বহুব্রীহি পর্ব-৫+৬

0
4

🔴বহুব্রীহি (পর্ব :৫, ৬)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

নিরিবিলি বাড়ির সবচে সরব মহিলা–রহিমার মার মুখে আজ সারাদিন কোন কথা নেই। মিনু ব্যাপারটা লক্ষ করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রহিমার মা?

রহিমার মা থমথমে গলায় বলল, কি হয় নাই। গরিবের আবার হওয়া হওয়ি। গরিবের কিছুই হয় না।

মিনু আর তাকে ঘাটালেন না। চুপচাপ আছে ভাল আছে, কথা বলা শুরু করলে মুশকিল।

সন্ধ্যায় চা বানাতে বানাতে রহিমার মা নিজের মনেই বলল, গরিবের দুঃখ কেউ বুঝে না। মাইনষেতো বুঝেই না আল্লায়ও বুঝে না।

খুবই ফিলসফিক কথা। এ জাতীয় কথাবার্তা বলা শুরু করলে বুঝতে হবে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে।

যা ঘটেছে তাকে ভয়াবহ বলা ঠিক হবে না। ঘটনা ঘটেছে গত রাতে। কাদের এবং রহিমার মা এক ঘরে ঘুমোয়। কাজকর্ম শেষ করে রাত এগারোটায় দিকে রহিমার মা ঘুমুতে এসে দেখে কাদের জেগে বসে আছে। কাদেরের চোখে নতুন চশমা। কাদেরকে কেমন ভদ্রলোক ভদ্রলোক লাগছে। কাদের বলল, কেমন দেহায় খালাজী?

রহিমার মা তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারল না। বিস্ময় সামলাতে সময় লাগল।

চশমা কই পাইছস?

কিনলাম। একশ দশ টেকা দাম। টেকা পয়সার দিকে চাইলেতো হয় না খালাজী। টেকা পয়সা হইল বাটপাতা। আইজ আছে কাইল নাই। জেবন তো বটপাতা না। জেবনের সাধ আহ্লাদ আছে। কি কন খালাজী?

রহিমার মা জবাব দিল না। কাদের চোখে থেকে চমশা খুলে গম্ভীর ভঙ্গিতে কাচ পরিস্কার করতে করতে বলল, জিনিসটার প্রয়োজনও আছে খালাজী। চেহারা সুন্দরের কথা বাদ দিলেও জিনিসটার বড়ই দরকার। চউক্ষে ধুলাবালি পড়ে না। রইদ কম লাগে। চউক্ষের আরাম হয়।

দাম কত কইলি?

একশ দশ। পাওয়ার দিলে আরো বেশি পড়ত। বিনা পাওয়ারে নিলাম। বুড়াকালে পাওয়ার কিনুম।

রহিমার মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আটকে রাখতে পারল না। এই কাদের ছোকরা বড়ই শৌখিন। বেতনের টাকা পেলেই এটা ওটা কিনে ফেলে। গত মাসে কিনেছে কলম। কলম কিনে এনে গম্ভীর গলায় বলেছে, কলম কিনলাম একটা খালাজী, চাইনিজ।

রহিমার মা অবাক হয়ে বলেছে, কলম দিয়া তুই করবি কি? লেহাপড়া জানছ?

কাদের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে লেহাপড়া কপালে নাই করমু কি কন? লেহাপড়া না জানলেও কলম এটা থাকা দরকার। পকেটে কলম থাকলে বাইরের একটা লোক ফাঁট কইরা তুমি বইল্যা ডাক দিব না। বলব, ভাইসাব।

রহিমার মারও খুব শখ ছিল একটা কলম কেনার। তবে কাদের যেমন কলম পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারে সে তা পারবে না জেনে কেনে নি। এখন আবার চশমা কিনে ফেলেছে। ঈর্ষায় রহিমার মার চোখ জ্বালা করতে লাগল।

কাদের বলল, দেহায় কেমন খালাজী?

রহিমার মা বিরক্ত মুখে বলল, যেমুন চেহারা তেমুন দেহায়। ভ্যান ভ্যান করিস না।

আয়নায় অনেকক্ষণ কাদের নিজেকে দেখল। তারপর বারান্দায় একটু হেঁটে আসল। চমশা পরার পর তার হাঁটার ভঙ্গিও বদলে গেছে।

সেই রাতে মনের কষ্টে রহিমার মার ঘুম হল না। তার মেজাজ খারাপের এই হচ্ছে পূর্ব ইতিহাস। মিনু পূর্ব ইতিহাস জানেন না। কাজেই রহিমার মা যখন এসে তাঁকে বলল, আমার চউক্ষে যেন কি হইছে আম্মা, তখন সঙ্গত কারণেই চিন্তিত হয়ে বললেন, কি হয়েছে?

চাউখ খালি কড় কড় করে।

তাই না-কি?

আবার চিলিক দিয়ে বেদনা হয়।

ডাক্তার দেখাও।

ডাক্তার লাগতো না আম্মা। চশমা দিলে ঠিক হইব। চশমার দাম বেশি নাএকশ দশ। কাদের কিনছে।

কাদের চশমা কিনেছে?

জি আম্মা। জেবনের একটা সাধ আহলাদ আছে না?

মিনু বিরক্ত হয়ে বললেন, কাদের যা করে তোমাকে তাই করতে হবে? তুমি বড় যন্ত্রণা কর রহিমার মা।

কয় দিন আর বাঁচুম আম্মা কন?

আচ্ছা ঠিক আছে যাও চশমা দেয়া হবে।

রহিমার মার চোখে আনন্দে পানি এসে গেল।

চশমা এল তার পরের দিন। রহিমার মা মুগ্ধ। আয়নায় সে নিজেকে চিনতে পারে না। কাদের বলল, ময়লা শাড়িডা বদলাইয়া একটা ভাল দেইখ্যা শাড়ি পরেন। খালা। চশমার একটা ইজজত আছে।

রহিমার মা তৎক্ষণাৎ শাড়ি বদলে গত ঈদে পাওয়া সাদা শাড়ি পরে ফেলল। নতুন শাড়ি এবং চশমার কারণে ছোট খাট একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

মনসুর বিকেলে এসেছে। তাকে খবর দেয়া হয় নি, নিজ থেকেই এসেছে। এ বাড়িতে আসবার জন্যে অনেক ভেবেচিন্তে একটা অজুহাতও তৈরি করেছে। অজুহাত খুব যে প্রথম শ্রেণীর তা নয়, তবে মনসুরের কাছে মনে হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর। সে ঠিক করে রেখেছে মিলিকে বলবে, আজ আমার জন্মদিন। কাজেই এই বাড়ির মুরুত্বীদের দোয়া নিতে এসেছি। জন্মদিনের কথায় সবাই খানিকটা দুর্বল হয়। মিলিও নিশ্চয়ই হবে। যতক্ষণ কথা বলার প্রয়োজন তার চেয়েও কিছু বেশি কথা বলবে। চা নাশতা দেবে। একটা মানুষতো আর একা একা বসে চা খাবে না। মিলি বসবে তার সামনে। কি ধরনের কথা সে মিলির সঙ্গে বলবে তা মোটামুটি ঠিক করা। কয়েকটা হাসির গল্প বলবে মিলিকে হাসিয়ে দিতে হবে। মেয়েরা রসিক পুরুষ খুব পছন্দ করে। হাসির গল্প সে নিজেও পছন্দ করে কিন্তু তেমন বলতে পারে না।

মনসুর দরজার বেল টিপল। দরজা খুলে দিল রহিমার মা। তার চোখে চশমা, পরনে ইস্ত্রী করা ধবধবে সাদা শাড়ি। মিলি সোফায় বসে কি একটা ম্যাগাজিন পড়ছে।

মনসুর রহিমার মার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, আজ আমার জন্মদিন।

রহিমার মা এবং মিলি দুজনই বিস্মিত হয়ে ডাক্তারে দিকে তাকাল। মনসুর মুখের হাসি আরও বিস্তৃত করে বলল, ভাবলাম জন্মদিনে মুরুব্বীদের কাছে থেকে দোয়া নিয়ে যাই। আপনি আমার জন্যে দোয়া করবেন–

এই বলে মনসুর নিচু হয়ে রহিমার মা-র পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল।

মিলি তার হতভম্ব ভাব সামলে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, রহিমার মা যাওতো ডাক্তার সাহেবের জন্যে চা নিয়ে এসো।

রহিমার মা চলে যেতেই মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, মনে হচ্ছে একটা ভুল হয়ে গেছে।

হ্যাঁ কিছুটা হয়েছে। আপনি মুরুব্বীদের দোয়া নিতে এসেছেন। রহিমার মা বয়সে আপনার অনেক অনেক বড় সেই হিসেবে মুরুব্বী–কাজেই এত আপসেট হচ্ছেন কেন? বসুন। যা হবার হয়ে গেছে।

জ্বি না। বসব না। কাইন্ডলি এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি যদি খাওয়ান। আমি ঠিক বুঝতে পারি নি। কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম।

আপনি বসুন। পৃথিবী উল্টে যাবার মত কিছু হয়নি। এ রকম ভুল আমরা সব সময় করি।

মিলি ভেতর থেকে ঠাণ্ডা পানি এনে দেখল ডাক্তার নেই। এই প্রথম ডাক্তার ছেলেটির জন্যে সে এক ধরনের মায়া অনুভব করল। তার ইচ্ছা করতে লাগল। কাদেরকে পাঠিয়ে মনসুরকে ডেকে আনায়। চা খেতে খেতে দুজনে খানিকক্ষণ গল্প করে। বেচারা বড় লজ্জা পেয়েছে।

পর্ব ৫ শেষ 📌

🔴পর্ব :৬🔴

দুপুরের খাওয়ার পর ফরিদ টানা ঘুম দেয়। বাংলাদেশের জল হাওয়ার জন্যে এই ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজন বলে তার ধারণা। এতে মেজাজের উগ্ৰ ভাবটা কমে যায়–স্বভাব মধু হয়। ফরিদের ধারণা জাতি হিসেবে বাঙালি যে ঝগড়াটে হয়ে যাচ্ছে তার কারণ এই জাতি দুপুরে ঠিক মত ঘুমুতে পারছে না।

তার ঘুম ভাঙল বিকেল চারটায়। চোখ মেলে অবাক হয়ে দেখল। সাত-আট বছরের একটি ফুটফুটে ছেলে এবং চার-পাঁচ বছরের পরীর মত একটি মেয়ে পা তুলে তার খাটে বসে আছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শিশুদের ফরিদ কখনো পছন্দ করে না। শিশু মানেই যন্ত্রণা। ফরিদের ভুরু কুঞ্চিত। সে গম্ভীর গলায় বলল, তোমরা কে?

ছেলেটি তার চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, আমরা মানুষ।

এখানে কি চাও?

কিছু চাই না।

ছোট মেয়েটি বলল, আপনি আমাদের ধমক দিচ্ছেন কেন? ধমক দিলে আমরা ভয় পাই না।

নাম কি তোমার?

আমার নাম নিশা, ওর নাম টগর। ও আমার ভাই।

আপনার নাম কি?

এতো দেখি বড় যন্ত্রণা হলো।

আমাদের নাম জিজ্ঞেস করেছেন আমরা বললাম, এখন আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি আপনি বলবেন না কেন?

আমার নাম ফরিদ।

আপনাকে কি বলে ডাকব?

কিছু ডাকতে হবে না।

বড়দের কিছু ডাকতে হয়, চাচা, মামা, খালু এইসব।

বললাম তো কিছু ডাকতে হবে না।

নাম ধরে ডাকব?

আরো বড় যন্ত্রণা করছে তো। নামো বিছানা থেকে। নামো।

টগর এবং নিশা গম্ভীর মুখে নামল। ঘর থেকে বের হল কিন্তু পুরোপুরি চলে গেল না, পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে রইল। মাঝে মাঝে পর্দা সরিয়ে মুখ দেখায় এবং জীব বের করে ভেংচি কাটে আবার মুখ সরিয়ে নেয়। রাগে ফরিদের সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। এত সাহস এই দুই বিছুর! এল কোথেকে এইগুলো? খুব সহজে এগুলোর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। এরা তার হাড় ভাজা ভাজা করে দেবে। সে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে। শিশুদের সঙ্গে তার এক ধরনের বৈরী সম্পর্ক আছে। শিশুরা তাকে নানান ভাবে যন্ত্রণা দেয়।

ফরিদ ডাকল, কাদের কাদের।

অবিকল ফরিদের মতে করে টগর বলল, কাদের-কাদের।

ফরিদ চেঁচিয়ে বলল, এই বিছু দুটাকে ঘাড় ধরে বের করে দে তো কাদের।

ছোট মেয়েটি ফরিদের মত করে বলল, এই বিছু দুটাকে ঘার ধরে বের করে দেতো।

ফরিদ প্ৰচণ্ড ক্ষোভের সঙ্গে বলল, উফ!

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি বলল–উফ!

টগর, এবং নিশা এখন যে খেলাটা খেলছে। তার নাম নকল খেলা। এই খেলা হচ্ছে মানুষকে রাগিয়ে দেবার খেলা। যাকে রাগিয়ে দেয়া দরকার তার সঙ্গে এই খেলা খেলতে হয়। সে যা বলে তা বলতে হয়। অবশ্যি বড়দের সঙ্গে এই খেলা খেলতে নেই। তবে টগর এবং নিশা দুজনেরই মনে হচ্ছে এই মানুষটা বড় হলে তার মধ্যে শিশু সুলভ একটা ব্যাপার আছে। তার সঙ্গে এই খেলা অবশ্যই খেলা যায়।

ফরিদ বিছানায় উঠে বসল। চাপা গলায় বলল, শিশুরা শোন, আমি কিন্তু প্ৰচণ্ড রেগে যাচ্ছি।

নিশা বলল, শিশুরা শোন, আমি কিন্তু প্ৰচণ্ড রেগে যাচ্ছি।

ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। টগর অবিকল তার মত ভঙ্গিতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বোনকে নিয়ে চলে গেল। দুই বিছু চলে গেছে দেখেও ফরিদের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তার কেবল মনে হচ্ছে এক্ষুনি এই দুইজন ফিরে আসবে।

রাতে রহিমার মা কাঁদো কাঁদো গলায় মিনুকে বলল, আম্মা বড় বিপদে পড়েছি।

মিনু বললেন, কি বিপদ?

নতুন ভাড়াইট্যার পুলা আর মইয়া দুইটা বড় যন্ত্রণা করে।

কি যন্ত্রণা করে?

আমি যে কথাটা কই হেরাও হেই কথাটা কয়। ভেংগায় আম্মা।

বলতে বলতে রহিমা মা কেঁদে ফেলল। মিনু অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন, ছোট দুটা বাচ্চা কি করেছে এতে একেবারে কেঁদে ফেলতে হবে? বাচ্চারা এরকম করেই। সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমার কাছে আসবে না।

টগর এবং নিশা যা করছে তাকে ঠিক সামান্য বলে উড়িয়ে দেবার পথ নেই। তারা বারান্দায় রাখা সোবাহান সাহেবের গড়গড়ায় তামাক টেনেছে। গেট বেয়ে দেয়ালের মাথায় চড়ে সেখান থেকে লাফিয়ে নিচে নেমেছে। মিনুর পানের বাটা থেকে জর্দা দিয়ে পান খেয়ে বমি করে ঘর ভাসিয়েছে। খাবার ঘরের সবগুলো চেয়ার একত্র করে রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলা খেলেছে। মিনু ধমক দিতে গিয়েও দিতে পারে নি। বরং মায়ায় তার মন ভরে গেছে। এই বয়সে বাচ্চাদের কোলে নিয়ে বেড়ানো বেশ শক্ত তবু তিনি দীর্ঘসময় নিশাকে কোলে নিয়ে বেড়ালেন। নিশা দুহাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে রইল। টগর বলল, তুমি আমাকে কখন কোলে নেবে? আমার ওজন বেশি না, নিশার চেয়ে মাত্ৰ পাঁচ পাউন্ড বেশি।

এরকম বাচ্চাদের উপরে কি কেউ রাগ করতে পারে?

চলবে 📌