বসরাই গোলাপের ঝাড় পর্ব-২০

0
798

#বসরাই_গোলাপের_ঝাড়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

২০.
তার ইচ্ছে হলো পেছন ফিরে তাকাতে, তাকাল না। সামনের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল। জিনিসগুলো ফেরত আনা জরুরি। এই পথে রওনা দিলে বেশ ভালো হত। চাবি নেই৷ নববীর ঘরের আলমারি, চাবিও তার কাছে থাকে।

রাত এগারোটা নাগাদ শরাফত উল্লাহ ডিআইজি সাহেবের রুমে ঢুকল। ঘরের দু’টো বাতি নেভানো। ডিআইজি সাহেব বললেন, “চাকরি চলে যাবার পর কি করবে ভাবছ?”

শরাফত চমকে উঠলো। নরম গলায় বলল, “এ কথা কেন বলেছেন, স্যার? আমি কি কোন ভুল করেছি?”

“তুমি কি করেছ তা তুমি খুব ভালো করেই জানো। প্রমাণাদি আমার হাতে চলে এসেছে। এরপর আর কোন আশা বাঁচবে বলে মনে হয় না। যদিও বাঁচে, আদালত চত্বরে হাঁটতে গিয়ে জুতার তলা ক্ষয়ে যাবে।”

শরাফত ভ্রু কুঁচকে ফেললো। সে নিজের অপরাধ জানে। পনেরো লাখ টাকা বিনিময়ে আনিসের কে’স থেকে কনকের নাম মুছে ফেলেছিল। ডিলটা হয়েছিল সামনা-সামনি। আনিসের অবস্থার খোঁজ খবর করতেই সে সেদিন হাসপাতালে গিয়েছিল। তখনই কনক তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল। বলল, “খু’নিকে ধরতে পেরেছেন?”

শরাফত নিরাশ গলায় বলল, “না, এখনও সম্ভব হয়নি। তবে খুব শীগ্রই ধরা পড়বে।”

“ধরে নিলাম- আপনি খু’নিকে ধরে ফেলেছেন। সে আপনাকে মোটা টাকা অফার করল। ধরুন আপনার কয়েক বছরের বেতনের সমান টাকা দিতে চাইল। আপনি রাজি হবেন?”

শরাফত ভরাট গলায় বলল, “কখনোই না। এসব কি বলছেন? আমি আমার দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারব না।”

“অথচ আপনার চোখ চকচক করছে।”

শরাফত বেশ কয়েকবার পলক ফেলল। বলল, “এসব কি উল্টো পাল্টা কথা বলছেন?”

“কথাগুলো উল্টো পাল্টা তবে অফারটা সত্যি। রাজি থাকলে জানাবেন।”

“খু’নটা কে করেছে? আপনি তাকে চেনেন?”

“চিনতেও পারি, তবে কখনও খালি চোখে তার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি।”

“এর মানে কি?”

কনক চলে গেল। সারাদিন ভাবার পর সে বুঝল কনক তার নিজের কথা বলেছে। কেউই আয়না বা দর্পনের সাহায্য ছাড়া নিজের চোখের দিকে তাকাতে পারে না৷ বোঝার পরপরই শরাফত কনকের সাথে দেখা করল৷ কনক তাকে পনেরো লাখ টাকার একটা চেক লিখে দিলো। শরাফত সেই চেক নিয়ে ব্যাংকে ভাঙিয়েছে। নিজের একাউন্টে কিছু জমা রেখেছে, কিছু টাকা দিয়ে একটা ছেলেকে ভাড়া করেছে, কিছু আবার খরচ করে ফেলেছে৷ ছেলের কাজ গু’লি করার ব্যাপারটা তার কাঁধে তুলে নেবে। পরের পরিকল্পনাগুলো খুব ভেবেচিন্তে করলেও চেক নেবার সময় অতো-শত ভাবেনি। কনককে সন্দেহ করার কারণ ছিল না। তাছাড়া শরাফত পুলিশ অফিসার, এতগুলো মানুষের ভেতর কেউই তাকে কখনো সন্দেহ করেনি। বরং আলাদা নজরে রেখেছে। ভরসা করেছে, বিশ্বাস করেছে। এমন কিছু হবে তা সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। ডিআইজি সাহেব অল্প হেসে বললেন, “পুলিশ অফিসার হয়ে চেক নেবার ভুল করলে কিভাবে? এটা কি গ্রহণযোগ্য? তুমি জানতে না কিছু হলে আগেই তোমার একাউন্টে খোঁজ করা হবে।”

রাগে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। এই বাগধারাটা কে আবিষ্কার করেছিল তা জানা নেই৷ এই মুহুর্তে শরাফতের মনে হচ্ছে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আর কখনও আবিষ্কার হবে না৷ রাগে আসলেই তার হাত নিজের কামড়াতে ইচ্ছে করছে। যদিও সে কনককে বলেছিল টাকাগুলো ক্যাশে প্রয়োজন। কনক বলল, “হাসপাতালে বসে এত টাকা নগদ পাব কিভাবে? দিতে হলে ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলতে হবে। এর থেকে আমি একটা চেক লিখে দিচ্ছি। আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন। জানতে চাইলে আত্মীয় স্বজন কিছু একটা বলে দিবেন। তাছাড়া আমি কল দিয়ে জানিয়ে রাখব। কেউ কোন প্রশ্ন করবে না।”

শরাফত টেবিলে ওপর ঘু’ষি মা’র’ল। ডিআইজি সাহেব বললেন, “শেয়াল নিজেকে যতই চালাক মনে করুক না কেন, সে চালাক নয়। ধূর্ত! ভেবেছ পুলিশ অফিসার তোমাকে কেউ কখনো সন্দেহ করতে পারবে না। কিন্তু দেখ, অবশেষে তুমিও ফেঁসে গেলে।”

শরাফত উঠে দাঁড়ালো। ডিআইজি সাহেব বললেন, “হয়তো ভাবছ আজ হঠাৎ তোমাকে তুমি করে বলছি কেন। গতকাল তো আপনি বলেছি।”

সে জবাব দিলো না। বিস্মিত চোখ তাকিয়ে রইল। ডিআইজি সাহেব বললেন, “কাজের জায়গায় ছোট বড় সবাইকেই আপনি সম্মোধন করি। তারা দেশের একটি বড় দায়িত্ব পালন করে, আইন রক্ষা করে। তাদের সম্মান দেবার জন্যই আপনি বলি। তুমি তোমার জায়গা ধরে রাখতে পারোনি। দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছ। আইনের চোখে তুমি একজন অপরাধী। অপরাধীকে সম্মান দেখানো সাজে না। তুই বলে অভদ্রতা হবে তাই তুমি বললাম।”

শরাফত বেরিয়ে গেল। দরজা পর্যন্ত যেতেই দু’জন কনস্টেবল এসে বলল, “স্যার আপনার গ্রে’ফ’তা’রি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আমাদের সাথে যেতে হবে।”

সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ডিআইজি কঠিন মাল। কোথাও কোন ফাঁক রাখেনি।

আজকের আকাশ ফাঁকা। কোথাও চাঁদ তারার দেখা নেই। নববী বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে৷ হাবিব তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। নববী চমকে উঠে বলল, “কি হয়েছে তোমার? এভাবে কাঁদছ কেন?”

হাবিব জবাব দিলো না। হাতের বাঁধন একটু শক্ত করল। নববী আর প্রশ্ন করল না৷ ভাবল -কনক আপার জন্য কাঁদছে। এমনিতেই সে তার ভাইবোনকে খুব ভালোবাসে। এমন ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। সে তাকে বাঁধা দিলো না। কাঁদলে মন হালকা হয়। আহা বেচারা! কেঁদে যদি খানিকটা শান্তি পায় তবে না হয় একটু কাঁদুক। সমস্যার কিছু নেই। কাঁদতে কাঁদতে হাবিবের হেঁচকি উঠে গেছে। নববী শাড়ির আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছে দিলো। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “আর কাঁদে না।”

হাবিব থামল না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল।

মহিউদ্দিন সাহেব খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছেন। ফজরের নামাজ শেষ তিনি সোহেলের ক’ব’র জিয়ারত করেন। আজও গেলেন। হাবিব মাটিতে বসে আছে। হাত পা ছড়িয়ে বাচ্চাদের মতো করে বসে আছে। তিনি গিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। হাবিব বলল, “আব্বা, আপনি সোহেলের নামে জায়গা কিনেছিলেন?”

মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “হ্যাঁ কিনেছিলাম। লাভ কি হলো! দাদু ভাই তো আর বেঁচে রইল না।”

“কেন কিনেছিলেন আব্বা? আমরা থাকতে, আপনি বেঁচে থাকতে নাতির নামে জমি কিনলেন তা-ও আবার শহরে। কেন করলেন?”

“জমি কেনার টাকার বেশিরভাগ অংশ পানের ব্যবসার লাভ। যে লোকের সাথে পানের ব্যবসা করি, উনি হঠাৎই একদিন বললেন, ‘তার পরিচিত এক লোকের ছেলে-বউ আলাদা হয়ে গেছে। তারা আর একসাথে সংসার করবে না। সমস্যা হলো তাদের একটা ছেলে আছে। ছেলের বয়স অল্প। এখন এতিমখানায় রেখে দিবে।
আমি বললাম, ‘বাচ্চা ছেলেটার দাদা নানা নেই?’
উনি বললেন, ‘নাহ, তারা বেঁচে নেই। কি বলব ভাই! আমার সেই বন্ধু তার নাতিকে যে কি পরিমাণ স্নেহ করত। পাতের খাবার তুলে খাওয়াত। এখন কি হলো দেখেন। এই ছেলে বড় হবার পরও দাদা বাড়ির সম্পত্তি পাবে না, চাচারা এমনিতেই ঠাঁই দিতে চায় না। মামারাও তাই। বাপ মায়ের ওই অবস্থা। কোন ভবিষ্যৎ রইল বলেন?’
আমি আর কিছু বললাম না৷ ভাবতে লাগলাম আল্লাহ না করুক আমার দাদা ভাইয়ের সাথেও যদি এমন কিছু হয়। তাই ওর নামেই জমি কিনলাম৷ কিছু না হোক এতটুকু তো ওর নিজের রইল।”

হাবিব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না৷ এমনিতেই তার বাবা ভীষণ রকমের দুশ্চিন্তা এবং কষ্টের মধ্যে আছেন। কনকের কাজকর্ম, এতদিন যা ঘটছে সবকিছু মিলিয়ে মন ভারী হয়ে গেছে। নতুন শোক সইরে পারবেন না। হয়তো হার্টফেল করে বসবেন। হাবিব ঝুঁকি নিতে চাইল না। উঠে দাঁড়ালো।
আজ অনেক কাজ। সকালের নাস্তার পরপরই নববীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একা যেতে চেয়েছিল, নববী তাকে একা ছাড়েনি৷ মানুষটা সারারাত কেঁদেছে। চোখের নীচ কেমন ফুলে উঠেছে। সকালে ভালো করে খেতেও পারেনি৷ কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। যেন র’ক্ত মাংসের মানুষ নয়,পাথরের মূর্তি।

পথে তাদের খুব বেশি কথা হলো না। নববী খেয়াল করল হাবিব তার একটা হাত ধরে আছে। ধরেছে খুব শক্ত করে।

বাপের বাড়ি পৌঁছানোর পরপরই নববী তার মা’কে সব খুলে বলল। এতদিন তারা কিছু জানতেন না। আজ সবকিছু শোনার পর চোখ কপালে তুলে ফেললেন। হতভম্ব গলায় বললেন, “ এসব কি বলছিস নবু?”

নববী মাথা দোলালো। দুপুরে খাবার পরপরই তারা দু’জন বেরিয়ে পড়ল। বাড়িতে না ফিরে সোজা থানায় গেল। ডিআইজি সাহেব নেই। আসতে দেরি হবে। হাবিব বলল, “তোমাকে গাড়ি তুলে দিলেও তো যেতে পারবে না। সন্ধ্যা নেমে গেছে।”

নববী বলল, “সমস্যা নেই। আমি পারব। তাছাড়া বাড়ি খুব বেশি দূরেও না।”

“অনেককিছু হারিয়েছি। তোমাকে আর হারাতে চাই না৷ কোন সুযোগও রাখতে চাই না। অপেক্ষা করলে দু’জনে একসাথে অপেক্ষা করব।”

“ডিআইজি সাহেবের আসতে কতক্ষণ সময় লাগবে?”

“জানি না। জিজ্ঞেস করা হয়নি। দেখছি।”

হাবিব একজন কনস্টেবলকে ডেকে বলল, “স্যার, বড় স্যার কখন আসবে?”

হাড়ভাঙা রুক্ষ চেহারা কনস্টেবল। এই চেহারায় পুলিশের চাকরি কিভাবে পেল সন্দেহ হয়। সে রসকষহীন কাঠখোট্টা গলায় বলল, “শুনেছি হাসপাতালে যাবেন। কখন ফিরবে বলেননি।”

হাবিব তার দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদসূচক হাসল। নববীকে গিয়ে বলল, “হাসপাতালে চলো। ডিআইজি সাহেব ওখানে। আপা” বলেই থেমে গেল। সময় নিয়ে বলল, “দেখে আসব।”

সে মাথা দোলালো। রিকশার হুড খোলা। গায়ে বাতাস লাগে। গ্রীষ্মে এ বাতাস আরাম দিলেও এখন কেউ পছন্দ করে না। নববী বলল, “ডিআইজি সাহেবের নম্বর নেই তোমার কাছে?”

“ওহ! হ্যাঁ! ছিল তো। ভুলে গেছি। কল দিয়ে দেখছি।”

ডিআইজি সাহেব কল রিসিভ করলেন না। সে আরও একবার কল দিলো। তবুও ধরলেন না।

কনকের অবস্থা ভালো। শরীর বেশ সুস্থ, মন মেজাজ ভালো নেই। অপরাধীর অপরাধ ধরা পড়ার পর সে আর নিজের চিন্তায় অটল থাকতে পারে না। কনকও পারছে না। তার খুব আফসোস হচ্ছে। এসব না করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো? তার জীবন কি অনেক খারাপ চলছিল? সে জবাব পায় না। বুক চি’রে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

হাসপাতালে ঢোকার আগ-মুহূর্তে ডিআইজি সাহেবের সাথে হাবিবের দেখা হলো। হাবিব বলল, “জিনিস নিয়ে এসেছি। এখানে নিবেন নাকি থানায়?”

“জিনিস এখানেও দিতে পারেন। সমস্যা হবে না৷ আমার সাথে দু’জন কনস্টেবল আছে, গাড়ির ড্রাইভার আছে। তাদের সাক্ষী রাখলেন। চাইলে আশেপাশের লোকদেরও ডাকতে পারেন।”

হাবিব কি বলবে বুঝতে পারল না৷ মাথা নিচু করে রইল। ডিআইজি সাহেব উনার ড্রাইভারকে ডেকে বললেন, কয়েকজন লোক ডেকে আনো। ড্রাইভার লোক ডেকে আনল। তিনি বেশ ঘটা করে জিনিস নেবার অনুষ্ঠান পালন করলেন। নববীকে বললেন, “আপনি সবটা ভিডিও করে রাখুন। ইতস্তত করবেন না। রাখুন।”

নববী ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ক্যামেরা অন করল। ডিআইজি সাহেব জিনিসপত্র খুব দেখে দেখে বুঝে নিলেন। বললেন, “হাবিব সাহেব, আপনাকে একবার থানায় আসতে হবে। ভাবীকে বাড়িতে রেখে আসুন। কাল সকালে নয়, আজ রাতের ভেতরই আসবেন। বারোটা পর্যন্ত থানায় থাকব।”

হাবিব নববীকে নিয়ে রিকশায় উঠল। নববী বলল, “উনি তোমায় কি বলবেন?”

হাবিব বলল, “জানি না।”

সে নববীর হাত চেপে ধরলো। তার মন বলছে সে আর কখনও নববীর হাত ধরতে পারবে না।

চলবে