বিন্নি ধানের খই পর্ব-১১+১২

0
347

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১১
#মিদহাদ_আহমদ

মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকা স্বামীর মুখে আজ তিন মাসের মাঝে প্রথম শুনলাম,

‘তুমি আমার অভ্যাস হয়ে উঠেছো’

কথাটা বলেই আরেকটা সিগারেট ধরালো আসিফ। সে আর কোন কথা বলার অবস্থায় নেই এখন। আমি ধীরপায়ে নিজের খাটে এসে বসলাম। এক কোণে বসে থাকতে থাকতে কখন যে আমার চোখ গড়িয়ে পানি বের হলো বুঝতেই পারলাম না! আজ প্রথম! আজ প্রথম আমার স্বামী আমাকে বলছে যে আমি তার অভ্যাস হয়ে উঠেছি! আজ যখন আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখন?

কিছুক্ষণ পর উঠে এলো আসিফ রুমে। আমাকে বললো,

‘তুমি চলে যেতে চাইলে যেতে পারো। আই এম সরি। তোমাকে এভাবে আটকে রাখার কোন রাইট আমার নেই। তাছাড়া বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি তোমার সাথে কোন ভালো ব্যবহার করেছি বলে আমার মনে হয় না। সব সময় তোমাকে নানান কথা বলে কষ্ট দিয়ে এসেছি।’

কথা বলার ফাকে মদ বের করে গ্লাসে নিলো আসিফ। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঢলতে ঢলতে বললো,

‘আমি মানুষটা ভালো না। দিনে সিগারেট, রাতে মদ আর নারীতে মত্ত থাকা মর্দ। আমার সাথে কে বা সংসার করতে চাইবে বলো? বাসার সবার কাছে আমি এক অবাধ্য সন্তান। পরিবারের সবার সামনে বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলে। অথচ আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করানো হয়েছিলো নুপুর৷ আই এম সরি। আজ তোমাকে আটকানো আমার ঠিক হয়নি। সব মানুষ তার জীবনে মুক্ত, স্বাধীন। ‘

কিছুক্ষণ আবার চুপ করে থাকলো আসিফ। আমি শুধু তাকে দেখেই যাচ্ছি। তারপর আসিফ আবার শুরু করলো,

‘জানো, যখন আমি কলেজে ছিলাম প্রায় সময়েই আমি নাইরপুল থেকে পাখি কিনে আনতাম। এনে কী করতাম জানো? বার্ড কখনো খাচায় থাকুক এইটা আমি চাইতাম না। তাই এদের মুক্ত করে দিতাম৷ স্বাধীন করে দিতাম। সব সময়ের জন্য স্বাধীন৷ তোমাকেও স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিতে হবে৷ কোন অধিকার নেই আমার কারোর জীবনে হস্তক্ষেপ করার। কারোর জীবনকে ধ্বংস করার। তোমাকে আটকিয়েছি কেন আমি জানি না। জানি না তুমি আমার অভ্যাস কিনা। হয়তোবা মদের নেশায় এতো মত্ত হয়ে উঠেছি যে কী বলতে কী বলে ফেলেছি। তুমি চাইলে যেতে পারো নুপুর। তোমাকে আমি আটকাবো না৷ যেখানে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা ইউ আর ফ্রি। আমার কোন রাইট নাই তোমাকে বন্ধ করে রাখার। কোন রাইট নাই…

কথাগুলো বলেই আসিফ হেলে পড়লো বিছানায়। মদের গ্লাসটা ঠাস করে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গেলো। আমি আসিফের মাথায় বালিশ দিয়ে দিলাম। গ্লাসের টুকরোগুলো পরিস্কার করলাম। তারপর বিছানায় আসতেই শুনতে পেলাম মনে মনে আসিফ বিরবির করছে,

‘আই লাভ ইউ নুপুর। আই লাভ ইউ’

আমার পুরো শরীর শিহরণ দিয়ে উঠলো৷ বিদ্যুৎ যেনো ছেয়ে গেলো পুরো দেহ জুড়ে। আসিফের এই অচৈতন্য হওয়া অবসাদ শরীরে সে যে জ্ঞানহীন কথা বলছে, সে জানে না এই কথাটুকু আমাকে কত বড় ভরসা দিয়ে দিলো এই সময়ে। একদিকে যখন আমার অন্ধকার হয়ে যাওয়া পৃথিবী আমাকে তাড়িত করে বেড়াচ্ছিলো, অন্যদিকে যেনো এই মানুষটা আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে!

সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমার কিছুটা দেরি হয়ে গেলো৷ ঘড়িতে সকাল আটটা। আমি তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে গেলাম। শাশুড়ি রান্নাঘরে যেতে না যেতেই বললেন,

‘নবাবজাদি হয়ে উঠছো নাকি দিনদিন? ঘরের বউদের যে সাত সকালে উঠা লাগে এইটা মাথায় নাই নাকি?’

‘মা রাতে ঘুমাতে একটু…’

‘থাক! আমাকে আর এসব বলতে হবে না। তোমার শ্বশুর চায়ের অপেক্ষা করছেন। তাকে চা দিয়ে আসো তাড়াতাড়ি। ‘

ননদ এসে বললো,

‘আমাকে ডিম আর ব্রেড রেডি করে দাও। আর গ্রিন টি দিও। লেবু দিও দুই টুকরা। ছোট করে কেটে৷ ‘

আমি সবার ফাই ফরমায়েশ মতো নাস্তা রেডি করে দিয়ে আসিফের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এলাম রুমে। এসে দেখি আসিফ বিছানায় হেলান দিয়ে দিয়ে বই পড়ছে। এই বাড়িতে এসে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম বুক শোকেছে হাজার তিনেকের মতো বই তখন খুঁজছিলাম কে এই বই পড়ে! এখন দেখছি আসিফ নিজেই পড়ছে! আমাকে দেখে আসিফ বললো,

‘কী? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বই পড়ছি দেখে? রিডিং রুমের সব বই আমার কালেকশন করা। এই তিন বছর বই পড়িনি একদম। ইচ্ছা করেনি৷ আজ ইচ্ছা হলো, তাই নিয়ে এলাম৷ কী? এভাবে দেখছো কেন? আমি কোন ভূতটুত নাকি?’

আমার হাসি পেয়ে গেলো। হাসি চাপা দিয়ে বললাম

‘কফি’

‘হুম। রেখে দাও টেবিলে।’

আমি কফি টেবিলে রেখে দিলাম৷ ফিরে আসবো এমন সময় আসিফ বললো,

‘আলমারিতে বোতল নাই দেখলাম৷ কই গেলো?’

‘কীসের বোতল?’

‘মদের’

‘আমি সরিয়ে ফেলেছি।’

‘মানে? হুয়াই? তুমি জানো না রোজ সকালে আমার…’

‘জানি! কিন্তু আজ না৷ আজকে যখন বই দিয়ে শুরু করেছো দিনটা, তখন নাহয় বই দিয়েই দিনটা কাটুক। এসব থেকে নাহয় দূরে থাকলা আজকের দিনে!’

‘অহ মাই গড! হুয়াট আর ইউ সেয়িং? তোমার মাথা পাগল হয়েছে নাকি?’

কথাটা বলেই বারান্দার কোন এক কোণা থেকে একটা সিগনেচার হুইস্কি বের করে আনলো আসিফ। আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম এই দৃশ্য দেখে। মানুষটাকে যত করে চাইছি এসব থেকে দূরে রাখতে, মানুষটা তত এসবে যেনো জড়িয়ে যাচ্ছে!

আমি রুম থেকে বের হয়ে এলাম। এদিকে শাশুড়ি শুনলাম শ্বশুরের সাথে কথা বলছেন, আজ সন্ধ্যায় নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তামান্নাকে। তারপর শাশুড়ি আমাকে ডেকে বললেন,

‘ডেজার্ট আইটেমের কোনকিছুই সম্ভবত পারো না তুমি৷ এক কাজ করো, কাজের মেয়ে দেখিয়ে দিবে সব। ওর সাথে সাথে থেকো। সন্ধায় তামান্নাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। ছেলে লন্ডন থাকে। দেশে এসেছে এক সপ্তাহ হলো। যদি পছন্দ হয়ে যায় তাহলে বিয়ে হয়ে যাবে রোজার পর পরই। ইফতার শেষে আসবে, তাই ভালোকরে ডেজার্ট আইটেম রেডি করা লাগবে। বুঝেছো?’

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।

ইফতার শেষেই তড়িঘড়ি করে সব রেডি করলাম টেবিলে। এদিকে ননাসও ইফতারের আগে বাসায় চলে এসেছেন৷ এসেই আমাকে বলে রেখেছেন, আমি যেনো ভালো কাপড় আর গহনা পরে থাকি। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখার পাশাপাশি মেয়ের ভাইর বউয়ের চাল চলন পোশাক এসব দেখবে। এতে যেনো তারা কোন খুঁত খুঁজে না পায়। আমি বুঝলাম না কনে দেখার সাথে আমার ভালো পোশাক আর গহনা পরে থাকার কী সম্পর্ক!

একমাত্র ননদ হিসাবে তামান্নাকে সাজানোর দায়িত্ব আমার হওয়ার ছিলো৷ সেই সুযোগ আমি পেলাম না আর। ননাস তাকে সাজিয়ে দিলেন। ঘন্টাখানের মধ্যেই পাত্রপক্ষ চলে এলো। একজন দুইজন না। পুরোপুরি এগারো জন। আমি খাবার রেডি করতে লাগলাম৷ চা বসালাম। খাবার টেবিলে থেকে শুনতে পেলাম পাত্রের মা বলছেন,

‘আমার বোনজির বিয়ে হয়েছে গত সপ্তাহে। আর জানেন আপা, কোন কমতি আমরা রাখিনি৷ আমার বোনেরও একমাত্র মেয়ে তো! বিয়েতে কী দেয়নি বলেন? কাঁঠালের কাঠের ফার্ণিচার, দুই দরজার ফ্রিজ, দেড় টনের এসি, বত্রিশ ইঞ্চি টেলিভিশন, আর মেয়ে নিজেই বাড়ি থেকে নিয়েছে ভরি সাতেক স্বর্ণ। আমরা আমাদের মেয়ের বিয়েতে কোন কমতি রাখিনি। সব দিয়েছি। মেয়েদের তো সব দিতেই হয়৷ আমার বোনের একমাত্র মেয়ে বলে কথা! আর জানেন, আমিও মনে করি মেয়ে আনতে হলে বড় ঘর থেকে আনা ভালো। কী বলেন?’

আমি শুনতে পেলাম আমার শাশুড়ি হেসে হেসে জবাব দিচ্ছেন,

‘হ্যাঁ আপা। ঠিক ই বলেছেন। মেয়ে বিয়ে দিতে কোন বাপ মা কম দেয় নাকি বলেন? আমারও শেষ মেয়ে। যদি আল্লাহর রহমতে বিয়ে ঠিক হয় তাহলে দিতে দেখবেন কোন কমতি রাখবো না।’

ওপাশ থেকে পাত্রের মা বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাদের আত্মীয় স্বজনের লিস্ট আবার লম্বা। ওই গত সপ্তাহে আমার বোনের মেয়ের বিয়েতে জামাই বাড়ির বরযাত্রী ছিলো দুই হাজার। আমাদেরও দুই হাজারের কম হবে না।’

আমার শাশুড়ি বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। তা কি আর বলতে বলেন? কনভেনশন হলে আয়োজন হবে৷ এখানে আমাদের কোন আপত্তি নেই। যা যা করার, যত হাজার লোকই আসুক সব হবে। সব। আর জানেন আপা, আমার ছেলের বিয়ে করালাম তিন মাস হলো। আমার বড় মেয়েরও বিয়ের হয়ে যাচ্ছে চার বছর। চার বছর আগে আমার বড় মেয়ের বিয়ের কাবিন ছিলো পনেরো লাখ টাকা। ছেলের বউকেও দিয়েছি কাবিনে লিখে সতেরো লাখ টাকা।’

আমি তাজ্জব বনে গেলাম আমার শাশুড়ির মিথ্যাচারে! আমার বিয়ের কাবিন ছিলো মাত্র এক লাখ টাকা। সেই জায়গায় তিনি কী অবলীলায় মিথ্যা বলছেন যে কাবিন সতেরো লাখ টাকা ছিলো!

শাশুড়ি আবার বলা শুরু করলেন,

‘এখন আপা আমার ছোট মেয়ে, বুঝেন ই তো। কাবিন যদি কম হয়, তার পরও আমি পঁচিশ লাখ টাকার নিচে দিবো না।’

পাত্রের মা বললেন,

‘সে আসলে সময়, সুযোগ, আয়োজন বেধে বাড়ে কমে আরকি! আমরা মেয়ে দেখতে পারি এবার?’

শাশুড়ি আমাকে ডাক দিলেন। বললেন,

‘নুপুর বউমা! তামান্নাকে নিয়ে চলে এসো তো ড্রইংরুমে…’

আমি তামান্নাকে নিয়ে গেলাম। বুঝতে বাকি রইলো না এই দরদামে কোন মেয়ের বিয়ে নয়, বিক্রি হতে চলেছে। বড়লোকি বিয়েতে কোন মেয়ের বিয়ে হয় না, হয় বিক্রি।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১২
#মিদহাদ_আহমদ

*অনুমতি ছাড়া কপি করা থেকে বিরত থাকুন। ইচ্ছা হলে শেয়ার দিন। কপি করে অন্য কোন পেইজ/গ্রুপ/ওয়াল/ওয়েবসাইটে দিতে হলে আগে আমার অনুমতি নিন।

তামান্নার হবু শাশুড়ি তামান্নাকে দেখেই বললেন,

‘গায়ের রঙ তো চাপা কিছুটা। তা মা, এখানে না বসে এক কাজ করো, দরজা থেকে একটু হেঁটে এসো তো।’

আমি তামান্নার ভাবি হয়েও আমার যেনো গা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিলো তাদের এই কান্ডটা দেখে। আমি মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছিলাম না। আশা করেছিলাম ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে তামান্না এর প্রতিবাদ করবে। কিন্তু না৷ সে যেনো মোমের পুতুল! সেও দরজা থেকে হেঁটে ভেতরে এসে ঢুকলো। সালাম করলো সবাইকে এক একজন করে পায়ে ধরে। বরের বোন এসে তামান্নার হাত দেখলো। চুল দেখলো সবার সামনে। এ যেনো এক চিরাচরিত গ্রামের চলে আসা রীতিনীতি সিলেটের ভদ্র বড়লোক ঘরেও পালন হচ্ছে। কয়েক বছর আগে আমার চাচাতো বোনের বিয়ের সময়েও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিলো। বরপক্ষ দেখতে এসে চাচাতো বোন মিলিকে এমনভাবে দেখছিলো, যে এরা কোন মাছ বাজারে মাছ কিনতে এসেছে, বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে নয়! শেষতক আমার চাচা রেগে গিয়ে বলেই দিলেন,

‘মেয়ে দেখার জিনিস, যাচাইয়ের জিনিস না। আপনারা যদি এভাবে হাত পা মুখ চোখ চুল দেখার হয়,তাহলে এসব দেখার জন্য অনেক ঘর আছে হয়তো। আমাদের ঘরে নাই। গরীব হতে পারি কিন্তু আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নয়।’

সেই বিয়ে আর হয়নি মিলির। মাস দুয়েক পর স্কুলের বাংলার টিচারের সাথে মিলির বিয়ে হয়ে যায়। সেই যাত্রায় মিলির বেঁচে যাওয়া যে তার জীবনে স্বর্গসুখ এনে দিয়েছিলো, তা আর বলতে বাকি রাখে না! মিলি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। জামাই বউ দুজনেই দুজনের ব্যপারে ভীষণ সাপোর্টিভ। একজন আরেকজনের হয়ে জীবন কাটিয়ে নিচ্ছে যেনো!

এদিকে তামান্নার হবু শাশুড়ি সব দেখেশুনে বললেন,

‘আমাদের সব ঠিকঠাক আছে। যদি বলেন তাহলে আলহামদুলিল্লাহ বলে দেই ‘

আমার শাশুড়ি যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন! আমার গরীব মা বাবা হয়তো খোঁজ নেননি এতকিছুর। কিন্তু তিনি? তিনি তো বড়লোক ঘরের। তার তো টাকার কমতি নেই। এমনও না যে একটা দুইটা মেয়ে কিছুকাল ঘরে পড়ে থাকলে অসম্ভব খারাপ কিছু হয়ে যাবে। আমি আশ্চর্য হলাম এমন এহেন আচরণে। শাশুড়ি বললেন,

‘আমাদের কোন সমস্যা নাই। আপনারা হ্যাঁ বললেই সব ঠিক আছে।’

আমি খেয়াল করলাম, তামান্নার হবু বরের বয়সে কম করে হলেও চল্লিশ হবে। মানুষের চেহারা আল্লাহর তৈরি। এই নিয়ে কিছু বলা হয়তো ঠিক না। কিন্তু বয়স? বিয়ের জন্য তো একটা নির্ধারিত বয়স আছে নিশ্চয়ই? এই গল্পটা মিদহাদ আহমদের লেখা গল্প। সর্বপ্রথম প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭ টায় গল্পের লেখক মিদহাদ আহমদের নিজের গ্রুপ midhad’ monograph এ পোস্ট করা হয়। যে বা যারা এই গ্রুপের বাইরে এই গল্পটা পড়ছেন আপনারা সেখান থেকে না পড়ে সবার আগে পড়তে আমার গ্রুপে এসে যুক্ত হোন। চোর থেকে সাবধান থাকুন। অন্তত সামাজিকভাবে সুন্দর বিয়েতে? এর তো কোন বিরোধ নেই! মা মেয়ের কোন ভ্রুক্ষেপ নাই এদিকে যেনো! কী অদ্ভুত মানুষজন!

মেহমানরা চলে যাওয়ার পর আমি আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। ভেতরে ভেতরে নিমজ্জিত হয়ে থাকা আমার প্রতিবাদী মন কেমন জানি উসখুস করতে লাগলো। অন্তরআত্মা বারবার বলছে, আমার ভেতরের প্রতিবাদকে এতদিন চাপা রেখে আমি যেনো আমার ভেতরের আমিকেই বন্দি করে রেখেছিলাম। আর আত্মা যখন মরে যায়, মানুষ তখন বাঁচতে বাঁচতেও মরে যায়। তার বেঁচে থাকার মধ্যে দেহগত বেঁচে থাকার চেয়ে আর বেশিকিছু অবশিষ্ট থাকে না। তামান্নার রুমে গেলাম আমি। দেখলাম তামান্না ড্রেসিংটেবিলে বসে বসে টাকা গুণছে৷ আমাকে দেখিয়ে সে বললো,

‘দেখেছো ভাবি? সালামিতে পাক্কা বিশ হাজার টাকা দিয়েছে। তারা আসলেই অনেক পয়সাওয়ালা লোক। আমার তো খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছা করছে।’

কথাটা বলেই দুই চোখ এক করে টাকার বান্ডিল বুকে চেপে এক অদ্ভুত হাসি হেসে উঠলো তামান্না। আমি কী বলবো বুঝতে পারলাম না। এই অসহায় হয়ে দেখাও আমার পক্ষে যেনো সম্ভব হচ্ছে না। আমি তামান্নাকে কিছুটা নিচু গলায়, আদরের সুরে বললাম,

‘তুমি এই বিয়েতে রাজি তামান্না?’

আমার প্রশ্নে বুঝতে পারলাম তামান্না বেশ বিব্রত এবং বিরক্ত। তার ভ্রু কপালে উঠে গেলো৷ সে কয়েক কদম এগিয়ে এলো আমার দিকে। তাক করে ওয়ারড্রব এর উপর থেকে রিমোট হাতে নিয়ে এসি অন করলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

‘কেন?’

‘রাজি বলো?’

‘হ্যাঁ আমি রাজি। কী হয়েছে তাতে?’

‘তাহলে ওই ছেলে যাকে তুমি ভালোবাসো? যার সাথে কলে কথা বলেছিলা?’

‘ওসব? টাকা ছাড়া দুনিয়া চলে ভাবি? টাকাই দুনিয়ার সব। প্রেম ভালোবাসা দ্যটস ফাইন। আছে থাকুক। চলতে দাও। কিন্তু তা না, প্রেম ভালোবাসাকে একবারে বেদবাক্য ধরে নেয় আজকালকার ছেলেমেয়েরা। যা কিনা মোটেও ঠিক না। আমি রাজি আছি এই বিয়েতে।’

‘ছেলে তোমার থেকে দ্বিগুণ বয়সের হবে তামান্না!’

আমি যেই না বলবো এই কথাটা, তামান্না সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে তার মা বোনকে ডেকে আনলো। তারপর যা শুরু হওয়ার তাই হলো। এ যেনো এক ঝড় শুরু হওয়ার উপক্রম। আমি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে চলে এলাম রুমে৷ আমার এসব কথা শোনার ইচ্ছা, মুড, রুচি কোন কিছুই আর বাকি রইলো না। এতদিনে এসব সয়ে যাওয়ার কথা যদিও! তার পরও আমার এসব সইলো না। আমার ননাস তানিয়া ও ননদ তামান্নার সাথে সাথে শাশুড়িও গলা বাড়িয়ে বলতে লাগলেন,

‘এবার দেখছি এই কু-নজর থেকে বাঁচার জন্য আমার মেয়েদের তাবিজ দিতে হবে। মানুষের যে এতো খারাপ নজর থাকতে পারে তা তোর মতো ছোট ঘরের গরীব মেয়েকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না ‘

আমি কথাগুলো এক কানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম৷ এখন আর এসব আমার আমলে নেওয়া হয়ে উঠে না। রুমে এলাম আমি।

পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষের মন। আর তারচেয়ে ভয়ানক মানুষের লোভ। লোভ যখন মানুষকে ধরে বসে তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না। ভেতরের রিপুকে বন্দি করতে না পারলে মানুষের জীবনের আসল কাজ সাধন হয়ে উঠে না। অথচ এই পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষ আসে তার জন্য স্রস্টার নির্ধারিত কিছু কাজ সম্পন্ন করার জন্য৷ কিন্তু মানুষ যখন লোভী হয়ে যায় নিজের অজান্তে, তার জন্য রাখা নির্ধারিত কাজ আর সে করে উঠতে পারে না। আপনজনের ভালোর জন্য আপন জনেরাই যখন লোভী হয়ে উঠে, তখন আর সেই ভালো ভালোর জন্য না বরং লোভের পাপের পরিণাম বয়ে আনে জীবনে।

অন্যদিকে তানিয়ার শাশুড়ি খোদেজা বেগম সন্ধ্যার পর নিজের বাসার সবাইকে নিয়ে বৈঠকে বসেছেন। সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্তে যেতে চান তানিয়ার ব্যপারে। তানিয়ার শাশুড়ি খোদেজা বেগম নাকি গলায় ছেলেকে বললেন,

‘বাবা রে! দেখ তোর বিয়ের তিন বছর হয়ে গিয়েছে।এখনও কোন নাতি নাতনির মুখ আমি দেখতে পেলাম না। আমার কি সাধ জাগে না নাতি নাতনি দেখবো বলে? আমার ছোট বোনেরা দাদি হয়ে গিয়েছে। তাদের ছেলের ঘরে আলো করে ছেলে এসেছে। তারা ঠিকই তাদের নাতি নাতনিদের নিয়ে সুখে শান্তিতে আছে। কিন্তু তোর? তোর কী হলো? এই জীবন, এই দুনিয়া সবকিছুই তো মানুষ তার সন্তানের জন্য করে।’

তানিয়ার স্বামী রাসেল তার মাকে বললো,

‘তোমরা কি তাহলে সুখে নও মা? আমি কি কোন কমতি রেখেছি তোমাদের?’

‘কিন্তু বাবা, যে সুখে আমি সুখি হবো, সেই সুখটা যে তুই দিতে পারছিস না এখন।’

‘কিন্তু মা, আরও দেখি না কিছুদিন। ডাক্তার তো বলেছে ওয়েট করতে৷ আর তেমন কোন মেজর প্রবলেম তো ডাক্তার বলেও নি।’

একবার কাশলেন খোদেজা বেগম। মেয়েকে বললেন পানি এনে দেয়ার জন্য৷ পানি পান করতে করতে বললেন,

‘ যে গাছ একবার ফলে না, সেই গাছে আর কোনবার ফল আসে না। এইকথা বিজ্ঞান টিজ্ঞান দিয়ে ফলানো যাবে না। এই কথা অবধারিত সত্য’

খোদেজা বেগমের ছোট ভাই, তার বোনের সাথে তাল মিলিয়ে রাসেলকে বললো,

‘দেখো ভাগনা, জীবন আসছে না যাচ্ছে? আর আপা তো তোকে ভুল কিছু বলছেন না। বউমার বিয়ে হয়ে আসার আজ তিন বছর। বউমার কোন সন্তান হচ্ছে না। হচ্ছে হবে এমন করে বললে তো আর সবকিছুর সমাধান ও হয় না। আর আপা যে তোকে জোর করছেন তার নিজের স্বার্থে এমনও না। আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে আসছে লন্ডন থেকে। সে দেশে এসে যে জামাই পাবে না এমনও না। ঠিকই জামাই তার জোটে যাবে। কিন্তু তারপর? আমরা তোর ভালোটা দেখছি। সবদিক দিয়ে ভালোটা না দেখলে চলবে? জীবন আবেগে চলে না। লন্ডনের সিটিজেন মেয়েকে বিয়ে করলে জীবনও সেটেল, আর বাচ্চাকাচ্চাও হলো। আমার তো এক ঢিলে দুই পাখি মারার এক ব্যবস্থা হয়ে গেলো তাইনা?’

‘আর তানিয়া? তার কী হবে?’

রাসেল বললো।

তার কথার সাথে সাথে তার বড় বোন বললো,

‘কী আর হবে? বিয়ের কাবিনে যেই টাকা লিখে দিয়েছিলা, সেই টাকাগুলো দিয়ে একেবারে বিদায় করে দিবা। সমস্যা সমাধান। জীবনও সমাধান। সহজ হিসাব।’

এদিকে আমি তামান্নার রুম থেকে বের হয়ে আমার রুমে ঢুকতেই দেখি বারান্দায় ওপাশ হয়ে বসে আছে আসিফ। মাথার উপর আলো জ্বালানো। সন্ধ্যার পর সচরাচর বারান্দায় বসে আসিফ সিগারেট খায়। বাতি জ্বালায় না কেউ। আমি ধীরপায়ে বারান্দায় গেলাম। সেখানে গিয়েই যেনো আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো। আসিফ কী সুন্দর ছবি এঁকেছে! আসিফের আকা স্কেচ আমি এই প্রথম দেখলাম। একটা মানুষের ভেতরে ভেতরে চাপা পড়ে থাকা প্রতিভা যে এভাবেও থাকতে পারে, তা আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না যেন! গভীর মনোযোগ হয়ে আমার চোখ আটকে গেলো সেখানে। বড় সাইজের কার্টিজ পেপারে সে শুধু আউট লাইন ড্র করছে এখন। সবার চোখগুলো যেনো সেখানে চির জীবন্ত! আমাকে দেখেই সে বললো,

‘কেমন হয়েছে?’

আমি গভীর মনোযোগী ভাব এনে দেখতে লাগলাম তার আঁকা স্কেচটা। আমাদের পুরো ফ্যামিলির ছবি এঁকেছে সে। একপাশে শ্বশুর, তার পাশে শাশুড়ি। শাশুড়ির পাশে আসিফ, আসিফের ডান পাশে আমি, অন্যদিকে শ্বশুরের পাশে আমার ননাস অপরদিকে আমার পাশে আমার ননদ। কী সুন্দর কাস্টমাইজড করে আঁকা ছবি! অথচ এই ফ্রেমে আমাদের কোন ছবি তোলা হয়নি। সে সাজিয়েছে তার নিজের মতো করে! তামান্নার ছবি থেকে চার আঙুল দূরেই আরেকটা অষ্টাদশী মেয়ের ছবি! কী সুন্দর তার চোখ, টানটান আখিতে যেনো নজর কাড়া একটা ভাব কথা বলে বেড়াচ্ছে! আমি বুঝতে পারছি যেনো সেই চোখের ভেতরে জেগে উঠা ভাষাগুলো। লম্বা মতোন চুল সেই মেয়েটার। আমি আসিফকে জিজ্ঞাসা করলাম,

‘ওই মেয়েটা কে?’

আসিফ বললো,

‘আমার প্রেমিকা। যাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন, বাঁচা, আমার পৃথিবী। আমার সবকিছুই।’

(চলবে)