#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল
৫.
হিমি বলল, “কী হবে এখন? কি করব?”
“কি করব বুঝতে পারছি না। চট করে কিছু মাথায় আসছে না।”
“ভাইয়া! হ্যাঁ, ভাইয়াকে কল দাও। সে এসে কিছু করুক।”
“তোমার ভাই কী করবে? তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে কার কী করার থাকতে পারে?”
“কিছু না কিছু তো করতে হবে। এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?”
ইনান কাঁদছে। বেশ জোরেই কাঁদছে। হিমি তার পিঠে আস্তে আস্তে চা’প’ড় দিচ্ছে। তার হাত হালকা কাঁপছে। মিনিট দুয়েক শান্ত মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। নরম গলায় বললাম, “একটা কাজ করলে কেমন হয়? পুলিশকে কল করি, কল দিয়ে ওদের এখানে আসতে বলি। তারপর যা হয়েছে খুলে বলব।”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমরা কোন দোষ করিনি৷ পুলিশেরা নিশ্চয়ই তদন্ত না করে কিছু করবে না। এটাই ভালো হবে। তুমি ত্রিপল নাইনে কল দাও।”
ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে তিনটে নয় টাইপ করলাম। কল দিতে যাব ঠিক তক্ষুনি তিনজন লোক ঘরের ভেতর ঢুকল। দু’জন মহিলা, একজন পুরুষ। পুরুষ মানুষটা বেশ বয়স্ক। টাক মাথা, জুলফির কাছে যে কয়েক গোছা চুল, তার বেশিরভাগ সাদা হয়ে গেছে। ভদ্রলোক ক্রমাগত পান চিবুচ্ছেন। ঠোঁটে চারপাশে পানের পিক লেগে আছে৷ তিনি সামনে এগিয়ে এলেন। উত্তেজিত গলায় বললেন, “একি! সুরভির কি হয়েছে? এভাবে পড়ে আছে কেন? তোমরাই বা কারা?”
হিমি আমতা আমতা করতে লাগল। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম, “উনি আমাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। দাওয়াত খেতে এসেছি।”
তুলনামূলক কম বয়সী মহিলাটা বলল, “মেঝেতে র’ক্ত ছড়িয়ে আছে। সুরভির অবস্থা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে এরা ওকে খু’ন করেছে।”
অন্যজন এগিয়ে গিয়ে সুরভির নাকের কাছে আঙুল রাখল। চিৎকার করে বলল, “নিঃশ্বাস চলছে না। এক্ষুনি পুলিশকে কল দাও। এই মেয়ে এখানে কেউ এসেছিল? কি দেখেছ তোমরা?”
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। তরল গলায় বললাম, “আমি কিছু দেখিনি। বাথরুমে গিয়েছিলাম, এসে দেখি উনি মেঝেতে পড়ে আছেন।”
“একটা মানুষ ছু’রির আ’ঘা’তে মৃ’ত্যুবরণ করল আর তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ?”
“আমরা দু’জনেই ঘাবড়ে গিয়েছি।” কথাটা বলে মোবাইলটা উনার দিকে এগিয়ে ধরলাম।
সরল গলায় বললাম, “পুলিশকে কল দিচ্ছিলাম তার মধ্যেই আপনারা চলে এসেছেন।”
উনি কথার জবাব দিলেন না। হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে ত্রিপল নাইনে কল দিলেন।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে চারপাশের পরিবেশ বদলে গিয়েছে। সুরভির বাসা জমজমাট। ছ’জন পুলিশ এসেছে। আরিফ এসেছে। তার মুখ থমথমে। আঁড়চোখে বেশ কয়েকবার আমার দিকে তাকিয়েছে কিন্তু কিছু বলেনি। শাশুড়ি মা ঘরের কোণে বসে বিলাপ করেছেন। বিলাপের সুর অস্পষ্ট। ‘কেন আসতে বললাম! আল্লাহ!’ শুধু এতটুকুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মহিলা পুলিশ এসেছে তিনজন। তাদের মধ্যে একজন শাশুড়ি মা’কে ধমক দিলেন। তেঁতো গলায় বললেন, “আপনি বাইরে যান। বাইরে গিয়ে কাঁদেন।”
শাশুড়ি মা চুপ করে গেলেন। দারোগা সাহেব বললেন, “আপনাদের মধ্যে কে কল দিয়েছেন? সমানে আসেন।”
ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন। মেকি হেসে বললেন, “আমি দিয়েছি।”
“বেশ ভালো। ঘটনা কী হয়েছে খুলে বলুন। সবকিছু বলবেন। প্রথমে নিজের পরিচয় দিবেন।”
“জ্বি, আমার নাম মকবুল। আমি এই বাড়ির মালিক। সুরভি মানে যে মহিলা মা’রা গেছে। সে আমার বাড়িতে ভাড়া থাকত। চারমাস আগে ভাড়ায় এসেছে। একা থাকত। শুনেছি তিন কূলে কেউ নেই৷ এখানকার এক বেসরকারি অফিসে কাজ করে।”
“একা থাকত! তাহলে আপনারা কারা?”
দারোগা সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন আমাকেই প্রশ্ন করেছেন।
আমি বললাম, “আমি উনার কলিগের স্ত্রী। উনি আমার স্বামীর সাথে একই অফিসে চাকরি করে। সুরভি আপা আমাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন।”
“ঘটনার সময় আপনারা ছাড়া এই ঘরে আর কে কে ছিল?”
“আমরা তিনজনই ছিলাম।”
“কি হয়েছে খুলে বলেন। আপনারা এখানে আসার পর সবকিছু স্বাভাবিক ছিল?”
“স্বাভাবিক ছিল। খেতে বসে হঠাৎই আমার গলায় খাবার আঁটকে যায়। হিমি পানি গ্লাস এগিয়ে দিতে গিয়ে কাপড়ে ঝোল মাখিয়ে ফেলে। আমি কাপড় ধুতে বাথরুম যাই। বাথরুম যাওয়ার খানিকক্ষণ পর হিমির চিৎকারে ছুটে এসে দেখি- সুরভি আপা মেঝেতে পড়ে আছেন। উনার পিঠে ছু’রি ঢোকানো। র’ক্ত পড়ছে।”
“মিস হিমি! আপনার ভাবী ঠিক কথা বলছে? সুরভির সাথে আপনি একা ছিলেন?”
হিমি মাথা দোলালো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ, না মানে ইনান আমার কোলে ছিল।”
“উনি কি ঠিক বলছে? আপনার ছেলে উনার কাছে ছিল?”
উপর-নিচে মাথা দোলালাম। তরল গলায় বললাম, “হ্যাঁ, ঠিক বলছে।”
“তাহলে মিস হিমি, আপনি উনার সাথে একা ছিলেন। এদিক থেকে দেখতে গেলে খু’নের সাথে আপনার হাত থাকার সম্ভাবনা সর্বোচ্চ।”
হিমি বলল, “আমি কেন এমন করব? উনার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। পরিচয়ও নেই বললেই চলে।”
“কেন খু’ন করেছেন সে কথা আপনি আমাদের বলবেন। তমা এদের সার্চ করো। দেখো এদের কাছে কি পাওয়া যায়। রুবেল তুমি সবার জবানবন্দি নাও। সবকিছু জিজ্ঞেস করবে। একদম সবকিছু। বাকিরা ঘর সার্চ করো। ঘরের প্রতিটা কোণা খুঁজে দেখবে। যেন কোথাও কিছু বাদ না যায়।”
সবচেয়ে লম্বা ছেলেটা আরিফের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তার বয়স বাইশ তেইশ। বেশ স্বাস্থ্যবান। মনে হচ্ছে সম্প্রতি গোঁফ রেখেছে। গোঁফের পেছনে অনেক যত্ন এবং সাধনা আছে তা বোঝা যাচ্ছে। চেহারার মতো তার গলার স্বরও বেশ গম্ভীর। আরিফকে নানান প্রশ্ন করছে। হাত হাতে মোবাইল ধরে একটু উঁচু করে রেখেছে। বোধহয় কথাবার্তা রেকর্ড করছে।
তমা আমাদের দু’জন নিয়ে ঘরের এককোণে সরে গেলেন। হিমির গায়ে হাত দিয়ে বললেন, “কিছু করলে এখনই স্বীকার করে নাও। ঝামেলা কম হবে।”
হিমি ক্লান্ত গলায় বলল, “কিছু নেই। আপনারা কেন বুঝতে চাইছেন না যে এই ঘটনার সাথে আমাদের কোন কানেকশন নেই। ভাবীর কাপড়ে ঝোল লাগার পর সে বাথরুমে গিয়েছিল। আমি ইনানকে কোলে নিয়ে বসে খাবার খাচ্ছি। হঠাৎই উনি মেঝেতে পড়ে গেলেন। তুলতে গিয়ে দেখি পিঠে ছু’রি আঁটকে আছে। ভয়ে পেয়ে চিৎকার করে উঠি, ভাবী এসে কি করবে বুঝতে না পেরে ত্রিপল নাইনে কল দিতে যাচ্ছিল তখনই উনারা আসেন।”
তমা বললেন, “স্যার, এই মেয়ে বলেছে সাহায্যের জন্য এরা ত্রিপল নাইনে কল দিতে যাচ্ছিল।”
দারোগা সাহেব কিছু বলবেন তার আগে মকবুল সাহেব কথা বলে উঠলেন।
“ঠিকই বলেছে। স্যার, ওদের এই কথাটা সত্যি। চিৎকার শুনে যখন আমরা এখানে আসি তখন ওই মেয়েটার হাতে মোবাইল ছিল। ত্রিপল নাইনে কল দিতে যাচ্ছিল। আমি ওর মোবাইল থেকেই কল দিয়েছি।”
দারোগা সাহেব অল্প হাসলেন। অন্যরকম গলায় বললেন, “এটা বেশ একটা ভালো বুদ্ধি! প্রথমে অপরাধ করবে তারপর নিজেরাই পুলিশকে কল দিয়ে ভিক্টিম সাজবে। এই পদ্ধতিটা আরও অনেক আগে থেকে চালু আছে। অনেকেই এমন করে। আপনারা এমন করছেন না তো?”
আরিফ বলল, “স্যার, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার বোন অথবা স্ত্রী, এদের কারো কাছে সুরভি আপাকে খু’ন করার কারণ নেই। ওরা দু’জন এখানে দাওয়াতে এসেছিল।”
আরিফ সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল। সে বেশ গুছিয়ে কথা বলছে৷ অফিসে বিরিয়ানি খাওয়া থেকে শুরু গতকাল বাড়িতে যাওয়ার প্রতিটা বিষয় তুলে ধরছে। সবকিছু শুনে দারোগা সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “কে’সটা বেশ জটিল হতে চলেছে। বন্ধ ঘর, ঘরে একজন বাচ্চা, তিনজন মেয়ে মানুষ। হঠাৎই একজনের পিঠে ছু’রি ঢুকে গেল। অন্য দু’জনের কাছে হ’ত্যার কোন কারণ নেই এবং তারা কিছু জানেও না। বেশ জটিল!”
তমা বললেন, “স্যার, আরও একটা ব্যাপার। এই যে তানজিলা, উনি বলছেন– ঘটনার সময় উনি বাথরুমে ছিলেন। পরে এসেছেন। তাহলে হিমি একা ছিল, বাচ্চা কোলে নিয়ে কেউ কাউকে খু’ন করবে কিভাবে?”
“হতে পারে বাচ্চাটা কোল থেকে নামিয়ে রেখেছিল।”
“এদের কারো কাছে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। ঘরেও বিশেষ কিছু নেই। এই অবস্থায় আমরা কি করতে পারি?”
“বাথরুমে পানি চিহ্ন পেয়েছ?”
“হ্যাঁ স্যার। বাথরুমের বেসিন, বেসিনের আশেপাশের জায়গাটা ভেজা। সময়ের সাথে পানি শুকিয়ে যায়নি। এর মানে অনেক পানি পড়েছে।”
মকবুল সাহেব বললেন, “আমার মনে হয় ওই মেয়ে দু’টোই খু’ন করেছে।”
মহিলা দু’জনও একসাথে একই কথা বলে উঠল।
দারোগা সাহেব বললেন, “মিস হিমি, সত্যি করে বলেন, সুরভি যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তখন আপনার ভাবী কোথায় ছিল?”
হিমি বলল, “ভাবী বাথরুমে গিয়েছিল।”
“দেখুন, আপনার কথার উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাই যা-কিছু বলবেন সত্যি বলবেন। মিথ্যে বললে আপনার বিপদ হতে পারে। এই খু’নের সাথে আপনার ভাবীর কোন হাত নেই তো? এমনও তো হতে পারে যে আপনার ভাইয়ের সাথে সুরভির অ’বৈ’ধ সম্পর্ক আছে। সেজন্যই তানজিলা উনাকে খু’ন করেছেন। আর এখন কিছু না জানার অভিনয় করছেন। এই কাজে আপনি তাকে সাহায্য করছেন।”
হিমি অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, “এমন কিছু নেই। ভাবী বাথরুমে গিয়েছিল। তাছাড়া এই খু’নে আমার কোন হাত নেই। আইন নিশ্চয়ই কোন নির্দোষ ব্যক্তিকে শা’স্তি দেবে না?”
দারোগা সাহেব একটু সময় নিয়ে চিন্তা করলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন, “মিস হিমি, মিসেস সুরভির খু’নের অপরাধে আপনাকে গ্রে’ফ’তা’র করা হচ্ছে। তানজিলাকে আপাতত বাইরে রাখা হলো। তবে উনি শহরের বাইরে যেতে পারবেন না।”
শাশুড়ি মা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎই তিনি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “হিমিকে জে’লে নিচ্ছেন আর এই মেয়েকে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? আমার মেয়ে তো কিছু করেনি। করলে এই মেয়ে করেছে। ধরতে হয় ওকে ধরুন।”
দারোগা সাহেব বরফ শীতল গলায় বললেন, “কাকে জে’লে নেব আর কাকে ছেড়ে দেব এই ব্যাপারটা আমাদের। আপনার মতামতের কোন প্রয়োজন নেই। তাছাড়া কে’স শেষ হয়ে যায়নি। তদন্ত চলবে। আসল অপরাধী ধরা পড়বে।”
শাশুড়ি মা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আরিফের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এই ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না। আমি নিজেও হজম করতে পারছি না। হিমির চেয়ে আমাকে স’ন্দে’হ করা সহজ। কিন্তু পুলিশেরা এমন কেন করল?
দারোগা সাহেব বললেন, “আপনাদের সবার জবানবন্দি নিয়েছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সবকিছু এখানেই শেষ। তদন্তের সার্থে আবারও আপনাদের ডাকা হতে পারে। আশা রাখছি আপনারা সাহায্য করবেন।”
রুবেল বলল, “সবাই বের হন। ঘরটা আপাতত বন্ধ থাকবে। যেন বাইরের কেউ প্রবেশ করতে না পারে। স্যার, আমি দরজায় তালা লাগিয়ে রাখছি।”
দারোগা সাহেব মাথা দোলালেন।
তমা হিমির হাত ধরে তাকে পুলিশের ভ্যানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শাশুড়ি মা কাঁদছেন, আরিফ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইনান আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে।
শাশুড়ি মা বললেন, “আরিফ কিছু একটা কর। হিমি কি জে’লে থাকবে নাকি?”
আরিফ কঠিন মুখে বলল, “নিষেধ করেছিলাম। তা-ও ওদের কেন এখানে পাঠালে? না আসলে তো এইসব ঝামেলা হতো না।”
শাশুড়ি মা বললেন, “আমার কি দোষ! সুরভি অনেকবার কল দিয়েছে। তোর বউ বলল– একটা মানুষ এতবার করে কল দিচ্ছে না গেলে খুব খারাপ দেখায়। তাই আমি রাজি হয়েছিলাম। এমন কিছু হবে জানলে কি ওদের আসতে দিতাম?”
শাশুড়ি মা’য়ের এমন মিথ্যে কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। হতভম্ব গলায় বললাম, “আমি কখন আসতে চেয়েছি?”
“এখন আর মিথ্যে বলে কি লাভ! তোমার তো আর কিছু হয়নি। কিভাবে বুঝবে! যা হয়েছে আমার হয়েছে। আল্লাহ! আর একটা কথা শোনো, মিথ্যে কথার কোন পা হয় না। বেশিদূর হাঁটতে পারে না।”
তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, “এ বাবা! আপনি কথাটা জানেন দেখছি।”
আরিফ চিৎকার করে উঠল। বিরক্ত গলায় বলল, “ঝামেলা করছ কেন? মাথা ঠান্ডা রাখতে দাও। যে করেই হোক এর একটা সমাধান বের করতে হবে।”
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। শ্বশুর আব্বু বাড়িতে ফিরে হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছেন। বেশ কড়া গলায় শাশুড়ি মা’কে নানান কথা শুনিয়েছেন। শাশুড়ি মা বিলাপ করছেন এবং কাঁদছেন। তার কান্না দেখতে আমার বেশ ভালোই লাগছে। কিছু মানুষের একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। সকালে নিজে সেধে আমাদের পাঠিয়ে দিলো আর এখন সব দোষ কাঁধে দিয়ে দিচ্ছে। আরিফকে বলেছে, শ্বশুর আব্বুকেও বলেছে– আমি নাকি হিমির হাত-পায়ে ধরে ওখানে নিয়ে গিয়েছি। খুবই বিরক্তিকর!
আরিফ ফিরল দেরিতে। ক্লান্ত গলায় বলল, “অনেক জায়গায় দেখেছি। কোন ব্যবস্থা করতে পারলাম না। হিমিকে কোর্টে হাজির না করলে কোন উকিলই ওর জামিন করাতে পারবে না। আপাতত থানায় থাকতে হবে।”
শ্বশুর আব্বু বললেন, “তোর কি মনে হয়? এসব কে করতে পারে?”
“জানি না। কিছু বুঝতে পারছি না।”
আমি একটু হাসলাম। আরিফ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “হাসছ কেন তুমি? কি হয়েছে?”
“বেশ ভালো নাটক করতে পারো। তোমার চোখ দু’টো সরল এবং নিষ্পাপ। অপরাধের ছায়া নেই। কিন্তু ওই চোখ পর্যন্তই।”
“এ কথার মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?”
ওর কথার জবাব দিলাম না৷ ঘরে চলে এলাম। আরিফ আমার পেছনে আসলো। কাঁধ ধরে ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল, “কি বলতে চাইছ তুমি?”
“বুঝতে পারছ না? নাকি সব বুঝেও না বোঝার ভান করছ? তোমার রুচি এত খারাপ? তোমার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের একটা মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করতে লজ্জা লাগল না? তুমি কি অবিবাহিত? নাকি এক বাচ্চার বাপ?”
আরিফ লম্বা শ্বাস নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল, “তানজিলা! আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। এমন কিছু বলো না যা কখনো সম্ভবই না। কল্পনাতেও বলো না। কখনোই ক্ষমা করব না। তাছাড়া কিসের ভিত্তিতে তুমি এসব বলছ? কার সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করেছি?”
“জানো না? কার সাথে কি করেছ সে-কথা তুমি জানো না?”
“না জানি না। এই পৃথিবীতে একমাত্র তুমি ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক নেই। কখনো ছিল না। কখনো হবেও না।”
“চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলা যায় তোমাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।”
আরিফ কিছু বলবে এর আগেই শ্বশুর আব্বু তাকে ডাকল। সে কড়া চোখে একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর বেরিয়ে গেল।
রাত বাড়ছে। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি নামবে বোধহয়। বৈশাখ মাস পড়ার পর থেকে প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির সামনে কাঁদা হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসলাম। আমার জীবনে কুৎসিত এক অধ্যায় শুরু হয়েছে। এই অধ্যায় কতটা দীর্ঘ জানা নেই। তবে এর প্রতিটা পাতায় কষ্ট লেপে আছে। এরপর কি হবে? সুরভিকে কে মা’র’ল? কেন-ই বা মা’র’ল? হিমি? নাহ! হিমি কেন এ কাজ করবে? ওর এ কাজ করার কোন উদ্দেশ্য নেই। নাকি আছে? আর কিছু ভাবতে পারলাম না। দু-হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলাম। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। ইনান ঘুমুচ্ছে। দোয়া করছি ও যেন জেগে না ওঠে। জেগে উঠলে ওকে সামলানোর কেউ নেই। আমার অবস্থাও ভালো না। শরীর কাঁপছে। আবছা দৃষ্টিতে চোখের সামনে একটা শার্ট ঝুলতে দেখছি। আরিফের শার্ট। এই শার্টটা ওর খুব পছন্দের। বেশিরভাগ সময় গায়ে পরে থাকে। কিন্তু এটা কোন জায়গা? কোথায় ঝুলছে? এতো আমাদের বাড়ির বাথরুম নয়। তবে কোথায়? সুরভির বাসায়? কি যেন বলেছিল– ‘আরিফেরও এমন অভ্যাস আছে। খুব আপনজন ছাড়া সহজ হয় না। তবে এখন আর হয় না… মাঝে মাঝে তো এমনভাবে কথা বলে মনে হয় আমি…’
চলবে