বাতাস বলে দেয় পর্ব-০৬

0
9

#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

৬.
সকালে ঘুম ভাঙল বেলায়। ততক্ষণে চারদিকে আলোয় ভরে গেছে। জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছে ঘরে। বহুকষ্টে চোখ মেলে তাকালাম। ঘুম জড়ানো গলায় বললাম, “ফ্রিজ থেকে খুব ঠান্ডা এক গ্লাস পানি আনবে? তেষ্টায় বুকের ছাতি ফে’টে যাচ্ছে।”

আরিফ বিছানার একপাশে বসে কাগজপত্র দেখছিল। কাগজ রেখে উঠে দাঁড়াল। সহজ গলায় বলল, “জ্বর আছে নাকি?”

চমকে নিজের কপালে হাত রাখলাম। কপাল পু’ড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য! গায়ে জ্বর, এটা এতক্ষণ বুঝতেই পারিনি। তবে কি আমার স্নায়ু নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছ? আরিফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার কথার জবাব দিলাম না। পাশ ফিরে ইনানকে দেখতে লাগলাম। ছেলেটা ঘুমচ্ছে। আরিফ এগিয়ে এসে আমার কপালে হাত রাখল। কোমল গলায় বলল, “এখনও বেশ জ্বর। বৃষ্টিতে ভিজেছিলে নাকি?”

না সূচক মাথা নাড়লাম। হালকা গলায় বললাম, “আমার এত খেয়াল রাখছ কেন?”

“অসুস্থ থাকলে কখনো অবহেলা করেছি?”

“না। আমি তেমনটা বলিনি।”

“কেমন বলেছ জানতে চাইছি না। ভালো লাগলে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এসো। ওষুধ না খেলে জ্বর পড়বে না।”

“আব্বা আম্মা কোথায়? হিমির কি অবস্থা?”

“আব্বা আর মা থানায় গিয়েছে। আমাকেও বের হতে হবে। অফিসের কাজ আছে। ঘুমচ্ছিলে তাই বের হতে পারিনি।”

দু’হাতে ভর দিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। মাথায় সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীরের অসুস্থতা গুরুত্ব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগতে লাগতে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। সময় নিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে মাথায় পানি দিলাম। শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছে। নাকি এটাও আমার ভুল ধারণা?

আরিফ খাবার বেড়ে বসে আছে। শান্ত ভঙ্গিতে তার সামনের চেয়ারটায় বসলাম। সকালের নাস্তায় আলুভাজি, ডিম পোচ এবং যবের রুটি।

আরিফ বলল, “খাওয়ার চেষ্টা করো। রান্না ভালো হয়েছে।”

“তোমার ব্যবহারে এতটা পরিবর্তন হওয়ার কারণ কি? হঠাৎই এমন স্বাভাবিক আচরণ করছ!”

“কারণ আমি তোমাকে কয়েকটা সত্যি কথা বলতে চাই। কথাগুলো শোনার পর তোমার সামনে দুইটা রাস্তা খোলা থাকবে। হয় সবকিছু মেনে নিয়ে আমার সাথে থাকবে।”

“নয়তো?”

“জানি না। খাওয়া শেষ করো। ইনানকে দুধ গরম করে খাইয়েছি। খেয়ে ঘুম পড়েছে। চট করে উঠে যাবে না।”

আনমনে রুটি ছিঁড়তে লাগলাম। মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। আরিফের ব্যবহার অদ্ভুত লাগছে। সে কি বলতে চায়? এমন কি বলবে যে কথার জন্য শুধু দুইটা পথ খোলা রয়েছে।

বহুকষ্টে প্রায় একটা রুটি শেষ করেছি। আরিফ আমার সামনে দুটো ওষুধ রাখল। স্বাভাবিক গলায় বলল, “ওষুধ খেয়ে নাও। আমার সামনেই খাবে। খেয়ে বিশ্রাম নেবে।”

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা দোলালাম। ঠিক তখনই আমার চোখ পড়ল ওর পরনের শার্টের দিকে। এই শার্ট তো আমার ব্যাগে রাখা ছিল। গতকাল সার্চ করার সময় মহিলা পুলিশ ব্যাপারটা অতো খেয়াল করেনি। আমার স্বামীর শার্ট বলাতেই রেখে দিয়েছে। বাড়ি ফিরে ওটা আর ব্যাগ থেকে বের করিনি। তাহলে কি আরিফ ব্যাগ থেকে শার্ট বের করেছে? কিন্তু এমন কিছু হলে তো ওর আমাকে প্রশ্ন করার কথা। নাকি সব জেনে-বুঝেই করছে?

আরিফ বলল, “কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে না থেকে ওষুধ খাও।”

ওষুধ দু’টো হাতে নিতে নিতে বললাম, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

“অফিসে যাচ্ছি। সেখান থেকে থানায় যাব।”

“ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে।”

আরিফ বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, “সদর দরজা লাগিয়ে দিয়ে বসো। মায়ের আসতে দেরি হবে।”

এলোমেলো পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা লাগালাম। ঘরে এসে ব্যাগ হাতড়াতে দেখি- শার্টটা ব্যাগেই রাখা আছে। চমকে উঠলাম। এটা এখানে ব্যাগে থাকলে আরিফের পরনের শার্ট কার? ওর কাপড়চোপড়ের ব্যাপারে আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না। একই রকমের দুটো শার্ট নেই। তাহলে? এমন কি হতে পারে গোটা ব্যাপারটাই আমার ভুল ধারণা? শার্টটা আরিফের নয়, অন্য কারো। একই রকমের হওয়ার কারণে গুলিয়ে ফেলেছি।

শার্টটা হাতে নিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখলাম। নাকে কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকলাম। শার্টের কাপড় পুরনো হয়নি। বেশ নতুন মনে হচ্ছে। খুব বেশি হলে চার পাঁচবার ধোয়া হয়েছে। শার্টের গন্ধটা আরিফ যে পারফিউম ব্যবহার করে সেই পারফিউমের কিন্তু এতে ওর গায়ের গন্ধ নেই। প্রতিটা মানুষের গায়ের গন্ধ আলাদা। তাছাড়া আরিফ খুব ঘামে। একটু রোদে বের হলেই ওর শরীর ঘেমে যায়। গরম পড়ে গেছে, শীতকাল হলে অন্য কথা ছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আলনা থেকে গতকাল যে শার্ট পরেছিল ওটা বের করলাম। দুটোর গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারলাম– আমার সন্দেহই ঠিক। কেউ ইচ্ছে করে এমন করেছে যেন আমি আরিফকে ভুল বুঝি।
বাথরুমে পাওয়া কালচে শার্টটা থেকে শুধু পারফিউম গন্ধ আসছে। গন্ধটা বেশ কড়া। ধুয়ে দিয়ে এত গন্ধ থাকা উচিত না। মানে শার্ট ধোয়া হয়নি। তাহলে ঘামের গন্ধ নেই কেন? তাছাড়া একটু আগে আরিফের গায়ে এই শার্টটা দেখলাম। কিন্তু কেউ কেন এমন করবে?

মোবাইল বের করে আরিফকে কল দিলাম। রিং হলো কিন্তু রিসিভ করল না। পরপর বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম। প্রতিবার এই অবস্থা।
বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলাম। ইনান উঠে গেছে। শার্ট দু’টো আলমারিতে রেখে ইনানকে কোলে নিলাম। আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছে। বোধহয় জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে।

দুপুরের পরপর শাশুড়ি মা কল দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “তোমার জ্বর কমেছে?”

“জ্বর নেই। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। তবে মাথায় হালকা ব্যাথা ব্যাথা করছে।”

“ওহ আচ্ছা। পুলিশের সাথে কথা বলো। উনারা কিছু বলতে চান।”

কয়েক মুহূর্ত পর রিনরিনে মিষ্টি গলা শোনা গেল। মেয়েটা বেশ আন্তরিক সুরে বলল, “শরীর ভালো থাকলে থানায় আসেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আপনাকে প্রয়োজন। আর খুব বেশি খারাপ লাগলে বলেন আমি আসছি।”

“সমস্যা নেই। আমি আসতে পারব।”

“ঠিক আছে। দ্রুত আসবেন।”

জ্বর ছেড়ে গেছে। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। ওষুধের প্রভাবে বেশ ভালো লাগছে। শুধু শরীর ভালো লাগছে এমন নয়, মনটাও বেশ হালকা লাগছে। ওই শার্ট আরিফের না হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। আমি আমার সংসার ভাঙতে চাই না। কিন্তু আরিফ তখন কি কথা বলতে চেয়েছিল? ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করলাম না। যখন বলবে তখন না হয় শুনব। বোরকা পরে হিজাব বাঁধলাম। ইনানকে তৈরি করে নিয়ে সদর দরজায় তালা লাগালাম। হিমির জন্য খারাপ লাগছে। মেয়েটার আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল।

ইনান তার দাদার কোলে। শ্বশুর আব্বু থানার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে এটা-ওটা দেখাচ্ছে। আমি থানার ভেতরে ঢুকলাম।

দারোগা সাহেব চেয়ারে বসে আছেন। তার মুখ গম্ভীর। টেবিলের সামনে তমা এবং রুবেল দাঁড়িয়ে আছে। তারা দু’জন একটু সরে দাঁড়িয়েছে। দারোগা সাহেব ইশারায় চেয়ার দেখালেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। আশা করছি খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিবেন।”

অল্প হাসলাম। জড়ানো গলায় বললাম, “নিশ্চয়ই। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”

“গতকালকের ঘটনা তাই এত দ্রুত ভুলে যাওয়ার কারণ নেই। যা-ই হোক আপনারা সুরভি বাসায় যাওয়ার পর সেখানে কি আর কেউ ছিল?”

“না সেখানে আর কেউ ছিল না। থাকলেও আমার চোখে পড়েনি।”

“সুরভি দরজা লাগিয়েছিল? একটু ভেবে বলুন। গতকাল বলেছিলেন– মকবুল সাহেব এবং বাকি দু’জন হুট করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। আপনি তখন সাহায্যের জন্য কল দিতে যাচ্ছিলেন। কেউ তার বাসার দরজা কেন খোলা রাখবে? ব্যাপারটা লজিকবিহীন হয়ে গেল না?”

চুপ করে রইলাম। তমা বললেন, “ভুল করতে পারে। হয়তো সুরভি দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল।”

দারোগা সাহেব হাত নেড়ে বললেন, “চুপ করো। উনাকে বলতে দাও।”

সহজ গলায় বললাম, “সুরভি আপা বলেছিলেন– উনি বাড়ির মালিকেও দাওয়াত দিয়েছেন। এক্ষুনি চলে আসবে তাই দরজা লাগানোর প্রয়োজন নেই।”

“বাড়ির মালিক বলতে মকবুল সাহেব?”

“বোধহয় উনিই হবেন।”

“রুবেল, মকবুল সাহেবকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করো।”

রুবেল পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করল। দারোগা সাহেব সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “আপনার স্বামীর সাথে সুরভির কোন ধরনের অ’বৈ’ধ সম্পর্ক ছিল? এ ব্যাপারে আপনি কী কিছু জানেন? অথবা এমন কিছু সন্দেহ করেন?”

“তেমন কিছু ছিল না। আর থাকলেও আমি তা জানি না।”

“হিমিকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সে শুধু একটা কথাই বলছে– খু’নের ব্যাপারে কিছু জানে না। এমনটা হতে পারে কী– যে সে আপনাকে বাঁচাতে চাইছে?”

“হিমির সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। খুবই ভালো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে আমার জন্য নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবে।”

“আপনার শাশুড়ির সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?”

বিরক্ত গলায় বললাম, “এই প্রশ্নের সাথে কে’সের কি সম্পর্ক? দয়া করে এমন অবান্তর প্রশ্ন করবেন না।”

“রেগে যাচ্ছেন কেন? আমরা সবাই জানি শাশুড়ি বউয়ের সম্পর্ক মসৃণ হয় না। তাছাড়া আপনার কি মনে হয় তদন্ত এতো সহজ?”

“আমার কিছু মনে হয় না। আর কি জানতে চান বলুন।”

দারোগা সাহেব হাসলেন। বরফ শীতল গলায় বললেন, “হিমি বলল– আপনার শাশুড়ি আপনাদের ওখানে যাওয়ার জন্য জোর করেছিল। উনার কথায় গেলেন। বন্ধ ঘরে খু’ন হলো আর কেউ কিছু জানেন না? অদ্ভুত ব্যাপার! আরও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আপনি আপনারা আমাকে এ কথা বিশ্বাস করতে বলছেন।”

কি বলব বুঝতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম। শাশুড়ি মা এতক্ষণ বাইরে ছিলেন। ভেতরে এসে বললেন, “তানজিলা, আমরা বাড়িতে যাচ্ছি। ইনানকে নিয়ে যাচ্ছি। কাজ শেষ হলে তুমি চলে এসো।”

“ঠিক আছে আম্মা। সাবধানে যাবেন।”

শাশুড়ি মা চলে গেলেন। রুবেল বলল, “উনি সত্যি কথা বলেছেন– মকবুল সাহেব বলল- সুরভি তাকেও দাওয়াত দিয়েছিল।”

দারোগা সাহেব আমার দিকে তাকালেন। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “সুরভির ব্যাপারে আমরা খোঁজ খবর করছি। লা’শ পো’স্ট’ম’র্টে’মের জন্য পাঠানো হয়েছে। খুব দ্রুত রিপোর্ট চলে আসবে। তারপর পুরোদমে তদন্ত শুরু হবে। আগামী বৃহস্পতিবার হিমিকে কোর্টে তোলা হবে, সেদিন রি’মা’ন্ডের জন্য আবেদন করা হবে। আজ রবিবার। আপনাদের হাতে দু’টো দিন সময় আছে। কিছু করলে বলে দিতে পারেন।”

“এক কথা কতবার শুনতে চান? কিছু না করলে কী বলব?”

“খোঁজ নিয়ে জানলাম স্বামীর সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। আরিফ সাহেব একদিন সুরভির থেকে খাবার চেয়ে খেয়েছিল। এই ব্যাপারটা নিয়ে মনমালিন্য চলছে না তো?”

“ঘুরে ফিরে একই কথা বলছেন! উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।”

“ঠিক আছে। আপনি এখন যেতে পারেন। প্রয়োজনে আবার ডাকব। ওহ হ্যাঁ! আপনার শরীর এখন কেমন আছে?”

“ভালো আছে।”

হিমির সাথে দেখা করে থানা থেকে বের হলাম। একদিনের মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে। সে আমার দেখে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। ভেজা গলায় বলল, “বিশ্বাস করো ভাবী, আমি কিছু জানি না। ইনানকে কোলে নিয়ে খাবার খাচ্ছিলাম। হঠাৎই উনি মেঝেতে পড়ে গেলেন। এরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না। তুমি তো আমার সাথে ছিলে, তুমি বলো আমি কেন এমন করব? আমি তো উনাকে চিনতামও না।”

কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন কয়েকটা বাক্য বলে ওকে স্বান্তনা দেওয়া চেষ্টা করেছি। কতটা বুঝেছে জানি না। তবে চোখ মুছতে দেখেছি।
আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে। থানার সামনে রিকশা নেই। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম না। হাঁটতে শুরু করলাম। থানার এই পথটা বেশ নির্জন। আশেপাশে দোকানপাট নেই। খানিকটা এগিয়ে বড় রাস্তা শুরু হয়েছে। সেখানেও তেমন দোকানপাট নেই।

হাঁটছি হঠাৎই আমার সামনে অল্প বয়সী দু’টো ছেলে এসে দাঁড়াল। দু’জনের গলায় শেকলের মতো চেন। মাথার চুল উসকোখুসকো। খাটো ছেলে পিচ করে পানের পিক ফেলল। টকটকে লাল পিক। পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে হাসল। অদ্ভুত গলায় বলল, “ঝামেলা করে লাভ নেই। ব্যাগটা আমাদের হাতে দিয়ে ফুটুন এখান থেকে।”

“ব্যাগ দেব মানে? আমার ব্যাগ তোমাদের কেন দেব?”

অন্য ছেলেটা বলল, “আমরা আপনার বাপ লাগি, তাই দেবেন। ঝামেলা করবেন না। মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দিই না। ভালোয় ভালোয় ব্যাগটা দিয়ে চলে যান।”

“কখনোই না। দিনে-দুপুরে ছিনতাই করতে এসেছ? সাহস তো মন্দ না।”

খাটো ছেলেটা বলল, “এই রোহান, ভালো কথা শুনবে না। চিৎকার করার আগে কাজটা করে ফেল।”

রোহান এগিয়ে এসে ব্যাগ ধরতে যাবে ঠিক তখনই কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিলো। চমকে বাম পাশে তাকালাম। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার পরনে কালো বোরকা, শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকা। হাতের আঙুল এবং চোখ দেখা যাচ্ছে। সে বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “থানার তিনশ মিটারের ছিনতাই করতে এসেছেন? সাহস তো মন্দ না।”

রোহান তেঁ তেঁ উঠল।

“এটা আমাদের ব্যাপার। ঝামেলা করিস না। চল সর এখান থেকে।”

“আপনারা চলে যান। ঝামেলা করতে চাই না।”

ছেলে দু’টো গেল না। রোহান দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “আজকে প্রথমবারের মতো মেয়ে মানুষের গায়ে হাত দিতে হচ্ছে।”

বলেই মেয়েটার দিকে হাত বাড়াল। মেয়েটা খুব সহজে তার হাত মুচড়ে দিলো। কাঁধের পাশে হাত দিয়ে খুব জোরে আ’ঘা’ত করল। রোহান ব্যাথায় কুঁকড়ে মাটিতে পড়ে গেল। অন্য ছেলেটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “এতটুকু মেয়ে হয়ে ভাইয়ের গায়ে হাত দিস। তোকে আজ শে’ষ করে ফেলব।”

মেয়েটা বোধহয় হাসল। কারণ তার চোখ ছোট হয়ে গেছে। মুহুর্তের মধ্যে অন্য ছেলেটার নাভির বেশ নীচে পা দিয়ে আ’ঘা’ত করল। কোমর থেকে বেল্ট খুলে পরপর বেশ কয়েকটা বাড়ি মা’র’ল।
রোহান ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে বেশ কাতর গলায় বলল, “ভাই, চল। ঝামেলা করা যাবে না। লোকজন চলে আসবে।”

ছেলে দু’টো দৌড়ে পালিয়ে গেল। মেয়েটা কোমরে বেল্ট পরতে পরতে বলল, “আপনি ঠিক আছেন?”

বিস্মিত গলায় বললাম, “আমি ঠিক আছি। তুমি ওদের এভাবে?”

“ওদের না মা’র’লে ওরা আমার গায়ে হাত দিতো। যাইহোক কোথায় যাবেন? একা যেতে পারবেন?”

কিছু বলার আগে আমার মোবাইল বেজে উঠল। আরিফ কল দিয়েছে। কল রিসিভ করতে বলল, “থানা থেকে বের হয়েছে? কোথায় তুমি?”

“থানার সামনের রাস্তায়। কেন কি হয়েছে?”

“হেঁটে চলে এসে বড় রাস্তায় দাঁড়াও। আমি আসছি।”

কল কেটে দিলাম। মেয়েটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। একটু হেসে বললাম, “চলে যাব। আমি হাসবেন্ড আসছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

সে তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে আমার হাতে দিলো। শান্ত গলায় বলল, “ঠিক আছে। নিজের যত্ন নিবেন। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগল।”

বলেই চলে যাচ্ছিল। পেছন ডেকে বললাম, “তোমার নাম কি?”

মেয়েটা অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “আমার নাম নাইমা।”
বলেই থানার দিকে হাঁটতে শুরু করল। বড় বড় পা ফেলে হাঁটছে। মুহূর্তেই বেশ অনেক দূরে চলে গিয়েছে।

বড় রাস্তায় এসে মিনিট খানেক দাঁড়ানোর পর আরিফ এলো। রিকশা নিয়ে এসেছে। কিছু না ভেবে রিকশায় উঠে বসলাম।
আরিফ বলল, “তোমার জ্বর নেই তো?”

“না নেই। শরীর ভালো আছে।”

“সকালে যে কথা বলেছিলাম, ওটা শেষ করতে চাই। বাড়িতে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলব।”

“সমস্যা নেই।”

রিকশা বেশ জোরে চলছে। গায়ে বাতাস লাগছে। বাতাস বেশ শীতল। হালকা শীত শীত লাগে। মেঘ ডাকছে। বেশ চমৎকার আবহাওয়া। মন ভালো করে দেওয়ার মতো চমৎকার। পাশে পছন্দের মানুষ। কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার! তবে আমি তা অনুভব করতে পারলাম না।

চলবে