া তা নাহলে টায়রার বাবা থেকে টিকলির বাবা’তে কীভাবে কনভার্ট হলো?’
চিকন ভ্রু জোড়া কুচকে আদরও তাই ভাবলো। এই প্রথমবার আর্দ্রর ভাবনার সাথে আদরের ভাবনা মিল খেলো। আদর বাবার দিকে চেয়ে রইলো আরো কিছু শোনার অপেক্ষায়,
‘তিনি তোমার আর টিকলির বিয়ের কথা বলছিলেন। আমিও ভাবছিলাম কিন্তু তোমাদের মতো অসভ্য ছেলে যার ঘরে আছে সে তো কোনো কিছুতে ভরসা পায় না। দেখা গেলো মত পাল্টে এবারো বিয়ে করলে না। লোকটার কাছে আমার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছিলো অপরাধ বোধে। যে কাজ আমার করার কথা ছিলো। যেখানে মাথা নিচু আমার করার কথা ছিলো সেখানে মেয়ের বাবা হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।’
পারতপক্ষে জামিলুর রেজা কিছু না জানলেও খান বাড়ির সবাই জানেন কেনো ওদের বিয়ে হয়নি। কারণ, ওই আর্দ্র! সেই রাগের চোটে আর্দ্র তখন দেড় মাস ভাইয়ের মুখদর্শন পর্যন্ত করেনি।
আদর কতক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না। থম মেরে অপ্রস্তুত, বিনষ্টবুদ্ধির ন্যায় বসে রইলো। বেশ অনেকক্ষণ বাদে সেন্টার টেবিলের উপরে খুলে রাখা ঘড়িটা হাতে পরে নিলো। মানিব্যাগ, ফোন পকেটে ঢুকালো। আজিম খান জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমি কি রাজি?’
আদর নিজ গন্তব্যে যেতে যেতে ছোট করে উত্তর দেয়, ‘হুম।’
‘ভেবে জানাও।’
‘ভাবাভাবির কিছু নেই। তোমরা সব ঝামেলা পাকিয়েছিলে তোমরাই সব ঠিক করছো। আমরা কলের পুতুল।’
আজিম খান জোরদার গলায় বলেন,
‘আমরা কোনো ঝামেলা পাকাইনি। প্রথমবার, শেষবার সববার ঝামেলা তুমি পাকিয়েছো। প্রথমবার এসে বলেছো মেয়ে প্রেগন্যান্ট আর শেষবার বেয়ারাদের মতোন তল্পিতল্পা বেঁধে সবগুলোকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আমার মান সম্মান ডুবিয়েছো। আবার বিয়ে না করে ফেরত এসে মেয়েটার মান সম্মান খুইয়েছো।’
আদর নিজের মতো চলে গেলো। আজিম খানকে একবার বলতে ইচ্ছে করলো,
‘ওর মান সম্মান আমি ডুবাইনি, বাবা। ও নিজে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি। তার ভালোবাসা’টা ঠিক লাল টকটকে ছিলো না। ফিঁকে ছিলো। সেই সাথে আমার জীবন’টাও ফিঁকে করে দিয়ে গেলো।’
চলবে❤️
#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১৯.
টায়রা মহা চিন্তিত মুখে বসে ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। আদর তো হ্যাঁ বলে খালাস। এরপর এই বিষয় নিয়ে আর কোনো শব্দ বিনিময় করেনি সে। কিন্তু বিপত্তি’টা বাঁধিয়েছে টিকলি। পাঁচ দিন হতে চললো অথচ তার দিক থেকে এখন অবধি কোনো রেসপন্স আসেনি। সবাই বিষয়’টা বুঝলেও জামিলুর রেজা এবং শায়লা আক্তার কিছু বুঝতে পারছেন না। তারা চিন্তিত ভঙ্গিতে ভেবে চলেছেন মেয়ে বোধহয় তাদের ক্ষমা করতে পারেনি। ওদিকে আদরের এসব নিয়ে কোনো হেল-দোল নেই। সে যেন নিশ্চিত জানতো এ হবারই ছিলো। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। নিজের রুটিন মাফিক চলছে সে।
এরমাঝে আরেক কান্ড ঘটেছে কাল। জানা গেলো নিভা প্রেগন্যান্ট। শুনার পর থেকে আর্দ্রর মন’টা খারাপ। মন খারাপের কারণও টায়রা বুঝতে পারছে তবে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। টায়রার এটেনশন না পেয়ে শেষমেশ আজ সকালে আর্দ্র বলেই ফেললো,
‘এতোদিনে আমার বাচ্চাও আপনার পেটে এসে যেতো। আপনার বাচ্চামোর জন্য আমি জীবনযুদ্ধে রাহুলের থেকে পিছিয়ে পরলাম।’
টায়রা চোখ উল্টে তা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো। রাহুল পারে না নিভাকে মাথায় তুলে রাখতে। আজ তাদের প্ল্যান ছিলো একবার টিকলির বাসার দরজায় নক করার। কিন্তু এখানে এসে দুর্বিপাক বাঁধলো রাহুল। সে নাকি তার বউকে এই রুম থেকে ওই রুমেও কোলে কোলে নিয়ে ঘুরছে। তার বউয়ের এই মূহুর্তে কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই। টায়রা মুখ টানা মারলো। আদিখ্যেতা দেখলে আর বাঁচি না! অগ্যতা নিভাকে ফোন লাগালো,
‘খেয়েছিস কিছু?’
নিভা যারপরনাই বিরক্ত হলো,
‘ঠিক ঘড়ি ধরা পঁয়ত্রিশ মিনিট আগে ফোন দিয়েছিলি। আধ ঘণ্টা পর পর খাবো? খাইয়ে খাইয়ে মেরে ফেলতে চাস আমাকে তোরা? আর কারোর বাচ্চা পেটে হয় না?’
বাস্তবিক অর্থে নিভা রাহুলকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো বললো। রাহুলের সাথে তার নিরব অভিমান চলছে। টায়রা মিনমিনে কণ্ঠে শুধালো,
‘রাহুল ভাইয়া পাশে?’
নিভা সরে এলো। নিচু কণ্ঠে বললো,
‘হ্যাঁ। কাল থেকে আমার সাথে চিপকে আছে তোর ভাই। আগে ভেবেছিলাম তোরা নির্লজ্জ। কিন্তু তোর ভাই আরো বড় নির্লজ্জ। আব্বু ফোন দিয়ে বললো, ‘ওকে নিয়ে একটু ঘুরে যাও, বাবা।’ তোর ভাই কি উত্তর দিয়েছে জানিস? ‘আমার বউ কোথাও যেতে পারবে না, বাবা। আপনি আপনার বউ নিয়ে এসে আমার বউকে দেখে যান। ওকে আমি রান্নাবান্না করতে দিচ্ছি না, অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছি। আর এই দুই ঘণ্টার জার্নি করে জ্যাম ঠেলে আপনার বাসায় যাবো? ইম্পসিবল।’ আরো কি করছে জানিস? একটু পর পর এটা সেটা নিয়ে এসে খাওয়াচ্ছে। এই ফল, এই ডিম, এই ব্রেড, এই ভাত, এই জুস, এই দুধ। ওয়াশরুমে গেলেও আমার পেছন পেছন গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। উফফ… উফফ বিরক্ত হয়ে গিয়েছি আমি কাল রাত থেকে। বাকি তিনদিন যে কীভাবে পার করবো!’
টায়রা চোখ মুখ কুচকে বললো,
‘তোর বরের বউয়ের তাও বাচ্চা পেটে হয়েছে আর কারোর হয় না! যাই হোক, টিকলির কাছে যাবি না?’
‘যাবো তো অবশ্যই। কান্নাকাটি করে হলেও যাবো। তোর ভাই আবার আমার চোখের পানি দেখতে পারে না। এখন তো আরো পারবে না। আগামী নয়টা মাস তোর ভাইকে একদম নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবো রে।’
নিভা কিটকিটিয়ে হাসে। তখনি রাহুলের ডাক আসে,
‘নিভা, ঠিক আছেন? এদিকে আসুন। এতো কী গোপন আলাপ যে দূরে গিয়ে কথা বলতে হয়?’
টায়রা ফোন থেকে শুনে বলে, ‘যা যা। তোর বর আবার হার্ট এ্যাটাক করবে বউকে দেখতে না পেয়ে।’
কাল রাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে…গাছ উড়িয়ে ঝড় উঠেছে…মেঘ চিড়ে বজ্রপাত ঘটেছে। সেই চৈত্রের বৃষ্টির ছটা এখনো প্রকৃতিতে লেগে আছে। ঝিম ধরা শীতল পবন…মাটির সোঁদা গন্ধ….গাছের পাতার ঝকঝকে সবুজ রঙ…। নিভা রাহুলের কাছে গেলো। রাহুল আধশোয়া হয়ে বসেছিলো। নিভাকে নিজের হাতের উপর শুইয়ে নিজেও শুলো। কাথা তুলে দিলো বুক পর্যন্ত। বারান্দার পর্দা সরিয়ে থাই গ্লাস খুলে রাখা। সূর্যের জোর নেই। রোদ্র নেই। কেবল কালবৈশাখী ঝড়ের আগমন বার্তা। রাহুল নিভার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কপালে চুমু দিলো। নিভা চোখ বন্ধ করে স্বামীর সোহাগ প্রাণ ভরে উপভোগ করলো কতকটা ক্ষণ। রাহুল নিভার পেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো নিভা মিষ্টি করে হেসে শুধালো,
‘মেয়ে চান নাকি ছেলে?’
রাহুলও বন্ধ ঠোঁটে মৃদু হেসে জবাব দেয়, ‘আপনি কি চান?’
‘মেয়ে এই না না ছেলে।’
রাহুল হেসে উঠে নিভাকে জড়িয়ে ধরে। সেই হাসিতে তার দাঁত দেখা যায়। প্রসন্ন হেসে নিভার চুলে গাঢ় চুমু খেয়ে বলে,
‘আপনি যেটা চান সেটাই।’
নিভা রাহুলের বুকে মুখ গুঁজে হাসে। শক্ত করে চুমু দেয় বুকের লোমের ভাঁজে। গেঞ্জির বোতাম খুটতে খুটতে বলে,
‘শুনুন না!’
‘বলুন না!’
‘ভালো লাগছে না একটু ঘুরতে নিয়ে চলুন।’
‘টিকলির বাসায় যেতে চান এই তো?’
নিভা ছোট করে উত্তর দেয়, ‘হু। যাই প্লিজ?’
‘না। কিছুদিন পরে যাবো।’
‘আজকেই যাই? আমার মন খারাপ লাগছে। এই সময় মন ভালো রাখতে হয় তাহলে বাবুরও মন ভালো থাকবে।’
‘একদম জায়গামতো ঢিল মারা শিখে গেছেন।’
নিভা লুকিয়ে হাসে। রাহুলের বাকিটুকু ব্রেনওয়াশ করে বলে,
‘আসার সময় আমরা ডাক্তারও দেখিয়ে আসবো, ঠিকাছে?’
রাহুল জোরেসোরে হেসে নিভার ঠোঁটে শুষ্ক চুমু খায়। বলে,
‘আপনি তো আমাকে একদম আগাগোড়া কন্ট্রোল করতে শিখে গেছেন।’
_______________________
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে টায়রা, নিভা। রাহুল নিভাকে রেখে এক কলিগের সাথে দেখা করতে গিয়েছে এই সুযোগে। টিকলি ভ্রু কুচকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে মিনিট পাঁচেক ধরে। নিভা দুর্বলতার ভান ধরে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করলো,
‘তুই আমাকে দেখতে যাবি তো দূরের কথা উলটে আমি তোকে দেখতে এলাম তাও আবার পাঁচ মিনিট ধরে দাড় করিয়ে রেখেছিস।’
টিকলির সোজাসাপ্টা কথা, ‘আমার বাসায় আমি তোদের ঢুকতে দেবো না।’
টায়রা উপয়ান্তর না পেয়ে টিকলির দিকে চোখ কুচকে তাকিয়ে ওর হাতের নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। নিভা ব্যর্থ চোখে তাকিয়ে টায়রার পথই অবলম্বন করলো। টিকলি বড় করে শ্বাস ফেলে দরজা লাগিয়ে ভেতরে ঢুকে সরাসরি বলল,
‘তোরা যা বলতে এসেছিস সেটা বাদে আর কিছু থাকলে বলে চলে যা।’
নিভা বলে, ‘এমন করিস কেন? কিছু খাওয়া।’
টায়রা বলে, ‘তোকে নাকি তোর বর খাওয়াতে খাওয়াতে মেরে ফেলছে? আবার এসেই খাই খাই শুরু করেছিস?’
নিভা চোখ পাকিয়ে তাকায়। টিকলি রান্নাঘরে গেলো। মিনিট কতক পরে জুস, কিছু ড্রাই ফুটস, চিকেন স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিয়ে এসে ওদের সামনে ঠাস করে ট্রে টা রেখে বলল,
‘তাড়াতাড়ি গিলে বাসা থেকে বের হয়ে যা।’
‘যাবো যাবো। তোর বাসায় থাকতে আসিনি।’
ওরা আস্তে-ধীরে খেলো। এরপর একসাথে মুভি দেখতে বসলো। গল্প-গুজব করলো। উচ্চস্বরে হাসলো। ওরা এসেছে তখন প্রায় ঘন্টা তিনেক হতে চললো। আশ্চর্যজনক ভাবে ওরা একবারও বিয়ের ব্যাপার নিয়ে কোনো কথা তুললো না। টিকলি স্বাভাবিক হয়ে এলো। নিভার পেটে হাত রাখতেই অনুভব করলো এ যেন তার সন্তান। মৃদুস্বরে বলল,
‘কি নাম রাখবি?’
‘তুই ভাব।’
‘নাহ। বাচ্চার মায়ের নাম রাখা উচিত। প্রথম বাচ্চা নিয়ে মেয়েদের সারাজীবনের জল্পনা-কল্পনা থাকে। কিশোরী থেকে তারা বাচ্চার উল্টেপাল্টে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ঠিক করে রাখে। সে বাচ্চা কীভাবে হাসবে… কীভাবে হাটবে.. কীভাবে আধোস্বরে তাকে মা মা বলে ডাকবে এসব তখন লাগে অলৌকিক স্বপ্নের মতো। কারোর উচিত নয় ব্যক্তিগত এই কল্পরাজ্যে হস্তক্ষেপ করা।’
নিভা মুগ্ধ দৃষ্টি ফেলে। টায়রা উৎসুক হয়ে তাকায়। ক্ষীণ আওয়াজে বলে,
‘এতো অনুভূতি চাপা দিয়ে রাখতে নেই, টিকলি।’
‘সবসময় প্রকাশও করতে নেই।’
‘কেনো?’
‘সময় সবসময় সবকিছুর যোগ্য হয় না।’
‘আদর ভাইয়া হ্যাঁ বলেছে।’
‘জানি। এবং সে এক সেকেন্ড সময় নেয়নি এও জানি। অথচ তার সময় নেওয়ার দরকার ছিলো। তার লজ্জা পাওয়া উচিত ছিলো। তার ব্যবহারের জন্য তার আক্ষেপ হওয়ার কথা ছিলো। অথচ সেসবের কিচ্ছু হয়নি। সে বিন্দাস! তাকে কোনোকিছু ঠেকায় না। তার পরিতাপ হয় না। এ আদরকে আমি চিনি না। এ আদরকে আমি ভালোবাসিনি। এই আদর আমাকে ভালোবাসেনি। যে ভেসেছিলো সে অন্য মানব ছিলো। আমার স্বপ্ন ছিলো। আর অন্য আদর ছিলো বলেই তখন সে আমায় গভীর মায়া দিয়ে যত্ন করে হাওয়াই মিঠাই এর ন্যায় ভালোবেসেছিলো। আমি সেসব ভুলে যেতে পারি না কেনো?’
টায়রা, নিভা উত্তর দিতে পারলো না। কিছু বিষয় যার যার উপর ছেড়ে দিতে হয়। নিজ থেকে ভেবে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে তাই সই। কখনো কখনো অহেতুক বুঝানো চলে না। অনুভূতিতে জোরাজুরি চলে না। এই যে কী সুন্দর ভাবে আদর নিজের কথাটুকু ব্যক্ত করে টিকলির ব্যাপার’টুকু মুক্ত মনে টিকলির উপরেই ন্যস্ত করেছে! আর কোনো রা কাটেনি আদর। ওরা সবাইও তাই করলো। ওই মূহুর্তে ওটাই ঠিক ছিলো। টিকলি ভেবে… কেঁদে… রাত জেগে.. নিজেকে পুড়িয়ে… মাথায় ব্যথা ধরিয়ে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে তা হবে অপ্রাকৃত, নৈসর্গিক।
চলবে❤️