বিকেলের যতো রঙ পর্ব-০৩

0
48

#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-০৩
#রুবাইদা_হৃদি

আম্মাকে যে খু’ন করা হয়েছে ব্যাপার টা ভাইয়া জানতো ভেবেই আমার মন মস্তিষ্ক উত্তাল হয়ে উঠলো৷ আমি একের পর এক প্রশ্ন করলেও ভাইয়া উত্তর না দিয়েমাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভাইয়া যে কান্না করছে এইটা আমি দূর থেকেই উপলব্ধি করতে পারছি৷ আমি কাছে গিয়ে ভাইয়ার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই ভাইয়া মুখ তুলে তাকালো৷ চোখ মুখ অসম্ভব লাল হয়ে উঠেছে৷ আমি কিছুটা রেগে বললাম,

‘তোমরা আমার সাথে ভণিতা করছো৷ আম্মাকে মে’রে ফেলা হয়েছে তুমি জানলে কিভাবে! বলো আমাকে৷’

‘আব্বা বলেছেন৷’

‘মানে!আব্বা কখন বললো৷ কোই আমাকে তো বলে নাই৷ আর কে মে’রেছে?’

আমি অবাক হয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করতেই ভাইয়া গলার স্বর খাঁদে নামিয়ে বললো,

‘ওইদিন হাসপাতালে নেওয়ার সময়৷ আব্বা জানিয়েছেন আম্মাকে না’কি উনি নিজেই কিছু একটা ওষুধ খাইয়েছিলেন৷ এরপরই আম্মা ব্রেইন স্ট্রোক করে বসে৷’

ভাইয়ার কথা শুনে আমার আসমান জমিন সব এক হয়ে যাচ্ছে যেন৷ আমি কিছুটা চিৎকার করে বললাম,

‘লোকটা কিভাবে পারলো ভাইয়া! আল্লাহ আমার আম্মা৷ আমার এতো ভালো আম্মা৷’

‘মিথি প্লিজ বোন আমার চুপ কর৷’

‘তুমি কেনো চুপ আছো ভাইয়া! লোকটা আম্মার খু’নি৷’

‘এখন তুই কি চাস? আব্বাকে লাইফ সাপোর্ট থেকে বের করে হাজতে দিয়ে আসি!’

ভাইয়া কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে কথাটা বললো৷ আব্বার অবস্থার কথা মনে হতেই আমি চুপ হয়ে গেলাম৷ আল্লাহ এমন কি পাপ আমরা করেছি! আম্মাকে হারিয়ে আব্বাকে নিয়ে বেঁচে ছিলাম৷ সেই আব্বা এখন গুরুতর অসুস্থ৷ আবার উনিই নাকি আমাদের এতিম করেছেন৷
মনের ভেতর ক্ষোভ নিয়েই আমি ভাইয়াকে বললাম,

‘আমি বিচার চাই৷ উনি আমার আব্বা বলে আমি তাকে ছেড়ে দিবো না৷’

ভাইয়া আমার কথা শুনে শব্দ করে কেঁদে ফেললো৷ কান্না দেখে আমি কিছুটা নরম হতেই ঘরের ভেতর থেকে সবাই ছুটে এলো৷ সবাইকে আসতে দেখে ভাইয়া নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে৷ তবে হোসেন কাকা ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললো,

‘আশরাফ ভাইজান ঠিক আছে তো?’

ভাইয়া দু’দিকে মাথা হেলিয়ে বুঝালেন ‘ঠিক আছে’৷ দাদি ভাইয়ার কাছে এসে বুকে আর পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,

‘কাঁদো কেন ভাই! কাইন্দো না৷’

ভাইয়া আর কোনো কথা বললো না৷ তবে মিনু খালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনার মুখটা কেমন হাসি হাসি ভাব বজায় আছে৷ আমাকে দ্রু কুঁচকে তাকাতে দেখেই মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে ফেললো৷ ভাইয়া আমাকে খাবার দিতে বলতেই আমি না দিয়েই রাগ করে ঘরে এসে দুয়ার আটকে দিলাম৷ এই মুহূর্তে আমার আম্মাকে ছাড়া কাউকে ভাবতে ইচ্ছে করছে না৷
‘আব্বা আপনাকে আমার আম্মা কতো ভালোবেসেছে৷ আপনি কি করে পারলেন আম্মাকে মেরে ফেলতে? ‘প্রশ্নটা আমি নিজ মনে করতেই কান্নায় ভেঙে পরলাম৷ এতো অমানবিক কষ্ট দুনিয়ায় আদৌও কেউ পেয়েছে কি’না আমার জানা নাই৷

.

রাত বাড়ার সাথে সাথে আমার ঘুমে চোখ বুজে আসছে৷ কিছুক্ষণ পূর্বে ঝুমা আপা ডেকে গিয়েছে উনি ঘরে শোবে বলে৷ আমি উত্তর না দিয়ে ঘাপটি মেরে পরে ছিলাম৷ ক্ষুদায় পেটে চোঁ-চাঁ শব্দ হলেও খাবারের ইচ্ছাটা মরে গেছে৷ কিছুটা ঘুম চোখে ভীড় করতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে বিরক্ত হলাম৷ বিরক্তি নিয়েই বললাম,

‘আপা তুমি তোমার মায়ের ঘরে যাও তো৷’

‘মিথি দরজাটা খোল বোন৷’

ভাইয়া নিচুস্বরে বলতেই আমি না চাইতেও উঠে দরজাটা খুলে দিলাম৷ আবছা আঁধারে দেখলাম ভাইয়ের হাতে ভাতের প্লেট৷ আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম,

‘ভাত নিয়ে যাও৷ আর ঘুমিয়ে পরো৷ তোমার না কাল ঢাকা যেতে হবে!’

‘আব্বা কিছুটা সুস্থ হলে আমি নিজেই পুলিশকে ব্যাপার টা জানাবো৷’

ভাইয়া কিছুটা কাঁপা কন্ঠে কথাটা বললো৷ এই মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর ধড়ফড়িয়ে উঠলো৷

‘অপরাধীর অপরাধ লুকিয়ে রাখাটাও একধরণের অপরাধ৷ তাই না ভাইয়া?’

আমার প্রশ্ন শুনে ভাইয়া মলিন হাসলেন৷ এরপর চেয়ার টেনে বসে বললো,

‘অপরাধের কারণ আর অপরাধী কোন উদ্দেশ্য খু’ন করেছে সেটা আগে জানতে হবে৷’

আমি প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে বিছানায় বসতেই ভাইয়া আবারো মলিন কন্ঠে বললো,

‘মিথি আব্বার চিকিৎসার জন্য আরো টাকার প্রয়োজন৷’

‘কালকেন দুই লক্ষ টাকা..’

‘আব্বাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে৷ পানির মতো টাকা যাচ্ছে মিথি৷ আমি তো কুল কিনারা পাচ্ছি না৷’

ভাইয়া আমার কথার মাঝে বাধা দিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো৷ আমি বিপদগ্রস্তের মতো ভাইয়াকে বললাম,

‘আম্মার গয়না গুলা আছে ভাইয়া৷ এর বাইরে তো ক্যাশ টাকা তো নাই৷’

ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বোধহয়৷ আমার ভাইয়াকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,ভাইয়া তুমি কিভাবে উনাকে চিকিৎসা করাচ্ছো?
তবে প্রশ্নটা করলাম না৷ ভাইয়া অত্যন্ত দুঃখ নিয়ে বললো,

‘চাকরিটা হয়ে গেছে ৷ ভেবেছিলাম চাকরি পেলেই ঝুমাকে ঘরে তুলবো৷ কিন্তু! আম্মা চলে যাবার পর থেকে আমাদের জীবনটাকে কে কোনদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না রে মিথি৷’

‘ভাইয়া ঝুমা আপাকে বিয়েটা করে না-ও৷’

আমার এই কথার ভাইয়া কোনো উত্তর দিলো না৷ অন্য প্রসঙ্গে বলতে আরম্ভ করলো,

‘পুলিশ আব্বার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছে৷ তাকে কারা এভাবে মা’রতে চাইলো সেটা জানা প্রয়োজন৷ অবশ্য উনারা বলছে আব্বার গ্রামে শত্রুর অভাব নেই৷ যেহেতু উনি সবার বিচার করতেন৷’

‘ভালোভাবে তদন্ত করতে বলো৷ কারণ আব্বার মতো ওরাও অপরাধী৷’

আমার কথা শুনে ভাইয়া শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো৷ এরপর ভাতের প্লেট নিয়ে একপ্রকার জোর করেই খাবার খাইয়ে দিয়ে ভাইয়া ঘর থেকে যেতে যেতে বললো,

‘গয়না গুলো গুছিয়ে রাখিস৷ আমি কাল নিয়ে যাবো৷’

.

প্রত্যুষের একগুচ্ছ রোদ উঠোনে হামাগুড়ি দিচ্ছে৷ ফজরের আজানার পর এতো বিশুদ্ধ একটা বাতাস চারদিকে বয়ে বেড়ায় যা নিঃশ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে ভেতরের সমস্ত বিষাক্ত বাতাস নিগড়ে ফেলে৷ আমি গোরস্থান থেকে আম্মার কবর জিয়ারত করে ফিরে আসতে কিছুটা রোদ উঠে গেছে৷ আম্মার কবরের কাছে গেলে বুক চিড়ে হৃৎপিন্ড টা বেরিয়ে আসতে চায়৷ বাড়ির গেইট দিয়ে উঠানে পাঁ রাখতেই খেয়াল করলাম মিনু খালা চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাকে দেখে একপ্রকার ছুটে এসে বললো,

‘ঝুমা আসছে?’

‘ঝুমা আপা আসবে কোথা থেকে!’

আমি কিছুটা বিরক্ত কন্ঠে বলতেই মিনু খালা দরজার বাইরে উঁকিঝুঁকি দিলো৷ এরপর পরই সে আবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো৷ তার এহেন কর্মকান্ডে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে উঠলো৷
ভাইয়ার ঘরে গিয়ে ভাইয়াকে ডেকে তুলে রান্নাঘরে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম কুলসুম রুটি বানাচ্ছে৷ আমাকে দেখে পিঁড়ে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘আফা আপনারে না কইছি খালাম্মার কবরে গেলে আমারেও ডাইকা নিয়া যাইবেন৷’

‘মনে থাকে না রে৷ দাদি কোথায়?’

‘কাল রাইতে হোসেন চাচার বাড়ি গেছে৷’

কুলসুমের কথা শুনে আমার কপালে ভাঁজ পরলো৷ এমন হুট করে চলে যাবার জন্য মনে অশান্তিতে ভরে উঠলো৷ আমি কুলসুমকে প্রশ্ন করলাম,

‘হঠাৎ গেলো কেন রে?’

‘কাল রাইতে আপনে ঘরে দুয়ার দিতেই হোসেন চাচা দাদিরে নিয়া গেছে৷ কিছু বইলা যায় নাই৷ তবে আশরাফ ভাই নিজেই অনুমতি দিলো৷’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি কিছুটা দমে গেলাম৷ আলুভাজি করার জন্য আলু নিতেই কুলসুম ক্ষীণ স্বরে বললো,

‘আফা একটা কথা কইতাম৷’

‘হ্যাঁ বল৷’

‘সকালে দেখলাম ঝুমা আপা বাড়ির বাইরে খাঁড়ায় আছে৷ আমারে দেখতেই চমকাইয়া উঠছে৷আমি জিগাইলাম আপা খাঁড়ায় আছেন কেন৷ আমারে জানেন ধমক দিয়া কয়,তুই তো কাজে যা৷’

কুলসুমের কথা শুনে আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো৷ তবে চিন্তাটা স্থায়ী হলো না ভাইয়ার ডাকে৷ আমি কুলসুমকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে আসতেই ভাইয়া গয়না গুলা চাইলো৷
আম্মার এতো সাধের গয়না গুলো দিতে কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেলো৷ ওইগুলা আম্মার গাঁয়ে উঠেছিলো৷ আমি কান্না গিলে বললাম,

‘ভাইয়া আম্মার খু’নির জন্য আম্মার জিনিস না দিলে হয় না?’

‘এভাবে বলিস না মিথি৷ আব্বা বলেছেন আম্মাকে ওষুধ দিয়েছেন৷ আব্বা সুস্থ হোক আমরা জিগ্যেস করবো কি এমন ওষুধ আমার আম্মাকে দিলেন যে আম্মা ম’রে গেলো৷’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি আলমারির চাবি খোজায় ব্যস্ত হয়ে পরলাম৷ আম্মা মারা যাবার পরের দিন ই আব্বা নিজেই আমাকে চাবিটা হাতে তুলে দিয়েছিলেন৷ ভাইয়া আমাকে চাবি খুজতে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো৷ সারা ঘর তন্নতন্ন করে করে খুজেও চাবি পেলাম না৷ আমি চাবিটা আমার ঘরের তোষকের নিচে রেখে দিয়েছিলাম৷ চাবি না পেতেই আমার বুক ধুকপুক করে উঠলো৷ ঘরের সব এলোমেলো করেও চাবিটা খুজে না পেয়েই ভাইয়াকে হাঁকিয়ে ডাকলাম৷ ভাইয়া আসতেই আমি চাবিটার কথা বললাম৷
ভাইয়া শুনে শান্ত স্বরে বললো,’আব্বা আম্মার ঘরে খুঁজে দেখ৷ ‘

আমি কথা শুনেই আব্বা আম্মার ঘরে ছুটে গেলাম৷ মিনু খালা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমি ঘরে ঢুকতে চাইলে উনি বাঁধা দিতেই আমি চিৎকার করে বললাম,

‘ঘরে চাবিটাই খুজতে যাচ্ছি৷ আপনার ঘর দখল করার জন্য যাচ্ছি না৷’

মিনু খালা আমার কথা শুনে আমাকে জড়ায় ধরে ম’রা কান্না জুড়লেন৷ আমি হতবিহ্বল হয়ে বারবার জিগ্যেস করতে লাগলাম,’কান্না করছেন কেন!’

আমার কোনো কথার উত্তর না দিয়ে হাঁক ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন৷ ভাইয়া আর কুলসুম ছুটে আসতেই মিনু খালা হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

‘ঝুমারে খুঁজে পাইতাছি না রে৷ বাবা ও বাবা আশরাফ আমার ঝুমা ঘরে বাইরে কোথাও নাই৷’

মিনু খালার কথা শুনে আমরা দু’ভাই বোন তাজ্জব বলে গেলাম৷ কুলসুম হাইহুঁই করে বললো,

‘দেখছেন আফা বলছিলাম না আমার ঝুমা আফারে দেইখাই ঘাপলা লাগছে৷’

‘কোই দেখেছিস?’ ভাইয়া প্রশ্ন করতেই কুলসুম সকালের ঘটনা খুলে বললো৷ ভাইয়া চিন্তিত সুরে মিনু খালাকে বললো,

‘আপনার আত্মীয় দের বাড়িতে খোজ নিয়েছেন?’

‘সবাইরে ফোন দিছি৷ কেউ কোনো সুরাহা করতে পারে নাই৷’

মিনু খালা কাঁদতে কাঁদতে বললো৷ ভাইয়া নিজের ফোন দিয়ে কাউকে একটা ফোন দিয়ে বললো,

‘মোজাম্মেল ঝুমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ তুই একটু আশেপাশে খুঁজে দেখ৷ খেয়াঘাট, বাসস্ট্যান্ড৷ আর শোন খুঁজে না পেলে থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করে আসবি৷ ছবি মিথির কাছে থেকে নিয়ে যাবি৷ বুঝছিস৷’

ওইপাশ থেকে কি বললো শোনা গেলো না৷ তবে ভাইয়া আরো কিছু কথা বলে কল কেটে দিলো৷ মিনু খালাকে চিন্তা করতে না বলে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘গয়না গুলা বের করে দে৷’

ভাইয়ার কথা শুনে মিনু খালা যেন আঁতকে উঠলেন৷ আমতা আমতা করে বললেন,

‘আলনারিতে কোনো গয়না নেই৷’

উনার কথা শুনে আমাদের মাথায় যেন সাত আসমান ভেঙে পরলো৷ ভাইয়া, আমি আর কুলসুম একপ্রকার ছুটেই আব্বা আম্মার ঘরে ছুটে গিয়ে দেখলাম আলমারিতে চাবি দেওয়া৷ আমি আলমারি খুলে সব খুজে দেখলাম সত্যি সত্যিই আম্মার কোনো গয়না কোথাও নেই৷

চলবে….