বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে পর্ব-০১

0
1840

#বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

শায়লা চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন, ছেলেকে আবার বিয়ে করাবেন। ছেলে তার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বুয়েট থেকে পাশ করেছে। একটা প্রমিন্যান্ট কোম্পানীতে চাকরি করছে। বেতনও প্রায় লাখটাকার উপরে। শ্যামলীর রিং রোডে ছেলের বাবার পাঁচতলা বাড়ি আছে। ছেলেরা দু’ভাই। ছোটো ছেলে বরিশাল মেডিকেল কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ছে। শায়লা চৌধুরীর স্বামী আফজাল চৌধুরী পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সরকারী উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা। সব দিক থেকে শায়লা চৌধুরীর ছেলে শেজাদ চৌধুরীকে অনেক মেয়ের বাবাই জামাই হিসাবে পেতে চায়।
এমনকি ছেলের বাবাও আফজাল চৌধুরীও নিজের ছেলের নিয়ে বেশ গর্ব করেন। কিন্তু শায়লার কথা হচ্ছে তার ছেলে যেহেতু ডিভোর্সী সেক্ষেত্রে ছেলের খুঁত আছে। একারনে সেদিন বিকেলে ঘটককে বাসায় আসতে বলেন। এবং একটা ডিভোর্সী মেয়ের সন্ধান দিতে বলেন। ঘটকের সামনে আফজাল চৌধুরী চুপ থাকলেও চলে যাবার পর শায়লা চৌধুরীকে রেগে গিয়ে বলেন,
—-তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? ছেলেকে তুমি ডিভোর্সী মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাও?
শায়লা চৌধুরীও তেতে উঠে বললেন,
—মাথা আমার না তোমার খারাপ হয়েছে। একটা নিঁখুত মেয়েকে তুমি তোমার খুঁতযুক্ত ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছো?
আফজাল চৌধুরী নিজের গলাটা আরো একটু চড়িয়ে বললেন,
—এখন ও আমার ছেলেকে অনেক মেয়ের বাবাই তাদের নিঁখুত মেয়েকে দিতে চায়। এরকম প্রতিষ্টিত ছেলে কোথায় পাবেন তারা? ছেলের ভালো চাকরি, ঢাকায় নিজেদের বাড়ি গাড়ি সব আছে। আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো পুরুষের গায়ে কখনও কালিমা লাগে না। আর ঐ মেয়েটাতো নষ্টা চরিত্রের মেয়ে ছিলো।
শায়লা চৌধুরীও দমে যাবার পাত্রী নন। তাই উনিও যুক্তি দেখিয়ে বলেন,
—মেয়েটা নষ্টা ছিলো কি ভালো ছিলো সেটা সমাজ দেখবে না। সমাজ দেখবে তোমার ছেলে সংসারকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। যেমন একটা মেয়ের ডিভোর্স হলে সমাজ সিংহভাগ দোষ মেয়েটাকেই দিতে চায়। একজন ডিভোর্সী মেয়েকে যেমন সমাজ আঙ্গুল দিয়ে তার ডিভোর্সটাকে ত্রুটি হিসাবে দেখাতে চায় তেমনি ডিভোর্সী ছেলের ক্ষেত্রেও একই কথা শোভা পায়। সুতরাং আমি শেজাদের সাথে কথা বলে দেখবো, ও কি চায়?
একথা বলে শায়লা আফজালকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। ওজু করে এসে আসরের নামাজ আদায় করতে বসলেন।
আফজাল চৌধুরী এই বিষয়ে আর কোনো কথা বললেন না। নিজের স্ত্রীকে উনি ভালো করেই চেনেন। একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে তাকে ফেরানো যায় না।
তবে মনে মনে স্ত্রীর উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। কারণ সমাজে তার একটা স্ট্যাটাস আছে। তার ছেলের কিসে কম আছে যে তাকে ডিভোর্সী মেয়েকে বউ করে আনতে হবে?
শেজাদ অফিস থেকে ফেরার পর নিজের রুমে বসে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখছিলো। শায়লা চৌধুরী সন্ধার চা,টা নিয়ে ছেলের রুমের দরজায় নক করলেন। ভিতর থেকে শেজাদ বললো,
—-আম্মু ভিতরে আসো।
শায়লা চায়ের মগটা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে নিজের মগটা হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
—শেজাদ, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই,
—জানি তো কি বলবে,নিশ্চয় বিয়ের কথা বলতে এসেছো?
—হুম,
—-মেয়ে দেখতে পারো। এবার আমি তোমাদের পছন্দেই বিয়ে করবো।
শায়লা চৌধুরী ছেলের কথায় খুশী হয়ে বললেন,
— তোমার জন্য আমি ভাবছি ডিভোর্সী কিংবা বিধবা মেয়েকে বউ করে আনবো।
মায়ের কথায় শেজাদ যেন একটু অবাক হলো। কেননা অফিস থেকেও ওর জন্য অনেক ভালো ঘর থেকে অবিবাহিত মেয়েদের বাবারা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে মায়ের এহেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কি মানে হতে পারে? সেজন্য মা শায়লা চৌধুরীকে ও জিজ্ঞাসা করলো,
—-তোমার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণটা জানতে পারি কি?
—-অবশ্যই, কেন নয়? তুমি যখন একটা ফ্রেস মেয়েকে বিয়ে করবে ও তখন তোমাকে কখনও না কখন তোমার ডিভোর্স নিয়ে কথা বলবে কিংবা রাগের মাথায় খোঁটাও দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তোমার বৈবাহিক দাম্পত্য জীবন আবারও হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই মা হিসাবে আমি চাই না তুমি আবারও অসুখী হও। তাছাড়া একজন ডিভোর্সী কিংবা বিধবা মেয়েকে তুমি যখন বিয়ে করবে সে কখনই এই বিষয়টা তোমার সামনে তুলবে না। কেননা যে আগুনে তুমি একবার পুড়েছো মেয়েটিও সেই আগুনে পুড়ে তোমার কাছে এসেছে। সে কারনে ও কখনই তোমার ঐ প্রসঙ্গটা টেনে আনতে চাইবে না।
শেজাদ মায়ের যুক্তি মেনে নিয়ে বললো,
—-আমিও তোমার সঙ্গে একই মত প্রকাশ করছি। সুতরাং তোমার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।
শায়লা বেগম মনে মনে ছেলের উপর খুব খুশী হলেন। উনি প্রতি মুহুর্তে আল্লাহপাকের কাছে ছেলের জন্য দোয়া করেন। নেহার চলে যাবার পর ছেলেটা মানসিকভাবে বেশ ভেঙ্গে পড়েছিলো। পাঁচ বছরের সম্পর্ক দুবছরের সংসার জীবন ফেলে কিভাবে নেহার চলে গেল? আজও শায়লা চৌধুরী বুঝতে পারেন না কি এমন কারণ থাকতে পারে?ছেলেকে একদিন উনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে বলেছিলো,
—ওর সাথে থাকতে গেলে তোমাদের সবাইকে আমার ছাড়তে হবে। সেটা আমি পারবো না বলে ও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।
যাক যা হবার হয়ে গিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে উনি ছেলেকে পরিপূর্ণ সুখী দেখতে চান।
মা চলে যাবার পর নেহারের কথা শেজাদের মনে পড়লো। নেহার মাঝে মাঝে ওর গায়ে হাত তুলতো। সে কারনে শেজাদেরও রাগের পারদ বেড়ে যেতো। ও তখন নেহারের গায়ে হাত তুলতো। আসলে তখন শেজাদ যে চাকরিটা করতো সেখানে বেতন খুব একটা বেশী ছিলো না। হাজার পঞ্চাশ টাকা ও বেতন পেতো। প্রতিদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে পার্টি করা,বিভিন্ন রিসোর্টে ঘুরতে যাওয়া,দেশ বিদেশ ঘুরতে যেতে চাওয়া এসব ম্যানেজ করতে গিয়ে শেজাদকে হিমসিম খেতে হতো। প্রথম প্রথম শেজাদ কষ্ট করে ম্যানেজ করার চেষ্টা করতো। এরপর যতবার শ্বশুর বাড়িতে যাবে হাজার দশেক টাকার মিষ্টি ফল এসব নিয়ে যেতে হতো। না নিতে পারলে কানের কাছে ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো বাজাতো ওর মান সম্মান নাকি বাবার বাড়িতে ধুলায় মিশে গেল। ওরা যে খুব বড়লোক ছিলো তা নয়। বাপ চাচারা মিলে মিরপুর এক নাম্বারে পাঁচতলা বাড়ি বানিয়েছিলো। নেহার খুব শোঅফ করতে পছন্দ করতো। এসব নানাবিধ কারণে শেজাদ বছরে একবার কিংবা দুবারের বেশী শ্বশুর বাড়ি যেতে চাইতো না। এসব নিয়ে নেহার নিত্য অশান্তি করতো। শেজাদ ওকে চাকরি করতে বললেই খেপে গিয়ে বলতো,
—-বউয়ের কামাই খাওয়ার এতো শখ কেন? আমাকে যদি কখনও ইনকাম করতে হয় সেটাকার একটা কানা পয়সা তোমার সংসারে আমি খরচ করবো না। খরচ যদি করতে হয় সেটা করবো আমার বাবা মায়ের সংসারে। কথাটা মনে রেখো।
শেজাদ নিজে পছন্দ করে পাঁচ বছর রিলেশনের পর নেহারকে বিয়ে করেছিলো। তখন ঘূর্ণাক্ষরে বুঝতে পারেনি নেহার এরকম সংকীর্ণমনা মানুষ। আগে জানলে নিজের জীবনের সাথে জড়াতো না। আসলে ভুলটা শেজাদের বেশী। কেননা বিয়ের আগে নেহারকে নিয়ে প্রায় দামী রেস্টুরেন্ট গুলোতে খেতে যেতো। ওকে অনেক দামী শাড়ি থ্রিপিচ গিফ্ট করতো। কিন্তু বিয়ের পরে হয়ে গেল সমস্যা। নেহার বিয়ের আগে কালে ভদ্রে গিফ্ট পেলেই খুশী হতো। মাসে একবার ভালো রেস্টুরেন্টে খেলেই খুশী হয়ে যেতো। কিন্তু বিয়ের পর চাহিদা বেড়ে যায়। তখন প্রতিমাসে দামী শাড়ি নয়ত গহনা কিংবা সপ্তাহে দুতিনদিন দামী রেস্টুরেন্টে খাওয়া মাসে দু’একবার কোথাও ঘুরতে যাওয়া এরপর ফেসবুকে সুখী কাপলের ছবি দিয়ে সবাইকে দেখানো ও কত ভালো আছে। শেজাদ আর পেরে উঠছিলো না। তাই মাঝে মাঝে নেহারকে খুব রাগ দেখাতো। আর তখনি নেহার ক্ষেপে গিয়ে ওর গায়ে হাত তুলতো।
নাহ্ শেজাদ আর ওর বিষাক্ত অতীতকে মনে করতে চাইছে না। যে বিষাক্ত অতীত ওর সুকুমার বৃত্তকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। শেজাদের আজ মনে হয় এই পৃথিবীতে অনেকেই সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝে না। কারো কাছে সম্পর্কটা অনেকটা পান্তাভাতের মতো ফেলনা মনে হয়। ওরা স্বার্থপরের নিজের পাওনাটা কড়ায়গন্ডায় বুঝে নেয় আর সম্পর্কের অপর মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে অবহেলা করে সুন্দর সম্পর্কটার ভিত নষ্ট করে দেয়।

চলবে