বিন্নি ধানের খই পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
319

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৮
#মিদহাদ_আহমদ

রাতে মা আমাকে কল করে বললেন, আমি যেনো আগামীকাল আসিফকে নিয়ে বাসায় চলে যাই। মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘তোমাকে কে বলেছে মা? আর তুমি এসব জানো কীভাবে?’

মা আমতা আমতা করে বললেন,

‘বেয়াইন কল দিয়েছিলেন। ঝিয়ারিকে দেখতে আসবে পর্শু জামাই বাড়ির লোক। আর তুই তো জানিস মা, একটা মেয়ে বাবা মায়ের উপর কতটুকু দায়িত্ব হিসাবে থাকে। এখন যে করেই হোক, তোর ননদের জন্য হলেও তো তোকে ঘরে যেতে হবে তাইনা? আর মেয়ের একমাত্র ভাই আর ভাইয়ের বউ কোথায় এইটা সবাই জানতে চাইবে না? মেয়ের বোনের চেয়ে মেয়ের ভাই আর ভাইয়ের বউ যে পাত্রপক্ষের কাছে বেশি মূল্য রাখে এইটা আমাদের এই সমাজের নিয়ম। সমাজের নিয়ম বহির্ভূত কোনকিছু আমরা করতে পারি না যে!’

মায়ের কথাগুলো স্পিকারে আসিফ শুনছিলো। সে কোন রিয়েক্ট করেনি। কল রাখার পর আসিফ যেনো রেগেমেগে আগুন হয়ে উঠলো। কিছুটা চিল্লানোর সুরে বললো,

‘অহ! এখন এখানে কল দিয়ে না হওয়ায় সেখানে কল দিয়ে ফোর্স করা হচ্ছে!’

আসিফের এসব কথাবার্তা আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না। সে কোন সময় কী বলে নিজেও বুঝতে পারে না। তাকে বললাম,

‘এখানে ফোর্স করা কোথায় হলো আসিফ?’

হন্যে হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে আসিফ আমার শাশুড়ির নাম্বারে ডায়েল করতে লাগলো। হয়তো এক দুইটা রিং হয়ে গিয়েছে এমন সময়ে আমি আসিফের হাত ধরে কেটে দিলাম কল। আসিফকে আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম,

‘দেখো আসিফ, দায়িত্ব থেকে সরে আসার চেয়ে ব্যর্থতা আর কিছুতে নেই। আমার ছোট ছোট ভাই দুইটা আছে। আমার যদি সামর্থ্য থাকতো তাহলে আমার মাকে আমি সেলাই করতে দিতাম না। তার সব খরচ আমি নিজে চালাতাম। আমি সামনে থেকে সব দায়িত্ব পালন করতাম। সেই জায়গায় তোমার কি কিছু করা লাগছে এখন? তোমার বিবাহযোগ্যা বোন আছে। আর আমাদের সিলেটের চিরাচরিত রীতি অস্বীকার করার উপায় আছে? তামান্নার এর আগের বিয়েও তো টুনকো একটা জেরে ভেঙ্গে গেলো। লোক জানাজানি করে রমজানের মধ্যেই তার পান চিনি হলো। মোহর ফিক্সড হলো। ঘটা করে আয়োজন হলো। এমন অবস্থার পর আবার এই মেয়ের ভালো একটা ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব যখন এসেছে, তখন আমাদের দিক থেকে তো সবকিছু পার্ফেক্ট রাখা লাগবে তাইনা?’

আসিফ নীরবে আমার কথা শুনলো। তারপর একটা সিগারেট ধরালো। কয়েকটা টান দিয়ে আমাকে বললো,

‘এখন তাহলে আমাদের কী করা উচিত?’

‘বাসায় ফিরে যাওয়া।’

‘একেবারের জন্য?’

‘না। আমি বলছি না একেবারের জন্য। আমি বলছি বাসায় ফিরে যাওয়া। তারপরের বিষয় তার পরে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আগামীকাল সকালেই আমরা বাসায় যাবো।’

আমার কথায় আসিফ অমত করলো না। শুধু বললো, আমার পরীক্ষা যে সামনের সপ্তাহেই! আমি আসিফকে বুঝিয়ে বললাম, পরীক্ষার সময় আছে এখনও। এই নিয়ে যেনো সে চিন্তা না করে।

পরেরদিন সকালে উঠেই আমরা দুজন বাসায় চলে গেলাম। এই সেই বাসা, যেই বাসা থেকে কয়েক মাস আগে আমি আর আসিফ বের হয়ে এসেছিলাম। শাশুড়ি এসে আমাকে আর আসিফকে রুমে যেতে বললেন। রুমে গিয়ে দেখলাম সবকিছু সাজানো গোছানো। আমাদের খাটের ঠিক উপরে বড় করে আমার আর আসিফের ছবি পেইন্টিং করে টাঙিয়ে রাখা। আমার আর আসিফের বিয়ের পোশাকে আঁকা পোর্টেট দেখে আমি অবাক হলাম খুব। আমাদের তো এমন কোন ছবি একসাথে তোলা হয়নি! আসিফও তাকিয়ে থাকলো মুগ্ধ হয়ে।

কিছুক্ষণের মাথায় শাশুড়ি মা চা নিয়ে এসে ঢুকলেন রুমে। আসিফ আর আমাকে বললেন

‘তোমরা দুজন এসেছো বলে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার বিশ্বাস ছিলো তোমরা আসবা। আমার আসিফ তার দায়িত্ব থেকে কখনো পিছু হটতে পারে না।’

আমি শাশুড়িকে দেয়ালের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম

‘মা ওইটা…’

‘অহ ওইটা? আমিই বানিয়েছিলাম। তোমরা যখন এই বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলা, এই রুমটা যেনো একেবারে খালি খালি হয়ে গিয়েছিলো। তারপর আমি নিজেই শিল্পী হাশেম খানকে দিয়ে তোমাদের দুজনের এই পোর্টেট আঁকিয়েছিলাম। হ্যাঁ কাস্টমাইজ করা ছবিটা। এই পোশাকে তো বিয়েতে আসিফের কোন ছবি নেই যদিও, তার পরও শিল্পীর তুলিতে সব হয়েছে।’

‘হাশেম খান? অহ মাই গড! আমার ছবি হাশেম খান এঁকেছেন?’

আসিফ আগ্রহচিত্তে বলে উঠলো।

শাশুড়ি মা বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই দেখো, কর্ণারে ওনার সিগনেচার করা আছে। এই ছবিতে উনি আড়াই লক্ষ টাকা নিয়েছেন সম্মানী।’

টাকার এমাউন্ট শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। জীবনে এই প্রথম শুনলাম ছবি কেউ আড়াই লাখ টাকা দিয়ে আঁকিয়েছে। আসিফকে খেয়াল করলাম টাকার বিষয়টা তুচ্চ করে দিয়ে বললো,

‘হাশেম খান স্যারের সিগনেচার ওয়ার্ক! এইটা আমি টাকা দিয়েও কল্পনা করতে পারি না।’

কথাটা বলেই সে আমার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো

‘আই লাভ ইউ আম্মু।’

শাশুড়ি মা ছেলেকে ছাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘তোর জন্য চুটকি সেমাই রান্না করেছি। নারিকেল দিয়ে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আয়৷ রেডি করা আছে।’

মা ছেলের দূরত্ব নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। এমন দৃশ্য দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে গেলো। খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে উঠলাম। মা কল দিলেন। মায়ের সাথে কথা বলে আমি রুম থেকে বের হয়ে শাশুড়ি মায়ের রুমে গেলাম। শাশুড়ির পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম,

‘মা কোনকিছু করতে হলে আমাকে বলবেন। আমি আছি তো।’

শাশুড়ি মা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে বললেন,

‘আপাতত কিচ্ছু করতে হবে না তোমার নুপুর। তুমি যে আসিফকে নিয়ে এসেছো, এটাই অনেক।’

পরেরদিন দুপুরে তামান্নাকে দেখতে জামাই বাড়ির লোকজন এলো। দুইটা লাইটেস ভর্তি মানুষ। দুইটা মোটরসাইকেল সাথে। কমবেশি জন ত্রিশেক মানুষ তো হবেই। এত লোক শুধুমাত্র কনে দেখতে এসেছে দেখে আমি ভিমড়ি খেয়ে গেলাম। ননাসও এসেছে বাসায়। ননাস আমাকে একটা শাড়ি দিয়ে বললো, শাড়িটা পরে নিতে। তামান্নাকেও সে রেডি করে দিলো। আমি খাবার রেডি করতে লাগলাম টেবিলে। জামাইর মা, বোন, ভাবি এরা ভেতরে চলে এলো। এই ঘর ওই ঘর হাঁটাহাঁটি করছে তারা। আমার কেমন জানি লাগলো তাদের এমন অবস্থা দেখে। জামাইর বোন আমার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো,

‘খালা আপনাদের বাসাটা সুন্দর। শেষ কবে রঙ করিয়েছিলেন?’

এহেন প্রশ্ন শুনে আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। কনে দেখতে এসে এসব জিজ্ঞাসা কেন আবার!

শাশুড়ি জবাব দিলেন,

‘না বছর দেড়েক হবে। এর ভেতরে আর রঙ করানো হয়নাই।’

‘অহ আচ্ছা। তাহলে পরেরবার যখন রঙ করাবেন তখন সামনের রুমে হালকা ক্রিম দিয়েন। রাতে ঘর বড় আর উজ্জ্বল দেখাবে। গাঢ় দিলে ঘর ময়লা ময়লা আর কেমন ছোট ছোট দেখায়।’

শাশুড়ি আর জামাইর বোনের কথা চলার সময়ে জামাইর ছোট বোন আমাকে এক কোণে নিয়ে এলো কথা বলে বলে। তারপর আমার হাত ধরে কিছুটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমার ননদ কেমন? আমাকে বলতে পারো। আমি কাওকে বলবো না। আর একটা ঘরের সবচেয়ে ভালো খবর সেই ঘরের পুত্রবধূই দিতে পারে। তুমি কী লক্ষ্মী দেখতে! আহা তোমার গায়ের রঙ। একেবারে যেনো দুধে আলতা!’

আমি একেবারে স্তব্ধ বনে গেলাম। ইচ্ছা করছিলো সবাইকে বলি গিয়ে, এ কেমন প্রশ্ন করছেন উনি! অনেক কষ্টে নিজেকে সামাল দিলাম। সামলিয়ে হেসে হেসে বললাম,

‘আমার ননদের গায়েত রঙ আমার চেয়ে কিছুটা চাপা। এ তো আপনারা দেখছেন ই।’

আমার কিছুটা কথা শুনেই জামাইর বোনের চোখে মুখে যেনো উল্লাস ফুটে এলো। সে বললো

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। তোমার মতো তো নয় ই। বলো বলো। তোমার সাথে কি খারাপ আচরণ করে সে?’

এবার উনি আমার যে উত্তর শুনলেন, তাতে যেনো একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। আমি বললাম,

‘রঙ চাপা হলেও আমার ননদ গুণে আমাকে টপকিয়ে। কী করতে পারে না বলেন? আজকালকার যুগে এমন সংসারী মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি৷ আমি গ্রামের মেয়ে। কিন্তু এখানে এসে দেখি যে, কাজে আমি কী? আমার চেয়ে আমার ননদ একেবারে একশো গুণ এগিয়ে।’

আমার তারিফ শুনে ওনার মুখ চুপসে গেলো একেবারে। শুধু বললেন

‘অহ আচ্ছা।’

শাশুড়ি মা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে বললেন,

‘নুপুর ওনাকে নিয়ে টেবিলে আসো।’

আমি শাশুড়ি মাকে বললাম

‘হ্যাঁ মা আসছি। ওনাকে এখানের রঙ দেখাতে নিয়ে এসেছি৷ জানতে চাচ্ছিলাম এদিকে কোন রঙ দিলে ভালো লাগবে।’

ফিরে যাবার সময় সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস করে বসলাম,

‘আপা এখানে কোন রঙ ভালো মানাবে?’

‘এসব জানি না। বড় আপাকে জিজ্ঞেস করে নাও৷’

কথাটা বলেই উনি আমাকে তরতর করে পার করে ডাইনিং টেবিলে চলে গেলেন।

এদিকে তামান্না মনে মনে ভাবছে,

‘আমি তো সবকিছু তোমাকে একা একা নিতে দিবো না আপু। তুমি ভেবেছো আমাকে সরিয়ে দিয়ে, ভাইকে সরিয়ে রেখে এই সম্পত্তি তুমি একাই ভোগ করবা, এমন আমি হতে দিবো না। ভাইকে কেমন করে খুশ করা লাগে এইটা আমি জানি। তাইতো শিল্পীর আঁকা ছবিটা এনে ভাইকে সারপ্রাইজ দিয়ে মায়ের প্রতি পজেটিভ ইম্প্রেশন ক্রিয়েট করলাম।’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৯
#মিদহাদ_আহমদ

খাবার খেতে খেতে জামাইয়ের বড় বোন বললো,

‘আমরা আসলে একটা সংসারী মেয়ে চাচ্ছিলাম। আমাদের বিশাল বড় বাড়ি, আমাদের বিশাল পরিবার এসব নিয়ে যে ধরে রাখতে পারবে, এমন একটা মেয়ে। আমার মায়ের এজন্য শহরের মেয়ে একেবারে না পছন্দ। শহুরে মেয়েরা নাকি কামচোর হয়।’

সরাসরি কারো বাসায় এসে এমন ‘কামচোর’ শব্দটা বলায় আমার কেমন জানি গায়ে ধরলো। আমি বললাম,

‘আমি তো গ্রামের মেয়ে। কই শহরে এসে তো কাজকাম কোনকিছু করা লাগছে না। আমাদের পরিবারের সদস্য কম হলেও, কাজের মানুষও তিনজন রাখা আছে। বিয়ে করিয়ে কি কেউ কাজের মানুষ নিয়ে আসে বলেন? আর ঘরের লোক ‘কামচোর’ হয় কখনো?’

ছেলের বোন আমতা আমতা করে বললো,

‘না আসলে এমন না। আমি বুঝিয়েছি যে শহরের মেয়েরা অলস প্রকৃতির আরকি। হা হা হা।’

কেমন জানি এক বীভৎস হাসি হাসলো মেয়েটা! শাশুড়ি আমার পাশে এসে উনার পায়ের কানি আঙুল দিয়ে আমার পায়ের বুড়ো আঙুলে একটা চাপ দিলেন। আমি পা সরিয়ে নিতেই আরও একবার চাপ দিলেন। বুঝতে অসুবিধা রইলো না যে তিনি আমাকে চুপ করতে বলছেন। এদিকে আমার ননাস শুরু করলেন,

‘আরে আমার বোনের কথা কী বলবো! যেমন দেখতে তেমন তার গুণও। কোন দিক দিয়ে কম বলেন? কী পারে না! গতবার আমাদের বাসার সামনের আমগাছ হেলে পড়েছিলো। তারপরের কাহিনী তো গোটা এলাকা জানে। একা একা একশো সতেরোটা আমের আমসত্ত্ব তুলেছিলো সে। সব একা এক হাতে। এখন বুঝেন মেয়ে কেমন কর্মের! ভাত, পোলাও, মাছ, তরকারী, ঝোল, শাক, লতা, চিংড়ি, ইন্ডিয়ান, চায়নিজ কিংবা কোরিয়ান, আসলে যতো বলবো ততো কম। কোন অংশে কমতি নেই।’
আমি এই গল্পের লেখক মিদহাদ আহমদ বলছি। গল্পটা সর্বপ্রথম আমার midhad’s monograph গ্রুপে সন্ধ্যা ৭ টায় পোস্ট করা হয়৷ যে বা যারা অন্য কোথাও গল্পটা পড়ছেন বা পড়বেন, আপনারা সবাই সতর্ক থাকবেন। আমার অনুমতি ব্যতীত কিছু অমানুষ, চোর, এই গল্পটা অন্য গ্রুপে দিয়ে থাকে। তাদের থেকে সাবধানে থাকবেন।

ছেলের মা বললেন,

‘বাহ বাহ। মাশাআল্লাহ। এমন গুণবতী মেয়েই তো আমার চাই। আমার সাত সাতটা মেয়ে। ছয়টা মেয়ের পর একমাত্র ছেলে, তারপর ছোট মেয়ে। সব মেয়েদের বিয়ে শেষ। পাঁচ মেয়ে তো বছরের বারো মাসে ঘুরেফিরে তিন চারবার আসেই। এক মেয়ের স্বামী বিদেশ, তাই সে আমার সাথেই থাকে। দুই নাম্বারটাকে নিয়ে এসেছি। জামাই আল্লাহ নিয়ে নিয়েছেন। এখন আমার এত বড় ঘর ছেড়ে মেয়ে একা একা থাকবে বলেন? ছেলে তো থাকবে বিদেশ। এখন এতবড় ঘরের সব কাজকর্ম, দেখেশুনে রাখার জন্য একটা সংসারী মেয়ে আমাদের লাগবে। মাশাআল্লাহ তামান্না একেবারে দেখতেও খোদার মায়া লাগানিয়া চেহারা।’

আমি এসব শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। আমার ননাস আমার ননদের সম্পর্কে একী বলছে! যে মেয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে চা বানিয়ে খায় না, সেই মেয়ে কিনা এসব একে একে সবকিছু পারে? খাবার রান্না করতে পারে?

এদিকে তানিয়া চিন্তা করছে মনে মনে, যে করেই হোক বোনকে বিদায় করতে হবে এই ঘর থেকে। তারপর আসিফও চলে যাবে৷ একা একা মায়ের আর কোন শক্তিও থাকবে না। সে সুযোগে যত সকাল সম্ভব সবকিছু হাতিয়ে নিতে হবে। কোন হেয়ালি করলে চলবে না।

তামান্নাকে দেখে যাবার সময় ছেলের মা মুঠো করে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে গেলেন আমার ননদের হাতে৷ হ্যাঁ বা না কোনকিছু বললেন না। যাবার সময় শুধু আমার শাশুড়িকে বলে গেলেন,

‘আসলে কনফার্ম করছি না এখন। আমাদের আরেক জায়গায় মেয়ে দেখা আছে। ওইটা দেখে আমি রাতে আপনাকে জানাবোনে।’

ওনি কী সুন্দর একটা হাসি দিয়ে চলে গেলেন কথাটা বলে!
তারা যাওয়ার পর আমি শাশুড়িকে বললাম,

‘মা এমন ঘরে কি তানিয়াকে বিয়ে দিয়ে দিবেন আপনি? যে ঘরের মেয়েরা আরেকটা ঘরের মেয়েকে সম্মান দেয়া শিখেনি, তারা কি আগলে রাখতে পারবে আমার মেয়েকে? জানেন ওদের সাথে আসা মহিলা একজন আমাকে ওই কোণার দিকে নিয়ে গিয়ে কি জিজ্ঞেস করেছিলো? জিজ্ঞেস করছিলো তামান্না মেয়ে হিসাবে কেমন। ঘরের পুত্রবধূরা নাকি ঘরের মেয়ে কেমন এইটা সবচাইতে ভালো জানে।’

‘অহ আচ্ছা! এজন্যই তো বলি তারা এখানে পেন্ডিং রেখে চলে গেলো কেন৷ আমাদের এতবড় ঘর, এতবড় আয়োজন, এতকিছু দেখে তো কেউ না করে চলে যাওয়ার কথা না। নিশ্চয়ই এই মেয়েটা কিছু বলে দিয়েছে গোপনে। এখন আবার এখানে এসে ভালো মানুষি করা হচ্ছে তাইনা?’

কথাগুলো বললো আমার ননাস। আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম যেনো। কী বলছেন উনি!

তামান্না এগিয়ে এসে বললো,

‘আপু সব সময় একটু বাড়াবাড়ি না করলেই নয়? তিল কে তাল সব সময় বানাতেই হবে?’

নাও উলটা বইছে দেখে তানিয়া হেসে হেসে তামান্নাকে বললো,

‘আরে আমি কি একটু রসিকতা করতে পারি না? সব সময় সিরিয়াস হলে হবে?’

শাশুড়ি আমাকে ডাক দিয়ে তার রুমে নিয়ে গেলেন। আমি মুখে হাসি এনে শাশুড়ির সাথে গেলাম। শাশুড়ি আমাকে বিছানায় বসিয়ে বললেন,

‘শোন নুপুর, আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের কথা। তোমাকে তো অনেকদিন ধরেই দেখছি। নীতিতে তুমি সব সময় অটল থাকো। কিন্তু নুপুর, আমরা কি আমাদের সমাজ বদলাতে পারবো বলো? সমাজের বাইরে কি যেতে পারবো বলো? সামান্য টুনকো কারণে তোমার চোখের সামনেই তামান্নার আগের বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো। এখন যেখানে ঠিক করতে চাচ্ছি, তারাও এখন পর্যন্ত হা বা না কোনকিছু জানায়নি। একজন মা হিসাবে আমি বুঝি, মেয়ে পার করা কত বড় দায়িত্ব। তুমি আমার কথাগুলো বুঝবে নুপুর আশাকরি। তোমার মাও তো তোমাকে বিয়ে দিয়েছেন শুধু তোমার ভালো চেয়ে। মা হিসাবে এই চাওয়াটুকুতে তো কোন ভুল নেই।’

শাশুড়ি মায়ের কথাগুলো আমি গভীর মনোযোগী হয়ে শুনলাম। আমাদের সমাজে নারীরা এতোটা অসহায় যে তাকে সমাজের নিয়ম বিরুদ্ধ কোনকিছু করতে নেই? এই ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। শাশুড়ি করুন স্মরে আমাকে বললেন,

‘তুমি আশাকরি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো নুপুর।’

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।

শাশুড়ির রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখি পুরানো সিন্দুক নিয়ে দুই বোনের কথা কাটাকাটি। সামনে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমাদের স্টোর রুমে রাখা সিন্দুক তানিয়া আপা খুলেছেন। তিনি সিন্দুক থেকে আগের দিনের নকশি করা কাঁথা একে একে আলাদা করছেন। সতেরোটা কাঁথা আলাদা করে একটা ব্যাগেও ভরে ফেলেছেন। এসে বাধ সাধলো তামান্না। সে এগুলো সব নিতে দিবে না। ননাসও জো ধরে বসে রইলেন। এগুলো তামান্নার কোন দরকারের? তামান্না বললো,

‘আমার নতুন বিয়ে হবে। আর এগুলো তো তোমার বা আমার কোনকিছু নয়। সব ই তো আমাদের দাদির হাতের বানানো। আজকাল কি এসব পুরোনো দিনের নকশিকাঁথার দেখা মিলে বলো?’

ননাস জোর গলায় বললেন,

‘আরে এজন্যই তো বলছি। তোর নতুন বিয়ে হবে। তুই এগুলো নিয়ে কী করবি? এগুলো তোর দরকার বা কাজের কোনটাই না। মানুষ এগুলো দেখলে হাসাহাসি করবে। আমি একা আছি এখন, এজন্য এগুলো নিয়ে নিচ্ছি। তোকে তো নতুন কিনে দেয়া হবে৷ কাঁথা নিতে হবে কেন আবার?’

তামান্না বললো,

‘ওসব তোমার বুঝা লাগবে না। দরকার হলে অর্ধেক অর্ধেক করো। তার পরও সব তুমি নিতে পারবে না।’

চোখের সামনে দুই বোনের এমন আচরণ দেখে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। রুমে চলে এলাম। আসিফ সিগারেট টানছিলো। আমাকে ডেকে বললো,

‘কাল বিকালে চলে যাচ্ছি। কাপড় যা এনেছিলে ব্যাগে ভরে নাও। আর পরীক্ষার পাঁচদিন আছে। তোমাকে তোমার বাড়িতে রেখে আসবো। ডেইলি দুই ঘন্টা জার্ণি করে তো আর পরীক্ষা দেয়া যায় না। কেন্দ্র তোমার কলেজের পাশের স্কুলে দিয়েছে’

‘তাই বলে আমি তোমাকে ছেড়ে…’

‘তো? তাতে কী হয়েছে? এক মাসেই পরীক্ষা শেষ৷ আর আমি গিয়ে দেখে আসবোনে। আমি তো যেতে পারবো না। আমার হোটেল আছে। ডিউটি না করলে বউর খরচ চালাবো কেমনে?’

আমি মুখ গুমোট করে বসে রইলাম। আসিফ গেয়ে উঠলো,

‘বাড়ৈ রে
যাকনা জাতি হোকনা ক্ষতি
দুঃখ নাইরে আর
সত্য করে কওরে বাড়ৈ
তুমি নি আমার
তোমার প্রেমের আবদুল করিম মরে যদি ভালো…’

আসিফের মুখের সামনে আমি আমার হাত দিয়ে দিলাম। রাগান্বিত গলায় বললাম,

‘এসব কী বলছো তুমি? এসব মরা বাঁচার কথা আর কখনো বলবা না।’

জড়িয়ে ধরলাম আসিফকে। ইদানীং আসিফ আমার প্রতি অন্যরকম কেয়ার নেয়া শুরু করেছে। মানুষটা যতো দিন যাচ্ছে, ততোই যেনো আগ্রহভরে আমার দিকে তার প্রেম-ভালোবাসা ঢেলে দিচ্ছে। আসিফ বললো,

‘বোকা মেয়ে! সবাই কি আজীবন এক সাথে? আজ নাহয় কাল আমাদের একজনের না একজনের তো অন্যজনকে রেখে চলে যেতে হবে তাইনা?’

‘তাই বলে যখন সময় আসবে তখন দেখা যাবে। যেইসেই কথাবার্তা সব সময় বলবে না আর।’

‘বাচ্চা রয়ে গেলা। এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে দিচ্ছো, তবুও বাচ্চামো গেলো না তোমার।’

রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমি টেবিলে বসেছি বই নিয়ে মাত্র! দরজায় টোকা দিয়ে শাশুড়ি মা আমাদের রুমে আসলেন। এসে আসিফকে বললেন,

‘তারা বিয়েতে রাজি হয়েছে। মাত্র কল করে জানালো।’

‘অহ আচ্ছা। যাক ভালোই।’

শাশুড়ি আসিফের কাছে গিয়ে তার হাতে হাত রেখে বললেন,

‘বাবা, মাকে একা রেখে আর যাস না। দেখ, তোর ছোট বোনও তোর মাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছে। এখন আমার সব বলতে তুই আর নুপুর। মা একা ঘরে একা একা কীভাবে জীবন কাটাবো বল? আমি এই কয়েকটা মাস কীভাবে কাটিয়েছিলাম একা একা শুধু আমিই জানি।’

শাশুড়ি মায়ের কথাগুলো আসিফ যেনো শুনেও না শোনার বাহানা ধরলো। শাশুড়ি মা আমার সামনে এসে আমার হাত ধরে বললেন,

‘নুপুর, আমার এখন কেউ নাই নিজের বলে। দুইটা মেয়ে তাদের সংসার সাজাবে আল্লাহর হুকুমে। এই সময়ে যদি আমি আমার একমাত্র ছেলে আর একমাত্র ছেলের বউকে আমার কাছে না পাই, তাহলে আমার বাকি জীবন কীভাবে কাটবে? আমি জানি, তুমি যে করেই হোক আসিফকে মানাবে। যে করেই হোক।’

শাশুড়ি মা রুম থেকে চলে গেলেন। আসিফ আমাকে বললো,

‘এখন তুমিও চলে এসো আমাকে বুঝাতে’

আমি কোন উত্তর দিলাম না। পড়ায় মনোযোগী হলাম।

কিছুক্ষণ পর আমার ননাস রুমে এলেন। ইনিয়ে বিনিয়ে আসিফকে বললেন,

‘দেখ ভাই, তুই জীবনে নিজের বলে কিছু করতে পেরেছিস। আজ তুই স্বাধীন ভাবে নিজের জীবনে কিছু করছিস। জানিস, এই ঘরে থেকে তোর কোন স্বপ্ন পূরণ হয়নাই? এই ঘরের আবদ্ধ জীবন তোর নিজ থেকে তোর স্বপ্ন, তোর ইচ্ছা সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে? আজ যখন নুপুরকে অবলম্বন করে এই ঘর ছেড়ে তুই বাঁচতে শিখেছিস, তখন কোনভাবেই আর নিজের স্বপ্নকে মেরে ফেলিস না। যেকোন ভাবেই হোক নিজেকে নিজের স্বপ্নের কাছে নিয়ে যা। এই ঘর, এই বিত্ত বৈভব তোর কাজে আসবে না। তোকে আবার তোর জীবন ধ্বংসের দিকে নিয়ে আসবে।’

আসিফের মুখের ভাবে বুঝা গেলো সে আমার ননাসের কথাগুলো পজেটিভভাবে গ্রহণ করছে। কিন্তু আমার কাছে ওনার কথাগুলো কেমন জানি লাগলো।

দরজার দাঁড়িয়ে বড় বোনের সব কথা শুনে ফেললো তামান্না।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৩০
#মিদহাদ_আহমদ

ননাস যাওয়ার পর তামান্না রুমে এসে তার ভাইকে বলতে লাগলো,

‘ভাইয়া, কিছু কথা বলার আছে তোমায়।’

‘কী কথা?’

‘মা অসুস্থ। বাবার হার্টে সমস্যা। দুইদিন পর যখন আমিও চলে যাবো তখন মা একা হয়ে যাবে৷ মাকে একা একা রেখে আমি কখনো ভালো থাকতে পারবো না। বাবার তো এই ভালো এই খারাপ। মানুষটার কি এখনও সেই আগের মতো করে ব্যবসাপাতি দেখার বয়স আছে বলো? ডায়াবেটিস কখন বাড়ে আর কখন কমে তার কোন নির্ধারিত সময় নাই। এদিকে তুমি আছো, ভাবিও আছে। যে ভাবেই হোক তোমরা এখন মায়ের সাথে থাকতে হবে। তোমরা যদি এভাবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নাও, তাহলে তারা থাকবে কীভাবে? এই এতবড় ঘর, এই এতকিছুর শেষ সময়ে এভাবে অবহেলা আর অনাদর এদের প্রাপ্তি হয়ে দাঁড়াবে?’

‘তুই যা তো। আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। আমার যা খুশি আমি তাই করবো।’

কথাটা বললো আসিফ। তামান্না আরও কিছুক্ষণ তার ভাইকে বুঝালো। তারপর রুম থেকে চলে গেলো। আমি খেয়াল করলাম একটা চাপা অভিমান আঁকড়ে ধরে সে বের হয়ে গেলো। হয়তো বলতে বলতেও বললো না

আমি আসিফের কাছে এসে বসলাম। আসিফকে বললাম,

‘দেখো আসিফ, তামান্না, মা দুজনের কথাও তো তোমাকে চিন্তা করতে হবে তাইনা? জীবন থেকে সরে যাওয়া মানে নিজের কাছে নিজেই ব্যর্থ হয়ে যাওয়া। আর দায়িত্বের বেলায় কখনো আমরা নিজের থেকে সরতে পারি না। দায়িত্ব জিনিসটাই যে আমাদের মনুষ্যত্ব। দায়িত্ব গ্রহণ আর দায়িত্ব পালন থেকে সরে আসার চেয়ে জীবনের আর কোন অন্যায় হতে পারে না।’

আসিফ কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকলো। আমিও আরও কিছুক্ষণ তাকে বুঝালাম। শাশুড়ি মা আমাকে ডাক দিলেন এমন সময়ে। আমি উঠে গেলাম ওনার কাছে। শাশুড়ি মা পানের বাটা থেকে পান সুপারি তুলতে তুলতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন

‘তোমার পরীক্ষা শেষ হবে কবে নুপুর?’

এমন মোলায়েম গলায় শাশুড়ি মা আমাকে কখনোই কোনকিছু জিজ্ঞেস করেননি। শাশুড়ি মায়ের প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম,

‘সামনের মাসের শেষের দিকে। ব্যবহারিক সহ।’

‘তাহলে তামান্নার পানচিনি, বিয়ে এসব কবে নাগাদ হলে ভালো হয়?’

আমি ভেবে পুলকিত হলাম যে শাশুড়ি মা আমার কথাও চিন্তা করছেন। আমি ওনাকে বললাম,

‘মা আপনি আমার জন্য কোনকিছু আটকে রাখতে হবে না। আমার পরীক্ষা তো চলবে। এর মাঝে তামান্নার বিয়ের যেকোন আয়োজনে যেনো কমতি না আসে।’

শাশুড়ি মা আমার মাথায় ওনার হাত রাখলেন। কী এক শীতল স্পর্শ আমাকে যেনো আলতো করে ছুয়ে দিয়ে গেলো!

তামান্না রুমে এসেই বললো,

‘ভাবি তুমি এখানে! আর আমি তোমাকে তোমার রুমে গিয়ে খুঁজছি। ভাইয়াকে চা দিয়ে এসেছি। তুমি চা খাবে?’

আমার চোখের সামনে আমার এক পরিবার যেনো ফুটে উঠলো। এমন পরিবার যেই পরিবারের স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম কোন একদিন। তামান্না বললো,

‘ভাবি আমার সাথে রুমে আসো। জানোই তো আমি কখনো শাড়িটারি এসব পরিনাই। তুমি এদিকে কত সুন্দর করে শাড়ি পরতে পারো। কাল তো চলে যাবা তোমার বাড়িতে। এখন আমাকে আজই শাড়ি পরা শিখিয়ে দিয়ে যাও।’

‘বাহ রে! আমি কি শাড়ি পরাতে পারি না? বোন রেখে ভাবি কেন? আমার কাছেই তো আসতে পারতি।’

কথাটা আমার ননাস এসে বললেন। তামান্না আমার ননাসকে বললো,

‘না তুমি তো কাজে কামে বিজি। তাই ভাবলাম ভাবিকে…’

‘হয়েছে হয়েছে। ভাবি লাগবে না। আমিই পরানো শিখিয়ে দিবো। আয়।’

বলেই ননাস তামান্নার হাত ধরে রুম থেকে বের হতে লাগলেন। শাশুড়ি মা পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন,

‘তানিয়া কিছু হিসাব করার ছিলো বিয়ে নিয়ে। কার, কোথায়, কীভাবে বাজেট এসব দেখার ছিলো। তুই একটু আয় তো এদিকে।’

শাশুড়ি মায়ের কথা শুনেই আমার ননাস চলে এলো তামান্নার হাত ছেড়ে। তামান্নাও এসে বললো,

‘কীসের বাজেট?’

‘তুই যা নুপুরকে নিয়ে। তোকে এসব দেখতে হবে না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। নুপুর যাও এখন তামান্নাকে নিয়ে। তাকে শাড়ি পরা শিখিয়ে দাও। এমনিতে তুমি গ্রামের মেয়ে। তোমরা এসব শাড়ির বিষয়ে বেশি জ্ঞান রাখো। যাও শিখিয়ে দিয়ে আসো তাকে।’

ননাস কথাগুলো বললো আমাকে। আমিও তামান্নাকে নিয়ে চলে গেলাম। যাবার সময় পেছন ফিরে তাকালে দেখলাম শাশুড়ি আমাকে চোখের ইশারায় তামান্নাকে নিয়ে যেতে বলছেন। তামান্না আমার সাথে যাওয়ার সময়ে মুখে বিরবির করে বললো,

‘জানি না কীসের হিসেব করবে আপা মায়ের সাথে। মানুষ চিনতে যে মানুষের এতদিন লাগে সেইটা আমার মাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।’

‘কিছু বললে তামান্না?’

‘না ভাবি। কিছু না। তুমি আইসক্রিম নিয়ে আসতে পারবা ফ্রিজ থেকে আমার জন্য? আজ গরম একটু বেশিই যেনো।’

‘আচ্ছা তুমি রুমে যাও। আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি।’

‘ওই পাঁচ লিটারের টা থেকে নিও না। ওইটা মেঙ্গো ফ্লেভার। তুমি ছোট বক্স থেকে এনো। স্ট্রবেরি ফ্লেভারেরটা।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

আইসক্রিম নিয়ে তামান্নার রুমে গেলাম। দেখলাম সে দুইটা সুতি আর একটা জর্জেট শাড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার দিকে মুখ করে। আমাকে দেখে সে বললো,

‘এই এতো লম্বা কাপড় মানুষ সামাল দেয় কীভাবে ভাবি?’

আমার হাসি পেলো তামান্নার কথায়৷ তাকে বললাম,

‘বিয়ে হয়ে গেলে সব পারবা বুঝলা। একেবারে পাকা গিন্নি হয়ে উঠবা তখন।’

তামান্নাকে শাড়ি পরা শেখানোর পর রুমে আসতেই আসিফ আমাকে বললো,

‘আমি বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাড়িওয়ালাকে বলেছি যে বাসা ছেড়ে দিবো৷ বাসায় যা যা আছে সব নিয়ে আসবো বিকালে গিয়ে। তোমার বইখাতা সব সাথে তো? নাকি বাসায় কিছু রয়ে গিয়েছে?’

আসিফের এই কথা শুনে আমি যারপরনাই খুশি হলাম। একটা মানুষকে শুদ্ধ পথে আনতে তার পরিবারের থেকে দূরে রেখে না বরং পরিবারে রেখেই তাকে শুদ্ধ পথে নিয়ে আসতে হবে। আসিফকে তার এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ আর জিজ্ঞাসা করলাম না। জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধও করলাম না। কিছু খুশি মনের মাঝে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়। আসিফের এই সিদ্ধান্তটাও ঠিক এমন। আসিফের উত্তর দিতে বললাম,

‘হ্যাঁ। বইখাতা সব আমার সাথেই আছে। চিন্তার কোন কারণ নেই।’

আমার রুম থেকে আমি দ্রুত প্রস্তান করলাম। খুশিমনে শাশুড়ির রুমের দরজায় গিয়ে টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। শাশুড়িকে জানালাম যে আসিফ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শাশুড়ি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন কপালে। ওনার চোখমুখে আনন্দের হাসি বইছে যেনো। এমন উচ্ছ্বাস আমি দেখে দেখে পরম সুখ অনুভব করতে লাগলাম। ননাস তানিয়া এসে জিজ্ঞেস করলো,

‘আসিফ সত্যি সত্যিই থেকে যাবে?’

‘হ্যাঁ আপা।’

‘সত্যিই?’

‘হ্যাঁ। কেন? আপনি খুশি না?’

‘আরে না না৷ ঘরের ছেলে ঘরে থাকবে৷ এটাই তো নিয়ম। যাক। শেষমেশ সে বুঝলো। আমি তো ভেবেছিলাম সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে। এই জীবনে আর ঘরমুখো হবে না কখনো।’

ননাস রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো। শাশুড়ি ওনার হাত থেকে চুড়ি খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘মা রে, আজ থেকে তোকে আমার ঘরের বউ হিসেবে মেনে নিলাম। তুই পেরেছিস আমার ছেলেকে আবার ঘরে ফিরিয়ে আনতে। তুই পেরেছিস তার জীবন থেকে সব অন্ধকার দূর করে দিতে।’

আমি জড়িয়ে ধরলাম শাশুড়ি মাকে।

পরেরদিন সকালেই আমি বাড়ি চলে গেলাম। মাঝখানে দীর্ঘ এক মাস কেটে গেলো। এর ভেতরে তামান্নার পানচিনি হয়ে গিয়েছে। আমার বায়োলজি ব্যবহারিক পরীক্ষার আগে কয়েক দিনের বন্ধ ছিলো। এই বন্ধের সময়ে তার পানচিনি ছিলো। আসিফ আমাকে আসতে নিষেধ করেছিলো তার পরও আমি ওর নিষেধ না মেনে চলে এসেছি। ঘরের বউ হিসাবে একটা দায়িত্ব তো আছে!

সেদিন বাসায় এসে দেখলাম আসিফের ঘর ঠিক আগের মতোই হয়ে গিয়েছে৷ রুমভর্তি সিগারেট এখানে সেখানে ফেলে রাখা। পুরোপুরি নির্ভুল না হতে পারলেও আন্দাজ করতে পারলাম সে আবার হুইস্কি খাচ্ছে প্রতিদিন৷ নিজেকে আর সামলে না রাখতে পেরে আসিফকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,

‘তুমি কি আবার আগের মতো ড্রাস নিচ্ছো?’

আসিফ একটা হাসি দিলো। হেসে হেসে বললো,

‘কী আবোল তাবোল বকছো বলো? এসবে মাথা ঘামানোর দরকার নাই। আগে পরীক্ষা শেষ করো তোমার। এখন পুরোপুরি শেষ না করে আসার কী দরকার ছিলো বলো?’

‘আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি আসিফ’

‘তোমার চোখ দুইটা দিনদিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছে নুপুর। কী গভীর চোখ দুটো! মায়াবতী চোখ!’

আমার কথার সরাসরি কোন উত্তর আসিফ দিচ্ছে না। আমি বুঝতে পারলাম আসিফ আমার থেকে কথাটা আড়াল করতে চাচ্ছে।

সেদিন শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম, আসিফ কখন বাসা থেকে যায় আর কখন ফিরে আসে। শাশুড়ি মা জানালেন, হোটেলে তার ইভিনিং শিফটেত ডিউটি। মাঝেমধ্যে নাকি বাসায় আসে না। তারপর আবার উপরি প্রশ্ন করলেন শাশুড়ি মা। জিজ্ঞেস করলেন,

‘কেন নুপুর? কিছু কি হয়েছে? জানো নুপুর, মাঝেমধ্যে যখন আসিফ বাসায় বাজার করে আনে, আমার জন্য একশো দুইশো গ্রাম সুপারি কিনে আনে, আমি তখন যারপরনাই খুশি হই। মাছ কিনতে সে অপটু। যেসব মাছ সে নিয়ে আসে, এগুলো তোমার শ্বশুর কখনো খান না৷ কাটা সুপারি নিয়ে আসে আমার জন্য, সাথে বাংলা পান৷ জানোই তো আমি সিঙ্গাপুরি সুপারি আর খাসিয়া পান ছাড়া খাই না। তবুও যত্ন করে ছেলের আনা বাজারগুলো রাখি। আমার ছেলে আমাকে বাজার করে এনে খাওয়াচ্ছে, এরচেয়ে বড় খুশির আর কী হতে পারে? আমার কোটি টাকার সম্পদের চেয়েও আমার ছেলে তার দায়িত্ব পালন করতে শিখেছে এইটা জানাই আসল জরুরি৷’

শাশুড়ি মায়ের চোখ মুখে এত আনন্দ দেখে আমি আর আমার মনের শঙ্কা ওনার কাছে বললাম না। চেপে গেলাম।

সেদিন রাতে ঘুমানোর বাহানা করে আসিফের পাশে আমি শুয়ে আছি। রাত তখন তিনটা হবে। আমি খেয়াল করলাম আসিফ চুপিচুপি ঘুম থেকে উঠে আলমারি খুলে কী যেনো নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। আমার অবুঝ মন আর ফিরে দেখতে চাইলো না আসিফ কী করছে সেখানে। হয়তো উঠে গেলে দেখতে পেতাম হুইস্কির বোতল হাতে সে বারান্দায় বসে আছে৷ ধোয়া ছাড়ছে সিগারেটের! অথবা এইটাও আমার মনের ভুল!

সকালে নাস্তা শেষ করলাম। শাশুড়ি মা বললেন, গাড়ি রেডি আছে। আসিফ আমাকে বাড়িতে ছেড়ে আসবে।

আসিফ আমাকে নিয়ে নিচে নামলো। আমি আশা করেছিলাম আসিফ আমাকে নিয়ে তার বাবার দেয়া গাড়িতে না, রিজার্ভ করা একটা সিএনজি করে আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবে। কিন্তু আমার সেই আশাকে ভেঙ্গে দিয়ে আসিফ কারের দরজা খুলতে খুলতে বললো,

‘আর তো এক সপ্তাহ মাত্র! তারপর আমার বউকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। এখন উঠে বসো তাড়াতাড়ি। আর শুনো, পরীক্ষা ভালোকরে দিও। কোন গাফিলতি যেনো না হয় পরীক্ষায়।
চলবে।