#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_১
#মুমতাহিনা_তারিন
হাতে প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট নিয়ে বসে আছে তুলি । তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। এমন নয় যে সে অবিবাহিত সে বিবাহিত এবং তাঁর সন্তান ও বৌধ কিন্তু ওর ভয় লাগছে এই ভেবে যার পরিবার এখন ও তাকে বৌমা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি যেখানে তার স্বামীর মনে সে জায়গা করতে পেরেছে কিনা বুঝতে পারেনি সেইখানে এই বাচ্চার ভবিষৎ কি!!বাসার কাজের খালা রাহেলা বার বার তাকে সান্তনা দিচ্ছে । যদিও সে জানে না সত্যি বাচ্চাটার কি হবে! শুধু তুলিকে মুখের সান্তনা দিয়ে যাচ্ছে যাতে বেশি টেনশন না করে ।
“খালা আমার বাচ্চার কি হবে! নিজের তো ঠিকানা নেই সেইখানে এই বাচ্চার কি জায়গা হবে”
রাহেলার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ তারও চিন্তা হচ্ছে আদনান তুলিকে মানতে পেরেছে কিনা বোঝার উপায় নেই । ছেলে মানুষ নিজের চাহিদা মেটাতে তুলিকে কাছে টানলেও তার বাচ্চাকে মেনে নেবে কিনা কে জানে । দুই বছর তো বিয়ে হয়েই গেলো তবুও প্রয়োজন ছাড়া আদনান তুলিকে কাছে ডাকেনি । তার ঘরে প্রথম দিন জায়গা হয়েছিল তারপর বাসায় মেহমান আসলে শুধু জায়গা হয় । নিজের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ না করে নিজেকে সাভাবিক করলো রাহেলা ।
” তুই চিন্তা করিস না মা । আদনানকে তো বিশ্বাস করিস আর যতই হোক ওর তো বাচ্চা ফেলে দিতে পারবে না । এখন এতো চিন্তা করা ঠিক হবে না । চল বাসায় অনেক্ষণ হয়ে গিয়েছে ”
“হ্যাঁ ”
_______________
পাশের বাসার শিউলি আপুর সাথে সব কথা বলে তুলি । রোমানা আদনানের সাথেই পড়াশুনা শেষ করেছে তারপর নিজের ক্লাসমেট রোহানকে বিয়ে করে সে ।তাদের বিয়েতে কারোর কোনো আপত্তি ছিল না । রোহান ভালো ছেলে সাথে ভালো চাকরি করছে এখন। নিজের প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে আজকে সব বলেছে তুলি। শিউলি ওদের মধ্যকার সকল বিষয় সম্পর্কে অবগত।
” তুলি তুমি এইসব কি চিন্তা করছো! আদনান অবশ্যয় এই বাচ্চাকে খুশি মনে মেনে নেবে । ওর সমস্যা কি জানো ও একটু গম্ভীর কম কথা বলে । ও কিন্তু বাচ্চাদের খুব পছন্দ
করে তুমি ওকে নিশ্চিন্তে বলে দিবা। ”
” কিন্তু আপু ওনাকে দেখে তো কিছুই বুঝতে পারিনা । আমি ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে অনার্মন জয় করে নেবো । আমি জানি উনি আমাকে খুব ভালোবাসবে কিন্তু তার আগেই বাচ্চা…”
” আচ্ছা তুমি কি কোনোভাবে অখুশি বাচ্চা হবে ভেবে?”
” না না আপু বাচ্চা তো আল্লাহর অনেক বড় রহমত । আমার কি সেই সাধ্য আছে আল্লাহর রহমতে অখুশি হব। আরো প্রথম মা হবো অনেক ভালো লাগছে কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি ওর ভবিষৎ নিয়ে ,,,,,বাবা থাকা সত্বেও যদি আমার বাচ্চা বাবার ভালোবাসা না পায়।”
শিউলি অনেক ভাবে বোঝাল তুলিকে। ওকে সুন্দর ভাবে সেজে গুঁজে আদনানকে ওর প্রেগন্যান্সির কথা জানাতে বললো। তুলির মনে বাড়তে থাকা শঙ্কা স্থির হলো । সবধরনের চিন্তা ভয়কে সাইডে রেখে নিজেকে প্রস্তুত করলো ।
___________________
বছরে তিন থেকে চারবার সবাই এক জায়গায় জড়ো হয় আদনানের চাচা,, খালা মামারা দুইদিন যাবত আদনানের বাড়িতেই আছে । সবকিছু তুলি আর রাহেলা সামলাচ্ছে। রাহেলা বাকি সব কাজ করলেও রান্নার কাজ তুলির করতে হয় গত দুইবছর ধরে এইটাই হয়ে আসছে ।
সবাই ড্রয়িং রুমে বসে গল্পঃ করছে । তুলির রান্না বান্না শেষ আজকে সে মিষ্টি রঙের শাড়ী পরেছে । খুব বেশি শাড়ি তুলির নেই যা আছে তার অধিকাংশ রংচটা মলিন । গোনাগাঁথা তিনটে শাড়ি আছে। তার থেকে বেছে মিষ্টি রঙের শাড়িটা পরেছে।হাতে আদনানের অনিচ্ছাকৃত দেওয়া চুড়ি । এই চুড়ি থেকে আলাদা ভাবে সবসময় দুটো চুড়ি পরে থাকে তুলি । কানে দিয়েছে ছোটো এক পাথরওয়ালা কানের দুল।
দৌড়ে বেসিনের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল তুলি । নাহ খারাপ লাগছে না মিষ্টি হেসে নিজেই নিজেকে বললো ।
আদনান আসার সময় হয়ে গিয়েছে অধীর আগ্রহে বসে আছে তুলি । কলিং বেলের আওয়াজটা হতে না হতেই এক প্রকার ছুটে গেলো তুলি । দরজা খুলতেই দেখতে পেলো ডাগর চোখের অধিকারী অরোরা কে । বুকের ভিতর বাজতে থাকা ঢাক ঢোল যেনো একটু নিস্তেজ হলো ।
অরোরা আদনানের সাথেই বড় হয়েছে । তুলির সাথে অরোরার মোটামুটি ভালো সম্পর্ক।
” আপু তুমি!! কেমন আছো? কত দিন পরে আসলে আমাকে তো ভুলেই গেছো”
তুলি মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলো । অরোরা প্রতিউত্তরে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো –
” আরে না তোমাকে কি আমি ভুলতে পারি । নতুন শাড়ী চুড়ি ব্যাপার কি হুমম?”
তুলি লজ্জায় মুখ অবনত করলো।
” তেমন কিছু না আপু । আসলে উনার আসার সময় হয়ে গেছে তো । জানেন আপু তোমাকে দেখতে এক্কেবারে আমার খালাতো বোনের মত । তোমাকে দেখলেই তার কথা মনে পড়ে ।আপু আসো তো বসো তুমি আমি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসতেসি। ”
_______________
খুশি খুশি মনেই তুলি কফি বানিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলো । অরোরা চা খায় না তাই খুব যত্ন করেই তুলি কফি বানিয়েছে । ড্রয়িং রুমে আসতে না আসতেই আদরীর চড় পরলো তুলির গালে। হাত থেকে ছুটে গেলো কফির মগ । বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে তুলি চলটা জ্বলে যাচ্ছে।কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই যাবে তখন কয়টা ছবি ছুঁড়ে মারল আদরী।
গমগমে পরিবেশটা মুহূর্তেই নিরব হয়ে গেছে। রাহেলা ছাদে গিয়েছিল কাপড় আনতে ঘরের দুয়ারে তার পা আটকে গেলো । তুলি নীচ থেকে একটা ছবি উঠিয়ে হাতে নিল তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তুলির সাথে অন্য পুরুষের অন্তরঙ্গ অবস্থায় আছে সে ।
” আপা আমি এই লোক কে ….”
আবার ঠাস করে শব্দ হলো । তুলির কথা শেষ হতে না দিয়েই আদনানের আম্মু লিতুন রহমান তুলির গালে একটা চড় মারলেন। এবার আর টাল সামলাতে পারলো না তুলি নিচে পরে গেল । শিউলি তুলিকে উঠাতে আসতে গেলেই লিতুণ গর্জে উঠলো ।
” খবরদার শিউলি ওই নোং*রা বে*শ্যার বাচ্চাকে তুই স্পর্শ করবি না । অনেক সতী সাবিত্রী না!! কয় পুরুষের বিছানায় গেছে ঠিক নেই । আজকে যদি অরোরা এই ছবি গুলো ওর কীর্তিকলাপ না বলতো আমরা তো একে অবলা ভাবতাম ”
তুলির কান যেনো কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারলো না । ও মুখ তুলে অরোরার দিকে একবার তাকালো। অরোরা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে । মনে মনে একটা কথাই বলছে সে আমাকে মাফ করে দাও তুলি আমি বাধ্য ,,,আমাকে মাফ করে দাও।
নিরবতা ভেঙে আদরির বর মালেক বলে উঠলো –
” এই ন*ষ্টা মেয়েকে আর ঠাই দেওয়া যাবে না এইখানে । যাই হোক এইটা তো আর পতি*তাল*য় নয় । একবার আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলছিল এই মেয়ে এখন দেখছেন আম্মাজান কার চরিত্র কেমন ”
বিনা নোটিশে ঘোষণা হয়ে গেলো তুলির আর জায়গা এইখানে হবে না । পরিবারের কেউ প্রথম থেকেই তুলিকে সহ্য করতে পারতো না এখন তো একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে হাতের কাছেই । শুধু মাত্র সমাজের কথা চিন্তা করেই শেখ পরিবার তুলিকে ঘরে রেখেছিল তাও নামে মাত্র । তুলির নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় লাগছে বাপ মরার সাতদিনের মধ্যে ওর বিয়ে হলো । তারপর ওর মা অনেক অসুস্থ ভাইয়ের কাছে পরে থাকে । এখন যদি ও চলে যায় তাহলে ওর অবস্থা কেমন হবে!! তারপর আবার পেটে বাচ্চা ।চোখের পানি বাঁধ ভেঙে প্রবাহিত হচ্ছে , ইচ্ছা করে ও আটকাতে পারছে না তুলি।
রাহেলা খালা ও কান্নাকাটি করছে । আদনান নাকি সব শুনছে দরজায় দাড়িয়ে কিন্তু কিছু বলেনি । আদনান ও কি ওকে অবিশ্বাস করলো!!! নাকি যা ছিল সব শরীরের চাহিদা মাত্র! আর ভাবতে পারছে না তুলি । সকালেই চলে যেতে হবে ওর আদরী কাবিনের টাকা দিয়ে গেছে । তুলি কোনো কিছু না বলেই টাকা গুলো নিয়ে নিয়েছে নিজের সন্তান পৃথিবীতে আনতে হবে । তাকে আনতে গেলেও এই টাকাটা প্রয়োজন পড়বে এখন আত্মসম্মান দেখিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার সময় নয়। নিজের পেটে আলতো হাত বুলিয়ে চোঁখের পানি মুছে নিলো তুলি …..
চলবে,,,