বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারণ পর্ব-২৩+২৪

0
615

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|২৩|
#শার্লিন_হাসান

সোফায় বসে আছে ফাইজা চৌধুরী সাথে আছে অন্তি। মেঘ এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কী হচ্ছে না হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে।

তখন আফরোজা বেগম তাকে ডেকে রুমে নেন। মির্জাদের দেওয়া বালা জোড়ার খোঁজ করতে জানতে পারেন ব্যাগে পড়ে আছে। আফরোজা বেগম বালা জোড়া নিয়ে ফোন হাতে বাইরে বেড়িয়ে আসেন।

মেঘ খাটে ধপ করে বসে পড়ে। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুকপর ভেতর হাহাকার চলছে। নিজেকে রোবট মনে হচ্ছে। সবাই তাকে শুধু বলছে আর সে অনুযায়ী তাই করছে। নিজের ইচ্ছের মূল্য দিতে পারছে না। এই মূহুর্তে আরিশকে বিয়ে করতে মন চাইছে না সোজা বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে মন চাইছে।

ঘন্টা দুয়েকের মতো অন্তি,ফাইজা চৌধুরী ছিলেন। তাঁদের বিদায় দিয়ে মেঘ রুমে এসে দরজা অফ করে দেয়। হাউমাউ করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। রাখিকে কয়বার জিজ্ঞেস করলো অথচ সঠিক উত্তরটি ফেলো না মেঘ।

মহীউদ্দীন তালুকদার বালা জোড়া দেওয়ার জন্য মির্জা বাড়ীতে যান। আজিয়াকে কল দিয়ে গেটের সামনে আসতে বলেন। সে আসতে বালা জোড়া হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় নেন। সেই সাথে বলে দেন, একটু পর তালুকদার বাড়ীতে চলে যেতে।

মেহরাব, মহীউদ্দীন তালুকদার বাড়ীতে ফিরতে,ফিরতে বারোটা বেজে যায়। তেমন একটা হইচই নেই। সাধারণ দিনের মতোই আজকের দিনটা মনে হচ্ছে। আফরোজা বেগম এবং রাখি রান্নাবান্নার জোগাড় করে নিয়েছেন। তার ঘন্টা দুয়েক পর আজিয়া সাথে মায়া,মোহান এসেছে। মেঘের সাথে কেউই দেখা করেনি এখনো।

রুদ্রর সাথে মেঘর বিয়েটা হবে শোনে মায়া,মোহনা সেই খুশি। মেঘের কষ্ট,ভালোবাসা সবই স্বার্থক হবে মানুষটাকে পেয়ে গেলে। অবশ্য এই খবরটা ভেতরে চাপা রাখতে না পেরে হৃদ,লিমাকে জানায় সাথে চলে আসতে বলে। আফরোজা বেগম বেমালুম ভুলে গিয়েছেন তাঁদের দুজনের কথা। মায়ার কথায় কল দিয়ো তাদের চলে আসতে বলে।

******

রুদ্র জিয়াউর রহমানের সাথে কথা বলে বেড়িয়েছে কিছুক্ষণ আগে। জিয়াউর রহমান তাকে ড্রপ করে দিয়ে আসনে। অসুস্থ তাই একা ছাড়বেন না তিনি। গাড়ীতে বসেই তাঁদের টুকটাক আলোচনা হচ্ছে। এরই মাঝে একপর্যায়ে রুদ্র বলে উঠে,

-আনায়া তো নিবরাস মির্জাকে পছন্দ করে। বলতে পারছে না ভয়ে। মামু আর না করবেন না, নিবরাসের সাথে কথা বলে ব্যপারটা দেখে নিবেন।

-কই আমার তো এমনটা মনে হলো না জারিফ। আনায়াকেও তেমন দেখিনি! সবসময় ভদ্রতা বজায় রাখতে দেখেছি। যদি পছন্দই করতো তাহলে ভাবভঙ্গি অন্যরকম থাকতো কিন্তু এরকম কিছু আমি ওর মাঝে পাইনি।

-মামু আমার মনের খবর আপনি জানেন? একদমই না! যতটুকু আমি প্রকাশ করি ততটুকুই আপনি দেখবেন জানবেন।

-দেখি! নিবরাসকে আমার ও ভালো লাগে। আমার ও পছন্দের ও! এখন মেয়ের যেহেতু ওকে পছন্দ; আমি না করবো না।

হাসে রুদ্র। নিবরাসের উডবিকে তো এক প্রকার সে কেড়েই নিলো! এখন কী আর বেচারাকে একা থাকতে দিবে? উঁহু! রুদ্র এতোটাও স্বার্থপর না। তার বিয়ের জনঢ় পাত্রী ও খুঁজে দিলো। অবশ্য নিবরাসের উচিত তাকে ট্রিট দেওয়া।

নিজের ভাবনায় নিজেই হাসে রুদ্র। ঘন্টা তিনের মাঝে তারা চৌধুরী বাড়ীতে পৌঁছায়।
রুদ্রকে দেখে ফাইজা চৌধুরী জড়িয়ে ধরে কেঁদে ই দেন। তার আদরের নাতি! ভেবে তো ছিলেন ম’রে টরে গেলো বুঝি। কত দোয়া করলেন তার বউমার নাড়ি ছেঁড়া ধন ফিরে আসুক তার কোলবুক ঠান্ডা করতে। ছোটবেলা থেকে নিজ হাতে সবটা দেখভাল করেছেন তিনি। আলাদা রকমের টান রুদ্রর প্রতি। জিয়াউর রহমানকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করলেন না ফাইজা চৌধুরী।
রাইহান চৌধুরীর সাথে জিয়াউর কথা বলবে নাকী বলবে না ভেবে পাচ্ছে না। তার জন্যই তো জিয়াউর রহমান তার বোনকে হারালো। তার ভাগিনা জারিফ,ভাগনি রাখি এতিম হলো।

তখন ফাইজা চৌধুরী বলেন,
-রাইহান যাও জিয়াউরের সাথে সব ভুলভাল মিট করে নেও। এই সুযোগ দ্বিতীয় বার পাবে না। নিজের ভুলগুলো স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নেও।

মাথা নাড়ায় রাইহান চৌধুরী। জিয়াউর রহমানকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। পুরোনো বন্ধু ছিলো তারা। বসে অনেকক্ষণ কথা বলেন দু’জন।

রুদ্র দূর থেকে তাঁদের দেখে হাসে। তার বাবা সব ভুল বুঝলো অবশেষে। কিন্তু কাকে হারালো সেটা তো বুঝলো না।

ভাঙা হাত,পা কপাল নিয়ে নিজের রুমের দিকে যায় রুদ্র। তার পেছন দিয়ে ফাইজা চৌধুরী দূধ, ডিম সাথে কিছু ফলমূল নিয়ে রুদ্রর রুমপর দিকে যান। রুদ্র কিছু খোজাখুজি করছিলো। তখন ফাইজা চৌধুরী বলেন,

-আরেকটু পর তো রওনা হবো আমরা। কিন্তু বর হাত ভাঙা,পা ভাঙা,কপাল ভাঙা দেখলে যদি কনে অজ্ঞান হয়ে যায়?

-দাদীন তুমি বুঝতে পারছো না। কনে আমার হাত, পা,কপাল এসব ভাঙা দেখলে অজ্ঞান হবে না। অজ্ঞান হবে আমায় দেখলে।

-কিন্তু তোমায় দেখলে অজ্ঞান হবে কেন?

-নিউটনের তৃতীয় সূত্র! এবার যাও বুঝে নেও।

-থাক এসব সূত্র টুত্র আমার বুঝতে হবে না। তুমি বলো, তোমার এই অবস্থা কে করলো?

-কে আবার? আয়মান!

-আমি যদি এই আয়মানকে শিক্ষা না দিয়েছি তো আমার নামও ফাইজা চৌধুরী না।

-ছাড়ো! কুকুর আমাদের পায়ে কামড়ালে আমরা তো আর কুকুরের পায়ে কামড়াবো না। মনে রাখবে আল্লাহ ছাড় দেন তবে ছেড়ে দেন না। সবটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও।

-আচ্ছা। আমার নাতিটা! আমার বউমার নাড়ি ছেঁড়া ধম আপনি এই ফল,ডিম,দূধ খেয়ে রেডি হয়ে নেন। চারটার দিকে রওনা দিবো আমরা।

-আচ্ছা ঠিক আছে।

ফাইজা চৌধুরী প্রস্থান করে কিচেনে যায়। রান্নাবান্নার আয়োজন সকাল থেকে করেছেন। হানি (অর্ণবের মা) অন্তি তারা দুই ঝা আবারো রান্না চাপাচ্ছে। যৌথ পরিবার দুই বেলা রান্না করা লাগে। সাদবি তার দুই কাকীমাকে এটা ওটা সাহায্য করছে।

বড়রা সাথে আরিশ,অর্ণব এসেছে অফিস থেকে। সাদবিকে দিয়ে ঠান্ডা শরবতের ট্রে পাঠালেন হানি।
সুন্দর ভাবে তাঁদের চারজনকে শরবত দিয়ে কিচেনে যায় সাদবি। সে আর কোন কাজ করবে না এখন রেডি হবে।

আরোহী এসেছে মিনিট পাঁচেক আগে। সে সাদবিকে সাহায্য করছে সাথে নিজেও সাজছে। আরিশ,অর্ণব তারা ও রেডি হয়ে নেয়।

জিয়াউর রহমান ও আছে তাঁদের সাথে। চৌধুরী পরিবারের মোটমুটি সব সদস্যই রেডি হয়ে রওনা দিতে,দিতে পাঁচটার কাছাকাছি বেজে গেছে।

মেঘকে নিয়ে পার্লারে এসেছে লিমা,মায়া,মোহনা তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হৃদ ও সাথে এসেছে। মুখটা শুকনো হয়ে আছে মেঘের। তার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে হৃদ,লিমাও বলছে না তার বিয়েটা আসলে কার সাথে হচ্ছে। মেঘ সরল মনে বলে দিয়েছে আরিশকে তার বর মনে হচ্ছে। তারা চারজনও সেটাই বলছে। এই নিয়ে কত যে বিলাপ করলো মেঘ কিন্তু কেউই পাত্তা দেয়নি।

ল্যাভেন্ডার কালারের কাতান শাড়ী পরিধান করেছে মেঘ। হাত ভর্তি ল্যাবেন্ডার কালার চুড়ি। নো মেকআপ মেকআপ লুক ক্রিয়েট করে দিয়েছে পার্লারের মেয়েটা। মেয়েটার মন খারাপ অথচ সে জানে না তাকে সাধারণ বউ সাজে কতটা সুন্দর লাগছে। লিমা তো মায়ার কাছে গিয়ে বলেও দিয়েছে,

-আজকে রুদ্র স্যার ফাঁসবে ভালো করেই। মেয়েটাকে এতো বেশী সুন্দর লাগছে। মনে হয় আল্লাহ আজকে আলাদা একটা সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে তার চেহারায়।

-তার ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে এটা সে না বুঝলেও তার চেহারা বুঝে গেছে তাই তো সব সৌন্দর্য আজকে প্রকাশ করছে।

মায়া,লিমার কথা মাঝে মোহনা বলে,
-এসব লজিক ছাড়া কথা বাদ দে তো মায়া। লিমার কথায় লজিক থাকলেও তোর কথায় পঁচা আলুর মতো। যা বুদ্ধি সঞ্চয় করে আয়।

-জমজ বোন হয়ে এমন করছিস? একটু তো মায়া দয়া কর আমার সন্মান নিয়ে। জুনিয়রের সামনে তো সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলি।

লিমা মেকআপ করতে বসে গেছে অলরেডি। মেঘের সাজ কমপ্লিট শুধু জুয়েলারি কিছু পড়া বাকী আছে। তখন মোহনা মায়াকে বলে,
-যা তো মেকআপ করতে বোস। তোর পর আবার আমাকে বসতে হবে।

-মেঘের জুয়েলারি পড়া শেষ হোক বা’ল।

সন্ধ্যা সাতটায় তারা রওনা হয় বাড়ীর উদ্দেশ্য। মেঘের মন সায় দিচ্ছে না বাড়ী যেতে। মন চাচ্ছে এখনি পালিয়ে যেতে। কয়দিন নিখোঁজ থেকে রুদ্রকে খুঁজে বের করে জোর করে হলেও বিয়েটা করে নিবে। প্রয়োজনে রুদ্রকে কিডন্যাপ করবে, ভয় দেখাবে তাও বিয়েটা করে নিবে। নিজের ইচ্ছাকে ধামাচাপা দিয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করে। মেঘকে নিয়ে তার রুমে যায় লিমা,মায়া,মোহনা। বরের বিয়ে পড়ানো শেষ হতে মেঘের রুমে আসে কাজী। কাজীকে দেখে এবার মায়াকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করেই কেঁদে উঠে মেঘ। চিৎকার করে বলে,

-আমি বিয়ে করবো না। এই আরিশকে আমি বিয়ে করবো না। আমাকে রুদ্র স্যারের কাছে যেতে দাও।

মুখ ফসকে সবার সামনে কথাটা বলেই দেয় মেঘ। রুদ্রর কথা শুনতে রাখি মেহরাবের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সেদিন তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলো মেঘ রুদ্রকে পছন্দ করে না। সব তার মনের ভুল! রাখি ভুল কিছু আন্দাজ করেনি। শুধুমাত্র মেহরাবের কথায় সে চায়নি রুদ্র মেঘকে বিয়ে করুক।

এরই মাঝে লিমা,মোহনা হেসে দেয়। মেঘ হাসির শব্দ শুনে তাকায়। কান্না বন্ধ করে দিয়ে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাদের দু’জনের দিকে। পাশ থেকে ফাইজা চৌধুরী লিমা,মোহনাকে ইঙ্গিত করে কিছু না বলতে। চুপসে যায় তারা দু’জন। মায়ার হাসি পাচ্ছে মেঘের কান্না দেয়। এই কাজিন,বন্ধুগুলো এমনই সিরিয়াস সময়ে না হাসলে এদের হয় না। মেঘ পারছে না সবার সামনে তাদের তিনটাকে চ’ড় দেয়। তখন আবার কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে। মেঘ এবার রাখিকে জরিয়ে ধরে কান্না করে দেয়।

ওর কান্নার মাঝে কাজী ছেলের নাম সাথে দোয়া পড়ে নেয়। মেঘ নিজের মতো করে কাঁদছে। এরই মাঝে কাজী বলে উঠে,
-মেঘ মা কবুল বলো?

-বলবো না হুজুর। আমি আরিশকে বিয়ে করতে পারবো না।

-না,না আরিশ আসবে কোথা থেকে মা? তুমি যার কথা এতোক্ষণ বললে তার সাথেই বিয়েটা হচ্ছে।

মেঘের টনক নড়ে তার মানে রুদ্র। সাত পাঁচ না ভেবে তিনবার কবুল বলেই ফেলে। তখন কাজী বলে,
-কিন্তু মা আমি বলার পর,পরই তুমি তিনবার কবুল বলবে। একসাথে না।

-ওই হলোই! কবুলই তো? তাহলে আবারো তিনবার বললাম, ‘কবুল,কবুল,কবুল।

এই নিয়ে বাকীরা হাসে তবে পাত্তা দেয়না। জানে মেয়েটা চঞ্চল। বিয়ে পড়ানো শেষ হতে বড়রা বাইরে চলে যায়। রুমে শুধু মায়া,মোহনা,লিমা আছে। মেঘ লিমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,

-যা দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আয়।

লিমা ও দরজা লাগিয়ে দেয়। মায়া নিজের ছবি তুলছে। এরই মাঝে মেঘ খাট থেকে নেমে নাচ দেয়। অবশ্য তার খুশির মূহুর্ত মায়া ক্যামেরা বন্দি করে নেয়। লিমাকে টেনে তার সাথেই উড়া ধুরা নাচা শুরু করে দেয়। মুখ দিয়ে একটা কথা বলছে,

-চুরি, চুরি দিল তেরা চু’রা’য়ে’ঙ’গে।
রুদ্র জানু ফাইনালী তেরা বাপকো মেরা শ্বশুর বা’না’য়ে’ঙ’গে।

-আরে রুদ্র জানুর জায়গায় আরিশ জানু বল। আরিশই তোর জামাই।

নাচ,গান সব বন্ধ হয়ে যায় মেঘের। মোহনার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে যাবে তার আগে লিমা বলে,
-তোর ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে মেঘ। তোর ভালোবাসার মানুষটার সাথেই তোর বিয়ে হয়েছে। আরিশটারিশ কেউ না। সবাই তোকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে।

#চলবে

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|২৪|
#শার্লিন_হাসান

রুদ্রর রুমে খাটের উপর বসে আছে মেঘ। এখন অব্দি রুদ্রকে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি তার। তালুকদার বাড়ী থেকে আসার পর কোথায় উদাও হয়েছে জানা নেই মেঘের। বিয়ে করলো অথচ বরকে দেখলো না। তবে এটা শিওর হয়েছে বিয়েটা তার ভালোবাসার মানুষের সাথেই হয়েছে।

ঘড়ির কাটা একটা ছুইছুই, রুদ্র রুমে প্রবেশ করেছে। দরজা অফ করার আওয়াজ কানে যেতে গুটিশুটি মেরে বসে যায় মেঘ। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। অনুভূতিরা আজকে উত্তেজিত! অবশেষে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে ফেলো। কিন্তু মানুষটা তাকে আদৌ ভালোবাসবে তো? নাকী দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করবে?

রুদ্র হালকা কেশে খাটে বসে। মেঘকে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটা বুঝবে তো? তার বর আস্ত নিরামিষ।

রুদ্রকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ নিজেই নড়েচড়ে বসে। গোমটা সরিয়ে বলে,

-গরমে মরে গেলাম। এভাবে কেউ এতক্ষণ বসে থাকতে পারে?

রুদ্র জবাব দেয় না। মেঘের দিকে তাকায়। এই পিচ্চি মেয়েটা তার বউ হয়ে গেলো।

-মেঘ শুনুন আমার কিছু কথা।

-আপনি করে বলছেন কেন? আমি কী এখনো আপনার স্টুডেন্ট নাকী?

-না আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে।

-তুমি করে সম্মোধন করবেন।

-ঠিক আছে মহারানী।

রুদ্রর কথায় মেঘ মুগ্ধ হয়ে তাকায়। আচ্ছা সে স্বপ্ন দেখছে না তো?

-আচ্ছা যান চেন্জ করে আসুন?

-আবার আপনি?

-তুমি.. যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো।

মেঘ মাথা নাড়ায়। ব্যাগ থেকে থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। রুদ্র ফোন হাতে নিয়ে গ্যালারীতে তার আর আলিশার যত পিকচার আছে, আলিশার সিঙ্গেল যত পিকচার আছে সব ডিলিট করে দেয়। সেই সাথে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেন্জারের কনভারসেশন ও অল ডিলিট। রুদ্র চায় না অতীত মনে করতে। মেঘকে ভালোবাসতে সময় লাগতেও পারে আবার নাও লাগতে পারে। সম্পূর্ণ ডিফেন্ড করে মেঘের ব্যবহার আর তার মনের উপর। রুদ্র চায় মেঘ তার মনের পুরো অংশটায় জায়গা করে নিক। চঞ্চল মেয়েটা তার জীবটাকে আরেকটু গুছিয়ে দিক। তার অগোছালো দিকটাআগলে রাখুক মেয়েটা। আর মেয়েটাকে ভালো রাখার দায়িত্ব সে নিতে চায়।

কিছুক্ষণ পর মেঘ আসে বেড়িয়ে। তার কাছে মনে হচ্ছে না রুদ্রর জীবনে অন্য কেউ আগে ছিলো। স্ত্রীর অধিকারটা একটু বেশী মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে।

-শুনুন স্যার আমি কিন্তু ওতোটা চাপা স্বভাবের না। যা বলবো সামনাসামনি! এখন তো আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী আপনার উপর আমার অধিকার আছে আপনি মানেন বা না মানেন। তো এখন আমার কয়টা অধিকার আপনাকে মানতে হবে।

হাসে রুদ্র। পরক্ষণে বলে,
-হ্যাঁ জানি আপনি মেয়েটা বেশ চঞ্চল! আচ্ছা দিলাম নাহয় আমার উপর সব অধিকার খাটানোর পারমিশন।

-আসসালামু আলাইকুম।
কথাটা বলে মেঘ গোমটা দিয়ে খাটের উপর তড়িঘড়ি বসে পড়ে। মেঘের কাজে রুদ্র ভ্যাবাছ্যকা খেয়ে যায়। এই না মাত্র মেয়েটা কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো।

কিছুক্ষণ নিবরতা পালন করে মেঘ গোমটা সরিয়ে বলে,

-ধুর কিছু বুঝেন না আপনি। সালামের জবাব দিবেন তারপর আমার গোমটা সরিয়ে আমায় দেখবেন।

-এটা তো প্রথমে দরকার ছিলো।

-তখন মনে ছিলো না। এখন মনে হয়েছে! আমি আবারে গোমটা দিচ্ছি।

মেঘ আবারো বড় করে গোমটা দিয়ে বসে। রুদ্র হাসি মুখে গোমটা সরায়।

-মাশাল্লাহ আমার বউ।

-হ্যাঁ এবার হয়েছে। এবার আসল কথায় আসি।

-কী?

-প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর সময় আপনার বুকে আমি মাথা রেখে ঘুমাবো। আর প্রতিদিন বাইরে বের হওয়া মানে কলেজ যাওয়ার সময় আমার কপালে চুমু খেয়ে কলেজ যেতে হবে। আবার আমি মাঝেমাঝে রাগ করলে দু’একটা ফুল দিয়ে রাগ ভাঙাতে হবে।

-আর কিছু?

-না আপাতত এই তিনটা।

-আচ্ছা ঠিক আছে।

-চলুন নামাজ পড়তে হবে।

রুদ্র সায় দেয় মেঘের কথায়। দু’জনে নামাজ আদায় করে শুয়ে পড়ে। রুদ্র ইতস্ত বোধ করছে মেঘকে টাচ করতে। কিন্তু মেয়েটাও! তাকে আর কথা বলার সুযোগ দেয়নি! তার বুকে মাথা দিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইলো। মেঘের এমন পাগলামি তে রুদ্র হাসে।

-আপনি ঘুমিয়ে গেছেন?

-না,কেন?

-আপনি খুশি তো?

-শুধু খুশি না, আমি হ্যাপি। ধন্যবাদ আপনাকে।

রুদ্র বাক্যব্যায় করে না। মেয়েটা তাকে ভালোবাসে! বুঝাই যায়। রুদ্রও আগলে রাখতে চায় মেয়েটাকে। কয়েকঘন্টার ব্যবধানে সম্পর্ক বদলে গেলো। ছয়-সাত ঘন্টা আগেও মেয়েটা হিসাবে তার স্টুডেন্টই ছিলো এখন বউ।

*****

রুদ্রকে বিয়ের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছে অর্ণব,আরোহী। পোস্টটা আলিশার চোখে পড়ে। সাথে,সাথে আরোহীকে নক দেয় সে।

-রুদ্র বিয়ে করলো কবে?

-আজকে।

-মেয়েটা কে?

-মেঘ।

-ওহ্ আচ্ছা! শুভকামনা রইলো তাদের জন্য।

আরেহী রিপ্লাই দেয় না। ইচ্ছে করেই পোস্টটা দিয়েছে সে। যাতে আলিশা দেখে আর ভাবে, ‘রুদ্র ও তাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারে। ঠকিয়েছে আলিশা সেও একদিন ঠকবে।’

আলিশা তার আর রুদ্রর পিক,কনভারসেশন পুনরায় দেখলো, পড়লো। তবে অপরপাশে রুদ্র তাকে ব্লক করে দিয়েছে। মন খারাপ হয়নি আলিশার। সে বাঁচতে চায়! সব ছেড়ে ছুঁড়ে দূরে চলে যেতে চায়। বেশী দেরী ও নেই আর তিনমাস পর বিডি ছেড়ে চলে যাবে। দুইমাস অপেক্ষা করছে ডিভোর্স লেটারের জন্য। আয়মানের নামে কেস দিয়েছে। তাকে জোর করে বিয়ে করেছে! সাথে তাঁদের প্রোপার্টি দেওয়ার জন্য থ্রেট দিয়েছে। তবে শুনেছে আয়মান নাকী জেলে। রুদ্রর বাবাকে প্রোপার্টির জন্য থ্রেট দেওয়ায়। বেশ খুশি হয় আলিশা। জেলে পঁ’চে ই মরুক মা ছেলে দু’টো।

পরের দিন সকালে চৌধুরী বাড়ীতে বৌভাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বেশী একটা লোকজন নেই এই তারা,তারাই থাকবে।

মেঘের ঘুমা ভাঙতে নিজেকে শক্তপোক্ত বাঁধনে অনুভব করে। হ্যাঁ এই বাঁধনটা রুদ্ররই। নড়েচড়ে রুদ্রকে ডাক দেয় মেঘ। কোন রেসপন্স নেই! মেঘও আর ডাক দেয়না চোখ বন্ধ করে নেয়। এই বুকেই তে সে আশ্রয় খুজে ছিলো। এই শক্ত বাঁধনটাই তো সে চেয়েছিলো।

রুদ্র চোখ মেলে তাকায়। মেঘকে তার বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে হাসে। ভালোবাসা যতটা না কষ্ট,বিরহবেদনার তার চেয়ে বেশী সুন্দর যদি ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া যায়। মেঘ পেয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটাকে।

-এই যে উঠুন।

রুদ্রর ডাকে মেঘ তাকায়। রুদ্র বাঁধন ছাড়তে উঠে পড়ে মেঘ। ফ্রেশ হয়ে নিচে যায়। বাকীরা কেউ উঠেছে কেউ উঠেনি। অন্তি,হানি তারা কিচেনে নাস্তার কাজে বিজি। মেঘ ফাইজা চৌধুরী, সাদবি এবং আরোহীর সাথে গল্প করছে।

অর্ণব,আরুশ,রাইহান চৌধুরী তারা মেহমানদের জন্য রান্নাবান্নার দিকটা দেখছে।

বাকীরা নাস্তা খেতে বসে গেছে। তাদের মাঝে রুদ্রও উপস্থিত হয়। পাশাপাশি চেয়ারে বসে নাস্তা খাচ্ছে মেঘ,রুদ্র। ফাইজা চৌধুরী তাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসে। তার নাতিটা এবার আর গম্ভীর থাকতে পারবে না। এই মেঘ মেয়েটা নাচিয়ে রাখবে। হ্যাঁ মেয়েটা চঞ্চল তবে মিশুক ও।

একটার দিকে তালুকদার বাড়ী থেকে মেহমান আসে। ছোট্ট পরিসরে অনুষ্ঠান হয়। আগামী কালকে মেঘ,রুদ্র যাবে তালুকদার বাড়ীতে।
সারাদিন ব্যস্ততার মাঝে কেটেছে তাদের। সন্ধ্যায় নাস্তা করে রুমে আসে মেঘ। রুদ্র কলে কারোর সাথে কথা বলছিলো। মেঘ সেসবে পাত্তা না দিয়ে শুয়ে পড়ে হাত পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

****

মিসবাহ কার্টুন দেখছে ফোনে। নিবরাস হসপিটাল থেকে মাত্র এসেছে। বিয়ে নিয়ে এখন আর কেউই তেমন কিছু বলেনা। নিবরাস ও সেসবে পাত্তা দেয় না। ফ্রেশ হয়ে কফির মগ হাতে লিভিং রুমে আসে নিবরাস। মিসবাহ নিবরাসকে দেখে ফোন রেখে দেয়। পাশের সোফায় তার নানু বসা।

-নানু আনায়া ইবনাত কী জেনো নাম আন্টিটার?

নিবরাস কফি মুখে নিতে গিয়েও নেয়না। চোখ বড়বড় করে তাকায়। আনায়ার খবর আবার মিসবাহর কানে কে দিলো? এই ছেলেটা তো আসলেই তার বিয়ের পেছনে পড়েছে। সে তো ভেবেছিলো মেঘ তাকে না মিসবাহকে বড়সড় ছ্যাকা দিয়েছে সেটার শোক করবে মিসবাহ আগামী এক বছরেও বিয়ের নাম মুখে নিবে না। আর না তার নানুকে জ্বালাবে। এখন তো একদিন না যেতেই বাচ্চাটা! নিবরাস তার মায়ের মুখের দিকে তাকায় কী বলে শোনার জন্য।

তখন মরিয়ম নওয়াজ বলেন,
-হ্যাঁ আনায়া ইবনাত অরি। তোমার জিয়াউর নানার মেয়ে। তোমার পছন্দ হয়েছে মিসবাহ?

-বলবো না। যদি আবার ভ্যানিশ হয়ে যায়?

-হবে না মিসবাহ। দুইদিন পরই নানু যাচ্ছে ভ্যানিশ হওয়ার আগে তাকে নিয়ে আসার জন্য।

-এসব কী আম্মু?

নিবরাসের কথায় মরিয়ম নওয়াজ বলেন,
-পাত্রি একজন গেছে আরেকজন আসবে। এই না যে আগের জনের সাথে বিয়ে না হলে জীবনেও বিয়ে করতে পারবা না। তুমি চুপচাপ থাকো আমি মেয়ে দেখছি। তোমার আংকেলের সাথে কথাও হয়েছে আমার।

উত্তর দেয়না নিবরাস। উঠে রুমের দিকে চলে যায়। এদের সাথে কথা বাড়ানো বেকার মনে হয়। বিয়েটা তাকে করতে হবেই হবে। তাও আর কাউকে পেলো না? আনায়াকে? যে ভাইয়া,ভাইয়া বলতে,বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো।

ভাবনাচিন্তা একদিকে রেখে নিবরাস ফেবুতে ঢু মারে। তার এই সিচুয়েশনে এমন একটা পোস্ট সামনে আসে যাতে করে মুখ থেকেে আপনাআপনি বেড়িয়ে আসে,

-সাইয়া আবার কী?

-ভাইয়া ক্যাম বি সাইয়া, সাইয়া এটার মানে কী?
গুগলে সার্চ দেয় নিবরাস। কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পর জানে সাইয়া মানে ব্যক্তিগত পুরুষ, জামাই,মাইন ইত্যাদি,ইত্যাদি।

****

কেটে গেছে এক সপ্তাহ। রাইহান চৌধুরী থানা থেকে বেড়িয়ে আসেন রুদ্র সহ। রুদ্রর উপর অট্যাক করে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে আয়মান সেই বিষয়ে অভিযোগ তুলে। বাবা ছেলের সম্পর্ক আগের থেকে কিছুটা ঠিক হয়েছে। তবে পুরোপুরি না। রাইহান চৌধুরী সাদবিকে নিয়ে চৌধুরী পরিবারের সাথেই থাকেন। তার ডিভোর্স পেপার ঠিকঠাক হচ্ছে আর একমাস পরই তিনমাস হবে আর সাইন করে সাদিয়াকে মুক্তি দিয়ে দিবে।

রুদ্র ফুলের দোকানের সামনে এসে গাড়ী থামায়। রাইহান চৌধুরী জিজ্ঞেস করেন,
-কিছু নিবে?

-হ্যাঁ ওদের জন্য আইসক্রিম নিবো।

-আচ্ছা যাও।

রুদ্র মাথা নাড়িয়ে ফুলের দোকানে ঢুকে যায়। সেখান থেকে কয়েক রকমের ফুল,বেলী ফুলের মালা নেয় কয়েকটা। আইসক্রিম হাতে গাড়ীতে এসে বসে। রাইহান চৌধুরী ফুল দেখে মুচকি হাসে। মেঘের জন্যই ফুল নিচ্ছে রুদ্র।

নিরবতার মাঝে রাইহান চৌধুরী বলে উঠেন,

-জারিফ অন্দরমহল তো ওভাবেই পড়ে আছে। মেঘ,তুমি,সাদবি,আম্মা,রাখি সহ চলে আসো? মেঘ সবটা দেখভাল করুক, আমার পরিবারে নতুন সদস্য আসুক বাড়ীটা একটু স্বচ্ছ হোক।

-এখানে থাকুক না। সবার মাঝে থেকে সব শিখে নিক। এইচএসসি দিক তারপর নাহয় আমরা অন্দরমহলে ব্যাক করবো।

-আরো নয়মাস বাকী এক্সামের।

-তাহলে আরো বছরখানেক এই বাড়ীতে থেকে যাই।

-আচ্ছা।

রাইহান চৌধুরীকে অফিসের সামনে নামিয়ে দেয় রুদ্র। সে বাড়ীতে আসতে দেখলো মেঘ ফাইজা চৌধুরী এবং সাদবি,অন্তি, হানি তাদের সাথে কথা বলছে। আরোহী তার শ্বশুর বাড়ীতে। রুদ্র আইসক্রিম গুলো সাদবির হাতে ধরিয়ে দেয়।

-সবাইকে দাও সাদবি।

রুদ্র বেড়িয়ে আসে। গাড়ী থেকে ফুলগুলো নিয়ে ভেতেরর দিকে অগ্রসর হয়। সবার চোখ ফাকি দিয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরে। তার মনে হচ্ছে সে চুড়ি করতে এসেছে। সাথে লজ্জা তো ঘিরে ধরেছে। একবার কারোর চোখে পড়লেই হলো! রাইহান চৌধুরীকেও মিথ্যে বলেছে আইসক্রিম তো বাহানা আসল উদ্দেশ্য ফুল।

সিড়ি দিয়ে নিশ্চুপ ভাবে উপরে উঠছে রুদ্র। ফাইজা চৌধুরীর চোখ যায় রুদ্রর দিকে। হাতের ফুলগুলোও চোখে পড়ে। তাতে মুচকি হাসেন তিনি। তার নাতি আগের থেকে একটু,একটু আমিষ হচ্ছে। পুরোপুরি হলেই হয়! তার ও তো শখ নাতির বাচ্চা দেখে যাওয়া। তাদের নামকাম ঠিক করে রেখে দেওয়া। কী জানি ভাগ্যে আছে কীনা।

#চলবে