বহুব্রীহি পর্ব-১৯+২০

0
3

🔴বহুব্রীহি (পর্ব :১৯, ২০)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

মনসুর সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে।

সোবাহান সাহেবের কারণেই সে এমনভাবে বসা। সোবাহান সাহেব চান যে সে আরাম করে বসে ক্ষুধা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার লেখাটা শুনে। মনসুর একবার শুধু ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার লেখাটা কত পৃষ্ঠা?

সোবাহান সাহেব বললেন, তিনশ বাইশ পৃষ্ঠা হয়েছে। এখনো লিখছি। আরো বাড়বে।

মনসুর হতভম্ব হয়ে বলল, সবটা আজ শুনাবেন?

হ্যা। নয়তো ফ্লো ঠিক থাকে না। ফ্লো থাকাটা খুব দরকার। একসঙ্গে না। শুনলে তুমি পরিষ্কার বুঝতে পারবে না।

তা ঠিক।

তুমি আরাম করে পা তুলে বস। খুব মন দিয়ে শুনবে। কিছু মিস করবে: की।

জ্বি আচ্ছা।

আর পড়ার সময় হু হা এই সব কিছু বলবে না। এতে আমার অসুবিধা হয়। কনসানট্রেসান কেটে যায়।

আমি কিছু বলব না।

ভেরী গুড।

সোবাহান সাহেব শুরু করলেন এবং অতি দ্রুত পড়ে যেতে লাগলেন। ঘণ্টা খানিক পার হবার আগেই ঘরে ঢুকল ফরিদ। সোবাহান সাহেবকে থামিয়ে বলল, দুলাভাই আপনার কাইন্ড পারমিশান নিয়ে কি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

কি কথা?

যাকে আপনি লেখা পড়ে শুনাচ্ছেন সেই গাধা ঘুমুচ্ছে। তাকিয়ে দেখুন–হা করে ঘুমুচ্ছে।

সোবাহান সাহেব তাকালেন এবং তার মন সত্যি সত্যি খুব খারাপ হয়ে গেল। আসলে তাই। ডাক্তার ঘুমুচ্ছে। হা করেই ঘুমুচ্ছে।

সোবাহান সাহেব উচ্চস্বরে ডাকলেন, মিলি মিলি। সেই শব্দেও ডাক্তারের ঘুম ভাঙলি না। কয়েকবার শুধু ঠোঁট কাঁপল। মিলি পাশে এসে দাঁড়াবার পর সোবাহান সাহেব বললেন, ডাক্তারের মাথার নিচে একটা বালিশ দাও মা ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্ষুধা বিষয়ক আমার এই জটিল লেখা পড়তে পড়তে যে কেউ ঘুমিয়ে পড়তে পারে এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

মিলি ডাক্তারের মাথায় নিচে একটা বালিশ দিয়ে দিল। পাতলা চাদরে গা ঢেকে দিল। এই সামান্য কাজটা করতে তার ভাল লাগল। প্ৰবল ইচ্ছা করতে লাগল। এই ছেলেটার হাতটা একটু ছুয়ে দেখতে। মানুষের মনে কেন এরকম ইচ্ছা! হয়? এই ইচ্ছার নামই কি ভালবাসা? তাহলে ভালবাসা ব্যাপারটা কি শরীর নির্ভর? কবি যে বলেন প্ৰতি অঙ্গ লাগি তার প্রতি অঙ্গ কাদেরে– এই কথা কি সত্যি? সত্যি হলে খুব কষ্টের ব্যাপার হবে। ভালবাসার মত এত বড় একটা ব্যাপারকে দেহে সীমাবদ্ধ করা খুব অন্যায়। খুবই অন্যায়। তবু কেন জানি ভালবাসা শেষ পর্যন্ত দেহেই আশ্রয় করে। বড় রহস্যময় এই পৃথিবী। বড়ই রহস্যময়।

মিলি গায়ে চাদর দিয়ে দিচ্ছে পাশে মুখ বিকৃত করে দাঁড়িয়ে আছে ফরিদ। সে বলল, এত বড় গাধা আমি আমার লাইফে দেখিনিরে মিলি। একটা ভদ্রলোক আগ্রহ করে তোকে একটা লেখা পড়ে শোনাচ্ছেন আর তুই ব্যাটা ঘুমিয়ে পড়লি? তোর একটু লজ্জাও লাগল না? আবার দেখনা নাক ডাকাচ্ছে। কষে একটা চড় দেব না-কি?

মিলি বলল, বেচারাকে ঘুমুতে দাও মামা বিরক্ত কর না।

আমার কি ইচ্ছে করছে জানিস? আমার ইচ্ছে করছে গাধাটাকে ধরাধরি করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসি। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলে একটা শক খাবে। বুঝবে কত ধানে কত চাল।

তুমি এ ঘর থেকে যাও তো মামা।

ঘরে প্রচণ্ড মশা। বেচারাকে মশা বিরক্ত করছে। সোফার উপর মশারী খাটিয়ে দেয়া যায় না। মিলি মসকুইটো কয়েল জ্বলিয়ে দিল।

রাতে ভাত খেতে খেতে সোবাহান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তার কি এখনো ঘুমুচ্ছে? মিলি লজ্জিত গলায় বলল, হ্যাঁ বাবা।

সোবাহান সাহেব বিস্মিত স্বরে বললেন, খুবই আশ্চার্যের ব্যাপার। ফরিদ বলল, দুলাভাই আমার ধারণা আপনার ক্ষুধা বিষয়ক বইটাতে ঘুম উপদ্রোকারী কিছু একটা আছে। আপনি যখন ডাক্তার ব্যাটাকে পড়ে শুনাচ্ছিলেন তখন আমিও দুতিন পৃষ্ঠা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম। আমার তিনবার হাই উঠল।

সোবাহান সাহেব কঠিন চোখে তাকালেন, কিছু বললেন না।

ফরিদ বলল, ইনসমনিয়ার ওষুধ হিসেবে এই বই বাজারে ছাড়া যেতে পারে। আমি ঠাট্টা করছি না দুলাভাই। আমি ড্যাম সিরিয়াস।

বিলু বলল, চুপ করতো মামা।

চুপ কর, চুপ কর এই কথা ইদানীং আমাকে খুব বেশি শুনতে হচ্ছে। আমার এটা শুনতে ভাল লাগছে না। সব মানুষেরই কিছু ব্যক্তিগত মতামত থাকতে পারে। এবং সেই মতামত প্ৰকাশের অধিকারও তার থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। দুলাভাইয়ের বইটি পড়ে আমার ঘুম আসছে এটা বলে দুলাভাইয়ের বইয়ের প্রতি আমি কোন অশ্রদ্ধা প্ৰকাশ করছি না। বইটির নতুন একটি ডাইমেনসনের দিকে আমি ইংগীত করছি।

মিনু বললেন, আর একটা কথা বললে এই ভাতের চামচ দিয়ে তোর মাথায় একটা বাড়ি দেব।

তা দাও। তবু আমার কথাটা আমি বলবই। সক্রেটিস ন্যায় কি? এ কথাটা বোঝাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। তাকে হেমলক নামের তীব্র হলাহল পান করতে হল। আমি ক্ষুধা এবং ঘুমের সম্পর্ক বলতে গিয়ে না হয় চামচের একটা বাড়ি খেলা মই।

সোবাহান সাহেব শান্ত গলায় বললেন, খাওয়া দাওয়ার পর তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ফরিদ।

ফরিদ বলল, জি আচ্ছা।

কথাগুলো অপ্রিয়। তবু আমি ঠিক করেছি কথাগুলো তোমাকে বলব।

জি আচ্ছা।

আনিস ছোকরা কি এখনো আসে নি?

বিলু বলল, না আসে নি।

কোথায় আছে? কোন খবর পাঠিয়েছে?

না।

ওকে যেন আর এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়া না হয়। যে মানুষ তার দুটি বাচ্চা ফেলে উধাও হয়ে যায় তাকে এ বাড়িতে আমি থাকতে দিতে পারি না।

ফরিদ বলল, আপনার এই প্ৰস্তাব আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি দুলাভাই।

তোমার সমর্থনের আমি কোন প্রয়োজন বোধ করছি না।

প্রয়োজন বোধ না করলেও সমর্থনা করছি। আপনি বোধহয় জানেন না। দুলাভাই যে সত্য এবং ন্যায়ের পেছনে আমি সদা সর্বদা হিমালয়ের পর্বতের মতাই দাঁড়াই।

তোমার কি খাওয়া শেষ হয়েছে ফরিদ?

জ্বি না। এখন একবাটি ডাল খাব। খাওয়া দাওয়ার পর আমি একবাটি ডাল খাই। ভেজিটেবল প্রোটিন। এটার খুবই দরকার।

ডাল খাওয়া শেষ হবার পর তুমি দয়া করে আমার ঘরে এসো। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

সোবাহান সাহেব নিতান্তই অনুত্তেজিত স্বরে যেসব কথা বললেন, সেগুলো হচ্ছে, ফরিদ আমার ব্লাড প্রেসার হচ্ছে একশ ষাট বাই পচানব্বই। আমার বয়সে এটাই স্বাভাবিক। কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি তোমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেই আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়।

বাড়ে তা কি জানতে পারি?

এ পর্যন্ত দুবার মেপেছি। দেখেছি উপরেরটা হয় দুশ নিচেরটা একশ দশ।

বলেন কি কোয়ায়েট ইন্টারেস্টিং।

তোমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হতে পারে! আমার কাছে ইন্টারেষ্টিং নয়। আমি চাই তুমি আর কখনো আমার সামনে না। আস।

তা কি করে সম্ভব?

আমার শ্বশুর সাহেব তোমার নামে আলাদা করে কিছু টাকা আমার কাছে গচ্ছিত রেখে গেছেন। এই টাকাটা আমি তোমাকে দিয়ে দিতে পারি। সেই টাকায় বাড়ি টারি কিনে তুমি মোটামুটি রাজার হালে থাকতে পার।

ফরিদ আগ্রহী গলায় বলল, অনেক টাকা না-কি?

হ্যাঁ অনেক টাকা। তবে তোমাকে আমি টাকাটা দিতে পারছি না। কারণ শ্বশুর সাহেব বলেছন তোমার মাথাটা ঠিক না হলে যেন তোমার কাছে টাকা না দেয়া হয়। তোমার মাথা ঠিক না।

আমার মাথা ঠিক না?

না।

আর আপনারটা হানড্রেড পার্সেন্ট ঠিক?

আমার মাথা নিয়ে কথা হচ্ছে না। তোমারটা নিয়ে কথা হচ্ছে।

ফরিদ হঠাৎ দাঁড়াল। গাঢ় গলায় বলল, দুলাভাই আমি চললাম। আমার কারণে আপনার প্রেসার বাড়বে না।

মনে হচ্ছে ফরিদের নিজের ব্লাড প্রেসারও হু হু করে বাড়ছে। মাথার ভেতর প্ৰলয় কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। মনে হয় এই অবস্থাতেই কবি নজরুল লিখেছিলেন—

আমি ভরা তরী করি ভরা ড়ুবি, আমি টর্নেডো, আমি ভাসমান মাইন।
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত, বিশ্ব বিধাত্রীর।

ফরিদের রাগ অনুরাগ কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না বলে নিজের ঘরে যেতে যেতে নিজেকে অনেকটা সামলে ফেলল। বসার ঘরে সোফায় ডাক্তার হা করে ঘুমুচ্ছে। ব্যাটাকে কষে একটা চড় দেবার ইচ্ছা অনেক কষ্টে দমন করতে হল। চড়টা দিতে পারলে রাগটা পুরোপুরি চলে যেত। রাগ কমানোর অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে একটি হচ্ছে অন্যের উপর রাগ ঢেলে দেয়া। কিংবা উল্টো দিক থেকে সংখ্যা গোনা—একশ, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই, ছিয়ানব্বই ফরিদ সংখ্যা পদ্ধতি চেষ্টা করল। পদ্ধতি আজ কাজ করছে না। সব দিন সব পদ্ধতি কাজ করে না। চুল ধরে হাঁচকা টান দিয়ে ডাক্তার ব্যাটাকে সোফা থেকে ফেলে দিলে কেমন হয়, ভদ্রতায় বাঁধছে। সমাজে বাস করার এই হচ্ছে সমস্যা। সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। ইচ্ছা করলেও কারোর চুল ধরে হ্যাচক টান দিয়ে নিচে ফেলে দেয়া যায় না।

ফরিদ মেঘ গৰ্জন করল, এই ব্যাটা উঠ।

ডাক্তার ধড়মড় করে উঠে বসল। তার কাছে সব কিছুই এলোমেলো। এখানে সে কি করছে? ঘুমুচ্ছে না-কি? এখানে ঘুমুচ্ছে কেন? সামনে ফরিদ মামা না? উনি এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?

স্লামালিকুম মামা।

ওয়ালাইকুম সালাম।

কি করছেন মামা?

তেমন কিছু করছি না। একটু আগে ভয়ঙ্কর কিছু করার ইচ্ছা করছিল এখন করছে না।

ডাক্তারকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফরিদ নিজের ঘরে চলে গেল। ঠাণ্ডা পানিতে ঘাড় ভিজিয়ে নিতে হবে তাতে মূল স্নায়ু শীতল হবে। বেশ খানিকটা ক্যাফিনও শরীরে ঢুকাতে হবে।

এতেও স্নায়ুর উত্তেজনা খানিকটা কমবে। কাদেরকে চায়ের কথা বলা দরকার। চিনি দুধ ছাড়া কড়া চা। প্রচুর ক্যাফিন দরকার। শুধু ক্যাফিনে কাজ হবে না, গানও লাগবে। এসব ক্ষেত্র রবীন্দ্র সংগীত খুব কাজ করে। মেঘের পর মেঘ জিমেছে। এই বিশেষ গানটি রাগ কমানোর ব্যাপারে কোরামিন ইনজেকশনের মত। পরপর দুবার শুনলেই রাগ-জল। আজ ঐ গানটিরও সাহায্য দরকার। আজকের অবস্থা বড়ই খারাপ।

ডাক্তারের ঘুম এখন পুরোপুরি ভেঙেছে।

সে এই মুহূর্তে বড় ধরনের লজ্জাও বোধ করছে। পুরো ব্যাপারটা এখন মনে পড়ছে। ক্ষুধার উপর লেখা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কি অসম্ভব লজ্জার কথা। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। মিলি নিশ্চয়ই ঘটনা শুনেছে। না জানি সে কি ভাবছে। তাকে গাধা ভাবছে নিশ্চয়ই।

রাত এখন প্রায় দেড়টা। এত রাতে চুপচাপ সোফায় শুয়ে থাকা ছাড়া কোন গতি নেই। কিন্তু আবার ক্ষিধেও লেগেছে। ক্ষুধা ব্যাপারটা কত ভয়াবহ তা প্ৰবন্ধ পড়ে ঠিক বোঝা যায় নি— এখন বোঝা যাচ্ছে। তার মনে পড়ল। আজ দুপুরেও তেমন কিছু খাওয়া হয় নি।

ঘুম ভাঙার পর থেকে চোখের সামনে শুধু নানান রকম খাবারে ছবি ভাসছে। এই মুহুর্তে যে ছবিটি ভাসছে সেই ছবিটি বেশ অস্বস্তিকর— বিশাল একটা চিনামটির প্লেট। সেই প্লেটে শিউলি ফুলের মত দেখতে পোলাও। পোলাওয়ের উপর আস্ত একটা ভেড়ার রোস্ট। রোস্টটির বর্ণ সোনালি। এত জিনিস থাকতে চোখের সামনে ভেড়ার রোস্ট ভাসছে কেন সেটা একটা রহস্য। চামড়া ছাড়িয়ে নেবার পর ভেড়া এবং ছাগলে কোন তফাৎ নেই। তবু কেন শুধু ভেড়ার কথা মনে হচ্ছে? রোস্টটাতো ছাগলেরও হতে পারে।

খুট করে শব্দ হল।

ঘরে ঢুকল পুতুল। তার ঘুম আসছিল না। সে এসেছিল পানি খেতে। বসার ঘরে আলো জুলতে দেখে কৌতুহলী হয়ে এসেছে। ডাক্তারকে রাতে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সে খুবই অবাক হয়েছে। তবে অবাক হওয়াটা সে প্রকাশ হতে দিল না। সহজ স্বরে বলল, স্নামালিকুম।

মনসুর বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। ভাল আছ?

এই মেয়েটির সঙ্গে তার অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে কখনো তেমন আলাপ হয়নি। মেয়েটা যে এতটা সুন্দর সে আগে লক্ষ্য করেনি। আলাদাভাবে এর নাক মুখ চোখ কোনটাই সুন্দর না। তবু সব কিছু মিলিয়ে মেয়েটাকে দেখতে তো বড় ভাল লাগছে। মনসুর উৎসাহের সঙ্গে বলল, কেমন আছ পুতুল? পুতুল বিস্মিত গলায় বলল,

ভাল।

আমি ক্ষুধা বিষয়ক লেখাটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ব্যাপারটা খুবই অন্যায় হয়েছে। জেগে দেখি সোফায় শুয়ে আছি- মাথার নিচে বালিশ।

মশার কামড়ে ঘুম ভেঙেছে। আমার মনে হয় ক্ষিধের কারণে। প্ৰচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে বুঝলে পুতুল।

পুতুল বলল, আপনি বসুন দেখি ঘরে কি আছে।

তোমার কষ্ট করার দরকার নেই পুতুল। তবে ফ্রীজটা খুলে দেখ। ঠাণ্ডা গরমে কোন অসুবিধা নেই।

আপনি বসুন আমি দেখি—

বাহ মেয়েটার কথা থেকে গ্রাম্য ভাবাটাওতো দূর হয়েছে। মেয়েটাকে বুদ্ধিমতী বলেও মনে হচ্ছে। মনসুরের মনে হল মেয়েটা কোন একটা ব্যবস্থা করবেই। কিছু না পেলে দুটাে ডিম ওমলেট করে নিয়ে আসবে।

মনসুরের চোখে আগের দৃশ্য ফিরে এল। সেই ভেড়ার রোস্ট। তবে তার সঙ্গে নতুন কিছু চিত্র যুক্ত হয়েছে। ভেড়ার রোষ্টের উপর এখন মুরগির রোষ্টও দেখা যাচ্ছে।

আধা ঘণ্টা পর পুতুল এসে বলল, খেতে আসুন।

খাবার ঘরে খাবার দেয়া হয়েছে। ভাত, রুই মাছের তরকারী, উচ্ছে ভাজা, ডাল। সবই গরম। রীতিমত ধোঁয়া উঠছে। একটা প্লেটে পেয়াজ কাচামরিচ দুটুকরা লেবু।

হতভম্ব মনসুর বলল, সব কি এখন রান্না করলে?

পুতুল হাসতে হাসতে বলল, এত অল্প সময়ে বুঝি রান্না করা যায়। সবই ফ্রীজে ছিল। আমি শুধু গরম করেছি। আপনি খেতে বসুন।

পুতুল প্লেটে ভাত উঠিয়ে দিল।

মিলির ঘুম আসছিল না। একটা মানুষ সোফায় শুয়ে আছে। হয়ত বেচারাকে মশারা ইতোমধ্যে খেয়ে ফেলেছে। একজনকে এই অবস্থায় রেখে ঘুমুতে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সে নিঃশব্দে বসার ঘরে ঢুকল। সেখান থেকে খাবার ঘরে। খাবার ঘরে কি হচ্ছে? মনসুর খাচ্ছে? কে খাওয়াচ্ছে তাকে? তাকে দুজনের কেউ লক্ষ্য করল না। মিলি পর্দার আড়াল থেকে লক্ষ্য করল দুজন কি সুন্দর গল্প করছে। এত খাতির দুজনের মধ্যে? কই এই খাতিরের কথাতো তার জানা ছিল না? আবার হাসির শব্দ আসছে। খিলখিল করে নিশ্চয়ই পুতুল মেয়েটাই হাসছে। রাগে মিলির গা জুলে যেতে লাগল। যদিও সে খুব ভাল করেই জানে রাগ করার কিছুই নেই। কেন সে রাগ করবে? তার রাগ করার কি আছে?

হাসাহাসির কারণ হচ্ছে ঠিক এই সময় ডাক্তার একটা মজার রসিকতা করছিল- রসিকতাটা বানর বিষয়ক। ডাক্তার কখনো রসিকতা করে কাউকে হাসাতে পারে না। এই প্রথম সে একজন গ্ৰাম্য বালিকাকে মুগ্ধ করল— পুতুল হাসতে হাসতে ভেঙে গড়িয়ে পড়ল। কিংবা কে জানে এই গ্ৰাম্য বালিকাটি হয়ত মুগ্ধ হবার অভিনয় করল। ডাক্তার অভিনয় ধরতে পারল না।

পর্দা ধরে ঈর্ষায় নীল হয়ে গেল মিলি। তার ভেতরে এত ঈর্ষা ছিল তাও সে জানতে না। সে যেভাবে এসেছিল সেইভাবে ফিরে গেল। নিজের উপস্থিতি সে কাউকে জানতে দিল না।

বানর গল্পের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ডাক্তার দ্বিতীয় গল্প শুরু করল। পুতুল। এই গল্পটিও চোখ বড় বড় করে শুনল এবং এক সময় হেসে উঠল খিলখিল করে।

ডাক্তার বানর বিষয়ক তৃতীয় গল্প খুঁজতে শুরু করল। তেমন কোন গল্প মনে পড়ছে না। এই মেয়েটি বানর ছাড়া অন্য কোন গল্পে হাসবে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। রিক্সাটা নেয়া ঠিক হবে না। বানর সংক্রান্ত গল্পই মনে করতে হবে। ডাক্তারের ধারণা মেয়েদের ব্রেইন Unidirectional. যে মেয়ে বানর সংক্রান্ত রসিকতায় হাসে সে অন্য রসিকতায় হাসবে না। তাকে বানর বিষয়ক গল্পই বলতে হবে। অন্য গল্প না। নারী জাতি খুব প্রবলেমের জাতি। এক চক্ষু হরিণীর মত।

পর্ব ১৯ শেষ 📌

🔴পর্ব :২০🔴

নাস্তার টেবিলে সোবাহান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ফরিদ তুমি যাওনি, ফরিদ তার চেয়েও বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় যাব?

তুমি বলেছিলে— এ বাড়িতে থাকবে না।

ফরিদ টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল, ভালমত চিন্তা করে দেখলাম- হুট করে কোন ডিসিসান নেয়া উচিত না।

তাহলে মিথ্যা কথা বললে কেন?

মিথ্যা কখন বলালাম?

গত রাতেই তো বললে।

বলেছি ভাল করেছি। এই নিয়ে আপনি দায়া করে এখন ক্যাট ক্যাট করবেন না। এমিতেই রাতে ভাল ঘুম হয়নি।

ফরিদ তার নাশতার প্লেট নিয়ে নিজের ঘর চলে গেল।

সোবাহান সাহেব, এমদাদ খোন্দকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেশটা নষ্ট হচ্ছে কেন জানেন?

দেশ নষ্ট হচ্ছে কি হচ্ছে না। এই নিয়ে এমন্দাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। এমদাদ এই মুহুর্তে রুটিতে পুরু করে মাখন লাগাতে ব্যস্ত। দেশ সম্পর্কে ভাববার ফুসরত কোথায়?

এমদাদ বলল, আমাকে কিছু বললেন?

হ্যাঁ। দেশটা কেন নষ্ট জানেন?

জ্বি না।

জানতে হবে। এসব নিয়ে ভাবতে হবে। শুধু মাখন দিয়ে রুটি খেলে হবে না।

অবশ্যই। অবশ্যই ভাবতে হবে।

সোবাহান সাহেব কঠিন গলায় বললেন, দেশটা নষ্ট হবার মূল কারণ হল আমাদের মিথ্যা বলার প্রবণতা।

তাতো ঠিকই বলেছেন জনাব। একবারে ঠিক।

জাতি হিসেবেই আমরা মিথ্যাবাদী।

অবশ্যই।

আমরা প্ৰতিজ্ঞা করি প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গার জন্যে।

আসল কথা বলেছেন। লাখ কথার এক কথা।

এমদাদ, সোবাহান সাহেবের প্রতিটি কথায় একমত হতে লাগল। সে সাধারণত করো কোন কথাতেই দ্বিমত পোষণ করে না। এমদাদ তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করেছে যে মানুষের সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার একটা পথ হচ্ছে সব কথায় একমত হওয়া।

এমদাদ সাহেব?

জ্বি।

সত্যি কথা বলার প্রবণতা যদি আমাদের মধ্যে বৃদ্ধি পায় তাহালে কিন্তু সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

অবশ্যই হয়।

মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা। চারদিকে শুধু মিথ্যা। এটা দূর করতে হবে।

সত্যবাদী জাতি হিসেবে আমরা যদি নিজেদের প্রমাণ করতে পারি। তাহলে অবস্থাটা কি হবে আপনি কি চিন্তা করে দেখেছেন এমদাদ সাহেব?

জ্বি না।

আমার গা শিউরে উঠছে। পৃথিবীর লোক জানবে বাঙালি মিথ্যা বলে না। বাঙালি সত্যবাদী। আমাদের আসনটা কি রকম হবে চিন্তা করুন। কত সম্মান কর…

সোবাহান সাহেব আবেগে আপুত হয়ে কথা শেষ করতে পারলেন না। বাঙ্গালী জাতিকে সত্যবাদী কি করে করা যায়। তাই নিয়ে ভাবতে লাগলেন। গাঢ় স্বরে বললেন, এমদাদ সাহেব?

জি।

জিনিসটা নিয়ে ভাবতে হবে।

অবশ্যই হবে।

চা শেষ না করেই সোবাহান সাহেব উঠে পড়লেন। ক্ষুধা অবশ্যই একটি ভয়াবহ ব্যাপার। তবে তারো আগে হচ্ছে সত্যবাদিতা। একটি সত্যবাদী জাতি নিশ্চয়ই ক্ষুধায় কষ্ট পাবে না।

এমদাদ নাশতার টেবিলে একা বসে রইল। তার জন্যে ভালই হল। একা থাকলে ইচ্ছামত খাওয়া দাওয়া করা যায়। একটা ডিমের জায়গায় দুটা ডিম নিলে কেউ বলবে না- এই বয়সে দুটা ডিম খাওয়া ঠিক না। কোলেস্টরল নাকি যেন ঝামেলা হয়। ডাক্তার ছোকরা বলছিল। আরে বাবা আল্লাহতালা তাহলে ডিম দিয়েছেন কি জন্যে? খাওয়ার জন্যেই তো। আল্লাহতালা তো না ভেবে চিন্তে কিছু দেন নাই। তিনি না ভেবে চিন্তে কিছু করবেন তা— কি হয়?

মিলি এসে বলল, বাবার কি নাশতা খাওয়া শেষ হয়ে গেল চাচা?

হ্যাঁ মা।

চা-তো শেষ করেননি।

সুখি মানুষ। মাথার মধ্যে হঠাৎ একটা চিন্তা এসে গেল— খাওয়া দাওয়া বন্ধ।

মিলি চিন্তিত গলায় বলল, আবার কি চিন্তা?

মিলি চিন্তিত মুখে বাবার ঘরের দিকে এগুলো।

এমদাদ প্লেটে পড়ে থাকা তৃতীয় ডিমটিও নিয়ে নিল। দুটা খাওয়া গেলে তিনটিও খাওয়া যায়। যাহা বাহান্ন তাহা পয়ষট্টি। এমন্দাদের মনও আজ খুব প্ৰসন্ন। কোন প্ৰসন্ন নিজেও ঠিক বুঝতে পারছে না। পুতুলের কাছ থেকে গত রাতের বর্ণনা শোনার পর থেকেই মনটা দ্রবীভূত অবস্থায় আছে। নতুন আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। আশার আলো ডাক্তার ছোকরা প্রসঙ্গে। চেষ্টা চরিত্র করে পুতুলের সঙ্গে এই ছোকরাকে গেথে ফেলা খুব কি অসম্ভব? এই জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। এই জগতে সবই সম্ভব। চেষ্টা চালাতে হবে। চেষ্টা।

সোবাহান সাহেব সত্য দিবস বিষয়ে চিন্তা করছেন। তাঁর চিন্তার সূত্রগুলো এখনো স্পষ্ট নয়। তবু তিনি যা ভাবছেন তা হচ্ছে সপ্তাহের একটি দিনকে কি সত্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করা যায় না? যেমন মঙ্গলবার, কিংবা বুধবার। এই দিনে কেউ মিথ্যা কথা বলবেন না। সবাই সত্য কথা বলবে। সব বড় বড় কাজ ঐ দিনটির জন্য নির্দিষ্ট থাকবে। প্রয়োজনে এই দিন আরো বড় করে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়া যায়। যেমন বিশ্ব স্বাক্ষরতা দিবস, বিশ্ব শিশু দিবস ঠিক এই রকম হবে বিশ্ব সত্য দিবস। এই দিনে পৃথিবীর সব মানুষ সূর্যোদয় থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত শুধুই সত্যি কথা বলবে।

মিলি ঘরে ঢুকে বলল, বাবা তুমি চা না খেয়েই চলে এসেছ?

টেবিলের উপর রাখ মা, খাব।

নতুন কিছু নিয়ে ভাবা শুরু করেছ?

হুঁ। সত্য দিবস।

ভাল।

না শুনেই বলে ফেললি ভাল? আগে জিনিসটা কি জানিবি তারপর বলবি ভাল। বোস- বুঝিয়ে বলছি।

আজ আমার সময় নেই বাবা। অন্য একদিন শুনব।

সেটাও মন্দ না। আমি নিজেও এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হইনি। প্রচুর ভাবনা চিন্তা করতে হবে। দেশটা পড়ে গেছে মিথ্যার খপ্পরে। সত্য। আজ নির্বাসিত। সেই নির্বাসিত সত্যকে প্ৰতিষ্ঠা করতে হবে।

চা খাও বাবা। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।

দেশটাই ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে মা। আর চা। আগে দেশটাকে আমাদের চাঙ্গা করতে হবে। দেশটা চলে গেছে কোন্ড ষ্টোরেজে। সেখান থেকে দেশটাকে বের করে তাকে গরম করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সত্যকে। একবার সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। আচ্ছা আনিস ছোকরা কি ফিরেছে? ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার।

জ্বি বাবা উনি ফিরেছেন। ডেকে দেব?

না থাক। আমি চিন্তাগুলো আরো গুছিয়ে নেই। এখনো সব এলোমেলো আছে। তুই কাজে যা। তোকে দেখে এখন কেন জানি রাগ লাগছে।

মিলি শুকনো মুখে বাবার ঘর থেকে বের হল। তার নিজের শরীরটা ভাল নেই। জুর জুর লাগছে। বাবার বকবকানি শুনতে একটুও ভাল লাগছে না।

সোবাহান সাহেব সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাবলেন। মাগরেবের নামাজের পর পারিবারিক সভা ডাকলেন। তিনি একটা স্থির সিদ্ধান্তে এসেছেন। এই সিদ্ধান্তের কথা পারিবারিক সভাতে জানানোই ভাল।

পারিবারিক সভাগুলো সাধারণত রাতের খাবারের পর হয়। এটা জরুরি সভা বলে আগেই শুরু হল। সভার শেষে রাতের খাওয়া হবে।

বসার ঘরে সভা বসছে। পারিবারিক সদস্যদের বাইরেও কিছু মানুষজন আছে যেমন এমদাদ ও তার নাতনী। আনিসের পুত্ৰ কন্য। আনিস আসেনি তার মাথা ধরেছে। সভার শুরুতে উপস্থিত সদস্যদের দস্তখত নেয়া হল। যে কোন পারিবারিক সভার এই অংশটি রহিমার মার খুব পছন্দ। আগে সে টিপ সই দিত। এখন দস্তখত দেয়। দস্তখত দেয়া নতুন শিখেছে। দস্তখত দিতে তার বড় ভাল লাগে।

পারিবারিক সভার প্রসিডিংস সাধারণ লিখে মিলি। আজ বিলু লিখছে। কে কি বলছে, কি আলোচনা হচ্ছে সবই লিখিতভাবে থাকার কথা। তা সব সময় সম্ভব হয় না। বিলু মিলির মত দ্রুত লিখতে পারে না।

সভার শুরুতে সোবাহান সাহেব পুরো ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করলেন। তিনি মনে করেন। সপ্তাহে অন্তত একটি দিন সত্যি কথা বলার চেষ্টা আমাদের থাকা উচিত ইত্যাদি…। তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতার পর তিনি এই প্রসঙ্গে অন্যদের মতামত চাইলেন। কারো কিছু বলার থাকলে সে বলতে পারে। তবে বলার আগে হাত তুলতে হবে। প্রস্তাবের পক্ষে হলে ডান হাতু। প্রস্তাবের বিপক্ষে হলে বা হাত।

সোবাহান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে লক্ষ্য করলেন ফরিদ দুহাত তুলে বসে আছে। সোবাহান সাহেব বললেন, তুমি কিছু বলতে চাও?

জি।

প্রস্তাবের পক্ষে না বিপক্ষে।

দুটোই।

তার মানে? রসিকতা করছি না-কি?

ফরিদ গম্ভীর গলায় বলল, আপনার সাথে রসিকতা করার অধিকার আমার আছে। সম্পর্ক সেই রকম। তবে আজ আমি আপনার প্রস্তাব একই সঙ্গে সমর্থন করছি আবার করছি না।

তার মানেটা কি?

সত্য দিবসে আমরা যেমন সত্য কথা বলব মিথ্যা দিবসে আমরা তেমনি শুধু মিথ্যা কথা বলব। সূর্যোদয় থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত শুধুই মিথ্যা। ঘরে মিথ্যা বলব, বাইরে মিথ্যা বলব, এমনকি সেদিন যদি মসজিদে যাই সেখানেও মিথ্যা বলব।

সোবাহান সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ফরিদ সেই অগ্নিদৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, সমস্ত দিন মিথ্যা কথা বলার ফল কি হবে সেটাও বলে দিচ্ছি মিথ্যা কথা বলতে ইচ্ছা করবে না। পারিবারিক পর্যায়ে যেমন মিথ্যা। দিবস থাকবে তেমনি জাতীয় পর্যায়েও মিথ্যা দিবস থাকবে। সেই দিন দেশের সবচে বড় মিথ্যাবাদীকে আমরা পুরস্কার দেব। উপাধিও দেয়া হবে। যেমন – মিথ্যা শ্রেষ্ঠ। কিংবা জাতীয় মিথ্যুক।

চুপ কর।

চুপ করব কেন? পারিবারিক সভায় আমার কথা বলার পুরো অধিকার আছে। আমি অবশ্যই কথা বলতে পারি। হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম- দেশে একট মিথ্যা একাডেমী স্থাপিত হবে। সেই একাডেমীর কাজ হবে জাতীয় পর্যায়ের মিথু্যকরা কে কি ভাবে মিথ্যা বলছেন তার একটা রেকর্ড রাখা। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরুন। এক নেতা পত্রিকায় একটা বিবৃতি দিলেন। দুদিন পর সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা বিবৃতি দিলেন। একাডেমীর কাজ হবে এই সব লক্ষ্য রাখা। এবং প্রয়োজনবোধে বাংলা একাডেমী পুরস্কারের মত মিথ্যা একাডেমী পুরস্কার প্রচলন করা যেতে পারে। এই মুহুর্তে একজনের নাম প্রকাশ করতে পারি যিনি সাধারণত মসজিদে মিথ্যা বলেন। সেই মিথ্যা ফলাও করে রেডিও টিভিতে প্রচার করা হয়।

সোবাহান সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, তোমার বক্তব্য শেষ হয়েছে?

জ্বি না। আমার আরো কিছু বলার আছে।

তুমি যে একটা গাধা তা কি তোমার জানা আছে?

দুলাভাই পারিবারিক সভায় একজন সদস্যকে গাধা বলাটা ঠিক হচ্ছে না।

অবশ্যই ঠিক হচ্ছে। বিলু তুই লেখ পারিবারিক সভায় ফরিদকে গাধা সাব্যস্ত করা হল। কাজগপত্রে রেকর্ড থাকা দরকার। বিলু বলল, তুমি একা গাধা বললেতো বাবা হবে না। সবাইকে একমত হতে হবে। তাছাড়া আমি নিজে মনে করি মামার আইডিয়ার একটা স্যাটায়ারিক্যাল ভ্যালু আছে।

কাদের এই পর্যায়ে উঠে দাঁড়াল এবং গভীর গলায় বলল, আমার মনে হয় মামার মত বুদ্ধির লোক এই দুনিয়ায় আল্লাহতালা বেশি পয়দা করে নাই। এইটা কাগজে-পত্রে ছাপা দরকার। আফা আপনে আমার মতামত লেখেন।

বিলু সোবাহান সাহেবের মতামতের পাশে কাদেরের মতামতও লিখল। তবে সভায় শুধু মাত্র সত্য দিবসের উপরই সিদ্ধান্ত নেয়া হল। ঠিক হল এই বাড়িতে মঙ্গলবার হবে সত্য দিবস। এই সত্য দিবসে কেউ কোন মিথ্যা বলবে না। কাদের প্রশ্ন তুলল, জীবন রক্ষার জন্যে যদি মিথ্যা বলার দরকার হয় তখন কি করা? এর উত্তরে সোবাহান সাহেব বলল, চুপ কর গাধা।

কাদের অন্ধকার মুখ করে বলল, বিষয়টার নিন্দা হওয়া দরকার।

গভীর বিস্ময়ে পুরা ব্যাপারটা পুতুল লক্ষ্য করছে। এ রকম একটা ব্যবস্থা যে কোন বাড়িতে চালু থাকতে পারে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। জীবনকে আনন্দময় করে তোলার এই সব উপকরণ তাকে মুগ্ধ ও অভিভূত করল। শুধু এমদাদ খোন্দকার সারাক্ষণ মুখ বিকৃত করে রইলেন এবং রাতে ঘুমুতে যাবার সময় পুতুলকে বললেন, আইজ একটা জিনিস শিখলাম পুতুল।

পুতুল বলল, কি জিনিস?

আইজ শিখলাম যে দলের গোদা যদি বেকুব হয় তা হইলে সব কয়টা বেকুব হয়। এই বাড়ির সব কয়টা মানুষ চাপে বোকা এইটা লক্ষ্য করছস?

পুতুল মুগ্ধ স্বরে বলল, এসব কাণ্ড কারখানা আমার বড় ভাল লাগছে। এদের নিয়ে কোন মন্দ কথা তুমি বলব না দাদাজান।

বেকুবরে বেকুব বলব না?

এরা বেকুব না। দাদাজান। এরা…

পুতুল কথা শেষ করল না। তার অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু দাদাজানকে এসব বলার অর্থ হয় না। দাদাজান বুঝবে না। সবাই সব জিনিস বুঝে না।

পুতুলের ইচ্ছা করছে তার নিজের যখন একটা সংসার হবে সেই সংসারেও এ রকম পারিবারিক সভা বসবে। সেই সভার সব বিবরণও এরকম করে লেখা হবে। আলোচনা হবে। জীবনের একঘেয়েমি এইভাবেই দূর করা হবে। একটাইতো আমাদের জীবন। লক্ষ কোটি জীবনতো আমাদের না। কেন আমরা এই জীবনকে সুন্দর করব না।

সত্য দিবস খুব কঠিনভাবে পালিত হতে থাকল।

মঙ্গলবার ভোরে ব্ল্যাক বোর্ডে লেখা হয় আজ সত্য দিবস। কাদের সেই ব্ল্যাক বোর্ডে বসার ঘরে ঝুলিয়ে দিয়ে আসে। সত্য দিবস শুরু হয়। কাদের এবং রহিমার মা দুজনই। এই দিবস কঠিন ভাবে মেনে চলে। যে ইলিশ মাছ অন্যদিন পঞ্চাশ টাকায় আনা হয়। সেই মাছ মঙ্গলবার কেনা হয় চল্লিশ টাকায়।

মিতু বিস্মিত হয়ে বলেন, আজ মাছ সস্তা নাকি?

কাদের উদার হয়ে বলে— না।

মিনু বলেন, তাহলে তুই চল্লিশ টাকায় এই মাছ আনলি কি করে?

কাদের চুপ করে থাকে। কথা বলতে গেলেই সমস্যা। থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে। সারাটা দিন তার বড়ই অস্বস্তিতে কাটে। রাত বারটায় হাফ ছেড়ে বাঁচে।

পুতুলও সত্য দিবসের ব্যাপারটা খুব মনে রাখতে চেষ্টা করে। এমনিতেই তার মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। তবু মঙ্গলবারে সে আরো সাবধান থাকে। যেন ভুলেও কোন মিথ্যা বের না হয়। পুতুল খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করল এই মঙ্গলবারেই বেছে বেছে তার দাদাজান বড় বড় মিথ্যা কথাগুলো বলেন। কেন তিনি এমন করেন কে জানে। মিথ্যা কথাগুলো অন্যদিন বললে কি হয়? এই নিয়ে আনিসের সঙ্গে তার কথা হল। আনিস হেসে বলল, সত্য দিবসের ব্যাপারটা তুমি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছ বলে মনে হয়। এটা এমন কঠিন ভাবে গ্রহণ করার কিছু নেই।

পুতুল বিস্মিত হয়ে বলল, নেই কেন?

আনিস হাসতে হাসতে বলল, পুরো ব্যাপারটাই ভুল।

ভুল?

হ্যাঁ ভুল। সপ্তাহের একটা বিশেষ দিন সত্য দিবস এর মানে হচ্ছে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে মিথ্যা বলা যাবে। সত্য বলতে হবে সত্য দিবসে। ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে না?

পুতুল কিছু বলল না। সে খানিকটা ধাধায় পড়ে গেছে। এমন ভাবে সে ভাবেনি আনিস বলল, দেখ পুতুল–দিবসের ব্যাপারটাই আমার ভাল লাগে না— একটা বিশেষ দিনকে করা হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। সব দিনইতো শিশু দিবস হওয়া উচিত। উচিত না?

হ্যাঁ তাতো ঠিকই।

অবশ্যি এইসব দিবসের একটা উপকারিতাও আছে।

কি উপকারিতা?

মনে করিয়ে দেবার একটা ব্যাপার আছে। বছরের একটি বিশেষ দিনকে সত্য দিবস করা মানে ঐ দিনে সত্য কথার প্রয়ােজনীয়তার দিকটির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

পুতুল বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি দুদিকেই যুক্তি দিতে পারেন।

আনিস হাসতে হাসতে বলল, তা পারি। এই পৃথিবীতে সব কিছুর অভাব আছে কিন্তু যুক্তির অভাব নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যেমন কঠিন যুক্তি আছে বিপক্ষেও তেমনি কঠিন যুক্তি আছে।

আপনি আল্লাহ বিশ্বাস করেন না কেন?

তুমি কর?

কি আশ্চৰ্য আমি করব না? আপনি সত্যি করেন না?

না। রাত্রির সঙ্গে এই নিয়ে প্রায়ই আমাদের ঝগড়া হত। সে তর্কে হেরে যেত। তর্কে হেরে গেলেই তার অসম্ভব মেজাজ খারাপ হত। একবার তর্কে হেরে সে কি করল জান? আমার খুব দামী একটা পাঞ্জাবী ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলল।

আনিস অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। রাত্রির কথা সে কখনো মনে করতে চায় না। কিন্তু এই মেয়েটির নানান ভঙ্গিতে রাত্রির কথা মনে করিয়ে দেয়। এটি কি পুতুল ইচ্ছা করেই করে?

আনিস খানিকটা অস্বস্তিও বোধ করে। পুতুলের চোখে সে এক ধরনের মুগ্ধতা দেখতে পায়। এই মুগ্ধতা সব সময় থাকে না। হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠে। পরীক্ষণেই মেয়েটির মুখ বিষণ্ণ হয়ে যায়। আনিস রাত্রির চোখেও এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছিল। এই মুগ্ধতা দেখার একটা আলাদা নেশা আছে। একবার দেখতে পেলে বার বার দেখতে ইচ্ছা করে। আনিস লক্ষ্য করছে সে ইদানিং নিজের অজান্তেই এই মেয়েটিকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে। সে জানে ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। সাবধান হতে হবে। আরো সাবধান হতে হবে।

এমদাদ সাহেব তাঁর এ বাড়িতে আসার কারণ পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার জন্য যে দিনটি বেছে নিল সে দিনটি মঙ্গলবার- সত্য দিবস।

সকাল বেলা সোবাহান সাহেব বাগানে হাটছিলেন। এমদাদ সেখানেই তাকে ধরল। সোবাহান সাহেব বললেন, কিছু বলবেন?

এমদাদ বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, অবশ্যই বলব। আপনারে বলবনাতো বলব কারে? আপনে হইলেন বটবৃক্ষ।

গৌরচন্দ্রিকার দরকার নেই। কি বলতে চান বলে ফেলুন।

এমদাদ হাত কচলে বলল, নাতনীটার একটা ব্যবস্থা করার জন্য জনাবের কাছে আসলাম। জানি— মুখ ফুটে এবার বলে ফেলতে পারলে সব সমস্যার সমাধান। বলেই ফেললাম। এখন আপনি হইলেন বটবৃক্ষ। যা করবার আপনি করবেন। আমার কাজ শেষ।

আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। কার কি ব্যবস্থার কথা বলছেন?

পুতুলের একটা বিবাহ দেয়ার কথা বলতেছি।

পুতুলের বিয়ে? কি বলছেন। আপনি? ওতো বাচ্চা একটা মেয়ে। মেট্রিক পাস করেছে এখন পড়াশোনা করবে।

মেয়েছেলে পড়াশোনা করে কি করবে জনাব? মেয়েছেলেকে তৈরি করা হয়েছে সন্তান পালনের জন্য।

সোবাহান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, এসব বলছে কে আপনাকে? মেয়েরা কি সন্তান তৈরির মেশিন না-কি?

বলতে গেলে তাই। বুঝতেছি আপনার শুনতে খারাপ লাগতেছে তবে এইগুলো হলো সত্য কথা। আজ মঙ্গলবার সত্য দিবস। মিথ্যা বলে পাপ করব আমি এমন লোক না। তা ছাড়া জনাব আমি বেশি দিন বাঁচব না। মৃত্যুর আগে দেখতে চাই নাতনীটার একটা গতি হয়েছে। এইটা দেখে যেতে পারলে মরেও শান্তি।

সোবাহান সাহেবের চোখের দৃষ্টি থেকে বিরক্ত ভাবটা গেল না। বরং আরো দৃঢ় হল। তিনি কঠিন গলায় বললেন, এত অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের পক্ষপাতি আমি না। আমার ফিলসফি হচ্ছে- মেয়েরা পুরোপুরি স্বাবলম্বী হবার পর বিয়ে করবে। পুতুলের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার এখানে থেকেই সে পড়াশোনা করতে পারে। তাছাড়া তার নিজেরও সে রকম ইচ্ছা। আমাকে কিছু বলেনি। তবে আমার স্ত্রীকে বলেছে।

এমদাদের মুখ হা হয়ে গেল। পুতুল তাকে না জানিয়ে ভেতরে ভেতরে এই কাজ করছে তা সে কল্পনা করেনি। এমদাদ বলল, পড়াশোনার কথা যে বলছেন জবান সেতো বিয়ের পরেও হতে পারে। একটা ভাল ছেলে যদি পাওয়া যায়। সে বিয়ের পরেও মেয়ে পড়াবে।

সে রকম ছেলে পাবেন কোথায়?

এমদাদ নিচু গলায় বলল, হাতের কাছে একজন আছে। আপনি মুখে একটা কথা বললে বিয়েটা হয়ে যায়। আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারি।

সেই ছেলে কে?

মনসুর আমাদের ডাক্তার।

ডাক্তার?

জ্বি। পুতুলারে তার খুবই পছন্দ। সব সময় দেখি কুটুর কুটুর গল্প করে।

তাই না-কি?

এক রাতে মনসুর এই বাড়িতে ছিল। ঐ রাতে পুতুল নিজেই ভাত টাত বেড়ে খাওয়াল। তার থেকে বুঝলাম পুতুলের নিজেরও ইচ্ছা আছে। এখন আপনি যদি শুধু একটু বলেন তাহলেই দুই হাত এক করে দিতে পারি।

কাকে আমি কি বলব?

মনসুরকে বলবেন।

আমি বললেই হবে?

অবশ্যই।

আচ্ছা দেখি।

তাতো দেখবেনই। আপনি না দেখলে কে দেখবে? আপনি হইলেন বটবৃক্ষ।

বটবৃক্ষ শব্দটা আমার সামনে দয়া করে আর উচ্চারণ করবেন না।

জি আচ্ছ- তবে সত্য কথা না বলেই বা কি করি? আজ আবার মঙ্গলবার। সত্য দিবস। বটবৃক্ষকে বটবৃক্ষ না বললে— মিথ্যাচার হয়।

সোবাহান সাহেব কঠিন চোখে তাকালেন। সেই দৃষ্টির সামনে এমদাদ চুপসে গেল। বটবৃক্ষ বিষয়টা নিয়ে আর আগানো ঠিক হবে না। তবে আজকাল মন্দ অগ্রসর হয়নি।

চলবে। 📌