বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
519

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী

এইচএসসি পরীক্ষার দশ দিন আগে কহু
‘ কুঞ্জছায়া ‘য় এসেছে। ওর ইচ্ছে ছিল হোস্টেলে থেকেই পরীক্ষা দিবে। কিন্তু ঐ বাড়ির কেউই কুহুর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি৷ তাই বাধ্য হয়েই কুহুকে এখানে আসতে হয়েছে।

সিক্তা, কুহু দুজনেই কোমড় বেঁধে পড়ছে। শুধু খাওয়ার সময় হলেই রুম থেকে বের হচ্ছে। তাহমিদ আজকাল বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে। কহু এই বাসায় আছে, ওকে প্রতিবেলায়ই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। আর কি চাই।

রাত বারোটা দশ। পড়তে পড়তে মাথা ধরেছে কুহুর। একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে ছাদে আসে। আজও ছাদের দরজা খোলা। তবে সেদিনের মত আজ ছাদ জুড়ে অন্ধকার ওঁত পেতে নেই। ভেতর থেকে উঁকি দেয় কুহু৷ ওর ভ্রু কুঁচকে আসে। তাহমিদ রেলিংয়ের কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।

” আমার ভবিষ্যতের বউ, এত রাতে ছাদে এসেছ কেন? এদিকে এসো। ”
কুহু যেই উঁকি দিয়েছে, ঠিক তখনই বলে তাহমিদ।
গুটিগুটি পায়ে তাহমিদের নিকট আসে কুহু।
” আপনি কি করে বুঝলেন, আমি এসেছি! ”
” তুমি আশেপাশে থাকলে ধরনের মিষ্টি গন্ধ আমার চারপাশে ভেসে বেড়ায়। যে গন্ধ জানান দেয়, তুমি এসেছ। বুঝতে পেরেছ, আমার শ্যামাঙ্গীনি? আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি কিন্তু। ”
” মাথা ধরেছে, তাই এখানে এসেছি। ”
” এই মেয়ে, এত রাতে ছাদে আসতে তোমার ভয় করেনা! আর মাথা ধরেছে, তাই আসলেই সুস্থ হয়ে যাবে? আজব! মেডিসিন নিয়েছ? ”
কুহু তাহমিদের কথার জবাব না দিয়ে বিরস বদনে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর নিরুত্তর থাকায় তাহমিদ বুঝে নেয়, ও মেডিসিন নেয়নি।
” চুপটি করে বসে থাক। আমি এক্ষুণি আসছি। ” কথাটা বলেই তাহমিদ ছাদ থেকে প্রস্থান করে।
কুহু ছাদে পেতে রাখা চেয়ারে বসে।

কিছুক্ষণ পর তাহমিদ পুনরায় ছাদে আসে। ওর হাতে একটা ট্রে। তাতে একটা পিরিচে দুইটা স্যান্ডউইচ, আরেকটা পিরিচে কয়েক টুকরা আপেল। আর দুইটা মগে কফি।
কুহু এসব দেখে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়।
” তারাতারি খেয়ে নাও। এগুলো শেষ করে মেডিসিন নিবা। ”
” আমার ক্ষুধা নেই। এখন কিছুই খেতে পারবনা। ” কুহু চোখমুখ কুঁচকে বলে।
” তোমার ক্ষুধা তার কি না, তা আমি জানতে চাইনি। আমি বলেছি, তুমি খাবে। ব্যাস। ”
” আমি একটা স্যান্ডউইচ খাই, আপনি একটা খান। বিশ্বাস করুন, দুইটা একসাথে খেতে পারবনা। ”
তাহমিদ কিছু না বলে একটা স্যান্ডউইচ নিজে নেয়, আরেকটা কুহুকে দেয়।
কুহু স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে বুঝতে পারে সেগুলো ঠান্ডা নয় গরম। তবে কি সে ফ্রিজ থেকে বের করে গরম গরম এনেছে!
স্যান্ডউইচ খেয়ে আপেল নিতে হয় কুহুকে। এবং ধীরে ধীরে সবগুলো শেষও করতে হয়। তাহমিদের জেদের কাছে কিছুতেই পেরে উঠেনা বেচারি। মেডিসিন নেয়ার পর নিস্তার মেলে ওর।

দুজন মানব-মানবী নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ঘেঁষে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
কুহু তাকিয়ে আছে সূদুর মহাশূন্যে। মহাশূন্যের অতল রহস্য ওকে সব সময়ই ভিষণভাবে টানে।
মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে মহাশূন্যের শূন্যতা।
এদিকে তাহমিদ যে ওকে এক দৃষ্টিতে দেখছে, সেদিকে নজরই নেই কুহুর।
তাহমিদ আজও জানেনা, এই মেয়েটাকে হঠাৎ করেই এত ভালোবাসল কেন!
এই মেয়ে কি জানে, তার জন্য সারা দুনিয়ার সাথে লড়তে দ্বিধা করবেনা ও? মেয়েটা কি অনুভব করতে পারে, ওর জন্য তাহমিদ এই মহাশূন্যের ন্যায় অসীম ভালোবাসা নিজের বুকে জমা রেখেছে? যে ভালোবাসায় কোন কামনা নেই। নেই কোন খাঁদ কিংবা সন্দেহ।
কিন্তু এই মেয়ে যে ধরা দিয়েও, দূরে পালায়! ও যে কি চায়, তা আজও বুঝতে পারেনি তাহমিদ। এত রহস্য কেন এই মেয়ের মাঝে! ঠিক যেন এই মহাবিশ্বের সমস্ত রহস্য এর মাঝে বিরাজমান।

” শ্যামাঙ্গীনি, আরও কত অপেক্ষা করাবে আমাকে? তোমার কি একটুও মায়া হয়না আমার জন্য? অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে বুঝি, আমিই শেষ হয়ে যাব। তবুও কি আমার অপেক্ষার পালা শেষ হবেনা? ”
তাহমিদের কথা শুনে চমকে তাকায় কুহু।
ঠোঁট কামড়ে, অসহায় চোখে চেয়ে আছে তাহমিদ। ওর এমন চাহনিতে কুহুর বুকের ভিতর দ্রিমদ্রিম শব্দ করছে। এমন মনে হচ্ছে, যেন এই শব্দ ধরনীর সব মানুষ শুনতে পাচ্ছে। এই বুঝি ঘুম ভাঙ্গলো সবার! শুকনো ঢোক গিলে কুহু। মনে মনে কথা গোছাচ্ছে।
” আমি আপনাকে অপেক্ষা করাচ্ছি! হঠাৎ আপনার এমন মনে হল কেন! ”
” অবশ্যই অপেক্ষা করাচ্ছ। লেখাপড়া শেষ করে তবে বিয়ে করবে। তোমার পড়া শেষ হতে কম করে ছয় বছর লাগবে। ততদিনে আমি বুড়োর খাতায় নাম লিখাব। কবে সংসার হবে, আর কবেইবা ছেলেমেয়ে হবে। তাদের মানুষ করব কবে। এ জন্মে আমার সংসার হবেনা। ”
তাহমিদের কথার ধরনে কুহু হেসে উঠে।
” আপনার নিজেরই তো পড়াশোনা শেষ হয়নি। এখনই সংসার করার এত শখ! আগে পড়াশোনা শেষ করুন। একটা চাকরি শুরু করুন। বাবা-মা ‘র যোগ্য ছেলে হয়ে উঠুন। নিজের রোজগার তাদের হাতে তুলে দিন। তারপর বিয়ে করার স্বপ্ন দেখবেন। ”
” বিশেষজ্ঞ ম্যাডাম আসছে আমাকে জ্ঞান দিতে। তোমার থেকে জ্ঞান কে চেয়েছে শুনি? আমার সংসারের স্বপ্নের বারোটা বাজিয়ে, সাধু সাজা হচ্ছে! ”
” আচ্ছা, যান আর জ্ঞান দিবনা। ”
” সত্যি কি তুমি সিদ্ধান্ত বদলাবানা! আমাকে এভাবে কষ্ট দিবা! এতটা নিষ্ঠুর তুমি শ্যামাঙ্গীনি! ”
তাহমিদের এই গলার আওয়াজ শুনলেই কুহু ভিষণ দূর্বল হয়ে পরে। কিন্তু ও যে নিরুপায়। এমনিতেই ফুপুর সংসারে এসে পরেছে। ফুপু-ফুপাই বাবা-মা’র দ্বায়িত্ব পালন করছে। তার ওপর যদি এখনই বিয়ের জন্য তাহমিদের সাথ দেয়, তবে আরেকবার তাদের বোঝা হতে হবে। তাহমিদ নিজেও স্টুডেন্ট। তার আরও দুই বছর লাগবে পাশ করে বের হতে। এসব ভাবলেই এখন বিয়ে করার সাধ মিটে যায় কুহুর।

” প্লিজ কুহু, একবার রাজি হও। আমি তোমাকে নিরাশ করবোনা দেখ। সব দ্বায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করব। দুনিয়াকে একজন ভালো সন্তান, ভালো স্বামী এবং আদর্শ বাবা হয়ে দেখাব। শুধু তুমি একটিবার আমার হাত ধর। ”
” আপনি এভাবে পাগলামি করছেন কেন! আগে নিজের পড়াশোনা শেষ করেন। তখন না হয় সব হবে। আমি বিয়ের পর দরকার হলে পড়াশোনা করব। ”
তাহমিদ বুঝতে পারে কুহু এখন কিছুতেই রাজি হবেনা।
” ওকে, তুমি যা চাও তাই হবে। আমার পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে, সেদিনই তোমাকে বিয়ে করে তবেই বাসায় ঢুকবো। মাত্র আর দুইটা বছর। ” তাহমিদ মুখে যতই বলুকনা কেন ও ভেতরে ভেতরে খুব করে কুহুকে চাচ্ছে।
” এখন নিজের রুমে যান। অনেক রাত হয়েছে। ”
” তুমি যাও, আমি কিছুক্ষণ পর যাব। ”
” না, আপনি এক্ষুনি যাবেন। একটা কথাও বলবেননা। ”
কুহুর কথার মধ্যে একটা অধিকারবোধ টের পায় তাহমিদ। নিমেষেই ওর ঠোঁটের কোনে হাসি খেলে যায়।
” কি ব্যাপার বউ বউ ফর্মে চলে গেছ মনে হচ্ছে! বিষয়টা মন্দ লাগছেনা। দুই বছর পরের শাসন, দুই বছর আগেই করছ! একটা সুখ সুখ অনুভূতি বুকে ধা’ক্কা মা’র’ছে গো, বউ। আমার মিষ্টি, বউ। এত সুখের জীবনও হয় বুঝি! তুমি সামনে আসতেই এত সুখ! যখন আমার রুমে থাকবে, সারারাত বুকে করে রাখব, অনেক ভালোবাসব, তখন না জানি কত সুখ হবে। ”
তাহমিদের এমন নির্লজ্জ রকমের কথা শুনে কুহু এক দৌড়ে নিচে চলে আসে।
কুহুর এরূপ কান্ডে হো হো করে হেসে উঠে তাহমিদ। এরপর নিচে আসে।

কায়েস কয়েকদিন থেকে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। টুকটাক দেখভাল করছে। আসলে বাড়িতে বসে থেকে শিউলির মুখ দেখতে তার ইচ্ছে করেনা। তাই ধীরে ধীরে আবার নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করছে।

শিউলি দুপুরের রান্নার আয়োজন করছে। আজ সকালে দৃষ্টি ফোন করেছিল। সবুজ নাকি বলেছে, কি একটা কাজে আজ এখানে আসবে। তাই বাহারি রান্নার জোগাড় করছে শিউলি। ফাঁকা বাড়িতে মনের আনন্দে কাজ করছে সে।
শিহাবও স্কুলে গেছে। এতে বেশ সুবিধাই হয়েছে শিউলির। কায়েসও জানেনা সবুজ আসবে। আবার শিহাব স্কুল থেকে ফেরার পূর্বেই যদি সবুজ চলে যায়, এতে কেউ জানবেওনা ও এসেছিল। এমনিতেই শিহাব খুব একটা পছন্দ করেনা সবুজকে। এখন পর্যন্ত সবুজের সাথে কথা বলেনি ছেলেটা।
শিউলির রান্না শেষ হতেই সবুজের আগমন ঘটে। হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাসিমুখে বাড়িতে ঢোকে।
শিউলি সবুজকে দেখেই একগাল হেসে এগিয়ে আসে।
মেয়ের জামাইকে আদর করে ঘরে এনে বসায়। একটু পর সবুজের সামনে নাস্তার পাহাড় নিয়ে হাজির হয় শিউলি।

এক টুকরা আপেল মুখে দিয়ে কথা বলে সবুজ।
” আম্মা, আমার আব্বা একটা কাজ দিয়ে পাঠালো। আপনি রাজি থাকলেই হবে। ”
” কি কাম, বাজান? আর তোমার আব্বা-আম্মায় কিমুন আছে? ”
” তারা সবাই ভালো আছে, আম্মা। আপনি জানেনই তো, চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে আমার আব্বা অনেককেই সরকারি ভাতার কার্ড করে দিতে পারে। প্রয়োজনমত কার্ড দেবার পরও আব্বার কাছে কয়েকটা কার্ড সব সময়ই থাকে। সেগুলো নিজের আত্মীয়দের দেয়। সেদিন দৃষ্টি বলল, ওর নানী, মামাদের কথা। আমি আব্বাকে বলেছি সে বিষয়ে। কিন্তু আব্বা বলল, তারা অন্য ইউনিয়নের বাসিন্দা তাই সরাসরি তাদের কার্ড করে দিতে পারবেনা। পরে আমি দৃষ্টির সাথে আলোচনা করে বের করেলাম, যদি আপনার নামে কার্ড করি, তাহলে হবে। ” সবুজের কথা শুনে আগলাদে গদগদ হয়ে যায় শিউলি।
দুইদিন হয়েছে বিয়ের, অথচ শিউলির মা, ভাইদের জন্য কত চিন্তা করছে!
” আমার কি করন লাগবো, বাজান? কিন্তু আমিতো হেইসব জিনিস পত্তর আনবার যাইতে পারুমনা। তোমার শ্বশুর জানলে আমারে মা’ই’রা ফালাইবো।
” আপনার কিছুই করতে হবেনা। শুধু একটা ফর্ম পূরণ করে দিবেন। আর বাকি কাজ আমিই করব। আর জিনিসপত্রগুলোও আমি তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করব। আব্বা কিছুই জানবেনা। ”
” কিন্তু, বাজান, আমি ফর্ম পূরণ করবার জানিনাতো। ”
” আচ্ছা, আম্মা আমিই সব ঠিক করে দিব। আপনি শুধু সই করবেন। আপনি সই করতে পারেন তো?”
” হ, নাম লেখবার পারি। ”
” তাহলে এখানে সই করে দেন। বাকিটা আমি পূরণ করছি। ” সবুজ পকেট থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে শিউলিকে দেখিয়ে দেয় কোথায় কোথায় সই করতে হবে। শিউলি সবুজের কথামত সই করে দেয়।

দুপুরের খাবার খেয়ে বিদায় নেয় সবুজ। সবুজ বিদায় নিতেই শিউলি ফোন করে দৃষ্টির কাছে। মেয়েকে সবটা জানায়। দৃষ্টি বলে ওর শ্বশুরের সাথে আলোচনা করেই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসলে দৃষ্টি খুব করে চায় ওর নানী, মামারা ভালো থাকুক।

চলবে…

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী

কুহুর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে চারটা পরীক্ষা হয়েছে। এবং সব-কয়টা পরীক্ষাই কুহুর খুব ভালো হয়েছে। কুহুর পরীক্ষার কেন্দ্র অনেকটা দূরে, তাই ওকে দুইদিন পৌঁছে দিয়েছে তাহমিদ আর দুইদিন গিয়েছে তাহমিনা আক্তার। সিক্তার সাথে যান আফরোজা নাজনীন সিক্তার পরীক্ষার কেন্দ্র আরও দূরে।

কুহু আর সিক্তা মনযোগ দিয়ে পড়ছে। এমন সময় রুমে তাহমিদের আগমন । কুহু তাহমিদকে দেখেও চুপচাপ পড়তে থাকে।

” কি রে, বুঁচি পড়াশোনা কেমন চলছে? ভালো করে পড়। রেজাল্ট ভালো না হলে মহাখালীর কোন বাদামওয়ালার গলায় ঝুলিয়ে দিব, বুঝলি? ” সিক্তার মাথায় চা’টি মে’রে বলল তাহমিদ৷ এরপর পা ঝুলিয়ে বসল সিক্তার খাটে।
” সত্যি করে বলতো, ভাইয়া। তুমি কি আমার পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে এসেছ, নাকি কুহুরটা জানতে এসেছ? কুহুর বিষয়ে জানতে চাইলে আমার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট না করে ওকেই জিজ্ঞেস কর। ” সিক্তা কাটকাট জবাব দেয়। সিক্তার জবাব শুনে তাহমিদ মাথা চুলকে হাসে।
” কুহু রে, আমাদের রুমে মেহমান এসেছে। তাকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করি বলতো? এ আবার যে সে মেহমান নয়। ডাক্তারী পড়ুয়া মেহমান। তারউপর আবার তোর হবু জামাই। ”
” সত্যিই কিছু খাওয়াবি! তাহলে এক কাজ কর, রান্নাঘরে ট্রে-তে নুডলস রাখা আছে, নিয়ে আয়। চটজলদি যা, নইলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে সিক্তার মুখ হা হয়ে গেছে।
” রান্নাঘরে নুডলস রাখা আছে, তা তুমি জানো, সেটা তুমি না নিয়ে এসে আমাকে আনতে বলছ! ”
” ঐ যে বললি, আমি মেহমান। মেহমান কি নিজের খাবার নিজেই বয়ে নিয়ে আসবে? বোনের হবু জামাইকে সম্মানের এই নমুনা! ”
সিক্তা তাহমিদের কথার সাথে পেরে না উঠে দুপদাপ পা ফেলে নিচে যায়।
সিক্তা চলে যেতেই তাহমিদ খাট থেকে নেমে আসে কুহুর কাছে।
” রাতে আমি ছাদে অপেক্ষা করব। ঘুমানোর আগে একবার এস। আর হ্যাঁ এতটুকু সময় মনযোগ দিয়ে পড়বা বুঝলে। জামাই ছাদে ডেকেছে বলেই উতলা হতে হবেনা। ”
” আমি ঘুমাবো রাত একটার পর। আপনি তখন ছাদে থাকবেন! ”
” সেই চিন্তা তোমার করতে হবেনা। তুমি শুধু ছাদে আসবা। ব্যাস। ” তাহমিদ কথা বলতে বলতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
” আর হ্যাঁ, সিক্তা নুডলস আনলে খেয়ে নিও। জীবনে প্রথমবার বানিয়েছি, খারাপ লাগলেও কষ্ট করে খেয়ে নিও। ” কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় তাহমিদ।
কুহু তাহমিদের যাওয়ার পানে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। ওর কতটা খেয়াল রাখে মানুষটা! যাকে তার মা, বড়মা এখনও মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, সেই মানুষই আজ ওর জন্য নুডলস বানিয়েছে! এত ভালোবাসা যে ওর ভাগ্যে ছিল, তা ভাবতেই কুহুর দু-চোখ বেয়ে অশ্রুধারা বইছে।

সিক্তা রুমে এসে দেখল কুহু পড়ছে, কিন্তু তাহমিদ সেখানে নেই।

” কুহু, ভাইয়া কই রে? ”
” সে তো চলে গেছে। ”
” কি! আমাকে নুডলস আনতে বলে সে হাওয়া! ”
কুহু লক্ষ্য করল ট্রে-তে তিনটা বাটিতে নুডলস রাখা আছে।
” সিক্ত, এক কাজ কর, তোর ভাইয়াকে তার রুমে গিয়ে তার ভাগেরটা দিয়ে আয়। ”
” বাপরে প্রেম! আমার ভাইয়ের জন্য কত চিন্তা করিস তুই, কুহু। তোদের প্রেম দেখছি যাকে বলে মাখোমাখো সেরকম। ”
কুহু বেশ জানে, এখন সিক্তার কথার উত্তর দিলেই সিক্তা আরও খোঁচাবে। তাই সে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
সিক্তাও হেসে ট্রে-তে করে একটা বাটি নিয়ে তাহমিদের রুমের দিকে যায়।

কুহু নুডলসের একটা বাটি নিজের কাছে এগিয়ে নেয়। ওর ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি। ওর জন্য তাহমিদ কষ্ট করে নুডলস রান্না করেছে ভাবলেই বুকের ভিতর হাজারও প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ছে।
কাঁটা চামচে নুডলস পেঁচিয়ে নিয়ে মুখে দেয় কুহু।
স্বাদটা নেহাৎ মন্দ লাগছেনা। খুব একটা ঝাল দেয়নি। আচ্ছা মানুষটা কি জানে আমি ঝাল খেতে পারিনা?

রাত বারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে কুহু ছাদে আসে। আলোকিত ছাদে পা দিতেই দেখল, তাহমিদ হাসনাহেনা গাছের পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়ছে। সামনে রাখা আরেকটা চেয়ারে পা তুলে রেখেছে। কুহুর পায়ের শব্দ পেয়ে তাহমিদ পেছনে তাকায়। কুহুকে দেখে চেয়ার থেকে পা নামায়। কুহু তাহমিদের কাছে না গিয়ে, রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। তাহমিদও মুচকি হেসে সেদিকে পা বাড়ায়।

” ভবিষ্যতের বউ, তুমি যে বলেছিলে একটার পর ঘুমাবা? এখনও তো একটা বাজেনি। তবে কি আমাকে না দেখে থাকতে পারছিলেনা! ” তাহমিদের নেশা জড়ানো গলা শুনে কুহুর বুক ঢিপঢিপ করছে। হাজারও কথা ঠোঁটের আগায় এসে আটকে গেছে। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলতে গেলেই, তাহমিদ পুনরায় বলে উঠে,
” এভাবে বারবার আমার সামনে ঠোঁট ভিজাবানা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হয়। নাকি ইচ্ছে করেই এমনটা কর? আমাকে আরও কাছে টানতে! ”
” ছিহ্ কিসব অশ্লীল কথাবার্তা বলছেন। একটুও লজ্জা নেই আপনার! বেশরম মানুষ একটা। ”
” তোমার কাছে কিসের লজ্জা! তুমি কি আমার পাশের বাড়ির ভাবি! নাকি বউয়ের বড় বোন! তুমি হলে আমার একটামাত্র বউ। তোমার সাথে লজ্জার কোন সম্পর্ক আমার নেই। তাই একটুআধটু অশ্লীল কথাবার্তা বলতেই পারি। ” তাহমিদের অকপট জবাব শুনে থ হয়ে যায় কুহু৷

কুহু কিছু বলার আগেই নিচে বসে পরে তাহমিদ। কুহুর ডান পায়ের সালোয়ার একটু উঁচু করে, কুহুকে ইশারা করে ধরতে। কুহু স্তম্ভিত বদনে সালোয়ার উঁচু করে ধরে।
কুহু বুঝতে পারছে তাহমিদ ওর পায়ে কিছু একটা পরিয়ে দিচ্ছে। একটু ঝুঁকে তাকাতেই বুঝতে পারল, নুপুর পরিয়েছে মানুষটা। তাহমিদের এমন কাজে স্বলাজ হাসিতে উদ্ভাসিত হয় কুহর মুখাবয়ব। ততক্ষণে বাম পায়ে নুপুর পরাতে শুরু করেছে তাহমিদ।

” এই যে, লজ্জাবতী। এবার চোখ খুলে চাও দেখি। তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছ, তোমার হাজার রূপে আমাকে ঘা’য়ে’ল করবার! তুমি জানোনা তোমাকে যেই রূপেই দেখি, তাতেই আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে যায়। তোমাকে কাছে পেতে বড্ড ইচ্ছে করে। ”
” আপনি এভাবে বললে, আমি আর কখনোই ছাদে আসবনা বলে দিলাম। শুধু আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেন। ”
” এই যে কানে ধরলাম। আর কখনোই তোমাকে আমার আবেগের কথা বলবনা। তবুও ছাদে আসতে না করোনা প্লিজ। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম একটা রোবটকে ভালোবেসেছি। ”
” আপনার বানানো নুডলস খুব টেষ্টি হয়েছিল। ধন্যবাদ এত মজার নুডলসের জন্য। ”
” সত্যিই তোমার ভালো লেগেছে! নাকি নেক্সটে আমার বানানো নুডলস খাওয়ার ধান্দা করছ? সেজন্য ধন্যবাদ দিচ্ছ? তবে এখন আর নুডলস বানিয়ে খাওয়াতে পারবনা। আমার পরীক্ষা কয়েকদিন পর থেকে। একবারে বিয়ের পর আবার আমার বানানো নুডলস খেতে পারবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। এই ব’দ ছেলেকে প্রশংসা করলেও উল্টা বুঝে।
” এমন ভাব করছেন যেন, আপনার বানানো নুডলসের জন্য আমি হা হুতাশ করছি! আর কিছু বলবেন? আমি ঘুমাতে যাব। ” গাল ফুলিয়ে বলে কুহু।
তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেয়েটা রে’গে গেছে। আচমকাই তাহমিদ কুহুর হাত ধরে টান দিয়ে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।
” রা’গ করলে আমার বউকে দেখি আরও এট্রাকটিভ লাগে! আমি নিষেধ করেছি না আমার সামনে এসব রূপ দেখাবানা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। ”
তাহমিদের এরূপ কাজে কুহু চুড়ান্তমাত্রায় চমকে গেছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছেনা, শুধু বড়বড় চোখে তাকিয়ে আছে।

তাহমিদ অনুভব করল কুহু বেশ কাঁ’প’ছে। মেয়েটার চোখমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। ও ঝটপট হাতের বাঁধন আলগা করে। কুহুকে ছেড়ে দিতেই মেয়েটা শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারায়। হুড়মুড়িয়ে পরে যেতে লাগলে তাহমিদ ওকে ধরে নেয়।

” রিল্যাক্স, আমি শুধু তোমাকে জড়িয়েই ধরেছি। আর কিছুই করিনি। তুমি না চাইলে তোমার কয়েক হাতের মধ্যে আমি আসবনা। তবুও এভাবে ভয় পেওনা। ” তাহমিদও একটু ভয় পেয়েছে। সামান্য জড়িয়ে ধরতেই এই অবস্থা!

কুহু একটু স্বাভাবিক হলে ওকে নিচে পাঠিয়ে দেয় তাহমিদ।

পরদিন কুহু একটিবারও তাহমিদকে দেখেনি। সেই সকাল থেকেই তাহমিদকে দেখবার জন্য ওর ভেতরটা ছটফট করছে। বেশ কয়েকবার তাহমিদের রুমের সামনে যেয়ে উঁকিঝুঁকি মেরেছে। কিন্তু ভেতর থেকে তাহমিদের কোন সাড়া পায়নি। এদিকে কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছেনা। কুহু ভেবেছে গতরাতের ঘটনায় তাহমিদ ওর ওপর রা’গ করেছে। এক পা দু পা করে কুহু দিদুনের রুমে আসে। এটাসেটা গল্প করতে করতে দিদুনকে তাহমিদের কথা জিজ্ঞেস করে। দিদুন জানায় আজ সকালেই তাহমিদের ক্লাস আছে। তাই সাতটার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছে। আসতে আসতে অনেক রাত হবে। দিদুনের কথায় কুহু হাঁফ ছাড়ে।

রাতে তাহমিদ কখন এসেছে, তা কুহু বলতে পারেনা। সকালে ডাইনিং টেবিলে তাহমিদকে দেখে। সে মহাশয় আপনমনে খেয়ে চলছে। অবশ্য তার বাম হাতে একটা বই রয়েছে। সে পড়ছে আর খাচ্ছে। একবারের জন্যও সে কুহুর দিকে তাকায়না। এতে কুহুর মন বেশ খারাপ হয়।
কুহু চুপচাপ অর্ধেক পরোটা খেয়ে উঠে যায়। সোজা এসে দাঁড়ায় দোতলার ঝুল বারান্দায়। কুহু এখানে নানান রকম ফুল গাছ এনে রেখেছে তাহমিনা আক্তারের সাথে মিলে।
একটা টবে ফুটে আছে সুগন্ধিযুক্ত সাদা লিলিয়াম। ফুলের গন্ধে বারান্দা ম ম করছে। কিন্তু লিলিয়ামের সুবাস আপাতত কুহুর মনকে শান্ত করতে পারছেনা। ওর মনে ঘরে তাহমিদ ঘুরঘুর করছে। সে কি সত্যিই কুহুর উপর রাগ করেছে!

” না খেয়ে চলে আসলে যে? সিনিয়র রাশেদিনের টাকা বাঁচাচ্ছ নাকি! তাহলে ভুল করবে। সে ভদ্রলোক অনেক টাকার মালিক। তুমি প্রতিদিন একটা করে রুটি কম খেলে, বছর শেষে তার বিরাট অর্থের এক আনাও কমাতে পারবেনা। ”
কুহু তাহমিদের কথা শুনে হ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকে।
তাহমিদ একটা প্লেটে করে দুইটা পরোটা, মাংস ভুনা আর সেমাই এনেছে।
” এদিকে এস। ”
কুহু বাধ্য মেয়ের মত তাহমিদের নিকট আসে।
” বস। ” নিজে একটা চেয়ারে বসে, কুহুকেও বসতে বলে।
কুহু চুপচাপ তাহমিদের নির্দেশমত কাজ করে।

” তুমি কি নিজের হাতে খাবে? নাকি আমাকে খাইয়ে দিতে হবে? ”
” আমার ক্ষুধা নেই। ” মলিন মুখে বলে কুহু।
” আমিতো জানি তোমার ক্ষুধা আছে কিনা। তারাতারি খেয়ে নাও সোনা পাখি। আমার ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে। তুমি না খেলে আমি যেতে পারছিনা। ”
” আপনি আমার ওপর রা’গ করে নেই! ”
” কেন! তুমি কি চাও আমি তোমার সাথে রা’গ করি! হাহ্ রাতে যে খেল দেখিয়েছ, আমি রা’গ ভুলে পারলে ভয়ে মায়ের পেটে ঢুকে যাই। তবে গতরাতে তওবা করেছি, তোমার সাথে একান্তে কথা আর নয়। কখন যে আমাকে ক’ল’ঙ্কে’র সাগরে ডু’বি’য়ে মা’র’বে সেই ভয় হচ্ছে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু লজ্জায় মাথা নিচু করে।

চলবে….

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী

আজ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কুহু, সিক্তা দুজনেই হাত-পা ছড়িয়ে ঘুম দিচ্ছে। আজ থেকে আগামী কয়েকদিন শুধু ঘুম আর ঘুম।
মাগরিবের আজান কানে আসতেই কুহু উঠে বসে। সিক্তাকে অনেক ডেকেও ঘুম থেকে জাগাতে না পেরে, অজু করে নামাজ আদায় করে। এরপর নিচে আসে দিদুনের কাছে। তাহমিনা আক্তার এবং আফরোজা নাজনীন মিলে রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন। কুহুও এসে তাদের সাথে হাত লাগায়।
ওদের কাজের মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। আফরোজা নাজনীন কুহুকে বললেন দরজা খুলতে।
কুহু দরজা খুলেই দেখল আনান হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

” কি রে, তাহমিদ ভাইয়ের বউ ভাবি, কেমন আছিস? বিয়ের আগেই শ্বশুর বাড়িতে বউমার আদর খাচ্ছিস! এমন কপাল কয়জনের হয়! ”
” ভাইয়া, তুমি এসেই শুরু করেছ! আবার আমাকে ভাবি ডাকছ! তোমার পা’গ’ল হতে আর দেরি নেই। ”
” সাধে কি আর তোকে ভাবি ডাকছি। তোর সেয়ানা হবু জামাই, আমি তোর বড় জানা স্বত্বেও সম্মান দিতে চায়না। আবার ছোট বোনকে যে তার হাতে তুলে দিতে চাই এ উপলক্ষে কোন ট্রিটও দেয়না। কথায় কথায় বেকায়দায় ফেলে। তাই তাকে শায়েস্তা করতেই এই নিনজা টেকনিক এ্যাপ্লাই করতে হচ্ছে। এখন থেকে তুই আমার ভাবি। যখন ইচ্ছে তোর কাছ থেকে ট্রিট আদায় করব। তার প্যাঁচে, তাকেই ফেলব। এখন সামনে থেকে সর। আর যা আমার জন্য ঠান্ডা লেবুর শরবত করে আন। ” কুহুকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আনান ভেতরে ঢোকে।
কুহু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে আনানের দিকে।

আনান নিচে কিছুক্ষণ খালামনির সাথে কথা বলে উপরে আসে। উপরে উঠেই প্রথমে উঁকি দেয় তাহমিদের রুমে। কিন্তু পুরো রুম জুড়ে সুনশান নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
এরপর আনান সোজা আসে সিক্তার রুমে। সিক্তা তখনও ঘুমে বিভোর।
আনান এদিক-ওদিক তাকিয়ে এক টানে সিক্তাকে তুলে বসায়। হঠাৎ এভাবে হ্যাঁচকা টান খেয়ে সিক্তার মাথা ঘুরে উঠে।

” এই কোন আপদ রে, এভাবে ঘুম ভাঙালি? ” বলেই সিক্তা আবার শুয়ে পরে।
” আমি তোর ঘুম ভাঙ্গাইলাম রে , ভুঁড়িওয়ালা বাপের ত্যাঁদড় মেয়ে। পরীক্ষা যেন দুনিয়ার আর কেউ দেয়না। ” আনানের গলা শোনা মাত্রই ঝট করে চোখ খোলে সিক্তা।
” এই অ’স’ভ্য ছেলে, তুমি এখানে এসেছ কেন! আমার বাড়িতে এসে, আমার বাবাকেই ইনসাল্ট করছ! তোমার এত বড় সাহস! ”
” তোর বাপের বাড়িতে এসেই তাকে ইনসাল্ট করব। তোর কোন সমস্যা? ”
” আমি বাবাকে ডাকব বলে দিচ্ছি। অ’স’ভ্য ছেলে। নিজের শুটকো বাপের কথা চিন্তা না করে, আমার বাবাকে নিয়ে পরে আছে। ”
” ঐ, আমার বাবাকে কি বললি? দাঁড়া আজকে তোর হচ্ছে। ” আনান সিক্তার চুল টেনে ধরে।
সিক্তা ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।
” একশো বার বলব শুটকো, শুটকো, শুটকো। তোমার বাপ একটা শুটকো। যতক্ষণ আমার চুল না ছাড়বে, ততক্ষণ বলতেই থাকব। ”
” বে’য়া’দ’ব মেয়ে, নিজের শ্বশুরকে কেউ এভাবে বলে! শ্বশুরকে সম্মান দিতে জানিসনা আবার নিজের ভুঁড়িওয়ালা বাপের সম্মান আশা করিস? ”
আনানের কথা শুনে সিক্তার মাথা হ্যাং হয়ে যায়। হা করে তাকিয়ে থাকে আনানের দিকে।
” কি বললে তুমি? কে, কার শ্বশুর? ”

আনান হঠাৎ করেই হুঁশে এলো। ঝগড়ার মাঝে কি বলেছে ভাবতেই চোখ বুজে আসে। সিক্তা আনানের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে, উত্তর শোনার আশায়।
আনান ঘাড় চুলকে অপ্রস্তুত হাসে।

” আমার বাবা, তোর শ্বশুর। তোর একমাত্র বরের একমাত্র বাপ। এবার বুঝেছিস, তোর শ্বশুরের একমাত্র ছেলের বউ? নাকি আরও ডিটেইলস বলতে হবে? ”
আনানের ঠোঁটকাটা কথা শুনে সিক্তা কি অনুভূতি প্রকাশ করবে বুঝতে পারেনা। তবে ও লক্ষ্য করল হঠাৎ করেই সামনের ছেলেটাকে বেশ লাগছে। তার হাসি, বাম গালে টোল, কোঁকড়া ঘনকালো চুল, একহাড়া গরনের উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারা নেহাৎ মন্দ নয়।

” কি রে, এভাবে সাইলেন্ট মোডে চলে গেলি কেন! আমার কথার প্রত্যুত্তরে তোর কোন কথা নেই বুঝি? আচ্ছা যা, তোর বাপকে ডেকে আন। তার সামনেই তাকে ভুঁড়িওয়ালা বলছি। ”
” একদম চুপ, শুট….. ” সিক্তা কথা শেষ করার আগেই আনান কথা বলে,
” আবার শ্বশুরকে উল্টাপাল্টা নামে ডাকছিস? তাও আবার একমাত্র বরের সামনে, তার একমাত্র বাপকে। তোর সাহস খুব বেড়েছে দেখছি! ”
” কক কে, কার বর? ফালতু কথা বলার জায়গা না পেলে, ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করো গিয়ে। ”
” কেন বর হিসেবে আমাকে পছন্দ নয় বুঝি? তোর বাপ কিন্তু এমন একটা ছেলে পেলে, সুযোগটা লুফে নিবে। তবে আমার কিন্তু তোকে হেব্বি পছন্দ। বউ হিসেবে তুই কিন্তু আমার মনের মতন। এই তোর কি আমাকে পছন্দ নয়? পছন্দ না হলেও অসুবিধা নেই। আমাকে তোর পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যত ইচ্ছে সময় নিবি। তবে শেষে হ্যাঁ বলবি এটাই আমার অর্ডার। তোর সেয়ানা ভাইকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনা কিছুতেই। ”
” আমার ভাইয়া তোমাকে কি করল! তার ওপর তোমার এত কিসের হিং’সা! ”
” কি করেনি তোর ভাই? এই তোর এসবে এত আগ্রহ কেন! তোর আগ্রহ থাকবে শুধু আমার ওপর। এখন অন্য চিন্তা না করে শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করবি, বুঝলি? এই নে, তোর শ্বাশুড়ির কাছ থেকে টাকা নিয়ে এই নুপুর তোর জন্য কিনেছি। যদি মুখে বলতে না পারিস, তবে নুপুর পায়ে পরলেই আমি বুঝে নিব। ” আনান পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে সিক্তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। এরপর ও রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

আনান আরেকবার তাহমিদের রুমের সামনে এসে উঁকি দেয়।
” কি রে, বউয়ের বড় ভাই, এভাবে ছোট বোনের জামাইয়ের রুমে উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন! একটুতো লজ্জা কর। আজকাল দেখছি ছুঁচোর মত আচরণ করছিস! ”
” হাহ্ ভাই, মুখে বলছ বউয়ের বড় ভাই, কিন্তু মনে সম্মানের লেশমাত্র নেই। একটা কথা শুনে রাখ, কয়েকদিন পর, তুমি তাহমিদ আমাকে সম্মান দিতে সচেষ্ট থাকবে। আমি কিন্তু তখন তোমার মত এমন হিটলারি ফলাবোনা। ”
” কোন লাভ নেই। এমন একটা ফিঁচকে ছেলের কাছে আমার বোনকে কিছুতেই দিবনা। তাই মিছেমিছি সম্মান পাওয়ার আশা বাদ দে। ” তাহমিদের কথা শুনে আনানের মাথায় যেন বাজ পরল! বেচারার মুখ চুপসে গেছে। যেই কথা ও ছাড়া কেউ জানেনা, সেই কথা এই সেয়ানা লোকের কাছে পৌঁছাল কিভাবে!
” ভাই, স্যালুট তোমাকে। তোমার ঐ দুটা চোখ নাকি সিসি ক্যামেরা! তবে সে যাইহোক তোমার বোন আমার হচ্ছে, এটা জেনে রাখ।তোমার আশায় গুড়েবালি। তুমি অযথাই আমাদের দুজনের মধ্যে ডিপজলের ভুমিকা পালন করতে এসোনা। ও অলরেডি পটে গেছে। আর কয়েক বছর পর, আমি তোমার ছোট বোনের স্বামী হব। তুমি উঠতে-বসতে আমার সামনে সম্মানের ডালা নিয়ে হাজির হবে। এইযে আমি, আমার কন্যার বড় ভাই হয়েও সম্মান না পাওয়ার আক্ষেপ তখন ঘুচবে। ”
আনানের কথা শুনে তাহমিদের ভিষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু ওর এখন হাসা মানেই আনানকে প্রশ্রয় দেয়া, তাই অনেক কষ্টে নিজের হাসি চেপে রাখে।

” কই গো বউ, খালি এমন করে শুয়ে থাক কেন? বাড়ির কাজকর্ম করা লাগবেনা? বাড়ির বউদের শুয়ে থাকলে সংসারের অবনতি নিশ্চিত। ” সবুজের মায়ের ক’র্ক’শ আওয়াজ শুনেও কোন হেলদোল নেই দৃষ্টির। ও শ্বাশুড়ির কথার জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শোয়।
” কি ব্যাপার, তুমি না উঠে বিছানায় গ’ত’র চেপে ধরলে কেন? আচ্ছা মেয়ে তো তুমি! কোন আদবকায়দা বাপ-মা শিখায়নি! ”
” আহ্ আম্মা। আমার আদবকায়দা যথেষ্ট আছে , শুধু আপনাদের মনে হয় মাথার দো’ষ আছে। আপনি আগে বলতেন, বাপেরবড়ি থেকে কিছু আনিনি তাই বাড়ির সব কাজ আমাকেই করতে হবে। আমিও সেটাই করলাম। কিন্তু যখন বাপের বাড়ি থেকে সবকিছু আনলাম, আপনার ছেলেকে আমার আব্বু ছয় লাখ টাকা দিল, তারপরও আমাকে কাজ করতে হবে! এখন থেকে আমি কোন কাজ করবনা। হয় আপনি সব কাজ করবেন, নয়তো কাজের মেয়ে রাখবেন। ” দৃষ্টির পাল্টা জবাবে মিইয়ে যায় ওর শ্বাশুড়ি।
এই মেয়েকে বাগে আনতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে তার স্বামী, সন্তান বাড়িতে আসা মাত্রই এই মেয়ের নামে বিচার দিবে। একটা দফারফা না করে সে আজ ভাত মুখে তুলবেনা।

চলবে….