বিন্নি ধানের খই পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
344

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৫
#মিদহাদ_আহমদ

‘সামান্যতম মানবিকতা মানুষের মাঝে নাই? কাকে বলছিলে?’

হতভম্ব হয়ে গেলো বদরুল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,

‘মা আ আ নে…’

‘মানে সামান্যতম মানবিকতা নাই?’

চোখ বড় বড় করে তাকালো তানিয়া। বদরুলের চোয়াল বেয়ে ঘামের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা জমাট বাধতে লাগলো। আকস্মিক এই অঘটন ঘটে যাবে এর ধারণাও করতে পারেনি সে। এ যেনো হুট করে উড়ে আসা সাইক্লোন সবকিছু তছনছ করে দিতে এসেছে৷ তানিয়া শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলে রেখে বদরুলকে জিজ্ঞাসা করলো,

‘কার সাথে কথা বলছিলে?’

তানিয়ার শব্দ করে গ্লাস রাখা দেখে বদরুল মনে মনে জাগ্রত হওয়া ভয়টা আরও নিরেট হয়ে উঠলো। সে বললো,

‘না মানে…’

‘অফিসের কেউ?’

এবার যেনো হিতাহিত জ্ঞান ফিরে পেলো সে৷ তারমানে তানিয়া কিছু শুনতে পায়নি? মনে সাহস সঞ্চার করতে লাগলো বদরুল। মুখ আটকালো না মিথ্যা বলতে। খই ফুটার মত বললো,

‘আরে হ্যাঁ। অফিসের সহকারী একজন। সে লোন নিবে বিশ লাখ৷ ম্যানেজার সিগনেচার দিচ্ছেন না এখানে৷ মানে দেখো মানুষের মাঝে সামান্যতম মানবিকতা নাই। একটা সিগনেচার করে ইস্যু করে দিলেই তো হয়৷ দেখো আজ আমাদের লাগছে না, কাল আমাদের লাগতে পারে না? এজন্যই বলছিলাম মানবিকতা আজকাল আর কারো মধ্যে নেই৷ সবকিছু একেবারে ডুবে গিয়েছে দুনিয়া থেকে। সবাই এমন হয়ে যাচ্ছে যেনো। তাইনা?

‘তাই?’

‘কেন? তাই তো। সন্দেহ আছে কিছু?’

‘অহ আচ্ছা। চলেন মিস্টার। খাবার রেডি করা আছে টেবিলে। টেবিলে খাবেন নাকি এখানে এনে দিবো? কাল সকালে আবার দাওয়াত আছে আপনার শ্বশুর বাড়িতে।’

‘আচ্ছা তুমি যাও। আমি বাথরুম থেকে আসছি।’

‘আচ্ছা আসো।’

বদরুল তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। বুকে থু থু দিলো। একদলার মতো থু বেরিয়ে এলো যেনো। তার সেদিকে খেয়াল নেই। এ যেনো এক মরুতে জেগে উঠা পানির ফুয়াড়ার মতো অনুভূতি! লুকিং গ্লাসে নিজেকে দেখতে দেখতে মুখে পানি ছিটা দিলো। চোখ দুইটা যেনো মুহূর্তেই লাল রক্তের বারুদ হয়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস তানিয়া শেষ মুহূর্তে এসে শুধু শেষের কথা শুনেছে। তাও পুরোপুরি না। যদি তানিয়া আজ শুনে ফেলতো তার কথা? কী অনর্থই না হয়ে যেতো।

মিনিট দুয়েকের মাথায় বদরুল টেবিলে গিয়ে খেতে বসলো। মনে মনে ভাবলো, এমন ভুল আর করা যাবে না। এরকম থাকলে কখন যে সবকিছু খোলে যাবে তানিয়ার কাছে!

খেতে খেতে তানিয়া তার স্বামীকে বললো,

‘জানো আমি প্ল্যান করেছি বাবা মায়ের থেকে সব সম্পত্তি আনার পর আমরা দুজনে সিঙ্গাপুর যাবো এক মাসের ট্যুরে। সবকিছু বেশিবেশি খরচ করবো। কোন রেস্ট্রিকশন থাকবে না। এর পরের বছরেই আমরা দুজন হজ্ব করে ফেলবো। কেমন?’

ভাত খেতে খেতে বদরুল বললো,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। কেন নয়? অবশ্যই হবে। তুমি যেমন চাচ্ছো তেমন হবে।’

আমার খাবার রান্না শেষ করতে করতে রাত তিনটা বেজে গেলো। এদিকে আসিফ একটা সিগারেট ধরিয়ে রান্নাঘরে এসে পায়চারি করতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলো আর কতক্ষণ৷ একেবারে যেনো শিশু বাচ্চা এসে বারবার জানতে চাইছে রান্নার আর কতক্ষণ বাকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার রান্না হয়ে গেলো৷ রুমে হাড়ি নিয়ে গেলাম। মেঝেতে বসে দুজনে খেয়ে নিলাম।

সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে আসিফের ডাকে। আমি দেখলাম আসিফ আমার সামনে চা আর সেমাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে বললো,

‘ঈদ মুবারক। আপনি কি এবার উঠবেন বিছানা থেকে? সকাল সাত টা বাজে।’

আমি তড়িঘড়ি করে উঠে গেলাম। আজ আমাদের প্রথম ঈদ৷ আসিফ নামাজে যাওয়ার আগে আমার উচিত ছিলো তাকে সেমাই করে খাওয়ানোর৷ কিন্তু না। আমার আগে সেই উঠেছে৷ নামাজের আর এক ঘন্টা বাকি। আমি নাস্তা সেড়ে গোছল করে আসলাম। আসিফকে বিদায় দিলাম নামাজের জন্য। আসিফ বের হতে না হতেই মায়ের নাম্বার থেকে কল। রাগে কষ্টে ফোন রিসিভ করলাম না। যে মানুষটা এভাবে আমাকে দূরে ঠেলে দিল, কী দরকার তার সাথে কথা বলার? কী দরকার তাকে ঈদ শুভেচ্ছা জানানোর?

আবারও রিং বেজে উঠলো। আমি ইগনোর করলাম। শাড়ি গায়ে জড়াতে লাগলাম। কল মায়ের নাম্বার থেকে অনবরত আসতেই লাগলো। আসতেই লাগলো। টানা পনেরোটা তো হবেই। বাথরুমের লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে সাজছিলাম আমি৷ আজ আমাকে সত্যিই ভীষণ সুন্দরি লাগছে। তারপর ফোন উঠালাম। ফোনের ওপাশে আমার ছোট ভাইয়ের কন্ঠ। ছোট ভাই হুলস্থুল করে বলছে আমাকে,

‘আপা জলদি আসো। আপা জলদি আসো। আব্বার শরীর ভালো না। আব্বার শরীর ভালো না।’

আমি শুনতে পাচ্ছিলাম অপর পাশে আমার মায়ের আহাজারি আর কান্নার আওয়াজ। মা আমার পাগলের মতো কান্না করছেন। আমি মুহূর্তে ভাষা ভুলে গেলাম যেনো। আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে আসিফ বাসায় চলে এলো নামাজ থেকে। সে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। আসিফ জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে। বললাম বাবা অসুস্থ। ছোট ভাই কল করেছে। আমার মুখ থেকে এই কথা শুনে আসিফ আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না৷ সে নিচে নেমে গেলো। গাড়ি একটা এনে আমরা বাড়ির পথে রওয়ানা হলাম। ঘন্টা দুয়েকের মাঝে আমরা বাড়িতে এসে পৌঁছালাম। মায়ের নাম্বারে কল দিলাম। কল রিং হচ্ছে কিন্তু বন্ধ৷ বাড়িতে এসে দেখি তালা দেয়া। কেউ নেই। পাশের বাড়ির চাচিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, আমার শাশুড়ি নাকি এসে আমার বাবাকে এম্বুল্যান্স করে শহরে নিয়ে গেছেন। আমি একেবারে তব্দা খেয়ে বসলাম। আমার শাশুড়ি এখানে? আমি মায়ের নাম্বারে কল করলাম আবারও। রিসিভ হচ্ছে না। আমি শাশুড়ির নাম্বারে কল দিলাম। শাশুড়ি কল রিসিভ করতেই বলে উঠলেন,

‘কী? এইতো আমাকে দরকার পড়লো তাইনা? তোমার মা তো কান্নাকাটি করে আমাকেই কল দিলেন৷ আমিই তাকে আনলাম হসপিটালে। রক্ত মাংসের মানুষ তো। পাষাণ আর হতে পারি না৷ আমরা নূরজাহান হসপিটালে আছি এখন। ঈদের দিন সকালে যে শাশুড়িকে কল করে অন্তত সালাম আদাব করা লাগে, এই আদবটুকুও জানো না নাকি?’

শাশুড়ি কল রাখলেন। আসিফ জিজ্ঞেস করলো,

‘মা কী বলেছেন?’

আমি ভাঙ্গা গলায় হসপিটালের নাম বললাম। আর কিছু বললাম না। আসিফ সিএনজিতে উঠে আবার শহরের দিকে গাড়ি ঘুরাতে বললো। রাস্তায় যেতে যেতে শুধু ভাবছিলাম আমি, একটা মানুষ এরকম কীভাবে হতে পারে! একটা মেয়ের বাবা অসুস্থ জেনেও কথা শুনাচ্ছে! একটুও বেগ নিচ্ছে না তার ভয়ার্ত কথাগুলো!

ঘন্টাখানেকের মাথায় আমরা হসপিটালে এসে পৌঁছালাম। আমি দেখলাম শাশুড়ি আমাকে ক্রস করে হসপিটালের গেইট দিয়ে বের হচ্ছেন৷ আমাদের গার্মেন্টস এর ম্যানেজার ওনার সাথে। উনি তাকে বলছেন,

‘সম্পর্কের খাতিরে তো কিছু যাকাতের টাকা দিয়েও পাশে থাকতে হবে৷ তুমি থাকো। কোন টাকা পয়সা লাগলে দিও। ডাক্তার যা করতে বলে তাই করো।’

আসিফও শুনলো তার মায়ের এই কথাগুলো। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সে বিষ খেয়ে বিষ হজমের মতো নির্বিকার হয়ে আছে। কোন প্রতিবাদ করছে না। অন্য সময় হলে আসিফ ঠিকই কথা বলতো কিছু না কিছু৷ শাশুড়ি আমাদের সামনে করেই বাইরে গিয়ে কারে চড়ে বসলেন। মনের ভেতরে সুচের মতো বিধলো ওনার কথাগুলো। আমার অসুস্থ বাবাকে সামনে রেখেও ওনার মুখ থেকে এসব আটকালো না? আমি তো এতদিন সব চুপ করে সহ্য করেছি শুধুমাত্র ওনার জন্য। ওনার ছেলের জন্য। কারণ আমি জানি, একজন মায়ের কাছে তার বাচ্চার চেয়ে বড় কোন প্রাপ্তি আর নেই। আমার মাও তো আমার ভালো থাকার জন্য আমার খারাপ হবে জেনেও এই বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। আমার মায়েরও তো একটাই শখ ছিলো, তার মেয়ে বড় ঘরে যাবে, বড় ঘরে থাকবে।

ভেতরে যেতেই দেখি মা কান্না করছেন বসে। ছোট ছোট ভাই দুইটা মাকে ঘিরে বসে আছে। বাবা আইসিইউ তে৷ আসিফ ডাক্তারের কাছে গেলো। জিজ্ঞেস করলো আর কিছু দরকার কিনা৷ উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোথাও নিতে হবে কিনা। ডাক্তার জানালো তারা দেখছে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা কোন কথা বলতে পারছে না। একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া মানুষের মতো বসে আছে। এ যেনো বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া কোন এক আগন্তুক বসে আছে থমকে। পথ যেনো একেবারে আগলে রেখেছে ভয়ার্ত কোন আর্তনাদে।

আমি নিজেকে সামলে নিলাম। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে না আর। রাস্তায় পুরোটা সময় কান্না করেছি কিন্তু এখানে এসে কান্না যেনো আমার থেকে দূরে সরে আমাকে শক্ত সামর্থ্যবানের মতো করে তুলেছে। মাকে বললাম

‘দেখো মা, বাবার কিচ্ছু হবে না। বাবা এভাবে আমাদের একা করে যাবে না। দেখবা বাবা ঠিকই আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আমাদের কাছে ফিরে আসবে। ‘

হায় আল্লাহ! আমি কি জানতাম আমার এই চাওয়াটুকু উপরওয়ালা রাখবে না। উপরওয়ালা প্রতিবারের মতো আমাকে এবারও যেনো প্রত্যাখ্যান করে দিলেন নিজের কাছ থেকে।

ডাক্তার এসে জানালো, আমার বাবা আর নেই। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নাই। ডাক্তার একেবারে সামনাসামনি এসে কথাটা বলে দিলো। মা শব্দ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠলেন৷ হাত দিয়ে ধরে রাখলেন আমার ছোট ছোট দুই ভাইকে। আমি একেবারে চুপ থেকে গেলাম। এ কোন নিয়তি প্রভু! তুমি এ কোন দিন আমাকে দেখাচ্ছো। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি একেবারে চলে গেলো গেলো এমন। আসিফ আমাকে ছাড়িয়ে আনলো মায়ের থেকে। একটু সামনে নিয়ে চেয়ারে বসালো৷ আমি একেবারে চুপ। আমার চোখ দিয়ে কান্না বের হচ্ছে না। আসিফ আমার হাত ধরতেই আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আসিফকে জড়িয়ে ধরলাম। আসিফ আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

‘নুপুর, তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমাকে তোমার মায়ের ভরসা হতে হবে। তোমাকে শক্ত হাতে তোমার ভাইদের জন্য কিছু করতে হবে। এভাবে তোমাকে ভেঙ্গে যেতে আমি দেখতে পারবো না। তুমি এভাবে যদি ভেঙ্গে যাও, তাহলে তোমার মা ভাইকে কে দেখবে?’

আসিফ আমাকে মায়ের পাশে এনে বসালো৷ আমি মায়ের হাত দুটো শক্ত করে ধরলাম। আমার ছোট ভাই দুইটাকে নিজের সাথে করে বাইরে নিয়ে গেলো আসিফ। তারা দুইটা সকাল থেকে কিছু খায়নি। হয়তো খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছে!

ঘন্টাখানেকের মাথায় সব ফর্মালিটি পূরণ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমাদের সেই মাটিমাখা গন্ধওড়া ছোট গ্রামের ভেতরে আমার বাবা লাশ হয়ে গেলেন৷ এইতো দুইদিন আগেও আমার বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,

‘ মারে তোকে বিয়ে দিয়ে তোর সব স্বপ্নকে আমি একেবারে চিরদিনের জন্য আটকে দিলাম এক বন্ধনের বাধনে। আমাকে ক্ষমা করি।’

মনেমনে বাবাকে সেদিন ক্ষমা করিনি আমি৷ কিন্তু কে জানতো, বাবাকে আজ আমাকে নিজেই ক্ষমা করে দিতে হবে!

বাড়িতে গিয়েই আমি অবাক হলাম। আমার শাশুড়ি এসে হাজির। গরু কেটে শিন্নি করার বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছে। পাশের ঘরের চাচি আমার মাকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই বললেন,

‘নুপুর তোর শাশুড়ি সাদা শাড়ি নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেই শাড়ি এখন তোর মাকে পরানো যাবে না। বিধবার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা শাড়ি সবার আগে বিধবার গায়ে দিতে হয়।’

আমার মায়ের চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। আমার কোন বোধশক্তি নেই যেনো। চুমকি খালা এসে কানে কানে আমাকে বললেন,

‘নাখফুল অগুতা খুলিলা তুই। খুলিয়া রাখিদে যেছাখানো। মাইনষে আইয়া দেখলে বাদ ফাইবো৷ আর লগালগ হাড়ি অখান বদলা। দেখ কিলান লাগের ই লাল রঙা হাড়ি ইকান দেখিয়া৷ তোর মারে ক ই উরি দিয়া কান্দন যেনো না দেয়৷ কিতা আর করবায় আল্লার মাল আল্লায় নিছইনগিয়া।’

আমার এমন দিন আসলো আল্লাহ, যে আমার নিজের হাতে আমার মায়ের নাকফুল খুলে ফেলতে হবে!

কেউ একজন ফিসফিস করে বললো,

‘আল্লাহ দেখো মেয়েকে নাকফুল দিলেন তো মেয়ের মায়ের নাকফুল নিলেন। আল্লাহর লীলা বুঝা দায়৷’

সবার কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে কানে এসে লাগছিলো শুধু৷ কোন কথা বলার উপায় ছিলো না। আমার মা একা হয়ে গিয়েছেন। আমার ছোট ছোট ভাই দুইটার মাথার উপরের ছায়া নাই হয়ে গিয়েছে। এই এহেন অবস্থায় আমার মায়ের পাশে থাকবে কে?

কেউ কেউ তারিফ করছেন আমার শাশুড়ির। বলছেন, বড় ঘরে বিয়ে দিলে নাকি এই লাভ৷ আজ আমার বাবার মারা যাওয়ার সাথে সাথে আয়োজন হচ্ছে, শিরনি হচ্ছে৷ আমার বাবার ভাগ্য নাকি বড়োই প্রসন্ন!

ঈদের দিন আসরের নামাজের পর আমার বাবার জানাজা হলো। শুনেছি জানাজার আগে বাবা সুদে যে টাকাটা এনেছিলেন মতিন মেম্বারের কাছ থেকে আমার বিয়ের সময়ে, সুদ আসল মিলিয়ে সেই টাকাটা হয়েছিলো ছয় লাখ। বাবা মিটিয়েছিলেন এক লাখ। আরও লাখ পাঁচেক বাকি। এই টাকাটার একটা ফায়সালা না করলে সে বাবাকে কবর দিতে দিবে না। আমার শ্বশুর এগিয়ে এসে নাকি বলেছেন তিনি সব টাকা বাবার জানাজার পর পরিশোধ করে দিবেন।

ঘটনাটা শুনে যতোটা না খুশি হয়েছি তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি। আমার শাশুড়ি এসে আমার বাবার শিরনি করছেন, আমার বাবার কাছে মানুষের পাওয়া টাকা শোধ করছেন আমার শ্বশুর। লোকের মুখেমুখে আমার বাবার মৃত্যুশোকের জায়গায় উচ্চারিত হচ্ছে আমার শ্বশুরবাড়ির জয়গান। অথচ আমার শ্বশুর শাশুড়ি এসব কেন করছেন তার কোন কারণ আমার জানা নেই। বাবার জানাজার পর আমার মা নিস্তেজ হয়ে গেলেন৷ শরীর একেবারে বসে এসেছে যেনো। আমি মায়ের মাথায় পানি দিলাম। ছোট ছোট ভাই দুইটা একেবারে বুঝছেই না কিছু। তারা দুইটা ব্যাট বল নিয়ে মারামারি করছে। আসিফ এসে তাদের নিয়ে গেলো।

এদিকে রাতে ঘুমানোর সময়ে আসিফের কানে ভেসে আসছিলো তার শ্বশুরের জানাজা পড়ানো ইমাম সাহেবের সেই একটা বাক্য। ইমাম সাহেব তাকে বলেছিলেন,

‘বাবা কুদ্দুস মিয়ার বড়ো শখ ছিলো তার মেয়ে একজন ডাক্তার হবে। আমাদের সে বলতো, তার মেয়ে একদিন আমাদের জন্য কাজ করবে। দেশের জন্য কাজ করবে। যেদিন তার মেয়ের বিয়ে তোমার সাথে হয়, তার পরের জুম্মায় একদিন কুদ্দুস মিয়াকে রসিকতা করে বলেছিলাম, মেয়েকে তো বিয়ে দিয়ে দিলা। ডাক্তার তো আর হলো না সে। সেদিন কুদ্দুস মিয়া বলেছিলো আমাকে, সে তোমাকে জানাবে তার মনের ইচ্ছাটা। খুব আত্মতুষ্টির সাথে বলেছিলো সে, তার মেয়ে জামাই নিশ্চয়ই তার মনের কথাটা রাখবে। আজ তোমাকে এই কথাটা বলার একটাই কারণ, সেদিনের রসিকতার জন্য আমি মনেমনে খুব কষ্ট পাচ্ছি রে বাবা। মানুষটা আজ ঈদের দিনে হুট করে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো আল্লাহর কাছে।’

অথচ আসিফের কাছে আসিফের শ্বশুর ওনার মনের কথাটা বলেননি একবারও। মানুষ তার ভেতরে চেপে রাখা কষ্ট, ইচ্ছা, স্বপ্ন সবকিছু চাপিয়ে কী সহজে চলে যায় দুনিয়া থেকে! মানুষের জীবনের যে কোন ভরসা নাই। কখন উতান হয়, কখন পতন হয়, কখনোবা উবে যায় বাতাসের দোলে, তার কোন খোঁজ নাই৷ চিঠি নাই, আসার আগমনী নাই। মানুষ তার নিজের ভেতরে ভেতরেই অনন্তের পথে পাড়ি জমিয়ে নেয়। কাওকে কিচ্ছু বলে না। টুপ করেই যেনো সে চলে যায় তার আপন ঠিকানায়।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৬
#মিদহাদ_আহমদ

বাবা মারা যাওয়ার চার দিনের মাথায় আমার মা ও ছোট ভাই দুইটাকে নিয়ে আসিফ ও আমি শহরের বাসায় চলে এলাম। অবশ্য এই প্রস্তাবনা আসিফ ই প্রথম দিয়েছিলো। সে বলেছে, এভাবে একা একা ছোট ছোট ভাই দুইটাকে নিয়ে মায়ের বাড়ি থাকা চলবে না। বাবা চলে যাওয়ার পর সে যেনো পুরোপুরি আমাদের পরিবারের অবিভাবকের জায়গাটা নিয়ে নিলো। আশেপাশের ঘরের চাচিরা আমাকে বলেছিলো, শ্বশুর বাড়িতে এভাবে মাকে নিয়ে গিয়ে ঘর সংসার করতে গেলে আমাকেই কথা শুনতে হবে। এ ভুল যেনো আমি না করি৷ আমার সদ্য হওয়া সংসারে নতুন কোন ঝামেলা নিয়ে গেলে আমার নিজের নাকি সমস্যা হবে। এই সেই নিয়ে তারা কত কথা শুনালো আমাকে! আমি কোন উত্তর না দিয়ে তাদের কথা শুনেছি শুধু। আমার এই শোনা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। জবাব দেয়ার কিছু নেই। আজ যদি আমার সাথে থাকা মানুষটা এই প্রস্তাবনা না রাখতো, তাহলেও আমার কিছু করার ছিলো না। আসলেই না। গ্রামের তারা তো জানে না যে আমি একা একাই আছি ঘর ভাড়া নিয়ে। এখানে আমার শ্বশুরের সংসার নাই৷ অনেকটা আমার মৌনসম্মতি ছিলো মাকে শহরে নিয়ে আসার বেলায়। আমার ছোট ভাই দুইটার মাথার উপরের ছায়া হয়ে উঠতে না পারলেও, সব সময় চোখের সামনে তো থাকবে! বাবার তো আর ছেলে হয়ে উঠা আমার হলো না। স্বপ্ন বুনার সময়ে হাতে চুড়ি পরে নিলাম। হায়রে জীবন আমার! আমার সদ্য বিধবা হওয়া মা তার ছোট ছোট ছেলে দুইটাকে নিয়ে যেনো একেবারে মরুভূমি দেখছিলেন। কোন পথ আর তার খোলা রইলো না। মাও এক প্রকার নিরব সম্মতিতে আমার সাথে চলে এলেন। বুঝতে পারলাম, মায়েদের কাছে যেকোন মূল্যেই তার সন্তানের ভালো থাকাটা প্রধান ধর্ম হয়ে উঠে৷ তারা বিছার করে না এর আগেপিছে কি হবে। গ্রামের লোকেরা ঠিকই আমার অগোচরে মায়ের কানে কানে বলেছে, অসম্মানের ভাত কি মায়ের পেট দিয়ে যাবে আমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে? মা সব জেনেও নীরবে শুধু নীরব সম্মতি দিয়েছিলো।

আমাদের এক রুম আর এক ডাইনিং রুমের বাসায় আমার মা ও ছোট ছোট ভাই দুইটার জায়গা হলো ডাইনিং রুমে। আসিফ বাসায় এসেই বাইরে গিয়ে জাজিম বালিশ নিয়ে এলো। সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে আসিফ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমার পড়াশোনার অনেক শখ ছিলো তাইনা নুপুর?’

‘হ্যাঁ। জানো আসিফ, আমাকে নিয়ে আমার বাবা অনেক স্বপ্ন দেখতেন। আমাকে দুই চোখ দিয়ে আমার বাবা অনেক বড় কোথাও কল্পনা করতেন। গ্রামের মানুষদের বলে বেড়াতেন, তার মেয়ে একদিন তার মুখ উজ্জ্বল করবে৷ কিন্তু দেখো, আজ আমার বাবা আমাকে একা রেখে, একা সংগ্রামের রাস্তায় ঢেলে চলে গেলেন। এতো দূরে, এতো দূরে যেখানে গেলে আর কেউ কারো কাছে ফিরে আসে না।’

আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। আসিফ আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘সব পূর্ণ হবে। সব। কারো স্বপ্ন অপূরণ থাকবে না। কারোর ই না।’

পরেরদিন আসিফ বাজার থেকে ফিরে এসেই আমাকে সেই সুসংবাদ জানালো। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে আমার ছোট ভাই দরজা খুলে দিলে প্রথমেই আমার ছোট ভাইকে কোলে তুলে ঘরে ঢুকলো সে। আমার মায়ের হাতে মিষ্টির বক্স ধরিয়ে দিয়ে আমাকে ঘরে তড়িঘড়ি করে একটা মিষ্টি আমার মুখে পুড়ে দিলো। আমার সদ্য বিধবা হওয়া মা আসিফের এই খুশি দেখে আসিফকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে বাবা?’

আসিফ আমার মাকে পায়ে ধরে সালাম করে বললো,

‘মা আমি চাকরি পেয়েছি।’

নুপুর জানো, আমি সিভি দিয়ে রেখেছিলাম আমার ফ্রেন্ডের কাছে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট এর একটা পোস্ট তাদের হোটেলে খালি ছিলো। ম্যানেজারের পোস্টটা সরাসরি আমি পেয়ে গেলাম। অবশ্য এর জন্য আমার কোয়ালিফিকেশনের প্রয়োজন হয়েছে৷ আজ সকালেই ছিলো ইন্টারভিউ। কাওকে না জানিয়েই আমি ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি। ভেবেছি হবে না হয়তো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে এমন সংবাদ আমি পেয়ে যাবো, ভাবতেই পারিনি। স্টার্টিং বেতন ষোল হাজার টাকা। আমার ভাবতেই কেমন জানি খুশি খুশি লাগছে।’

আসিফের এই খুশি দেখে আমি বিমোহিত হয়ে গেলাম। যেই আসিফের এক সময়ের হুইস্কির বোতলের দাম ছিলো ষোল হাজারেরও বেশি, সেই আসিফ আজ কিনা ষোল হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেয়ে খুশি মানাচ্ছে? মানুষটা আসলেই নিজেকে পরিবর্তন করতে চাচ্ছে, নিজেকে মানাতে চাচ্ছে এই বৈরি সময়ে এসেও। হয়তো এই মানানোর পেছনে কাজ করছে প্রকৃতির ভালোবাসা, উপরওয়ালার চাওয়া।

আমার ছোট ভাই আসিফকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘আমাদের ওই ফ্রাইড রাইস খাওয়াতে নিয়ে যাবা এবার? নাটকে দেখেছি বিচ্চুকে তার দুলাভাই ফ্রাইড রাইস খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছে ওই এসি ওয়ালা বড় হোটেলে। এক পাশে স্লিপার আর অনেক অনেক বল নেট দিয়ে ঘিরে রাখা। বাচ্চারা সবাই সেখানে খেলছে। বল দিয়ে যেনো গোছল করছে। নিয়ে যাবা আমাকে?’

আসিফ ছয় ফুট লম্বা। এবার মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আমার ছোট ভাইর মাথায় হাত দিয়ে বললো,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। কেন নয়? আমার ছোট শালাবাবুর আবদার আমাকে মেটাতেই হবে।’

‘সেখানে কি আমাদের খেলতে দিবে? ওই এতো এতো বল, বেলুন, স্লিপার এসব থাকবে? কেউ আমাদের বকা দিবে না তো? আর ফ্রাইড রাইস নাটকের বিলুর প্লেটের মতো সাজিয়ে দিবে তো?’

আসিফ এবার এক গাল হাসলো আমার ছোট ভাইকে দেখে। আসিফ হাসলে তার গালে টোল পড়ে। আসিফ আমার ছোট ভাইর মাথা ঝাকিয়ে বললো,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। সব হবে৷ সব আছে সেখানে৷ আর সাজিয়ে বিলুদের মতো কেন, এরচেয়ে সুন্দর, এরচেয়ে ভালো, এরচেয়ে বেশি করে খাওয়াবে। প্লেয়িং জোন আছে। আমরা দুজন একসাথে খেলবো। একসাথে খাবো। শুধু তুমি আর আমি না, আমরা সবাই আজ রাতে বাইরে খেতে যাবো। কেমন?’

আমার ছোট ভাই হাততালি দিয়ে উঠলো। বললো,

‘ইয়ে কী মজা! কী মজা! কী মজা। আমরা খেতে যাবো৷ আমরা একসাথে খেতে যাবো।’

মা আমার ছোট ভাইকে আসিফের থেকে ছাড়িয়ে আসিফকে বললেন,

‘যাও বাবা ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি বিন্নি ধানের চাউল রান্না করেছি। সাথে মাছ ভাজা আছে। খেতে দারুণ লাগবে তোমার।’

‘ওয়াও! ইয়াম্মি। আচ্ছা আমি আসছি।’

আসিফ রুমে চলে গেলো। মা আমাকে বললেন,

‘এমন মেয়ে জামাই যেনো সব মায়েরা পায় রে মা। দেখ, জামাই কত ভালো মনের মানুষ। আমাদের একটা বারের জন্যও পর ভাবছে না৷ তোর ছোট ছোট ভাই দুইটাকে সে তার নিজের আদরে ভরিয়ে রাখায় চেষ্টায় আছে।’

আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম।

আসিফ ফ্রেশ হয়ে আসতেই মাটিতে কাগজ বিছিয়ে আমরা সবাই একসাথে খেতে বসলাম। খেতে খেতে আসিফ আমাকে বললো,

‘আগামীকাল তোমার কলেজে যাবো নুপুর৷ এইচ এস সি পরীক্ষা সামনে। রেজিস্ট্রেশন করা চলছে এখন। আর সবকিছু বাদ দিয়ে আপাতত পরীক্ষায় মন দাও। পড়াশোনায় মন দাও। কাল সকালেই আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। বুঝেছো?’

আমি একেবারে থ বনে গেলাম আসিফের কথায়। মা বললেন,

‘বাবা এখন আর এসবের কী দরকার বলো? একটা মেয়ে বিয়ের পর তার সব ধর্ম, কর্ম, মন একেবারে স্বামীর সংসারেই দিবে। এমনটাই হয়ে আসছে। বিয়ের পর কি আর এসব নতুন করে করা সাজে? লোকে কী বলবে বলো? দুজনে এখন ঘর সাজিয়েছো, দুইদিন পর দুজনে সংসার সাজাবে, আল্লাহ দিলে তোমার একটা চাকরিও হয়ে গিয়েছে। জীবন এখন নতুন করে সাজানোর সময়৷ সবকিছু এখন অনুকূলে হবে। আর এই মায়ের দোয়া তো আছেই সব সময়। নুপুরকে আর দরকার আছে পড়ানোর? যা দরকার দিন চালানোর তার সবকিছুই তো আছে তাইনা? এসব করে তো সময় লস হবে, এনার্জি লস হবে। তারচেয়ে যেমন আছে, তেমন থাকুক না।’

‘না মা। যেমন আছে তেমন থাকা যায় না। আপনি হয়তো এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন নিজের স্বপ্নগুলো চাপা দিয়ে। আপনি নিজেও হয়তো জানেন না আপনার ভেতরে কী কাজ করছে, কী বেঁচে আছে, কী স্বপ্ন ছিলো। হয়তো এভাবেই আপনার স্বপ্নগুলো কোন এক কালে আপনার থেকে দূরে চলে গিয়েছিলো। ঠিক যেমন আমার স্বপ্নগুলো আমার থেকে যোজন যোজন দূরে চলে গিয়েছে। আজ যখন আমার হাতে আমার খুব কাছের কারোর স্বপ্ন পূরণ করার ক্ষমতা আছে, তখন দেখিই না একবার চেষ্টা করে? চেষ্টা করতে কি কোন দোষ আছে? কোন অসুবিধা আছে? নিশ্চয়ই নাই। তাহলে কেন আমরা চেষ্টা থেকে দূরে থাকবো?’

খেয়াল করলাম মা একদম চুপ করে আছেন। কোন কথাই আর বলছেন না যেন। আসিফ পেট ভরে খেয়ে রুমে চলে এলো। আমিও রান্নাঘর পরিস্কার করে রুমে এলাম। আসিফ আমাকে দরজা লাগাতে বললো। একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেট ধরাতে ধরাতে গান শুরু করলো। গেয়ে উঠলো,

আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরান যাহা চায়

তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চায় গো
আমার পরান যাহা চায়

আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনি, দীর্ঘ বরস-মাস
যদি আর কারে ভালবাসো
যদি আর ফিরে নাহি আসো
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও
আমি যত দুঃখ পাই গো
আমার পরান যাহা চায়

গান গেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আসিফ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘আবার পড়া শুরু করবে তো?’

আসিফের জিজ্ঞাসার মাঝে আমি এক নিষ্পাপ জিজ্ঞাসা পাচ্ছিলাম। একটা ছোট বাচ্চা যেমন তার মায়ের কাছে খেলনা কিনে দেয়ার আবদার করে, আসিফ ঠিক তেমন করেই আমার কাছে আবদার করছে যেনো! তার কথাটা আমার কানে ভাসছে৷ ‘আবার পড়া শুরু করবা তো?’

কী নিরেট এক বাক্যের ভেতরে যেনো উপর থেকেই এক দৈববানী এসে ঢুকেছে। হয়ে উঠেছে প্রাণ সঞ্চারি। ভূমিকা পালন করছে জীবনের সাথে গানের। আমি মুগ্ধ নয়ন চেপে, কর্ণযোগল দিয়ে শুধু শ্রবণ করছি যেনো!

আসিফ আবার জিজ্ঞেস করলো,

‘কী? পড়বা তো?’

আমি লজ্জাবতী গাছের পাতার মতো লজ্জায় লাল হয়ে বললাম,

‘কেন নয়?’

সন্ধ্যার পর বাইরে থেকে এসে আসিফ বললো রেডি হয়ে নিতে৷ রাতের ডিনারে বাইরে যাবো। আমি ভেবেছিলাম আসিফের হয়তো মনে নেই৷ কিন্তু না৷ তার ঠিকই মনে আছে। আসিফ মাকে ডেকে বললো,

‘মা আপনিও রেডি হয়ে নেন। আমাদের সাথে যাবেন।’

মা আসিফকে কিছু বললেন না। আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,

‘আমি কীভাবে? জামাইর সাথে আমি কেমন দেখায় না? লোকে কী বলবে?’

আমি মাকে অভয় দিয়ে বললাম,

‘এইটা তোমার মেয়ের সংসার। লোকে কী বলবে এতে তোমার কী যায় আসে বলো? এখানে তুমি আমাদের সাথে আছো। আমাদের সাথে থাকবা৷ আমরা সব সময় যেমন থাকি ঠিক তেমন৷ তোমার এতো অপ্রস্তুত হওয়ার দরকার নেই।’

আমার কথা শুনে মা আর অমত করলেন না।

এদিকে তানিয়া তার মাকে কল করে অনর্গল বলে যেতে লাগলো,

‘দেখলা তো তোমার ছেলে কী করলো? খুব তো নিজের বেয়াই বেয়াইনের খাতির করতে গিয়ে শিরনি বিতরণ করে এলে। আর তারা কী করলো বিনিময়ে? তোমার ছেলেকে কখনো দেখেছো তোমার দায় দায়িত্ব নিতে? দেখেছো একবেলা এসে মুখে খাবার তুলে দিতে? এখন সেই রাক্ষসীর সাথে থেকে থেকে ওর মায়ের দায়িত্বও নিচ্ছে! আর এসব তুমি দেখছো বসে বসে?’

মেয়ের কথা শুনে নুপুরের শাশুড়ি কল কেটে দিলেন৷ মনে মনে ভাবতে লাগলেন, সত্যিই তো! যে আসিফ কখনো নিজের দায়িত্ববোধ শিখেনি সেই আসিফ এখন তার শাশুড়ি আর শাশুড়ির ছোট ছোট বাচ্চা দুইটাকে নিয়ে সংসার করছে? কখনো যার মধ্যে মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধ আসেনি সে এখন দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠেছে?

কাকতালীয়ভাবে আসিফ, নুপুর, নুপুরের মা ও ছোট ছোট দুই ভাই মিলে যে রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে গেলো, সেই একই রেস্টুরেন্টে তানিয়া ও তানিয়ার স্বামী ডিনার করতে যায়। তানিয়া দেখে ফেলে আসিফকে। সে সাথে সাথেই কল করে তার মাকে। তানিয়ার মা কল রিসিভ করলে তানিয়া বলে উঠে,

‘ভিডিও কল দাও। দেখাবো তোমাকে।’

‘কী দেখাবি?’

‘আরে ভিডিও কল দাও বলছি। দরকার আছে তো।’

তানিয়ার মা ভিডিও কল দিলেন। তানিয়া ভিডিও কলে ভালো করে দেখালো, আসিফ তার স্ত্রী ও শাশুড়ি নিয়ে বাইরে ডিনার করছে। সাথে ছোট ছোট দুই শালাও আছেন। ভিডিও কল কেটে দিলেন আসিফের মা। তানিয়ার স্বামী তানিয়াকে বললো,

‘তোমার মাথায় এত বুদ্ধি খেলে কীভাবে বলো?’

‘তুমি দেখো না। এভাবে এভাবেই আমি বিষ ঢেলে একেবারে শেষ করে দিবো আসিফের পার্ট।’

অন্যদিকে একা আলিশান ঘরে আসিফের মায়ের চোখ বেয়ে জল গড়ালো। যে ছেলে নিজে কখনো মায়ের উপর তার দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, সেই ছেলে আজ শাশুড়ি নিয়ে বাইরে ডিনার করছে? এদিকে তার মা কীভাবে অনাদরে, একা একা দিন কাটাচ্ছে সেদিকে তার কোন খবর নেই? পৃথিবী যেনো তার সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম দিন আজ দেখাতে চলেছে। এ যেনো এক গভীরতম ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে দেয়া।

রাতে ঘুমানোর সময় আমি মনে মনে ভাবলাম, যে মানুষটা আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য এতকিছু চিন্তা করতে পারে, সেই মানুষটার স্বপ্ন, সেই মানুষটার জমানো আবেগ ভালোবাসায় গড়ে তোলা পৃথিবীকে আবার জাগ্রত করে তুলতে হবে। যেকোন ভাবেই হোক, আসিফকে তার স্বপ্নের জায়গায় দাঁড় করাতেই হবে। যার এত সুন্দর গলা, তার এই গলার জোরেই তো সুনাম হবে, কিন্তু এই গলাকে মানুষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠা পৃথিবীতে যে এখনও ঝরে যাওয়া তারাদের জায়গা হতে পারে, সেইটা আবার জানিয়ে দিতে হবে। যে করেই হোক, যেভাবেই হোক। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আর স্বপ্ন কখনো মানুষের অপূর্ণ থাকতে পারে না।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৭
#মিদহাদ_আহমদ

আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো আসিফ। আমি ঘুমচোখে তার দিকে চেয়ে বললাম,

‘কী হলো? এত সকাল?’

‘নজরুল কী বলেছেন?

“তোমার ছেলে উঠলে মা গো রাত পোহাবে তবে”

এহেম! তুমি আমার ছেলে নও যদিও, তার পরও সেই দায়িত্ব নিয়ে তোমার ঘুম ভাঙ্গাতে এলাম। উঠো তাড়াতাড়ি।’

আমি বিছানায় উঠে বসলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম সকাল ছয়টা বেজে এগারো মিনিট। আসিফ বললো,

‘ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও নাস্তা সেরে। সাতটায় সিএনজি চলে আসবে। যেতে হবে তো।’

আমার মনে পড়লো আসলেই তো! আজ আমাদের কলেজে যাওয়ার কথা। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে! কিন্তু আসিফের ঠিকই মনে আছে৷ বিছানা ছেড়ে উঠতেই দেখি মা খাবার রেডি করে ডাইনিং রুমের মেঝেতে কাগজ পেতে বসে আছেন। সকাল সকাল চোখের সামনে ধোয়া উড়ানো ভূণা খিচুড়ি দেখেই আমার মনটা ভালো হয়ে গেলো৷ কতদিন হলো মায়ের হাতের ভূণা খিচুড়ি খাইনি আমি!

সাতটায় বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে। বাড়িতে যেতে যেতে নয়টা। আসিফ আমাদের কলেজে যাওয়ার আগে গোরস্তানে গাড়ি থামালো। সে নেমে আমার বাবার কবর জিয়ারত করে এলো। আমাকে হাতের ইশারায় বাঁশঝাড়ের দিকে দেখিয়ে বললো,

‘ওইখানে তোমার বাবার কবর নুপুর।’

আমার চোখ বেয়ে পানি নেমে এলো। আমার বাবা৷ যে বাবার কোলে পিঠে চড়ে আজ আমি এই নুপুর হয়েছি, সেই বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো! এভাবে একা করেই? আমার জীবন যেনো এক নিমিশে উবে যাওয়া কর্পুরের মতো হয়ে উঠলো!

আসিফ আমাকে স্বান্তনার বানী শুনিয়ে বললো,

‘এমন করলে হবে বলো? তোমাকে তোমার বাবার কবর দেখিয়েছি কেন জানো? আমি চাই তুমি তোমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করো। আমি চাই তোমার বাবা তোমার ভেতরে যে স্পৃহা জাগিয়ে দিয়েছেন, সেই স্পৃহার জোরেই তুমি একদিন তোমার স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে চলে যাও। তাইনা?’

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। কিছুক্ষণের মাথায় কলেজের হেড টিচারের রুমে আমাকে নিয়ে ঢুকলো আসিফ। স্যার শুরুতেই আসিফের কথা শুনে যারপরনাই প্রশংসা করলেন। বললেন,

‘এভাবে যদি আমাদের সমাজের সব পুরুষেরা উঠে আসে, নিজ হাতে তুলে নেয় নারী শিক্ষার দায়িত্ব, তাহলে দেখবে বাবা, একদিন এই বাংলাদেশ আমাদের নিজেদের স্বপ্নের বাংলাদেশ হয়ে উঠবে। আমাদের দেশটা হয়ে উঠবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু আসলে বাধা কোথায় জানো? নারীদের পায়ে শিকল পড়িয়ে রাখা হয়৷ তাদের স্বপ্নদের আর আকাশের ঘুড়ি করা হয় না। তাদের সব পুষে রাখা স্বপ্নকে চাপা দিতে দিতে তারা নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে দায়িত্বজ্ঞান হারিয়ে ফেলে! নুপুরের কন্ডাক্ট আর রেজাল্ট দুটোই ভালো। প্রথম বর্ষের রেজিস্ট্রেশন শেষ কিন্তু এই ফাইনাল রেজিস্ট্রেসন না করলে সে পরীক্ষা দিতে পারতো না৷ সে কি এখন ক্লাস করতে পারবে কিছুদিন? না মানে আমি চাপ দিচ্ছি না। তুমি যে তাকে কলেজে এনে এক্সাম দেয়ার জন্য নিয়ে এসেছো সেটাই অনেক বড় বিষয়ে। তার পরও আমি বলছিলাম যে…

আসিফ বলে বসলো,

‘হ্যাঁ স্যার অবশ্যই। কেন নয়? অবশ্যই ক্লাস করতে পারবে সে।’

আমি বললাম,

‘কিন্তু এতদূর… ‘

‘কোন সমস্যা নেই। পড়ালেখার পেছনে সময় না দিলে স্বপ্ন পূরণ হবে কীভাবে?’

আমি চুপ করে গেলাম। ফর্ম ফিলাপের সব কার্যক্রম শেষ করলাম৷ কার্যক্রম বলতে শুধু আমার সিগনেচার আর ফর্ম ফিলাপের টাকাটা দিলাম৷ যখন আমার নামের জায়গায় বাবার নাম, নিজের নামের স্পেলিং ঠিক আছে কিনা মিলিয়ে দেখছিলাম, তখন যেনো একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠছিলো আমার বাবার মুখখানা। এ যেনো এক ভাস্কর হয়ে জলে উঠা প্রোজ্জ্বল দ্বীপ।

এদিকে আসিফের মা কল করলেন নুপুরের মায়ের নাম্বারে। কল করে শুরুতেই বলে বসলেন,

‘ভালো আছেন তো আমার ছেলে- ছেলে বউদের নিয়ে?’

নুপুরের মায়ের আর বুঝতে বাকি রইলো না বেয়াইনের অভিমানের সুর। তিনি বললেন,

‘আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন আছেন আপনি?’

‘আসিফ কোথায় এখন?’

আসিফের মা সালামের জবাবও দিলেন না। নুপুরের মা বললেন,

‘তারা দুজন কলেজে গিয়েছে। আসিফ বলেছে নুপুরকে নাকি আবার পড়ালেখা শুরু করাবে। আমি অবশ্য তাদের না…. ‘

নুপুরের মায়ের কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই কল কেটে দিলেন আসিফের মা।

কলেজ থেকে বের হতে হতে এগারোটা বেজে গেলো। সিএনজি সাথে ছিলো। আমরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

দুপুরে খাবারদাবার সব মা রেডি করে রেখেছেন৷ আমরা ভাত খাচ্ছিলাম এমন সময় মা বললেন,

‘আমাদের কি বাড়িতে রেখে দেওয়া যায় না? আমরা থাকতে পারবো তো একা একা।’

আসিফ বললো,

‘আপনাদের কি এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে মা?’

‘না না বাবা। সমস্যা হবে কেন। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু বাবা নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে এভাবে থাকি কীভাবে বলো? যতোই হোক আমার ছেলে দুইটার জন্মমাটি। তাদের বাবার ভিটে। এইটা কি ছেড়ে থাকা যায়? আর তোমরা দুজন তো আছোই৷ আমার যেকোন আপদে বিপদে তোমাদের আমি পাবোই৷ আর এমন না যে দুজন দুই ভিন্ন দেশে বাস করছি। তাইনা বাবা?’

আসিফ কোন কথা বললো না। আমিও নিশ্চুপে ভাত খেয়ে নিলাম।

বিকালে অফিস থেকে এসে বদরুল তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ওদিকের কি কোন খবর পেলে? আসিফ তো শুনলাম হোটেলে জয়েন করেছে।’

এই কথা শুনে তানিয়া যেনো আকাশ থেকে পড়লো। বললো,

‘হোটেলে? কীসের হোটেলে?’

‘আরে বাবা আমি খবর নিয়েছি। সে এখন খুব ভালোভাবে ঘর সংসারে মন দিয়েছে জানলাম। বউকে কলেজে ফর্ম ফিলাপ করিয়েও এনেছে৷ শুনলাম পরীক্ষা দেওয়াবে। তুমি বেশি দেরি করো না আবার। মায়ের সাথে কথা বলো। দেখো সবকিছু আমাদের নামে করে ফেলতে পারো কিনা না।’

‘আচ্ছা আমি দেখছি।’

বদরুলকে পাশে রেখেই তানিয়া তার মাকে কল দিলো। কল দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝালো যে ছেলে এখন তার শাশুড়ি আর শাশুড়ির সন্তান পালতে ব্যস্ত। তারপর এও বললো তানিয়া কলেজে গিয়েছে ফর্ম ফিলাপ করতে। সে পরীক্ষাও দিবে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো মেয়ের কথাগুলো গিয়ে বিধলো আসিফের মায়ের মনে। তবুও মেয়েকে কোনকিছু বুঝতে দিলেন না। এক পর্যায়ে তানিয়া বললো,

‘তোমার এতকিছু এখন কী করার পরিকল্পনা করছো?’

‘এতকিছু মানে?’

‘মানে এই বিশাল সম্পত্তি যা যা আছে তার আরকি!’

‘কেন? আমি এখনও বেঁচে আছি নাকি? না মরে গেছি?’

‘না তা বলছি না মা।’

তানিয়া বুঝতে পারলো মায়ের সাথে এখন আর এই বিষয়ে কথা আগানো যাবে না। সে কল রেখে দিলো।

এদিকে তামান্না মায়ের কথাবার্তা শুনে আন্দাজ করতে পারলো বড় বোন কোন বিষয়ে কথা বলছিলো মায়ের সাথে। তামান্না এসে মাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগলো,

‘আপু কী বলেছে? সে সম্পত্তি চায় নিশ্চয়ই? এজন্য ই তো কল করেছিলো তাইনা?’

মা আর মেয়ের কথায় সায় দেন না। চলে যান নিজের রুমে। কাজের মেয়েকে ডেকে দুপুরের রান্না করে ফেলতে বলেন।

কেটে যায় মাস চারেক। এপ্রিল মাস। সামনের সপ্তাহ থেকে আমার পরীক্ষা। এই চার মাসে বেশকিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে আমার জীবনে৷ মাকে অনেকবার বুঝানোর পরও মা আমাদের সাথে আর থাকেননি। বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন৷ আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম মা কোন এক চাপানো কষ্ট আমাদের থেকে আড়াল করে বাড়িতে চলে গিয়েছেন। মা সেলাইয়ের কাজ জানতেন। মেশিন আগ থেকেই ছিলো। এই মাস চারেকের প্রতি মাসেই আসিফ তার বেতনের টাকা থেকে চার হাজার টাকা করে মাকে দিতো। মা সেলাই মেশিন চালিয়ে এ বাড়ি ওবাড়ির বউ ঝিয়েদের ড্রেস সেলাই করে দিয়ে যা উপার্জন করতেন, তা দিয়েই আমার ছোট ছোট দুই ভাই আর মায়ের দিন চলে যেতে লাগলো। এদিকে বাসা ভাড়া ছয় হাজার টাকা আর আমার মাকে চার হাজার টাকা দিয়ে আসিফের যে যৎসামান্য টাকা বাঁচতো সেই টাকা দিয়ে আমাদের চলতে হিমশিম লেগে যেতো। ফিজিক্সের বেশকিছু প্রবলেম সলভের জন্য আমি নোট কিনতে পারিনাই। পারিনাই বললে ভুল হবে, আমিই আসিফকে বলিনাই। নিচের তলার আপর সাথে আমার ভালো খাতির হয়ে যাওয়ায় তাদের ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড আমাকে দিয়ে দেন তিনি৷ সেই থেকে ইউটিউব দেখে দেখেই নিজের প্রবলেম সলভ করছি। খুব ভালো করেই আমাদের দিন কাটছিলো যেনো। কিছুটা অভাব, কিছুটা মেনে নেয়া, কিছুটা মানিয়ে নেয়া। ননাসের নাম্বার থেকে কল এলো আসিফের মোবাইলে। আসিফ কল রিসিভ করলো। ননাস আসিফকে বললেন,

‘তামান্নার বিয়ের আলাপ এসেছে। জামাই আমেরিকা থাকে। বয়স একটু বেশি। এর আগেও জামাইর একটা বিয়ে হয়েছিলো শুনেছি। বিয়ে টিকে নাই। একটা বাচ্চা আছে। বয়স দুই বছর। এদিকে সবাই তো জানেই যে তামান্নার আগের বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে। এখন মা এখানে কথা বলতে চাচ্ছিলেন।’

আসিফ বললো,

‘বলতে চাইলে বলো। আমি কী করতে পারি এখন?’

‘মা আমাকে বলেছেন যেনো তোকে কল করে জানিয়ে দেই সবকিছু। পর্শুদিন জামাইর বাড়ির লোকজন তামান্নাকে ফাইনাল দেখতে আসবে। সবকিছু মোটামুটি ফিক্সড বলা যায়৷ তারা তো আর জানে না যে ঘরের ছেলে আর ছেলের বউ ঘরছাড়া। এখন মা বলেছেন, তোদের দুজনকে লোক দেখানোর জন্য হলেও বাড়িতে আসতে হবে।’

আসিফ সরাসরি না বলে কল কেটে দিলো।

এদিকে তানিয়া মাকে কল করে আগ বাড়িয়ে বললো,

‘বলেছি তোমার ছেলেকে। তোমার ছেলে বলেছে, তার এসবে কোন মতলব নেই। কোন যোগসাজশ নেই। সে আসতে পারবে না। তার বউয়ের নাকি সামনে পরীক্ষা। তোমাকেও বলি মা, এত করে বুঝালাম, এত করে বললাম যে ছেলে আর তোমার ছেলে থাকেনি, তার পরও এসব কেন করছো? ভুলে যাও যে তোমার একটা ছেলে ছিলো। আমিই তোমার সব। এখন তোমার ছোট মেয়েকে যেখানে বিয়ে দিচ্ছো, আজ বাদে কাল সে আমেরিকা যদি চলে যায় তাহলে কী হবে বলো? এই আমাকে আর আমার জামাইকেই তো তোমায় দেখে রাখতে হবে তাইনা? আর কতো বুঝাবো তোমাকে? বাবারও তো বয়স হয়েছে নাকি? ‘

এক ঝাড়ির মতো কথাগুলো বলে তানিয়া কল কেটে দিলো।

(চলবে)