বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0
273

#বাবুইপাখির অনুভূতি
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৪৯+৫০+৫১
_________________

‘ তুমি কি এখনো অথৈকে ভালোবাসো ভাইয়া?’

অনেকক্ষণের হতাশা আর নীরবতা কাটিয়ে কথাটা বলে উঠল আহি নীরবকে। আর আহির কথা শুনে কিছুটা হকচকিয়ে উঠলো নীরব। সে ভাবে নি আহি এই মুহূর্তে এমন কিছু বলবে। নীরবকে হতাশা ভরা চোখে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারো বলে উঠল আহি,

‘ কি হলো ভাইয়া, তুমি কিছু বলছো না কেন?’

পুনরায় আহির কথা শুনে নীরব তার বইটা বন্ধ করে শীতল দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ তুই কি এই রাতের বেলা এটা শুনতে আমার রুমে এসেছিস?’

নীরবের কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করে বললো আহি,

‘ তুমি না বড্ড কথা প্যাচাও ভাইয়া আমার প্রশ্নের হ্যাঁ বা না উওরটা দিলেই তো হয়।’

উওরে নীরব আহত দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ তুই আমায় ভালোবাসিস এখনো?’

এবারের কথা শুনে আহি সত্যি সত্যি বিস্মিত। তাঁর কথার প্রতি উওরে এমন কিছু বলবে নীরব এটা সত্যি কল্পনার বাহিরে ছিল তার। আহিকে চুপ থাকতে দেখে আবারো বলে উঠল নীরব,

‘ আমি তোকে হার্ড অথবা কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাটা বলি নি তোর প্রশ্নের পাল্টা উওর দিয়েছি জাস্ট।’

‘ আচ্ছা আমি যদি তোমায় বলি অথৈকে ভুলে আমায় ভালোবাসতে তুমি কি ভালোবাসবে ভাইয়া?’

নীরব স্থির দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ ভালোবাসাটা সবার জন্য আসে না বুঝলি, আর যার জন্য আসে সে বুঝতে পারে না যেমন তুই আমায় ভালোবাসিস কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। ভালোবাসার জন্য সর্বপ্রথম যেটার প্রয়োজন সেটা হলো হৃদয়ের অনুভূতি। তোর হয়তো আমার প্রতি এমন অনুভূতি ছিল কিন্তু আমার তো নেই আমি চাইলেও তোকে ভালোবাসতে পারবো না। কারন আমার কোনো কালেই তোর প্রতি সেইরকম কোনো অনুভূতি ছিল না। আমি ছোট বেলাই থেকেই তোকে আমার ছোট বোনের নজরে দেখেছি এখনও দেখি। কিন্তু ভালোবাসাটা হবে না, লাস্টের কথাটা খুব অনুশোচনা নিয়েই বললো নীরব’।

নীরবের কথা শুনে কিছুক্ষন স্বচ্ছল দৃষ্টিতে নীরবের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠ নিয়েই বললো আহি,

‘ হুম জানি। আমি এই কথাগুলো শোনার জন্য আসে নি ভাইয়া আমি শুধু এতটুকুই জানতে চাই তুমি কি অথৈকে এখনো ভালোবাসো কি না। কিন্তু তুমি তো?’

‘ আমায় খারাপভাবে নিস না আহি, আসলে কিছুদিন যাবৎ মাথাটা ঠিক নেই। সহজ জিনিসগুলো আমার কাছে খুব জটিল মনে হয়। ‘অথৈ’ নামটা আমি ভুলতে চাই, কারন অথৈ আমার জীবনের এক তরফার এক গল্প৷ কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছি না তাই এত জটিলতা।’

‘ আচ্ছা ধরো, যদি অথৈ তোমার লাইফে আবার চলে আসে তাহলে কি তোমার জটিলতা কমে যাবে ভাইয়া?’

আহির এবারের কথা শুনে নীরব বিস্ময়কর চাহনী দিয়ে বললো,

‘ তোর কথার অর্থ বুঝলাম না আহি?’

নীরবের কথা শুনে বিষন্ন আহি। বিষন্নতা নিয়েই বললো সে,

‘ আমি এমন জটিল কিছু বলি নি যে তুমি বুঝতে পারছো না। তুমি বড্ড বদলে গেছো ভাইয়া?’

শুঁকনো হাসলো নীরব তারপর বললো,

‘ সত্যি খুব বদলে গেছি তাই না।’

‘ তা নয় তো কি নিজের কি অবস্থা করেছো বলো তো, চুলগুলো এলেমেলো, শার্টের বোতামগুলো এলেমেলো। চোখে মুখের কি অবস্থা। যাই হোক আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। কাল তোমায় একটা জায়গায় নিয়ে যাবো তৈরি থেকো বিকেল ৫ঃ০০টায়।’

বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আহি। আহিকে উঠতে দেখে বললো নীরব,

‘ কোথায় যাবো?’

‘ তা না হয় গেলেই দেখবে পাবে শুনো নিজেকে পরিপাটি করে নিও।’

বলে মাথাটা নিচু করে বললো আহি,

‘ সরি ভাইয়া।’

উওরে নীরব শীতল ভেজা কন্ঠে বললো,

‘ হঠাৎ সরি কেন?’

বিনিময়ে আহি তাঁর হাতে করে আনা লাল ডাইরিটা বের করে নীরবের টেবিলের উপর রাখলো যেটা এতক্ষন সে লুকিয়ে রেখেছিল। টেবিলের ওপর ডাইরি দেখে বেশ হতভাগ হয়ে বললো নীরব,

‘ এটা কিসের?’

‘ এটা তোমার জন্য। পড়ে দেখো তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।’

‘ আমি কোনো কালেই ডাইরি পড়ি না এটা তুই জানিস না।’

‘ জানি তারপরও দিলাম। একবার পড়ে দেখো একজন মানুষের তার ভালোবাসার মানুষটার প্রতি অনুভূতি লেখা আছে। পড়লে তোমার ভালো লাগবে। আজ তবে আসি কাল টাইম মতো তৈরি থেকো তোমার জন্য ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ আছে।’

বলেই পিছন ঘুরে হাঁটা শুরু করলো আহি। নীরব আহির কাজে ভীষণই অবাক। না চাইতেও কৌতুহলী সে লাল ডাইরিটা হাতে নিলো কয়েক পৃষ্ঠা উল্টাতেই ভিতরে কথাগুলো দেখতেই চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। সে খুশি হয়ে আহির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ আহি?’

সাথে সাথে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়লো আহি, সে জানতো নীরব তাকে ডাকবে। তাই খুশি মনে পিছন ঘুরে বললো আহি,

‘ শোনো ডাইরিটা পড়ার জন্য তোমায় শুধু আজকের রাতটুকুই দিতাম। কাল সকালে ডাইরিটা আবার আমায় ফেরত দিয়ে দিবে অবশ্য না দিলেও চলবে এটা তোমারই আর হ্যাঁ সময় মতো তৈরি থেকো কিন্তু ঠিক বিকেল পাঁচটা।’

‘ আমরা যাবোটা কোথায় আহি?’

‘ বললাম তো গেলেই দেখতে পাবে। আর শোনো নিজের অনুভূতিগুলো গুছিয়ে রেখো কাল কাজে আসবে।’

বলেই আর দু’মিনিট না দাঁড়িয়ে চলে গেল আহি। আর নীরবের চোখে মুখে প্রশান্তির হাসি। আজ বহুদিন পর যেন নিজেকে আবার ফিরে পেতে চলেছে নীরব। সে তো ভাবতেই পারে নি সে যাকে কয়েকদিন আগেই ভালোবেসেছে সে কিনা তাকে না দেখেই আরো আগে থেকেই ভালোবাসে।’

নীরব খুশি মনে ডাইরির প্রতিটা পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো।’ তাঁর পাশে থাকা জানালার কার্নিশ বেয়ে আসছে রাতের মৃদু আলো। সাথে খোলা আকাশের তাঁরার জ্বল জ্বল হাসি। সে ভাবে নি অথৈই যাকে ভালোবাসে সেই মানুষটা সে নিজেই।’

এই ডাইরিটা লুকিয়ে লুকিয়ে অথৈদের বাড়ির থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিল আহি। মুলত নীরবকে দেখানোর জন্যই কারন সেও চেয়েছিল অথৈ যে ঠিক নীরবকে কতটা ভালোবাসে সেটা নীরবও জানুক। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সিঁড়ি নিচে নামলো আহি।’

_____

মাঝ রাতে ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে বাহিরে। জানালার সাদা পর্দা ভেদ করে অল্পস্বল্প বৃষ্টির পানি আসছে ভিতরে। কিন্তু সেদিকে আপাতত আদ্রিয়ানের খেয়াল নেই। সে চুপচাপ বসে আছে তাঁর নিজ রুমেই থাকা টেবিল জুড়ে। তাঁর সামনে আজও বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে শুভ। আজ হসপিটাল থেকে ফিরতে একটু লেট হয় শুভর। যার কারনে ক্লান্ত হয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।’

টেবিলের উপর থাকা ল্যাম লাইটের মৃদু আলোতে বসে চুপচাপ কিছু একটা ভাবছে আদ্রিয়ান। আজ আহি নেই তাঁর সেকেন্ড রাত চলছে, মনে ভিতর অজানা ভয়,অনুভূতি,ক্ষোভ,মান-অভিমান সবকিছুই উঁকি মারছে আদ্রিয়ানের। আকাশে মেঘের গর্জন চলছে খুব আদ্রিয়ান আনমনেই তাকালো আকাশ পথে। এই বৃষ্টি বার বার আদ্রিয়ানকে মনে করিয়ে দেয় আহিকে। শ্রীমঙ্গলের সেই রাত, ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে সেই ল্যামপোস্টের দুরত্বে বেঞ্চে বসে তাঁকে নীরব ভেবে জড়িয়ে ধরার মুহূর্ত, ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে দুটো আঘাত পাওয়া। এক আঘাত তাঁর মানসিক যন্ত্রনার কারন, আর দুই শারীরিক আঘাত। তবে শারীরিক সেই আঘাত আদ্রিয়ানকে কষ্ট দেওয়ার চেয়েও আনন্দ দিয়েছিল বেশি যেই আঘাত বারংবার আহিকে জড়িয়ে ধরার মুহূর্ত সৃষ্টি করে দিয়েছে তাঁকে, বার বার জাগিয়ে তুলেছে তাঁর অনুভূতি, তাঁর বুকের স্পন্দন,ধীরে ধীরে কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে তাঁর ভয়, বাবা মাকে হারানোর ক্ষত আরো কত কি?’ আহির সাথে কাটানোর প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা স্মৃতি সবকিছুই এঁকে এঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ান নিমিষেই তার চোখ দুটো বুঝিয়ে নিল, কিন্তু তাতেও যেন শান্তি মিললো না আবারো চোখ খুলে ফেললো চটজলদি সে। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে আদ্রিয়ানে, যেই যন্ত্রনা আদ্রিয়ানকে ভিতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।’

কাল সে চলে যাবে? আবার কবে দেখা হবে আহির সাথে জানা নেই। আদ্রিয়ান চাইছে যাওয়ার আগে নিজের সেই অনুভূতিগুলো আর একবার প্রকাশ করতে যদিও সেদিন তেমন কিছুই বলা হয় নি। হোক না আহি আর একবার তাঁকে ব্যর্থতার সুখ দিলো। এটাই লাস্ট এরপর আর সে জ্বালাবে না আহিকে। এই কয়দিনে এত কাছাকাছি থেকেও কি আহির তাঁর প্রতি বিন্দুমাত্র অনুভূতি সৃষ্টি হয় নি, একবার তাঁর সাথে সারাজীবন থাকার প্রতিশ্রুতি জন্মায় নি। যদি জন্মে থাকে তাহলে নেক্সট যখন দেখা হবে তার সাথে আহির, তখন হয়তো আর পাঁচটা রঙিন উপন্যাসের মতো তাদের উপন্যাসের শেষপাতাটাও রঙিন হবে নয়তো ব্যর্থতাই হবে তাদের উপন্যাসের মূল মন্ত্র। আর ভাবলো না আদ্রিয়ান, কিন্তু কিভাবে সে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করবে? মুখে করা যাবে না, কারন সে গুলিয়ে যাবে আর নয়তো সময়ে কুলাবে না। হঠাৎই আদ্রিয়ানের মনে পড়লো আহির সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের কথা। ভরা বিয়ের আসরে চিঠি লেখার ঘটনা, আদ্রিয়ান ভেবে নিলো সেও তাঁর অনুভূতি শুঁকনো চিঠির খামের আড়ালেই জানাবে। যেই ভাবা সেই কাজ আদ্রিয়ান কিছু একটা ভেবে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। চলে যায় সিঁড়ি বেয়ে নিচে, আনমনেই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল বুকশেলফের কাছে। একটা মোটা খাতা বের করে আনমনেই বসলো গিয়ে বুকশেলফের পিছনে থাকা টেবিল চেয়ারের কাছে। সেখানে থাকা ছোট্ট ল্যাম লাইটটা জ্বালিয়ে গুছিয়ে নিজের অনুভূতিগুলো লিখতে লাগলো আদ্রিয়ান। বাহিরে মুসল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে, আকাশটাও হয়ে আছে মেঘাচ্ছন্ন, হিমশীতল বাতাস বইছে চারপাশে আর এসবের ভিড়েই নিজের অনুভূতিগুলো সাজাতে ব্যস্ত আদ্রিয়ান।’

কে জানে এই অনুভূতিগুলো আধও আহি বুঝতে পারবে কি না?’

____

ভোরের গা ছমছম করা বাতাস বইছে চারপাশে। বেলকনিতে জমে আছে এখনো বৃষ্টির পানি, বেলকনিতে থাকা গাছের প্রতিটা পাতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে জমে আছে বৃষ্টির পানি। ফুলের পাপড়ি জুড়েও ভাসছে বৃষ্টির পানি। বেলকনির দরজা খোলা থাকায় বাতাসে শরীর শিউরে উঠছে আহির। গায়ে জড়িয়ে থাকা কাঁথাটাকে ঘুমের ঘোরেই আর একটু কষা করে জড়িয়ে নিলো সে।

কাল বৃষ্টি পড়ায় বৃষ্টি দেখতে বেলকনির দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল আহি। যখন থেকে জানতে পেরেছে সে, অথৈও নীরবকে ভালোবাসে তখন থেকেই নিজের বুকের ওপর যেন একটা ভাঁড়ি পাথর জমে ছিল। নীরবকে ডাইরিটা দেওয়ার পর থেকে সে ভাড়ি ভাবটা যেন একটু কমেছিল তাঁর। আজ হয়তো পুরো দমে কমে যাবে। কিন্তু তারপরও কোথাও না কোথাও একটা শুন্যতা টের পাচ্ছিল আহি। শুধু শুন্যতা ঠিক কার জন্য এটাই বুঝতে পারছিল না সে। কারন কাল আদ্রিয়ানকে ভীষণভাবেই মনে পড়ছিল আহির। নীরবকে সে কোনোকালেই পাবে না এটা যেমন সত্য তেমনি তাঁর জন্য এমন একজন আছে যে সত্যিকার অর্থে তাঁকে ভালোবাসে। যে নীরবের থেকে ব্যর্থতা পাওয়ার পর থেকে তাঁকে সামলিয়েছে। তাঁর মনখারাপের সময়ে তাঁর পাশে থেকেছে, তাঁকে বাঁচাতে নিজে আঘাত পেয়েছে।’
এইরকম হাজারো কথা ভাবছিল আহি। আহি তো পুরোই অবাক কারন যে রাতগুলোতে নীরব ছাড়া কেউ আসতো না সেই রাতগুলোতেই সে নীরবের জায়গায় আদ্রিয়ানকে নিয়ে ভাবছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিলো মনেই নেই আহির। ঘুমের চাপটা একটু বেশি থাকায় বেলকনির দরজা আঁটকাতেও ভুলে গিয়েছিল সে।’

বর্তমানে,

গভীর ঘুমে মগ্ন আহি। হঠাৎই তাঁর সেই রাতের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে যে রাতে বৃষ্টির মধ্যে আদ্রিয়ান আহিকে তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করতে এসেছিল। সে হাত জড়ো করে বলেছিল তাঁকে,

‘ তোমায় আমাকে ভালোবাসতে হবে না আহি, আমি তোমায় ভালোবাসবো তুমি শুধু আমার সাথে থাকবে, আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই, আই নিড ইউ।’

পর পর কথাগুলো মনে পড়তেই হঠাৎই মনে পড়লো সেই দৃশ্যের কথা যখন তাঁকে সাহায্যের জন্য নিজের মাথায় আঘাত পেয়েছিল আদ্রিয়ান। সেই দৃশ্যের কথা ভাবতেই থরথর করে কেঁপে উঠলো আহি। ফট করেই চোখ খুলে তাকালো আহি, আশপাশ থেকে বোঝার চেষ্টা করলো আসলে কোথায় আছে সে, এক মূহুর্তের জন্য হলেও আঁতকে উঠেছিল আহি। আদ্রিয়ানের নিথর দেহের কথা ভাবতেই শরীর যেন বারবার কেঁপে উঠছিল। মোবাইলটা অন করতেই দেখলো আহি ছয়টাও বাজে নি তখন। ফট করে এমন এক স্বপ্ন কেন দেখলো ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না আহি। তাঁর মনে হলো একবার আদ্রিয়ানকে ফোন করা উচিত কিন্তু এত সকালে ফোন করে কি বলবে সে তাই আর করা হয় নি। কল করতে নিয়েও সংকোচে আবার করলো না। ফোনটাকে বিছানার ওপর রেখেই অগ্রসর হলো সে ওয়াশরুমের দিকে। আজ আর ঘুমাবে না কেন যেন অজানা এক ভয় এসে গ্রাস করলো তাঁকে। তবে আজ একবার আদ্রিয়ানের সাথে দেখা করার কথা ভাবলো আহি?’ সময় হলে ঠিক যাবে। এমনিতেও ফিরে এসে সেইভাবে কথা হয়নি তাদের। জোরে এক নিশ্বাস ফেললো আহি। মনটা কেমন যেন করে উঠলো আচমকা?’

.
.

আজ বহুদিন পর ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো আহি। আর কিছুদিন পরই তাঁদের ফাস্ট ইয়ারের এক্সাম। কিন্তু পিপারেশন বেজায় খারাপ। এসব ভাবতে ভাবতেই ভার্সিটি পৌঁছে গেল আহি। ভার্সিটি ঢুকতেই দেখা মিললো রিনি আর অথৈর। অনেকদিন পর অথৈকেও ভার্সিটি দেখে তাঁর ভালো লাগছে। খুশি মনে এগিয়ে গেল আহি ওদের দিকে। তারপর রিনি আহি নিজেদের ক্লাসে আর অথৈ নিজের ক্লাসের দিকে অগ্রসর হলো।’

আজকের মতো ভার্সিটি শেষ করে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো আহি। তবে যাওয়ার আগে অথৈকে বলেছে সে, আজ বিকেলে যেন একবার বের হয় তাঁর সাথে। অথৈও রাজি হয়ে যায়, রিনিকে বলেছিল কিন্তু রিনির কাজ আছে বলে যেতে পারবে না সে। আজ ভার্সিটিতে অথৈর সাথে নীরবের দেখা হয় নি, হয়তো নীরব আজ আসে নি। অবশ্য অথৈ এতে একটু সাচ্ছন্দ্য ফিল করেছে না জানি নীরবের মুখোমুখি হলে কেমন অবস্থা হবে তাঁর। অথৈ মোটেও চায় না নীরবের সাথে তাঁর দেখা হোক। কারন দেখা হলেই তো সেই বুক চিঁড়ে কান্না আসবে যেটা মোটেও করতে চায় না অথৈ।’

তারপর বলতে না বলতেই ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লো বিকেল পাঁচটার কাঁটায়।’

সুন্দর এক নদীর কিনারায় পাশে বেঞ্চে বসে আছে অথৈ। সামনেই যতদূর চোখ যায় শুধু পানি, তবে বেশ কয়েক কিলোমিটার দুরত্ব রয়েছে অগণিত গাছপালা। যেগুলো একদম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে অথৈর দিক থেকে। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন গাছ দিয়ে তৈরি বিশাল পাহাড়ের ছড়াছড়ি। অথৈর দৃষ্টি সেদিকেই, আকাশটাও আজ একদম সচ্ছল পরিষ্কার, কাল রাতে যে বৃষ্টি হয়েছিল তাঁর ছিটেফোঁটা নেই এখন, নদীর ঢেউয়ের তীব্রতায় একটা দুটো নৌকা যাচ্ছিল বেশ দুরত্ব নিয়ে।’

তাদের এপারেও টুকিটাকি রয়েছে গাছপালা। অথৈ যেখানে বসে আছে তাঁর থেকে কিছুরা দূরেই বিশাল একটা গাছ। গাছের কিছু পাতা ঝুঁকে আছে নদীর দিকে। অথৈ পুরো জায়গাটাই চোখের ফ্রেমে বন্দী করে নিচ্ছে। হয়তো বাসায় গিয়ে আঁকবে সে।’

অন্যদিকে তার থেকে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে শুকনো মাটির রাস্তায় পায়চারি করছে আহি। চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ তাঁর। চারপাশের বাতাসে অথৈ আর আহির দুজনেরই চুল উড়ছে ভীষণ। আহি পায়চারি করছে সাথে কিছুক্ষন পর পর নিজের হাতের ঘড়িটাও দেখছে। অথৈ বুঝতে পারছে না আহি কিসের জন্য এমন করছে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তাতেও এই মুহূর্তে মন সায় দিচ্ছে না ছোট্ট দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো অথৈ। ইদানীং সবকিছুতেই যেন দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে তাঁর।’

এমন সময় হতভম্ব হয়ে দূর সীমানা থেকে কেউ একজন দৌড়ে এদিকেই আসছিল। যদিও ছেলেটির মুখটা বোঝা যাচ্ছিল না তখন। আহি বর্তমানে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। আর বলতে না বলতেই সেই মানুষটা আরো কাছাকাছি ছুটে আসছিল তাদের দিকে, সাথে মুখচ্ছবিটিও ভেসে আসছিল নিকটে। দুরত্ব যখন কয়েক কদমের তখন আহি এগিয়ে যায় সামনে সত্যি সত্যি নীরবকে দেখে কিছুটা হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বলে,

‘ এত সময় কেন লাগালে ভাইয়া, আমরা সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য?’

‘ সরি রে একটু লেট হয়ে গেছে।’

‘ এখানে একটু লেট।’

‘ সরি রে।’

‘ আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে আর কিছু বলতে হবে না আমার সাথে আসো?’

বলেই অথৈর দিকে অগ্রসর হলো দুজন।’

অন্যদিকে অথৈ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলো সে ভাবে নি আহি এতক্ষণ নীরবের জন্য অপেক্ষা করছিল। সাথে সাথে বুকটা দক করে উঠলো অথৈর এখন কি করবে সে?’

আহি নীরবকে একটুখানি সময়ের জন্য দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে যায় অথৈর দিকে। অথৈও আহিকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সে বুঝতে পারছে না আহির উদ্দেশ্য। আহি অথৈর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,

‘ অনেক তো হলো দুরত্ব আর কত?’

হুট করে আহির এমন কথা শুনে যেন হতাশ অথৈ। সে বুঝলো না আহির কথার অর্থ? আহিকে হতাশার চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে আবারো উঠল আহি,

‘ বুঝলি না তো আমি জানি তুইও নীরব ভাইয়াকে ভালোবাসিস।’

এবার যেন আহির কথা শুনে চারশো চল্লিশ বোল্ডটা ঝটকা খেলো অথৈ। মাথায় বারংবার একটা কথাই মাথায় আসছে তাঁর আহি কি করে জানলো এসব, কই সে তো ভুল করেও কারো সাথে এসব নিয়ে কথা বলে নি তাহলে কি করে আহি জানলো এসব?’
!
!
!
!
!
#চলবে…..

#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৫০
_________________

বিস্ময়সূচক চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে অথৈ আহির মুখের দিকে। সে এখনো বুঝতে পারছে না আহি কি করে জানলো এসব। অথৈর চাহনী দেখে আহি বেশ বুঝতে পেরেছে অথৈর মনে কি চলছে এখন। আহি মুচকি হেঁসে অথৈর হাত ধরে নিয়ে আসলো নীরবের সামনে। তারপর নীরবের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ তোমার ভালোবাসার মানুষকে তোমার কাছে পৌঁছে দিলাম ভাইয়া এখন আমার ছুটি।’

আহির কথা শুনে নীরব কিছুটা অবাক হয়ে বললো,

‘ ছুটি মানে কোথায় যাবি তুই?’

‘ আপাতত আমায় এখন হসপিটালে যেতে হবে দু’ঘন্টার ছুটি নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম। আর তাছাড়া তোমরা এখন তোমাদের কনফিউশান দূর করবে সেখানে আমি থার্ড পারসন হয়ে কি করবো?’ অথৈ এতদিন খুব কষ্ট পেয়েছে ভাইয়া। তুমি আর ওকে কষ্ট দিও না।’

এতটুকু বলে অথৈর দিকে তাকিয়ে বললো আহি,

‘ আমি জানি অথৈ,তোর মনে এখন কি চলছে? প্রথমেই সরি বলছি তোকে না জিজ্ঞেস করেই তোর পারসোনাল ডাইরিটা আমি একটু ধরেছিলাম।’

আহির কথা শুনে বিস্মিত চোখে তাকালো অথৈ আহির দিকে। এতক্ষণ পর যেন অথৈ বুঝতে পারলো আহি এসব তাহলে তাঁর ডাইরি থেকে পেয়েছে। অথৈ অনুশোচনাসূচক আহির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ আহি?’

‘ দেখ আমি জানি এখন তুই কি বলবি বাট আমি এখন কিছুই শুনবো না। তোরা দুজন কথা বল আমি আসছি।’

বলেই ওদের দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উল্টোদিক ফিরে যেতে নিলো আহি। কয়েক কদম যেতেই অথৈ গম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে বললো,

‘ দাঁড়া আহি, কষ্ট লুকাতে পালিয়ে যাচ্ছিস নাকি?’

হুট করেই অথৈর মুখে এমন কথা শুনে থমকে গেল আহি। বিষন্ন ভরা মনটাকে দূরে সরিয়ে রেখে শুকনো হেঁসে পিছন ফিরে বললো সে,

‘ পালাতে যাবো কেন?’

উওরে অথৈ আহির দিকে এগিয়ে এসে বললো,

‘ পালাচ্ছিস না তো কি করছিস, এত ভালো হতে কে বলেছে তোকে?’

‘ ভালো হওয়ার কি আছে এখানে?’

‘ অনেক কিছু আছে আর আমি নীরবকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবো না।’

‘ কেন পারবি না? আমি নীরব ভাইয়াকে ভালোবাসতাম বলে

উওরে মাথা নিচু করে ফেলে অথৈ। অথৈকে মাথা নিচু করতে দেখে শুকনো হেঁসে বললো আহি,

‘ তাহলে শোন আমি এখন আর নীরব ভাইয়াকে ভালোবাসি না। আর ভালো আমি নই তুই সেজেছিস নিজের ভালোবাসাকে লুকিয়ে রেখে।’

আহির প্রথম কথাটা শুনে শুরুতে অবাক হলেও পরক্ষণেই বিশ্বাস না করে বললো অথৈ,

‘ আমাদের মিলাতে মিথ্যে বলছিস?’

‘ কি মিথ্যে বলেছি আমি?’

‘ এই যে তুই নীরবকে ভালোবাসিস না। তাহলে কাকে ভালোবাসিস তুই?’

অথৈর এবারের কথা শুনে হুট করেই আহির সামনে আদ্রিয়ানের ফেসটা ভেসে উঠল। ফট করেই বলে উঠল সে,

‘ মিথ্যে বলতে যাবে কেন?’

‘ আমি জানি আহি তুই নীরবকে সেই ছোট বেলা থেকে ভালোবাসিস তাহলে হুট করে কি এমন হলো যে এখন তুই ভালোবাসিস না।’

‘ কারন আমি সত্যি অন্য কাউকে ভালোবাসি।’

আহির এবারের কথা শুনে অথৈ নীরব দুজনই বেশ অবাক। অথৈ তখন এমনি বলেছিল ‘তাহলে কাকে ভালোবাসিস তুই? কিন্তু এখন সত্যি সত্যি আহির মুখে অন্য কারোর কথা শুনে হতভাগ সে। হতভাগ হয়েই বলে ফেললো অথৈ,

‘ কে সে, আর তুই যে মিথ্যে বলছিস না তাঁরও বা কি প্রমান আছে?’

মনটা অস্থিরতা ফিল করছে আহির। কিছুক্ষন চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো আহি,

‘ আমি মিথ্যে বলা পছন্দ করি না এটা তুই ভালো মতো না জানলেও নীরব ভাইয়া ঠিকই জানে। এটা ঠিক একটা সময় নীরব ভাইয়াকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম তাঁকে নিয়েই ছিল আমার ধ্যান জ্ঞান সবকিছু। কারন সেই ছিল আমার ছোট বেলা নিয়ে ঘেরা ‘বাবুইপাখির অনুভূতি’ মিশ্রিত গল্প। কিন্তু যেদিন থেকে জেনেছি নীরব ভাইয়া আমায় নয় তোকে ভালোবাসে তখন থেকেই ধীরে ধীরে আমি তাঁকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কষ্ট পেয়েছি খুব এটা ঠিক কিন্তু আমার সেই কষ্টের সময়গুলোতে কেউ একজন ছিল আমার পাশে। যে খুব কেয়ারিং করেছে আমার, বৃষ্টির রাতে নিজ গাড়ি করে নিজ বাড়িতে নিয়ে সেবা করেছে আমার, হতাশা ভরা বিকেলে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে বন্ধু হয়েছে আমার, রাতের জোৎসা ভরা আলোতে উঁচু পুলের মাঝে দার করিয়ে নীরব ভাইয়াকে ভুলতে সাথে নিজের ফিলিংস গুলোকে বিসর্জন দিতে হেল্প করেছে আমায়, আমার ব্যাথার দিনে আমায় সামলিয়েছে, হঠাৎ দুপুরের রোদে গাড়ি করে ঘুরতে নিয়ে গেছে আমায় যদিও সেই দিনগুলো তাঁর জন্য মন খারাপের দিন ছিল কিন্তু তাঁরপরও আমার জন্য হেঁসেছে, মাঝরাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে অনিচ্ছা থাকা সত্বেও ভিজেছে আমার সাথে, নীরব ভাইয়া ছিল আমার ছোট বেলার অস্তিত্বে যেটা বড় হওয়ার সাথে সাথে ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু আদ্রিয়ান উনি আমার যৌবন কালে অনুভূতি আর উনি আমায় আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে। তাই আমিও ওনায় ভালোবেসে ফেলেছে। নীরব ভাইয়া ছিল আমার প্রথম আর অতীতের ভালোবাসা কিন্তু আদ্রিয়ান আমার বর্তমান জীবনে গল্প। যেটা চাইলেও আমি আর মুছতে পারবো না। ঝড়বৃষ্টির রাতে আমাকে বাঁচাতে নিজে আঘাত পেয়েছে, আরও কত কি এঁকে তো ভালোবাসতেই হতো আমায়। নিজের অজান্তেই মন দিয়ে ফেলেছি আমি তাঁকে। মানুষটা রাগী আর গম্ভীর টাইপের কিন্তু মনের দিক থেকে খুব ভালো। নীরব ভাইয়া আমার প্রতিবেশী হয়েও সেইভাবে তাঁর কাছাকাছি কখনোই যাই নি আমি বা প্রয়োজন পড়ে নি। কিন্তু ওই মানুষটার সাথে কারনে অকারণে ভুল করে কতবার কাছাকাছি হয়েছি তাঁর হিসাব। কিছুদিন আগে তো কাছাকাছি হওয়াটা যেন একটা রুটিনে পরিণত হয়েছিল। এতটুকু বলে থামলো আহি তারপর আবারো বললো সে,

‘ কতবার যে মানুষট আমায় হেল্প করেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। আমার ওপর রেগে থাকলেও আমায় হেল্প করেছে বহুবার বহুক্ষণে।’

আহি যখন কথাগুলো বলছিল প্রতিটি কথার সাথে সাথে সে আদ্রিয়ানকে ফিল করছিল। আর আহির কথা শুনে অথৈরও কেন যেন মনে হলো আহি সব সত্যি বলছে। বিচলিত মন নিয়ে বললো অথৈ,

‘ তাঁর মানে তুই?’

‘ হুম তুই যেটা ভাবছিস সেটাই, হয়তো আমারই বুঝতে একটু সময় লেগেছে। আমি নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি আদ্রিয়ানকে। আর বিয়ে করলে তাঁকেই করবো যে আমায় ভালোবাসে, আমার জন্য ফিলিংস আছে যার। তাঁকে বিয়ে করবো না যে আমায় ভালোবাসে না, যার আমার জন্য কোনো ফিলিংস নেই।’

লাস্টের কথাটা আহি নীরবের দিকে তাকিয়েই বলেছে। নীরবও আহির লাস্টের কথাটা যে তাঁকে ইংগিত করেই বলেছে সেটা বুঝতে পেরে সেও মাথা নিচু করে ফেললো। নীরবের কাজে শুঁকনো হাসলো আহি। তারপর চটজলদি নীরবের উপর থেকে চোখ সরিয়ে অথৈর দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,

‘ তাই বলবো আমায় নিয়ে আর ভাবিস না আমি ভালো আছি। এখন তোরাও ভালো থাক। অবশেষে বলবো তোদের ভালোবাসার দিনগুলো সুন্দর হোক দোয়া রইলো। আজ তবে আসি বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে বুঝলি। এমনিতেই হসপিটাল থেকে অনেকদিনের ছুটি নিয়েছিলাম আজ আবার ২ ঘন্টার ছুটি নিয়েছি। ২ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অনেক আগে আর দেরি হলে সত্যি সত্যি চাকরিটা চলে যাবে আমার।’

বলেই নীরবের দিকে একপলক তাকিয়ে আদ্রিয়ানকে মাথায় নিয়েই হাঁটতে শুরু করলো আহি। এমন সময় দূর আকাশে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল এক মস্ত বড় প্লেন। আহি তাকালোও সেটার দিকে, কেমন যেন শুন্য শুন্য মনে হলো কিছু। কিন্তু আবার এমনি ভেবে হেঁটে গেল সে।’

কিন্তু সে তো বুঝলো না তার শুন্যতা ফিল হওয়া মানুষটাই মাত্র প্লেনে করে কোনো এক জানালার সিটে বসে তার কথা ভাবতে ভাবতেই চললো তাঁর থেকে বহু দূরে। এতটাই দূরে যে চাইলেও সে সেখানে পৌঁছাতে পারবে না।’

এদিকে আহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো নীরব আর অথৈ। দুজনেই বেশ অবাক আহির কথা শুনে। নীরব এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখলো অথৈর। হয়তো অথৈর অবস্থাটা সে বুঝতে পারছে। অথৈও ছলছল চোখে তাকালো নীরবের দিকে পরক্ষণেই নীরবের বুকে মাথা রাখলো সে। নীরবও হাত বুলালো অথৈর মাথায়। এবার যেন দুই প্রেমিক-প্রেমিকার বুকে প্রান ফিরে এলো। অনেক দিনের ভালোবাসা যেন আজ পূর্ণতা পেল। এবার আর রইলো কোনো বাঁধা যেটা রইলো সেটা হলো ভালোবাসা, ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।’

আকাশের সূর্য্যিমামাও মস্ত বড় আকাশের নদীর দূর সীমানা দিয়ে ডুবতে শুরু করলো। কারন,

‘এখন যে তাঁর বাড়ি ফেরার সময়।
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাতের দিকে অগ্রসর হওয়ার পূর্বাভাস।
সূর্য্যিমামাকে হারিয়ে চাঁদ মামাকে স্বাগতম দেওয়া আলাপন।’

_____

রাত_৯ঃ০০টা…

হসপিটাল থেকে জাস্ট বের হলো আহি। মনটা বড়ই অস্থির তাঁর। আহি বুঝতে পারছে না এত খারাপ আর খালি খালি কেন লাগছে তাঁর। সেই সন্ধ্যা থেকেই মনটা বড় উতলা হয়ে আছে। সকালের স্বপ্নটটাও হুট করে হানা দিলো তাঁর। আহি তাঁর অস্থিরতার মন নিয়েই অগ্রসর হলো আদ্রিয়ানের অফিসের উদ্দেশ্যে। আজ অথৈকে যা যা বললো আহি তাঁর একটাও তাঁর মনগড়া বা বানানো ছিল না সে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে আদ্রিয়ানকে। আর আদ্রিয়ানের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য হয়তো নীরবকে তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছে। এই জন্যই হয়তো বলে,

‘ সবার ভাগ্যে সবাই থাকে না,
ভাগ্যে তো সেই থাকে যাকে আপনার জন্য আল্লাহ বানিয়েছে। তাই মন খারাপ করবেন না যা হারিয়ে গেছে তা তো গেছেই অপেক্ষায় থাকুন সেই মানুষটার জন্য যাকে আপনার জন্য বানানো হয়েছে। কে জানে তাঁকে পেয়ে হয়তো আপনি আপনার হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকেই একসময় তুচ্ছ মনে করবেন। আবার হয়তো মনে হবে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটাই পেয়ে গেছে। তাই মন খারাপ করবেন না কারন জীবন খুবই সুন্দর।’🍁

আনমনেই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেল আহি। আর হাঁটতে হাঁটতেই কখন যে আদ্রিয়ানের অফিসের সামনে চলে আসলো সে বুঝতেই পারে নি। এরই মাঝে সেই সময় অফিস বন্ধ করে অফিস থেকে বেরিয়ে আসছিল নিলয়। আহিকে আনমনেই এদিকে আসতে দেখে বললো সে,

‘ আহি তুমি এখানে?’

হুট করেই নিলয়ের কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে তাকালো আহি তাঁর দিকে, পরক্ষণেই সে যে আদ্রিয়ানের অফিসের সামনে চলে এসেছে এটা বুঝতে পেরে বললো আহি,

‘ হুম আমি! একটু আদ্রিয়ানের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম কিছু কথা ছিল ওনার সাথে।’

আহির কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বললো নিলয়,

‘ কিন্তু আদ্রিয়ান তো নেই আহি?’

‘ নেই মানে উনি বাড়ি চলে গেছেন কিন্তু ওনার অফিস তো আরো এক ঘন্টার মতো খোলা থাকার কথা।’

‘ হুম তা ঠিক কিন্তু,

নিলয় আর কিছু বলার আগেই আহি বলে উঠল,

‘ ঠিক আছে কোনো ব্যাপার না আমি ওনার সাথে কাল দেখা করে নিবো।’

‘ তা তো হবে না আহি।’

এবার আহি ভীষণই বিষন্ন। এমনিতেই মনটা তাঁর অস্থির হয়ে আছে কখন আদ্রিয়ানের সাথে দেখা করবে কিন্তু নিলয়ের কথায় প্রচন্ড হতাশ সে। হতাশা নিয়েই বললো আহি,

‘ হবে না কেন ভাইয়া?’

‘ কারন আদ্রিয়ান তো বাংলাদেশ নেই।’

‘ বাংলাদেশ নেই মানে কোথায় গেছে?’

‘ ওহ তো অফিসের একটা কাজে আজ বিকেলের ফ্লাইটে সুইজারল্যান্ড গেছে।’

নিলয়ের কথা শুনে প্রচন্ড হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো আহি,

‘ কি?’

‘ হুম।’

‘ কবে ফিরবে?’

‘ তা তো ঠিক নেই।’

‘ ওহ।’

বলেই প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে চললো আহি বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আহির যাওয়ার পানে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই বলে উঠল নিলয়,

‘ আহি দাঁড়াও!’

সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো আহি। আহত দৃষ্টিতে নিলয়ের দিকে তাকালো সে। আহিকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে নিলয় দৌড়ে এসে তাঁর পকেট থেকে একটা নীল খামের চিঠি বের করে আহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘ এটা তোমার জন্য আহি আদ্রিয়ান যাওয়ার আগে তোমায় দিতে বলেছিল।’
!
!
!
!
!
#চলবে…..

#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৫১
_________________

ছলছল চোখে তাকাচ্ছে আহি, কখনো নিলয়ের দিকে তো কখনো নিলয়ের হাতে থাকা চিঠিটার দিকে। আহির এই মুহূর্তে মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আদ্রিয়ান তাঁর আশেপাশে নেই। আহি ছলছল চোখ নিয়েই নিজের হাত নিলয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘ এটা কিসের ভাইয়া?’

‘ তা তো জানি না। আমি পড়ে দেখি নি আসলে আদ্রিয়ান চেয়েছিল নিজ হাতে এটা তোমায় দিতে কিন্তু সময়টা এত দ্রুত চলে গেল যে ও বুঝতেই পারে নি। যাইহোক রাত হচ্ছে এখন বাড়ি যাও বাড়ি গিয়ে পড়ে নিও চিঠিটা।’

উওরে দু’বার মাথা নাড়িয়ে পিছন ফিরে চললো আহি। আহির চোখ এইমাত্র অনেক কিছু বললো নিলয়কে। যেটা নিলয় বেশ বুঝতে পেরেছে। আনমনেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

‘ একটু দেরি হয়ে গেল যে আহি।’

বলেই আকাশ পথে তাকালো নিলয় আর উইস করলো,

‘ আদ্রিয়ান যেন খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসে দেশে।’

ভেবেই অন্যদিক দিয়ে চললো নিলয়।’
____

রাতের জোৎসা ভরা আলোর পথ পেরিয়ে আনমনেই হাঁটছে আহি। মনটা একদমই ভেঙে গেছে তাঁর, বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করছে। শুন্যতা ফিল হচ্ছে ভীষণ এতক্ষণে আহি বুঝতে পারলো সন্ধ্যা থেকেই তাঁর মনটা এত উতলা কেন ছিল?’ ভালোবাসাটা যেন তাঁর জন্য নয়, যখনই ভালোবাসা নিবেদন করতে যায় তখনই কোনো না কোনো প্রবলেম এসে তাঁকে ধরা দেয়। নীরবের ক্ষেত্রেও হয়েছে আর এখন আদ্রিয়ান। ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আহি। আজ আকাশের বুকে কোনো তাঁরা নেই, একদমই নিরিবিলি আর নিস্তব্ধ লাগছে চারপাশ। আহি আনমনেই হাঁটতে লাগলো তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভিতর থেকে একদম পাথর হয়ে গেছে সে। সে বুঝতে পারে না বার বার তাঁর সাথেই এমন কেন হয়? সত্যি কি তাঁর ভাগ্যে ভালোবাসা নেই। যাকে সে মন থেকে ভালো বাসতে যায় তখনই সে তাঁর থেকে দূরে চলে যায়।’

আহি নানান কিছু ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললো নিজের গন্তব্যে দিকে।’

আর এইদিকে, মেঘের মাঝে ভেসে চলা ফ্লাইটের তিন নাম্বার সারির লাস্টের সিটের জানালার পাশে বসে আছে আদ্রিয়ান। মনে ভিতর অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে তার। সে জানে না আহি তাঁর অনুভূতি মিশ্রিত চিঠিটা পড়ে কি করবে? তাঁকে কি আবার ফিরিয়ে দিয়ে উদাস করবে নাকি আনমনেই চোখে বুঝিয়ে ফেললো আদ্রিয়ান। আর বেশি ভাবতে পারলো না সে। বুকের ভিতর কেমন ধুম ধুম শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন ছুড়ি দিয়ে তাঁর হৃদয়টাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। জোরে নিশ্বাস ফেললো আদ্রিয়ান। অস্থিরতা হচ্ছে ভীষণ? সে জানে না আগামী দিনগুলো কিভাবে সে সুইজারল্যান্ডে কাটাবে? কম হলেও তাঁকে আহিকে ছেড়ে ৬ মাস থাকতেই হবে। এতগুলো দিন কি করে আহিকে ছেড়ে থাকবে ভাবতেই বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে আদ্রিয়ানের।’

মাঝেমধ্যে কিছু ব্যস্ততার কাছে ভালোবাসাকে হার মানতেই হয় যেমন আজ আহি আর আদ্রিয়ানকে মানতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে সময়টা যেন সত্যি খুব বেশি বেইমানি করে ফেলে।’– কথাগুলো ভেবে আকাশ পথে আদ্রিয়ান আর মাঝ রাস্তায় আহি দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। তাঁরা কেউ জানে না এদের উপসংহারটা আসলে কেমন হবে?’ বিচ্ছেদ নাকি অন্যকিছু।’

.
.

টেবিলের কোনে জানালার পাশে বসে আছে আহি। রাতের আকাশে থাকা চাঁদ মামার মৃদু আলো উঁকি মারছে তাঁর রুমে। জানালার কার্নিশ বেয়ে অল্প স্বল্প বাতাসও আসছে কিছু কিন্তু যেটা খুবই অল্প এতটাই অল্প যে জানালার পর্দাটাও খুব বেশি নড়তে পারছে না। এসবের ভিতরেই টেবিলের ওপর নিলয়ের দেওয়া আদ্রিয়ানের লেখা নীল খামের চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আছে আহি। বিষন্ন হয়ে আছে মনটা তবে চিঠিটা পড়ার জন্য নয় আদ্রিয়ানের এইভাবে হুট করে চলে যাওয়ার জন্য। আহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নীল খামের ভিতর থেকে সাদা পৃষ্ঠার চিঠিটা বের করলো তারপর দুই ভাঁজ খুলতেই আদ্রিয়ানের হাতের লেখা চোখে পড়লো আহির। যেখানে প্রথমেই লেখা__

‘ আমি জানি না তোমার নামের এই চিঠিটা তোমার মনে কোনো জায়গা করে নিতে পারবে না। আমার অনুভূতিগুলো তোমার সামনে ঠিক ভাবে উপস্থাপন করতে পারবে কি না? তবে কি জানো আমি কখনো ভাবে নি কোনো মেয়ের জন্য এইভাবে চিঠি লিখতে বসবো তাও কি না বৃষ্টির মাঝে এই গভীর রাতে। এই বৃষ্টিই যেন তোমাকে আমার মনে করে দেওয়ার প্রথম তরঙ্গ।’

‘ তোমার সাথে আমার প্রথম আলাপনই হয়ে ছিল ঝগড়া দিয়ে, মনে আছে কি তোমার সেই বিয়ে বাড়ির কথা। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়েই সোফাতে বসে ছিলাম আমি, কারন এইসব বিয়েবাড়ি টিয়েবাড়ি একদমই পছন্দ নয় আমার তারওপর সেই ছোট্ট বাচ্চার নিয়ে আসা চিঠি। চিঠির খামের ওপর লাভ লেটার লেখা দেখেই চরম রাগ হয়েছিল আমার। আর রাগের বসেই সেদিন ফাঁকা রুমে তোমায় নিয়ে গিয়ে কতটাই না উচ্চ স্বরে কথা বলেছিলাম তোমার সাথে,সেদিন তো তোমাকে সহ্য করতেই পারছিলাম না। কিন্তু কে জানতো একটা সময় সেই সহ্য করতে না পারা মেয়েটাকেই এত ভালোবেসে ফেলবো আমি। এরপর তোমার সাথে সেকেন্ড মিট হলো ভুল করে তুমি আমার গাড়িতে উঠলে। সেদিনও কি ঝগড়া তোমার সাথে, সেটার কারনও ছিল এই চিঠি তুমি ভুল করে আবারো নীরবের চিঠি আমায় দিয়ে ফেললে, তারপর ঝগড়ার বেগে ধুলোবালিতে সেদিন কতই না বাড়াবাড়ি যদিও সেসব ভাবলে এখন ভীষণ হাসি পায় আমার, তারপর তুমি আমার অফিসে এলে তোমায় দেখে রাগ করে তাড়িয়ে দিলাম, শ্রীমঙ্গলে দেখা হলো, ঝড়বৃষ্টিতে ভয় পেয়ে তোমায় জড়িয়ে ধরলাম। এই জড়িয়ে ধরা বিষয়টাই যেন ছিল তোমার প্রতি আমার প্রথম অনুভূতির সূচনা। এটার জন্যই জানতে পারলাম তুমিই ছিলে সেই মেয়ে যে কি না ছোট বেলায় আমায় বাঁচিয়ে ছিলে। তারপর আবার অফিসে দেখা হলো ঝগড়া করলাম যদিও সেদিন তোমার কোনোই দোষ ছিল না কিন্তু তারপরও আসলে কি বলো তো ছোট বেলা থেকেই আমি নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারি না, তারওপর তোমার সাথে আমার রাগটা কিছুতেই দেখাতে পারতাম না যার বিনিময় হিসেবে বার বার কটুকথা শোনাতাম তোমায়। তারপর সেদিন ভার্সিটিতে নীরবের প্রতি তোমার ব্যর্থতার অনুভূতি দেখলাম। সেদিন ছিল তোমার প্রতি আমার শূন্যতার অনুভূতি। তোমার সেই বেঞ্চে বসে রিনিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার দৃশ্যটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না আমি। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন বার বার মনে হয়েছিল তোমার কাছে গিয়ে তোমাকে শান্ত্বনা দেই। কিন্তু সেটা তো কিছুতেই পসিবল ছিল না। তারপর বৃষ্টিতে ভিজে তোমায় নিয়ে আমার বাড়িতে আনা তোমার লেখা প্রথম চিঠির ‘বাবুইপাখির অনুভূতি’ গুলো পড়া যেটা তুমি টানা চারদিন বসে লিখেছিলে। সেদিন খুবই খারাপ লেগেছিল আমার বার বার মনে হয়েছিল হয়তো একটুর জন্য হলেও নীরবকে তোমার ভালোবাসা উচিত ছিল। পরক্ষণেই এখনকার কথা ভাবলে মনে হয় ভালো হয়েছে নীরব তোমায় রিজেক্ট করেছে। কারন ও রিজেক্ট না করলে হয়তো আজ আমি এখানে বসে তোমার জন্য অনুভূতি লিখতেই বসতাম না। হয়তো তোমায় ভালোবাসার সুযোগটাই হতো না।’– এই কথাটা পড়ে আনমনেই হেঁসে ফেললো আহি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো পড়তে শুরু করলো_

‘ তারপর ধীরে ধীরে তোমার সাথে বন্ধুত্ব করা তোমাকে চেনা, ধীরে ধীরে তোমাতে আসক্ত হওয়া, তোমাকে ভালোবাসার আবেদন জানানো যদিও সেটা ব্যর্থতা ছিল। জানো তো আমি যখন সেদিন তোমায় ভালোবাসার কথা বলেছিলাম তখন আমি এটা ভাবে নি তুমিও আমায় ভালোবাসবে। আমি শুধু চেয়েছিলাম তুমি আমার কাছে থাকবে। তোমার আমাকে ভালোবাসার প্রয়োজন নেই, আমি তোমায় ভালোবাসবো তুমি শুধু থাকবে আমার কাছাকাছি, রোজ রাতে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো আমি। কারন তুমিই যে আমার রাতের দুঃস্বপ্নের মাঝে একটু খানি আলোর রশ্মি। হসপিটালের যে কটা রাত তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিলাম সেই কটা রাত যেন আমার জীবনের শান্তিময় রাত ছিল। আমার জীবনে এই পর্যন্ত যতগুলো রাত গিয়েছিল তাঁর মধ্যে সেই হসপিটালে কাটা এক সপ্তাহ ছিল সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। এরপর মাঝখানে কাটলো যে দুই দিন। এই দু’দিনেই তোমার শূন্যতা ঠুকরে ঠুকরে যন্ত্রনা দিচ্ছিল আমায়।’

‘ আচ্ছা আমায় কি একটুও ভালোবাসা যায় না আহি? নীরবের মতো না হক ওর থেকে অল্প খানিকটা কি ভালোবাসা যেত না? তোমার কি এই কয়দিনে আমার এত কাছাকাছি থেকেও বিন্দুমাত্র আমার জন্য ফিলিংস জন্মায় নি? একবারো কি এই রাগী মানুষটাকে তুমি মিস করো নি? একবারও কি তোমার মনে হয় নি এই মানুষটার সাথেও একসাথে থাকা যায়, বা এই মানুষটার সাথে সারাজীবন থাকার প্রতিশ্রুতি জন্মায় নি? তোমাকে কি খানিকটায়ও আদ্রিয়ান নামক মানুষটার শুন্যতা ফিল করায় নি?’– আমাকে কিন্তু বড্ড করেছে তোমার স্মৃতিতে আমি যেন ক্ষণে ক্ষণে চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছি আহি, আমার তোমায় খুব প্রয়োজন? আমার ভিতরটা যে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে আহি, আমি শান্তি মতো ঘুমাতে পারি না রাতে, একটা আমার দুঃস্বপ্নের কারন আর দুই নাম্বার কারনটা হলে তুমি? প্লিজ আমায় আর ক্ষত বিক্ষত করো না, নইলে যে সত্যি সত্যি শেষ হয়ে যাবো আমি। তুমি নামক আসক্তি আমায় ধীরে ধীরে শেষ করে দিবে আহি। তোমায় বড্ড বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি আমি। এবার প্লিজ দূরে সরিয়ে দিও না আমায়, আমি যে আর সইতে পারছি না। বার বার মনে হয় আমার হৃদয়টাকে কে যেন ছুড়ি দিয়ে বারংবার আঘাত করছে। জ্বলন্ত আগুন দিয়ে হৃদয়টাকে ক্ষনে ক্ষনে পুড়িয়ে দিচ্ছে।”

এতটুকু পড়েই ধম ফেললো আহি। আদ্রিয়ানের এই কথাগুলো যেন তাঁকেও ভিতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। চোখ ভেসে আসছে তাঁর। আহি আকাশ পথে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো,

‘ আপনি আমায় এত ভালো কেন বাসলেন আদ্রিয়ান? পরক্ষণেই আবার ভাবলো, এতই যখন আমি নামক আসক্তি আপনায় কষ্ট দিচ্ছিল তাহলে কেন এইভাবে না বলেই হুট করে চলে গেলেন আপনি? আমার সাথে কি একবার দেখা করা যেত না, বা ফোন করে একটি বার বলা যেত না আমি চলে যাচ্ছি আহি। এতই সময়ের অভাব পড়লো আপনার যে দুই দন্ড কথা বলারও টাইম হলো না। এখন নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন আর এই আহি নামক মেয়েটাকেও কষ্ট দিচ্ছেন। আপনি বড্ড খারাপ আদ্রিয়ান, বড্ড খারাপ। আর পড়বো না আমি আপনার চিঠি।’

বলেই চিঠিটাকে টেবিলের উপর রেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আহি। হুট করেই এক আকাশ সমান অভিমান এসে ভর করলো তাঁকে। বড্ড অভিমান হলো আহির আদ্রিয়ানের ওপর।’

‘ এত ভালোবাসে অথচ ভালোবাসার মানুষটার জন্য একটুখানি সময় বার করতে পারলো না। চাই না আপনার ভালোবাসা থাকুন আপনি দূরে কোনো প্রয়োজন নেই আহির আপনাকে হুহ।’

বলেই রুমের লাইট অফ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আহি। পাশ ফিরে একবার চিঠিটার দিকে তাকিয়ে উল্টোদিক ঘুরে কাঁথা জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো আহি। কিছুক্ষন পর আবার চোখ খুলে তাকালো সে। আবার অভিমান করে চোখ বন্ধ করে নিলো। আবার বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো আহি। শান্তি মিলছে না তাঁর, আদ্রিয়ানের ওপর ভিষণভাবে রেগে গেছে সে? এতটাই রেগে গেছে যে কাছে পেলে কি করতো জানে না আহি?’

অন্যদিকে আহির কান্ড কারখানা বার বার পলক ফেলে দেখতে লাগলো তাঁর বিছানার ওপর থাকা খরগোশ ছানা। সে বুঝতে পারছে না আহির কান্ড কারখানা। কেন বার বার উঠছে বসছে ছটফট করছে। বুঝতে পারলে হয়তো শান্ত্বনা দিতো।’

এদিকে,
আহি চরম প্রকার বিরক্ত হয়ে বিছানার ওপর থেকে তাঁর ফোনটা বের করে কল করলো রিনিকে। প্রথম দু’বার কল করতেও রিনি ধরলো না, এতে যেন আরো রাগ হলো আহির। তিন নাম্বার কল করতেই অপর পাশে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে উঠল রিনি,

‘ হ্যালো?’

রিনির হ্যালো শুনে অপরপাশে কর্কশ গলায় বলে উঠল আহি,

‘ ওই বান্দর মাইয়া এতক্ষণ সময় লাগে ফোন ধরতে, কখন ফোন দিসি আমি?’

হুট করেই এমন ঝাঁঝালো গলা শুনে ঘুম উড়ে গেল রিনির পরক্ষনেই এটা যে সত্যি সত্যি আহির নাম্বার কি না চেক করে বললো,

‘ হ্যালো?’

‘ আবার কি হ্যালো হ্যালো করছিস আদ্রিয়ান এমন কেন করলো রিনি, আমায় নাকি বড্ড ভালোবাসে তাহলে আমায় না বলে কি করে সুইজারল্যান্ড চলে গেল। গেল তো গেল যাওয়ার আগে একবার আমার সাথে দেখা করতে পারতো না। কল করে বলা যেত না আমি চলে যাচ্ছি। আমায় ছাড়া নাকি থাকতে কষ্ট হয়, ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায় তাহলে কি করে পারলো আমায় ছেড়ে চলে যেতে। লোকটা চরম বদমাশ, শয়তান, রাগী, হনুমান আমি কখনই ক্ষমা করবো না তাঁকে, কি করে পারলো এতটা নিষ্ঠুর হতে,, এই রকম হাজারো আদ্রিয়ান কানেক্টেড কথা বলতে লাগলো আহি রিনিকে। এক পর্যায়ে সে নিজেই বক বক করতে করতে ফোন কেটে দিল। আর রিনি পুরো অবাক হয়ে থ মেরে বসে রইলো সে কিছু বুঝতেই পারলো না আহি কেন এইভাবে তাঁর সাথে চিল্লাচিল্লি করলো, আদ্রিয়ান কাজের জন্য সুইজারল্যান্ড গেছে সেটা সে জানতো কারন শুভ তাঁকে বলেছিল কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁর কি করার ছিল?’ হঠাৎ করে আবারো ফোনটা বেজে উঠল রিনির এবারও আহির নাম্বার দেখে থ মেরেই ফোনটা তুলে বললো সে,

‘ হ্যালো।’

‘ তোর হ্যালোর ৪৪০, শোন ওই বদমাইশ লোকটাকে বলে দিস এই আহি তাঁকে ভালোবাসে না। তাঁর প্রতি আহির কোনো ফিলিংস নেই, তাঁর জন্য এই আহি মোটেও কষ্ট পাচ্ছে না।’

বলতে বলতে কেঁদে ফেললো আহি। আহিকে কাঁদতে দেখে ভয়ংকর ভাবে অবাক হয়ে বললো রিনি,

‘ কি হলো তুই আবার কাঁদছিস কেন?’

রিনির কথা শুনে কান্না ভেঁজা কন্ঠে বলে উঠল আহি,

‘ কাঁদবো না তো কি করবো? কি করে পারলো এমন করতে, আমাকে তো একবার কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। আদ্রিয়ান খুব খারাপ রিনি, খুব খারাপ।’

এভাবে কিছুক্ষন কান্না ভেঁজা কন্ঠে বকবক করে আবার ফোন কেটে দিল আহি। এরপর আধ ঘন্টা কেটে গেল রিনি চুপচাপ থ মেরে বসে রইলো। আহিও আর কল করে নি হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আহির বিষয়টাকে বুঝতে তাঁর আধ ঘন্টা সময় লাগলো। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে চরম রাগ নিয়ে রিনি কল করলো শুভর নাম্বারে।’

____

হসপিটাল থেকে কেবলই বের হলো শুভ এমন সময় রিনির কল দেখে খুশি হয়ে বললো সে,

‘ হ্যালো জান।’

সাথে সাথে কর্কশ কন্ঠ নিয়ে অপর পাশে বললো রিনি,

‘ তোমার জানের গুষ্টি কিলাই, তোমার ভাই কি করে পারলো আমার বেস্টুকে কাঁদাতে, কিভাবে না বলে চলে গেল সুইজারল্যান্ড। আমার বেস্টু কাঁদতে কাঁদতে আধ ঘন্টা,আর চিল্লাতে চিল্লাতে একঘন্টা ধমকালো আমায়।’

রিনির কথা শুনে ফট করেই বলে উঠল শুভ,

‘ তো এক্ষেত্রে আমি কি করতে পারি?’ আর তুমি আমার ওপর কেন রেগে আছো? আমার কি করার ছিল?

‘ কি করার ছিল মানে তুমি তোমার ভাইকে আটকাবে না।’

রিনির কথা শুনে বিস্মিত হয়ে বললো শুভ,

‘ আমি! আমি কি করে আটকাতাম আর ভাইয়ার চলে যাওয়াতে আহি আপু কেন কাঁদছে?’

শুভর কথা শুনে ভয়ংকরভাবে জোরে শব্দে করে একটা চিল্লানি দিল রিনি, এতটাই জোরে চিল্লানি দিল যে শুভর কান যেন ওখানেই স্তব্ধ হয়ে গেল।’

ততক্ষণে রিনিও ফোন কেটে দিল। আর শুভ থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বিস্মিত হয়ে বললো,

‘ কি হলো? কেন হলো? কিছুই তো বুঝলাম না তাহলে মাঝখান দিয়া আমার কানটা কেন ঝালাপালা হয়ে গেল?’
!
!
!
!
!
#চলবে…..