#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|২৫|
#শার্লিন_হাসান
সবার সাথে কথা বলে রুমে আসতে একটু লেট হয়ে যায় মেঘের। এতেই রুদ্র রেগে বসে আছে। সোফার উপর বসে হাত দিয়ে কপাল ঘেঁষছে। মেঘ দেখেও না দেখার ভাণ করে শাওয়ারের জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। রুদ্র মেঘের কান্ড দেখে চুপসে যায়।
ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা ফুলগুলোর দিকে একনজর তাকায় রুদ্র। শখ করে এনেছে বউয়ের হাতে,খোপায় পড়িয়ে দিবে। অথচ বউই তার ধারেকাছে ঘেঁষে না।
ঘন্টা খানিক পর মেঘ শাওয়ার নিয়ে বের হয়। রুদ্র কথা বলেনা। মেঘ ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেতে ফুল দেখে। একনজর রুদ্রর দিকে তাকায়। সে লোক ফোনে এমন ভাবে ধ্যাণ দিয়েছে!
রুদ্রর সামনে এসে মেঘ বলে,
-এতক্ষণ বসে আছেন কেন?
-নাচাবো নাকী? মানক আপনি এমন ভাবে বলছেন আমি বসেও থাকতে পারবো না।
-না,না আসলে তা বলিনি! আচ্ছা ফুল এনেছেন আগে বললেই তো আমি শাড়ী পড়তাম।
-বেশী ভাব দেখালেন না? লাগবে না আপনার শাড়ী পড়া। আর ফুলগুলো আমি ডাস্টবিনে ফেলে দেবো।
-আমি দিলে তো ফেলে দিবেন?
-রুদ্র কারোর অনুমতির অপেক্ষা করে না। বুঝেছেন?
চুপসে যায় মেঘ। সে কী রুদ্রকে পাত্তা না দিয়ে বড় ভুল করে ফেললো? তাকে বললেই তো হতো যে মেঘ ফুল এনেছি। রুদ্রর দিকে একনজর তাকায় মেঘ। সে ফোন নিয়ে ব্যস্ত!
এরই মাঝে ডাক পড়ে লান্স করতে যাওয়ার জন্য। রুদ্র উঠে শাওয়ারের জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। মেঘ ফুলগুলো দেখছে। ঘ্রাণ নিচ্ছে। তবে রুদ্র আসার আগে জায়গার গুলো জায়গায় রেখে নিচে চলে যায়। অন্তি,হানির সাথে খাবার টেবিলে সাজানোর কাজে হেল্প করছে মেঘ। সাদবি কলেজে থেকে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। মেঘের কয়েকদিন গ্যাপ যাচ্ছে! আগামী কাল থেকে সেও নিয়মিত হবে।
রুদ্র, সাদবি আসতে সবাই খেতে বসে পড়ে। রুদ্র আগের থেকে কিছুটা চঞ্চল হলেও আবার গম্ভীর হয়ে যায়। মেঘ বুঝতে পারছে না তার ভুলটা কী?
রুদ্র চুপচাপ খাবার খেয়ে রুমে চলে যায়। মূলত সে রুমে যাওয়ার সাথে,সাথে মেঘ কেন রুমে গেলো না। প্রয়োজনে আধাঘন্টা পরে যেতো, কিন্তু সে তো পাক্কা দেড় ঘন্টা পর রুমে গিয়েছে।
এখন তারা কেউ কারোর সাথে কোন কথা বলে না।
******
আনায়াকে দেখতে এসেছেন মরিয়ম নওয়াজ। তাদের দেখাদেখির পালা শেষ! বিয়ের দিন তারিখ ও ঠিক করে নিয়েছেন। আনায়ার আম্মু সীতারা আহমেদ সব কিছুর দেখভাল করছেন। নিবরাস এসেছে সাথে মিসবাহ,মাইশাও এসেছে। তাঁদের কথাবার্তার পাট চুকে যেতে সব ঠিকঠাক করে বিদায় নেয় মির্জা পরিবার।
মির্জা পরিবারের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখবেন না মরিয়ম নওয়াজ। বাড়ীতে এসে আত্মীয়স্বজনে অলরেডি দাওয়াত দিয়ে দিয়েছেন কলে। কেউ আসছে,কেউ আসবে। নিবরাসের নানার পরিবারের মামিরা চলে আসবে আগামীকাল। তার মামারা আসবে বিয়ের আগের দিন। সবাই তো ব্যস্ত!
মিসবাহ সে তো বেশ খুশি। যাক তার মামার জীবনে আরেকটা পার্মানেন্ট লাউডস্পিকার আসবে। যদিও আগেরটা কোমড় ভাঙা ছিলো কিন্তু এবারেরটা ভালোই হবে।
জিয়াউর রহমান চৌধুরী পরিবারে ইনভাইট দিয়ে দিয়েছেন। আগামী কালকে তাঁদের সবাইকে চলে আসতে বলেছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
****
আলিশার আজকাল একটু ব্যস্ত সময়ই কাটছে। ফাইনাল এক্সাম শেষ হলেই সে বাঁচে। ভিসা পাসপোর্ট সব রেডি হচ্ছে। আশরাফ খানের সাথে সম্পর্ক আগের থেকে উন্নত হয়েছে তার। আফিয়া ইসলাম সে তো সাদিয়া আর আয়মানকে এখনো বকে। তাদের প্রোপার্টির উপর নজর। কয়েকবছর জেলের ভাত না খাইয়েছে। অলরেডি তিন তিনটা কেস আয়মানের নামে।
আলিশা বেলকনিতে বসে,বসে শুকনো ফুলগুলো দেখছে। রুদ্রর দেওয়া ফুলগুলো সে রেখে দিয়েছিলো।
❝সময়ের সাথে মানুষ গুলো কত বদলে যায়। অথচ চলমান সময়ে থাকা কিছু জিনিস পুরোনো স্মৃতি,মূহুর্তকে মনে করিয়ে দেয়।❞
মানুষ কথা দেয় শুধুমাত্র মূহুর্তটাকে সুন্দর করার জন্য! এছাড়া আর কিছু না। এমন কয়জন আছে যে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে? হাজারে দু’একজন। প্রিয় মানুষকে নিজের করে পেতেও ভাগ্য লাগে। সবার ভাগ্য এক না।
হাসে আলিশা। কিছু পুরোনো পিকচার আগের সময়টাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। অথচ রুদ্রর বিয়ে হলো সপ্তাহ পেড়িয়ে। রুদ্র এতো সহজে মুভ অন করে নিলো ভাবতে পারেনি আলিশা। হার্টলেস একটা মানুষ রুদ্র। যে খুব কম অনুভূতি প্রকাশ করে। সবসময় তাকে শক্ত আর শান্ত থাকতে দেখেছে আলিশা।
-হ্যাঁ হার্টলেস বলেই মুভ অন করতে পেরেছে। অবশ্য কারোর খারাপ সময় তো আর কারোর জন্য থেমে থাকে না। আমিও থেমে নেই রুদ্রর জন্য।
ফাইজা চৌধুরী কফির মগ মেঘের হাতে ধরিয়ে দেয়। রুদ্রকে দিয়ে আসার জন্য। মেঘ ভয়ে,ভয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হয়। আবার ধমক দিয়ে বসে কীনা কে জানে?
খাটের উপর হেলান দিয়ে বসেছিলো রুদ্র। মেঘ কফির মগ নিয়ে রুদ্রর দিকে বাড়িয়ে দেয়।
-আপনার কফি।
-আমি চেয়েছি আপনার কাছে?
-এই সময় তো আপনি কফি খান। আর এটা চাওয়া লাগে নাকী আজব? আমি না আপনার বউ এসব বিষয় তো আমাকেই খেয়াল রাখতে হবে।
-আপনার লেখাপড়া নেই? এতো বউ হতে হবে না। আগে পড়ালেখা ঠিক মতো করে এক্সাম গুলো তে পাশ করুন। আমি ফেলটুস মেয়েকে ভালোবাসবো না আর না বউ হিসাবে মানবো।
-ধুর! আপনি এখন আমার জামাই বাড়ীতে একদম টিচারগিরি করতে আসবেন না। পারলে ক্লাসে যা টিচার গিরি করার করিয়েন কিছু বলবো না।
-আমার কথার দাম নেই আপনার কাছে।
-আমার কোন কথার দাম আছে আপনার কাছে?
-অবশ্যই আছে,ছিলো। এই আপনি তো বলেছিলেন প্রতিদিন আপনাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে। আমি তো তাই করি! আপনি বলেছেন মাঝেমধ্যে ফুল এনে দিতে আমি তো ফুল এনেছি। বলুন আমি কোন দিক দিয়ে আমি আপনার কথার দাম দিইনি?
-তিনটা শর্তর দুইটার দাম দিলেন। আরেকটা তো হাওয়ায় ভাসে।
-আমার শর্ত মানলে তিন নাম্বার শর্ত আমিও মানবো।
-পড়ালেখা আমি সিরিয়াস ভাবে নিতে পারবো না। এই টেনেটুনে পাশ করবো। মনোযোগ দিয়ে সংসার করবো।
-তাহলে আপনার আর সংসার করতে হবে না। আগামী কালকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিজের বাড়ী চলে যাবেন।
-এই,এই আপনার মাথা খারাপ?
-ঝগড়া না করে পড়তে বসুন তো!
-সে নাহয় বসবো তবে শর্ত আছে।
-কী শর্ত?
-আমাকে তুমি করে সম্মোধন করতে হবে।
-হ্যাঁ সেটা তো করিই। আমার মন চেয়েছে তাই আপনি বলে সম্মোধন করেছি। আপনি না বুঝলে আমার কী?
-আপনি রাগ করেছেন স্যার?
-সেটা কী আমি আপনাকে বলবো?
-আচ্ছা বলতে হবে না। এক মিনিট বসুন।
মেঘ দরজাটা লক করে আসে। রুদ্র কফির মগটা হাতে নেয়। মেঘ থামিয়ে দেয়।
-কফি এখন মুখেও নিবেন না।
-কেন?
ব্রু কুঁচকায় রুদ্র। মেঘ রুদ্রর কোলের উপর বসে তার গলা জড়িয়ে ধরে মুচকি হাসে।
-আপনার রাগ ভাঙাতে এসেছি।
-সাইডে বসুন না।
-সাইডে বসলে রাগ ভাঙাবো কীভাবে?
কথাটা বলে রুদ্রর ঠোঁটজোড়া দখল করে নেয় মেঘ। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে বলে,
-আচ্ছা আপনি এতো আনরোমান্টিক কেন? দেখুন আমি নিজে সেধে,সেধে রোমান্স করছি। কী একটা নিরামিষ কপালে জুটলো বাবা।
-আগে জানতাম আপনি ঠোঁটকাটা এখন জানলাম আপনি ভাবপ্রবণও।
-ওই একটু আধটু! জামাই মানুষ একসপ্তাহ হলো বিয়ে হলো একটা চুমুও দিলো না। এই দুঃখ কই রাখি?
-ফেলটুস মেয়েকে আমি চুমু দেই না।
-আমি কবে ফেল করলাম?
-করেছেন ক্লাস টেস্টে।
-ওটা সবসময়ই করি।
-সেজন্য ফেলটুস মেয়েকে আমি চুমু দিবো না।
-আচ্ছা চুমু দিতে হবে না আদর করুন।
-আরেকটু বড় হোন।
-আমি ছোট? আপনার আমাকে ছোট মনে হয়?
-আঠারো তো হয়নি। আগে আঠারো হোক তারপর!
-মানে আমার আঠারো বছর হওয়া অব্দি অপেক্ষা করতে হবে আপনার চুমুর জন্য।
-হ্যাঁ! আমার বউ আগে বড় হোক। এতো তাড়াতাড়ি পাকতে হবে না। আর আপনার বর আরেকটু রোমান্টিক হোক।
-থাক লাগবে না আপনার চুমু।
-আচ্ছা যান পড়তে বসুন।
-এমাহ আপনার রাগ ভাঙেনি? আরো লাগবে চুমু?
– না, না আর লাগবে না। আপনি পড়তে বসুন।
-আটটা বেজে যাচ্ছে। রাতের অর্ধেক প্রায় হয়ে গেছে। আমি আবার অর্ধেক থেকে পড়া ধরি না। আগামী কালকে সন্ধ্যা থেকেই একবারে পড়তে বসবো।
-এখনো সন্ধ্যা। দুইঘন্টা পড়লেই হয়ে যায়। দশটা অব্দি পড়বেন।
-আল্লাহ উঠাই নেও। বিয়েটা করলাম কেন? একমাত্র পড়া থেকে বাঁচার জন্য! আর এখন জামাই পড়ার জন্য গাইডলাইন দেয়।
-পড়তে বসবেন?
-না।
-স্কেল আনবো?
-কীইইই?
-ঠিকই শুনেছেন। আমি ফেলটুস মেয়েকে পাত্তা দিবো না তো! আমার কথা না শুনলে আগামী কালকে বাপের বাড়ী।
মেঘ উঠে দাঁড়ায়। কাঁদো, কাঁদো মুখ করে বলে,
-আজকে না পড়লে হয় না?
-না! আগামী কালকে থেকে কলেজ যেতে হবে। আমার পড়া না দিতে পারলে কিন্তু পালিশ মেন্ট দেবো।
-আমি না আপনার বউ।
-তখন আমি স্টুডেন্টকে পড়াবো,পড়া জিজ্ঞেস করবো। বউকে না।
-আসলে আপনি না সম্পর্কের মূল্য বুঝেন না।
-আবার?
-সত্যি বুঝেন না। বউ মানে কী সেটা বুঝেন? না বুঝেন না আপনি আবার বুঝবেন সম্পর্কের মূল্য।
-বই-খাতা নিয়ে এখানে আসুন মহীরানী আপনাকে আজকে আমি সম্পর্কের মূল্য বুঝাবো। প্রথমে প্রেমের ক্যামিস্ট্রি দিয়ে শুরু করবো। তারপর পুরো সম্পর্কের ক্যামিস্ট্রি বুঝাবো।
-না থা..ক থাক লাগবে ন.. না।
-এখন না করছো কেন?
-আমি ছোট মানুষ। আঠারো হোক তারপর প্রেমের ক্যামিস্ট্রি বুঝবো।
-কী বাঁচাল একটা জুটলো কপালে। এটার সাথে প্যানপ্যান করতে,করতে দিনদিন আমিও বাঁচাল হয়ে যাচ্ছি।
মেঘ কিছু বলেনা। সোফায় বসে পড়ে। আজকে সে পড়তে বসবে না। না মানে না! ইচ্ছে করছে রুদ্রর মাথা ফাটাতে। পড়ার জন্য এতো গাইডলাইন আগে কেউ দেয়নি। আদরে বড় হয়েছে। এতো পড়াশোনা লাগেনা জীবনে! এখন মনে হচ্ছে এই লোক তাকে ঈশ্বর চন্দ্রের শিষ্য বানাতে চায়।
-আপনার ফোনটা একটু দিন না?
-ফোন দিয়ে কী করবা?
-না মানে আমার আইডিটা আনব্লক করবো।
-আমি আবার কবে আইডি ব্লক করলাম।
– ওই যে ফা’লতু একটা আইডি আছে না।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ মেয়েটা আসলেই ফাল’তু। সোজা ব্লক করে দিয়েছি।
-আমি ফাল’তু?
-তুমি ফাল’তু হতে যাবা কেন? ফাল’তু তো ওই মেয়েটা।
-ওই মেয়েটাই আমি।
-ওহ্! ভুল কিছু বলিনি তাহলে। তোমার ক্যারেক্টার এতো লুজ ছিলো কেন?
-ক্রাশ ছিলেন সেজন্য। নাহলে মেঘ কাউকে নিজে থেকে নক দেয় না। আর আমার ক্যারেক্টার ভালোই! একজনের উপর ক্রাশ খেয়েছি, তাকেই নক দিয়েছি এবং তারই বউ হয়েছি।
-গুড!
মেঘ উঠে দাঁড়ায়। রুদ্রর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বিছানায়া শুয়ে পড়ে। ফেবুতে ঢুকে সে ভিডিও দেখছে। রুদ্র দেখছে মেঘের কান্ড। সে যে এতক্ষণ পড়তে বসার জন্য বকা-ঝকা করলো সেসব কানেই নিলো না মেয়েটা।
রুদ্রও বেশী কথা বাড়ায়নি। হুটহাট ক্লান্ত লাগছে তার। মেঘের পাশের বালিশটায় মাথা রাখে সে।
#চলবে
#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|২৬|
#শার্লিন_হাসান
পরের দিন সকালে চৌধুরী বাড়ীর সদস্যরা বিয়ের জন্য যাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বিকেলের দিকে সবাই রওনা হবে!
মেঘ রেডি হয়ে নিয়েছে। রুদ্রর সাথে কলেজ যাবে। নাস্তা করে দু’জন বেড়িয়ে পড়ে।
বাজারে সামনে এসে গাড়ী থামায় রুদ্র। মেঘ তাকে প্র্শ্ন করে,
-গাড়ী থামালেন কেন?
-নামো গাড়ী থেকে। বাকী পথ হেঁটে বা রিকশা দিয়ে চলে যাবে। আর হেটেই যেতে পারবা। পাঁচমিনিটের পথ।
-নামবো না গাড়ী থেকে। আপনি ভয় পাচ্ছেন? এই তো না আমরা লুকিয়ে নিয়ে করেছি।
-জ্ঞান দিতে হবে না। তুমি কী বুঝো? যাও তো! আমার লেট হয়ে যাচ্ছে।
-যাবো না।
-তাহলে তুমি থাকো আমি দরজা লক করে হেঁটে চলে যাই।
-আরে আপনি…!
-নামো।
-গাড় ত্যাড়া কোথাকার। আজকে বাড়ীতে আসিস শুধু!
-তুই তোকারি করছো কেন? আস্ত বেয়া দ ব তুমি!
মেঘ নেমে যায়। যাওয়ার সময় রুদ্রকে বলে,
-বউ হই আমি আপনার। এতো ভাব নিচ্ছেন মনে হয় আমার সাথে কলেজে গেলে আপনার প্রেস্টিজ কমে যাবে। এখানে আমাকে অসন্মান করা হলো! মনে রাখবেন কথাটা।
মেঘ চলে যায়। রুদ্র তার পেছন দিয়ে গাড়ী স্টার্ট দেয়।
মেঘকে ক্রস করে রুদ্রর গাড়ী সামনে এগিয়ে। রাগে ক্ষোভে মেঘ পারছে না গাড়ীর কাচ গুলো ভেঙে দেয়।
-এখন না ভাঙি একটু পর ঠিকই ভাঙবো। বেশী ভাব না আপনার! মেঘ কী হারে,হারে টের পাবেন।
বিড়বিড় করতে,করতে গেট দিয়ে প্রবেশ করে মেঘ। লিমা,হৃদের সাথে দেখা হতে হৃদ জিজ্ঞেস করে,
-স্যারের সাথে আসলি না? একসাথে আসলে কী হয়?
-আমি বারণ করছিলাম নাকী এই রুদ্রকে। কী ভাব! নিজের বউকে নিয়ে একসাথে কলেজে প্রবেশ করতে পারবে না। আমায় বাজারে নামিয়ে দিয়েছে।
-সো স্যাড! একসাথে আসলে কী সমস্যা?
-আজকে শুধু বাড়ী যাই।
-হু! এমন বকা দিবি।
-সাত জনম মনে রাখবে।
ক্লাসের সময় হতে তারা ক্লাসে চলে যায়। পরপর দুইটা ক্লাস শেষ করে তৃতীয় পিরিয়ডে রুদ্রর ক্লাস। মেঘ ঠিক করেছে আজকে কোন কথাই বলবে না। রুদ্র ক্লাসে প্রবেশ করতে বাকীরা দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। মেঘ বসেই রয়! এই নিয়ে এতো মাথাব্যথা নেই। এতো,এতো স্টুডেন্টদের ভীড়ে তাকে দেখা যায় না। তখন আবার কানে ভেসে আছে পেছনের বেঞ্চ থেকে কিছু কথা। তাও রুদ্রকে নিয়ে।
-আজকের শার্টটা স্যারকে দারুণ মানিয়েছে। এমনিতে তো সুন্দর তারউপর এই ব্লাক শার্ট। উফফ ভাই ফিদা আমি।
মেঘ পেছনে তাকায়। মেয়েগুলো রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। তখন আবার রুদ্র মেঘকে ডাক দেয়,
-এক্সকিউজ মি? পেছনে কী দেখছেন? স্ট্যান্ড আপ।
মেঘ দাঁড়ায়। রুদ্র তার সোজাসুজি বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ায়। আবারো বলে,
-পড়ালেখা তো করেনই না। তার উপর ক্লাসে ডিস্টার্ব করছেন। এরজন্য আপনার পালিশমেন্ট হওয়া উচিত!
-আপনাকে দেখিয়ে আমি পড়বো নাকী? আর আপনার ক্লাসে পড়া পারলেই তো হয়! আমার পড়াশোনা নিয়ে আপনাকে এতো মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি যা জিজ্ঞেস করবেন তার উত্তর আপনার ফেলেই তো হয়।
মেঘের ত্যাড়া কথায় বাকীরা অবাক। এতো রাইট কোথা থেকে আসলো মেঘের? স্যার কিছু বলবেন না? আচ্ছা মেঘ আর স্যারের মধ্যে কিছু চলছে না তো?
পেছনের বেঞ্চের মেয়েগুলো বলে। তখন রুদ্র বলে,
-ওকে ফাইন! আমি যা জিজ্ঞেস করবো তার উত্তর দিন।
-কী জিজ্ঞেস করবেন?
-আচ্ছা ইংল্যান্ডে একজন সাইনটিস্ট আছেন যাকে বসর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও বলা হয় ওনার নামটা কী বলুন তো?
-আমি অন্য দেশের খোঁজ রাখি না স্যার। আমার দেশের হলে একটা কথা ছিলো! কোথাকার ইংল্যান্ড! অন্যদেশের খোঁজখবর রাখার সময় আছে আমার?
মেঘের কথা রুদ্র রেগে যায়।
-মুখটা বেশী চলে আপনার। বেয়াদবি করার জন্য করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকবেন আমার পুরো ক্লাসের টাইম অব্দি।
মেঘ তেজ দেখিয়ে বাইরে চলে যায়। পেছনের বেঞ্চের মেয়েগুলো এই নিয়ে হাসাহাসি করছে। রুদ্র রাগ দেখিয়ে সবার উদ্দেশ্য বলে,
-সাইলেন্ট প্লিজ! আমার ক্লাসে খুব একটা বেয়াদব বা বেয়াদবি করে না কেউ বাট উনি মনে হয় হাতির পাখা দেখে ফেলেছেন। শিক্ষক যে হই সেটা ভুলে গেছেন।
হৃদ আচ্ছা মতো গালি দিচ্ছে রুদ্রকে। লিমা তো মুখ বাঁকাচ্ছে। এই ত্যাড়ার একটু দয়ামায়া বলতে কিছু নেই।
রুদ্রর ক্লাস শেষ হতে মেঘ ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে যায়। সোজা রিকশা ধরে বাড়ীর দিকে।
রুদ্রকে নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই তার মনে। একে তো গাড়ী থেকে নামিয়ে দিয়েছে। তারউপর সামান্য বিষয় নিয়ে কথা শোনালো। পেছনে তাকিয়েছে তো কী হয়েছে? কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে? তাকে যে মেয়েরা চোখ দিয়ে গিলে খায় সেটা ভালো। আজকে বাড়ী গেলে শার্ট এটা না পুড়িয়েছে মেঘ। সাথে গাড়ীর কাচ গুলো না ভেঙেছে। রুদ্র জানে মেঘ পড়ালেখায় কাঁচা! সবসময় সেটা নিয়ে খোঁটা, অপমান করা লাগে? প্রশ্ন করা কী খুব জরুরি ছিলো?
চৌধুরী বাড়ীতে এসে সোজা ফাইজা চৌধুরীর রুমে চলে যায় মেঘ। তখন ফাইজা চৌধুরী কলে কথা বলছিলেন। মেঘকে দেখে বলেন,
-কী হয়েছে মেঘ? এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?
-তোমার নাতিকে বলো এই কলেজ থেকে ট্রান্সফার হয়ে যেতে নাহলে আমায় অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে।
-কিন্তু কেন?
-তুমি জানো দাদী? আমাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে দিয়েছে তোমার নাতি। আমার সাথে কলেজ গেলে তার সন্মান ধুলোশ মিশে যাবে। তো! এখানে আমাকে অপমান করা হলো না?
-আচ্ছা রুদ্র আসুক।
-সে তো আসবে! তুমি শোনো আরেকটা কথা?
-কী কথা?
-মেয়েরা বলে ওনাকে কালো শার্টে সুন্দর লাগে। বউ হয়ে আমি কীভাবে সহ্য করি? উনাকে কে বলে কালো শার্ট পড়ে যেতে? আমি কিছু বলতে গেলে আমায় দাম দেয় না। বাইরের মেয়েরা যে ওনাকে এটা ওটা বলে তা শুনতে ভালো লাগে ওনার কাছে।
-রুদ্র আসুক শুধু। আমরা দু’জন মিলে ওকে বকা দেবো।
-তুমি দিও! আমি চলে যাচ্ছি তালুকদার বাড়ীতে। কথাই বলবো না উনার সাথে।
-আরে আজকে আমরা আনায়াদের বাড়ী যাবো। ওর বিয়ে সামনে।
-তুমি বুঝো না দাদী। আমি কী বলি শোনো?
-কী?
-আনায়ার বিয়ের আগে রুদ্র স্যারকে পাঠাবে তালুকদার বাড়ীতে আমায় নিয়ে আসার জন্য। সে যে আমায় অপমান করলো তার জন্য তো তাকে স্যরি বলতে হবে।
-রুদ্র বলবে না স্যরি।
-কেন?
– ও এমনি! তুমি কোথাও যেও না। ও রেগে গেলে সমস্যা। এই বাড়ীতেই থাকো। প্রয়োজনে কথা বলো না দু এক ঘন্টা।
-দু এক ঘন্টা কম হয়ে গেলো না? বলো দুই তিন মাস।
-আচ্ছা বলো না। আগে ফ্রেশ হও! খাবার খাও!
-আচ্ছা যাচ্ছি।
মেঘ প্রস্থান করে। ফাইজা চৌধুরী ও রুদ্রকে সাপোর্ট দিচ্ছে এই দুঃখ সে কই রাখে?
ছুটি হতে রুদ্র লিমাকে জিজ্ঞেস করে মেঘের কথা। লিমা জবাব দেয়, ‘সে জানে না।’
এতেই বেশ চটে যায় রুদ্র। ধমক দিয়ে বলে,
-আপনার সাথে না বসে ছিলো। কী জানেন আপনি? এই না বান্ধবী গলায়,গলায় ভাব। এখন ও কোথায় গেলো সেটাই জানেন না।
-আপনি ওকে অপমান না করলেও পারতেন।
-সেটা আপনাকে বলতে বলিনি। আপনার বান্ধবী আমায় থ্রেট দেয়। বাড়ীতে থ্রেট দিলে মানা যেতো কিন্তু না রাস্তায় থ্রেট দেয়। তখন তো আমি তার টিচার! বাড়ীতে নাহয় বর।
-আপনি এতো টিচার আর বরের হিসাব করেন কেন?
-তো কী করবো? আমি চাইনা আমাদের বিয়ের ব্যপারটা পাবলিক হোক। নাহলে মেঘেই সমস্যায় পড়বে।
-কেন? কেউ আবার আপনায় বিয়ে করার জন্য থ্রেট দিচ্ছে নাকী?
-না! থ্রেট দিবে কেন? ওতো সাহস নেই। আর আপনার বান্ধুবী তো আবেগে কান্না করলো! ডায়েরি লিখলো! ওর ভালোবাসা খাঁটি।
লিমা কেশে উঠে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
-আচ্ছা স্যার আসি আমি।
-যান।
রুদ্র ফাইজা চৌধুরীকে কল দেয়। মেঘ বাড়ী গেছে কীনা। ফাইজা চৌধুরী জানায়, ‘দেড় ঘন্টা আগেই সে বাড়ীতে চলে এসেছে।’
রুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। বাড়ীতে গেলে কানের নিচে দু’টো না মেরেছে তাহলে তার নাম ও রুদ্র না। না বলে চলে আসার মজা বুঝাবে। এতো তেজ কেন মেয়েটার? সে নাহয় শাসন করলো। তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে? বাড়ীতে তো শাসন করতে পারে না। কিছু বলতে গেলে আসে গলা জড়িয়ে ধরতে। রুদ্র ও গলে যায়। মেঘের পড়ালেখার যা অবস্থা পাশ করবে কীনা সন্দেহ।
রুদ্র চৌধুরী বাড়ীতে এসে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। মেঘ তখন শুয়ে ফোন স্ক্রোল করছিলো। রুদ্রকে দেখেও না দেখার ভাণ করে সে।
রুদ্র দরজা লক করে মেঘকে ডাক দেয়। মেঘ ডাকে পাত্তা দেয় না। রুদ্র মেজাজ হারায়! ধমকের স্বরে বলে,
-কথা কানে যায় না?
-কী বলবেন বলুন?
-না বলে চলে এসেছো কেন?
-ওটা কলেজের বিষয়! বাড়ীতে টানছেন কেন?
-যেই বিষয়ই হোক তোমার উত্তর আমার দায়িত্ব আছে।
-দায়িত্ব পালন করেন তো?
-তোমার কী মনে হয় আমি নাচি?
-না, না আপনি তো কোনদিন কোন শার্ট পড়ে গেলে মেয়েরা আপনায় নিয়ে কমপ্লিমেন্ট দিবে,মেয়েরা ক্রাশ খাবে,ফিদা হবে ওইটাই করেন।
-বাজে কথা ছাড়ো।
-আচ্ছা যান মাথা ঠান্ডা করুন। ফ্রেশ হোন।
-এই মূহুর্তে আমার ইচ্ছে করছে তোমায় কয়েকটা থাপ্পর দিতে।
-হাত বেশী চলে আপনার।
-তোমার মতো নিব্বিকে বিয়ে না করলেই ভালো হতো আমার।
-আর আপনার মতো রাগী,ত্যাড়া লোককে বিয়ে না করলেই ভালো হতো আমার। আমি তো আপনাকে বলিনি আসুন,আসুন স্যার আমায় বিয়ে করুন। আপনাকে বিয়ে না করলে আমি শহীদ হয়ে যাবো। আপনার জন্যই আমার বিয়ে ভেঙেছে। দাদীন মেঘকে বলো অন্য কোথাও যাতে বিয়েটা না দেয়। আপনি নিজেই তো পাগ’ল হয়ে গিয়েছেন।
-আসলেই তুমি বাঁচাল।
-যান তো আমার চোখের সামনে থেকে। আপনাকে দেখেই আমার শরীর জ্বলে।
রুদ্র আর কথা বাড়ায়না। শাওয়ারের জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। মেঘ উঠে রুদ্রর কাবাডের সামনে যায়। কাবাড থেকে ব্লাক কালারের যত টিশার্ট,শার্ট আছে সব নামায়। সুন্দর ভাবে একটা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে বালিশের নিচে রেখে দেয়।
ছাঁদে গিয়ে না পুড়িয়েছে ব্লাক কালার শার্ট, টিশার্ট। তার নিজের ও ব্লাক ফেবারিট। রুদ্রকেও ব্লাকে দারুণ মানায়। কিন্তু মেয়েরা তাকে নিয়ে কমপ্লিমেন্ট দিবে কেন? আর ব্লাক কালার পড়তে হবে না রুদ্রর।
কিচেন রুম থেকে লাইটার এনে ছাঁদে যায় মেঘ। ছাদের একপাশে খোলামেলা জায়গায় শপিং ব্যাগে আগুন ধরিয়ে দেয়। দাঁড়িয়ে থেকে টিশার্ট গুলো পুড়ছে আর আনন্দ নিচ্ছে মেঘ।
তখনি শক্ত বাহু তার কোমড় খামচে ধরে। মেঘ তাকায়। রুদ্র তার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। মেঘ একবার আগুনের দিকে তাকায় আরেকবার রুদ্রর দিকে।
-কী পোড়াচ্ছো এখানে?
-ওই আমার কিছু কাগজপত্র।
-ডাস্টবিনে ফেলে দিলেই তো হয়।
-আরে না ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার মতো না। আমাকে যারা লাভ লেটার দিয়েছে তাই পুড়িয়ে দিচ্ছি। আপনি দেখলে যদি আবার জ্বলেন সেজন্য।
-ফাল’তু কথা ছাড়ো। চলো লান্স করবে।
-হ্যাঁ,হ্যাঁ চলুন।
রুদ্রকে নিয়ে ভালো,ভালোয় কেটে পড়ে মেঘ। আজকের মতো বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে। অন্তি,হানি,সাবি,ফাইজা চৌধুরী, রুদ্র সবার সাথে খেতে বসেছে মেঘ।
তখন ফাইজা চৌধুরী বলে উঠেন,
-বিকেলে তো আমরা সবাই যাবো। রুদ্র মেঘকে বলো ব্যাগ গুছিয়ে নিতে। তালুকদার বাড়ীতে এখন যেতে হবে না।
-কে বলেছে ও তালুকদার বাড়ীতে যাবে?
ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে রুদ্র। তখন মেঘ বলে,
-না কেউ যাবে না।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে এদিকটা অন্তি,হানির সাথে মিলে সামলে নেয় মেঘ। একটু পর বড়রা আসবে অফিস থেকে। তাঁদের জন্য শরবত সাথে খাবার রেডি করছে মেঘ,হানি। মনে,মনে আফসোস করছে মেঘ। শার্ট গুলো সুন্দর ভাবে পুড়েছে তো?
এদিকটা সামনে আবারে ছাঁদে যায় মেঘ। হাতে ঝাড়ু। শার্টগুলো পোড়া শেষ। মেঘ তড়িঘড়ি ঝাড়ু দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলে। যদিও তেমন কেউ ছাঁদে আসেনা তবে আসলে আবার সমস্যা। পোড়া কিছু দেখলে খোঁচানো শুরু করে দিবে।
রুদ্র কাবাড খুলতে দেখে তার গোছানো জামাকাপড় কিছুটা এলোমেলো। বিশেষ করে কালো রংয়ের শার্ট আর টিশার্ট গুলো দেখতে পাচ্ছে না।
-আচ্ছা মেঘ তখন কী পোড়াচ্ছিলো?
টনক নড়ে রুদ্রর। মূহুর্তে চোয়াল শক্ত করে নেয়। তখন আবার রুমে মেঘের আগমন।
সেও হাসি দিয়ে বললো,
-রুদ্র স্যার শুনুন না।
#চলবে