বিকেলের যতো রঙ পর্ব-১৫

0
40

#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব-১৫
#রুবাইদা_হৃদি

আজকে সকালে একটা সুখবরে আমাদের আঁধারে ঢেকে থাকা ঘরে যেন কিছুটা আলোর ছটা ছড়িয়ে পরলো৷ যদিও ব্যাপার টা আমাদের ভাবনার বাহিরে ছিলো৷ তবুও সুখবর টা আমাদের মধ্যে থাকা কিছুটা বিষাদ ধূলিসাৎ করেছে৷ ভাইয়ার চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তি বিরাজ করছে৷ ফ্লোরে হাত পা ছিটিয়ে বসে বললো,

‘বুঝলি টাকার সমস্যা হয়তো কিছুটা মিটবে৷’

‘মিটলেও,উকিলের ফিস দিতে দিতে তো ফতুর হয়ে যাবো৷’

ভাইয়া আমার কথা শুনে মুচকি হাসলো৷ এরপর বললো,

‘হোসেন চাচা সিলেট উনার চাচা শশুর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো৷ কতোটা বলদ উনি ভাব! টাকা চাওয়ার জন্য আমাকেই ফোন করেছে৷’

‘আসলে উনার কোনো লজ্জা শরম নেই৷ আমি বুঝি না এতো কাহিনির পরেও আমাদের কাছেই এরা সাহায্য চায়৷’

‘ওরা ভাবে আমরা তো নরম মাটি৷ পা দিয়ে পিষলে হয়তো পানি বের হবে৷’

‘আমার আনন্দ লাগছে হোসেন চাচা আর ইমরান আবারো ধরা পরেছে ভেবে৷’

‘শুনলাম ঝুমাকে পায় নি৷’ ভাইয়া আমার কথার মাঝেই বললো৷ ঝুমা আপার প্রসঙ্গ উঠতেই আমি বললাম,

‘পাশের বাসার রোকসানা আন্টি আজ সকালে এসেছিলো ভাইয়া৷’

‘কি জন্য৷’

‘উনার একটা এতিম ভাইঝি আছে৷ মেয়েটা বোধহয় গ্রামে থাকে নানির কাছে৷ আমি চাচ্ছিলাম মেয়েটাকে দেখে আসতে৷’

‘তুই কি বেশি পেঁকে গেছিস মিথি! ইদানীং আম্মার মতো আচরণ করিস৷’

ভাইয়া কিছু টা তপ্ত গলায় বললো৷ কিন্তু আমি আদতেই সেসব পাত্তা দিচ্ছি না৷ আজকে সত্যি সত্যি আমার মন ভালো৷ ভালো হবার কারণ কিছু জল্লাদ আবারো ধরা পরেছে৷

.
চারদিকে সাঁঝ ছড়িয়ে পরতেই ভাইয়া একটা লোকের সাথে বাসায় ঢুকলো৷ লোকটাকে এর আগে কয়েক দিন আদালত চত্ত্বরে দেখেছি৷ উনি বাসায় ঢুকতেই আমি অবাক হয়ে ভাইয়াকে ইশারা করে বললাম,

‘উনি এসেছেন কেনো!’

‘কেসের বিষয়ে আলোচনা করতে৷ তুই চা নাস্তা নিয়ে আয়৷’

আমি আর কথা বাড়ালাম না৷ রান্না ঘরে ঢুকলাম চা বানানোর উদ্দেশ্য৷ ভাইয়া আর উনি বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করছেন৷ আমি দশ মিনিট পর চা নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ভাইয়া বললো,

‘মিথি তুই এখানে বস৷ অনেক দরকারী আলোচনা আছে৷’

আমি বিনাবাক্য বসে পরলাম৷ লোকটা আমাকে দেখে একবার চোখ তুলে তাকালো৷ দৃষ্টি গভীর৷ আমি কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম৷ উনি চোখ নামিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘তোমার বয়স কতো?’

‘জ্বী৷ উনিশ বছর৷’

‘বুঝলেন আশরাফ সাহেব আপনাদের দলিলপত্র আমি ঘাটাঘাটি করেছি৷ আর আমার এক বন্ধু ভূমি মন্ত্রালায়ণে আছে ও বলেছে আপনার বাবা মাত্র পাঁচ শতাংশ জমির মালিক৷ আর বাকি পঁয়ত্রিশ শতাংশের মালিক আপনার আম্মা৷ উনি মৌখিক ভাবে জমি বিক্রি করেছেন৷ কিন্তু যেহেতু আপনার আম্মা মৃত তাহলে ওয়ারীশ সূত্রে সেই মালিকানা আপনারের উপর বর্তিত হয়েছে৷ আপনার আব্বা শুধুমাত্র পাঁচ শতাংশ রেজেস্ট্রি করে দিতে পেরেছেন৷ বাকিটা স্ট্যাম্পে উল্লেখ করেছেন যে দিবেন৷ তাই আপনারা এখনো আপনার আম্মার জমি গুলার মালিক৷ কারণ আপনার নানা জীবিত নেই৷ উনি জীবিত থাকলে মালিকানা উনার নিকট হস্তান্তর হতো৷’

‘তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমারা মালিকানা পাবো আবার!’

ভাইয়া কিছুটা অবাক হয়ে বললো৷ লোকটা গম্ভীর চিত্তে বললো,

‘পাবেন৷ আপনার আব্বা এবং আপনার খালার নামে প্রতারণার মামলা করবেন সর্বপ্রথম৷ বাকিটা পরে আলোচনা করবো৷’

‘উনারা অলরেডি জেলে পঁচে ম’রছে৷’

আমি লোকটার কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বললাম৷ লোকটা হাসলো৷ ধীর কন্ঠে জবাব দিলো,

‘অপরাধ করলে তো শাস্তি পাবেই৷’

‘এইগুলার জন্য ছোটাছুটি করা লাগবে৷ আপনি তো জানেন আমার বোন একা থাকে৷ এরপর মন মানসিকতা বা টাকা পয়সা ও এতো নেই৷’

ভাইয়ার কথায় লোকটা অসন্তুষ্ট হলেন৷ এরপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘তোমরা আসলেই বোকা৷ দুনিয়া কি এতোই সহজ!একটু চালাক হোও৷ আমি তো তোমাদের পাশে আছিই৷ টাকা পয়সা হাতে আসলে দিয়ে দিবা৷’

লোকটার কথায় ভাইয়া আশ্বস্ত হতে পারলো না৷ তবে লোকটাকে বুঝতে না দিয়ে বললো,

‘আমি একটু ভেবেচিন্তে আপনাকে জানাচ্ছি৷ চা নাস্তা করেন আপাতত৷’

‘মিয়া যা করার দ্রুত করেন৷ দালালের অভাব নেই দুনিয়াতে৷’

লোকটা চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে খাচ্ছে৷ ভাইয়ার সাথে আরো নানা বিষয়ে আলোচনা করছে৷ ভাইয়া কিছুটা জোরপূর্বক সেই সব গিলছে৷ আমি উঠে চলে আসার জন্য পা বাড়াতে লোকটা বললো,

‘বোনের বিয়ে দিয়ে দেন৷ এরপর কিছুটা ঝামেলা মিটে যাবে৷’

‘আমার বোন আমার কাছে ঝামেলা না৷ ও আছে বলেই হয়তো দুনিয়াতে আমি বেঁচে থাকার শক্তি পাচ্ছি৷’

ভাইয়া একদম হড়বড় করে বললো৷ লোকটা এরপর কথা বাড়ালো না৷ উঠে চলে যেতে যেতে ভাইয়াকে জমির ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিলো৷

লোকটা চলে যেতেই ভাইয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো৷ আমাকে দেখে জোরে জোরে শ্বাস টেনে বললো,

‘কয়েকদিন যাবৎ আঠার মতো লেগে আছে৷ আক্কাস নাকি আব্বার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো৷ সেই সূত্র ধরেই সব জেনেছে৷ আমাদের উকিলের থেকে নাম্বার নিয়ে বাসায় আসলো৷ সবাই আসলে স্বার্থলোভী৷’

‘এখন উনি কি চায়!’

‘আক্কাসের থেকে দখলদারি সরিয়ে আমাদের টা আমাদের বুঝিয়ে দিবে৷ বুঝিস ই তো! টাকা পয়সার ব্যাপার৷ কামাই হবে কিছু৷’

আমি মৃদু হাসলাম৷ তবে ভাইয়া থেমে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

‘তবে লোকটা কিন্তু একটা পথ দেখিয়ে গেছে৷ আম্মার সম্পদের মালিকানা পেলে অনেকটা উপকার হবে৷ আমি রাফাতের সাথে এই ব্যাপারে কালকেই আলোচনা করবো৷’

‘দেখো কোনটা ভালো হয়৷ তবে আক্কাসের ত্রিশ লাখ টাকা কে শোধ করবে৷’

‘কেনো মিনু খালা৷ কারণ আমার জানামতে মহিলার কাছে এখনো পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে৷ আর ওইটা আমাদের ভাবতে হবে না৷ রাফাতের সাথে আগে কথা বলে দেখি৷’

ভাইয়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো৷ এই দায়িত্বশীল ভাইয়াকে দেখে আমার বেশ স্বস্তি মিলছে৷

.

বাড়ি ওয়ালি আন্টি বেশ অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ আমি অস্বস্তি বোধ করে নড়েচড়ে বসছি বারবার৷ উনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

‘তোমাদের কেউ নেই দেখে আমি নিজ দায়িত্বে ভাড়া দিয়েছি৷ কেউ দিতো!’

‘না আন্টি৷ গত আট মাসে আপনি বেশ খেয়াল রেখেছেন৷’

‘কিন্তু তোমরা তো আমার সাথে বেইমানি করছো৷’

‘এইটা কি বললেন!’
আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম৷ কারণ ভাড়া আমরা রেগুলার দিচ্ছি৷ গ্যাস,বা বিদ্যুৎ বিল নিয়েও ঝামেলা নেই৷ উনি আমার অবাক দৃষ্টি দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

‘আমার এতিম ভাইঝি র সাথে তোমার ভাইয়ের বিয়েটা হলে ক্ষতি কি! তোমাদের অভিবাবক নেই৷ এই অবস্থায় আশরাফকে মেয়ে দিবে কে?’

আন্টির কথায় আমার কিছুটা খারাপ লাগলেও আমি প্রকাশ করলাম না৷ তবে শান্ত কন্ঠে বললাম,

‘ভাইয়া অফিস আর কেসের ব্যাপারে অনেক ছোটাছুটি করছে৷ আপনি তো জানেন আমার আম্মার কেস তার উপর আবার জমির ব্যাপারে অনেক ঝামেলা যাচ্ছে৷ আপাতত ভাইয়া বিয়ে করতে চাচ্ছে না৷’

‘তোমাগো সব সমস্যা তোমার আঙ্কেল সমাধান করে দিবে৷ কিন্তু তোমরা দু ভাইবোন শুধু পালাই পালাই করো৷ কাউকে বিশ্বাস করছো না৷’

‘আন্টি নিজের আব্বা বিশ্বাস ভেঙেছে৷ এরপর আর কাকে বিশ্বাস করবো বলেন!’

আমার কথাতে আন্টি বেশ মর্মাহত হলেন৷ নরম কন্ঠে বললেন,

‘চিন্তা করো না৷ তোমার আংকেল খুবই ভালো মানুষ৷ উনি তোমাদের নিরাশ করবেন না৷’

‘ভাইয়া আসলে আমি এই ব্যাপারে কথা বলবো৷’

আমার কথাতে আন্টি সন্তষ্ট হলো না বোঝা গেলো৷ সে নিজ উদ্যোগে বললো,

‘থাক তোমার কষ্ট করতে হবে না৷ পরশু তো শুক্রবার! আমি নিজেই আশরাফের সাথে কথা বলবো৷’

আমি আর কথা বাড়ালাম না৷ এরপর উনি নিজ মন মতো বিভিন্ন আলাপ জুড়লেন৷ আমি হা হু করতেই উনি আবারো বিরক্ত হয়েই উঠে চলে গেলেন৷ উনি যেতেই আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন৷

.
সন্ধ্যা পেরুতেই ভাইয়া ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো৷ হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘রাফাত বললো দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে হবে৷ যেহেতু আমরা দখলচ্যুত হয়েছি তাই আমাদের মামলা করা সহজ হবে৷ আর প্রামাণ্য দলিল তো আমাদের কাছে আছেই৷’

‘তাহলে তো ভালোই৷’

‘কিছুটা ঝামেলা আছে৷’

ভাইয়া পরিশ্রান্ত ভাবে বললো৷ আমি বেশ চিন্তায় পরে গেলাম৷ জায়গা জমির ঝামেলা টা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন৷

চলবে…