বাতাস বলে দেয় পর্ব-০২

0
11

#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

২.
ঝড়ের বেগ বাড়ছে। বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ, মেঘের গর্জন, কানে তালা লেগে যায়। অন্ধকার ঘর হাতড়ে মোবাইল খুঁজতে লাগলাম। ইনান চুপ হয়ে গিয়েছে। কাঁদছে না। হিমি মোমবাতি হাতে ঘরের ভেতর ঢুকল। আনন্দিত গলায় বলল, “বৈশাখ শুরুর আগেই বৃষ্টি। এবার গরম কম পড়বে।”

তার কথার জবাব দিলাম না, হাসলাম। হিমি বলল, “ভাবী, ইনান ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ওকে শুইয়ে দাও।”

“কোলে থাকুক। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভয় পাবে।”

প্রায় আধঘন্টা মতো ঝড়ের তান্ডব চলল। বাড়ির সামনে বড় মেহগনি গাছটা ভেঙে পড়ল। ঝড়ের পুরো সময়টাতে আরিফ ঘরে আসেনি। রাগ করে বাড়ির বাইরে চলে গেল নাকি? ইনানকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার খোঁজে গেলাম।

আরিফ স্টোররুমে বসে মোবাইল চালাচ্ছে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগল না। সরু গলায় বললাম, “ঘর সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছ নাকি?”

আরিফ আমার দিকে তাকাল না। সহজ গলায় বলল, “তেমনটা করতে পারলেই ভালো হতো।”

“সংসার তোমার কাছে এতটা বিরক্তির হয়ে উঠেছে আগে কখনো বুঝিনি।”

“আগে বিরক্তি ছিল না, তাই বুঝতে পারোনি। এখন আছে, এখন বুঝতে পারলেই হলো।”

“কারণ জানতে পারি?”

সে চুপ করে রইল। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আরিফের পাশে বসলাম। শান্ত গলায় বললাম, “কি হয়েছে তোমার? কোন ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত? না বললে কিভাবে বুঝব বলো?”

“বুঝতে হবে না। কিছু হয়নি আমার।”

আমি আরিফের গায়ে হাত রাখলাম। বরফ শীতল গলায় বললাম, “তুমি তো জানোই! অহেতুক অশান্তি পছন্দ করি না। ভালো লাগে না। বেশ বুঝতে পারছি আমাদের সম্পর্ক আগের মতো নেই। তোমাকে দোষ দেব না। হয়তো আমি নিজেই বদলে গিয়েছি। তবে এসবের একটা সমাধান প্রয়োজন। ইনান বড় হচ্ছে। ওর জন্য হলেও প্রয়োজন।”

হঠাৎই আরিফের ভাবমূর্তি বদলে গেল। আমার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তৎক্ষনাৎ তাকে কিছু বললাম না। মানুষটা কাঁদছে, একটু কাঁদুক। পৃথিবীর সব পুরুষ কাঁদতে পারে না। সবার চোখে পানি আসে না। কান্নাগুলো কষ্ট হয়ে বুকের মাঝে দলা পাকিয়ে থাকে। আরিফ এমন নয়। সে কাঁদতে পারছে। কাঁদুক।

মিনিট দশেক পর তার কান্না থামল। চোখ মুছে বলল, “সময়টা আমার জন্য ভালো যাচ্ছে না। পরে তোমাকে সব বুঝিয়ে বলব। আপাতত কিছু জিজ্ঞেস করো না। দয়া করে আমায় কিছুটা সময় দাও।”

হাসলাম। তাচ্ছিল্যের হাসি! আমার গোটা জীবনটাই যাকে দিয়ে চেয়েছি। সে আজ আমার কাছে সময় ভিক্ষা চাইছে। জীবন সত্যিই অদ্ভুত!

শ্বশুর আব্বু ঝড় থামার পর বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরলেন রাত দশটার দিকে। নরম গলায় বললেন, “ক্ষয়-ক্ষতি যা হয়েছে তা বেশ ভালোই। মনজুর দোকানের টিনের চাল উড়ে গেছে। গাছের ডাল ভেঙেছে। তালেবদের মাটির ঘরের দেয়াল ধসে গেছে।”

শাশুড়ি মা বললেন, “আমাদের গাছপালা কিছু ভাঙেনি?”

“ভাঙার মতো গাছ থাকলে তবেই না ভাঙবে। শীতের সময় সব গাছ কে’টে ফেলেছি। ভাঙার মতো কিছু অবিশিষ্ট নেই।”

“তা ভালো। রাত হয়েছে। খেতে আসেন। তানজিলা আরিফকে ডেকে নিয়ে এসো। হিমি আয়। লাইট নিভে গেলে আর খেতে পারবি না। ঝড়ে কোথায় কোন তার ছিঁ’ড়ে গেছে কে জানে! দুদিনের মধ্যে কারেন্ট আসবে না।”

রান্নার আয়োজন ভালো। আলু বেগুন দিয়ে রুই মাছের ঝোল, চিংড়ির মালাইকারি। আরিফের পছন্দের খাবার। তবুও সে খুব বেশি খেতে পারল না। সামান্য একটু মুখে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলল। নরম গলায় বলল, “আমার খাওয়া শেষ।”

শাশুড়ি মা ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পরক্ষনেই কটমট দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। যেন তার ছেলের না খাওয়ার জন্য আমিই দায়ী। আমার দোষে সে ভালোমতো খেতে পারেনি।

ঘড়িতে বারোটার মতো বাজে। আরিফ বিছানার একপাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। সাড়াশব্দ নেই। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। পরপর দু’বার হাই তুললাম। শীত লাগছে। বিছানায় কাঁথা কম্বল নেই। উঠতে ইচ্ছে করল না। গুটিশুটি হয়ে আরিফের ব্যাপারে ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন! এমন কি হয়েছে যে কথা আমাকেও বলতে পারছে না!

সুস্থ মানুষ তার প্রিয়জনের চোখের পানি সহ্য করতে পারে না। কখনো সম্ভবও না। তাদের চোখে পানি দেখলে মনটা কেমন হুহু করে ওঠে। আরিফ তখন কাঁদছিল, ভীষণ মায়া লাগছে। নরম চোখে তার দিকে তাকালাম। সে বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে। মুখের উপর ডিম লাইটের সবুজ বলো এসে পড়ছে। ভালো লাগছে দেখতে। অতীতের কিছু সুন্দর স্মৃতি মনে করতে গিয়ে সুমির বলা কথাগুলো মনে পড়ল। বাড়িতে বউয়ের সাথে জেদ দেখিয়ে অফিসে গিয়ে মেয়ে কলিগের টিফিন চেয়ে খাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার কি-না জানি না। তবে তা প্রতিটা মেয়ের জন্য কষ্ট এবং য’ন্ত্র’ণার। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। প্রচন্ড রকমের মনকষ্ট নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বোধহয় রাতে আবার ঝড়বৃষ্টি নামবে।

সকালে ঘুম ভাঙল দেরিতে। চোখ মেলে দেখি আমার গায়ের কাঁথা। পাশে ইনান নেই, আরিফও নেই। কাঁথা সরিয়ে হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। ব্যস্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। হিমিকে ডেকে বললাম, “ইনান তোমার কাছে?”

হিমি বই পড়ছিল। ডানে বামে মাথা দুলিয়ে বলল, “ইনানকে ভাইয়া নিয়ে গেছে।”

“কোথায় গিয়েছে তুমি কিছু জানো?”

“বলে যায়নি। ইনান উঠে কাঁদছিল। আমি গিয়ে দেখি ভাইয়া ওকে কোলে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে।”

শাশুড়ি মা রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিলেন। আমার গলা শুনে বেরিয়ে এলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “গতকাল রাত পর্যন্ত দু’জনের মধ্যে তো ভালোই চুলোচুলি লেগে ছিল। এক রাতে এমন কি করলে যে স্বামী তোমার বশে চলে গেল?”

উনার কথার ধরন একটাই কুৎসিত ছিল যে গায়ে জ্বা’লা ধরে যায়। হিমি গলার স্বর হঠাৎ অনেকখানি নিচু করে বলল, “মায়ের সাথে ভাইয়া ঝগড়া হয়েছে।”

“কি নিয়ে?”

“ইনানকে ভাইয়ার কোলে দেখে মা বলল– বউকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ছেলে মানুষ করছিস। বাহ! বেশ ভালো। আজকালকার ছেলেরাও হয়েছে। বউ ছাড়া কিছু বোঝে না।”

“তারপর?”

“তারপর ভাইয়া মা’কে ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে ইনান নিয়ে চলে গেছে।”

“ওহ!”

মুখ-হাত ধুয়ে সকালের রান্না বসলাম। শাশুড়ি মা বললেন, “এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকলে দু’দিনেই সংসার মাথায় উঠবে।”

দুশ্চিন্তায় মাথা ভার হয়ে আছে। তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না। তবে এবার আর চুপ থাকলাম না। কঠিন মুখে বললাম, “আচ্ছা আম্মা! আপনি ঠিক কি চাইছেন একটু বলবেন? গতকাল আরিফের সাথে ঝামেলা হয়েছিল। আপনি বললেন– স্বামীর মন জয় করতে না পারলে সংসার ছেড়ে দাও। আর আজকে জিজ্ঞেস করছেন কিভাবে স্বামীকে নিজের বশে এনেছি। এক মুখে দু’রকম কথা বললেন কিভাবে?”

শাশুড়ি মা একটু মিইয়ে গেলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, “বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি করে হাত চালাও। সকালের নাস্তা দুপুরবেলা খাব নাকি?”

একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। রাঁধতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। ইচ্ছে না থাকলেও রাঁধতে হবে। সংসারে বউদের কখনো ছুটি হয় না। যেসব মেয়ে রান্নাঘর থেকে সামান্য একদিনের ছুটি পায় নিঃসন্দেহে তাকে ভাগ্যবতী বলা যায়। চাল ধুয়ে ভাত চড়িয়ে দিলাম।

খানিক বাদে হিমি চিৎকার করে উঠল। করুণ গলায় বলল, “কি হয়েছে? তোমাদের এমন দেখাচ্ছে কেন? ইনানের হাতে কি হয়েছে?”

রান্না ফেলে রেখে ছুটে গেলাম। আরিফ ইনানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইনানের ডান হাতের কনুই একটু কে’টে গেছে। ব্যস্ত হাতে ছেলেকে কোলে নিতে নিতে বললাম, “কি হয়েছে তোমাদের? এমন অবস্থা কিভাবে হলো?”

আরিফ বলল, “তেমন কিছু হয়নি। হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছি। এই ওষুধটা ইনানের হাতে লাগিয়ে দাও।”

“তোমার কিছু হয়নি? দেখি, এদিকে ফেরো।”

আরিফ ফিরল না। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ঘরে চলে গেল। আমিও তার পেছন পেছন এলাম। তরল গলায় বললাম, “জেদ করো না। কোথায় কি হয়েছে দেখতে দাও।”

আরিফ শান্ত হয়ে বিছানায় বসল। তার কনুই, হাঁটু, ঘাড়ের বেশিরভাগ অংশ ছিলে গেছে। দগদগে লাল গোশত বেরিয়ে আছে। তুলো ভিজিয়ে ক্ষ’ত জায়গাগুলো ভালোমতো পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিলাম।

আরিফ বলল, “তোমাকে এত কথা শোনাই, খারাপ ব্যবহার করি। তবুও আমার সেবাযত্ন করছ?”

সামান্য হাসলাম। জবাব দিলাম না।

“তানজিলা!”

“উঁ?”

“আমায় ছাড়া থাকতে পারবে? আমি নেই এমন হলে কি ইনানকে নিয়ে থাকবে? নাকি আবার বিয়ে করবে?”

চমকে ওর দিকে তাকালাম। আরিফের চোখ-মুখ শান্ত। বিরক্ত গলায় বললাম, “এসব কি ধরনের কথা? তুমি কোথায় যাবে?”

“গত রাতে স্বপ্ন দেখেছি– আমি ট্রেনে চড়ে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি। ইনান খুব কাঁদছে। ওর আশেপাশে কেউ নেই৷ তুমিও না। সেজন্যই প্রশ্নটা করলাম।”

“স্বপ্ন স্বপ্নই হয়। বাস্তবে এর কোন ব্যাখ্যা নেই।”

“তুমি হয়তো বিশ্বাস করো না। যাইহোক খেতে দাও। ভীষণ খিদে পেয়েছে। খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে।”

ভাত বেড়ে দিয়েছি। আরিফ খুব আগ্রহের সাথে খাচ্ছে। তরকারি বলতে দু’পদের ভর্তা, আমের গুটি দিয়ে টক ডাল।
বিয়ের পরপর এমনই এক দিনের কথা,
তখন ইনানের জন্ম হয়নি। শ্বশুর শাশুড়ি হিমিকে নিয়ে খুলনা গিয়েছে। বাড়িতে শুধু আমরা দু’জন। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। আমার শরীর বেশ সুস্থ ছিল। হঠাৎই গায়ে জ্বর চলে এলো। সেকি জ্বর! কাঁপুনি ছুটে গেছে। আরিফ বৃষ্টি মাথায় গিয়ে ওষুধ এনে দিলো। চিন্তিত গলায় বলল, “নিজে তো নিজের যত্ন নিতে পারো না। আমার একটা কথাও শুনতে চাও না। এখন কার কষ্ট হচ্ছে?”

“ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে আপনার কষ্ট হচ্ছে।”

“বাজে কথা বলো না। খানিকক্ষণ বিশ্রাম করো। ছটফট করলে সুস্থ হতে সময় লাগবে।”

“দুপুরে খাওয়ার মতো কিছু নেই। রাঁধতে হবে।”

“রাঁধতে হবে না। চুপচাপ বসে থাকো।”

“না রাঁধলে খাব কি?”

“একবার উপবাস করলে কিছু হবে না৷ বরং এটা শরীরের জন্য বেশ উপকারী।”

“ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। না খেয়ে থাকতে পারব না। আপনার উপকার আপনার কাছেই রাখুন। তাছাড়া আমার এখন ভালো লাগছে। জ্বর ছেড়ে গেছে৷ শরীর ঠান্ডা। বিশ্বাস না হলে গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে নিতে পারেন।”

“বিশ্বাস করছি। প্রতিটা কথাই বিশ্বাস করছি। ঘরে শুকনো খাবার কিছু নেই?”

“না নেই। গতকাল সন্ধ্যায় শেষ হয়ে গিয়েছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। বাইরে কিছু পাওয়া কি-না দেখছি।”

“এই বৃষ্টিতে বাইরে কোথায় কি পাবেন? তাছাড়া বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমার একা থাকতে ভয় করে।”

“ভালো কথা। খুব ভালো কথা৷ তবে যা-ই বলো না কেন– শরীরের এই অবস্থা নিয়ে আ’গু’নের তাপে রান্না করা যাবে না।”

“তাহলে কি করব? না খেয়ে থাকব?”

“শুয়ে বসে বিশ্রাম নেবে৷”

“আর রান্না?”

“দেখছি কি করা যায়।”

“আপনি রান্না জানেন?”

আরিফ খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তারপর রান্নাঘরে চলে গেল। দোকানের খাবার খেতে আমার কোন অসুবিধা নেই। শাশুড়ি মা বলেছিলেন– আরিফ বাইরে খাবার খেতে পারে না। সেজন্যই জোর করছিলাম। তাছাড়া ওর কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছিল।
প্রায় তিন ঘন্টা পর, আরিফের রান্না শেষ হলো। ডিম আলু ভর্তা। আমের গুটি দিয়ে টক ডাল।

খাবারগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে আমার সামনে দিয়ে বলল, “যা পেরেছি রেঁধেছি। খেয়ে নাও। তারপর চুপচাপ শুয়ে থাকো।”

ভাত মেখে মুখে দিলাম। আরিফ বলল, “রান্না কেমন হয়েছে? খাওয়া যায়?”

উৎসাহী মুখে তাকিয়ে আছে। চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছে। মুচকি হেসে বললাম, “খুব ভালো হয়েছে।”

পুরো খাবারটা শেষ করলাম। গোসল সেরে আরিফ নিজে খেতে বসল। এক গ্রাস মুখে দিয়ে ছুটে আমার কাছে এলো। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “ভবিষ্যতে যা কিছুই হোক। আজকে পর আমার জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে কোন আক্ষেপ অথবা আফসোস থাকবে না।”

তার কথার জবাবে হেসেছিলাম। নুনে পো’ড়া ভর্তা, ডাল ছিল অসম্ভব টক। মুখে দেওয়া যায় না। তবুও খাবারটা আমার কাছে ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল এমন সুস্বাদু খাবার এ জীবনে আর খাব না। তখন ওকে ‘আপনি’ সম্মোধন করতাম। এখন তুমি বলি। তবুও ওই সময়গুলো বেশি ভালো ছিল। ভালো সময়গুলো কত দ্রুত পেরিয়ে যায়!

“হাসছ কেন?”

আরিফের কথায় ধ্যান ভাঙল। ব্যস্ত গলায় বললাম, “তোমার আর কিছু লাগবে?”

“খাওয়া শেষ। পারলে এক কাপ চা বানিয়ে দাও। মাথা ধরেছে।”

রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি চাপালাম। আরিফ চায়ে চিনি খুব মাপজোপ করে খায়। এক চামচ উঁচু উঁচু আর এক চামচ সমান। মাঝেমধ্যে একটু আদা কুঁ’চি করে দিই। চায়ের স্বাদ বাড়ে।

চা নিয়ে আরিফের সামনে রাখলাম। সে হেলান দিয়ে খাটের উপর বসে আছে। পাশেই মোবাইল। সাইলেন্ট মোডে রাখা হয়েছে বোধহয়। কল আসছে, শব্দ হচ্ছে না। ফোনের স্কিনের ওপর ‘সুরভি ম্যাডাম’ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে।

আরিফ বলল, “আমার একটু কাজ আছে। বের হতে হবে। এখন আর চা পান করব না।”

কথাগুলো বলে সে আর এক মিনিটও দাঁড়াল না। আলমারি থেকে নীল সুতার কাজ করা সাদা পাঞ্জাবিটা বের করে পরল। তারপর তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগল না। অফিসের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের স্যার ম্যাডাম সম্মোধন করাই যায়। কিন্তু আরিফ আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকে৷ সে বলে– খুব কাছের একজনকে এই নামে ডাকা যায়। বিষন্ন মুখে চায়ের কাপ সরিয়ে রাখলাম। আর ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল আজ পহেলা বৈশাখ।

চলবে